You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.04.26 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | শেরে বাংলার দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী | কাজের নামে অকাজ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৬শে এপ্রিল, শনিবার, ১৩ই বৈশাখ, ১৩৮১

শেরে বাংলার দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকী

আজ শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের দ্বাদশ তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলার কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের প্রিয় নেতা। ফজলুল হক বারো বছর আগে মহাপ্রয়াণ করেছিলেন। তার মৃত্যুতে জাতির সেদিন যে ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা পরবর্তীকালে পূরণ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্পর্শে। সর্বোপরি এ, কে, ফজলুল হক ছিলেন মেহেনতি বাঙালি জাতির অভিভাবক। উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রিয় নেতা। শেরেবাংলা আজীবন দুঃখী কৃষকের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্বপ্ন ছিল বাংলার সর্বহারা কৃষকদের জীবনে হাসি ফুটিয়ে তোলা। অবিভক্ত ভারতে তিনি যখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখনই তিনি কৃষকদের ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তিনি বাংলা বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন। বিশেষ করে মহিলা শিক্ষার প্রসারের জন্য ফজলুল হকের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শেরেবাংলা ছিলেন সর্বপ্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদগাতা। তার বাঙালি প্রীতিই পরবর্তীকালে তাকে বাংলার মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধাভাজন করে তুলেছিল। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে বাঙালি স্বাতন্ত্র রক্ষার জন্য তিনি যে নীতি ঘোষণা করেছিলেন তাই-ই পরবর্তীকালে বাংলার মুক্তি আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল। বস্তুতপক্ষে আজ একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে বীজ একদিন শেরেবাংলা বপন করেছিলেন সেটাই পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ফুলে-ফলে বিকশিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে বাঙালির যে স্বাতন্ত্র শেরেবাংলা একদিন ঘোষণা করেছিলেন পরবর্তীকালে সেটাই স্বাধীনতার দ্বারোৎঘাটন করেছে। তাই বাঙালি চির কৃতজ্ঞ এই মহান নেতার প্রতি। আজ তার স্মৃতিচারণের দিনে যেমন সারা দেশের কৃষক-শ্রমিক শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করবে তেমনি স্মরণ করবে দেশের অগণিত বিদ্যার্থীরা। এতদ্বসত্ত্বেও আমরা বলব সরকার যেন শেরে বাংলা স্মৃতি ও তার সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য যথার্থ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আমাদের জাতির গর্বের ধন বলতে যাদেরকে আমরা বুঝিয়ে থাকি তাদের জন্য শুধু জন্ম ও মৃত্যু দিবসের কর্মসূচি প্রণয়ন করে যথার্থ মর্যাদা প্রদর্শন করা সম্ভব হবে না। বরং তাদের জীবনের প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনা ও চিহ্নকে চিরকালের জন্য ধরে রাখতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ। এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা অবশ্যই সর্বাগ্রে প্রয়োজন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের এই দ্বাদশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা কতৃপক্ষের কাছে এই দাবি করি। শেরে বাংলার পবিত্র বিদেহী আত্মা সেইদিন সত্যিকার অর্থে শান্তি পাবে যেদিন তার স্বপ্ন পূরণ হবে, যেদিন বাংলার মেহেনতি কৃষক ও শ্রমিকের মুখে হাসি ফুটবে। আমরা এই পবিত্র দিনে তাঁর মহান আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

কাজের নামে অকাজ

পাচ্ছ তাই খাচ্ছ না পেলে খেতে কি! ঠিক এই ধরনের একটা মনোভাব আমাদের অধিকাংশ সরকারি আমলাদের মধ্যে বিদ্যমান। সোজা ভাষায় তারা দেশের জনসাধারণকে এ কথাটাই বোঝাতে চান যে, যা করা হচ্ছে তাই যথেষ্ট। আর এই ‘যথেষ্ট’র ঠেলায় পড়ে খাবি খাচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। গত ২৬শে ও ২৭শে এপ্রিল যথাক্রমে ‘বাংলার বাণী’ ও ‘ইত্তেফাক’-এ যে দুটো সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা রীতিমত উদ্বেগজনক। ‘জনসাস্থ প্রকৌশল বিভাগের কর্তারা কি ঘুমিয়ে ছিলেন’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়েছে যে জনস্বাস্থ প্রকৌশল বিভাগের জন্য কর্তৃক সাহায্য হিসেবে প্রদত্ত ১ লাখ ১০ হাজার নলকূপ বসানোর কাজ অনেক পিছিয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর ‘ইউনিসেফ’ বাংলাদেশকে সাহায্য হিসেবে ১৮ কোটি টাকা মূল্যের ১ লাখ ৬০ হাজার নলকূপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে কূপের পানির তীব্র সংকট রয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা উদ্দেশ্যেই এই সাহায্য দেওয়া হয়।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ নলকূপ স্থাপনের কাজে হাত দেয় বাহাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে হতে। ‘ইউনিসেফ’ এর সাথে চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের জুনের মধ্যেই ১ লাখ ৬০ হাজার নলকূপ স্থাপনের কাজ শেষ করার কথা। জনসাস্থ প্রকৌশল বিভাগ এ পর্যন্ত মাত্র ৫০ হাজার নলকূপ বসাতে পেরেছে।
নলকূপ যথাসময়ে স্থাপন করতে না পারার স্বপক্ষে কতৃপক্ষ অর্থাভাবের কথা উল্লেখ করলেও সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। এই পরিকল্পনার গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার অন্য খাত থেকে নিয়েও এই অর্থের ব্যবস্থা করেছেন।
দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে দেশের গ্রামাঞ্চলে ৫০ হাজার নলকূপ স্থাপন করতে জনসাস্থ প্রকৌশল বিভাগের প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা গচ্চা দিয়েছেন। গচ্চা দেবার নেপথ্য কাহিনী হলো প্রকৌশলীরা নলকূপে প্লাটফর্ম তৈরি এক ‘অভিনব পন্থা’ উদ্ভাবন করেন। কিন্তু বর্তমানে সেই অভিনব পন্থা অকেজো বলে প্রমাণিত হয়েছে।
নলকূপ খনন করার পর রাজমিস্ত্রিরা ওই স্থানেই প্লাটফর্ম তৈরি করে-এই হলো চিরাচরিত প্রথা। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রকৌশলীরা এই নিয়ম ভঙ্গ করে অভিনব পন্থা আবিস্কার করেন। এই নতুন নিয়ম অনুসারে এই সকল ‘প্লাটফর্ম’ তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। সিমেন্টের এই প্লাটফর্ম গুলির দুই ভাগে ভাগ করা হয় যখন এগুলো নলকূপের নিচে লাগানোর চেষ্টা করা হয়। তখন দেখা যায় ঠিকমতো তা বসেনি। বহু চেষ্টা করেও সিমেন্টের দুই টুকরো একত্র করা সম্ভব হয়নি।
কাজে কাজেই সরকারি অর্থের অপচয় করে যে প্লাটফর্ম গুলো নির্মিত হয়েছিল তা গ্রামাঞ্চলের কোন বাড়ি, আঙ্গিনা অথবা পুকুরের ঘাটে শোভা পাচ্ছে।
এধরনের একটি ‘অভিনব পন্থা’ অবলম্বনের পশ্চাতে কী কারণ ছিল তা জানা যায়নি। তবে এই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত পন্থাকে অকেজো বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ আবার সনাতন পদ্ধতিতে ফিরে গেছে।
মোদ্দা কথা হলো শেষ পর্যন্ত পর্বত মূষিকই প্রসব করেছেন। কাজের নামে অকাজ হয়েছে। অথচ এ কথা কে না জানে যে, চৈত্র-বৈশাখ মাসে গ্রামাঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। খাল-বিল পুকুর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। সামান্য খাবার পানির জন্য গ্রামের বৌ-ঝিদের দূরদূরান্তে যেতে হয়। এ কথায় মানুষের দুর্ভোগের আর সীমা থাকে না। অথচ ‘ইউনিসেফ’ যেখানে মানবিক দিক বিচার বিশ্লেষণ করে ১ লাখ ১০ হাজার নলকূপ দিয়েছেন, সরকার যেখানে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন সেখানে জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা যথাসময়ে নলকূপ বসানো কাজ শেষ করা দূরে থাকুক ইতিমধ্যে ৫০ লাখ টাকা গচ্চা দিয়ে বসে আছেন। কথায় বলে, কম দুঃখে কাতর অধিক শোকে পাথর। জনসাস্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের কাজকর্ম দেখে পাথরে রূপান্তরিত হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। এ ধরনের ঘটনা যে একটা তা নয় অনেক ঘটনাই অহরহ ঘটছে। কাজেই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, এসব অঘটনের মাত্রা যাতে কমে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হোক। অন্ততঃ পালের গোদা গুলোকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। কেননা, জনসাধারণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারো নেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন