বাংলার বাণী
ঢাকা : ১১ই অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৭৪, ২৪শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
সমাজবিরোধী দমন অভিযান
অবশেষে মওজুতদার, মুনাফাখোর, চোরাচালানী এবং সমাজবিরোধী লোকদের বিরুদ্ধে পুলিশী অভিযান শুরু হয়েছে।
অভিযানের প্রথম দিন গত মঙ্গলবার ঢাকা সহ বিভিন্ন স্থানে ২৪ ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক করা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত পুলিশের প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে যে, মানুষকে দারুণ কষ্টের মুখে ঠেলে দিয়ে এরা সমানে খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য বাড়িয়ে চলেছিল। সবকিছুর দাম জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। চোরাচালানী ও সমাজবিরোধী লোকেরা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। বিভিন্ন সময়ে সরকার বার বার এদের সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও এই সমাজবিরোধী লোকেরা তাদের ঘৃণ্য কার্যকলাপ থামায়নি। সরকার তাই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন।
চোরাচালানী, মওজুতদারী ও মুনাফাখোরী দেশকে দিনের পর দিন অন্ধকারের অতলে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিকে দিচ্ছে পঙ্গু করে—এ বাস্তব উপলব্ধি যে আইন শৃঙ্খলার ধারক বাহকদের হয়েছে এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা বৈকি! দেশের মানুষ অন্ততঃ খানিকটা আশ্বস্ত হতে পারবে এই ভেবে যে, যাক শেষ পর্যন্ত দেরীতে হলেও সর্বাত্মক পুলিশী অভিযান শুরু হয়েছে।
চোরাচালানী, মওজুতদারী ও মুনাফাখোরীর বদৌলতে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সমস্যা ও সংকট যে বাড়ছে—এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কথা স্বীকৃতি যেমন পুলিশের প্রেস রিলিজে পাওয়া গেছে, তেমন পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রচারিত সাম্প্রতিক বুলেটিনে। বুলেটিনে বলা হয়েছে, প্রধানতঃ চোরাচালান ও মওজুতদারীর জন্য মার্চ মাসে খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ঐ মাসে মোটা চালের মণকরা খুচরা দাম সর্বনিম্ন ৬ টাকা থেকে ৩৩ টাকা বৃদ্ধি পায়। গত দু’বছরে দেশের ৩টি নগর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় শিল্প শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় শতকরা ১১২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে চোরাচালানী, মওজুতদারী, মুনাফাখোরী ও বিভিন্ন সমাজবিরোধী তৎপরতার দরুণই সমস্যা সংকট বেড়েছে।
আগেই বলেছি যে, এ অভিযানকে অভিনন্দন আমরা জানাচ্ছি। এতদসত্ত্বেও কতকগুলো প্রশ্ন থেকে যায়। যে প্রশ্নগুলোর উপর নির্ভর করছে অভিযানের ভবিষ্যত সফলতা। ছিটেফোঁটা পুলিশী অভিযান যে আগেও পরিচালনা হয়নি তেমন নয়। মাঝে মধ্যে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে হানা দিয়ে মওজুত মাল উদ্ধার করেছেন। ব্যবসায়ীরাও গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু তারপর যে কি হয়েছে তা কেউ বলতে পারেন না। এবারের সর্বাত্মক অভিযানের প্রথম দিনেই দেখা যাচ্ছে পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে চোরাচালানী সহ চাল ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করেছেন। ঢাকা থেকে ভুয়া রেশন কার্ডও উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের নামের পাশে লেখা হয়েছে চোরাকারবারী, মুদ্রা পাচারকারী অথবা অন্য কিছু। যদি তাই হয় তাহলে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, যদি তারা চোরাকারবারী বা মুদ্রা পাচারকারী হয়ে থাকেন তাহলে এতদিন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হলো না কেন? প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, প্রতিবেশী বন্ধুদেশ ভারতেও সম্প্রতি চোরাচালানী, মওজুতদারী ও সমাজবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশী অভিযান শুরু হয়েছে। এ অভিযানে কুখ্যাত চোরাচালানী (যদিও তিনি বর্তমানে চোরাচালানে লিপ্ত নন বলে ঘোষণা করেছেন) কুলি মস্তানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কুলি মস্তান এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চোরাচালানী, মওজুতদারী বা মুনাফাখোরী একক প্রচেষ্টায় হয় না—এর পেছনে সব মহলের লোক থাকা প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেছেন, মাঝে মধ্যে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এ ধরনের অভিযান চালানো হলেও আসল কাজ কিন্তু ঠিকই চলে।
কুলি মস্তান ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে যে বক্তব্য রেখেছেন তা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আমাদের দেশেও যারা সমাজবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত তারা একা নন। এদের পেছনে অনেক বড় বড় রুই কাতলাও রয়েছে। এরাই নেপথ্য থেকে কলকাঠি নাড়ে। সুতরাং অভিযান যদি চালাতে হয়ে তাহলে শুধুমাত্র ১ হাজার ভুয়া রেশন কার্ড বা ৮০ লক্ষ সিগারেট অথবা গুটি কয়েক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করলেই হবে না। সমস্যা ও সংকটের জন্মদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমরা আশা করি এবারের অভিযান পরিচালনায় পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।
বাংলাদেশ ও প্যালেস্টাইন
