You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৬শে ডিসেম্বর, বুধবার, ১০ই পৌষ, ১৩৮০

পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বিপুল

আমাদের সমগ্র জাতির সোনালী স্বপ্নের প্রতীক ও ইঙ্গিত ‘পাট’। অথচ, এ রাজ্যের নানান দুর্নীতি, অব্যবস্থা, চক্রান্ত ও গ্যাঞ্জাম দেখলে সত্যিই হতাশ হতে হয়। দুঃখ লাগে আমাদের এক শ্রেণীর কলুষিত গণ-চরিত্রের নিম্নমান রূপ দেখে। আমরা জানি, বিপুল তাদের চক্রান্ত, বিভিন্ন তাদের পদ্ধতি এবং ব্যাপক তাদের আনাগোনা। কিন্তু আমরা জানিনা, নিজেদের সামান্য সংকীর্ণ বৈষয়িক স্বার্থে তারা আমাদের মতো একটা গরীব ও গঠনোন্মুখ গোটা জাতিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে কিইবা লাভের সন্ধান পায়। এ মাসের প্রথম থেকে পাট রাজ্যের একটা মোটামুটি চিত্র লক্ষ্য করা যাক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ মাসে দু-দু’ বার নারায়ণগঞ্জ সফর করেন। দু’বারই ছিল তার আকস্মিক সফর এবং উভয় ক্ষেত্রেই ছিল পাটের প্রকৃত নৈরাজ্য সরেজমিনে তদন্ত করা।
তদন্ত শেষে তিনি নানান নির্দেশ দেয়া ছাড়াও কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড পাটকে নিয়ে কোন রকমের ছিনিমিনি খেলাই বরদাশত করা হবে না। এর পরদিন খবরে প্রকাশিত হয় যে, কাঁচা পাটের অভাবে খুলনার ষ্টার জুট মিল পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, মিল পুরনো দেনা শোধ করতে না পারায় নতুন ঋণ পাচ্ছেনা। ৬ই ডিসেম্বর আফিল জুট মিলে আগুন লেগে বেশ কিছু ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এ সময়ে আবার চাঁদ টেক্সটাইলেও নানান গ্যাঞ্জাম। ১৩ই ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আমিন এজেন্সীর পাটের গুদামে আগুন লেগে যে বিপুল টাকার পাট পুড়ে যায়, পুলিশের মতে তা ছিল একটি ষড়যন্ত্রমূলক চক্রান্ত৷ ১৭ই ডিসেম্বর খবরে প্রকাশ, পরিবহনের অভাবে রংপুর জেলার বিভিন্ন সরকারি পাটক্রয়কেন্দ্রে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ মণ পাট গুদাম ভর্তি হয়ে আছে কিম্বা খোলা অবস্থায় স্তূপাকারে পড়ে আছে। তাতে এমন পাটও আছে যা, উৎপাদনকারীরা ও ব্যবসায়ীরা কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে বটে; কিন্তু বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। পাট ক্রয় সংস্থা নিজেও স্বীকার করেছে যে, অর্থ সংকট, গুদাম স্বল্পতা, পরিবহণের অভাব- সব মিলিয়ে তাদের ‘হাত গুটিয়ে’ থাকার অবস্থা। প্রবল বর্ষণে ইতিমধ্যেই নাকি সেখানে প্রায় ৩ কোটি টাকার পাট সম্পূর্ণ অথবা আংশিক পচে গেছে। পাট চালান না হওয়ায় ক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে সমূহ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে অন্যদিকে উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা তাদের পাট বিক্রি করতে পারছেনা। ফলে ক্রমে সে পাট চোরাচালানকারীদের হাত ঘুরে অবাধে সীমান্ত পার হচ্ছে। গত ২১শে ডিসেম্বর প্রকাশিত এক খবর অনুসারে প্রায় পঞ্চাশ লাখ বেল কাঁচা পাট অবিক্রিত থাকায় দেশ প্রায় একশো পঁচিশ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রার্জন থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এদিন ভেড়ামারায় এক অগ্নিকাণ্ডের ফলে প্রায় নব্বই হাজার টাকার পাট ভস্মীভূত হয়ে যায়। সময় মতো দমকল বাহিনী আসতে পারেনি বলেই নাকি এতো ক্ষতি হয়েছিল। এদিন রাত আটটায় আদমজী চটকলের ৬ নং জেটিতে একটি পাটের নৌকায় আগুন লেগে প্রায় ৭শ’ ২০ মণ পাট ভষ্মীভূত হয়ে যায়। ২৩শে ডিসেম্বর খবরে জানা যায় যে, সময় মতো রপ্তানি না হবার দরুণ দেশের বিভিন্ন চটকলে প্রায় ৬৭ হাজার টন পাটজাত দ্রব্য পড়ে আছে।
এসব দ্রব্যের মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকারও ওপরে বলে প্রকাশ। এ ছাড়া আরো হাজারো রকমের সমস্যা। স্বতন্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ের পাটের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে বেশ কয়েকদিন হোলো। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থায় দেশের মানুষ যথেষ্ট খুশি হয়েছে এবং অনেক আশাও রাখে। নতুন মন্ত্রণালয় গঠনের পর এ পর্যন্ত পাট রাজ্যের নৈরাজ্য ও সমস্যা দূর করণে কর্তৃপক্ষ ঠিক কতটুকু সাফল্য অর্জন করেছেন তা এখনো জানা যায়নি, তবে এখনো আমরা মাঝে মাঝে পুরনো অনেক চিত্রেরই দেখা পাই বল্লে অত্যুক্তি হয় না।
পাট রাজ্যের প্রধান প্রধান অন্তরায়ের মধ্যে আছে খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব, প্রাপ্য বীমা টাকার অনাদায়, দায়ের টাকার সুদ, গুদাম স্বল্পতা, পরিবহণে অব্যবস্থা, রপ্তানীর অভাব ও আরো প্রচুর সমস্যা। আমাদের সংশ্লিষ্ট পাট মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কে তাদের দায়িত্বসজাগ হয়ে এ রাজ্যের সমস্ত নৈরাজ্য দূর করে অচিরেই দেশ ও জাতির ধন্যবাদার্হ হবেন বলে আমরা আশা রাখি।

জন্যসংখ্যা স্ফীতি রোধ করতে হবে

বাংলাদেশের জনসংখ্যা স্ফীতি এক প্রকট আকার ধারণ করেছে। বর্ধিত জনসংখ্যা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে নানাভাবে জর্জরিত করেছে। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় সর্বোচ্চ হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন এবং ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা আনুপাতিক হারে তিনগুণ বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই জনসংখ্যা স্ফীতি যদি রোধ করা সম্ভব না হয়, তাহলে বাংলাদেশকে সন্দেহাতীত কারণেই এক সংকটাকীর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে৷ দিনের পর দিন জনসংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে অভাব ও দারিদ্রের লক্ষণও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বেকারত্বের অভিশাপে আমাদের যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে। কলে এবং কারখানায় আমাদের জন্যশক্তিকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। হাসপাতালে দুঃস্থ রোগীদের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করাও সম্ভব হচ্ছেনা। দেশের বেশির ভাগ মানুষই থেকে যাচ্ছে অক্ষর পরিচয়হীন। কিন্তু জন্ম-নিয়ন্ত্রণের যদি কোন পন্থা নির্ধারণের না করা হয় তাহলে সমস্যা দিনে দিনে আরো ব্যাপক হতে বাধ্য। অথচ জাতীয় কল্যাণের স্বার্থে এ দেশের চিকিৎসক সমাজকে জনসংখ্যা রোধের কাজে সুপরিকল্পিত উপায়ে নিয়োজিত করা উচিত। সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ইউনিটের উদ্যোগে আয়োজিত চারদিন ব্যাপী সম্মেলনে বিভিন্ন চিকিৎসক অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, জাতীয় কল্যাণের স্বার্থে চিকিৎসক সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ করণীয় কর্তব্য রয়েছে। সম্মেলনে এ অভিমতও দেয়া হয়েছে যে, মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন যদি সুপরিকল্পিত ভাবে জাতীয় স্বার্থে কাজ করে, তাহলে দুঃস্থ মানবতার সেবায় চিকিৎসক সমাজ সব সময়ই সদাজাগ্রত ভূমিকা পালন করতে অক্ষম হবে। আমরা জানি, দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে চিকিৎসকদের ভূমিকা বিরাট বিশেষ করে, দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে এসে উন্নীত হয়েছে যার ফলে সার্বিকভাবে এতে দেশের সমস্যা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে।
বিপুল জনসংখ্যার চাপে বাংলাদেশ আজ অভাব-অনটন, হাহাকার ইত্যাদি এত প্রকট। তাই সুখী, সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনের জন্য চিকিৎসক সমাজকে নিতে হবে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। অন্ন, বস্ত্র এবং আনন্দোজ্জ্বল পরমায়ুর জন্য চাই জন্ম নিয়ন্ত্রণের সঠিক পদক্ষেপ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা কোন দেশেরই মঙ্গল ডেকে আনে না। জনসংখ্যার চাপ থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য চাই জন্মনিয়ন্ত্রণ সুবন্দোবস্ত। এই ব্যবস্থা অবিলম্বে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত আমরা অভাব, দারিদ্র্য, অশিক্ষার করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাবো না। বাংলাদেশের কল্যাণেই জনসংখ্যা রোধের কার্যকর ব্যবস্থাবলম্বন অবশ্য প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

