এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে কানাডার নিরাপদ ও আরামদায়ক বাড়িতে বাস করা ও বড় হওয়ার সৌভাগ্যই পােষ্যদের ব্যক্তিগত পরিচয় গঠনে সহায়তা করেছে। তারা নিজেরাই উপলব্ধি করেছে তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও মানসিক সমস্যাদি কোথায় বা কতখানি, সেটা আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তাবােধ বাড়াতে সাহায্য করেছে আনুপাতিকভাবে। বলাবাহুল্য, বর্তমান দত্তক গ্রহণের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণের বিষয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে। দত্তকায়িত ছেলেমেয়েদের নিজ নিজ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ও নানাবিধ ভাবাবেগ এবং ব্যক্তিগতভাবে জীবনধারণের ক্ষেত্রে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা অক্ষমতা। একইসাথে জীবনের সফলতার বিচারকালে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে বাংলাদেশিরা তাদের জন্মগ্রহণ ও জন্মের ব্যাপারগুলি কীভাবে দেখেছিল; তারা যে কী ব্যাপকভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিল, সে বিষয়টিও স্মরণ রাখতে হবে। তারা বাংলাদেশে থাকলে তাদের ভবিষৎ কী দাঁড়াত সেটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এ কথা স্বীকার্য যে আমরা যতই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেষ্টা করি না কেন, বাংলাদেশ প্রকল্পএর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমাদের গবেষণা অনেকাংশে সীমিত। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের মূল্যায়ন প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বাবা-মা ও পােষ্যদের বিবৃতিনির্ভর। তাদের বিবরণ থেকেই আমরা জানতে পারি তাদের বর্তমান অবস্থান। পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি তাদের বর্তমান অবস্থান। যেমন, রায়ান এক সফল ব্যবসার পরিচালক, শ্যামা জনপ্রিয় শিক্ষক, আরেকজন শিক্ষক আমিনা দুবাইতে গবেষণার কাজ করছে। এখানে উদাহরণস্বরূপ মাত্র কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলাে।
আরেকটু গভীরে বর্তমান উদ্যোগের সফলতার মাপকাঠি খুঁজতে গেলে আমাদেরকে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের উত্থাপন করতে হবে: বাংলাদেশে যে যুদ্ধশিশুদের অবশিষ্ট কজন ছিল, তাদের কী হয়েছে? বাংলাদেশে ওরা কোথায় বাস করে? বাংলাদেশি যুদ্ধশিশু যাদের বয়স এখন। তেতাল্লিশে পড়েছে তাদের সম্পর্কে আমরা কতটুকু জ্ঞান রাখি? মূলস্রোতের বাংলাদেশিদের সঙ্গে তুলনায় যুদ্ধশিশুদের অবস্থান কোথায়? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নিষ্ঠুর সত্যি। কথাটা হলােঃ বাংলাদেশি জনগণ যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে দুঃখজনকভাবে অজ্ঞ, তারা সে বিষয়ে কিছু জানে না বললেই চলে। একটু ঘুরিয়ে বললে বলা চলে, অনেক বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে কিছুই জানতে চায় না, জানেও না। শুধু তাই নয় বাংলাদেশিরা ১৯৭২ সালে পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের বিচিত্র জীবন।
সম্পর্কে আগ্রহহীন । অন্যভাবে শব্দান্তরিত করলে এরকম জিজ্ঞাসা করা যায়ঃ যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে বাংলাদেশিরা কি আদৌ কখনাে ভেবেছে বা এখনও ভাবে? ২০১৪ সালের ডিসেম্বরএ বাংলাদেশিরা প্রথমবারের মতাে জানতে পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এর একটি রায় যেটা যুদ্ধশিশু ও তাদের জন্মদাত্রী মাদের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল-এর অবস্থান। আমরা এ অধ্যায়ের শেষের দিকে সেটাতে আলােকপাত করব । কানাডাতে দত্তক নেয়া হয়েছিল যাদের, সে যুদ্ধশিশুরা বাংলাদেশের প্রথম দলের । বাংলাদেশ অথবা অন্য কোনাে দেশের যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে আর কোনাে নথিপত্র আছে কিনা সেটা আমাদের জ্ঞানগােচরে নেই। অন্য কোনাে দেশে যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে কোনাে নথিপত্র পাওয়া গেলে তুলনা করে বলা যেত, বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের ব্যবস্থাপনায় আমরা কত বেশি বা কম সফল হয়েছি। এ কথা সত্যি যে, অসহায় ও আশ্রয়হীন বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুরা তাদের জন্মদেশে আত্মপরিচয় না দিয়ে লােকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে জন্মলগ্ন থেকেই। সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত সেসব যুদ্ধশিশুরা আজ সবদিক দিয়ে বিমর্দিত । কেননা কেউ জানে না তারা কারা। তাদের সংখ্যা কত ছিল, কেউই তা বলতে পারবে না। পরিতাপের বিষয়। যুদ্ধশিশুদের জন্মের ইতিহাস ও জন্ম-পরবর্তী বছরের তথ্য এতই দুর্লভ যে প্রয়ােজনীয় তথ্যাদির অভাবে আমাদের পক্ষে কোনােভাবেই কোনাে তুলনামূলক আলােচনা করা সম্ভব। নয়। আমরা যে বিষয়টি জানি এবং যে বিষয়ে কিছু নথিপত্র রয়েছে সেগুলাে শুধু কয়েকটি অনাথ আশ্রম যেখানে যুদ্ধশিশুদের জন্ম হয়েছিল এবং অনেক পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আসা হয়েছিল দত্তক দেয়ার উদ্দেশ্যে। যা হােক, অপরিজ্ঞাত ইতিহাস হলেও যতটুকু আমাদের জ্ঞানগােচরে রয়েছে বা জনশ্রুতি আছে সেগুলাের উপর ভিত্তি করে দুটি তথ্য বেরিয়ে আসেঃ এক, প্রয়ােজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থাদি না থাকায় এবং সঠিক পুষ্টির মান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা না থাকায় দূর্বল ও অবহেলিত শিশুগুলির অনেকেই বাঁচেনি। সে সময়ের সরকারি কিছু প্রামাণিক দলিলাদি থেকে আমরা জানতে পারি ঐ সব দাতব্য প্রতিষ্ঠান যেন মৃত্যুর লীলাভূমি ছিল, যেখানে শিশুদের মৃত্যুহার অত্যন্ত বেশি ছিল। দুই, ঐ শিশুরা যেন এক নির্মম, ক্ষমাহীন সমাজে চরম অবহেলায় বড় হয়েছিল, যেমনভাবে রাস্তায় ভিখারিরা বাস করে। আমরা এও জানি যে, ঐ শিশুরা নিজেদের জন্মের দেশে বাঁচবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, যেহেতু তারা সমাজে আত্মপরিচয় দিতে কুষ্ঠিত ছিল।
সে সময় সর্বাঙ্গিন সাহায্যের জন্য বিশ্বনিখিলে কেউই তাদের পাশে ছিল না। শুধুমাত্র সরকার ছাড়া কোনাে সমাজপতি, সমাজের পদস্থ ও বিত্তশালী কোনাে সমাজহিতৈষী কেউই এগিয়ে আসেননি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। সে দেশের সমাজ তাদের অভ্যর্থনা জানায় নি, চরম অবহেলায় উদাসীন হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি যখন রায়ান নিজেকে প্রথম বাংলাদেশি যুদ্ধশিশু হিসাবে প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে তখন সেটি বাংলাদেশে সে সপ্তাহের সবচেয়ে চমকপ্রদ সংবাদ ছিল । সে রাতারাতি প্রসিদ্ধি লাভ করে বাংলাদেশিদের ঔৎসুক্যকে উস্কে দিয়ে । বিস্মিত হওয়ার কোনাে কারণ নেই জন্মের সময়ে ওরা ঠিক এর বিপরীত কারণে সকলের নিকট “অবাঞ্ছিত” শিশু হিসেবেই পরিগণিত হয়েছিল। আবার এতেও বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই। তাকে নিয়ে হৈ চৈ বেশিদিন টেকেনি। প্রথম সপ্তাহে রায়ান ১৯৯৭ সালে যে রকম আগ্রহের ঢেউ সৃষ্টি করেছিল, পরের বছর বাংলাদেশ ছেড়ে যাবার বহু আগে সে নিজেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল।
চাঞ্চল্যকর খবর কাগজে পড়া বা টেলিভিশনে দেখার পরও কোনাে যুদ্ধশিশুই নিজের পরিচয় দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি । আজ ৪৩ বছরের যুদ্ধশিশুরা এখনও বাংলাদেশি সমাজের লুকানাে। মানুষ । এ যেন আরেক মিথ্যা পরিচয়ের আড়ালে আসল পরিচয় লুকিয়ে বাঁচা। যুদ্ধশিশুদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশে বা দেশের বাইরে পােষ্য হিসাবে নিজের বাড়ি বা একটি পরিবার পেয়েছিল? প্রাসঙ্গিক তথ্যাভাবে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কখনাে সম্ভব নয়। যদিও খুবই সীমিত আমরা বাংলাদেশে বড় হওয়া যুদ্ধশিশু সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি প্রফেসর ইয়াসমিন সাইকিয়া-এর বহুল আলােচিত গ্রন্থ Women, War, and the Making of Bangladesh: Remembering 1971, Durham, Duke University Press Books, 2017 থেকে। তার আগে আমরা যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে তেমন কিছুই জানতে পারিনি। সাইকিয়া তার অনুসন্ধানী গবেষণার কাজ করে অন্ততপক্ষে তিনজন যুদ্ধশিশু সম্পর্কে বলেছেন, যাদের মাঝে দুজন চাইনি তাদের বিষয়ে কোনাে আলােচনা হােক, যদিও তারা প্রফেসরের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। তৃতীয়জন নারী যার নাম বিউটি, সাইকিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ আলােচনা করেন। তিনি দ্বিধাহীনভাবে তার আসল নামটিই (বিউটি) ব্যবহার করতে বলেন। বিউটি তার মায়ের মতাে আত্মপরিচয় লুকানাের পক্ষপাতী নন। সত্যিই এটি ভাগ্যের পরিহাস যে বিউটি নামী নারী গাইবান্ধার এক অনাথ আশ্রমে বেড়ে উঠেছে যেখানে তার মা তাকে পরিত্যাগ করে যায় তার জন্মের পর পর ১৯৭২ সালে। বিউটির মা নূরী বেগম (বীরাঙ্গনা) ছদ্মনাম ব্যবহার করেন বাংলাদেশে নতুন জীবন যাপনের শুরু থেকেই । বিউটি নামের এ যুদ্ধশিশুটি অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠে। জীবন যত আনন্দময়ই হােক না কেন, আমরা সাইকিয়ার গবেষণায় দেখতে পাই অকমনীয় যুদ্ধশিশু বিউটি তার অভিশপ্ত জীবনে কোনাে সৌন্দর্যই উপভােগ করেনি। অথচ সবার কাছে সে “বিউটি” হিসেবেই পরিচিত । সাইকিয়া তার তথ্যবহুল গবেষণায় উল্লেখ করেছেন যে ধর্ষিতা ও প্রমত্ত পাশবিকতার শিকার এবং যুদ্ধশিশুর ভীত-সন্ত্রস্ত যে মা নূরী বেগমকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়ে সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা
করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে, দুর্ভাগ্যক্রমে সে বছরই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল। তখন নূরী বেগম চতুর্দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখতে পান। আমরা সাইকিয়ার মন্তব্যে দেখতে পাই বিউটি ও তার মায়ের জীবন কাহিনী কত হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী । প্রফেসর সাইকিয়া নূরী বেগমের নিজস্ব বক্তব্য নথিবদ্ধ করেন, যদিও তিনি জনসম্মুখে নিজেকে ধর্ষণের শিকার হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন, পরবর্তীকালে তিনি সেটা চেপে যেতে চান, সার্বক্ষণিক অস্বস্তি থেকে রক্ষা পেতে চান । সাইকিয়া এও লিখেছেন যে বিউটি চায় সকলে তার জন্মের ইতিহাস জানুক, তাতে তার কিছু যায় আসে না; বার বারই অন্যদের মতাে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছে (সাইকিয়া, পৃ: ৮২)।
সাইকিয়ার অনুসন্ধানী গবেষণার মাধ্যমে আমরা এও জেনেছি যে, “নূরী বেগম ও বিউটি দুজনই এ যাবৎ কষ্টকর জীবনযাপন করেছেন, কেবল মাত্র সামাজিকভাবে ও আর্থিকভাবেই। নয়, তাদের পরিচয়ের কারণেই সেটা বেশি ঘটেছে তারা যেটুকু গােপন রেখেছেন আর যেটুকু ফাস করেছেন, তাতেই ওলটপালট হয়েছে তাদের জীবনের স্থিরতা” (সাইকিয়া, পৃ:৮৩)। সাইকিয়ার মতে শান্তি-স্বস্তির অভাবে জীবিকা তথা আর্থিক অসচ্ছলতা বেড়েছে কমেনি। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, “বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং জনগােষ্ঠী ওদের ঘরে জায়গা দেবে না, হাঁড়ির রান্নার ভাগও দেবে না। আজ পর্যন্ত দেয়নি” (সাইকিয়া, পৃ:৮৩)। বিউটি, যার একবার বিয়ে হয়েছিল এবং বর্তমানে যে তালাকপ্রাপ্ত, কখনাে সে তার পূর্ববর্তী স্বামীর অশ্লীল ও অসহনীয় মন্তব্য ভুলতে পারে নাঃ “তােমার মা যেমন পতিতা, তুমিও তাই।” ঐ। মন্তব্য শুনলে বিউটি রাগে-দুঃখে-কষ্টে-বিষাদে ক্রোধােন্মত্ত হয়ে ওঠে। প্রতি মুহূর্তেই সে। প্রচন্ডভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পাগলের মতাে অস্থিরতায় । সাইকিয়ার মতে বিউটি আজ অনিশ্চয়তায় দিশেহারা। “চেহারায় মানুষের মতাে হলেও আমি মানুষের মতাে বােধ করি না মােটেই,” ছলছল চোখ নিয়ে বলে খিদ্যমান বিউটি (সাইকিয়া, পৃ:৮৩)। যদিও সে জীবিত তাকে অন্যরা যেমন বলে, তেমনি নিজেও সেভাবে সে যেন বিবর্ণ মৃতবৎ এবং শবসদৃশ । সাইকিয়ার গবেষণা থেকে আমরা এও জানতে পারি যে, তার সঙ্গে কথা বলার সময় মৃত্যু ভয়ে মুষড়ে পড়া বিউটি অসহায় বােধ করে সাহায্যের জন্য চেঁচিয়ে ওঠে: “আমার কোনাে বাড়ি নেই, পরিবার নেই। আমি কাজ করতে চাই, কিন্তু কাজ পাই না। আমি কোথায় যাব এখন? বাঁচার জন্য কী করব? আমার সময়, আমার জীবন দিয়ে কী করব? উত্তর খুঁজে পাই …। আমার মা আমাকে পছন্দ করে না, আমার সঙ্গে সে সময় কাটাতে চায় না। সে ভয়। পায় । আমাকে তার মেয়ে হিসাবে স্বীকার করতে চায় না। আমার কোনাে পরিচয় নেই” (সাইকিয়া পৃ: ১০৯)। আজ নূরী বেগমের জীবন এমন এক অবস্থানে এসে পৌঁছেছে যে তার “বুক ফাটে তাে মুখ ফোটে না” । সে কাউকেই জানতে দিতে চায় না তার জীবনের করাল বেদনা। বিউটির অবস্থা এখন এতই খারাপ যে, তার গর্ভধারিণী মাও তাকে সামাজিক জটিলতা ও বাধার কারণে প্রকৃত পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তার চারপাশের লােকজন তাকে কেবল বিদ্রুপ করে একটা বেওয়ারিশ কুকুরের সামিল করে দিয়েছে ।
কালের কবলে পতিত হওয়া বিউটি তার প্রতি মানুষের আচরণে বিস্মিত হয় না মােটেই । ভয়-বিহ্বলতার সাথে লড়াই করে সে সকল দুঃখকষ্টের মধ্যেও বাঁচার চেষ্টা করছে। চল্লিশাের্ধ বয়সেও তার নিজের। জন্মভূমিতে দেশের লােকেরা তাকে পরিচিতির ক্ষেত্রে যে অপমানকরভাবে চিত্রিত করে আসছে, তা সত্ত্বেও সে তার সেই ছিন্নভিন্ন আত্মপরিচয় ও মনের ধূ-ধূ জ্বালা নিয়ে খাপ খাইয়ে চলার কৌশল খুঁজছে। নিজেকে নিয়ে নানা কানাঘুষা শুনেও আত্মপরিচয়হীন বিউটি না শােনার ভান করে বাঁচতে চাচ্ছে। যেহেতু গৃহহীন শিশুদের জন্য সাধারণ মানুষের মনের কোণে স্নেহের ঠাই বর্তমান, সেহেতু আদর্শিকভাবে যুদ্ধশিশুদেরও একটি যথােপযােগী ব্যবস্থা করা উচিত ছিল সরকারি পর্যায়ে। আমরা প্রথম ও তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি কীভাবে বাংলাদেশি সমাজ “অবাঞ্ছিত” আখ্যা দিয়ে কোনাে ঘৃণিত ও অবহেলিত শিশুকেই আশ্রয় দেয়নি; কীভাবে উচ্চসিত মুজিব সরকার তখন অগ্রাধিকার দিয়ে একটি বাস্তবমুখী কর্মসূচি হাতে নেন। নিজ উদ্যোগে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে এসব অনাকাক্ষিত” শিশুদের বিদেশে আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঠিয়ে তাদেরকে বাঁচার সুযােগ করে দেন। বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের কানাডীয় জীবন-বৃত্তান্ত এটাই প্রমাণ করে যে সরকার বিধিপূর্বক দত্তক ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের জীবনযাপনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পথ সুগম করার নিশ্চয়তা দাবি করেছিলেন। বাংলাদেশে বড় হওয়া যুদ্ধশিশুদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে হলে আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারব যে, একজন যুদ্ধশিশু যদি নিজেই নিজের পরিচিতি সর্বজন সম্মুখে তুলে ধরে, তাহলে অন্য কারাে পক্ষে সেটা করা সম্ভব না। এ পর্যন্ত আমরা কেবল বিউটি সম্পর্কে জেনেছি। বিউটির বর্তমান ও অতীত বিষয়ে আমরা ততটুকুই জেনেছি, যতটুকু সাইকিয়া জানতে পেরেছেন। বাংলাদেশে সর্বত্র বিরাজমান কিন্তু অদৃশ্য যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে তিনি এর চেয়ে আর বেশি কিছু নথিভুক্ত করতে পারেননি। এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের জ্ঞানগােচরে আসেনি। সাইকিয়ার সঙ্গে যে অন্য দুজন যুদ্ধশিশু কথা বলেছেন, স্পষ্টত তারা কোনাে আত্মপরিচয় গােপন করেনি। যে পরিবেশে যুদ্ধশিশুদের মায়েরা গর্ভধারণ করেছিলেন, সে কথা ভেবে ৪৩ বছর পরেও সমাজপতিদের ভ্রু কুঁচকে যায়। বাস্তবতা এতই কঠোর যে, যুদ্ধশিশুরা তাদের নিজের দেশেই অপরিচয়ের আড়ালে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছে। বিউটি, যে তার জন্ম ও জীবন সম্পর্কে খােলাখুলি বলে, এবং তার মা, যে আড়ালে থাকতে চায়, উভয়েই দারিদ্র, অপরাধবােধ, লজ্জা ও অস্বস্তিতে জর্জরিত। বাংলাদেশি সমাজ যেহেতু যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে তেমন কোনাে উৎসাহ দেখায় নি, তাতে মনে হয়, আর দেখাবেও না। সেদিক দিয়ে দেখলে এটা সহজেই অনুমেয় যে, যুদ্ধশিশুরা কেন আত্মপরিচয় দিতে অনাগ্রহী। তবে ২০১৪ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রেক্ষিতে আশা করা যায় যে বাংলাদেশিরা।
যুদ্ধশিশু বিষয়ে এত বছরের সামাজিক নিশ্ৰুপতা প্রত্যাখান করে এখন সামাজিক দায়িত্বভার। গ্রহনের ব্যাপারে সচেতন হবে। একটু অন্যভাবে দেখলে, এরকমও বলা যায়, নিজেদের কোনাে দায়িত্ব বা দোষ না থাকলেও সমাজের চোখে খাটো বা স্বল্প সুযােগ-সুবিধার মধ্যে বাস করার কারণে ওদের এখন
প্রাপ্তবয়স্ক সমাজবিরােধীদের সঙ্গ করতে দেখা যায়। যদিও স্পষ্ট কোনাে পরিচয় নেই, তবুও এদের দেখা যাবে আশেপাশে চোখ খুলে তাকালেই । আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না যুদ্ধশিশুরা কোথায়, এটুকু বলা যায়, হয়তাে তারা দারিদ্রপীড়িত জনগােষ্ঠীর মধ্যেই মিলেমিশে আছে । যুদ্ধশিশু হিসাবে তাদের পৃথকভাবে পরিচিত করিয়ে দেবার কোনাে দাপ্তরিক রীতিপ্রক্রিয়া। নেই। ফলে একের পর এক সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের হিসেবের বাইরে যে শিশু জনগােষ্ঠী তাদের ভাগ্যোন্নয়নে তেমন কোনাে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি। কোনাে দালিলিক প্রমাণ না থাকায় বাংলাদেশে বড় হওয়া যুদ্ধশিশু সম্পর্কে আমরা কোনাে মন্তব্য পােষণ করতে পারব না। যেহেতু বিউটি গাইবান্ধার আশ্রমে বড় হওয়া একজন যুদ্ধশিশু, সে নিজেই সাক্ষ্য বহন করে যে মােটামুটিভাবে প্রথম থেকেই যুদ্ধশিশুরা। সামাজিকভাবে নিগৃহীত না হওয়ায় পরবর্তীকালে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত অনাথ আশ্রমগুলিতে তারা খানিকটা ধোঁয়াশাকীর্ণ পরিচয়ে বেড়ে ওঠে। জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে। বলা যেতে পারে যে তাদের জন্মকালীন পরিবেশের সঙ্গে পরবর্তী লভ্য পরিবেশের খুব একটা পার্থক্যও ঘটেনি । দুঃখজনক হলেও সত্য যে লাগাতার অবহেলার তারা শিকার হয়েছে এযাবৎকাল । অনেকের স্মৃতিগােচরে আছে যে সাধারণ ক্ষেত্রে মা-বাবা শিশুদের যে আদর যত্ন করেন, সেটা না পাওয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক হলে যুদ্ধশিশুরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পালিয়ে যায় । জনরবভিত্তিক এ ধরনের কাহিনী তাই প্রায়ই শােনা যায়। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কোনাে গবেষণা বা লেখালেখি না হলেও তাদেরকে ঘিরে যে জনশ্রুতি রয়েছে সেটা অনুযায়ী তারা তাদের জীবনকে ঘিরে লজ্জা, অস্বস্তি আর ব্ৰিত হওয়ার সম্মুখীন। হতাে। সেসব থেকে তারা মুক্তি চেয়েছিল। তারা মনেপ্রাণে চেয়েছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ। থেকে মুক্তি ও পরিবর্তন। যখনই অন্য ধরনের জীবনের সন্ধান পেয়েছে, তখনই তারা বাধা। ভেঙে ছুটেছে। যুদ্ধশিশুরা নিজেদেরকে সবসময় অবহেলিত অবস্থায় দেখে আসছে । অন্যভাবে বলা যায়, যেহেতু জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার যত্ন তাদের ভাগ্যে নেই, তারা । সর্বক্ষণ সকলের অনাদর, ঘৃণা ও টিটকারি সহ্য করা শিখতে শিখতে বড় হয়েছে ।
এক সময়ে সহ্যসীমা যখন চরমে পৌছে তখন তাদের অনেকেই অনন্যোপায় হয়ে বেরিয়ে এসে মিশে যায় আপামর মানুষের মধ্যে। সেখানে তাদের কোনাে পরিচয়ের প্রয়ােজন হয়নি। অনিশ্চয়তা, অযত্ন ও অবহেলার মাঝে তারা তাদের জীবনের নিরাপত্তা খুঁজে ফিরছে। অনুমান করা যায়, তাদের অনেকে হয়তাে আরও ধ্বংসাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের সাথে স্বেচ্ছায় জড়িত হয়ে গিয়েছে যা ধরে নেয়া যেতে পারে আত্মহত্যার শামিল। সাইকিয়া তাঁর। লেখনীতে বিউটির জীবনের নিদারুণ বেদনা ও চরম দুর্দশার যে চিত্র তুলে ধরেছেন সেটি চল্লিশাের্ধ যুদ্ধশিশুদের বর্তমান জীবনের রূঢ় বাস্তব সম্পর্কে আমরা যে ধারণা পােষণ করি। সেটিকেই আরও জোরালাে করেছে । বাংলাদেশে বড় হওয়া যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে প্রয়ােজনীয় প্রামাণিক দলিল না থাকলেও যেসব ঘটনা বা কাহিনী নানা আশ্রমের কর্মীবৃন্দ ও সমাজকর্মীদের দৃষ্টিগােচরে এসেছে, সেগুলাে থেকেও অনুমান করা যেতে পারে কীভাবে বেড়ে ওঠা যুদ্ধশিশুরা কষ্টেসৃষ্টে জীবিকার্জনের পথ খুঁজে নিয়েছে। ওদেরকে মাথায় রেখে যদি আমরা ভিয়েতনামের যুদ্ধশিশুদের কথা ভাবি তাহলে আমাদের স্মরণে আসবে তাদের আমেরিকান বাবাদের, যাদের ধর্ষণের ফলশ্রুতি সেসব যুদ্ধশিশুরা। উভয় বর্ণীয় (শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ) আমেরিকান বাবা ও ভিয়েতনামী। মাদের মিশ্র রক্তে জন্ম নেয়া এই যুদ্ধশিশুদের আমেরেশিয়ান বলে আখ্যা দিলেও তারা ভুমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই তাদের জন্মভূমিতে ছিল উপেক্ষিত ও অবহেলিত। আমরা এ কথা জানি। যে দক্ষিণ ভিয়েতনামে এদেরকে “জীবনের ধূলিকণা” বলা হত । যেন ওরা বাতাসের সঙ্গে উড়ে এখান থেকে ওখানে যায়। ঠিক সেভাবে বাংলাদেশের পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের “শত্রু সন্তান” অথবা “জারজ শিশু” বলে বাংলাদেশি সমাজ তাদের কোনাে দায়-দায়িত্ব নেয়ার কথা ভাবেননি। যে পনের জন যুদ্ধশিশুর জীবন বৃত্তান্ত আমরা জানলাম তারা যদি বিদেশে যাওয়ার। সুযােগ থেকে বঞ্চিত হত অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের মতাে, তাহলে তাদের জীবনে যে কী হত সেটা সহজেই অনুমেয়। ১৯৭২ সালে অটোয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের তৃতীয় সচিব জামিল মজিদ যুদ্ধশিশুদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যা ভাবতেন, সেটা স্মরণ করা এ প্রসঙ্গে প্রনিধানযােগ্য। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, আপন দেশে জনেও সে দেশে যুদ্ধশিশুরা সমাজের মূলধারা থেকে এমনি বিচ্ছিন্ন। হয়ে যাবে যে তারা মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
প্রকৃতপক্ষে, মজিদ তখন যুদ্ধশিশু দত্তকগ্রহণ প্রকল্পে যারা কাজ করছিলেন, তাদের কাজকে ‘মহৎ’ কাজ বলে উল্লেখ করে তাদের উদ্যোগের প্রশংসা করেছিলেন। মজিদের সংশয় ছিল সে সময় যতটুকু সম্ভব বিশেষ উদ্যোগ ছাড়া বাংলাদেশে এসব “অনাকাক্ষিত” শিশুদের ভবিষ্যৎ থাকবে অনিশ্চিত। তাই তিনি অকপটে তার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন এটা বলে যে, “যুদ্ধশিশুরা সামনে খুব খারাপ সময় কাটাবে” (The Globe and Mail, 12 September 1972)। এ কথা অনস্বীকার্য যে, তার উদ্বেগের সত্যতা শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে থেকে যাওয়া যুদ্ধশিশুদের বেলায়। তাদের সম্পর্কে যে কোনাে ধরনের লিখিত বা অলিখিত পরিসংখ্যান নেই সেটা প্রমাণ করে যে সামাজিকভাবে তাদের কোনাে পরিচয় তাে নেই বরং বাংলাদেশের আদমশুমারিতেও তারা কোনাে সংজ্ঞা বা শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নয়। সংক্ষেপে বলা যায়, তারা বাংলাদেশে থেকেও নেই। বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে জামিল বলেছিলেন, ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুরা উত্তর আমেরিকায় খুব সুন্দর পারিবারিক জীবন পাবে, যেখানে শিশুদের নিরাপত্তা ও পরিবারের সুরক্ষা বিশেষ কল্যাণকর কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত হয়, সেখানে জীবনের অধিকার, স্বাধীনতা ও সুখী হবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের সুনিশ্চিত করা হয়। মজিদ ১৯৭২ সালে যুদ্ধশিশুদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন চল্লিশ বছর পরে বাংলাদেশে বড় হয়ে ওঠা যুদ্ধশিশু বিউটির জীবন বিষয়ে আলােচনা করতে গিয়ে আমরা সে কথার সত্যতা যাচাই করতে পেরেছি। বিউটির মতাে যারা মনােজ্বালা নিয়ে বেঁচে আছে, যাদের গৃহ নেই, যারা সর্বহারা, মানবিক অধিকার থেকে চির বঞ্চিত, সামাজিকভাবে বৈষম্যতার শিকার জীবনের আরম্ভ থেকে, যাদের জন্মদাত্রী মায়েরা বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বিষয়ে মানুষ মূলত অজ্ঞাত, তেমন বিশেষ কিছু কেউই জানে না। রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার এবং জমে থাকা কূপমুন্ডতার বেড়া ভেঙে এই শিশুদের দায়িত্ব। গ্রহণে কেউ আগ্রহ দেখাননি। সেজন্যই সমাজের সর্বনিম্নস্তরের দারিদ্র যেখানে নির্মম সেখানে। যুদ্ধশিশুদের যে সমাজ বর্জন করেছিল সে সমাজে বিষয়টি অস্বাভাবিক হিসাবে কখনাে দেখা হয়নি। বস্তুতপক্ষে, হৃদয়হীনতার বিপরীতটি দারিদ্রের পক্ষে স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে বাস করার যে মৌলিক অধিকার রয়েছে সে। বিষয়েও কেউ কোনাে জোর দাবি করেননি। সামাজিক স্তরবিন্যাসে তাদের জায়গা কোথায়? আমরা ধরে নিতে পারি যত মৌলিকই হােক না কেন, এটা একটা জটিল প্রশ্ন। যাদের সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনাে আত্মপরিচয় নেই তাদের বিষয়ে এ ধরনের প্রশ্নের কোনাে উত্তর দেয়া সম্ভব নয় । নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে দেশে তাদের জন্মকে সামাজিকভাবে “অপবিত্র” হিসাবে দেখা হয়, সে দেশে তারা উন্নতি লাভের সিড়ির সর্বনিম্ন ধাপে । সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞানে ওটা সংখ্যালঘুদের অধীনতা ও ক্ষমতাহীনতার সমার্থক।
বাংলাদেশে হয়তাে তারা বেড়ে উঠেছিল এটা ভেবে যে, “দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কীসের?” আরও দুস্থ, এতিম, পরিত্যক্ত ও বিকলাঙ্গ শিশুদের সাথে বড় হওয়া সেসব যুদ্ধশিশু স্বভাবত শুনে আসছে গুলি, বন্দুকের শব্দ ও ভয়াবহতার কথা; একাত্তরের নারকীয় হত্যাকান্ডের লােমহর্ষক বিবরণ; তাদের মাদের প্রতি নির্দয় ও নিষ্ঠুরতম আচরণের কথা । বিষাদময় জীবনে মা-বাবার উষ্ণ আদরের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে আদর্শ মা-বাবা হিসাবে কাউকে না পেয়ে । জনশ্রুতি মতে, নানা শিশুসদন ও আশ্রম থেকে কৈশাের বয়সে বেরিয়ে আসা যুদ্ধশিশুরা পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে ঘুরে ঘুরে বড় হয়েছে। আবাসবাসস্থানহীন সেসব যুদ্ধশিশুদের জীবনের শুরু থেকে কিছু ছিল না, ছিল না কোনাে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। সামাজিকভাবে নিগৃহীত এই যুদ্ধশিশু তাদের সত্যিকার আত্মপরিচয় লুকিয়ে নতুন পরিচয় দিয়ে নিতান্ত সাধারণ মানুষ হিসাবে বেঁচে আছে তাদের জন্মস্থানে। অনুতাপের বিষয়, জনশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের পােষ্যগ্রহণ যে হয়নি তা নয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অনেক পরিবার একান্তে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া, অনাদৃত ও পরিত্যক্ত অনেক যুদ্ধশিশুদের । কিন্তু তাদের কেউ এ বিষয়ে কারাে সাথে কোনাে সংলাপে যােগ দেননি অথবা ঘূণাক্ষরেও কারাে সাথে এ বিষয়ে কথা বলেননি। সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনাে উদ্যোগের মাধ্যমে কেউ দত্তক গ্রহণ করলেও সেসবের কোনাে দলিলাদি নেই । ফলে অনুকম্পাবশত যেসব যুদ্ধশিশুকে বাংলাদেশিরা লালন-পালন করেন, তাদের বিষয়ে কোনাে পরিসংখ্যান কোথাও পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে সামাজিক নিশ্ৰুপতা বাংলাদেশের ঘূণেধরা সমাজে যুদ্ধশি যে আজও নিগৃহীত তারই ইঙ্গিত বহন করে। যুদ্ধশিশু বিউটির অতিষ্ঠ জীবনের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে যদি বাংলাদেশের অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের জীবন ধারার প্রতিফলন হিসাবে ধরা হয়, তাহলে সে হবে সে নাটকের বিয়ােগান্তক উপসংহার যার আরম্ভ হয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ওদের জন্মের ভেতর দিয়ে । যে যুদ্ধশিশুরা মানবিক বিবেচনার দুগ্ধধারা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, তারা যে মর্মবিদারী দুঃখ পেয়েছিল, তার খবর কেউ জানে না। কেউ সে বিষয়ে জানার ইচ্ছা পােষণ করে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তরও আমাদের জানা নেই।
আনুমানিকভাবে বলা যেতে পারে বর্তমানে বাংলাদেশে পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের কেউ কেউ হয়তাে জীবনসঙ্গী ও সন্তানসহ সংসার পেতেছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা হয়তাে যুদ্ধশিশুদের অতীত সম্পর্ক কিছুই জানে না । হাড়-জ্বালানাে ব্যথা বুকে নিয়ে পিতৃ-মাতৃহীন এবং স্নেহ-আদর বঞ্চিত যুদ্ধশিশুরা জীবন চালিয়ে নিচ্ছে তাদের আপন গতিতে, নিষ্ঠুর বাস্তবের সাথে তাল রেখে। তাদের দুঃসহ জীবন যুগপৎ এটা প্রতিপন্ন করে যে মানুষ নানা দুঃখ-কষ্ট নিয়েও বাঁচতে চায় । বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের যাপিত গােপন ও দুঃসহ জীবন আমাদের ডি’কস্টার দুটি মন্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেয়ঃ যেহেতু আমরা যুদ্ধশিশুদের চিনি “সকল যুদ্ধশিশুর বিষয়ে জানার কোনাে উপায় নেই;” “তাছাড়া, নিজেদের তারা চেনাতেও রাজি নয়।” এবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাক একই পরিস্থিতিতে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুদের দিকে, যাদের লালিত-পালিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল সাধারণ কানাডীয় বাবা-মায়ের বাড়িতে। এখানে আমরা একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণের চেষ্টা করতে পারি এদের জীবনের সাথে বাংলাদেশে বড় হওয়া একই সময়ের যুদ্ধশিশুদের জীবনের । শুরুতে আমরা যুক্তিযুক্তভাবে বলতে পারি যে কানাডীয় বাবা-মায়েরা ঐ শিশুদের জীবন সত্যিকার অর্থে পাল্টে দিয়েছিলেন তাদের দত্তকগ্রহণের মাধ্যমে – নিরাপদ, নিশ্চিত ও গর্ব করার মতাে পারিবারিক জীবন এবং কানাডীয় পরিচিতি দিয়ে। আমরা যে কেবল তাদের ঠিকানা জানি, তা নয়, এ বইয়ের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে তাদের যে বিবৃতি আমরা পড়েছি তার থেকে তাদের জীবনের বর্তমান ইতিহাস জানতে পেরেছি। তাদের জীবনে নমনীয়তা, সংবেদনশীলতা ও সম্পদশীলতা যেমন সক্রিয় তেমনি সকল কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে আদর্শ মানবিক ধারার উন্নয়ন অনুশীলনে ব্যস্ত থেকেছে আশৈশব – এ বৃত্তান্ত দত্তকগ্রাহীতা মা-বাবা ও শিশু উভয়ের বক্তব্য থেকে জানতে পেরেছি আমরা। কানাডাতে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ায় শুধু যে কানাডীয় দত্তকগ্রাহী মা-বাবার গৃহে ওরা নিরাপদ আশ্রয় পেল তা নয়, বাংলাদেশে তাদের পরিচয় দিতে যে সামাজিক অসুবিধা ছিল। সেসব দূর হয়ে নতুন ঠিকানায় আরও প্রশস্ত সব সুযােগ সুবিধার জানালা খুলে যায় ।
কানাডাতে দত্তকায়িত হওয়া বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের অবৈধ শিশু হিসাবে তাদের জন্মভূমিতে তারা যে লজ্জা ও অবহেলার পাত্র ছিল সে কলঙ্ক চিহ্ন যেন মুহূর্তের মধ্যে চিরতরে মুছে গেল তাদের জীবন থেকে । অবশ্য এ কথাটি সত্য যে, ১৯৬০ এর দশক থেকে অবৈধ সন্তানদের যে কলঙ্ক ও লজ্জার দৃষ্টিতে দেখা হত সে দৃষ্টিভঙ্গি আস্তে আস্তে বদলানাের পথে ছিল । যুদ্ধশিশু হােজে, অনিল অথবা রিজা রুফিয়া ওদের প্রত্যেকের একটি নিজস্ব কানাডীয় পরিচয় রয়েছে, যার ওপরে নির্ভর করে ওরা গর্বভরে মাথা উঁচু করে বাস করছে কানাডাতে । যুদ্ধশিশুদের বয়স আজ ৪৩-এর কোঠায় এবং তারা সকলেই কানাডায় সম্মানজনক জীবনযাপন করছে। যেসব অবহেলিত শিশুদের বাংলাদেশ থেকে কানাডা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকে আজ তাদের দেশ কানাডা”-তে নেতৃত্বদানে উপযােগী ভূমিকায় সমাজে উপযুক্ত দায়িত্ব পালন করছে। দত্তক বিষয়ক আলােচনায় অবশ্য এ কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে ‘দত্তকগ্রহণ ব্যবস্থা মানুষের তৈরি একটি আইনি ব্যবস্থা অনাথ ও পিতৃমাতৃহীন শিশুদের একটি নিরাপদ ও বিপদমুক্ত পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট করার মাধ্যমে। অনেকে মত পােষণ করেন যে দত্তক গ্রহণ ব্যবস্থা প্রকৃত প্রস্তাবে প্রাকৃতিক নিয়ম বা সত্যকে লঙ্ঘন করে । আন্তবর্ণীয় দত্তক ব্যবস্থা ভালাে কি মন্দ, সে বিচারে না গিয়ে এটুকু বলা যায় যে, কানাডাতে দত্তক নেয়া বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুরা অনুকূল পরিবেশে প্রতিপালিত হয়ে ফুলে-ফুলে প্রস্ফুটিত হয়েছে। কানাডাতে আজ তারা আদর্শ নাগরিক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। সে দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করলে আমরা বলতে পারি, ১৯৭২ সালের মুজিব সরকার ও কানাডাস্থ এফ এফ সি’র একটি সফল অংশীদারিত্বের প্রকল্প। “যুদ্ধশিশুরা যারা ১৯৭২ সালে কানাডা এসেছিল, তাদের একজনের সঙ্গে ২০ বছর পরে পরিচিত হয়ে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম এটা ভেবে যে কানাডীয় নাগরিকরা তাকে কোথায় তুলে দিয়েছে আজ,” বলেন জেম্স বার্টলম্যান, তকালীন কানাডীয় হাই কমিশনার যিনি কানাডীয় টিমকে যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে আনতে সহায়তা যুগিয়েছিলেন। (James Bartleman, On Six Continents-A Life In Canada’s Foreign Services, 1966-2002, Douglas Gibson Books 2005, p.64.).. তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা ১৯৭২ সালে অন্টেরিও সরকারের শিশু কল্যাণ বিভাগের পরিচালক বেটি গ্রাহাম-এর কর্মকান্ডের কাহিনী পড়েছি । তিনি নানাভাবে কানাডাতে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার বিরােধিতা করেছিলেন।
তিনি মনে করতেন, তারা “রােগাক্রান্ত, অপুষ্ট এবং তাদের সারা শরীরে ঘা” । এ কথাটি এখন স্পষ্ট, গ্রাহাম নিজে কখনাে ভাবতে পারেননি যে ওরা গর্বিত কানাডীয় নাগরিক হিসাবে বড় হবে একদিন। বছর গড়িয়েছে, যুদ্ধশিশুরা তাদের নিজস্ব মূল্যবােধে মাথা সােজা করে দাঁড়িয়েছে আজ। বহুসংস্কৃতির ধ্বজাধারী কানাডীয় সমাজে নিজ নিজ জায়গা করে নিয়েছে, কানাডাকে গর্বিত করেছে। যেখানে তারা শিশু হিসাবে এসেছিল সেখানে তারা বড় হয়ে উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পেয়েছে, তাদের পরিবার সম্পর্কেও তারা গর্বিত। ওরা উপযুক্ত মূল্যবােধ আহরণ করেছে, যার বলে ভালাে ও নীতিবান হিসাবে তারা খারাপ ও ভালাে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তারা এমন জীবনযাপন করছে যা সৃষ্টিকর্তা যেন তাদের উপহার হিসাবে দান করেছেন। তাদের দত্তগ্রাহী মা-বাবার সাহচর্যে সে জিনিসগুলাে পুষ্ট হয়েছে, ভালােবাসায় ঋদ্ধ হয়েছে এতগুলাে বছরব্যাপী। বুনস্ট্রা অথবা গুড়-দের বিবরণী অথবা দত্তক নেয়া গ্রুপের অন্যান্য যেকোন মা-বাবার বক্তব্যে এরকম একই কথা বলা হয়েছে। তাদের সন্তানদের বিষয়ে প্রতিবারই তারা প্রকটভাবে সন্তানের জন্য তাদের স্নেহ, আদর-যত্ন ও ভালােবাসার কথা উল্লেখ করেছেন। স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে দত্তক নিয়ে অনাথ শিশুদের নিজের শিশু দাবি করে তারা যে শুধু এই শিশুদের নিজের শিশুর মতাে লালন পালন করেছেন, তা-নয়। তারা তাদের নিঃশর্ত আদর ও স্নেহ মমতা দিয়ে পিতৃমাতৃত্বের এক জলজ্যান্ত প্রমান রেখেছেন। বাংলাদেশ প্রকল্প- কে তাই জাতিভেদের দূরত্ব ঘুচিয়ে আন্তবর্ণীয় মিলন ও পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মিলনক্ষেত্র বলা যেতে পারে ।
বাংলাদেশে অপরিচিত ও অবহেলিত হলেও দত্তকায়িত যুদ্ধশিশুদের কানাডীয় জীবনের যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি সে তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারেনিঃসন্দেহে তাদেরকে এমন এমন পরিবারে নিয়ে আসা হয়েছিল যেখানে প্রতিটি শিশু পেয়েছিল উপযুক্ত বাবা-মা ও ভাইবােন। তাদের জন্মভূমিতে সামাজিকভাবে তারা উপেক্ষিত হলেও বাংলাদেশের বাইরে কানাডাতে তাদের দত্তক নেয়া পরিবারগুলােতে তারা ছিল অখিলপ্রিয়। অন্যভাবে বলা যায়, পরম করুণাময়ের যেন এ ব্যাপারে এতখানি হাত ছিল যে, তিনি তার ইচ্ছামতাে শিশুদের বিভিন্ন পরিবারে পাঠিয়ে দিয়ে লক্ষ্য রেখেছেন, সে ঠিকমতাে মিলেমিশে যেতে পারছে কিনা। এক্ষেত্রে মনে হতে পারে, এক একটি বিশেষ পরিবারের জন্যই যেন এক একজন বিশেষ শিশুকে দত্তক নেয়া হয়েছিল। যে শিশুর দেহে ক্ষত ছিল, সেটার বিশেষ যত্ন করা হয়েছে, অবাঞ্ছিত শিশুকে বেশি করে আদর দেয়া হয়েছিল আর দত্তক নেয়া মাবাবা ও শিশু সকলেই এ ব্যাপারে গর্বিত ছিলেন আগাগােড়া। মহৎ জীবনের আকাক্ষাই জীবনের পাথেয়।
সে দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করলে বলা যেতে পারে যে, কানাডাতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বর্তমানে যুদ্ধশিশুরা প্রমাণ করেছে যে তারা সুন্দরভাবে বড় হয়ে উঠেছে তাদের মা-বাবার সাদরে ও স্নেহমাখা মমতায় । এর ফলশ্রুতিতে তারা উদ্যমী, স্থির, বিচক্ষণ, ভারসাম্যপূর্ণ, সফল ও সমন্বিত জীবনযাপনে উৎসাহী। বাংলাদেশে অনাথ শিশুদের সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক সিস্টার মারগারেট ম্যারি ১৯৭২ সালে যুদ্ধশিশুদের তত্ত্বাবধানে থাকাকালীন সেসব শিশুদের অনুর্ভূত বৃত্তিশক্তির কথা ভেবেছিলেন, আজ ৪৩ বছর পরে সৎপথাবলম্বী যুদ্ধশিশুরা কানাডাতে বাস্তবিকপক্ষে প্রমাণ করেছে তাদের সৃজনশীলতা ও বিকাশযােগ্যতা। প্রয়াত সিস্টার ম্যারি ওদের দত্তক নেবার সুফল অনেকাংশে দেখে গিয়েছেন, ২০১০ সালে তার প্রয়াণের আগ পর্যন্ত। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা লক্ষ্য করেছি কীভাবে সিস্টার ম্যারি বাংলাদেশ প্রকল্পের সাফল্য নিশ্চিত করতে কী পরিশ্রমই না করেছিলেন! সিস্টার ম্যারি নিশ্চিত ছিলেন যে প্রেম ও ভালােবাসা ছাড়া একই জাতের একটি পরিবারে প্রয়ােজনীয় বন্ধন বা সম্পর্ক কখনাে তৈরি হয় না। সিস্টার ম্যারি যখন দত্তকায়নের জন্য যুদ্ধশিশুদের বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন তখন তাকে খেয়াল করতে হয়েছিল দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়েদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুনাবলির দিকগুলাে। যার ফলে শিশুরা দেখতে কতটুকু দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়ের মতাে, কী তাদের ধর্ম, বর্ণ, গৌত্র এসবের কিছুই মাথায় রাখেননি। প্রত্যেক কানাডীয় আবেদনকারী ছিলেন শেতাঙ্গ কানাডীয় । আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি কেমন করে সিস্টার ম্যারি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন যাতে শিশুদের উপযােগী পরিবার খুঁজে মিলিয়ে দেয়া যায়; তিনি শুধুমাত্র একটি পরিবারের জন্য একটি শিশু খোজেননি। বরং তিনি খুঁজেছেন একটি শিশুর জন্য যথােপযুক্ত ও মানানসই একটি বাড়ি ও বাবা-মা। যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়ে তিনি নিশ্চিত করেন যে কানাডাতে যে কোনাে শিশুকে নিয়ে যে কোনাে বাড়িতে বা পরিবারে যাতে না দিয়ে দেয়া হয় । তিনি বিশ্বাস করতেন যে, লালন-পালনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি হলাে মা-বাবার মমত্ববােধ ও আদর-ভালােবাসা। এখানে বাবা-মা বা পােষ্যদের বর্ণ গৌত্র প্রাধান্য পায় না। দর দত্তক প্রকল্পের সাফল্য বর্তমান উত্তর আমেরিকায় দত্তক বিষয়ে যে [ার একটি প্রধান দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। আন্তবর্ণীয় দত্তক দেয়ানা সুফল রয়েছে বলা যায়, তা হলাে শিশুদের চিরতরে তাদের উৎস থেকে সাংস্কৃতিক গণহত্যা সাধন মাত্র। কিন্তু যুদ্ধশিশুদের আমরা স্পষ্টত দেখেছি সমাজের মূলস্রোত থেকে আবর্জনার মতাে সরিয়ে দেয়া শিশুদের একদল নাডীয় বাবা-মা পােষ্য হিসাবে নিয়ে আসেন। সেখানে ছিল আদর যত্ন। 1 মা-বাবা ও ভাইবোেন। বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে তাদের পুরাে তভাবে পাল্টে দেয়া সম্ভব হয়েছে। লাচনা এবং সংলাপে প্রায়শই প্রশ্ন উঠে আন্তবর্ণীয় দত্তক ব্যবস্থা নিয়ে।
শোষণ করেন যে কানাডীয় আদিম অধিবাসীদের (যাদেরকে নেটিভ কানাডীয় এ হয়) যেসব ছেলে-মেয়েদের কানাডীয় ককেশীয়দের (শ্বেতাঙ্গ) বাড়িতে সেসব আদিম অধিবাসী শিশুরা নিজেদের শ্বেতকায় ভেবে বড় হয়। কিন্তু এাংলাদেশি যুদ্ধশিশুরা শ্বেতকায় বাবা-মায়ের বাড়িতে লালিত-পালিত হয়েও এ সচেতনা ও অনুভূতিশক্তি নিয়ে বড় হয়েছে। শ্বেতকায় পােষ্য শিশুরা ডীয় সাধারণ মানুষের কাছে থেকেও অবহেলা ও তাচ্ছিল্য পেয়েছে, কিন্তু = ভাষ্যমতে সেরকম অবহেলার সম্মুখীন তারা কখনাে হয়নি। অথবা খনাে এড়িয়ে গিয়েছে, এরকম কোনাে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তারা হয়নি। =ত্রে এত কম যে কারাে পক্ষে শেষ কথাটি বলা সহজ নয়। আন্তবর্ণীয় মানসিক ক্রিয়াকর্মের গতিপ্রকৃতি বুঝতে হলে আরও ব্যাপক পরিসরে = প্রয়ােজন। বষণার নমুনা আকারে ছােট, বাংলাদেশ প্রকল্প-এর ফলাফল অনুসারে মাত লক্ষণ বিচারে পৃথক একটি শিশুর শারীরিক বৈশিষ্ট্য মিলের অভাব শিশুর বড় হয়ে ওঠা বাধাপ্রাপ্ত হবার কথা। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে সেরকম ঘটেনি। বাস্তবিকপক্ষে একেবারে শুরু থেকে সংবাদপত্রের খবর, য়েদের গৃহে বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের আগমন এবং এফ এফ সি’র = অধ্যায়ে বিধৃত) অত্যন্ত ইতিবাচক ছিল। আমরা দেখেছি ব্যাপারটা ন না যে, যুদ্ধশিশু তাদের মায়ের কোল থেকে টেনে এনে ভিন্নজাতের মাদেয়া হয়েছিল, যেমন ঘটেছিল মিস্রবণীয় ভিয়েতনামী শিশুদের বেলায়। চতুর্থ অধ্যায়গুলােতে দেখেছি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত খবরঃ কীভাবে র নিদারুণ ও শশাচনীয় অবস্থা থেকে উদ্ধার করে কানাডার উষ্ণ গৃহে মাদেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হয়তাে সংখ্যায় নেহাৎ অল্প হওয়ার কারণেই = দত্তক নেবার ব্যাপারটা তেমন বড় হয়ে ওঠেনি। যদিও ১৯৭০ সালের এশিয়ার নানা দেশ থেকে বেশ কিছু শিশু দত্তক নেয়া হয়েছিল । এর আরেকটি শােচনীয় দিক হলাে যে, এ উদ্যোগের ফলাফল একটি অসার প্রমাণিত করে, শিশুর চেহারা যদি তার বাবা-মায়ের মতাে না হয় তাহলে সে শিশুর আত্মসম্মানের ব্যাপারটা বিকশিত হতে জটিলতা দেখা দেয় । যুদ্ধশিশুদের বিবৃতি পড়ে আমরা যা জেনেছি তাতে John Triscliotis-এর In Search of Origin বইটি’র বক্তব্যের সঙ্গে সেগুলি বরাবর মিলে যায়। একই বিষয়ে আলাদাভাবে গবেষণা করে ট্রিসেলিওটিস রক্তের সম্পর্ক’-কে বাতিল করে বর্তমানে দত্তক নেয়া বাবা-মা পােষ্যদের বিবৃতির সারমর্মের বিষয়ে গুরুত্ব আরােপ করে বলেছেন যে, শিশুর উন্নয়নের জন্য জন্মদাত্রীর তুলনায় যত্নকারীর গুরুত্ব বেশি। ক্যাপুচিনাে দম্পতির সাথে হাত মিলিয়ে তাদের পছন্দের পােষ্যের জন্য তুমুল সংগ্রাম চালিয়েছিলেন তাতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, কানাডীয়রা ভালােবাসা ও সহমর্মিতায় বিশ্বাসী । ১৯৭২-এর সংবাদপত্রে যেভাবে যুদ্ধশিশুদের অসহনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, সেসব বর্ণনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে অধিকাংশ কানাডীয়রা যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও পরিত্যাগ করার ঘটনাকে বিয়ােগান্তক মনে করেন। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বলা যেতে পারে যে, ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাের নেতৃত্বে কানাডীয়দের যে দল বাংলাদেশে। যুদ্ধশিশুদের উদ্ধার করতে যান, তারা এক অভূতপূর্ব ইতিহাস গড়েন। ক্যাপুচিনােরা তখন যেরকম সহযােগিতা পান, তা অবিশ্বাস্য।
এ নিরিখে এটা বললে অতিশয়ােক্তি হবে না যে, ভিয়েতনামে অনাথ শিশুদের জন্য মমতায় যা করা হয়েছিল, সেটা এক সামাজিক বিপ্লবের রূপ নেয় যখন বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধশিশুরা এসে কানাডা পৌঁছে। ১৯৭০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে, গত ৩০ বছরে আন্তবর্ণীয় দত্তক দেয়া নেয়া একটি গ্রহণযােগ্য বৈশ্বিক ব্যবস্থার মতাে কানাডাতে প্রসার লাভ করেছে। এক্ষেত্রে তারা দত্তকগ্রাহী ও পােষ্যের জীবনের একটি সত্যকে উদাহরণসহ প্রতিষ্ঠিত করেছেন, মাতৃত্বের উৎস যেখানে, সে ভালােবাসা এবং যত্ন, যা কেবল সন্তান ধারণ করলেই হয় না । আরেকদিক দিয়ে এটাও বলা যেতে পারে যে, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে খুঁজে খুঁজে আন্তবর্ণীয় অনাথ শিশুসহ বাংলাদেশে অবহেলিত যুদ্ধশিশুদের কোলে তুলে নিয়ে তারা বাবামায়ের মায়াডাের ও স্নেহাশীর্বাদের এক জলন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করেন। কানাডীয় দম্পতিরা এটাই প্রমাণ করলেন যে শুধু সন্তান প্রসবই যে মা হওয়ার পস্থা তা নয়। বরং নিঃশর্ত স্নেহ আদর ও ভালােবাসা দিয়ে নানাবর্ণীয় ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে বাবা-মা পিতৃমাতৃত্বের দৃষ্টান্ত রাখতে পারেন। একদিক দিয়ে বিচার করলে আমরা কানাডা-বাংলাদেশ প্রকল্পকে দত্তকগ্রহী মা-বাবার সংকল্পরূপে দেখতে পারি। সেসব বাবা-মায়েরা চেয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের। সরকারকে কিছুটা স্বস্তি দিতে। কানাডীয়রা লক্ষ্য করেছিলেন কেমন করে বাংলাদেশি বুদ্ধিবৃত্তীয় নেতা থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞানীরা লাঞ্ছিত নারী ও পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের “সামাজিকভাবে” পঙ্গু বলেই আখ্যায়িত করেছিলেন । এমতাবস্থায় অন্তত কয়েকটি নিঃসহায় যুদ্ধশিশুদের উদ্ধারকাজে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। যদিও বাংলাদেশ প্রকল্প- টি একটি বেসরকারি উদ্যোগ ছিল, যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে নিয়ে আসার বিষয়ে বাংলাদেশ ও কানাডীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখেছি বাংলাদেশ ও কানাডীয় সরকার উভয়ই শুরু থেকে অবহিত ছিলেন যে, সংস্কারবদ্ধ বাংলাদেশিয় সমাজে আবহমান কাল থেকে দত্তক গ্রহণের বিষয়টি কখনাে পুরােপুরি স্থান পায়নি। সরকারের বিশ্বাস ছিল যে, জ্বরা, মৃত্যু ও শােক সকলের জন্যই অবধারিত ।