আগামী সোমবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্যালেস্টাইন প্রশ্নে একটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপিত হতে চলেছে। বাংলাদেশ সহ আরব ও অপরাপর কয়েকটি দেশ এই নয়া প্রস্তাবের উদ্যোক্তা। আসন্ন প্রস্তাবের মূল বক্তব্য হলো : নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্যালেস্টাইনী প্রশ্ন আলোচনাকালে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থার (পিএলও) প্রতিনিধিদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। পিএলও প্রতিনিধিদেরকে পরিষদে স্থান দেওয়ার দাবী সংক্রান্ত এ প্রস্তাবের প্রতি ভারত সহ ৬৯টি দেশ ইতিমধ্যে সমর্থন জানিয়েছে।
পরবর্তী এক খবরে জানা গেছে যে, গত মঙ্গলবার জাতিসংঘে আরব গ্রুপের চেয়ারম্যান লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত কামাল হাসান মাঘুর সেক্রেটারী জেনারেল কুর্ট ওয়াল্ডহেইমের কাছে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থার প্রতিনিধিদেরকে আমন্ত্রণ জ্ঞাপন সম্পর্কিত একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ পরিষদে নভেম্বর মাসের আলোচ্য সূচীতে প্যালেস্টাইন প্রশ্নটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্যালেস্টাইনীদের বিষয়টি আজকের সৃষ্ট কোনো নতুন সমস্যা নয়া মধ্যপ্রাচ্য তথা সমগ্র বিশ্বের কাছে। সাম্রাজ্যবাদী চক্রের দুরভিসন্ধির শিকার ঊনিশ শ’ আটচল্লিশ সালে প্যালেস্টাইনের জনগণকে বাধ্য করা হয়েছিল তাদের আপন মাতৃভূমি থেকে চলে যেতে এবং সেই সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ফসল হলো মধ্যপ্রাচ্যের ‘বিষফোঁড়া’ ফ্যাসিস্ট ইসরাইল রাষ্ট্র। সেই থেকে শুরু এবং এখনও পর্যন্ত প্যালেস্টাইনের মূল জনগণ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে অপরের করুণাপ্রার্থী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সেই পালেস্টাইনী উদ্বাস্তুরা আজ ছাব্বিশ বছর ধরে স্বাধিকার আদায়ের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনৈতিক অঙ্গনের গতিধারার পথ বেয়ে রাষ্ট্রসংঘ সাধারণ পরিষদে সোমবারের আসন্ন প্রস্তাবকে আমরা নির্যাতিত জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রগতিশীল জাতিগুলোর একটা বলিষ্ঠতম উদ্যোগ বলে অভিহিত করছি। উনিশ শ’ আটচল্লিশ থেকে চুয়াত্তর এই দীর্ঘপথ পরিক্রমায় প্যালেস্টাইনী জনগণকে কম আত্মত্যাগ আর দুর্যোগের মোকাবেলা করতে হয়নি এবং এখনও পর্যন্ত তাদের এ সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
আগামী নভেম্বর মাসে সাধারণ পরিষদে প্যালেস্টাইনের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। সুতরাং যাকে নিয়ে আলোচনা তাকে অর্থাৎ প্যালেস্টাইনী জনগণের প্রতিনিধিদেরকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে সেখানে। ইসরাইলের যেমন বক্তব্য থাকতে পারে, আরব উদ্বাস্তুদের বক্তব্য পেশেরও অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে সেখানে এবং তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সহ যে ঊনসত্তরটি দেশ এই প্রস্তাব সমর্থন করছে আমরা আন্তরিকভাবে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। প্যালেস্টাইনীদেরকে যে তাদের আপন অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের জন্য যে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা দরকার সেটা বিলম্বে হলেও খোদ ইসরাইলও তা বুঝতে পেরেছে। সম্প্রতি পশ্চিম জার্মানীর হামবুর্গে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী রাবিন অধিকৃত জর্ডান এলাকায় স্বতন্ত্র প্যালেস্টাইনী রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনার কথা বলেছেন। এই সম্ভাবনার কথা অবশ্য নতুন নয়, বেশ কিছু দিন ধরে শোনা যাচ্ছে এবং এটাও হতে পারে যে, আরব জনগণের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কলহ সৃষ্টির জন্য সাম্রাজ্যবাদী চক্রের এটা একটা নয়া কৌশল মাত্র। তবে এ কথা ঠিক ইসরাইল বিলম্বে হলেও বুঝতে পেরেছে যাদেরকে একদিন আপন মাতৃভূমি থেকে বিতাড়ন করা হয়েছিল, তাদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি দরকার। আমরা মনে করি, প্যালেস্টাইনী জনগণের সাফল্যও ঠিক ঐখানে এবং এই নয়া বাস্তব উপলব্ধির পথ ধরে যেদিন প্যালেস্টাইনীরা আপন আবাসভূমি অর্জন করবে সেদিন খুব দূরে নেই।
তবে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ভূমিকার কথা অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। জন্মলগ্ন থেকে শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও বাংলাদেশ পৃথিবীর স্বাধিকার ও শান্তিকামী মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করে এসেছে এবং তার প্রধান উদাহরণ হলো ভিয়েতনাম অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার, কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুক সরকারের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান এবং আরব জনগণের সাথে সর্বক্ষেত্রে একাত্মতা প্রকাশ করা। বিগত আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন এবং আগামী সোমবার সাধারণ পরিষদে প্যালেস্টাইনী প্রশ্নে সহ উদ্যোক্তা হিসাবে কর্মতৎপরতা। সুতরাং নতুন রাষ্ট্রের মহৎ উদ্যোগের মধ্য থেকে একটি অধিকার বঞ্চিত জাতি বিশ্ববিবেকের কাছে নিজের কথা বলতে পারুক আমরা সেই কামনা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক