বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৬ই ডিসেম্বর, রোববার, ৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
আজ সেই পূন্য অমোঘ দিন
আজ ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর। সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাঙালি ও বাংলা দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল শোষণ, নির্যাতন আর রক্ত ঝরা ইতিহাসের এ এক অমোঘ অবিস্মরণীয় দিন। আজ থেকে মাত্র দু’বছর আগে ১৯৭১ সনের ঠিক এই দিনটিতেই আমরা সমূলে উৎপাটিত করেছিলাম ‘পাকিস্তান’ নামীয় দীর্ঘ চব্বিশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ভয়াল কুটিল কালো ইতিহাসের এক মারাত্মক বিষবৃক্ষকে। দীর্ঘ ন’মাস বাংলার সংগ্রামী জনতা ও প্রাণ তথাস্থ দুর্বার দামাল ছেলেদের সশস্ত্র সংগ্রাম এক সাগর রক্তের দিগন্ত ফিনকি ছোটা রক্ত-হোলি আর লক্ষ লক্ষ অসহায়া বাঙালীর মা-বোনের ভূলুন্ঠিত সম্ভ্রমের এক চরম অগ্নিমূল্যের বিনিময়ে আমরা প্রাণ শপথের আখরে উড্ডীন করেছিলাম আমাদের রক্তস্নাত
বাংলার অনেক সাধের জলন্ত সূর্য পতাকাটিকে ঠিক এই দিনেই- এমনই এক পূণ্য অমোঘ মুহূর্তে। আজ আবার সেই দিন অনন্ত প্রাকৃতিক নিয়মের চাক্রিক সফর শেষে বছরান্তে ঘুরে এসেছে আমাদের জীর্ণ পর্ণ কুটিরে। এবার নিয়ে মোট তিনবার এলেও আসলে মাত্র দু’বারই আমরা এ পূণ্য দিনটিকে সত্তিকারের প্রাণ-প্রাচুর্য ও বেদনা-মিশ্রিত উচ্ছল প্রাণানন্দ নিয়ে উদযাপিত করতে যাচ্ছি। আর সে বর্গী নেই সত্যি, নেইও সে নির্মম পাঞ্জাবী হামাদদেএ ভয়াল কুটিল বিভীষিকা কিম্বা একাত্তরের সেই চরম অভিশপ্ত রাতের মৃত্যু মুখোমুখি সভয় প্রাণ প্রমাণ গোনার পালা। আজ আমরা স্বাধীন, সাড়ে সাত কোটি মুক্ত বিহঙ্গ আবার ডানার পত পত ধ্বনির সুললিত ছন্দ ঝংকারে এগিয়ে চলেছি উন্নতির অসীম সোনা পথে।
মনে আমাদের দুর্বার বাসনা, সামনে আমাদের বিপুল কর্তব্য এবং চোখে-মুখে আমাদের দুরন্ত সাগরের উত্তাল হাতছানি। বিশ্ব মানচিত্রের আমরা এক নবীন, বলিষ্ঠ যোজনা। আমাদের এ চিরচলার প্রচণ্ডতায় শত্রু পলায়ন মুখ্য, বিশ্ব বীর্য বিস্ময়ে বিমূঢ়। হ্যাঁ- আমাদের এ প্রচন্ড জীবন চলার প্রথম উন্মেষ হয়েছিল সেই একাত্তরের ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর- যেদিন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষিত পাক সামরিক বাহিনী নিতান্ত অসহায়ের মতোই আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় সৈন্য ও বাংলার দামাল ছেলেদের যৌথ কমান্ডের হাতে। তাই, যখনই এ দিন বছরান্তে আমাদের কাছে ঘুরে আসে, তখনি আমরা আবার নতুনভাবে অবগাহন করে নেই নতুন ও দৃপ্ততর শপথের উজ্জ্বল রজত সাগরে। সুতরাং, এদিন শুধু নিছক আনন্দ উৎসবের দিন নয়, এ দিন প্রাণ শপথেরও দিন। আজ এতো আনন্দের মাঝেও আমাদের হৃদয় নিংড়ানো বেদনাশ্রু স্মৃতির ব্যথায় বেদনা-আকুল।
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ লক্ষ জানা-অজানা শহীদের বিদ্রোহী আত্মাও আজ আকুল আগ্রহে শত বিস্ফারিত নেত্রে আমাদের সবার দিকেই তাকিয়ে আছে। রক্ত ও প্রাণের মূল্যে যে মহা ঋণভার তারা আমাদের দিয়ে গেছে, সে ঋণ আমরা কিভাবে পরিশোধ করছি, তা আজ তারা সবাই অলক্ষ্যে লক্ষ্য করছে। তাদের বিদেহী শুভেচ্ছাও আমাদের আগামীর চলার পথে নরম পুষ্পের মতো চারপাশে ছড়িয়ে আছে। যে আদর্শের খাতিরে তারা তাদের এতো সাধের প্রাণ দেশ ও জাতিকে উপহার দিয়ে গেছে, একমাত্র সেই আদর্শকে সমুন্নত রাখতে পারতেই শহীদদের বিদেহী আত্মা সুখ পাবে, আমরাও আমাদের মহা ঋণভার পরিশোধ করতে পারবো। আজকের এ পূণ্য অমোঘ দিনের প্রকৃত মর্যাদা রাখতে হলে আমাদের আবার নতুন করে স্মৃতির রোমন্থন করতে হবে, নতুন করে শপথ নিতে হবে। আমাদের আবার ভাবতে হবে আমরা সবাই বাঙ্গালী, আমরা একই মায়ের একই আদর্শে উদ্ধুদ্ধ কয়েক কোটি বীর সন্তান, একই বৃন্তের একই হৃদয় সূত্রে গাঁথা সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত পলাশ কৃষ্ণচূড়া।