কিন্তু তবুও গুটিকয়েক নবজাত শিশুদের যদি বাংলাদেশের বাইরে নিয়ে আসা যায় হয়তাে তারা নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাবে । দুই সরকার সে লক্ষ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বিশেষ নজর রেখে ছিলেন কোনাে রকমের প্রশাসনিক জটিলতা বা আমতান্ত্রিক বিলম্বতা যেন না হয় । মুজিব এবং ট্রুডাে সরকারের কড়া নির্দেশ ছিল যে ইমিগ্রেশন এবং দত্তকগ্রহণের কাজ যেন আশু গতিতে করা হয়। লাইব্রেরি ও আর্কাইভ এর নথিপত্র ঘেঁটে আমরা জেনেছি, কানাডীয় সরকারকে সহযােগিতার দৃষ্টান্ত সম্পর্কে, যেমন- যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কানাডীয় নাগরিকের দল স্বদেশে রওয়ানা হবার পর, হংকং-এ কানাডীয় হাই কমিশনারের দপ্তরে কানাডীয় ইমিগ্রেশনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট Department of External Affairs এবং Manpower and Immigrationএর দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে নিম্নবর্ণিত বিষয়ে উপদেশ দেনঃ “আপাতদৃষ্টিতে অনাথ শিশুদের দেশত্যাগের আইনি ছাড়পত্র মিলতে দেরি হচ্ছিল এবং শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের ফলে কানাডীয় দল নির্ধারিত দিনে দেশে (কানাডা) ফিরতে পেরেছে । ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন সংস্থার কার্যকলাপের যে উচ্চ প্রশংসা আন্তজাতিক অঙ্গনে এ উপলক্ষে মিলেছে তাতে আর সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বাংলাদেশের জনসাধারণের এক বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখন থেকে কানাডাকে বিশেষ সমীহের চোখে দেখবে ।” (Library and Archives Canada. RG 76 Vol. 1237, File: 5850-2-710, pt.1.)। কথাগুলিকে বাগাড়ম্বর মনে হলেও এতে কানাডাবাসীর ভালােবাসা ও মায়া-মমতার কথা বুঝতে ভুল হয় না। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি যে এদের মধ্যে কোনাে দম্পতি ছিলেন অপ্রত্যহীন । কম বেশি সবার ঔরসজাত সন্তান ছিল । কিন্তু তবুও তারা আগ্রহ নিয়ে অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সদ্বিচ্ছা প্রণােদিত হয়ে যুদ্ধশিশুদের দত্তকগ্রহণ করেন। যুদ্ধশিশুদের কানাডা নিয়ে আসার ধারাবাহিকতা, পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের বেড়ে ওঠা কানাডীয় জীবন-বৃত্তান্ত আমাদের সত্যিকার অর্থে বিস্মিত করে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, প্রকল্পের সফলতা দত্তক নেওয়ার পক্ষে একটি উৎসাহব্যাঞ্জক উদাহরণ হিসাবে পরিগণিত হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে আমরা ধরে নিতে পারি যে, ক্ষুদ্রাকার হলেও যুদ্ধশিশুদের নিয়ে এ যৌথ উদ্যোগের সফলতা আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক গ্রহণ ব্যবস্থায় ইচ্ছুকদের অনুপ্রেরণার যােগান দেবে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই কানাডাতে দত্তক গ্রহণের পক্ষে গবেষণার তেমন বিস্তৃতি লাভ করেনি। এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যায় যদি আমরা আমেরিকাতে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক নেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টিপাত করি ।
সেখানে এ বিষয়ে গবেষণার ব্যাপকতা অনেক বেশি। বাংলাদেশ প্রকল্প- এর সাফল্য আরেকটি বিষয় প্রমাণ করেঃ যে কানাডা ও বাংলাদেশের সমাজে মানবসম্পদের ব্যাপকতর উপস্থিতি ও মান্যতাদান বৃদ্ধি করার সময় হয়েছে – হােক দত্তক নেয়া বাবা-মা ও পােষ্য ভিন্ন জাতের, সংস্কৃতির । পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম। অধ্যায়গুলােতে আমরা দেখেছি কানাডীয় দম্পত্তিরা যে অঙ্গীকার নিয়ে দত্তকায়িত শিশুদের লালন-পালন করেছেন, সেখানে তাদের মধ্যে কখনাে সম্পর্কের কোনাে ভাঙ্গন দেখা দেয়নি। আমরা পােষ্য এবং তাদের বাবা-মায়ের নিজ নিজ বিবরণীতে দেখেছি দত্তক ব্যবস্থাকে তারা দেখেছেন একটি প্রবাহমান প্রক্রিয়া হিসেবে। সেখানে ছিল না কোনাে আদর স্নেহ ও ভালােবাসার কমতি । এ সত্যকে ধরে নেয়া যেতে পারে যুদ্ধশিশুদের কাহিনীর সবচেয়ে বড় সাফল্য। যুদ্ধশিশুদের মধ্যে তিনজন বাদে ওদের পরবর্তী জীবনে স্বভাব চরিত্রে তেমন ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যায়নি। আমরা দেখেছি মার্টিনের লেখাপড়া শিখতে অসুবিধে হয়েছিল । রাজিব। সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগেছে, রানি বাই-পােলার ডিসঅর্ডারে ভুগে নিজের প্রাণ নিজেই নিয়ে নেয়। দত্তক বিষয়ে অবধারিত সাফল্য সচক্ষে দেখলেও বাংলাদেশে দত্তকপ্রথার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে এটি এমন এক বিষয় যেখান থেকে অসংখ্য সামাজিক ধাধার মুখােমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ প্রকল্পটি কানাডাতে নাটকীয় কার্যকারিতা দেখালেও এটি আন্তর্দেশিক, আন্তর্জাতিক এবং আন্তবর্ণীয় পােষ্য গ্রহণের যে প্রথা বিশ্বজুড়ে প্রচলিত, তার মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ। ঘূণেধরা। সমাজে বাংলাদেশে অনেকেই জন্মসূত্রে মা-বাবা হওয়া এবং আইনত দত্তকগ্রাহী মা-বাবা হওয়ার মাঝে বিস্তর পার্থক্য দেখেন । রক্তের সম্পর্কই দেখা যায় ইসলামি ও বাংলাদেশি সামাজিক সংস্কৃতিতে বড় ভূমিকা পালন করে উত্তরাধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে।
সাধারণ বাংলাদেশি সমাজের ধারণা, দত্তক নিলে এমন একটি সম্পর্কের সৃষ্টি হয় যা শারীরবৃত্তিক সম্পর্কের মতাে কিছুতেই নয়। আমরা দেখেছি মুজিব সরকার ১৯৭২ সালে International Social Service-এর সুপারিশের উপর ভিত্তি করে এটার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমরা দেখেছি সে সময়ে যখন যুদ্ধশিশুদের লালন-পালনের জন্য কোনাে বাংলাদেশি পরিবারই দায়িত্ব নিতে চাননি, তখন আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থাই সবচেয়ে উত্তম (বিকল্প) পন্থা হিসাবে গণ্য করা হয় । যদিও রক্তের সম্পর্ককে সাংস্কৃতিক বাধা দিয়ে ছিন্ন করা সম্ভব, বিশেষ করে যেসব শিশু সবদিক দিয়ে সমাজে পরিত্যক্ত, তবুও বাংলাদেশিরা মনে হয় না আন্তবর্ণীয় দত্তকের জন্য। প্রস্তুত । রক্তের সম্পর্ককে সাংস্কৃতিক বাধা দিয়ে ছিন্ন করা সম্ভব এবং পরিবর্তে দত্তক ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে যে প্রশ্ন প্রথমে ওঠে সেটা হলােঃ অন্য কারাে সন্তান নেয়ার দরকার কী? অতএব বাংলাদেশে পরিপূর্ণ সংসারের স্বাদ পেতে হলে শারীরবৃত্তিক সম্পর্কে যুক্ত একটি শিশুর মা-বাবা হতে হবে। পরিতাপের বিষয়, দত্তকগ্রহণের মাধ্যমে কোনাে পাতানাে সম্পর্কিত শিশুর বাবা-মা হওয়া বাংলাদেশ সমাজ ভালােভাবে দেখে না। বরং পুরাে বিষয়টাকে বক্র দৃষ্টিতে দেখে। বাংলাদেশে স্বামী-স্ত্রীর প্রেম, স্ত্রীর গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও সন্তান পালন হলাে সহজ সংসারচক্র। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক দত্তক দেয়া নেয়ার প্রথাকে কি উৎসাহিত করা উচিত? প্রশ্নটা বােধকরি জোরদার হয় যখন জিজ্ঞাসা করা হয়ঃ বাবা-মা হতে গেলে দম্পতির জাতিভিত্তিক উপযােগিতা কি আর বিবেচিত হবে না? এ রকমও জিজ্ঞাসা করা যায়ঃ দত্তক নেয়া বাবা-মা | এবং বিভিন্ন জাতের দত্তক ছেলেমেয়েদের মধ্যে সন্তোষজনক ব্যক্তিগত সম্পর্ক সৃষ্টির সুযােগ করে দেবার সময় হয়েছে কি? এ কথা সত্যি যে, গ্রহণযােগ্য একটি বক্তব্য দাঁড় করানাের পক্ষে বর্তমান তথ্যের নমুনা খুবই অপ্রতুল। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলাদেশ প্রকল্পের ইতিবাচক ফলাফল ও তার | সফলতার প্রমানের জন্যই দত্তক নেয়া-দেয়ার এজেন্সি এবং দত্তক ব্যবস্থার সমর্থন করে সেসব সংঘ ও ব্যক্তিবর্গের সাথে সরকারের সংলাপের প্রয়ােজন। একমাত্র সংলাপের। মাধ্যমেই সরকার ও দত্তক সমর্থনকারীদের আর্ন্তজাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক ব্যবস্থার বিষয়ে একে অন্যের সম্মুখীন হওয়া উচিত। বর্তমান প্রকল্পের সাফল্য হয়তাে এরকম বড় নীতিসংক্রান্ত প্রশ্নকে উপরে নিয়ে আসবে: কানাডা ও বাংলাদেশ কী আরও বেশি বেশি আন্তর্দেশিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক বিষয়ে কাজ করবে? ধরে নেয়া যেতে পারে যে এ বিতর্কের ডানে, বাঁয়ে ছােটাছুটি চলবে ।
শেষ পর্যন্ত হয়তাে প্রশ্ন করবে কেউ: বাংলাদেশে দত্তক প্রথার আন্তর্জাতিকীকরণ কীভাবে সম্ভব? পরিশেষে বাংলাদেশ প্রকল্পের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণে আমরা আত্মবিশ্বাসী যুদ্ধশিশু আমিনার | প্রণিধানযােগ্য একটি উক্তি স্মরণ করতে পারি। আমি নিজে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা কানাডীয় বাড়িতে উষ্ণ আদরে লালিত-পালিত হওয়ার সৌভাগ্যকে দেখে ভিন্ন | দৃষ্টিতে । তৎকালীন কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী পিয়ের এলিয়ট ট্রুডাে নানা জাতি ও সংস্কৃতির মানুষকে নিয়ে যে কানাডার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তেমনি যুদ্ধশিশুরাও যেন এক টুকরাে স্বপ্নের মধ্যেই বড়াে হয়ে উঠেছে কানাডার মাটিতে। “ট্রুডাে স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আমি ঐ স্বপ্নের একটি অংশ ছিলাম,” (আমিনা লেখককে ই-মেইল পাঠিয়েছিলেন, ২ অক্টোবর, ২০০৯)। আমিনার মতে, বহুজাতীয় ও বহুসংস্কৃতির কানাডা একটি অলীক কল্পনা ছিল না; সেটা ছিল টুডাের স্বপ্ন যার বাস্তবায়ন হয়েছে ১৯৭০ দশকের শেষেই যখন কানাডীয় মাল্টিকালচারালিজম এর উপর ভিত্তি করে বিশদভাবে বিস্তৃতি লাভ করে কানাডীয় সমাজ। উপরের উক্তিটি আমিনা ব্যক্ত করেছিল তার নিজের জীবন এবং নানা পটভূমি থেকে আসা ভাইবােনদের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কেমন করে তাদের তাদের বাবা-মায়েরা লালন-পালন করেছেন, তাদেরকে ভালােবেসেছেন, তাদেরকে স্নেহ আদরে মানুষ করেছেন। তবু অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের জীবনবৃত্তান্ত যেন প্রতিফলিত হয় আমিনার এ চমৎকার উক্তির মধ্যে। মনে হয়, আমেনা যেন ওদের সবার পক্ষে সবার কথা বলছে। যখন আমিনা বলে, “আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের যে ভিত গড়ে দিয়েছেন, যার ওপর ভর দিয়ে এখন | আমরা সামনে এগােচ্ছি, আমাদের প্রত্যেকের মুক্তির পানে,” (আমিনা উলসির গবেষণাপত্র, পৃ: ৬৮) তখন আমাদের কাছে মনে হয় আমিনাই যেন তাদের সবার মুখমাত্র । যেন আমিনা। অন্য সকল যুদ্ধশিশুর কথা বলছে যারা ১৯৭২ সালে একসাথে কানাডা এসেছিল। সংক্ষেপে, এ যৌথ বাংলাদেশ প্রকল্পটি আমাদের কালের সবচেয়ে মানবিক প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে একটি, যেখানে একদল সাধারণ কানাডীয় নাগরিক যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে কয়েকটি অনাথ শিশুকে কানাডাতে নিয়ে নিজেদের গৃহে মানুষ করার সংকল্পে বাংলাদেশে আসেন। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি কেমন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে সরকারের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় কয়েকজন যুদ্ধশিশুকে নিয়ে গিয়ে নানা সমস্যা স্বত্ত্বেও তাদের নিজের পছন্দের ১৫ জন শিশুকে নিজ গৃহে আশ্রয় দেন। কানাডীয় বাবা-মায়ের বাড়িতে এসব শিশুরা তাদের জীবনের শুরু থেকে শেখে যে তারা নিজ নিজ দত্তকগ্রাহী পরিবারের সন্তান, তাদের সকলেই নানাবর্ণীয় মানুষ, তারা একই পরিবারের সদস্য ।
যে দেশে ঐ শিশুরা জন্মগ্রহণ করেছিল, সেখানে তাদের কোনাে জায়গা হয়নি; তারা আশ্রয় পেল ১২ হাজার কিলােমিটার দূরের দেশ কানাডাতে। নিঃসন্দেহে এফ এফ সি স্বেচ্ছাসেবকেরা দত্তক শিশুদের নির্ঘাৎ মৃত্যুর হাত থেকে তুলে এনে তাদেরকে নতুন করে বাঁচার এক সুযােগ করে দিন – তাদের জীবনে একটি অন্যমাত্রার তাৎপর্য যােগ করে দিতে সমর্থ হয়েছেন। অন্যভাবে বলা যায়, যুদ্ধশিশুরা প্রথম থেকেই গৃহ পায়, ভাইবােন পায়, আর পায় অপরিমিত স্নেহ। প্রামাণিক উপাদানের সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার দরুন যুদ্ধশিশুদের জন্মের ইতিহাস ও জীবনবৃত্তান্তের যে অজ্ঞাত দিক রয়েছে সেদিকটা হয়তাে থেকেই যাবে। তবুও কানাডাতে দত্তকায়িত ১৫টি যুদ্ধশিশুর বিষয়ে বিরল ঐতিহাসিক প্রামানিক দলিলপত্রাদি পরীক্ষা এবং প্রকৃত যুদ্ধশিশু ও তাদের দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের নিজ নিজ বিবৃতির উপর ভিত্তি করে বর্তমান গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল সন্নিবেশিত করেছি। যুদ্ধশিশু ও তাদের বাবা-মায়েরা অভিজ্ঞতা। সম্পর্কে যা বলেছেন সেগুলাে আমি অনুলিখনের চেষ্টা করেছি।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর-এর কয়েক মাস আগে অনেকের কর্ণগােচরে আসে একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্বাক্ষ্য দিয়েছে ‘৭১-এর এক যুদ্ধশিশু, হবিগঞ্জস্থ শামসুন নাহার। তার সাথে ছিলেন তার জন্মদাত্রী মা বীরাঙ্গনা মাজেদা বেগম যিনি নিজেও সাক্ষ্য দেন। যেহেতু সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া এবং পরিচলনা বিচারকের একান্ত কক্ষে (in camera) নেয়া হয়, সেসবের তথ্যাদি সাধারণ মানুষের জ্ঞানগােচরে আসেনি। যা হােক, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে বাংলাদেশের লােক সংবাদ মাধ্যমে প্রথমবারের মতাে জানতে পারে চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান-এর দেয়া মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে দন্ডিত মােহাম্মদ কায়সার-এর রায় । রায়টি তিনি ‘৭১-এর বীরাঙ্গনাদের উৎসর্গ করেছেন। এ রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে যে, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে এসব নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা দেশের জাতীয় বীর।” রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে বিচারপতি হাসান ধর্ষণের শিকার নারী ও যুদ্ধশিশুদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলাের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি একইসাথে বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান” বলে আখ্যা দেন। নিঃসন্দেহে এই আশাবাদ ব্যক্ত করা যেতে পারে যে, যদি সত্যি সত্যি সরকারি বা বেসরকারি কোনাে প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে উদ্যোগ নেন, হয়তাে বা অপরিচিতির আড়াল থেকে লুকিয়ে থাকা। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা এত বছরের সামাজিক নিশ্ৰুপতা ভেঙে এগিয়ে আসবে জনসম্মুখে ।