সাতাশ খানার মধ্যে তেরো খানাই বিকল

উত্তর বঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ এবং রাজধানী ঢাকার সাথে তো বটেই এলাকার বিভিন্ন জেলাগুলোর মধ্যেও সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে আসছে তা নিয়ে এ যাবতকাল বহু লেখালেখিও হয়েছে- বলাও হয়েছে কম নয়। স্বাধীনতার পর সেসব ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নতিও হয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার সব সময় লক্ষ্য করা গেছে যে, যখনই কিছু লেখালেখি হয়, তখনই এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে। তারপর আবার সেই একই অবস্থা হয়ে যায়। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবর অনুযায়ী জানা গেছে যে, রাজধানী ঢাকার সাথে সড়কপথে উত্তর বঙ্গের বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা বা অন্যান্য জেলার যোগাযোগের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার কোচ সার্ভিস। অথচ এই কোচ সার্ভিসেও নিয়মিতভাবে দূর্যোগ দেখা দেয়া যেন একটি নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খবরে প্রকাশ, খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে এখন এই কোড সার্ভিস একেবারেই বন্ধ হবার আশংকা দেখা দিয়েছে। আর অনিয়মিতভাবে চলাচলের জন্য প্রায় প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার যাত্রীকে ভোগ করতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার যে ডিপোটি বগুড়ায় স্থাপন করা হয়েছে, একমাত্র সেই ডিপোতে ২৭ খানা কোচ রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ খানাই খুচরা যন্ত্রপাতির অভাবে বিকল। বাকী ১৪ খানার অবস্থাও অত্যন্ত নড়বড়ে। কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে চলছে মাত্র। ওই ১৩ খানা কোচ ছাড়াও ৪টি ইটালিয়ান বোরসানি, ২টি মারসিডিজ, ১টি শেভ্রলেট ও ২টি ডজ গাড়িও একমাত্র যন্ত্রাংশের অভাবে বিকল হয়ে রয়েছে। আর এদিকে মিনিবাসগুলো মেরামতের কোন ব্যবস্থা না করে এর বদলে এখন দূর পাল্লার বড় বড় বাসগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।
বড় বড় বাসগুলো মিনিবাসের রুট স্টপেজে থামে না। ফলে যাত্রীরাও নিয়মিতভাবে নিজেদের গন্তব্যে পৌছতে পাচ্ছেন না। সরকারি বাস চলাচলে যখন এহেন অব্যবস্থা চলছে, তখন বেসরকারি বাসগুলোও যাত্রীদের কাছ থেকে তাদের খেয়াল খুশিমতো ভাড়া আদায় করছে বলেও শোনা যায়। এমতাবস্থায় উত্তর বঙ্গ দেশের একটি বৃহত্তর অংশ। সভ্যতার বিকাশ আর জাতীয় উন্নয়নের প্রশ্নে যোগাযোগ ব্যবস্থা হচ্ছে প্রধান অবলম্বন। সেক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তর একটি অংশ যদি যোগাযোগ ব্যবস্থার অব্যবস্থায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, তবে জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় উন্নয়নও অবশ্যই বিঘ্নিত হতে বাধ্য।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!