You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২২শে নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ক্ষেত্রে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে সরকারের উৎপাদন ও মুনাফা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে গতকাল বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে যে, এসব রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পাঙ্গসমূহ বিগত মুক্তিযুদ্ধকালের ধকল কাটিয়ে দ্রুত সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। অবশ্য, ১৯৭০-৭১ সালে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনের পরিমাণ কি ছিলো তা’ উল্লেখিত হয়নি।
সংবাদে আরো বলা হয়েছে যে, বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে ১৯৭২-৭৩ আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে, অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সূতার উৎপাদন প্রায় শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বস্ত্রের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ৪৪ ভাগ।
১৯৭২-৭৩ সালে সূতা কলগুলোতে ২১৫ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড সূতা তৈরী হয়, কিন্তু চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসেই তৈরী হয়েছে ২৪৭ লাখ ৪ হাজার পাউন্ড। অপর পক্ষে, কাপড়ের কলগুলোতে এ বছরের প্রথম তিন মাসে বস্ত্র তৈরী হয়েছে ২১১ লাখ ২৩ হাজার গজ। গত বছর একই সময়ে এ উৎপাদন ছিলো ১৪৭ লাখ ৩৭ হাজার গজ।
বস্ত্রমিলগুলোতে এই বছরের প্রথম তিন মাসে ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা মূল্যের কাপড় ও সূতা বিক্রি করেছে। গত বছর এ আয় ছিলো ২৩ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা।
অনুরূপভাবে পাট শিল্পেও উন্নতি দেখিয়ে বলা হয়েছে যে, বর্তমান গতিতে উন্নতি হলে আশা করা যায় চলতি আর্থিক বছরে পাট শিল্প ১৬০ কোটি টাকা অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে। বিবরণে সার, রসায়ন ও ভেষজ শিল্পে উন্নতির পরিমাণ শতকরা একশো পাঁচ ভাগ দেখানো হয়েছে। এবং এভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের প্রায় সবক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখানো হয়েছে।
নিঃসন্দেহেই সংবাদটি আমাদের সবার কাছেই এক গভীর আশার বাণী ও এক সুখী ও সমুন্নত জীবনের আশ্বাস বহন করে এনেছে। এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পোন্নতি ও মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের এ অগ্রগতি ঈশ্বর-গতি পেয়ে আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত সোনার বাংলা সত্যিই একদিন সোনার দেশে পরিণত হোক, এটা আমরা সবাই একান্ত গভীরভাবে কামনা করি।
কিন্তু এতো কিছু সত্ত্বেও আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে যে বিভিন্ন পর্বত-প্রমাণ অভাব-অসুবিধা, বিশৃঙ্খলা, দুর্বলতা এবং গাফিলতি ইত্যাদি আছে সেগুলোকে অকারণ ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে নিয়ে আত্মতৃপ্তি নিলে চলবে না।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে আমাদের এতো দুর্বলতা সত্ত্বেও যখন আমরা এমন উল্লেখযোগ্য উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছি তখন এসব দুর্বলতা দূর করতে পারলে আমরা নিশ্চয়ই অচিরেই উন্নতির চরম শীর্ষে ও উপনীত হতে পারবো।
আমাদের শিল্পক্ষেত্রে যে কয়টি দিকের প্রতি আমাদের তাৎক্ষণিক নজর দিয়ে শিল্প-দুর্বলতা দূর করার দিকে মনোযোগী হতে হবে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন, সুষ্ঠু, অপ্রতিহত ও আধুনিক ব্যাংকিং প্রথার প্রচলন, কাঁচামালের সুলভ্যতার নিশ্চিত সাধন, খুচরা যন্ত্রাংশের পর্যাপ্ত মওজুদ রক্ষণ, শ্রমিকের আধুনিক আলোকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ, স্বজনপ্রীতি পরিহার করে যে যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানের দায়িত্ব অর্পণ, পরিবহনের জন্যে উপযুক্ত পরিমাণ জাহাজ, বার্জ, টাগ, লঞ্চ, ট্রাক ইত্যাদির সদা প্রস্তুত থাকার ব্যবস্থাকরণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যাপ্ত ও নিশ্চিতকরণ, শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে আন্তরিক ও সৌহার্দ্যমূলক সম্প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন, কর্মে শ্রমিকের উৎসাহ বৃদ্ধিকরণ ইত্যাদি প্রধান।
কারণ, প্রায়ই অযোগ্য ব্যবস্থাপনা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে, কিম্বা ব্যাংকের ঘাপলায়, কিম্বা কাঁচামাল বা খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে, কিম্বা শ্রমিকের অজ্ঞতা বা বিদ্যুতের অভাব বা একটা না একটা কারণে উৎপাদন ব্যাহত বা বন্ধ হবার কথা আমাদের কানে আসে এবং আমরা শংকিত হই।
সুতরাং উল্লেখিত দুর্বলতা সমূহকে দূরীকরণ করে আমাদের শিল্প ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ জঞ্জালমুক্ত করা এবং উৎপাদন ও মুনাফার চরম লক্ষ্যে পৌঁছুনোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিক কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।

লাল ফিতার দৌরাত্ম্য

লাল ফিতা বড়ো লোভনীয় বস্তু। বাড়ীর ছোট্ট খুকীরা এক চিলতে লাল ফিতা পেলে খুশীতে ডগমগ হয়ে যায়। কিন্তু লাল ফিতার মোড়কে বন্দী এক একটি ফাইল যে আজ দেশের মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বোধ হয় এই সত্যটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন না। সচিবালয়ে লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা একেকটি ফাইল নিশ্চল পড়ে আছে। কেউ ঐ ফাইল ঘেঁটে দেখছে না। দেখলেও এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে একেবারে নট নড়ন চড়ন। সচিবালয়ের ফাইলগুলোর এই স্থবিরতা সম্পর্কে তাই দেখা দিয়েছে প্রশ্ন, উঠেছে অনেক অভিযোগ। কেউ আমলাতান্ত্রিক ঘাপলাকে দায়ী করছেন, আবার কেউ বা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বলে ক্ষোভ ও মনের জ্বালা মেটাচ্ছেন। কিন্তু এতে সমস্যার কোনো সত্যিকার সমাধান হচ্ছে না। বরং সব সমস্যা ঐ লাল ফিতার অভ্যন্তরে স্তূপীকৃত হয়ে জমা হচ্ছে। সচিবালয়ের ফাইল নড়াচড়ার সঙ্গে নাকি ‘নগদ নারায়ণে’র সম্পর্ক রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে কর্তাব্যক্তিরা ফাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার আগে নাকি নিজেদের ‘নগদ প্রাপ্তি’টাও কড়ায় গন্ডায় আদায় করে অতঃপর ফাইলের ভেতর চোখ বুলান এবং ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে স্বীকৃত হন। প্রশাসনযন্ত্রের মুখ্য কেন্দ্র সচিবালয়ের কোনো কর্মীর পক্ষেই এ অভিযোগ শুভকর নয়। এ ধরনের মারাত্মক অভিযোগ একটি স্বাধীন দেশের প্রশাসনযন্ত্রের ঢিলেমীকেই উলঙ্গ করে তোলে। সচিবালয়ের মতো এবং বিভিন্ন অফিস, আদালতের গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে যারা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি এ ধরনের গাফিলতিমূলক কাজ কারবার করছেন, তাদের চৈতন্যোদয় হওয়া দরকার।

সাধের আসন আজ টলটলায়মান

পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চের নায়কদের সামনে সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান আজ এক নিদারুণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিককালের কয়েকটি সংবাদে সমস্যাটির প্রকটতা সহজেই অনুমেয়। পাকিস্তানের নেতাদের সাধের কাশ্মীর প্রসঙ্গের রাজনীতিও আজ হাতছাড়া হতে চলেছে। ফলে ভুট্টো সাহেবের নর্তন-কুর্দন অনেকটা অসার হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন পূর্বে একটি পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আবদুল ওয়ালী খান ও আজগর খান উভয়েই বলেছেন—ভুট্টোর দমননীতিই শেষ পর্যন্ত পাঠানদের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করবে। গত নির্বাচনের পর পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়েছে। ওয়ালী খানের মতে, সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে এটা একটা প্রহসন মাত্র। সেখানে গণতন্ত্রের শোষণ ও নিপীড়নের ষ্টিম রোলার চালানো হচ্ছে। দীর্ঘদিনের এই নিষ্পেষণের ফলে সীমান্তের মানুষ আজ মুক্তির জন্যে দিন গুণছে। তারা যে কোনো মুহূর্তে ‍পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। আর সেটা হলে গোটা পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়েই মারাত্মক প্রশ্ন দেখা দেবে। ওয়ালী খানের ভাষায়—‘বিগত পঞ্চাশ বছর যাবত আমরা অহিংস আন্দোলন করেছি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জনাব ভুট্টো এক্ষণে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই এখন যুদ্ধ ছাড়া জনগণের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ নেই।’ অন্যদিকে জনাব ভু্ট্টো বেসামাল হয়ে বলগাহারা বক্তব্য রাখতেও দ্বিধা করছেন না। সম্প্রতি ডেরা ইসমাইলের এক জনসভায় ভাষণ দানকালে তিনি বলেছেন—আফগানিস্তানের বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতা মিঃ দাউদ বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ দখল করে নেবার মতলব আঁটছেন। পাখতুনদের সমর্থন করার জন্যে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে জনাব ভুট্টো বার বার অশালীন ও মর্যাদাহীন উক্তি করেছেন।
বস্তুতঃপক্ষে পাকিস্তানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের মুক্তি আন্দোলনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা-দেখে বেসামাল হয়ে পড়েছেন। একদিকে ঐ দু’প্রদেশে সংগ্রামের উত্তাল ঢেউ অন্যদিকে কাশ্মীর প্রসঙ্গটিও আজ হাতছাড়া হতে বসেছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাফল্য প্রত্যক্ষ করে যেমন বেলুচ ও পাঠানদের চোখ খুলে গেছে তেমনি কাশ্মীরের নেতা শেখ আবদুল্লাহরও মোহভঙ্গ হয়েছে। কিছুদিন পূর্বে শেখ আবদুল্লাহ বলেছিলেন কাশ্মীরীদেরকে প্রথমে ভারতীয় হতে হবে পরে তারা মুসলমান বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। পাকিস্তানী বর্বর শাসকগোষ্ঠী যে কত বড় নৃশংস এবং ঔপনিবেশিক মনোভাবাপন্ন তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বোধ হয় সবচেয়ে বেশী উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে শেখ আবদুল্লাহ। আর সে কারণেই গত কয়েক মাস ধরে তাঁর মনোভাবের নতুন মোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তি যে একটি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া সত্যিকার মুক্তি নয় তা কাশ্মীরবাসীও নতুন করে উপলব্ধি করছে বলে আমাদের ধারণা। এদিকে বেলুচ ও পাঠানদের সংগ্রাম আরো তীব্র রূপ ধারণ করতে চলেছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও তার সাফল্যই তাদেরকে নতুন পথের সন্ধান করে দেবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আর পাকিস্তানের শোষক শ্রেণীর ভিত্তিমূলও যে সেই মহাঘাতে কেঁপে উঠবে সে ব্যাপারেও আমরা নিঃসন্দেহ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!