কুৎসিত ষড়যন্ত্রের নায়ক আমেরিকা
কুৎসিত ষড়যন্ত্র আঁটছেন স্বার্থান্বেষী মার্কিন মহল। তাদের মদৎ দিচ্ছেন বৃটেনের পাক-প্রেমিকেরা। এঁরা চান, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর রাষ্ট্রসংঘবাহিনীর মােতায়েন। তাতে নাকি জাগবে শরণার্থীদের মনে নিরাপত্তা বােধ। নির্ভয়ে ফিরবেন তারা ইয়াহিয়ার রাজত্বে। সেখানে পুনর্বাসনের কাজকর্ম। দেখবেন। রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক দল। চমৎকার পরিকল্পনা। বাংলাদেশের উপর ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসন কায়েম রাখতে হলে এর চেয়ে ভাল ফন্দী কল্পনাও করা যায় না। নিজের জমিতে ভারত কেন অনুমতি দেবে রাষ্ট্রসঙ্ঘ বাহিনীর অবস্থানের? সে তা পাকিস্তানের মত দাগী খুনী নয়? শরণার্থীরা তার আশ্রিত। এদের ভিটেছাড়া করেছে কে? ইয়াহিয়ার নরঘাতকের দল। এই হত্যাকারীদের গিলােটিনের নীচের মাথা গলাবে কোন নির্বোধ? বাংলাদেশের গণহত্যার যে-সংস্থা সেজেছে বৃহন্নলা, তার আশ্বাসে আস্থা রাখতে কোন মহমূখঃ ইয়াহিয়ার প্রাণের দোস্ত প্রেসিডেন্ড নিকসন। পাক মারণযজ্ঞের ইন্ধন জোগাচ্ছেন তিনি। মার্কিন এবং চীনা অস্ত্র ডেকে এনেছে বাংলাদেশের সর্বনাশ। ভক্ষকরা আজ রাষ্ট্রসঙ্ঘের নামাবলী পরে সাজতে চাইছে রক্ষক। পাক-বেতারের মিথ্যাচারের উপর চলছে সত্যের প্রলেপ দেবার অপচেষ্টা। ইয়াহিয়া বলছেন বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক। মার্কিন-প্রভাবিত রাষ্ট্রসংঘের মাতব্বররাও বলবেন—তথাস্তু। বাইরের দুনিয়া হফি ছাড়বে। ওরা ভাববেকরার নেই কিছুই। ঝাট গেছে মিটে। সবাই জানেন, এ অবস্থায় শরণার্থীরা ফিরতে পারেন না স্বদেশে। ভারত মুখ খুললেই উপদেশ আসবে—পাক-ভারত বিরােধ মিটিয়ে ফেলাই ভাল।
ইয়াহিয়াকে বাঁচাবার জন্য কেন উঠেপড়ে লেগেছে আমেরিকা? চীনের সঙ্গে চলছে তার দোস্তীর পায়তারা। ইসলামাবাদের খুনীর সঙ্গে তাদের গভীর প্রণয়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যাপকতা যদি বাড়ে, তবে ভেস্তে যাবে চক্রীদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এ-অবস্থায় বাংলাদেশ বাহিনীর ক্রমবর্ধমান সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা দরকার। মুক্তি-সংগ্রামীদের সহায়ক ভারত। ভারতের এবং বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে রাষ্ট্রসংঘবাহিনী থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে গেরিলারা। ওরা অবাধে ব্যবহার করতে পারবে না সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চলের ঘাঁটিগুলাে। ওদের সম্ভাব্য সাহায্য পাঠাতে ভারতেরও হবে অসুবিধা। বাংলাদেশের ভিতরের প্রতিরােধও পাবে প্রচণ্ড বাধা। পাক-সৈন্যদল তখন সাবাড় করতে পারবে মুক্তি-সংগ্রামীদের। তাদের পরােক্ষ মদৎ দেবেন রাষ্ট্রসংঘ বাহিনী। বিশ্বসভার এই ন্য়ক্কারজনক ভূমিকার নজির পাওয়া যাবে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ব আরব-ইস্রাইলের সীমান্তে, বিশেষ করে জর্ডানে। বহু আগেই হুশিয়ার হয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাঁরা স্পষ্টই বলেছেন, মুক্ত অঞ্চলে মােতায়েন হতে পারবে না কোন রাষ্ট্রসংঘবাহিনী। পাকিস্তানের ছাড়পত্র নিয়ে যদি কেউ আসে সে চিহ্নিত হবে শত্রু হিসাবে। তার নিরাপত্তার জন্য দায়ী থাকবে না মুক্তিবাহিনী। নয়াদিল্লীর মতামতও পরিষ্কার। কোন অবস্থাতেই ভারতের মাটিতে পা দেবার অনুমতি পাবে না রাষ্ট্রসংঘের সৈন্যদল। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে এ-ধরনের আব্দার বরদাস্ত করা অসম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুদ্ধরত পাক সরকার। ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে রাষ্ট্রসঙ্ঘ বাহিনীর উপর স্থিতির প্রশ্নটাই সেখানে অবান্তর।
এ-কথা সত্য, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে উৎসুক নয়াদিল্লী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচল অবস্থা যতদিন থাকবে, ততদিন হবে না শরণার্থী সমস্যার কোন সমাধান। এই অচল অবস্থা অবসানের একমাত্র উপায় বাংলাদেশ থেকে পাক-বাহিনীর অপসাররণ এবং সেখানে লােকায়ত্ত সরকারের প্রতিষ্ঠা। মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগ জনসাধারণের সত্যিকারের প্রতিনিধি তারা ছাড়া পরিচ্ছন্ন প্রশাসন গড়ে তােলার ক্ষমতা নেই অন্য কোন দলের। পাক-জঙ্গীশাহীর দৃষ্টিতে এরা সব রাষ্ট্রদ্রোহী। তাদের বিরুদ্ধে চলছে বিচার প্রহসনের আয়ােজন। মার্কিন চক্ৰীয় জোরদার করতে চাচ্ছে ইয়াহিয়ার হাত। মুক্তিবাহিনীর সগ্রামের তীব্রতায় তাদের মনে জাগছে প্রচণ্ড সন্ত্রাস। ওরা জানে, মুক্তিসংগ্রামীদের দাবিয়ে রাখার সাধ্য নেই পাক-বাহিনীর যতদিন যাবে ইয়াহিয়ার শক্তি কমবে এবং বাংলাদেশ সরকারের জোর বাড়বে। প্রসার ঘটবে মুক্তাঞ্চলের আমেরিকা এবং পাকিস্তানের পক্ষে এই সম্ভাব্য চিত্র ভয়াবহ। রাষ্ট্রসংঘের মাধ্যমে ওরা খুঁজছে পরিত্রাণের পথ। এ-পথ তারা খুঁজে পাবে না। ধোকায় ভুলবে না ভারত এবং ভুলবে না বাংলাদেশ। পশুদের তাড়া খেয়ে নিরস্ত্র শরণার্থীরা এসেছেন ভারতে। অস্ত্র হাতে পশু তাড়া করে ফিরে যাবেন তারা স্বদেশে। মুক্তিবাহিনী দেখাবেন পথ। সে-দিনের আর দেরী নেই। পাক-চীন এবং মার্কিন আঁতাত রুখতে পারবে না বাংলার গণ-সংগ্রামে দুর্বার স্রোত।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৩ জুলাই ১৯৭১