রক্তপাত, প্রাণ বিদ্বেষ বা হানাহানি দিয়ে নয়, প্রীতি দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে ও বিশ্ব সৌহার্দ্য দিয়েই আমরা গড়ে তুলবো এক নতুন প্রেমের তাজমহল- সোনার বাংলাদেশ। আজ আমাদের শপথ নিতে হবে আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত সোনার বাংলাদেশেকে আবার পুনর্গঠনের। শপথ নিতে হবে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর, সহনশীলতা ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রশস্তকরণের। সাবধান হতে হবে দেশের শত্রু ও অন্যান্য কুটিল চক্রান্ত সম্পর্কে। আলস্যিভরে বসে থাকা নয়, চরম প্রচেষ্টা ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে উন্নতির নির্দিষ্ট সরল পথে। একমাত্র তখনি আমাদের এ স্বাধীনতার অর্থ পূর্ণ হবে, একমাত্র তখনি আমরা লাখো শহীদের রক্ত ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবো। একমাত্র তখনি আমরা প্রকৃতই বলতে পারবো “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।”
সবুজ বিপ্লব সাধনে উদ্ভুত সমস্যা দূর করুন
নানাবিধ অভাব ও সমস্যার জন্য কৃষিবিপ্লব ব্যাহত হবার পথে বলে আমরা গ্রাম বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর পাচ্ছি। বাংলার বাণী এবং আরেকটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে জানা যায় কোন কোন জায়গায় কৃষিবিভাগের কর্মচারীরা দীর্ঘদিন থেকে বেতন পাচ্ছেন না, কোথাও গমবীজের গুদাম শূণ্য, আলুবীজ ফুরিয়ে গেছে, কোথাও বীজ সংগ্রহের ব্যাপারে কৃষকদেরকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, কোথাও কীটনাশক ঔষধ ছিটানোর যন্ত্রের অপ্রতুলতা ইত্যাদি একটা না একটা সমস্যা লেগেই আছে। উপরন্তু তার উপর রয়েছে কৃষি বিভাগীয় কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজে গাফিলতি। আর এর ফলে সবুজ বিপ্লব সাধনের কর্মসূচিতে গ্রামের চাষী ভাইয়েরা উৎসাহী হলেও তাদের আশা ও শ্রম ব্যর্থ হবার পথে।
খবর বেরিয়েছে জামালপুর শেরপুরে কৃষি বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কৃষি কর্মকর্তাদের দায়িত্বে গাফিলতির দরুন কৃষি বিপ্লব কর্মসূচি সমস্যার সম্মুখীন। সেখানকার অধঃস্তন কর্মচারীরা বিগত ৬ মাস থেকে নাকি বেতন পাচ্ছেন না। এব্যাপারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোন সুফল হয়নি। শীতের মৌসুমে আমন ধান উঠার পর পরই ভিজা ভিজা জমিতে গম চাষের উপযুক্ত সময় হলেও সেখানকার কৃষি অফিসের গমবীজের গুদাম শূন্য, আলু চাষের সময় শেষ হবার আগেই আলুবীজও ফুরিয়ে গেছে, বীজ সংগ্রহের ব্যাপারে প্রপার চ্যানেলের প্রথমে কৃষি অফিসার, তারপর কৃষিউন্নয়ন সংস্থা এবং অতঃপর থানা কৃষি অফিসারের কাছে আবেদন নিবেদন ও তোষামোদ ইত্যাদি জটিলতা অতিক্রম করেও কাজ না হওয়ায় চাষী ভাইদের দুর্ভোগ, পর্যাপ্ত বীজতলার সরকারী ব্যবস্থা না থাকা এবং পোকা মাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষার জন্য কীটনাশক ঔষধ ছিটানোর যন্ত্রণার অপ্রতুলতা এবং সার থাকা সত্ত্বেও সার ডিলারদের পাত্তা না থাকায় সেখানকার সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
অপর এক খবরে জানা যায় বরিশাল জেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা সত্ত্বেও এবং কৃষি ভাইদের বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা থাকলেও প্রয়োজনীয় পাওয়ার পাম্প, টিলার, স্প্রে মেশিন ও বীজের অভাব এবং সারের দূর্মূল্যের কারণে সবুজ বিপ্লব সাধনের কর্মসূচিতে বিঘ্ন দেখা দিয়েছে৷ জেলা কৃষি দপ্তরের হিসাব অনুসারে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ১ লাখ ৬৩ হাজার একর ইরিচাষের জমির জন্য কমপক্ষে ৮০০টি পাওয়ার পাম্পের একান্ত প্রয়োজন থাকলেও সেখানে রয়েছে মাত্র ৫৪১টি এবং তার মধ্যে আবার দীর্ঘ দিন থেকে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে ২০২টি ৷ মোট ৮২১৬টি কীটনাশক ঔষধ ছিটানোর মেশিনের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অকেজো এবং সারের অভাব না থাকলেও গতবারের তুলনায় সারের মূল্য ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকদের পক্ষে সার ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না এবং সার সংগ্রহের ব্যাপারে সরকারের কড়া বিধি নিষেধ থাকায় সাধারণ কৃষকদেরকে দুর্ভোগ পোয়াতে হচ্ছে। খবরে আরো জানা যায় সেখানে ১৪৭১ মণ আলু বীজ আনা হলেও দীর্ঘদিন ধরে বস্তাভর্তি হয়ে থাকার ফলে শতকরা ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ বীজ পচে নষ্ট হয়ে গেছে বলে কৃষকরা অভিযোগ জানাচ্ছে। সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি বাস্তবায়নের যে সব সমস্যা ও অব্যবস্থার খবর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যে ভাবে প্রতিদিন আসতে শুরু করেছে তাতে আমরাও শঙ্কিত না হয়ে পারছি না। সবুজ বিপ্লবের আহ্বান জানানোর পূর্বেই এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের ব্যাপারে যে সমস্ত সমস্যা ও অভাব দেখা দিতে পারে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গভীর ভাবে ভেবে দেখার কথা এবং সে সব সমস্যার প্রতিবিধানের জন্য পর্যাপ্ত কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করে রাখার কথা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আদৌ ভেবেছেন কিনা সন্দেহ।
সবুজ বিপ্লব মুখের কথা নয়, বক্তৃতার বক্তব্যও নয়। সবুজ বিপ্লব সাধন করতেই হবে। কেননা আমাদের দেশে সমাজতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটবে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমেই। আর সমাজতন্ত্র কায়েম হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় চার মূল আদর্শের অন্যতম একটি। সুতরাং শুধু চটকদার কথা কিংবা আহ্বান নয় বরং সবুজ বিপ্লব সাধন আমাদের অন্যতম সংগ্রামও বটে। অথচ পূর্বেই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণের ত্রুটির জন্য সবুজ বিপ্লব ব্যাহত হলে তার জন্য দায়ী হতে হবে মূলতঃ কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকেই।
কেননা চাষী ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুর আহবানে সবুজ বিপ্লব সাধনে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে এসে কৃষিবিষয়ক প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবের সম্মুখীন হলে তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে- ফলে সবুজ বিপ্লবও বিলম্বিত হয়ে পড়বে। আর এরজন্য দোষ কৃষক ভাইদের হবে না, হওয়ার কথা নয়। আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কালবিলম্ব না করে সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্ভূত অভাব ও সমস্যাবলী যথার্থভাবে দূর করে চাষী ভাইদের উৎসাহ উদ্দীপনাকে কাজে লাগাবেন এবং সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথকে ত্বরান্বিত করে তুলবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক