কানাডাতে বেড়ে ওঠা যুদ্ধশিশু
যেসব বাড়িতে কানাডীয় যুদ্ধশিশুরা বড় হয়েছে সেসব বাড়িতে প্রায় প্রত্যেকেরই আন্তবর্ণীয় ছেলেমেয়ে ছিল যাদের অনেকের আগমন হয়েছিল তাদেরই মতাে দত্তকের মাধ্যমে। এ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাবাে কেমন করে বড় হবার বছরগুলােতে দত্তকগ্রাহী বাবা মায়ের বাড়িতে বহুজাতিক আবহ যুদ্ধশিশুদের জন্য স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল। আমরা জানতে পারব কীভাবে তাদের জীবনে সেগুলাের উন্মেষ ঘটেছিল। যুদ্ধশিশুদের নিজ নিজ বিবৃতি থেকে আমরা এও জানব কেমন করে তাদের বাবা-মায়েরা তাদের লালন পালনের মাধ্যমে আবেক, প্রকৃতি এবং পরিচিতির জন্ম দিয়েছিলেন তাদের জীবনে। আমরা দেখতে পাবাে এসব যুদ্ধশিশু বাড়ি ও মা-বাবা বলতে কানাডাকেই তাদের বাড়ি এবং কানাডীয় শ্বেতাঙ্গ বাবা-মাকেই তাদের বাবা-মা হিসাবে গণ্য করে । বিভিন্ন পদ্ধতিতে নেয়া (যেমন, সরাসরি মুখােমুখি বসে, টেলিফোনে এবং চিঠি ও ই-মেইলের। মাধ্যমে) সাক্ষাঙ্কারগুলাে শব্দান্তরিত করার পর এরকম ছিলঃ
১, বয়ঃসন্ধিকালে তাদের পরিবারে তাদের অবস্থান বা উপস্থিতি কতটুকু ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বিত ছিল বলে মনে হয় তাদের কাছে? এখন বয়ঃপ্রাপ্ত হবার পর তারা কি রকম অনুভব করছে? তাদের শ্বেতাঙ্গ মা-বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের স্বরূপ কেমন?
২. মা-বাবা যেখানে শ্বেতাঙ্গ এবং ভাইবােনদের অনেকেই বহুজাতিক, সে ক্ষেত্রে জাতীয়তা ও নৃতাত্ত্বিক বংশধারাভিত্তিক পরিচিতির বিষয়ে তারা কী ভাবে? ৩, তাদের ভিন্ন জাত বা উৎসের নৃতাত্ত্বিক পার্থক্যের কারণে কি তারা কখনাে বিদ্দিষ্ট
আচরণ বা ব্যবহারের মুখােমুখি হয়েছে? হয়ে থাকলে সেটা কী ধরনের ছিল? তাদের আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তারা তাদের জীবনের ইতিহাসকে কীভাবে দেখে ? কোন্ সংস্কৃতিতে তারা নিজেদেরকে সংশ্লিষ্ট বা একীভূত মনে করে? বাড়ি বলতে
তারা কোন্ দেশকে গ্রহণ করে? এ সাক্ষাৎকারগুলাে অনেক বছর যাবত একটি একটি করে কখনাে বা একটু একটু করে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই লেখকের সঙ্গে তাদের কয়েকবার সাক্ষাৎকারের প্রয়ােজন হয়েছে। পােষ্যরা খুশিমনে লেখককে তার কাজে সহায়তা করেছেন, আগ্রহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেছেন। সাক্ষাৎকারগুলাে অনানুষ্ঠানিক ছিল, মা-বাবা।
অনেক ক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন, আবার কখনাে বা ছিলেন না। সাক্ষাঙ্কারগুলাে থেকে আমরা যেসব উপস্থাপনযােগ্য তথ্যাবলি পেয়েছি, সেগুল আমরা দুটি প্রধান ভাগে উপস্থাপন করবাে:
১. দত্তক নেয়া শিশুদের জীবনের প্রথম বছরগুলাে;
২. তাদের অতীত ও বাংলাদেশ (তাদের জন্মদেশ) সম্পর্কে জানার ইচ্ছা;
৩. তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ও আত্মীয়তা;
৪. বাংলাদেশে প্রথমবার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা;
৫. তাদের জাতীয় এবং কানাডীয় আত্মপরিচয়; এবং ৬, কানাডাতে বর্ণবৈষম্যের কোনাে অভিজ্ঞতা আছে কিনা
প্রথম বছরগুলাে
যুদ্ধশিশুদের সকলেরই জীবনের প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা ও আবেগসমূহ একই ধরনের ছিল বলা যায় । ওরা সকলে যার যার দত্তক পরিবারের ইতিবৃত্ত, ধর্ম, রীতিনীতি, মূল্যবােধ, ন্যায়নীতি সম্পর্কে জেনেছে । নিজ নিজ কমিউনিটিতে নিজের অবস্থান জেনেছে বা তৈরি করেনিয়েছে কোনাে ধরনের বাধা ছাড়াই। ওদের মা-বাবা প্রথম দিকে চেনা জানার বিষয়ে তাদের পথ-প্রদর্শক ছিলেন। সে সময়ে তারা নিজেরা যতদূর সম্ভব নির্দেশনা ও আবেগ সহায়তা নিয়েছেন যাতে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধকে ঘিরে তাদের জন্ম, পরিত্যাগ এবং দত্তকগ্রহণের বিষয়টি সব দিক দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয় । যেন তারা তাদের কানাডীয় জীবনযাপনের শুরুতেই ঐতিহাসিক সত্যগুলাে সম্পর্কে অবহিত থাকে। এ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাবাে বাবা-মায়েদের প্রতি যুদ্ধশিশুদের শ্রদ্ধাবােধ ও গভীর ভালােবাসা তাদের নিজের বর্ণনা থেকে; কেমন করে তাদের বাব-মারা বাংলাদেশ থেকে নান। বাধা-বিপত্তি পার হয়ে তাদেরকে কানাডাতে নিয়ে আসেন। প্রথম বছরগুলাের দিকে। আলােকপাত করতে গিয়ে সবাই মনে রেখেছে তাদের কানাডীয় পরিবারে একে অন্যের প্রতি। শ্রদ্ধাশীল হওয়ার উপদেশ। তাদেরকে শেখানাে হয়েছিল কারাে জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মায়ের পরিচয় না জানলেও একজন মানুষকে মানুষ হিসাবে জানতে হবে, তাকে উপযুক্ত সম্মান দিতে হবে। যুদ্ধশিশুদের নিজস্ব ভাষ্যমতে, যতদুর তারা মনে রাখতে পেরেছে সেটার ওপর ভিত্তি করে তারা তাদের স্মৃতিচারণে উল্লেখ করে যে তাদের বাল্যকাল আরও দশটি পরিবারের মতােই সাধারণভাবে কেটেছে, যদিও তারা তাদের দুর্বিপাক অতীত সম্পর্কে জানত। আমাদের সাক্ষাঙ্কারগুলােতে “togetherness” শব্দটি কয়েকবার ব্যবহার করা হয়েছে এ অর্থে যে শৈশবে তারা দত্তক পরিবারে সমর্থন, আদর, অন্তরঙ্গতা এবং একে অন্যের জন্য। ভালােবাসা কেমন পেয়েছিল।
পেছনের দিকে তাকিয়ে ওরা সবাই এক বাক্যে বলে যে তারা তাদের বাবা-মা ও ভাইবােনদের আপনজন ভেবেই বড় হয়েছে। ছােটবেলাতেই তারা উপলব্ধি করে যে তারা নানা বর্ণীয় হলেও তারা তাদের বৈচিত্রময় পরিবারেরই একজন। সদস্য, যেখানে তাদের বাবা-মায়েরা শ্বেতকায়, কিন্তু ভাইবােনরা কেউ বা শ্বেতকায়, কেউ বা কৃষ্ণকায়, আবার কেউবা আন্তবর্ণীয় । তারা তাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে বড় হয়ে ওঠাকে সবসময়ই দেখেছে আদি, অকৃত্রিম এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবারের একটি সহযাত দিক। তাদের প্রথম জীবনের স্মৃতিচারণে তাদের মনে পড়ে স্কুলের বন্ধু ও খেলার সঙ্গী খোঁজার কথা । তারা সেটা বেশ পরিষ্কারভাবে মনে রেখেছে যে সাধারণ পারিবারিক রীতিনীতি মূলত কানাডীয় সংস্কৃতির অনুসরণ ছিল। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করে তারা মনে করে ত্বকের রং এর উপর ভিত্তি করে তারা কখনাে বন্ধুত্ব করতে যায়নি। যুদ্ধশিশুরা যেহেতু জাতিগত বিচারে অন্ধ ছিল, সম্পর্ক স্থাপনে এটা তাদের পক্ষে সহায়ক হয়েছে কানাডীয় জীবনে বিচিত্র কানাডীয়দের সাথে মিশতে এবং একসাথে কাজ করতে ।
অতীত এবং জন্মদেশ সম্পর্কে জানার বাসনা
যতদুর মনে করতে পারে, যুদ্ধশিশুরা “দত্তক” শব্দটির সাথে পরিচিত ছিল একদম ছােট বেলা। থেকেই । অবশ্য দত্তক শব্দের অর্থ কী, সেটা পূর্ণ অর্থে অনুধাবন করতে তাদের অনেকদিন লেগেছিল। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি যেসব পরিবার বেশিরভাগ দত্তক পরিবারে একাধিক শিশু লালিত পালিত হয়েছে। ক্রিস বুনস্ট্রার কথাই ধরা যাক। ক্রিস অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের মতােই ছেলেবেলা পার করেছে। কিউবেক প্রদেশের একটি ছােট শহরে ক্রিস। বড় হয়েছে। তার পরিবারে সাতটি ছেলেমেয়ের মধ্যে পাঁচজনই বাইরে থেকে এসেছে দত্তকায়নের মাধ্যমে। ক্রিস বলে যে, সে ছেলেবেলা থেকেই জানত যে তাকে তার বাবামায়েরা দত্তকের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসেন। তবে সে ঠিক মনে করতে পারে না কবে সে জানতে পেরেছিল দত্তক শব্দের অর্থ কী। ছেলেবেলায় তার নিজস্ব ইতিহাস বিষয়ে তার অনেক প্রশ্ন ছিল। অধিকৃত বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কীভাবে তার জন্মদাত্রী মা তাকে গর্ভে ধরেছিলেন। সে নির্মম কঠোর সত্য বিষয়ে তার দত্তক নেয়া মা-বাবা তাকে একটি ঐতিহাসিক বিবরণ শুনিয়েছিলেন । তার উৎস সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার মনে পড়ে, তার মা-বাবা অসংখ্যবার ব্রিতকর অবস্থায় পড়ে যেতেন। বিশেষ করে যখন সে খুবই ছােট ছিল। তার মা-বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাকে বােঝাতে যে তার জন্মের ইতিহাস এবং জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মা সম্পর্কে জানলেই যে অভ্যন্তরীণ শান্তি অথবা নিরাপত্তা নিশ্চিত। হবে, এমন কথা নেই।
যুদ্ধশিশুরা যখন বড় হয়ে তাদের জটিল পরিচিতি নিয়ে ভাবতে শুরু করে তখন বুঝতে পারে যে আপাতদৃষ্টিতে আত্মরিবেধী বলে মনে হলেও মূলত বিষয়টি সত্যবিরােধী নয় । যখন তারা কঠিন বাস্তবের মুখােমুখি হয় তখনই হৃদয়ঙ্গম করে যে তাদের জন্য অতীত জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা তখন ঐটুকু উপলব্ধি করে যে বংশানুপাত বিষয়ক জ্ঞানের সাথে অপেক্ষকৃতভাবেও যুক্ততা রয়েছে যা তাদের বােঝা উচিত। কিন্তু শুরু থেকে তারা এটাও বুঝতে পারে যে তারা এ বিষয়ে বিশেষ দূরে কখনাে এগুতে পারবে না। পরিণত বয়সে পৌছানাের আগেই তারা জানতে পারে যে তাদের জীবনের মৌলিক নথিপত্রের অভাব।
রয়েছে। সে জন্য তারা সে বিষয়ে সবসময়ই সচেতন ছিল । তারা জানে তাদের অনেকের জন্ম হয়েছে ঢাকাস্থ শিশু ভবনে একান্ত গােপন অবস্থায়। তারা এটাও জানে যে যাদের জন্ম হয়েছে শিশু ভবনের বাইরে অন্য কোথাও, তাদেরকে জন্মের পরপরই কে বা কারা শিশু ভবনে ছেড়ে দিয়ে যায় কোনাে তথ্য ছাড়াই । কানাডাতে পাঠানাের আগে মিশনারিজ অব চ্যারিটির কর্তৃপক্ষ কোনাে ধরনের তথ্যই সরবরাহ করতে পারেননি। আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে দেখেছি অনাথ আশ্রমে কীভাবে নবজাতকদের জন্ম সংক্রান্ত তথ্য বা নথি তৈরি করা হয়েছিল, তবে চিকিৎসা বা বংশগত বিষয়ক কোনাে তথ্যই সেখানে ছিল না। তারা জীবনের প্রারম্ভেই জেনেছিল যে তারা ছিল “অপ্রার্থিত” যুদ্ধশিশু কাজেই তাদের অনন্য জন্মবৃত্তান্তে বেশি কিছু তথ্য নেই । অল্প বয়সে তারা জেনেছিল যে, যেহেতু তাদেরকে “অবাঞ্চিত” হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল, তাদের বিষয়ে সমাজে কেউ কোনাে আগ্রহ নেননি। সত্য বলতে কি, তারা এও জেনেছিল যে “অবাঞ্চিত শিশুরা যেমন অনাদৃত ও অবহেলিত, তেমনি তাদের গর্ভধারিণী মায়েদেরকেও বাংলাদেশের লােকেরা ঝালে ঝােলে অম্বলে সমাজ থেকে দূরে রেখেছে। দুটি ব্যাপারই নৈতিকতার বিচারে বিস্বাদ মনে হয়েছিল বাংলাদেশিদের মন মানসিকতায়। অতএব এরা। ছিল অবশ্য বর্জনীয়। পেছনের দিকে তাকিয়ে যুদ্ধশিশুরা এখন আরও দৃঢ়তার সাথে মনে করে যে, সে সময়ে বিষয়টি তাদের জন্য খুব কষ্টকর, এজন্য তাদের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে জানার কোনাে রকমের তথ্য কোথাও প্রাপ্তব্য ছিল না যেখান থেকে তাদের পরিত্যাগের ইতিহাস জানা সম্ভব হতাে। বয়ঃসন্ধিকালে ইতােমধ্যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প পড়ে এবং জেনে, যুদ্ধশিশুরা যতটুকু অনুধাবন করতে পেরেছিল সেটার ওপর ভিত্তি করেনিজেরা তাদের জন্মবৃত্তান্তের একটি অতীত ঘটনার বিবরণ (যেটাকে দত্তক জগতে ইংরেজিতে বলা হয় storyline) থেকে একটা কাহিনী কথন তৈরি করে। সেটা ছিল এরকমঃ আধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ধর্ষণের শিকার, যৌন সহিংতার শিকার এক নারী গােপনে সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন । শিশুর জন্ম যেহেতু কলঙ্কময় মা নিজেই নিজের প্রাণ নিয়েছেন। যদি সে মা আত্মহত্যা নাও করে থাকে, সে তার আপন পরিচয় লুকিয়ে অন্য পরিচয়ে জীবনধারণ করছে। জন্মদাতা ধর্ষণকারী বাবা তিন বছর যুদ্ধবন্দি হিসাবে ভারতে কাটিয়ে ছাড়া পেয়ে পাকিস্তানে ফিরে যান।
অবাক হবার কিছু নেই, অনুপস্থিত বাবা সম্পর্কে তাদের মনােভাব তাচ্ছিল্যপূর্ণ। তাদের জন্মবৃত্তান্তের প্রেক্ষাপটের আলােকে যুদ্ধশিশুরা শুরুতেই বুঝতে পারে যে জীবনে কখনাে তাদের ত্রিমুখী পুনর্মিলন (দত্তকায়িত শিশু, তার পােষ্য মা-বাবা এবং জন্মদাত্রী মা) হবে না। এখানে ঘটনাগুলাে এরকম যে পুনর্মিলনের কোনাে সম্ভবনা বা সুযােগ ইতিহাস রাখেনি । দত্তক জগতে সাধারণত ধরে নেয়া হয় যে খোঁজাখুঁজি এবং পুনর্মিলন এমন একটি ধারণা যার ঘােরে বয়ঃসন্ধিকালে অনেক পােষ্যই তাদের মনকে অতিষ্ঠ করে রাখে। সাধারণত কানাডাতে বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত দত্তক শিশুর দলিলাদি গােপনীয়তার সাথে রাখা হয় । কিন্তু বর্তমান গ্রুপের কানাডীয় দত্তকগ্রাহী মা-বাবা তাদের শিশুদের জন্ম ইতিহাস লুকিয়ে রাখেননি। বাবা-মায়েরা যুদ্ধশিশুদের উৎসাহ দেবার চেষ্টা করে সবসময় বলেছেন তারা বাংলাদেশে গিয়ে দেখতে পারে, জানতে পারে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ এবং যুদ্ধশিশুদের জন্মকে ঘিরে যে সব নৃশংস কাহিনী, সেগুলাে তারা জানুক, এটাই বাবা-মা চেয়েছিলেন। যেহেতু জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে আর কোনাে তথ্যাদি নেই, সেজন্যই যুদ্ধশিশুরা সাধারণত কোনাে বাঁধনহারা কল্পনায় কখনাে অভিনিবেশ করেনি যে ভবিষ্যতে তারা কোনাে একদিন তাদের বাংলাদেশি মা-বাবার সঙ্গে পুনর্মিলন হবে। বয়ঃপ্রাপ্তি হতে হতে বেশিরভাগ যুদ্ধশিশু তাদের জন্মবৃত্তান্ত জানতে বা শুনতে আগ্রহ দেখায়নি। ১৯৮৯ সালে রায়ান, ল্যারা, রাজিব, আমিনা এবং রানী বাংলাদেশে গিয়েছিল, যেখানে তারা তাদের জন্মবৃত্তান্তের যা জানত সেসবের সত্যতা যাচাই করতে পেরেছে। তাদের প্রতিক্রিয়ার বিশদ বর্ণনা বর্তমান অধ্যায়ে “যুদ্ধশিশুদের প্রথম সফর নিজের জন্মদেশে” উপশিরােনামে বিধৃত হয়েছে। বাংলাদেশের যে অনাথ আশ্রম থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়েছিল, সে আশ্রমটি তাদের স্বচক্ষে দেখার সুযােগ হয়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তারা উপলব্ধি করেছিল যে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের লোেকদের চেহারার মিল থাকলেও সংস্কৃতির অমিল ছিল ব্যাপক। ল্যারা মরিস অন্টেরিও প্রদেশের ব্র্যাম্পটন শহরে বড় হয়েছে। পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে তিনজনই দত্তক নেয়া। সে বাংলাদেশের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত ভাবলেও সে জানে যে তার জন্মের শিকড় এখন কোথাও সে খুঁজে পাবে না। বিবরণ যেমন সমানে এগােয় ল্যারাও তার জন্মবৃত্তান্তের দুটি সংস্করণ সম্পর্কে জানতে পারে ঐতিহাসিক বৃত্তান্তেঃ পাকিস্তান সৈন্যদের ডুবন্ত ভেঙে চুরে যাওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ছােট যুদ্ধ জাহাজ থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছিল; অথবা, গর্ভধারণের মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই তার মা তাকে প্রসব করেই প্রাণ হারান।
বুদ্ধিমতী ল্যারা তার জন্মকাহিনী দুটির একটিরও সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা না করে। দুটোই গ্রহণ করে – হয়তাে সে ভগ্নপ্রায় নৌবাহিনীর জাহাজে পড়েছিল; অথবা শিশু ভবনের সুপিরিওর সিস্টার মার্গারেট ম্যারি তাকে উদ্ধার করেছিলেন। তাকে বলা হয়েছে কেন কোথায় এবং কীভাবে তাকে নদীতে ফেলে দিতে এসেছিলেন তার পরিবারের কেউ। সিস্টার ম্যারি নিজেই তার বাবা-মাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন ল্যারাকে কুড়িয়ে পাওয়ার ঘটনাটি । শুধু তাই নয়, কখন এবং কী অবস্থায় যুদ্ধশিশুদের জন্ম হয় সেটাও জানিয়েছিলেন। তাদের পরিত্যাগ ও উদ্ধার ঘিরে নানা ধরনের গল্প কাহিনী ইত্যাদি সিস্টার। ম্যারি উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন যে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে তখন নানা ধরনের গল্প তৈরি করে। যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে কলঙ্ক লেপন করা হচ্ছিল। তার জন্মবৃত্তান্তের ব্যাপারে ল্যারা খুব সহজভাবে অকপটে বলে যে, তার জন্ম হয়েছে কোথায় বা কীভাবে ওতে কিছু যায় আসে । তার জীবনের শুরু থেকে যাদেরকে তার মা-বাবা হিসাবে জেনে আসছে (শ্বেতকায় ডরােথি ও জন) তারাই তার প্রকৃত মা-বাবা। সে আর অন্য কোনাে বাবা-মাকে জানে না। খােলাখুলি স্বভাবের ল্যারা একদম নির্দ্বিধায় বলে: “সত্যি বলতে কি, এতগুলি বছরে আমি আসলে কখনাে আমার অতীত নিয়ে ভাবিনি। আমার জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবা বাংলাদেশে ফেলে আসলেও আমি কখনাে তাদের কাউকে খুঁজে বের করার চেষ্টাও। কোনােদিন করিনি। কথাটি ল্যারা আরও একটু পরিষ্কারভাবে বলে: “আজ পর্যন্ত আমি আমার পরিবারের উৎস অনুসন্ধান করার কোনাে চেষ্টা করিনি এবং নিকট ভবিষ্যতেও আর করব বলে মনে হয় না। “এমনকি যদি আমার শিকড় খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়ও, আমি জানি না কোথায় শুরু করব” বলে এ বিষয়ে অনেকটা অপ্রস্তুত ল্যারা ! সে ভয় পায় যে সত্যি সত্যি তেমন হলে এসব নিয়ে চিন্তা করার মতাে নানা বিষয় রয়েছে। আমার বংশানুগতি সম্বন্ধীয় ইতিহাস আমি। জানতে চাই, যার কাছ থেকে আমি আমার ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পেয়েছি, সেটা। জানতে চাই; সে যা হােক, আমার মনে হয় না আমি আমার জীবনের এ পর্যায়ে এসে আমার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারব।” আমিনা উলসি যে মেয়েটি অন্টেরিওর লন্ডন শহরের কাছে কোমাকায় বড় হয়েছিল তার। আরও পাঁচ ভাইবােন সবাই উলসি পরিবারে এসেছে দত্তকের মাধ্যমে, এ পর্যন্ত দুবার বাংলাদেশে গিয়েছে।
প্রথমবার ১৯৮৯ সালে যখন ওর বয়স ১৬ বছর এবং দ্বিতীয়বার ২০১০-এ। সে তার অবস্থান দেখে এভাবেঃ “পেছনে তাকালে আমি বলব উত্তরাধিকার, ভাষা এবং সংস্কৃতি বিষয়ে তেমন কিছু জানতাম না। যদিও আমার মা-বাবা আমাকে সে সব বিষয়ে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছেন। আমিনা আরও বলে, “আমার জীবন দর্শন এরকমঃ অতীত গিয়েছে অতীতে ডুবে, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ হলাে আমার পছন্দের বাঁচবার সময় ও জায়গা।” “অনাথ আশ্রমের ওই অত ছেলেমেয়ে থাকতে আমাকে কেন? আমাকে কেন বাঁচানাে হলাে?” চিন্তান্বিত আমিনা অনেকবারই এ প্রশ্নটি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছে। উত্তর পেয়ে আমিনা এখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে, যদি কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে কী করে কী হলাে! অনেক বছর পর একবার ঠান্ডা মাথায় বসে আমিনা অতীতের স্মৃতি রােমন্থন করে তার মাবাবার কাছে যা শুনেছিল তাই সে এভাবে ব্যক্ত করেঃ “আমার শুরু খুবই সাধারণভাবে। হয়েছিল ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছিল। আমি যুদ্ধাবস্থায় মায়ের গর্ভে বড় হই।” আমিনা আরও বলে, “মাদার তেরেসার অনাথ আশ্রমে ১৯৭২ সালে আমাকে পাঞ্জাবি। নাম আমিনা খার্তুম দেয়া হয়েছিল, আমিনা অর্থ মূল্যবান রত্ন ।” যে নারী তার জন্ম দিয়েছিলেন, তার বিষয়ে আমিনা কিছুই জানে না, তবে সে বলে, “তিনি হয়তাে খুবই অল্প বয়সী ছিলেন।” কথাগুলাে শান্ত, ধীর, স্থির আমিনার মুখে শুনে মনে হয় আবেগ উৎসের ওপর যেন তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। রায়ান গুড় অন্টেরিওর এগজেটার শহরে বড় হয়েছে। ওর আরেক বােন আছে যাকে রায়ানের বাবা-মা দত্তকায়নের মাধ্যমে নিয়ে আসেন বাংলাদেশ থেকে। সে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলে বহু বছর আগে বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে সে তার মাকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল সেটা অনেকটা ছিল এরকমঃ “মম আমি তামাটে রংয়ের আর তুমি ও ড্যাডি সাদা কেন?”১২ কোনাে সন্দেহ নেই, এক সােজা সরল শিশুর সাদাসিধে প্রশ্ন, কিন্তু দেখতে যেমন সােজা তার উত্তরটা তেমন নয় কেন? ছােটবেলার কথা স্মরণ করে রায়ান বলে সে সময়ে তার মা হয়তােবা উত্তর দিয়েছিলেন এভাবে, “তুমি বাংলাদেশে জন্মেছিলে, আর মমি ও ড্যাড কানাডাতে। হয়তাে অবশ্যম্ভবী বা সেটা আন্দাজ করে তার মা ছবির বই বের করে এনেছিলেন যেটা তিনি ইতােমধ্যে তৈরি করেছিলেন, যেটা তার মা-বাবার কাছে তাদের বাড়িতে বইয়ের সেলফের তাকে আজও রয়েছে। কথা প্রসঙ্গে রায়ান এভাবেই সে সময়টুকুর স্মৃতিচারণ করে।
এ পর্যন্ত রায়ান তিনবার বাংলাদেশে গিয়েছে। প্রথমবার সে গিয়েছিল ১৬ বছর বয়সে, ১৯৮৯ সালে ক্যানাডপ্ট সংগঠিত সফরে আরও কয়েকজন যুদ্ধশিশু ও অনাথের সঙ্গে। দ্বিতীয়বার ১৯৯১ সালে ১৯ বছর বয়সে সে বাংলাদেশে গিয়েছিল তার জন্মদাত্রী মাকে খুঁজতে (রায়ানের অভিজ্ঞতার বিশদ বর্ণনা আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি একক যুদ্ধশিশু হিসাবে তার মা-বাবার বিবরণীর পরই)। ১৯৯৭ সালে সে আবার এক বছরের জন্য গিয়েছিল । বাস্তবতা এবং সম্ভাব্যতার সঠিকতা নির্মাণ করতে গিয়ে সে নিশ্চিত হয় যে তার জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে পাবার কোনাে সম্ভাবনাই নেই। তাকে খোঁজা কেবল এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক সফর হবে যা নিঃসন্দেহে নিস্ফল হবে শেষ পর্যন্ত ।
এ বইয়ে যতগুলাে যুদ্ধশিশুর কথা আলােচিত হয়েছে, রায়ানই একমাত্র ব্যক্তি যে তার অতীতকে নিয়ে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে খােড়াখুড়ি করেঃ “আমার জন্মদাত্রী মা সম্পর্কে আমার ঔৎসুক্যের স্বরূপ পাল্টেছে। আমার এখন সকল জন্মদাত্রী মায়েদের সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা করে; তাদের ২৫০,০০০-এর প্রত্যেকের সম্পর্কে।” বলে রায়ান। তারপর এ বিষয়ে বলতে গিয়ে সে আবারও লিখেছে “যুদ্ধ সম্পর্কে আমার বােধ এবং অনাচার অত্যাচার যা হয়েছিল সে বিষয়ে ধারণা যেমন বাড়তে লাগল তেমনি আমি বাস্তবিকপক্ষে বােধ করি যে আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফসল – সে কথা বােঝার এবং উপলব্ধি করার সক্ষমতাও আমার বৃদ্ধি পেল । আমার জন্মদাত্রী মা একজন পাকিস্তানি সৈনিকের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। এহেন কথা বলা যদিও কষ্টকর, রায়ান দৃঢ়ভাবে ঐ কথা বলার পরেও আরও বলে: “ঐ রকম উপলব্ধির পরও আমার ভেতরে কোনাে অষন্তোষ বা খারাপ ইচ্ছা জাগেনি ।” সেটা বােধ করি তার মা-বাবার সঙ্গে আশৈশব বাস করার ফলেই। রায়ান ডরিন ও ডেইলকে মা ও বাবাই ভাবে, যাদের সে তার জীবনের আরম্ভ থেকে দেখে আসছে । “আমার মা-বাবা সম্পর্কে ধারণা হয়েছে আমার কানাডীয় দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে দেখে, তাদের সাথে অনুরক্ত হওয়ার মাধ্যমেই । জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার কোনাে ধারণা থেকে থাকলেও সেটা পরিপূর্ণভাবে ঢেকে গিয়েছে তাদের থেকে অসংলগ্ন ও বিচ্ছিন্নতার। জন্য, রায়ান তার অবস্থান বিশদ করতে গিয়ে এ কথাটি বলে ।
রায়ান তার জন্ম, পরিত্যাগ, দত্তক নেয়া এবং কানাডাতে বড় হয়ে ওঠাকে ঘিরে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা, সেগুলাে আরও গভীরভাবে বােঝার চেষ্টা করে। রায়ান বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু জানতে পারে । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে যতই তার বসবাসের দিন ও রাতের সংখ্যা বাড়ছিল, ততই সে উপলব্ধি করছিল যে সে বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তারপর সময় গিয়েছে তরতর করে, এক বছরেরও বেশি সময় বাংলাদেশে
কাটিয়ে কানাডা ফিরে যাবার পর রায়ান বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহ পুরােপুরি হারিয়ে ফেলে। স্বভাবতই সে তার বাস্তবিক কানাডীয় জীবনে আরও ঘনিষ্ঠভাবে মিশে যেতে থাকে। রানী মরাল সাসকাচিওয়ান প্রদেশের সাসকাটুন শহরে বড় হয় দুসন্তানের এক পরিবারে, যেখানে একটি দত্তক ও অন্য সন্তানটি দম্পতির ঔরসজাত সন্তান। রানীর বাবা-মা লক্ষ্য করেছিলেন রানী তার উৎস খোজার প্রেক্ষিতে অন্য যুদ্ধশিশুদের তুলনায় যেন আলাদা ইচ্ছা পােষণ করত। তার উৎসের ব্যাপারে টান বা আগ্রহ এতই প্রবল ছিল যে সে সবসময়ই নানা ধরনের কবিতা লিখে তার মনের কথাগুলাে ব্যক্ত করত । আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে পড়েছি রানী তার এক কবিতায় লিখেছিল যে সে সবসময়ই তার “কখনাে-না-দেখা” জন্মদাত্রী মার কাছে রয়েছে বলে সে অনুভব করে। লক্ষণীয় যে, রানী এ কবিতায় লিখেছিল যখন সে ১৬ বছর বয়সে ঢাকাতে গিয়েছিল তার (কানাডীয়) মা-বাবার সঙ্গে। এখানে মনােযােগ আকর্ষণের একটি বিশেষ দিক হলাে যে অনাথ আশ্রমের ভিতরে যাওয়ার ঘটনা রানীকে এক নতুন ব্যক্তিগত ক্ষমতার অধিকারী করে যেন । রানী সে অভিজ্ঞতাটি উপভােগ করে প্রগাড় আবেগপ্রবণ মনে ভীষণ সন্তুষ্টি সহকারে । আরও আগ্রহান্বিত বিষয় যে বাংলাদেশে তার। (কানাডীয়) বাবা-মায়েদের সাথে থেকেও সে সময়ে সে বাংলাদেশের সাথে আরও বেশি বা সংশ্লিষ্টবােধ করেছিল ।। আবেগতাড়িত রানী তার বাবা-মায়ের সাথে থেকে যেন এক অলীক কল্পনায় নিমজ্জিত হয়ে সে অনুভব করে তার “কখনাে-না-দেখা” জন্মদাত্রী মা যেন তার চারপাশেই। এই সূত্র ধরে আমরা যুদ্ধশিশু বিষয়ক ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখব, একই দেশে বড় হয়ে উঠলেও অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। রবার্ট ও হেলকে ফেরিদের মেয়ে (আমরা ওকে ‘খ’ বলে ডাকব যেহেতু সে তার পুরাে নামটি দিতে চায়নি) অন্টেরিও প্রদেশের বার্লিংটন শহরে বড় হয়েছে। ফেরিদের পরিবারে মােট ১৩ টি সন্তান, যাদের মধ্যে তিনজন তাদের ঔরসজাত এবং বাকি সবাই ‘খ’ এর মতাে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় ভাইবােন। তার জীবনের অবস্থানে সে কোনােভাবেই সংঘাতের মুখােমুখি হয়নি। তার বাংলাদেশি জন্মদাত্রী মা এবং অনুপস্থিত পাকিস্তিনি জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে তার (কানাডীয়) মা-বাবা তাকে যা বলেছেন তার চেয়ে বেশি সে জানতে চায় না। এ বিষয়ে মােটেই তার কোনাে আগ্রহ নেই ।
‘খ’ কখনাে আরেক জোড়া মা-বাবার সঙ্গে পরিচয়ের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেনি । তার মা-বাবা তাকে বলেছেন তার জন্মদাত্রী মা কেন তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন এবং কীভাবে তাকে দত্তকায়নের মাধ্যমে কানাডাতে নিয়ে আসা হয়েছে। ফলে ‘খ’ এর বিশ্বাস। জন্মেছে যে, তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার হদিস আর কখনাে মিলবে না। এ কঠিন সত্যকে সে গ্রহণ করে বুঝতে পেরেছে যে কানাডাতে তার জীবন যে রকম দেখে এসেছে, সে রকমই চলবে। সে যে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শৈশব থেকে বড় হয়েছে, তারাই ওর সবচাইতে আপনজন। ‘খ’ এর ভাই, যাকে আমরা ক’ বলে ডাকব, সেও একটি যুদ্ধশিশু যাকে একই সঙ্গে ফেরি দম্পতি দত্তক নিয়েছিলেন। সেও তার বােনের মতাে তার পুরাে নামে এখানে পরিচিত হতে চায়নি। ‘ক’ও তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে তার (কানাডীয়) বাবা-মায়ের থেকে শুনেছে । সে তার জন্মদাতা বাবাকে একজন “সৈন্য” এবং মাকে হয়তাে ছাত্রী হয়ে থাকবে’৯৮ বলে বর্ণনা করে। ‘ক’-এর ভাষ্যমতে, এ কাহিনীর আরেকটি সংস্করণ রয়েছে। সেটা অনেকটা এরকমঃ তার জন্মদাত্রী মা তাকে প্রসব করার সময় মৃত্যুরবণ করেছিলেন। বাস্তবিকপক্ষে তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে তার জ্ঞানের সীমা এ পর্যন্তই যা সে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে জেনেছে। ‘ক’ এর সাথে নানাভাবে কথা বলার পর যেটা পরিস্কার হয়ে ওঠে সেটা তার জন্মবৃত্তান্তু সম্পর্কে তার একধরনের “উদাসীনতা।” বেশ নিঃসঙ্কোচে সে বলে যে, সে এ বিষয়ে কোনাে অনুসন্ধানে বিশেষ আগ্রহী নয়। হােজে হােগ কিউবেক প্রদেশের একটি ছােট শহরে এক ফরাসিভাষী পরিবারের মা-বাবা আর তাদের একটি ঔরসজাত সন্তানের সঙ্গে বেড়ে ওঠে। সে তার মৌলিক গল্পটি জানে। সেটা এরকমঃ “আমার জন্ম নভেম্বর ২৪, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের, দরেন্দায়, মানে, আমার জন্ম সনদপত্রে ওটাই লেখা রয়েছে, আমার ইমিগ্রেশনের কাগজপত্রেও তাই । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় আমার জন্ম, আমার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবা কে, এবং তাদের কী হলাে, সেটা কেউ জানে না । দত্তক জগতের পরিভাষায় বলা যায়, আমি একজন চিরকালের ননসার্চার’ অর্থাৎ আমি আমার জন্মবৃত্তান্ত শুনতে বা খুঁজতে অনিচ্ছুক,”২০ বলে হােজে । “হােজে কেন তার জন্মদাত্রী মাকে খোজে না, যেটা নাকি এক ঋদ্ধ অভিজ্ঞতা হতে পারত? সে কি প্রত্যাখ্যানের ভয়ে ভীত? সে কি এমন শঙ্কিত যে তার প্রিয় কানাডীয় পরিচিতি হারিয়ে যাবে? হােজে নিজেই সরল খােলামনে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।
সেটা হলােঃ “উপরােল্লিখিত কোনােটাই নয়।” তার জন্মদাত্রী মা এবং ধর্ষনের দায়ে অভিযুক্ত জন্মদাতা বাবার সঙ্গে কোনাে যােগাযােগ না থাকায় হােজে তাদের সম্পর্কে যে সামান্য কিছু জানে তাতেই সে সন্তুষ্ট। “ওদের বিষয়ে সত্যিই আমার এর চেয়ে বেশি কিছু জানার দরকার নেই। আমার কাছে এমন একজন পুরুষ ও একজন নারীর সম্পর্কে খোঁজখবর করা অর্থহীন মনে হয় যাদের সঙ্গে আমার বংশানুগতির অন্যতম নিয়ন্ত্রণ উপাদানের মিল (genes) ছাড়া অন্য কোনাে মিল নেই। যদি হঠাৎ কোনােভাবে তাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েও যায় আমরা সবাই পরস্পরের অচেনা । আমাদের সকলের ধর্ম হয়তাে বা আলাদা হয়ে গিয়েছে দেখতে পাবাে, ভাষা আলাদা, মূল্যবোেধ আলাদা, ইত্যাদি। আমার মা আমাকে অনেকবার বলেছেন যে আমি যদি বাংলাদেশে যেতে চাই তিনি আমার সঙ্গে যাবেন। আপনিতাে বােঝেন যে এটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যেটা লাভ করতে আমি অবশ্যই আগ্রহী হবাে। ২০০৪ সালে হােজে বাংলাদেশে গিয়েছিল প্রথমবার। তারপরের বছরই আবার ২০০৫ সালে। সে তার মায়ের সাথে বাংলাদেশে গিয়েছিল। দুটো সফরেই বিশেষ কিছু ঘটেনি। একরকম আগ্রহশূন্যতার মধ্যে কর্মহীন দিনরাত কেটেছে কারণ মা ও মেয়ে রাস্তাঘাটে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতময় কর্মসূচির কারণে বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত ছিলেন। সে সময়ের হতাশাগ্রস্ত হােজের এখনও মনে পড়ে তার “অদ্ভুত লেগেছিল ঢাকার হােটেলের ঘরে বসে। সময় কাটাতে।”২ই আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে হােজের দেয়া বিশদ বর্ণনা পড়েছি।
নিঃসন্দেহে, হােজের মনে ভালােবাসা এবং তার জন্মদেশের জন্য হৃদয়ের উষ্ণতা রয়েছে যার কিছুটা সংলাপের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। আমার কথায় ভুল বােঝে না, আমার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে, সে কথা আমি গর্বের সাথে সবাইকে বলি,” হােজে সহজবােধ্য ভঙ্গিতে খােলাখুলিভাবে ব্যক্ত করে। যখন থেকে সে কথা বলতে শেখে, তখন থেকেই সে সবাইকে বলত যে তার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য বাংলাদেশিরা যুদ্ধ করেছিল । সেজন্যই ১৯৭২ সালে এক কানাডীয় পরিবার তাকে দত্তকায়নের মাধ্যমে কানাডা নিয়ে আসেন। হােজের ভাষ্যমতে, এটা অত্যন্ত বিরক্তকর যে অজ্ঞতার কারণে অনেক লােক ভারত,পকিস্তান এবং বাংলাদেশকে একই দেশ হিসাবে ধরে নেন । এটা মােটেই ঠিক নয়। মৃদুভাষী হােজে সেসব লােকদের বিনয়ের সাথে নম্রভাবে উত্তরে বলেঃ * বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশের মানুষ কষ্ট করে লড়ে স্বাধীনতা পেয়েছে।”২৪ শ্যামা হার্ট কিউবেক প্রদেশের মন্ট্রিয়ল শহরে বড় হয়েছে নয়টি সন্তানের পরিবারে, যেখানে আটজনই ছিল দত্তক নেয়া সন্তান । শ্যামা কখনাে তার জন্মদাত্রী মাকে জানতে চায়নি বিশেষ করে কৈশর অবস্থায় । শ্যামা কথাটি ঠিক এভাবে ব্যক্ত করেঃ “আমি আমার জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে গােড়া থেকেই আমার মা-বাবার কাছ থেকে জেনেছি, যার ফলে হঠাৎ ব্যাপারটা জেনে আবিস্কারের আনন্দে মেতে ওঠা হয়নি আমার। আমার মনে পড়ে দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েরা তাদের জন্মবৃত্তান্তের গােড়ার কথা জানতে খুঁজে বেড়ায় । কিন্তু আমার বেলায় ঠিক সেটা হয়নি। আমার মনে হয়েছিল আমার চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ের জন্য আমার বংশানুগতির নিয়ন্ত্রক উপাদান (genes) জানা দরকার। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে, অর্থাৎ সে সময়টা বয়ঃসন্ধিকালের সময় ছিল না। সে সময়ে শ্যামা তথ্য সন্ধানের খোঁজে বাংলাদেশের শিশু ভবনে একটি চিঠি লিখেছিল । কিন্তু কোনাে নতুন তথ্য পাওয়া যায়নি। কোনাে উত্তর না পেয়ে শ্যামা হতাশ হয়েছিল, কিন্তু অবাক হয়নি। “আমার মা আমাকে যে পরিস্থিতিতে গর্ভে ধারণ করেছিলেন এবং যে সময়টা আমি মায়ের গর্ভে থাকতে পেরেছিলাম, সেটা জানার পর আর কখনাে আমার অনুমিত’ বাবাকে খোজার অথবা দেখার কোনাে তাগিদ অনুভব করিনি। আমাকে বলা হয়েছিল যে, যেহেতু তখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল, এটা খুবই সম্ভব যে আমার অনুমিত পিতা আমার জন্মদাত্রী মাকে ধর্ষণ করেছিলেন। আমার জন্মদাত্রী মাকে খোজা অথবা দেখা করার কথা যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমি বলব আমার কখনাে তেমন ইচ্ছা হয়নি। আমার চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনাে নথি বা বর্ণনাদি যদি কোথাও থেকে থাকে সে বিষয়ে আমার খুব আগ্রহ ছিল,” বিনয়নম্রে শ্যামা কথাগুলাে উচ্চারণ করে। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের সঙ্গে শ্যামার কোনাে আবেগীয় সম্পর্ক আছে বলে সে মনে করে । তথাপি সে বাংলাদেশে সম্পর্কে ভাবে বৈকি! “আমার মনের এক অংশ বাংলাদেশে ESL [English as Second Language] কোর্স পড়াতে আগ্রহী।
কিন্তু আমার মনের আরেক অংশ এ ব্যাপারে খুবই সচেতন যে উপনিবেশবাদ বিশ্বকে, বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতাে অনুন্নত ভুখন্ডকে, কী অবস্থা থেকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে,”” সংক্ষেপে শ্যামা তার মনের কথাটি ব্যক্ত করে। যদিও শ্যামা অল্প কথায় বিষয়টি ব্যক্ত করে, তার কথা থেকে এটা ধরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে যে সে তার জন্মদেশে সফরে যাবার সম্ভবনাকে। কখনাে নাকচ করে দেয়নি। শিখা ক্যাপুচিনাে অন্টেরিও প্রদেশের অটোয়ার কাছে ম্যাকসভিল নামে ছােট একটি শহরে ২১ জন ছেলেমেয়ের পরিবারে বড় হয়ে ওঠে। ওদের ভাইবােনদের মধ্যে মােট দুজন ফ্রেড ও বনি ক্যাপুচিনাের ঔরসজাত, আর বাকি সবই দৃশ্যমান সংখ্যালঘু যারা দত্তকায়নের মাধ্যমে ক্যাপুচিনাে পরিবারে এসেছে ছােটবেলায় । যখন কেউ শিখাকে জিজ্ঞাসা করত কোথায় তার বাড়ি বা কোথা থেকে সে এসেছে, উত্তরে সে খুব সহজভাবেই বলত যে তার জীবন শুরু হয় কানাডাতে, তার মা-বাবা ফ্রেড আর বনি কাপুচিনাের সঙ্গে। শিখা বলে কখনাে তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগেনি এ মর্মে যে, তার দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের সাথে তার সম্পর্কটা আসল না অন্য কিছু। তার বাবা-মা মেয়েবেলাতে তাকে যে জন্মকাহিনী শুনিয়েছেন অর্থাৎ কখন কী অবস্থায় তার জন্মদাত্রী মা অন্তঃসত্ত্বা হন এবং তাকে জন্ম দেন ইত্যাদি, তাতেই সে সন্তুষ্ট ছিল । শিখা বলে সে সময় থেকে তার জীবনবৃত্তান্ত বা অতীত সম্পর্কে আর খােড়াখুড়ি বা খোজাখুজি করার বাসনা কখনাে হয়নি তার। অনিল মউলিং অন্টেরিও প্রদেশের মিসিসাগা শহরে ৪ ছেলেমেয়ের পরিবারে বড় হয়, যাদের সাবাই দত্তকায়নের মাধ্যমে মৌলিং পরিবারে আসে। বাংলাদেশের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে অনিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে সে সময় ও সুযােগ পেলে বাংলাদেশে যাবে। তার ইচ্ছার তালিকায় বাংলাদেশ সফর রয়েছে। এবার আমরা চলে যাব অনিলের ভিন্নধর্মী দার্শনিক। দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ জানতে। আবেগের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনিল বলেঃ “আরও ভালাে। হবে, যদি এরকম সুযােগ পাওয়া যায় যে আমাকে যে অনাথ আশ্রম থেকে এখানে আনা হয়েছিল সেখানে যাওয়ার। যদি সত্য সত্যিই সেটা হয় তবে আমি সেখানে গিয়ে স্বেচ্ছাশ্রম দান করব।” অনিল আবারাে বলে, “বাংলাদেশে গেলে আমি অবশ্যই আমার সাধ্যমতাে শ্রম ও সময় দেবাে এবং প্রয়ােজনে অর্থ দেবাে যাতে অনাথদের অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব হয় ।”২৯ তার জীবনের শুরুর দিকে তাকিয়ে অনিল বলে যে সে শুনেছে তার বাবা-মার কাছ থেকে যে শিশু ভবনে তাদের যথাসাধ্য দেখাশােনা করা হয়েছে। কাজেই যে অনাথ আশ্রমে যারা তাদের আশ্রয় শুশ্রুষা করে স্বাস্থ্য ঠিক রেখেছিল, সে তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। “তারা আমাকে জায়গা দিয়েছিলেন আশ্রমে, আমাকে লালন-পালন করেছিলেন।
আমি মনে করি। আমার জীবন তাদের স্নেহ-মমতাতেই ফিরে পেয়েছিলাম। আমি যত আশীর্বাদ পেয়েছি, তার । সবই ওদের কারণে,” বলে অনিল । সুযােগ পেলে সে অবশ্যই বাংলাদেশে যাবে, সে বিষয়ে তার কোনাে স্বন্দেহ নেই। উল্লিখিত বক্তব্য চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বলতে পারি, একই সাথে আসা ১৫ জন যুদ্ধশিশুদের মধ্যে অনিল অনেকাংশে তাদের তুলনায় একটু অন্যরকম। দত্তক নিয়ে যে একটি ত্রিমুখী মিলনের কথা বলা হয় সেটা সাধারণত পােষ্য ছেলেমেয়ে, তাদের জন্মদাত্রী মা এবং দত্তকগ্রহণকারী মা বাবাকে ঘিরে। সেটাকে রায়ানের মতাে অনিল সম্ভাব্য বিষয় হিসাবে দেখেনি। মাঝে মাঝে আমি চরমপন্থী হলেও অন্য সবসময় তেমন নই। ত্রিমুখী মিলনের জন্য আমার ভেতর থেকে কোনাে তাগিদ আমি অনুভব করিনি। এমন কি আমার সঙ্গে আমার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার দেখা হয়ে গেলেও আমি তাদের আমার (দত্তক নেয়া) মা-বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবার কোনাে তাগিদ অনুভব করব বলে মনে হয় না । আমার বর্তমান অবস্থানে থেকে আমার মনে হয় না মানসিক ও আবেগিক দিক দিয়ে পুরােপুরি আমার জীবনের সাথে তাদেরকে অঙ্গীভূত করতে পারব। অতএব, তাদের মধ্যে আপস রফা হবারও কোনাে প্রয়ােজন বা জায়গা দেখি না,” অনিল মন্তব্যটি করে। দ্বিধাহীনভাবে। আজ পর্যন্ত তার জীবনে “এ কারণে কোনাে শূন্যতা দেখা দেয় নাই,”৩২ বলে অনিল । “আমার জীবনে সুখ কখনাে তারা কোথায় আছেন বা ছিলেন সে তথ্য জানা বা না জানার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না।” এ বলে সরলমনা অনিল তার অভিমত ব্যক্ত করে । বড় হয়ে ওঠার সময় দত্তকের কারণে সে কখনাে এমন বােধ করেনি যে সে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে বা নিজেকে ভিনদেশি হিসাবে দেখেছে। অন্য পােষ্যদের মতােই অনিল বিশ্বাস করে তার জন্মদাত্রী মায়ের আত্মত্যাগ যে বৃথা যায়নি তা তিনি (মা) জানলেও এটা পরম সত্য যে, তিনি অবচেতন মনে আশান্বিত ছিলেন, তার সন্তান জীবনের সর্বোকৃষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করবে। আত্মতুষ্ট অনিল নিজের এবং অন্য পােষ্যদের অনুভূতির বিষয়ে বলতে গিয়ে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেঃ “বিয়ােগান্তক ব্যাপারটি শােনার পরপরই আমার মনে হয়েছিল যদি আমি আমার জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে পেতাম, তাহলে তাকে প্রথমেই জানাতাম যে তার দুঃখের কারণে আমি নিজেও যে কী গভীর দুঃখে দুঃখী । তাকে বলার চেষ্টা করতাম যে আত্মত্যাগের (বলিদানের সুফল হিসেবে) ঘটনা থেকে এক আশ্চর্য সুন্দরের জন্ম হয়েছে (অর্থাৎ তার মার পরিত্যক্ত ছেলে আজও ভালােভাবে বেঁচে আছে]।”৩৪ পােষ্যদের বিবরণী থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসে যে তারা যুদ্ধশিশুদের দিয়ে দেয়া”- কে কখনাে ঠিক “প্রত্যাখ্যান” অর্থে দেখেনি।
জন্মদাত্রী মায়েদের দুর্দশা যখন চরমে পৌছেছিল, তারা অপারগ হয়ে আপন সন্তানদের সেখানে আশ্রমের নিশ্চিত সেবার পরিবেশে রেখে যান । বাংলাদেশ সফর করার ইচ্ছা সকলেরই থাকুক বা নাই থাকুক, পােষ্যরা সবাই নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করে যে একজন জনদ্রাত্রী মা কেন তার সন্তানকে দিয়ে দিয়েছিলেন”? একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাধারণত দেখা যায় পােষ্যরা তাদের জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার প্রতি রাগান্বিত হয়ে ওঠে। কারণ তারা তাদের নবজাত শিশুকে ত্যাগ করেছিলেন । কিন্তু আমরা যেসব যুদ্ধশিশুদের পর্যালােচনা করছি, তারা তাদের জন্মদাত্রী মায়েদের বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগই রাখেনি। তারা জেনেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের এমনিতে অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির মুখােমুখি হতে হয়েছিল। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, এসব যুদ্ধশিশুরা কেন কখনাে “দিয়ে দেয়া” শব্দটির সাথে “প্রত্যাখ্যান” করা শব্দটি সমান বিবেচনায় আনেনি। মূল অর্থে দুটি শব্দই ভিন্ন এবং পােষ্যরা বা সম্পূর্ণভাবে অন্য দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিষয়টি মূল্যায়ন করেছে। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি যুদ্ধশিশুরা কেমন করে এ কঠিন সত্যকে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের দত্তকায়নের কাহিনীর সাথে অঙ্গীভূত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা সংবেদন ও সহানুভূতিশীল যে তারা কোনাে অবস্থাতেই তাদের জন্মদাত্রী মাদের গায়ে কালিমালেপন করতে চায়নি । বলা যেতে পারে এটা এক রকমের অদৃশ্য আনুগত্যের প্রকাশ বটে!
সমাজবিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মীরা পােষ্যদের পর্যাপ্ত জন্মতথ্য উদঘাটনে অনীহার কারণ হিসাবে যে ক্ষেত্রে একমত প্রকাশ করেছেন তা হলাে, পােষ্যরা যখন কোনাে সমস্যা বা ইস্যুর কারণে অস্বস্তিতে থাকে, তখন তাদের উৎস অনুসন্ধানের কাজে ব্যাপ্ত হলে তারা বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ শাস্তির উৎসের সন্ধান পায়। শিশুরা যখন ভালােবাসার বাড়িতে অপরিমিত স্নেহে বড় হয়, তাদের জন্য সেটা শুধু মনের দিক দিয়ে ঠিক থাকার বিষয় ছিল না। পােষ্যরা নির্দিষ্টভাবে তাদের জন্মকে ঘিরে নানা নেতিবাচক বৃত্তান্ত জেনে বড় হয়েছে । তাদের জন্মবৃত্তান্ত এবং দত্তকগ্রহণের ইতিহাস শােনার পর মােটামুটিভাবে যুদ্ধশিশুরা ওটা মেনে নিয়েছিল যে আর কোনাে তথ্য নেই যা খুলে বলতে হবে । ওরা বড় হওয়ার সময় জেনেছিল যে এটা কোনাে তথ্য গােপন রাখা বা চাপা দেবার বিষয় নয়। তাদের জীবনের এ সত্য মেনে নেবার পর তাদের জন্য অন্য কোনাে জীবনবৃত্তান্ত বিষয়ে আর হতভম্ব বা বিভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা ছিল না। কাজেই আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, ছােটবেলা থেকেই জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে যে আর কোনাে রকমের তথ্য নেই, সেটাকে তারা খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পেরেছিল। সেজন্য তাদের মনোেযােগ কখনাে দুজোড়া বাবামায়ের (অর্থাৎ জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবা এবং দত্তকগ্রাহী বাব-মা) অস্তিত্ব বিদ্যমানের কথা কখনাে ভাবেনি।
পারিবারিক সম্পর্ক ও বন্ধন
যুদ্ধশিশুরা বেশ খােলাখুলিভাবে তাদের বাবা-মা, ভাই-বােন এবং বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা বলেছে কোনাে দ্বিধাগ্রস্ততা ছাড়া । জাতি ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য সত্ত্বেও প্রত্যেকের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির অনেক ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ঘটনা ও গল্প রয়েছে। যুদ্ধশিশুদের ভাষ্যমতে, তাদের বাবা-মায়েরা তাদের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাব। তারা ছেলেমেয়েদের সাহায্য যুগিয়েছেন, বাড়িতে ইতিবাচক ও উপভােগ্য পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন যেখানে ঢুকলেই বাইরের ভীতি, ক্লান্তি, পরাজয় সব পেছনে পড়ে থাকে, বাড়িতে কেবল নিশ্চয়তা।
কানাডার বিভিন্ন শহরে বড় হয়ে এসব শিশু কিছু কিছু সাধারণ মনােভাব প্রকাশ করে, যেমনসমর্থনসূচক মেলামেশা, অন্যকে মেনে নেয়া, ধৈর্য্য ধরা এবং সহযােগিতা করা ইত্যাদি বিষয়ে তারা ছােটবেলাতেই জ্ঞানলাভ করে। তাদের নিজ নিজ বিবরণী থেকে আমরা দেখতে পাই তাদের বাড়িতে নেতিবাচক আবহাওয়া, যেমন- একজন আরেকজনকে চুপ করিয়ে দেয়া, অন্যদের বিরূপ সমালােচনা, বিরুদ্ধাচারণ, ঘৃণা এবং দোষারূপ করা ইত্যাদির কোনাে উদাহরণ নইে। তাদের মধ্যে কেউই কখনাে কাউকে এ ধরনের কিছু করতে দেখেছে বলে দাবি করেনি। তাদের পারিবারিক জীবনের একটি লক্ষণীয় দিক যে, দত্তক নেয়া মা-বাবা যে রক্তের বন্ধনে বাঁধা নয়, সেটা তারা অল্প বয়সে থেকে জানতে পারে যখন পরিবারের সদস্যরা তাদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন। তাদের প্রত্যেকে একই বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন যে, অল্প বয়সে তাদের ইতিবাচক অভিজ্ঞতার ফলে তারা স্বতঃস্ফূর্ততা, স্বাচ্ছন্দ্য ও পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে মেলামেশার আনন্দ বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই উপভােগ করতে আরম্ভ করে । তাদের এখনও মনে রেখেছে তাদের মা-বাবা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গে ও ভাবনা চিন্তা তাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ধীরে ধীরে সঞ্চার করার কী চেষ্টাই না করতেন। বাবা-মায়েরা সবসময়ই তাদেরকে বলেছেন যে কোনাে পােষ্যের জন্য, সে সমজাতি বা গােষ্ঠীর হােক বা হােক, পরিবারের সকলের ভালােবাসা ও সমর্থন পেয়ে পরিবারে বড় হওয়া সর্বাগ্রে প্রয়ােজন। ওদের বিবরণী থেকে তিনটি প্রধান “ধারণা” উঠে এসেছে। সেগুলাে হলােঃ “স্থায়ী বাড়ি” সেখানে তাদের বাবা মারা তাদের ভালোবাসেন এবং স্নেহ আদর করেন” এবং মা-বাবার। প্রতি পােষ্যদের কৃতজ্ঞতাবােধ এবং মা-বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের দৃঢ়তা । সে সাথে তাদের মা-বাবা যে প্রতিজ্ঞাবলে তাদের কানাড়া নিয়ে এসেছিলেন, সেটা হৃদয়ঙ্গম করা বা মর্মে মর্মে বােঝা। তাদের বাবা-মায়েরা যে অঙ্গীকার নিয়ে তাদের শত বাধা অতিক্রম করে। কানাডা নিয়ে এসেছিলেন, যুদ্ধশিশুরা তাদের মা-বাবার এ সংকল্প ও বিজয় থেকে যে যেমন বুঝেছে, তেমন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিরও রূপ পাল্টেছে। তারা সজ্ঞান হবার পর থেকে জেনে এসেছে যে তারা তাদের মা-বাবার ঔরসজাত সন্তান নয় । বরং তাদের বাবা-মায়েরা তাদের নিজ পছন্দে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে এসেছিলেন লালন-পালনের জন্য। তারা এমনই বিশেষ গুণের দম্পতি যারা কখনাে ঔরসজাত সন্তান আর দত্তকায়িত সন্তানের মধ্যে কোনাে প্রভেদ দেখেন না। তাদের সবাই সমান ভালােবাসা ও আদর পায় বাবা মায়ের সন্তান হিসেবে।
প্রাপ্তবয়স্ক যুদ্ধশিশুদের ভাষ্যমতে তাদের বাঁধন তাদের মা-বাবার সঙ্গে বনাম তাদের জন্মদাত্রী। মায়েদের সঙ্গে একটি সহজ পাটি গণিতের অঙ্কে প্রকাশ করা যায় তারা তাদের গর্ভধারিণীর জঠরে নমাস কাটিয়েছিল (অথবা আরও কম অপরিণত শিশুর ক্ষেত্রে। যুদ্ধশিশুদের অধিকাংশই এরকম ছিল)। পেছনে যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশে তাদের জন্মের আগে, আর পােষ্য গ্রহণকরা মা-বাবার পরিবারে যােগ দেবার পর, তারা তাদের জীবনের শুরু থেকে ওই সব বাড়িতে ওই পরিবারের সদস্যরূপে বাস করে আসছে। স্বভাবতই তারা যখন বড় হতে শুরু করে, মা-বাবার সঙ্গে তাদের বাধনও আরও সুদৃঢ়, আরও টেকসই হতে লাগে । যুদ্ধশিশুদের সাথে বার বার সংলাপের মাধ্যমে এটা আরও প্রমাণসিদ্ধ হয় যে, শিখা, ল্যারা, ক্রিস অথবা অন্য যে কেউই হােক না কেন, ওরা প্রত্যেকেই স্বচ্ছন্দে তাদের পূর্ণ পরিচিতি লাভ করেছে তাদের (দত্তক নেয়া) বাবা-মায়ের থেকে, তাদের সংস্পর্শে এসে। যেহেতু তারা তাদের জন্মদাত্রী মায়েদের জীবিত অথবা মৃত কোনােভাবেই চেনে না বা জানে না, এতে মনে হয় যেন তাদের বর্তমান কানাডীয় জীবনে তাদের কিছুই যায় আসে না।
তাদের বাবা-মায়েদের নিঃশর্ত স্নেহ-ভালােবাসা থেকে তারা এটা জানে যে তারা সর্বদা তাদের ছেলেমেয়েদের সাহায্য করতে প্রস্তুত। যখন যার যা সাহায্যের দরকারই হােক না কেন, তারা তখন পাশে এসে দাঁড়াবেন। নিজেকে নিঃশেষ করেও তাদের সন্তানদের জন্য যেটা করণীয় তাই করবেন। সন্তানদের সুখভােগ ও ধনৈশ্বর্য তারা দেখেতে চান, এ বিষয়ে সন্তানদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাদের ভাষ্যমতে, তাদের বাবা-মায়েরা সবসময়ই অবগত ছিলেন যে সুস্থ ব্যক্তিত্ব ও মন-মানসিকতা একজনের নিরপত্তারােধে সহায়ক। অনেক কিছু বলার অবসরে হাসিখুশি ল্যারা বলে সে বংশবৃত্তান্তের পার্থক্যের বিষয়টি বেশ। সহজেই এড়িয়ে গিয়েছিল। কারণ তার জীবনে কখনাে শূন্যতাবােধের অভিজ্ঞতা হয়নি । “আমার পরিবার আমাকে আমাদের পরিবারের একজন বলেই গণ্য করেছে, যদিও আমাদের মধ্যে বংশালতার দিক দিয়ে কোনাে যােগাযােগ নেই। আমাকে কখনাে কেউ এমন কিছু বলেনি বা এমন আচরণ আমার সঙ্গে করেনি যার জন্য আমাকে ভাবতে হয়েছে যে আমি সবার চেয়ে ভিন্ন । আমার চেহারা পরিবারের অন্য কারাে সঙ্গে না মিললেও আমি সবসময় ভেবেছি যে আমরা একই পরিবারের সন্তান”। যুদ্ধশিশুদের নিজ নিজ বিবৃতি থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যে ভালােবাসা তারা তাদের জাতিগতভাবে ভিন্ন মা-বাবার কাছ থেকে পেয়েছে, তাতে রক্তের বাঁধন না থাকলেও ছিল দুর্লভ বিশ্বাস, আনুগত্যতা ও দায়বদ্ধতা। আজকের অস্থির ও উদ্বেগজড়িত বিশ্বে সবচেয়ে প্রয়ােজন মা-বাবার ভালােবাসা ও স্নেহ । বাংলাদেশে তাদের জন্মের পর নৈতিকতার দৃষ্টিতে দেখলে কানাডাতে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা তাদেরকে বুকে জড়িয়ে নেবার যে ব্যগ্রতা ও আবেগ প্রকাশ করেছিলেন, তাতে তারা নিজেদের মূল্যবান ও আদরণীয় ভাবতে শিখেছে। বৈকি! একভাবে না হােক, আরেকভাবে প্রত্যেকে বলেছে যে তাদের বাবা-মায়েরা তাদেরকে পছন্দ করেনির্বাচন করেছেন, শব্দটি হয়তােবা বাবা-মায়েরা কখনাে এভাবে উচ্চারণ করেননি। কিন্তু তারপরও সবাই জানতেন কেমন করে এ সব দম্পতিরা আন্তবর্ণীয় অনাথদের এনে তাদের বৈচিত্রময় পরিবার গড়ে তােলেন। যুদ্ধশিশুদের ভাষ্যমতে, তাদের বাবা-মায়েরা সবসময়ই অবগত ছিলেন যে সুস্থ ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা ব্যক্তির মধ্যে নিরাপত্তাবােধ, স্বাবলম্বিতা, আত্মনির্ভরশীলতা, ইত্যাদি গুণাবলি সৃষ্টি করে। গর্বিত লিজ হােগ (হােজের মা) তাদের সন্তান বাংলাদেশ থেকে পৌছাবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকা কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে জানান তাদের নতুন জীবনের একটি ছােট বর্ণনা দিয়ে। প্রথমদিকে রাজিনা (পরে নাম বদলিয়ে রাখা হয় হােজে) কেউ হাত বাড়ালেই এগিয়ে যেত, অচেনা, অদেখা যে কেউই হােক। কিন্তু শীঘ্রই মাসখানেকের মধ্যে, পরিবারের সঙ্গে রাজিনার আসক্তি এত গভীর হলাে যে, প্রতিবেশিদের কেউ তাকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করলেও রাজিনা কখনাে যেত না। “রাজিনা তখন কাঁদতে আরম্ভ করত এবং সে তার মায়ের বাহু ধরে। রাখত” বলেন লিজ সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে। লিজ নিজে কী সুখীই না বােধ করতেন, আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি ভাবতেন যে তার সন্তান ঠিকই তার মাকে চিনতে পেরেছে যে তিনি [লিজ) তার (রাজিনার বিশেষ কেউ।
পেছনে যতদুর হােজের মনে পড়ে, সে অবশ্য গণনা থামিয়ে দিয়েছে, কতবার যে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, পােষ্য সন্তান হিসাবে তার কেমন লাগে; অথবা, তার বাবা-মাকে কি আসল মা-বাবা মনে হয়? না কি অন্য রকম কিছু । এ ধরনের বিরক্তিকর প্রশ্নের জন্য হােজের। কাছে মােটামুটিভাবে প্রস্তুত উত্তর ছিল। আমাকে যারা আদর যত্ন করেছেন, ভালােবেসেছেন, আগামী দিনের বিশ্বের জন্য উপযােগী করে তুলেছেন, তারাই কেবল মাবাবা নামের দাবিদার, অন্য কেউ নয়,”৩৭ অনুত্তেজিত হােজে নিস্তরঙ্গে এ ধরনের উত্তর দিয়েছে অগণিতবার । বাবা-মা সম্পর্কে স্পষ্টবাদী হােজের অভিমত সে তাদের সম্পর্কের গভীরতার উপর ভিত্তি করে যতটুকু উপলব্ধি করতে পারে, যে তারা অপরিবর্তনীয় । কারণ। তারা তাকে লালন পালন করেছেন। শিখার মতে, তার পরিবারের সবচেয়ে চমৎকার বৈশিষ্ট্য হলাে পরিবারের নৈকট্যবােধ, তাদের মা-বাবা সর্বদাই প্রত্যেক পারিবারিক সদস্যদের জন্য তৈরি ছিলেন। শিখার নিজের আসক্তি তার মা-বাবার জন্য তাই সে পারস্পরিক ভালােবাসার সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেয় । ওর মাবাবা আত্মন্যায়নিষ্ঠ মানুষ, ভালােমন্দের পার্থক্য গুরুত্ব সহকারে দেখেন। শিখা গর্ববােধ করে বলে যে ওরা ভাইবােনেরা ওদের মা-বাবার সবচেয়ে প্রিয় মূল্যবােধগুলিকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনচর্চার সঙ্গ করেনিতে সক্ষম হয়েছে। সে অনুভব করে তার মা-বাবা তার মধ্যে এক সম্ভাবনার বােধ প্রেথিত করে দিতে পেরেছেন যা বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর নানা সীমানা ভেঙে ফেলে অনায়াশে বর্তমানের বৈচিত্রময় কানাডাতে নানা বর্ণীয় কানাডীয়দের সাথে পারস্পরিক। সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করেছে। বন্ধুসুলভ শ্যামা তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রায় একই রকমে । শ্যামা বলে যে সৌভাগ্যক্রমে সে বেঁচে আছে কারণ তাকে তার মা-বাবা চেয়েছিলেন। কোনাে ধরনের কুণ্ঠাবােধ না করেই শ্যামা দৃঢ়ভাবে তার মতামত ব্যক্ত করে বলে যে, কানাডীয় মাই তার “আসল” মা, যেহেতু এ মাই তাকে লালন করেছেন, তাকে কানাডার মাটিতে মানুষ করেছেন। কাজেই, সে তাকে মা বলে তার শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত জেনে এসেছে। এ পরিবারের মা-বাবা, ভাইয়েরা এবং বােনেরা, চাচা চাচি, দাদা, দাদি, নানা, নানি, ছােট ভাইবােন, সবাই এত সহজ ও স্বাভাবিক জীবনের মতাে বাস্তব যে শ্যামা সবসময় মনে করেছে যে সে হার্ট পরিবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনিল তার স্মৃতিচারণে বলে যেহেতু সে শিশু অবস্থায় কানাডাতে আসে, কানাডীয় বাড়িতে পৌছানাের অভিজ্ঞতা তার মনে নেই। বাংলাদেশে জন্মানাে এবং কানাডার মাটিতে বড় হওয়া। যুদ্ধশিশুরা নিজেদের এমনভাবে দেখে তাতে মনে হয় ওদের জীবনে সত্যিই কোনাে অতীত। রয়েছে বলে তারা ভাবে না। বাস্তবিকপক্ষে কানাডীয় বাড়িতে তাদের জীবন শুরু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা মনস্তত্ত্ববিদদের অভিমতকে বিবেচনায় আনতে পারি। ঐতিহ্যবাহী মনস্ত। ত্ববিদদের মতে, শিশুরা দুবছর বয়সের আগে চিন্তা করতে পারে বলে কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মূলত এ যুক্তি সিগমন্ড ফ্রয়েড-এর এবং এ যুক্তি আমাদের পর্যবেক্ষণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ফ্রয়েড-এর মতে, যে ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুরা চিহ্ন ও প্রতীক ব্যবহার করতে শেখে এবং স্মৃতিচিত্র আঁকতে সমর্থ হয়, সেটার সঙ্গে যুদ্ধশিশুদের ব্যাপারটি পুরােপুরি মেলে। তাই যুদ্ধশিশুদের অধিকাংশের দাবি – তাদের একমাত্র বাব-মা কানাডীয় শ্বেতাঙ্গ বাব-মা ।
সে অর্থে যুদ্ধশিশুদের বক্তব্য যে তারা অন্য কোনাে বাবা-মাকে চেনে না সেটা স্মৃতি রক্ষা বিষয়ক গবেষণার ফলাফলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ভিন্ন বর্ণীয় বাড়িতে দত্তক নেয়ার কারণে তারা কোনােভাবেই বিচলিত মনে হয়নি, কারণ যে বাড়িতে বড় হয়েছে সে বাড়িটি তার নিজের বাড়ি হিসাবে ভেবেছে। এ কথা স্বীকার্য যে, বাস্তবতার নিরিখে যুদ্ধশিশুদের জীবন কানাডাতেই শুরু হয়েছিল তাদের শ্বেতকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবে, এই যুদ্ধশিশুদের সাথে তাদের কখনাে-নাদেখা” জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার কোনাে সম্পর্ক কখনাে গড়ে ওঠার প্রশ্ন ওঠেনি। বাকি সব যুদ্ধশিশুর মতাে অনিলও তার কানাডীয় বাবা-মাকে একমত্র মা-বাবা হিসাবে গণ্য করে। শুধু তাই নয়, তার শ্বেতকায় মা-বাবা এবং নানা বর্ণীয় ভাইবােনদের জন্য ভালােবাসা ও স্নেহ জন্মেছে সে বাড়িতে যেখানে সে নিজ স্নেহ ভালােবাসা পেয়ে বড় হয়। সবার সাথে তার দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনের ফলে অনিল বােধ করে তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি তার জীবনের এক অবাক কর সত্য । অনিল বলে তার শ্বেতকায় বাবা-মা এবং বিভন্ন জাতিও উৎসের ভাইবােনদের সঙ্গে রয়েছে তার এক আশ্চর্য আপন করা সম্পর্ক । আজ পর্যন্ত অনিল মনে রেখেছে সে মা তার মা-বাবার কাছ থেকে শুনেছিল ছােটবেলায় তার জন্মের পরপরই তার জন্মদাত্রী মা তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন কারণ সে অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের মতাে ছিল “অপ্রার্থিত” এবং “অনাকাক্ষিত”। খুবই ভােলামেলা কথাবার্তা যেহেতু বালার অভ্যাস, অনিল তার জন্মদাত্রী মা এবং অনুমিত বাবা সম্পর্কে তার অবাক করা অচেনা অনুভূতির কথা বলতে দ্বিধাবােধ করে না। যদি কখনাে তার জন্মদাত্রী মার সঙ্গে দৈবক্রমে তার দেখা হয়ে যায়, সে প্রথমেই তাকে বলতে চেষ্টা করবে যে সে তার মায়ের বিয়ােগান্তক পরিস্থিতির কারণে অত্যন্ত দুঃখিত। একই রকমভাবে আমিনা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে অত্যন্ত গভীর ভালােবাসার বাঁধনে আটকে আছে । তার সম্পর্কটি এমন যে, সে ভাবতে পারে না অন্য কোনাে দম্পতি তার জীবনে ওদের জায়গাটি নিতে পারে। তার বাবা এমন একজন ব্যক্তি যিনি তার জীবন, তার পরিবার, গির্জা, তার কাজ এবং অভাবিদের সহায়তায় নিবেদন করেছেন। বিগত বছরগুলিতে তার বাবা অনেককে তার কাজের মাধ্যমে এবং অন্তদৃষ্টির সহায়তায় উপকার করেছেন। তারপরও তিনি কার কী উপকার করেছেন, তা কখনাে মনে রাখেন না। আমার মায়ের দৃষ্টি এবং অনাথদের সহায়তায় ব্রত বাস্তবায়নের পেছনে শক্তি যােগান আমার নীরব বাবা,” জানায় আমিনা ।
“মিলিয়ন ডলারের বিনিময়েও আমি ওদের হারাতে রাজি হব , আত্মতুষ্ট ও পরিতৃপ্ত আমিনা ওর মা-বাবার গর্বে গর্বিত হয়ে বলে। আমিনার চেনাজানার মধ্যে তার জীবনের আর কোনাে বাবা-মা নেই তার বর্তমান বাবা-মা ছাড়া। আমিনাকে আপনি যেভাবেই তার বাবা-মা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন না কেন, তার উত্তর সবসময় উল্লিখিত উক্তটির মতাে । একইভাবে ক্রিস তার বাবা-মাকে মনে করে তারা এখানে তার লালন পালন, আদর যত্ন, খাবার-দাবার যােগানাের কাজ করে চলছেন। পেছনে যতদুর মনে করতে পারে, সে একই চিত্র দেখে। সে স্বীকার করে তার অজানা জন্মদাত্রী মা তাকে অত্যন্ত অবাঞ্চিত ঘটনাক্রমের
সময়ে প্রসব করেছিলেন, যে জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে নিঃশব্দে সরে যেতে হয়েছিল। ইচ্ছাকৃতভাবে উৎস সন্ধানে অনাগ্রহী ক্রিস তাকে ত্যাগ করা তার জন্মদাত্রী মায়ের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার প্রতি তার কোনাে বিশেষ টান অনুভব করে না। বরং দেখা যায় কুণ্ঠাহীনভাবে ক্রিস বলে যে, সে তাদের সম্পর্কে আর কিছু জানতে চায় না। সে তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং মা-বাবার সঙ্গে এত দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত যে, তার আর কখনাে বাইরে কোথাও ভালােবাসা ও স্নেহ খুঁজে বেড়াতে হয়নি। সে তার দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকেই একমাত্র মা-বাবা হিসাবে জানে । সে তার জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা। বাবার কথা বলেনি। আবার রায়ানের মতে, তার মা-বাবা তাকে অনাথ আশ্রমে থাকতেই ভালােবাসতে শুরু করেন, যে মুহূর্তে তারা তাকে পছন্দ করেছিলেন সে মুহূর্ত থেকে, যদিও তখন অনেক কিছুই অনিশ্চিত ছিল। মা-বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কের বাঁধন তার কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন। সে বাংলাদেশে থেকেছিল ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে। সে সময়টুকুতে প্রায়ই বাড়ির জন্য তার মন কেমন করত । তার ই-মেইল (যেগুলাে সে তার বাব-মা ও বন্ধুদেরকে পাঠাত, আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে পড়েছি)-এ আমরা দেখেছি কেমন করে সে তার আত্মপরিচয় নিয়ে ভাবত । নানা বিষয়ে তার নিজস্ব অনুভূতি এবং পর্যবেক্ষণের কথা বর্ণনা করে সে প্রতি সপ্তাহে তার। বাবা-মাকে অবহিত করত বাংলাদেশে তার দৈনন্দিন জীবন কেমন করে কাটত। তার। পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতার কথা সে প্রকাশ করেছে অজস্রবার। এসবের উদাহরনণ দিয়ে সে তার কানাডীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার একান্ত অনুভূতি ব্যক্ত করেছে। একদিকে কানাডা, যে দেশকে সে তার বাড়ি হিসাবে দেখে, আর অন্যদিকে বাংলাদেশ তার জন্মদেশ। রায়ান এ দুয়ের মাঝে অনেকটা দোদুল্যমান অবস্থায় থেকে তার বাবা-মাকে লিখেছিল: “আমি মনােযােগ হারায়ে ফেলেছি আমার মনে হচ্ছে আমি মদোন্মত্ত এবং মাতাল । আমি মােহমুক্ত অবস্থায় মনে করি আমি অসুখী । মনে হচ্ছে আমি যেন আরও অসুখী হয়ে পড়ছি। মনে হয় আমি যেন শুধু বাড়ির কথা ভাবছি । মনে হয় আমি যেন আরও বেশি করে বাড়ির কথা ভাবছি । বাড়িটা কোথায়?” উভয়সংকটে পড়ে গিয়ে রায়ান বারবার নিজেকে এ প্রশ্নটি করে। সে বুঝতে পারে জন্মভূমি সম্পর্কে তার ভালােবাসা এবং উত্তেজনা একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তার ওপর ভর করেছিল, কিন্তু সেটা এখন কেটে গিয়েছে। বাংলাদেশে সে তার পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতি এত গভীরভাবে উপলব্ধি করে যে সে সময়ে নিজেকে অত্যন্ত অসহায় ভেবেছিল । শুধু তাই নয়, দেখা গেল একের পর আরেক নিরুৎসাহকরণের ঢেউ এসে তাকে ডুবিয়ে দিতে থাকে ।
এক বছরের একটু বেশি সময় পার করে হতাশাব্যজনক হয়ে রায়ান উপসংহার টানল। যে, তার জীবনের গতিপথে সে একটি সঙ্কটজনক মােড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আহত এবং গভীরভাবে আশাহীন হয়ে, মােমবাতি নিঃশেষ হয়ে এলে তার যে দশা হয়, রায়ানও সে। অবস্থায় উপনীত হয়ে তার “ডন কিহেতি” অভিযাত্রার শেষ ঘােষণা করে। তার পরপরই কানাডাতে (তার বাড়িতে) ফিরে যায় ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে। বর্তমানে চল্লিশােধে পৌছেও পােষ্যরা তাদের মা-বাবার সঙ্গে তাদের আজীবনের সুদৃঢ় সম্পর্কের কথা উচ্চারণ করে। মানুষের যে সৃষ্টি হয়েছিল যাতে তারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে সেটা বজায় রাখে, একথা যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কের গভীরতা লক্ষ্য করলে নিশ্চিতরূপে সেটার দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখা যায়। তারা জানে তারা তাদের মা-বাবার রক্ত-মাংসের অংশ নয়। কিন্তু তবুও তারা উপলব্ধি করে যে তারা তাদের মা-বাবারই একটি অংশ এটা এমন এক ধরনের অনুভূতি যেটা তাদের পারিবারিক সমন্বিতকরণে সহায়তা করেছে। তাদের বক্তব্যকে গুছিয়ে গদ্যের মতাে ব্যক্ত করলে বলা যেতে পারে যে কোনাে গভীর মা-বাবা ও শিশু বাধনে উপস্থিতি না থাকলে কখনাে কোনাে স্বাস্থ্যপ্রদ নৈতিক ও আবেগীয় উন্নয়নের সুষ্ঠু কাঠামাে থাকে না। স্পষ্টত কানাডীয় জীবনে বিপুল সংখ্যক পরিবার নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত । সেখানে রয়েছে দাম্পত্য কলহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, পারিবারিক ভাঙন, রেষারেষি, ঝগড়া-বিবাদ, সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি, পরিবারিক বন্ধনের ঝামেলা, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, নৈতিক অধঃপতন, ব্যক্তিত্বের বিপর্যয়, মানসিক বিকার, নেশা, মদ্যপান এবং সামঞ্জম্যহীনতা। এতসবের মধ্যেও আশ্চর্য এক সত্য যে, যুদ্ধশিশুরা বড় হয়েছে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। পারস্পরিক নির্ভরতায় মধ্য দিয়ে। তাদের মধ্যে কোনাে রকমের পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা এবং সম্পর্কের অবনতির কোনাে দৃষ্টান্ত নেই। যে দুটো পরিবারে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তাদের সম্পর্কে আমরা পড়েছি পঞ্চম অধ্যায়ে । বিখ্যাত মনঃসমীক্ষণবিদ John Triseliotis-এর মতে পােষ্যদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলাে উৎকৃষ্ট মানের যত্ন এবং সম্পর্ক। সরলভাবে বললে, ট্রিসলিওটিসের মূল বক্তব্য অন্যান্য গুণাগুণের হেরফের ঘটলেও পরিবারে ভালােবাসা একাই অন্য সব ঘটতি পূরণে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম।”৪৩
যুদ্ধশিশুদের জন্মদেশ সফর
১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ এর আমন্ত্রণে কানাডীয় বহুজাতিক দত্তক নেটওয়ার্ক সংস্থা কানাডাতে দত্তক নেয়া ছেলেমেয়ে এবং তাদের বাবা-মায়েদের জন্য বাংলাদেশে এক সফরের আয়ােজন করে। ডেল ও ডনা উলসির নেতৃত্বে পরিচালিত ঐ সফরের বিষয়ে আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে বিস্তারিত পড়েছি। ক্যানাডপ্ট সমর্থক গ্রুপটি ডনা উলসির পরিচালনায় কানাডাতে সমন্বয়করণের কাজে নিযুক্ত । আমরা উনা ও ডেল উলসি সম্পর্কেও পঞ্চম অধ্যায়ে অনেক কিছু পড়েছি। তাদের। সফরকালে বাংলাদেশে একটি অনাথ আশ্রম ১.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ১৩ একর জমির ওপরে প্রতিষ্ঠিত, শ্রীপুর কমিউনিটি কমপ্লেক্স প্রজেক্টের উদ্ধোধন হয়েছিল। ঢাকা থেকে প্রায় ৭২ কি.মি উত্তরে এ প্রকল্প ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও মন্ট্রিয়লস্তু Families For Children (FFC)-এর অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে ইতােমধ্যে পড়েছি কেমন করে FFC ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ১৫ টি যুদ্ধশিশুকে বাংলাদেশ থেকে কানাডীয় পরিবারের দত্তক শিশু হিসাবে প্রতিপালনের জন্য কানাডাতে নিয়ে আসেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদ বাংলাদেশি অনাথদের মঙ্গলবিধানে ব্যক্তিগত আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং শিশু পল্লীকে “অনাথ। শিশুদের যত্ন ও শিশুকল্যাণের আদর্শ নিকেতন বলে প্রশংসা করেন” (The Toronto Star, 13 February, 1989) । ২৭ জন দত্তকায়িত ছেলেমেয়ে এবং তাদের কয়েকজনের মা-বাবা ২৭ শে জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলদেশে সাতদিনের এক ঝটিকা সফরে কানাডা ত্যাগ করেন। ঔ গ্রুপের সাথে সফরে আরও ৫ জন যুদ্ধশিশুও (রানী, রায়ান, ল্যারা, রাজিব ও আমিনা) ছিল । তাদের সাথে ছিলেন রবিন ও বারবারা (রানীর মা-বাবা), ডনা (আমিনার মা) এবং ডেইল ও ডরিন (রায়ানের মা-বাবা), এশিয়ায় (ব্যাংকক) দু সপ্তাহের সফরের মধ্যে বাংলাদেশে (ঢাকা) তাদের সফর ছিল এক সপ্তাহের । বাংলাদেশি পােষ্যদের জন্য সেটা ছিল তাদের প্রথম সফর। গ্রুপটির সঙ্গে আরও ছিলেন সংবাদিক, প্রতিবেদক ডালিয়া রাইখ এবং ক্যাথি ওয়ালিস এবং আলােকচিত্র ও ক্যামেরা ব্যক্তিত্ব এড হীল ও ওয়েইন জেনিংস যারা The London Free Press পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। ওরা সবাই এক সাথে ভ্রমণ করেন। ডাঃ মাইকেল এ্যালেন। তখন টরন্টো ইস্ট জেনারেল হাসপাতালে শিশু শাল্য চিকিৎসাবিদরূপে কর্মরত এবং ফ্রাঙ্ক জোনস তখন The Toronto Star পত্রিকার কলামিস্ট। ওরা কয়েকদিনের জন্য ঢাকা গিয়েছিলেন উদ্বোধনীর সময়ে এবং সেখান থেকে গ্রুপের কার্যকলাপ বিষয়ে কানাডাতে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠান। এমিল গােভরাে সে সময়ে ঢাকাতে নিযুক্ত কানাডীয় হাই কমিশনার । তিনি গ্রুপটিকে উষ্ণ ও উৎসবমুখর অভ্যর্থনা জানান। সে সময়ে ব্যানার, পতাকা ও রঙিন অঙ্গসঙ্গ উপস্থিত সবাইকে আমােদিত করেছিল। গােভবাের অফিস গ্রুপকে দুটি বাস সরবরাহ করেন যাতে তাদের যানবাহনের সমস্যা মেটে এবং এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেতে কোনাে অসুবিধা না হয়। গ্রুপটি সুন্দরবন হােটেলে অবস্থান করে বাস দুটো পুরাে সাতদিন তাদের ব্যবহারের জন্য তাদের সাথে ছিল ।
প্রথম দিনে গ্রুপ শ্রীপুরে অবস্থিত FFC আয়ােজিত অনাথ আশ্রম (Children’s Village) প্রকল্পটি দেখতে যায় । আবেগে অস্থির ছেলেমেয়েরা উত্তেজিত এবং ভীতও ছিল। উত্তেজিত ছিল এ জন্যে যে তারা তাদের জন্মদেশে তাদের উৎস খোজার সন্ধানে কিছুটা সময় কাটাবে; আবার ভীতও ছিল কারণ তারা ঠিক জানত না তারা বাংলাদেশে কী দেখবে । ঝকঝকে নতুন শিশু পল্লীতে একটি শশাবার ঘর, মসজিদ, স্কুল, হাসপাতাল, কমিউনিটি হলাে এবং একটি হাতে কলমে কাজ শেখার কেন্দ্র ছিল। ওখানে প্রায় ৭০০ অনাথের স্থান সঙ্কুলান হবার ব্যবস্থা ছিল। আশ্রমের ভেতরে গিয়ে তারা দেখতে পেল অনেক ছেলেমেয়ে সেখানে প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গ । অনেকের কোনাে ক্রাচ ছিল না। অনেকের দাঁতে গর্ত হয়ে গিয়েছিল এবং বলতে গেলে পুরােপুরিভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । কারাে পেট ফোলা শরীরে খােলা ঘা এবং ক্ষত । তাছাড়া অনেক শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল।
অনেকের নানা অঙ্গ অচল। তারপরও তরুণ কানাডীয়রা। রাস্তায় যারা চূড়ান্ত অবহেলায় পড়ে পড়ে ভাগ্যের মার খাচ্ছে, তাদেরকে দেখে মনে মনে। ভাবে যে তুলনামূলকভাবে শিশু পল্লী ও শিশু ভবনে যত্ন পাওয়া শিশুদের চেহারায় কী সুন্দর। দ্রষ্টব্য পার্থক্য। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমিনা বলে প্রথম দিন বেশিসংখ্যক অনাথদের এক জায়গাতে দেখে কিছুক্ষণের জন্য সে ভয়ে শিলীভূত হয়ে গিয়েছিল। আমিনা সে অদ্ভুত অনুভূতির কথা মনে করে তার সে সময়ের ভাবনা ব্যক্ত করে এভাবে: “হে আমার সৃষ্টিকর্তা, এ অবস্থাতাে আমারও হতে পারত।” এখানে একটি বিষয় গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে যে, এ ধরনের ভাবনাটা যে আমিনার একার ছিল তা নয়, অন্যান্য অনাথের মনেও ওরকম ভাবনার ওলট পালট হয়েছিল, বিশেষ করে যখন তারা অন্য শিশুদের সঙ্গে ছিল । স্বভাবতই তারা ভয় পেয়েছিল এটা ভেবে যে তারা নিজেরাও আজ এখানে এদের মতাে কষ্টে বাস করতে হয়তাে বাধ্য হতাে যদি তাদের কানাডীয় বাবা-মায়েরা সৌভাগ্যক্রমে তাদেরকে কানাড়া না নিয়ে যেতেন দত্তকায়নের মাধ্যমে। এ ধরনের শােচনীয় দৃশ্যগুলাে তাদের মনকে এত আবিষ্ট করে রেখেছিল যে এটা তাদের জন্য বেশ পীড়াদায়ক ছিল, বিশেষ করে প্রথম। কয়েকদিন । নিজের চোখে বাংলাদেশে নগ্ন বাস্তবতার রূপ দেখার পর এত মানুষের কষ্ট তরুণ। কানাডীয়দের মনের অবস্থা উথাল পাতাল করে দিয়েছিল । জীবনে প্রথমবারের মতাে তারা শিশুদের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে দেখা আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে কেমন করে শিশুরা ফেলে দেয়া খাবারের অবশিষ্ট অংশ এবং ভাঙাচুড়া কুড়ােচ্ছে। কানাডীয় কিশাের কিশােরীর কাছে এর সবকিছুই ছিল নতুন, এমনকি ছড়ানাে এলােমেলাে, নােংরা ঢাকা শহরের গন্ধ, বাংলা ভাষায় গাওয়া গানের কলি এবং সর্বত্রগামী জনতা ও ফেরিওয়ালার চিৎকার ও দৃশ্যাবলি। পেছনের দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক যুদ্ধশিশুরা বলে যে এ অবিস্মরণীয় সফরের মাধ্যমে তারা তাদের বাড়ির প্রতি (অর্থাৎ কানাডা, যে দেশে তারা বড় হয়েছে) তাদের আকর্ষণ ও ভালাে লাগার যুক্তি নতুন করে সাজানাের ও বােঝার সুযােগ লাভ করেছিল। তাৎক্ষণিকভাবে তারা। শিখে যে ভাগ্যক্রমেই তাদের বাবা-মায়েরা তাদের দত্তক নিয়ে কানাডাতে বড় হওয়ার সুযােগ করে দিয়েছিলেন । কিশাের বয়সের যুদ্ধশিশুদের আবেক এক নতুন চূড়ায় আরােহন করেছিল যখন তারা অনাথ আশ্রমের রেজিস্টার বই-এ হাত দিয়েছিল। ১৬ বছর বয়সের পাঁচজন, ল্যারা, রানী, আমিনা, রাজিব ও রায়ান, তাদের নথিবদ্ধ জন্মবৃত্তান্তের একটি অংশ দেখবার জন্য সাহস সঞ্চয় করে তৈরি হয়েছিল। ওটা তাদের নিজের চোখে দেখা যেন তাদের জন্মবৃত্তান্তের একটি টেমপ্লেট যাতে তাদের আত্মপরিচিতি ও বংশধারা বৃত্তান্ত রেকর্ড করা হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে, সে টেমপ্লেটে ছিল শুধু তাদের জন্মের তারিখ এবং জন্মকালের ওজন। ল্যারা এতই উত্তেজিত হয়েছিল যে সে জোরে চেঁচিয়ে উঠে তখন সে তার নাম তালিকায় প্রথমে দেখতে পায় ।
“নামটা দেখে আমার বিশ্বাস হয়নি। মনে হয়েছিল আমি আমার অতীত দেখতে পাচ্ছিলাম,” ল্যারা তাদের সহযাত্রী সংবাদ প্রতিবেদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার চিৎকারে। ল্যারা যে নতুন আনন্দে তার নাম “আবিষ্কার করে, সে মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রতিবেদক ল্যারার বক্তব্যটি হুবহু লিখেছিলেন: “আমি কাঁদছিলাম, কিন্তু আমি জনতাম আমি আনন্দে কাঁদছিলাম, না কি দুঃখে, সে সময়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল আবেগে উল্লাসিত ল্যারা। একই অবস্থা হয়েছিল রানী, রায়ান, আমিনা ও রাজিবের, যারা একই রেজিস্টার বই-এ নিজেদের নাম স্বচক্ষে দেখেছিল। সেদিনের অভূতপূর্ব আনন্দের অনুভূতি ওদের দখল নিয়েছিল। ওরা একে অপরেকে তুরীয় আনন্দে আলিঙ্গন করেছিল । পরিণত বয়স না হলেও কিশাের বয়সেও তাদের পরিপক্কতা অনেক বেশি ছিল। কানাডীয় জীবনে দেখা ছবিগুলাে। পাশাপাশি সাজিয়ে সে সময়ে তারা একটি সুন্দর ছবি নির্মাণ করেছিল তাদের অন্তরে। তারা এখনও মনে রেখেছে কেমন করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে রেজিস্টার বই-এর পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক যেন নামগুলাে “আবিষ্কার করেছিল সেদিন। যতটুকু তথ্য ছিল ততটুকুতেই সে সময়ে তারা সন্তষ্ট দিল। তাদের আর কোনাে তথ্য সন্ধানের প্রয়ােজন ছিল না। জন্ম ও পরিত্যাগের সত্য গল্পটি খুঁজে বের করার যে তাগিদ ছিল, সেটা যেন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল তাদের মন থেকে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে এ পাঁচজন যুদ্ধশিশু যেন জীবনবৃত্তান্তের ব্যবহার্য এক বিশ্বসযােগ্য বর্ণনার খোঁজ পেয়েছিল। সে মুহূর্তে তারা অনুভব করতে থাকে যে তারা পৃথিবীতে যেন আরও বিশ্বাসযােগ্য আস্থার পাত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠত হতে পেরেছে। তারা সবাই উপলব্ধি করে। তারা কোথায়? তারা কারা? কোনাে কৃষ্টি বা গােষ্ঠীর সাথে তারা সংশ্লিষ্ট? তাৎক্ষণিকভাবে তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা হৃদয়ঙ্গম করে যে, তাদের অতীত ইতিহাস তখন আর অচেনা অজানা ছেলেমেয়েদের ইতিহাস হিসাবে গণ্য করা হবে না । “নতুন আবিষ্কৃত তথ্য পরিচিতি যেন সাথে সাথে সে শূন্যস্থান পূরণ করে দিয়েছিল। যে কানাডীয় বাবা-মায়েরা বাংলাদেশি সন্তানদের নিয়ে গিয়েছিলেন তারা, যেমন- ডনা উলসি, সে সময়ের রােমন্থন করতে গিয়ে বলেন যে যুদ্ধশিশুদের বাংলাদেশ সফর করাটা। স্থানীয় আয়াদের (যারা শিশুদের যত্ন করেছিল) জন্য এক চিরস্মরণযােগ্য ব্যাপার ছিল। অবাক হবার কিছু নেই, তাদের অনেকে নিজেরাই অনাথ ছিল। ঐ সময়ে তাদের বয়স ছিল খুবই অল্প । হাফিজা নামে যে আয়া আমিনা এবং আরও কয়েকজনকে দেখাশােনা করেছিলেন, তিনি তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি সেদিন। এটা যেন তাদের জন্য ছিল এক পুনর্মিলনের ক্ষণ, যার প্রভাবে আবেগের ঢেউ উপস্থিত সকলকে ভাসিয়ে নিয়েছিল। ঢাকায় নানা কাজকর্ম, খেলাধুলায় আমােদ প্রমােদে ব্যস্ত থাকার পর গ্রুপ যখন বাংলাদেশ ত্যাগ করে তখন সকলেই বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তারা নিজেরাই বলাবলি করেন যে গ্রুপের পক্ষে যদি আবার কখনাে বাংলাদেশে আসা সম্ভব হয়, সেটা শীঘ্রই হবে না । শেষ পর্যন্ত তারা বাড়ি ফেরে অত্যন্ত সন্তষ্টচিত্তে। রায়ানের মতে সফরটি তাদের জন্য চোখ খুলে। দেয়ার মত অভিজ্ঞতার খোজ দিয়েছে। তারা তথ্য যেমন পেয়েছে, মানুষের কাছ থেকে। হৃদয়ের উষ্ণতাও পেয়েছে; দারিদ্র ও দুর্দশার কথা তারা যতই শশানে থাকুক না কেন।
যে সব বাবা-মায়েরা সাথে ছিলেন, তাদের জন্য এটা তাৎপর্যপূর্ন ভ্রমণ হয়েছিল বহু আবিস্কারের চমক নিয়ে।
যে দেশে যুদ্ধশিশুরা দত্তকয়িত হয়েছে সে দেশের, অর্থাৎ কানাডার, জন্যও তাদের প্রশংসা বেড়েছে বৈ কমেনি। কানাডীয় বাবা-মায়েরা আনন্দভরে দেখেছিলেন তাদের ছেলেমেয়েরা কীভাবে অনাথ আশ্রমের রেজিস্টার বই-এ নিজেদের নাম দেখে অবাক বিষ্ময় একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিল, আশ্বস্ত করেছিল। তাদের উৎসের খোঁজ করা পােষ্যদের নিজেদের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাবা-মায়ের জন্যও। ওদের বাংলাদেশ সফরের তাৎক্ষণিক ফলাফলের মধ্যে ছিল এক নতুন জাগৃতি বা সচেতনা। যা তাদের পরিবারকে আরও ঘনিষ্টতা দিয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে প্রথম কয়েকবছর তারা সভা-সমিতি করেছে, দান সংগ্রহের জন্য গাড়ি ধােয়া থেকে শুরু করে তহবিল সংগ্রহের জন্য নানা অভিযানে সহায়তা যুগিয়েছে। পেছনের দিকে তাকিয়ে তারা বলে বাংলাদেশে যাওয়াটাকে তারা একটি অত্যন্ত মন ছুঁয়ে যাওয়া পুনর্মিলনী হিসাবে বিবেচনা করে। যদিও ওটা তাদের জন্মদাত্রী মা আথবা অনুমিত (জন্মদাতা) বাবার সঙ্গে পুনর্মিলন ছিল না। এটাকে। তারা দেখে তাদের জীবনের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে। যুদ্ধশিশু এবং অন্যান্য পােষ্যদের এ সফরকে ঠিক কীভাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে সেটা নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ কিছু লেখালেখি হয়েছে । এটাকে “বাড়ি আসা” বলা যেতে পারে কিনা, যেমন নাকি সংবাদ মাধ্যম এটাকে তাই বলেছে; অথবা বাংলাদেশি পােষ্যদের মাতৃভূমি সফর” সেটা নিয়েও বেশ বলাবলি হয়েছে। এ কথা স্বীকার্য যে, এসব তরুণ কানাডীয়রা তখন বয়ঃসন্ধিকাল পেরুচ্ছিল। সে কথাটি মনে রেখে বলা যেতে পারে যে তাদের জীবনে এটা বােধ হয় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সময় ছিল। অনেকে এটাকে focal point যা আত্মপরিপূরণকারীর অভিজ্ঞতা হিসাবে গণ্য করতে পারেন। এ অভিজ্ঞতাটুকু শুধূ যে যুদ্ধশিশুদের বেলায় প্রবলভাবে প্রভাব ফেলেছে তা নয়। এটা অন্যান্য অনাথ যারা একই সাথে সফরে গিয়েছিল তাদের বেলাও প্রযােজ্য। কয়েক বছর পর পােষ্য ছেলেমেয়েরা অ্যালেক্স হেইলির Roots এর নাট্যরূপ উপস্থাপনার সঙ্গে পরিচিত হয়। সে সময়ে ছবিটি। দেখে মার্কিন ও কানাডীয় জনসাধারন গভীরভাবে প্রভাবিত হন। প্রাপ্তবয়স্ক যুদ্ধশিশুরা, তখন ছবিটি থেকে মূল শিক্ষণীয় বার্তা সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এ কথা বলা নিপ্রয়ােজন যে দত্তক বিষয়ের সংলাপে একজনের বংশধারা পুত এবং পবিত্র বলে বিবেচনা করে বিশেষ গুরুত্বারােপ করা হয়েছে। সংক্ষেপে, কারাে পরিচিতি জানতে বংশ পরিচয়। অপরিহার্য।
ওরা কানাডাতে ফেরার পরপরই The London Free Press-এ ক্যাথি ওয়ালেস একটি ৩০ মিনিটের ডকুমেন্টারি লিখেন যার শিরােনাম ছিল “Children of Bangladesh.” শিশুদের। জন্মভূমিতে তাদের সংক্ষিপ্ত সফর বিষয়ক ছবিটিতে বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেয়া বর্তমান। কানাডীয় ছেলেমেয়েদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও মতামত সন্নিবেশ করা হয়। সেটা ১৯৮৯ সালের ৫ই মার্চ প্রথম দেখানাে হয় CCPL TV-তে। এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় যে যদিও ১৯৭৯-এ যুদ্ধশিশুদের “অপ্রার্থিত” ও “অবাঞ্চিত শিশু হিসাবে গণ্য করে তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, মাত্র, ১৬ বছরের মধ্যে একই ছেলেমেয়েরা যেন সম্ভাব্য সম্পদ হয়ে বাংলাদেশে এসেছিল।
প্রেসিডেন্ট এরশাদ ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ নিয়ে সানন্দে, বাংলাদেশিদের দেখানাের চেষ্টা করেন এসব “দিয়ে দেয়া” শিশুরা কীভাবে উচ্ছ্বাস জীবন ভােগ করছে শুধু দত্তকায়িত হবার সৌভাগ্যে। শিশু পল্লীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিস্মিত হয়ে বাংলাদেশিরা স্বচক্ষে দেখেছিল দত্তকব্যবস্থার এক সফলতার জলন্ত দৃষ্টান্ত। প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশিদের জ্ঞানগােচরে আসে ১৬ বছর আগের সেসব “অনাকাক্সিক্ষত অনাথ এবং যুদ্ধশিশুরা” হঠাৎ করে যেন ভালােবাসা ও আকর্ষণের পাত্র হয়ে ওঠে। “এটা অদৃষ্টের পরিহাস যে, আমরা (যুদ্ধশিশুরা) সমাজের বর্জরূপে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম এবং ফিরে এসেছি প্রায় খ্যাতিমান ব্যক্তিরূপে নতুন নামে নতুন নাগরিকত্ব এবং জীবনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। পুরাে ব্যাপারটাকে ভাগ্যের একটি মােচড় বলে আমিনা এ মন্তব্যটি করে।
যে পাঁচজন যুদ্ধশিশু অন্যান্য বাংলাদেশি পােষ্যদের সাথে ছিল, তাদের সবাই উষ্ণ অনুভব নিয়ে কানাডা ফিরে আসে। নিঃসন্দেহে তারা বাংলাদেশের প্রতি একটা তাৎক্ষণিক টান অনুভব করেছিল – এমন এক দৃঢ়বন্ধন যেটা তাদের এক নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। সে সময়ে তারা সাগ্রহে সংশ্লিষ্ট হতে চেয়েছে তাদের জন্মভূমির সাথে । কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে যা হলাে তাতে দেখা গেল যে তাদের কানাডীয় বাড়িতে ফিরে এসে সেখানেও উপলব্ধি করে যে তারা যেন তাদের মাতৃভূমি” কানাডাতে ফিরে এসেছে। তারপর ক্রমে ক্রমে তাদের জন্মভূমির জন্য তাদের ভালােবাসা ও অনুরাগ হ্রাস পেতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রানােচ্ছল যুদ্ধশিশুরা নির্বিঘ্নে কানাডীয় জীবনের কার্যক্রমে লিপ্ত হয়ে যায়। জাতিগত ও কানাডীয় পরিচিতি সাক্ষাক্তারের সময় প্রত্যেক যুদ্ধশিশু ব্যক্ত করেছে পরিচিতি বলতে সে কী বােঝে। তাদের কথামতাে পরিচিতি অনেক কিছু দিয়ে তৈরি হয় যাতে অন্তর্ভুক্ত থাকে জন্মসংক্রান্ত বাস্তবতা, যেমন জাতিগত ও লৈঙ্গিক পরিচয় এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা; ধর্ম বিষয়ক অভিজ্ঞতা, আরও অন্যান্য ঐতিহাসিক ও নিজের সম্পর্কে বংশানুগতিক বিষয়ের তথ্য । দত্তকগ্রাহী মা-বাবা এবং তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি বিষয়ে কথাবার্তা থেকে তাদের জীবনচক্র সম্পর্কে অনেক আগ্ৰহ উদ্দীপক বিষয়ে জানা সম্ভব হয়েছে। তাদের কোনাে ইতিবাচক নৃতাত্ত্বিক চেতনা এবং নৃতাত্ত্বিক শিকড় চেহারায় ফুটে ওঠে কিনা সেটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটি জরুরি সত্য। বেরিয়ে আসে। যে সত্যটি হলাে তাদের নিজস্ব বােধ তাদের পরিবারের অন্যান্য অবস্থান বিষয়ে – যে দত্তকায়িত নেয়া শিশুদের পরিচিতি তৈরির বিষয়টি অনন্য নয়। তারা এটা সমস্বরে বলে যে দত্তকের জটিলতা প্রায় ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের মােকাবিলায় দাঁড় করিয়ে দেয় পােষ্য ছেলেমেয়ে ও তাদের পরিবারকে।
এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় দিকটি হলাে যে, কোনাে যুদ্ধশিশু নিজের পরিচিতি বিষয়ে বা নিজের সম্পর্কে কোনাে সন্দেহের অনুভূতির ইঙ্গিত প্রকাশ করেনি বা দেখায়নি । সাধারণত কারাে আত্মমর্যাদাবােধ কম হলে এবং আচার ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিলে সে সব বৈশিষ্ট্যগুলাে প্রতিফলিত হয় । আরও উল্লেখযােগ্য দিক হলাে যে, তারা অন্যান্য সংখ্যালঘু গােষ্ঠীকে এড়িয়েও চলেনি । অন্যভাবে বলা যায় যে, তাদের ত্বকের রং শ্বেতকায় বাবা-মায়ের ত্বকের রং থেকে ভিন্ন দেখেও তারা সে সত্যকে প্রকাশ্যে বা গােপনে প্রত্যাখান করেনি। তার বদলে তাদের অনন্য পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যে বিশেষ পরিবারগুলি তাদের বড় করে তুলেছে তাদের সমাহারে এক পরিচিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়। ঐ অর্থে তারা অন্যান্য পােষ্যদের মতাে শ্রেণিহীন ও অত্মমর্যাদাহীন হয়ে যায়নি । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা জানতে পারে না তারা কারা বা কে? যার ফলে একরকমের সন্দেহজনক এবং ঝামেলাপূর্ণ পরিচিতির মােড়ক বা লেভেল গায়ে সেঁটে দিয়ে তারা নিজেদের সম্পর্কে নিচু ধারণা তৈরি করে নেয়। আমি কে? প্রত্যেকে সফলভাবে এ প্রশ্নের উত্তর বের করেছে। সাধারণভাবে বললে পরিচিতি তৈরির প্রক্রিয়ায় নৃতাত্ত্বিক বিবেচনা প্রােথিত করা থাকে, যে অবস্থা টিকিয়ে রাখা নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি জানার উপর প্রতিষ্ঠিত । যুদ্ধশিশুদের ক্ষেত্রে নৃতাত্ত্বিক বিবেচনা তেমন জোর দিয়ে দেখা হয়নি। তাদের কানাডীয় বাবা-মায়েরা বরং এটাকে একটু কম প্রাধিকার দিয়েছেন। যুদ্ধশিশু এবং তাদের বাবা-মায়ের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের জন্মের উৎস এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচয় তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচিতির একটি খন্ড মাত্র ছিল, যা মৌলিকভাবে বংশানুজাতির নিয়ন্ত্রক উপাদান (genes) হিসাবে গণ্য করা হয় । আমরা প্রথম অধ্যায়ে দেখেছি তথ্যাভাবে যুদ্ধশিশু সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা সম্ভব হয়নি যেহেতু জন্মদাত্রী মায়েরা তাদের নাম পর্যন্ত দিতে চাননি, আর জন্মতাদা পিতারাতাে সে সময়ে যুদ্ধবন্দি হিসাবে ভারতে। কাজেই বংশবৃত্তান্তের বিষয়ে কোনাে তথ্যই পাওয়া যায়নি যা নথিবদ্ধ করার মতাে ছিল। কাজেই যৌন শিকারের ফলশ্রুতিতে যাদের জন্ম, সেখানে তারা যে কোথা থেকে আসলাে বা কী তাদের বংশপরিচয়, সেটা নির্ধারণ কোনােভাবে সম্ভব নয়। আবার প্রকৃতপক্ষে এটাও সত্য যে তারা যে সব পরিবারে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিশে আছে, সেসব পরিবারের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে তারা পরিচিত হতে পারে না। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষরূপে বেশ উল্লেখযােগ্য কঠিন কাজের ভার নিয়ে সামাজিকীকরণ, ব্যক্তিকরণ এবং আত্মপরিচিতি নির্মাণে তারা সফল হয়। শুধু তা না, তারা তাদের বৈচিত্রময় এবং বহুগগাষ্ঠীয় পরিবারে বড় হয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য আচরণ, চলাফেরা, কথাবার্তা ও মেলামেশার কৌশলগুলাে রপ্ত করতে সক্ষম হয়। তাদের মতামত ও মন্তব্যের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কোনাে কোনাে যুদ্ধশিশু তাদের জাতিগত পটভূমি সম্পর্কে জানতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিল।
যেমন বলা যায়- রায়ান, রানী, আমিনা, ল্যারা, রাজিব ছাড়া অন্যরা যখন বাংলাদেশ সফর শেষে কানাডা ফিরে আসে তখন তাদের চিন্তা ভাবনায় বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশি দুবিষয়টি বেশ অনেকদিন ছিল। আবার অনেকে, যেমন- ক্রিস, অনিল, শ্যামা, হােজে, যুদ্ধশিশু “ক” এবং “খ” একেবারে অনাগ্রহী না হলেও বাংলাদেশি বা বাংলাদেশ (বা তাদের জন্মভূমি) সম্পর্কে উদাসীন ছিল যা আজও তাদের মধ্যে বিরাজ করে।
১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি যখন “দৃশ্যমান সংখ্যালঘু” শব্দাবলি চালু হয় কানাডা সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা কর্মসূচির কারণে, যুদ্ধশিশুরা তখনও কিশাের, ক্রমে ক্রমে তারা যখন বড় হলাে, তখন তারা বুঝতে শিখে যে ঐ শব্দাবলির মূল অর্থ । সংক্ষেপে, সরকারের সংগা অনুযায়ী “দৃশ্যমান সংখ্যালঘু” বলতে তাদেরকে বােঝায় যারা জাতিগতভঅবে শ্বেতাঙ্গ নয় অথবা যাদের ত্বকের রং সাদা নয় অর্থাৎ একইসাথে যারা কোকেশীয় এবং কানাডীয় আদিবাসীও নয়; তাদেরকে কানাডীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী “দৃশ্যমান সংখ্যালঘু হিসাবে পরিগণিত করা হয়। মূলত এ ধরনের আত্মপরিচিতি উদ্দেশ্য হলাে চাকুরি ও জীবিকা অর্জনে। সকলের সমান সুযােগ দেয়ার নিশ্চয়তা দান । কিন্তু পুরাে প্রক্রিয়াটি নির্ধারণ করা হয় আত্মপরিচিতির মাধ্যমে, অর্থাৎ স্বীয় উপলব্ধির মাধ্যমে। এখানে অন্য কেউ একজনের গােষ্ঠীয় বা বর্ণীয় সংশ্লিষ্টতা আরােপ করতে পারে না। আমরা এ অধ্যায়ে দেখতে পাবাে যুদ্ধশিশূদের নিজ নিজ ধারণা এবং নিজ পরিচয় স্থাপনে তাদের উপলব্ধির ধারা পরিনত বয়স। হলেও যুদ্ধশিশুরা তখন জানতে পারে গােষ্ঠী বা বর্ণগত পরিচয় নির্ধারণের প্রক্রিয়া যেটার সনাক্তকরণ পুরােপুরিভাবে স্বতঃপ্রবৃত্ত অর্থাৎ কোনােভাবেই বাধ্যতামূলক নয় ।
প্রাপ্তবয়স্ক যুদ্ধশিশুদের অনেকে এ বিষয়ে জানে যে মিশ্র জাতির পােষ্যদের জাতিগত সচেতনতা এবং আত্মপরিচিতির ইস্যুগুলি নিয়ে যদিও Leon Chestang এবং Rita Simon-এর মতাে অনেকেই গভীরভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণা করেছেন, এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফলাফল কেউই এখনও নির্ধারণ করতে পারেননি। পরিচিতি নির্মানের বিভিন্ন পর্যায়ের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবার জন্য পােষ্যদের দুটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল অতীত ঘটনাবলি সম্পর্কে এবং সংশ্লিষ্ট অনুভূতিগুলাের বিষয়ে যেগুলির হয়তাে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে:
• বর্ণের দিক দিয়ে দৃষ্টিপাত করলে তারা নিজেদের সম্পর্কে কী উপলব্ধি করে? তাদের কি নিজের পরিচিতি বােঝার মতাে অনুভূতি রয়েছে? কানাডীয় শ্বেতাঙ্গ মা-বাবার থেকে আলাদা তাদের কী জাতিগত পরিচয় রয়েছে? বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ও আগ্রহ কি তাদের পরিচিতি তৈরিতে কোনাে না কোনাে ভাবে প্রভাব ফেলেছে? আমরা দেখতে পাবাে, কানাডাতে বেড়ে ওঠা যুদ্ধশিশুদের জাতিগত পটভূমির বিচারে নিজেদের কোনাে সংঘাতময় পরিস্থিতির মুখােমুখি হতে হয়নি। যদিও তাদের মা-বাবা ও তাদের জাতীয়তাবােধের জনগন সেখানে পৃথক পৃথক, তবুও তারা তাদের বাড়িতে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে খাপ খাইয়ে বড় হয়েছে। আবার বাড়ির ভিতরে অথবা বাড়ির বাইরেও তারা কখনাে কোনাে দ্বন্দ্ব বা বিরােধ অনুভব করেনি । প্রকৃতপক্ষে পােষ্যদের জীবনবৃত্তান্তের ঐতিহাসিক বর্ণনা যা সত্যাশ্রিত কানাডীয় বহু সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে নানা
উৎপাদনগুলাে যুদ্ধশিশুদের বৈচিত্রময় পরিবারের সম্পর্ক স্থাপনে এবং নিজস্ব ভিন্নতা এবং একাত্মতা নির্ধারণে সাহায্য করেছে। বন্ধুবান্ধবদের মহলে অথবা প্রতিবেশিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় তাদের সামাজিক মর্জাদা প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ায় তারা কখনাে এমন অনুভব করেনি যে তারা সংখ্যালঘু কোনাে জনগােষ্ঠী অথবা কোনাে না কোনােভাবে প্রতিকূল অবস্থায় অস্তিত্বমান।
যুদ্ধশিশুদের নিজস্ব ভাষ্যমতে, আমরা দেখতে পাবাে বিভিন্ন পটভূমির মানুষের জমায়েতে সামাজিকতার সর্বাপেক্ষা অধিক সুযােগ করে দিয়েছে নানা জাতিগােষ্ঠীর মানুষের সাথে স্বহজভাবে মেলামেশার দক্ষতা এবং সামাজিক কৌশলের মাধ্যমে ।
এ কথা স্বীকার্য যে এই পােষ্যদের পরিচিতি একটি একরৈখিক নৃতাত্ত্বিক পরিচয় যেমন নয়, তেমনি ওটা কোনাে দ্বিত্ত্ব পরিচিতিরও নিয়ামক নয়। তাদের নিজস্ব ভাষ্যমতে তারা “বাংলাদেশে জন্ম নেয়া কানাডীয়” – এ বিষয়ে তারা সবাই একমত । নিতান্ত সাধারণ এক যুক্তি দিয়ে তারা দাবি করে যে মুখ্যত কানাডাই তাদের দেশ, যেখানে তারা ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। বাংলাদেশকে তাদের দেশ বলতে ভাবতে পারে না। কারণ সেখানে জন্মগ্রহণ করলেও শিশু অবস্থায়ই তাদেরকে বাইরে “পাঠায়ে দেয়া হয়। অবশ্য দত্তকায়নের মাধ্যমে। কানাডীয় বাড়িতে শিশু অবস্থা থেকে লালিত পালিত হওয়ার দরুণ তাদের জন্য কোনাে রকমের উপযােজনের প্রয়ােজন হয়নি। তারা কানাডাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের নিজ দেশ ভেবে বড় হয়েছে, স্বীয় অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। যদিও তারা যে বাংলাদেশে জন্মেছে সে কথাটি স্বীকার করে খােলাখুলিভাবে । তাদের মাতৃভাষা মানে ইংরেজি অথবা ফরাসি (যারা কিউবেক প্রদেশে বড় হয়েছে এবং যাদের মা-বাবা ফরাসিভাষী) মানে কানাডীয়। তাদের ভাষা ব্যবহারের ভঙ্গি, শব্দচয়ন, বাক্যের ছন্দস্পন্দন, কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, সবই কানাডীয়, তেমনি আচারব্যবহারে, চাল-চলনে, পপাশাক-পরিচ্ছদে, অঙ্গ-প্রতঙ্গ সঞ্চালনে তাদের স্বকীয়তা ধরা পড়ে, তাদের কানাডীয় ব্যক্তিত্ত্ব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। যদিও তারা বড় হয়ে ওঠার সময় দেখেছে যে তাদের ত্বকের রং তাদের মা-বাবার ত্বকের রং থেকে আলাদা, তবুও তারা তাদেরকে তাদের মা-বাবা মেনে তাদের সাথে একাত্মবােধ করেছে প্রথম থেকেই। তারা কানাডীয় পরিচিতির খন্ড খন্ড প্রকাশিত রূপ তা হােক পােশাকে, ভাষায়, সামাজিক নেঠওয়ার্কে, সঙ্গীতে, শিল্পে, খেলাধুলায়, খাবারে, সর্বত্র ডুব দিয়ে আপদস্ত ক কানাডীয় হবার ব্রতে যােগ দেয়। অনেকগুলাে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ ও আন্তবর্ণীয় ভাইবােনের সঙ্গে পরিবার প্রধানরা ১০০ ভাগ কোকেশীয় (শেত্ত্বাঙ্গ), এসবের মাঝেই তারা বড় হয়েছে তাদের কানাডীয় পরিবারগুলােতে। আমরা ইতােমধ্যে দেখেছি যে মা-বাবার সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক তাদেরকে কানাডীয় হয়ে ওঠাকে আরও দৃঢ় করেছে। আরেকভাবে বলা যায়, তাদের কখনাে এক মিনিটের জন্যও মনে হয়নি, যে তারা ভিন্ন। তাদের বাবা-মায়েদের চেয়ে (দেখতে) ভিন্ন হলেই যে তারা তাদের চেয়ে কোনাে অংশে কম, সেটা তারা কখনাে ভাবেনি। পরিবর্তে কানাডাকে তাদের বাড়ি” বিবেচনা করার মাধ্যমে তারা নিজেদের কানাডীয় হিসাবে দেখছে, ব্যস ঐ পর্যন্ত । এ বিষয়ে যত যুদ্ধশিশুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, একথা তাদের সবার বেলাতেই প্রযােজ্য যা যুদ্ধশিশুদের দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে। নানা আলােচনায় প্রকাশ পেয়েছে যে তারা নিজেদের ত্বকের রং ছাড়া অন্য সব বিচারে নিজেদের “শ্বেতাঙ্গ” হিসাবে দেখে মূলত তাদের “শ্বেতাঙ্গ মা-বাবার সাথে সবসময় একাত্মতা অনুভব করার জন্য বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা বলে যে এটা একান্ত প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধির কথা। তারা তাদের মা-বাবার সাথে এত ঘনিষ্টতাবােধ করে যে তাদের মধ্যে যে বর্ণীয় পার্থক্য রয়েছে, সেটা তাদের উপলব্ধির সমীকরণের বাইরে। প্রকৃতপক্ষে চেহারার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও তারা কখনাে কোনাে অসুবিধেবােধ করেনি। তারা এ বিষয়ে জানে যে মার্টিন লুথার কিং, জেমস্ বল্ডউইন এবং ম্যালকম এক্স মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে “whiteness is a state of mind.যেহেতু যুদ্ধশিশুরা দত্তকগ্রহণকালে নিছক শিশু ছিল, এটা আসলে এমনই অবস্থা যে তারা অন্যান্য কোনাে মাবাবার কথা ভাবতেও পারে না। অন্ততপক্ষে, সেটা তাদের কখনাে মনে পড়ে না। বাংলাদেশের সাথে যে অনিলের কোনাে সম্পর্ক নেই, বা থাকলেও তার মধ্যে কোনাে গভীরতা নেই, সে বিষয়টি ব্যাখা করতে গিয়ে অনিল বলে: “আবেগীয় পর্যায়ে আমি বাংলাদেশের সঙ্গে কোনাে যােগাযােগ খুঁজে পাই না। আমার দেশ থেকে আমার শিশু অবস্থায় বেরিয়ে আসা দিয়েই সেটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ভবনা চিন্তা কখনাে কখনাে অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে থাকে। আমার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনাে অভিজ্ঞতাকেই আমি কোনােভাবে মনে করতে পারি না। তাই আবেগীয়ভাবে আমার জন্মদেশের সাথে আমি আমার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারিনি। যুদ্ধশিশুদের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি বিক্ষনীয় দিক হলাে যে তাদের জাতিগত উৎস। বিষয়ে গর্ব করার মতাে অর্থ হলাে তারা তাদের পটভূমির কোনাে কিছু সম্পর্কে ব্রিতবােধ করে না।
তারা জানে এটা এমন একটি ইস্যু যেটা বাংলাদেশে বাস করলে তাদের নিশ্চিতরূপে সামনাসামনি হতে হতাে। সে অর্থে তাদের কখনাে কোনাে জটিল প্রশ্নের মুখােমুখি হতে হয়নি । বহুসংস্কৃতির দেশ কানাডাতে বড় হয়ে ওঠার জন্য যুদ্ধশিশুদের কখনাে বর্ণীয় পার্থক্যের বিষয়ে কোনাে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়নি। অবাক হবার কিছু নেই সমাজ জীবনে কখন এবং কোন্ পর্যন্ত সমীকরণের বিষয়ে পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি অংশের উপর তাদের পশ্চাদপটের বিষয়ে জোর দেবে বা দেবে না, সেটা তারা জানে। কানাডীয় কৃষ্টিতে বড় হওয়ার সময় ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিচিতির ক্ষেত্রে তারা চেষ্টা করেছে তাদের শ্বেতাঙ্গ বাবা-মা এবং শ্বেতাঙ্গ, আন্তবর্ণীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভাইবোেনদের সংশ্লিষ্টতা দৃঢ় করতে। দত্তক বিষয়ে পেশাজীবীদের অভিমত থেকে আমরা জানি যে বয়ঃসন্ধিকালে অনেক পােষ্যই পরিবার থেকে বাঁধন ছিন্ন করে পালাতে চায়নিজের স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বাধীনতার জগতে। তখন মনে অনেক প্রশ্ন জাগে যেগুলি অত্যন্ত জটিল এবং যেগুলির উত্তরও মেনে নেয়া কষ্টকর। ফলে শুরুর বছরগুলিতে কেউ কেউ অস্বস্তিতে ভুগে, বিশেষ করে, যাদের নৃতাত্ত্বিক পশ্চাদপট তাদের দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের থেকে অন্যরকম। বর্তমানে যুদ্ধশিশুদের ক্ষেত্রে তারা কখনাে এমন কিছু বলেনি বা এমন পরিস্থিতির কোনাে বর্ণনা দেয়নি যেখানে তারা অভিলাষ করেছে তারা কেন শ্বেতাঙ্গ হয়ে জন্মায়নি। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে পড়েছি, তার একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল অনিল । খুব ছােট বেলায় অনিল এরকম ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল যে, সে যদি তার মা-বাবার মতাে হতাে (গায়ের রং-এর দিক দিয়ে)। প্রাপ্তবয়স্কে পেছনে তাকিয়ে ওটাকে জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে প্রত্যাখান করা হিসাবে সে দেখেনি। এখন সে মনে করে, সে সময়ে খুব সম্ভবত ওটা শিশুর নিজের মা-বাবার মতাে হবার সরল ইচ্ছা ছিল মাত্র । “আমি যখন ছােট ছিলাম এ ধরনের মন্তব্য (বড় ছেলেদের ছােটদের প্রতি সর্দারি প্রসঙ্গে) শুনে আমার এও মনে হতাে যে আমি যদি ককেশীয় হতাম” । সৌভাগ্যক্রমে অনিলের ঐ ধরনের অনুভূতি বেশি দিন বয়ে বেড়াতে হয়নি। কারণ ততদিনে তারা আস্তে আস্তে জীবনের পথে চলা শুরু করে দিয়ে সম্মুখের দিকে এগুতে শেখে। অনিল তার রােমন্থনে বলে: “এ সময়ে আমি যে অন্যরকম, এতে আমি বেশ আরামে দিন কাটাতে শুরু করি। আমি যে আমি সেটা উপভােগ করতাম।” কানাডার প্রতি তার সম্পর্কের গভীরতা এবং তার মা-বাবা ও পরিবারবৃন্দের সাথে সংশ্লিষ্টতা। ব্যক্ত করতে গিয়ে অনিল বলে: “আমাকে যদি কোনাে আবেগী সম্পর্কের কথা বলেন, তবে আমি বলব কানাডাই আমার লক্ষ্যস্থল। এটা আমার বাড়ি। এখানেই আমাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। এখানেই আমাকে লালন পালন করা হয়েছিল, ভালােবাসা ও আদর দিয়ে আমাকে বড় করেছে আমার পরিবার। কানাডাই আমার বাড়ি, আমার আশ্রয়স্থল, আমার নিরাপত্তা ।” যুদ্ধশিশুদের সাথে আলােচনা যখন এগুতে থাকে তখন দেখা গেল আরও কয়েকজন পােষ্যও ছােটবেলায় অনিলের মতাে আশা পােষণ করেছিল যেন তারাও তাদের মা-বাবার মতাে যদি হতাে। কোনাে কোনাে পােষ্য যখন ১৩ বা ১৪ বছর বয়সের, তখন কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে তারা আবার আয়নায় নিজেদের দেখত আর ভাবত তারা তাে বাস্তবিকপক্ষেই অন্য দেশ থেকে কানাড়াতে এসেছে। অবশ্যই তাদের বাবা-মায়েরা তাদের মতাে দেখতে না। আবার যখন বেশি ছােট ছিল তখন তারা দেখে বুঝতে পারত তারা দেখতে অন্যরকম, অন্তত ত্বকের দিক দিয়ে। তাদের মনে তখন এধরনের প্রশ্ন জাগত: আমি কে? আমাকে দত্তক নেয়া হয়েছিল কেন? আমাকে বাংলাদেশে রাখা হয়নি কেন? কানাডাতে “আমি আমার মা-বাবার সন্তান এবং আমার অনেক বিশ্বাস ও রীতিনীতি, কাজকর্ম সরাসরি তাদের দেখে দেখে করতে শিখেছি।”
খুব স্বাভাবিকভাবেই আমিনা কথাগুলাে বলে। সে বলে যে সে উলসি দম্পতির সন্তান হিসাবে নিজেকে দেখে। উলসি পরিবারের সঙ্গে একাত্ত্বতাবােধ করতে তার কোনাে বাধা বা সংঘাতের অনুভূতি হয় না। স্মৃতি রােমন্থন করতে গিয়ে হঠাৎ আমিনার একটি ঘটনা মনে পড়ে। ঘটনাটি শুনলে বােঝা যাবে উলসি পরিবারের একজন সদস্য হওয়াকে সে খুবই স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে দেখে। “শিক্ষকদের কলেজে আমার বন্ধু জোহরার সঙ্গে যখন আমার আলাপ হয়, সে আমার নাম দেয় বাইরের দিকটা। তামাটে হলেও ভেতরটা যাচ্ছেতাই সাদা” বলে । সত্যি বলতে কি, তখনই আমি বুঝতে পারি
সংস্কৃতি বিষয়ে অনেক কিছু জানবার রয়েছে । সে আমাকে একটি মসজিদে নিয়ে যায় এবং ‘পাকিস্তানি’ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় (যেটা অনেকটা বক্রাঘাতমূলক কারণ আমি। তাে সম্ভবত আধা পাকিস্তানি)। কিন্তু অমি উপলব্ধি করি যে আমি কানাডীয় এবং ওটাই আমার পরিচয় । সে যা হােক, আমার এরকমও মনে হয় যে আমি একজন বিশ্বনাগরিক। আমি এখনও শিখছি এবং নিজেকে পর্যায়ক্রমে সংজ্ঞায়িত করছি। শেষ পর্যন্ত, আমি প্রথমে নিজেকে দেখি একজন মানুষ হিসেবে, কোনাে রং যেখানে অগ্রাধিকার পায় না,” আত্মপরিচয়ের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে খুব সহজভাবেই আমিনা কথাগুলি বলে। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমিনা ছাত্রী, তখন হঠাৎ একদিন তার বােধাদয় হয় যে সে নিজেকে কী “নিগূঢ়ভাবে শ্বেতাঙ্গ” হিসাবে দেখে। সে তার নিজ উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করে এভাবেঃ “তখনই প্রথমবারে মতাে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি কানাডীয় সংস্কৃতির অঙ্গলীনা হয়ে গিয়েছিলাম। সে আবারও বলে, “আমার কমিউনিটিতে সংখ্যালঘু হওয়াতে আমার কিছুই যায় আসেনি, কারণ আমার খুব ভালাে একদল বন্ধু ছিল এবং বাড়িতে চমৎকার সমর্থন ও পারিবারিক বন্ধন আমাকে ধরে রেখেছিল। আমি নিজেকে সংখ্যালঘু না। ভেবে মনে করতাম আমি তাদেরই (শ্বেতকায় বাবা-মায়ের) একজন সন্তান। আমি একজন কানাডীয় যে তার শ্বেতকায় মা-বাবার সাথে থাকে, তার ত্বকের রং বাদামি এবং নাম অন্য রকম (আমিনা) যেটা আমি গ্রেইড ফাইভ-এ থাকাকালীন কানাডীয় করেছিলাম । Amina থেকে Ami নাম দিয়ে,” কথাগুলাে সংলাপের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। দেখতে দৃশ্যমান। সংখ্যালঘু হলেও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান আমিনা এমনভাবে ব্যক্ত করে তার অভিমতটি যেন তার মনের মধ্যে তার বংশবৃত্তান্ত বিষয়ে কোনাে রকমের ভ্রান্তি নেই। একথা স্বীকার্য যে যুদ্ধশিশুরা কানাডীয় কৃষ্টিতে বড় হওয়াতে তারা মানসিক দিক দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতই কানাডীয় যে তারা কোনােভাবেই বাংলাদেশি প্রতীক হিসাবে ভাবে না। একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং মজার ব্যাপার যেটা প্রকাশিত হয়েছে, তা হলাে তাদের বাবা-মায়েরা জাতিগত পরিচিতির বিষয়ে জোর না দিয়ে কানাডীয় বহুসংস্কৃতির উপর জোর দিয়েছিলেন। এর ফলে তাদের এক সর্বব্যাপী কানাডীয় পরিচিতি তৈরিতে সহায়তা করেছিল, যেটা বহুত্ববাদিতায় বিশিষ্ট এবং সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষনীয় যা আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে বিশেষভাবে দেখেছি, যে দত্তকগ্রাহী পিতা-মাতার কেউ কেউ তাদের ছেলেমেয়েদের তাদের জন্মদেশ সম্পর্কে অতিরিক্ত কিছু জানার বা শেখার সুযােগ করে দিয়ে তাদের অত্মপরিচিতিতে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আবার এটাও দেখেছি কোনাে কোনাে বাবা-মা নিজেদের লােকালয়ে ভারতীয় কানাডীয়দের সঙ্গে স্থিতিশীল। সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আমরা এ অধ্যায়ে আরও দেখব যে কোনাে কোনাে বাবা-মা আবার তেমন কিছু করেননি। আমরা ইতােমধ্যে জেনেছি, আমিনার বাবা-মা লন্ডনে, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টেরিওতে পি এইচ ডি’র ছাত্র ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে আমিনাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। রবিন ও বারবারা সরল চেনা পথ ছেড়ে অজানা পথে হেঁটেছিলেন। তাদের মেয়ে রানীর জন্য ভারতীয় বংশােদ্ভূত মানুষজন খুঁজতে, যাতে রানী তাদের সঙ্গে মিশে ভারতীয় কলা কৃষ্টি, ভাষা ও সভ্যতা ইত্যাদি সম্পর্কে আরও জানতে পারে, শিখতে পারে। আবার অনেকে, যেমন- রােবের্তো এবং মার্গো কার রিবেইরাে (মার্টিনের বাবা-মা) এ বিষয়ে কিছুই করেননি, সেটা আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে ইতােমধ্যে পড়েছি। সে যা হােক, আমরা যেমনটি যুদ্ধশিশুদের সাক্ষাৎকারে দেখেছি, তারা তাদের বাবা-মাকে ভালােবেসে ও পছন্দ করেনিজেদের মিলিয়ে নিয়ে বড় হয়েছে এবং যথাযথভাবে একীভূত হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কে এসে যুদ্ধশিশুরা এক পর্যায়ে এটাও উপলব্ধি করে ইতিবাচক পরিচিতির এক পূর্ণ বিকশিত অনুভূতি প্রশস্তকর কানাডীয় পরিচিতির মাধ্যমে। আন্তবর্ণীয় দত্তকের যারা বিরােধী সমালােচক তারা যুক্তিদেন যে আন্তবর্ণীয় শিশুটি কখনাে জানবে না সে কে? কিন্তু এ কথা আমরা ধরে নিতে পারি যুদ্ধশিশুদের নিজ নিজ বর্ণনার উপর ভিত্তি করে যে পরিচিতি। সনাক্তকরণের বিভিন্ন পথে ঘুরে ফিরে যুদ্ধশিশুরা তাদের শ্বেতকায় মা-বাবা ও বহুবর্ণীয় ভাইবােনদের সংস্পর্শে এসে উপলব্ধি করে যে আন্তঃবর্ণীয় দত্তকগ্রহণের বিরােধীদের যুক্তি অযথার্থ। নিজেদের মধ্যে তাদের সামাজিক অবস্থানের বিষয়ে কোনাে ধরনের বিভ্রান্তি বা সংঘর্ষ ছাড়াই তারা নিজেদের কানাডীয় মূলস্রোতের মানুষ হিসাবে দেখে আসছে। এক পর্যায়ে তারা নিজেরা দাবি করে যে তারা কানাডা এবং কানাডীয় জীবনের অভিন্ন অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়। শিখা ক্যাপুচিনাে তার আত্মপরিচিতির কথা বলতে গিয়ে জানায় যে, যখন বড় হচ্ছিল তখন তার ত্বকের সাথে যে তার মা-বাবার ত্বকের পার্থক্য রয়েছে, সেটা কোনােদিন খেয়ালই করেনি। জাতিগতভাবে ভিন্ন জাতের পােষ্যদের কানাডীয় হিসাবে পরিচিত হতে অনেকের আত্মপরিচিতি প্রতিষ্ঠায় অসুবিধে হলেও শিখা বলে, তার বেলা কোনাে সমস্যাই হয়নি। “আমার জীবনে কখনাে এমন একটি মুহূর্ত আসেনি যখন আমি হঠাৎ বুঝতে পারি যে আমি আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের থেকে আলাদা, আত্মবিশ্বাসী শিখা খুব সহজভাবেই। কথাটি বলে । যে ক্যাপুচিনাে পরিবারে ২১ জন ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড় হয়েছে, যেখানে ১৯। জন ছেলেমেয়েই দত্তকের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যাপুচিনাে পরিবারে আসে। কিন্তু সবাই ফ্রেড ও ক্যাপুচিনাের সন্তান হিসেবেই পরিচিত । দৃশ্যতঃ পৃথক হলেও জাতিসত্তা ও ত্বকের রং বিচারে তার নিজের সম্পর্কে ধারণা ছিল যে সে কানাডীয় মূল স্রোতের একজন প্রতিনিধি। একই গ্রুপের অন্যান্য যুদ্ধৃশিশুদের মতাে শিখা নিজেকে “বাংলাদেশে জন্মানাে একজন কানাডীয়” হিসাবে দেখে । এর সাথে কোনাে অবান্তর প্রশ্ন বা সন্দেহের অবকাশ নেই। অল্প বষসে যুদ্ধশিশু ক’ (ডাঃ রবার্ট ও হেলকে ফেরি যাকে দত্তক নিয়েছিলেন) অন্টেরিও প্রদেশের বর্লিংটন শহরে বড় হয়ে ওঠে এক বহুজাতি পরিবারে। সেখানে ১৩ জন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৩ জন ছিল ফেরিদের ঔরসজাত সন্তান। ‘ক’ এর মনে পড়ে স্কুলে।
শ্বেতাঙ্গ বন্ধু ছিল যাদের সঙ্গে সে খেলাধুলা করত, এবং একসাথে গল্পগুজব করত । এটা ওর। কাছে খুবই স্বাভাবিক ছিল যে সে নিজেকে ওদের একজন ভাবত যদিও দেখতে সে ওদের মতাে নয়। সে কখনাে ভাবেনি যে সে সংখ্যালঘু । হােক না তার গায়ের রং বাদামি, অন্য রকম জন্মবৃত্তান্ত এবং বংশানুগতির ইতিবৃত্ত। সে এক মুহূর্তের জন্যও তার আত্মপরিচিতির পূনমূল্যায়ন করার প্রয়ােজন অনুভব করেনি। ‘ক’ বলে যদি কেউ ভাবে সে কানাডীয় নয়, তখন সে সবিনয়ে কেবল বলবে, “তবে। তাই।” অর্থাৎ ওতে তার কিছু যায় আসে না। অন্যেরা তাকে যেভাবেই দেখুক না কেন সে। নিজেকে ভালােভাবেই জানে। আত্মপরিচয়ের বিষয়ে ‘ক’ তার অবস্থানে এত বিশ্বাসী যে কানাডীয় জীবনে অন্যান্যদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে তার (কানাডীয় বা ভিন্ন)। সামাজিক পরিচিতি নির্ধারণের জন্য কোনাে সময় ব্যয় করার প্রয়ােজন আছে বলে সে কখনাে মনে করেনি। আবার ‘ক’ এর বােন ‘খ’ আরেক যুদ্ধশিশুর মতে বহুজাতিক সকল সম্ভাব্য সংজ্ঞা অনুযায়ী সে কানাডীয় । জন্মদেশ সম্পর্কে তার ধারণা নিতান্তই অল্প। তার জন্মের ইতিহাস ও ইতিবৃত্তির বিষয়ে সে জানে । সে তার বাবা-মাকে নিয়ে এ বিষয়ে আলােচনায়ও বসেনি। তার শৈশবের। সাংস্কৃতিক আবহ এবং বড় হবার সময়ে যে পরিবেশ পেয়েছে সে সবটাই ছিল কানাডীয় । প্রকৃতপক্ষে সে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং জানতেও আগ্রহী না। সংক্ষেপে ‘ক’ এবং ‘ক’ এর দুজনের কেউই বাংলাদেশের বিষয়ে কোনােরকম আগ্রহ প্রকাশে অনিচ্ছুক । অবশ্য তাদের জন্য যে বাংলাদেশে এবং তাদের জন্মবৃত্তান্ত যে আরও দশজনের মতাে নয়, সে বিষয়টি তারা কখনাে অস্বীকার করে না। আত্মপরিচিতি ও জন্মবৃত্তান্তের বিষয়ে শ্যামা হার্টের অভিজ্ঞতা যেমন কৌতূহলী তেমন মজাদার । শ্যামা হার্ট কিউবেক প্রদেসের মন্ট্রিয়ল শহরে বড় হয়ে ওঠে ৯ ভাইবােনদের মধ্যে । ইউনিভার্সিটিতে একটি কোর্সের প্রকল্পের জন্য তার নৃতাত্ত্বিক বিষয়ের অধ্যাপক তাকে তার পরিচিতি নির্মাণ করে দেখাতে বলেছিলেন। জবাবে সে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছিল একটি মনােলগের মাধ্যমে সে তার পরিচিতি, জাতি, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতির সমাহারে পরিবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। শ্যামা সে সমস্যাটি ব্যাখ্যা করে এরকমঃ “আমার ত্বকের রং অথবা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্টের নিরিখে আমাকে আমার শিক্ষকেরা কখনাে আলাদা করে সনাক্ত করেননি। এ কারণে আমিও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য কোনাে ইস্যুরূপে সনাক্ত করিনি। আমার লক্ষ্যগুলাে আমাদের মতােই, সে কানাডীয় হােক বা অন্য কিছু, আর সেটা হলাে আমার জীবনের উৎকর্ষ উত্তরােত্তর বৃদ্ধি করা।
বিষয়টি বিশদকরণ করতে গিয়ে শ্যামা আবারাে বলে, “আমি নিজেকে অত সরলভাবে দেখার বিষয়ে আপত্তি করছি। আমাকে একটি বিশেষ দলের সঙ্গে চিহ্নিত করে বা আমার নামের সাথে ছাপ দিয়ে আলাদাভাবে রেখে দেবে, আমি কখনাে তা গ্রহণ করব না। অন্যরা আমাকে সংজ্ঞায়িত করে আমার নামে একটি মােড়ক বা লেবেল দিয়ে ভাববে যে সনাক্তকরণের কাজটি শেষ, তা হবে না। আমি কানাডীয় কারণ এখানে আমি বড় হয়েছি এবং যা জানার জেনেছি। একই সঙ্গে, আমার পূর্ব ভারতীয় উৎসের কাথাও মনে রাখতে হবে কারণ আমার জন্ম বাংলাদেশে।
শ্যামা যে পরিবারে বড় হয়েছে সে পরিবারকেই সে নিজের পরিবার হিসাবে দেখে উত্তরাধিকারকে ইতিবাচক অর্জন হিসাবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু দুই দিক থেকে উত্তরাধিকারীসূত্রে প্রাপ্তিকে সে স্বীকৃতি দিতে অপারগ । অর্থাৎ সে মনে করে না যে অন্য কোনাে পরিবার বা দেশের সাথে তার কোনাে যােগসূত্রতা রয়েছে। ল্যারা মরিসের মতে, একজন কানাডীয় হওয়া এবং একজন দৃশ্যমান অথবা “নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু পরস্পরবিরােধী ভাবা উচিত না। ল্যারা নিজেকে পুরােপুরিভাবে কানাডীয় হিসাবে গণ্য করে সে নিজের পরিচিতি এভাবে নির্ধারণ করে: “যখন আমি নিজেকে মূল্যায়ন করি তখন নিজেকে অশ্বেতাকায় ব্যক্তি হিসাবে ব্যক্ত করার আগে আমি নিজেকে কানাডীয় হিসাবে দেখি, যে বাংলাদেশে জন্মেছিল। তারপর দেখি নিজেকে একজন অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে।” ল্যারা বলে তাকে যে দম্পতি কানাডাতে নিয়ে এসে লালন পালন করেছেন তাদেরকেই সে তার বাবা-মা হিসাবে জানে । আস্থাশীল ল্যারা আবারাে বলে: “যদিও আজ আমি যা হয়েছি, সেটা আমার কানাডাতে বেড়ে ওঠার সুফলই বলতে হবে, তবুও আমি স্বীকার করব যে আমার নৃতাত্ত্বিক পশ্চাদপটে আমার বাংলাদেশে জন্মানাের ব্যাপারটা রয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, ওটা কখনাে নিয়ে নিতে পারবে না কেউ।সংক্ষেপে, পশ্চাদপট সম্পর্কে সে গর্বিত। রানী মরাল সাসকাচিত্তয়ান প্রদেশের সাসকাটুন শহরে অনেক ভালােবাসা এবং স্নেহ আদরে বড় হয়েছিল । কিশােরী অবস্থায় সে সত্যিকারের পরিচয়ের বিষয়ে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে রাগ করত, ভয় পেত এবং অনেক সময় নিজেকে অন্যান্যদের থেকে ভিন্ন ভেবে কষ্ট পেত। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে পড়েছি সে কেমন করে মাঝে মাঝে সবকিছুর মধ্যে উদাসীনতায় ভুগত। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে কোথায় সে নিজেকে উপস্থাপন করবে, এ নিয়ে রানী মারাত্মক সমস্যায় পড়েছিল । অন্যান্য যুদ্ধশিশু যারা তার সাথে কানাডাতে আসে, ওদের কারােরই এ ধরনের মানসিক অশান্তি ছিল না। রানীর অতীতে মানসিক ভ্রমণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার, অনাথ আশ্রম সফর পর্যন্ত তাে বটেই। আমরা দেখেছি রানীর জীবনকাহিনীতে বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে রানী কেমন করে নতুন ভাবে আত্মপরিচিতির বিষয়ে আক্রন্ত হয়ে পড়েছিল। ঢাকাতে রেজিস্টার বই-তে তার নাম দেখে সে তৃপ্তি লাভ করলেও তার জীবনে এক নতুন দিকনির্দেশ যােগ দেয়। এটা পরিষ্কার যে কানাডীয় সমাজে আত্মপরিচয়ের বিষয়ে রানীর অভিজ্ঞতা অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের তুলনায় ভিন্ন। বস্তুতপক্ষে এখানে এটা একটি জায়গা যেখানে রানী বাকি সবার চেয়ে (যেমন, আমিনা, ল্যারা, রায়ান ও রাজিব, যারা বাংলাদেশে একসাথে গিয়েছিল) সম্পূর্ণরূপে অন্য ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে রানী নিজের সঙ্গে লড়াই করে তার সংশ্লিষ্টতার কথা ভেবে কোনাে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। সে তার কানাডীয় মাকে দেখে এসেছে আশৈশব । কিন্তু ঢাকাতে শিশু ভবনে সে হঠাৎ করে তার “কখনাে-না-দেখা” মাকে ও যেন এক ঝলক দেখেছে বলে বিশ্বাস করে।
এক পর্যায়ে রানী এত মরিয়া হয়ে পড়ে যে সে তার সত্যিকারের আত্মপরিচিতির বিষয়ে বিভ্রান্ত ও বিচলিত হয়ে পড়েছিল। যে রানী কানাডাতে তার কানাডীয় মা-বাবার সঙ্গে বড় হয়েছিল তার কাছে সশরীরে যাচ্ছিল একবার, আবার যে অচেনা মায়ের গর্ভে সে বেড়ে উঠেছিল, যে মা তাকে রাখতে পারেননি শেষ পর্যন্ত এ দুটি রূঢ় সত্যের মাঝখানে পড়ে এক অসহনীয় বাস্তবের মুখােমুখি হয়েছিল। তার নিজস্ব পরিচিতি খুঁজতে গিয়ে রানী ছিড়ে খুঁড়ে নিজেকে যেন একাকার করে দিয়েছিল। সে উপলব্ধি করেছিল যে তার অনুভূতির ভেতরে কাজ করার জন্য তার অতীতের প্রয়ােজন হয়েছিল। এ পর্যন্ত তার জীবনে যে পরিচিতির শূন্যতা যেখানে ছিল সেখানে বর্তমান নির্মাণের মাধ্যমে পরিচয় সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সে সফল হতে পারেনি।
মনােবিজ্ঞানী Erick Erickson-এর যুগান্তকারী এবং প্রণিধানযােগ্য মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। পৃথকভাবে পরিচিতির বিষয়ে গবেষণার পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন যে ব্যক্তির অতীতের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলিতে কী ঘটেছিল সে বিষয়ে অজ্ঞতা অথবা কোনাে জ্ঞানের অভাব ঘটলে তার জীবনচক্রে ছেদ পড়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে মানুষিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে যায়। সেটা রানীর ক্ষেত্রে লক্ষনীয়, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে ব্যক্তির পক্ষে সামনে এগােনাে কষ্টকর হয়ে পড়ে, ভবিষ্যৎও সংকটপূর্ণ মনে হয় । রানী যে দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে ফেরত আসার পর, সত্যিকার অর্থে তারপর থেকেই রানীর অবস্থা আরও করুণ হতে থাকে। মৃত্যুবরণের মাধ্যমে যেন রানী বেঁচে যায়। আগেই বলেছি এ গ্রুপের অন্য কারাে এ ধরনের সমস্যা ছিল না।” আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে রায়ান গুড-এর কথা আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। তার জীবনের ঘটনাবলি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রায়নই প্রথম বাংলাদেশি যুদ্ধশিশু যে বাংলাদেশে গিয়ে একবছরেরও বেশিদিন ছিল, শুধুমাত্র নিজের সত্যিকার পরিচয় প্রতিষ্টা করার জন্য । সেখানে সে খুব কম সময়ের মধ্যে খ্যাতি ও সম্মানের পাত্র হয়েছিল। রায়ানের নিজস্ব বর্ণনা। থেকে আমরা পরিচিতি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া ভালােভাবে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করতে পারি । পরিচিতি নির্মাণের প্রাথমিক বছরগুলােতে পরিবেশের উপাদানের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি থাকে, যেমন- শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক । আমরা ইতােমধ্যে লক্ষ্য করেছি রায়ান অল্প বয়স থেকে জানত যে তার ত্বকের রং তার মা-বাবার ত্বকের রং থেকে পৃথক । কিন্তু তা সত্ত্বেও সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বড় হয়েছে যে, যে পরিবার তাকে কোলেপিঠে। মানুষ করেছে, সে পরিবারই তার – সে পরিবারের সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এ গাঢ় সম্পর্ক কোনােভাবেই ছিন্ন করার নয়। যে ১৫ জন যুদ্ধশিশু নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করেছি, তার মধ্যে রায়ানই সকলের চেয়ে স্পষ্ট কষ্ঠে নিজের পরিচিতির প্রতিষ্ঠাতা। তার পরিচিতিতে যে সব আপত্তি, বিরােধিতা ও সংঘাত রয়েছে সে খােলাখুলিভাবে সব প্রকাশ করেছে এবং অপ্রিয় ও জীবনের রূঢ় বাস্তবকে মেনে নিয়ে তার নিজ ভাবনা ও অনুভূতিকে স্পষ্ট ভাষায় রুপদানে সক্ষম হয়েছে। আমরা সেটা পঞ্চম অধ্যায়ে পড়েছি। ঢাকাতে গিয়ে রায়ান প্রথমেই যে মানবিক ধাক্কা খেয়ে বাংলাদেশে অশ্রুতপূর্ব এবং উদ্ভট অবস্থা লক্ষ্য করে, সে ধাক্কার অভিঘাত থেকে সে পুরােপুরিভাবে মুক্তি পায়নি।
সম্ভবনার বীজ খুঁজতে গিয়ে রায়ান যেন আরও বদ্ধপরিকর হয়ে ঘাটাঘাটি করেনিজেকে এ বিষয়ে আরও উৎসাহিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে তার কানাডীয় মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তার “পশ্চিমে বড় হয়ে ওঠাকে পরীক্ষা করার জন্য তার অনুসন্ধানী তৎপরতা চালাতে মনস্থির করে। সে বলে সে তার জন্মদেশকে দেখে তার পূর্ব পুরুষের দেশ এবং তার পুর্বপুরুষের দেশ হিসেবে।
বাংলাদেশে থাকাকালীন সে অবাধে দুই দেশ, (বাংলাদেশ ও কানাডা) এবং দুজন মায়ের কথা বলেছে। একজন বাংলাদেশি মা যিনি তাকে গর্ভে ধারণ করে অকালে জন্ম দিয়েছিলেন এবং আরেকজন দত্তক নেয়া মা যিনি তার আত্মার জন্ম দিয়েছিলেন। তার জন্মপরিচিতি বর্ণনা করতে গিয়ে রায়ান লিখে: “আমার নাম বাদল আমার দুজন মা আছেন। একজন আমাকে রায়ান বলে ডাকেন,তাকে আমি সারা জীবন ধরে চিনি, যিনি আমাকে বাদল ডাকেন, তাকে আমি কখনাে দেখিনি । আমার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে, যে মা আমায় বাদল বলে ডাকেন, তার গর্ভে তিন সপ্তাহ পরে আবার আমার জন্ম হয়েছিল কানাডাতে, এবারে ঐ মায়ের গর্ভে যিনি আমাকে রায়ান বলে ডাকেন । একজন পাকিস্তানি সৈন্য আমার যে মা। আমাকে বাদল নামে ডাকেন, তাকে ধর্ষণ করেছিল । আমি একজন যুদ্ধশিশু।” একেবারে কোনাে ধরনের কুণ্ঠা ছাড়াই রায়ান এভাবে বক্তব্যটি রাখে । স্পষ্ট ভাষায় সে বলে সে বাংলাদেশ ও কানাডার সাথে প্রত্যক্ষভাবে অঙ্গীভূত । বহু প্রচলিত প্রবচন “to call a spade a spade”-টি উল্লেখের মাধ্যমে তার যুক্তিটি তুলে ধরার চেষ্টা করে। রায়ান গর্বের সাথে স্বীকার করে যে সে উপলব্ধি করে যে দুই দেশই তার। সে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু বেড়ে উঠেছে কানাডার মাটিতে। “আমি একটি নতুন স্বাধীনতা পাওয়া দেশ বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। আমার রক্ত বাংলাদেশের এবং আমি অবশ্যই গর্বিতবােধ করি যে আমার এবং বাংলাদেশের জন্ম প্রায় একই সময়ে । আমার একটি গভীর ও অনড় সম্পর্ক এ দেশের সঙ্গে রয়েছে। অন্যদের দৃষ্টিতে যেখানে হয়তাে ভয়ঙ্কর ধরনের অন্যায় এসবের পেছনে রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি আমার ভালােবাসা দুরপনেয় কেন? রায়ানের ভাবনা যেমন তাকে বলে, একজন তাকে জীবন দিয়েছিলেন তাে অন্যজন তাকে শিখিয়েছিলেন সে জীবন নিয়ে সে কীভাবে বাঁচবে।
ঢাকাতে যতদিন এগুতে থাকে, দেখা গেল সজীব ও প্রানবন্ত রায়ানও একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার দরুণ অনেকটা নির্জীব ও নিষ্প্রাণ হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে। ঢাকা শহরে এত ঠাসা জনতার ভিড়ের মাঝখানে দাড়িয়েও জনতার অচেনা মুখের পাস দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অনুভব করে যেন তার চারপাশে কেউই নেই, যেন সে সম্পূর্ণরূপে একাকি । “জনতার ভিড়ে আমি আলাদা কেউ ছিলাম না, বাংলাদেশে আমি দেখতে আরও দশজনের মতােই। সমস্যাটা হলাে আমার বংশানুগতির উপাদানগুলাে যেখানে বাঙালি, সেখানে আমার মস্তিষ্ক কানাডীয় । আমি বাঙালীর বিরুদ্ধেও পথাবরােধ আবার পশ্চিমের বিরুদ্ধেও পথাবরােধ। এ সত্য বহন করে বেড়ানাে কঠিন ও কষ্টকর, নিঃসঙ্গতার এক চরম পর্যায়ে এসে রায়ান। ঢাকা থেকে এক চিঠিতে কথাগুলাে তার বাবা-মার কাছে ব্যক্ত করেছিল। আস্তে আস্তে রায়ান আরও অনুভব করে যে কোনাে কোনাে সময়ে এমন অতীত বিধূর হয়ে। পড়ত, বিশেষ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে যা সে প্রায়ই হতাে, তখন সে তার বাড়িকে অর্থাৎ কানাডীয় জীবনকে খুব বেশি মিস করত। “আমি দিনের বেলা স্বপ্ন দেখতাম, রাতে স্বপ্ন
দেখতাম, আমার কানাডীয় জীবন আমাকে তাড়া দিত, ভাত দেখলে আমার ভেতরটা যেন বিদ্রোহ করে উঠত। পশ্চিমা খাবারের জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠতাম। অতএব অতিরিক্ত খরচ করে আমি নুডল ও পাস্তা কিনে এনে খেতাম। তাতে আমি অনেক ভালাে বােধ করতাম। এভাবে রায়ান ওর বাবা-মাকে ঢাকা থেকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল বাংলাদেশে তার জীবনের টুকিটাকি ।
রায়ানের চিঠি থেকে এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশে সে অনেক উৎসাহ নিয়ে এসেও কিছু দিনের মধ্যেই উপলব্ধি করে যে সে কানাডীয়, সে মােটেই বাংলাদেশি নয়। ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে রায়ান যখন বাংলাদেশে কাটাচ্ছিল তখন দেখা গেল তার আবেগকে কানাডাতে রেখে আসা বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারেনি। সে তখন না পেরেছে বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্ম হতে, না পেরেছে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে একাত্মতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে । সে অনেক আগ্রহ নিয়ে স্বীয় উদ্দোগে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছে সে সময়ে। রায়ান অনেকবারই বলেছে যে নাগরিকত্ব নেয়ার মােটেই প্রয়ােজন ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব তার নিকট অত্যন্ত মূল্যবান বিষয় ছিল। সে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকেই নিজে অভিনন্দন জানায়। আজ পর্যন্ত রায়ানের নিকট এর তাৎপর্য বিরাট । অন্য কোনাে কারণে নয়, কেবল বাংলাদেশের সঙ্গে তার যােগাযােগের বিষয়টি তার জন্মের দেশ হিসাবে তাকে মাথায় করে রাখার লক্ষ্যেই কেবল নাগরিকত্ব নেয়া – অদ্ভূত আবেগের কাজ আর কী!
শেষ পর্যন্ত প্রাণচঞ্চল রায়ান কী পর্যায়ে যে পৌছেছিল সে আরেক কহিনী । সেটাও তার আত্মপরিচিতি এবং সংশ্লিষ্টতার এক জ্বলজ্বলে উদাহরণ । যেখানে একজন বড় হয়ে ওঠে, সেখানকার শৈশবের সব স্মৃতিগুলাে এমন বড় হয়ে উঠতে পারে যে, সে অন্যসব স্মৃতিকে ম্লান করে দেয়। সেগুলাের সাথে অনেক সময় কোনাে সংশ্লিষ্টতাও থাকে না। যদিও রায়ানের অসাধারণ শক্তিশালী মন তার জন্ম ও জীবন শুরুর কঠোর বাস্তবতাকে স্বীকার করেনিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত রায়ান নিজেকে কানাডীয়” বলে পরিচয় দিতে মনস্থির করে। লক্ষণীয়, সব। যুদ্ধশিশুদের মধ্যে রায়ান এ কথাটি উচ্চারণ করে এক অসাধারণ বিশ্বাস ও অনুরাগের সাথে । অন্যান্যরাও তাদের নিজ নিজ অঙ্গভঙ্গিতে তাদের আত্মপরিচয়ের একই অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। এই যুদ্ধশিশুদের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তারা তরুণ বাংলাদেশি কানাডীয়দের মতও নয়। বাংলাদেশি-কানাডীয় প্রজন্মরা কানাডাতে তাদের যারা তাদের বাবা-মাকে কানাডীয় এবং বাংলাদেশি মূল্যবােধ আকড়ে ধরবার জন্য যেন এক দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে। এসব জন্মসূত্রে কানাডীয় ছেলেমেয়েরা এবং তাদের বাংলাদেশি বাবা-মায়েরা উভয়েই বিভিন্ন পর্যায়ে কানাডীয় সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় স্থাপনের মধ্যমে তাদের নিজ নিজ পরিচিতির জায়গা খুঁজে পেয়ে যায়। অন্যভাবে কথাটি বলা যায়, যে তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে তারা কানাডীয় সমাজজীবনে নানাভাবে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশি কানাডীয় বাবা-মায়েরা তাদের মাতৃভাষা বাংলা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। ঐতিহ্যবাহী মূল্যবােধ, বাংলাদেশি কানাডীয় জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করে শিশুদের বড় করে তােলার ব্যাপারে পরিবারিক ধারা ও রীতিনীতি কাজ করে।আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে আরও দেখেছি যে সাধারনতঃ পরিবার ও সমাজে সম্মিলিত দায়বদ্ধতা কাজ করে। প্রত্যেকটি পরিবারের বৃত্তান্ত পড়তে গিয়ে দেখা যায় যে মূলধারার কানাডীয় সমাজে ব্যক্তিসত্ত্বা ও স্বাধীনতার গুরুত্ব সবার ওপরে। যেসব যুদ্ধশিশু কানাডাতে বড় হয়েছে তাদের বাড়িতে বাবা-মায়েরা বাংলাদেশি কানাডীয়দের মতাে এসব সংস্কৃতির সমন্বয়ের কোনাে প্রয়ােজন দেখেননি। আত্মবিশ্বাসী হােজ বলে: “আমার মনের মধ্যে এটা পরিষ্কার ভবনা যে আমি কানাডীয় এমনকি কেউ যদি আমাকে নাও চেনে। আমার চেহারা দেখে আমাকে কানাডীয় নাই মনে করুক।” যখন হােজে বড় হয়ে উঠছিল, তার মা-বাবা তাকে শিখিয়েছিলেন তার জন্মসূত্র ও উত্তরাধিকার। হােজে মনে রেখেছে ছােট বেলার কথা। সে বলে, “যেভাবে আমাকে বড় করে তােলা হয়েছিল, তাতেই আমাকে কানাডীয় অথবা কুবেকোয়া (আমার মা-বাবা ফরাসিভাষী কুউবেক প্রদেশের বাসিন্দা) হিসাবে অনেকখানি গড়ে দেয়া হয়েছে।” কিউবেক প্রদেশে বড় হয়েছে বলে হােজে নিজেকে একজন কুবেকোয়া হিসেবেও গণ্য করে । “আমি কুবেকোয়াদের মতাে কথা বলি, কুবেকোয়াদের মতাে চিন্তা করি, অতএব আমি অবশ্যয়ই একজন কুবেকোয়া।” এটাই হােজের মূল বক্তব্য। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সে সময়ে তার নিজের সামাজিক পরিচিতি এবং নানাবর্ণীয় কানাডীয়দের মাঝখানে তার অবস্থান কী হতে পারে সে বিষয়ে হােজে যথেষ্ট পাড়াশােনা করেছে । যখন জিজ্ঞাসা করা হয় সে তার পশ্চাদপট সম্পর্কে শক্ত ধাতের মেয়ে হজের নির্দিষ্ট উত্তর হলাে: তার বাড়ি কানাডা। যারা তার উৎস বিষয়ে জানতে বারবার জিজ্ঞাসা করেন, হােজের ন্দ্র ও শান্তগােছের উত্তরঃ “আমার জন্ম বাংলাদেশে।” এরপর বিস্তারিত। কিছু হােজে আর বলে না। সে অবাক হয়ে ভাবে, একজন আরেকজনকে এভাবে কত দূর পর্যন্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে যেতে পারে। কেননা হােজে কখনাে কারাে প্রশ্নের উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকে যখন অনেকে পশ্চাদপট অথবা নৃতাত্ত্বিক বংশধারা বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন? হােজে নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর দেয়, “দেখুন আমি জানি আমার জন্মবৃত্তান্ত ।
যত লােকের সাথে আমার দেখা হয়, তাদের সবাইকে যে সেটা জানতে হবে, এমন কথা নেই । কানাডীয় পরিভাষায় বললে একজন সহজেই বলতে পারে, তাতে আপনার কিছু এসে যায় না, তাই ?” বিনয়বান হােজে সর্বদাই শান্ত ও ভদ্র থেকে এ ধরনের ঔৎসুক্য সামাল দেয়। বাস্তব জীবনে লােকে এভাবে নিজেকে পরিচিত করে না: হ্যালাে! আমার নাম…। আমার জন্ম হয়েছিল টরন্টো অথবা সাসকাটুন-এ। তাহলে আমাকে কেন ওরকম করতে হবে? আমি যেখানে হােক জন্মেছিলাম, সেটা একটা ব্যক্তিগত ব্যপার । আমি কাকে সে কথা বলব কিংবা বলব না, সেটা পছন্দ করার অধিকারও আমার রয়েছে,” বলে পাল্টা প্রশ্ন করে শিষ্টাচারী হােজে। পােষ্যদের নিজ নিজ বর্ণনা ও সংলাপের মাধ্যমে কানাডীয় হিসাবে তাদের সামাজিক অবস্থানের নানা জরুরী দিক প্রতিফলিত হয়। তাদের মতামতের থেকে এটুকু পরিষ্কার হয়েছে যে, তাদের ওরকম কিছু নেই, যাকে বলা যেতে পারে একটা গ্রুপ পরিচিতি।” হয়তাে এ কারণে যে তারা কানাডার বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন সামাজিক পরিবেশে তারা বড় হয়েছে। লক্ষণীয় যে প্রতিটি পরিবারের মিশ্র পটভূমির ছেলেমেয়েদের পরিবার বলতে যে ধারণা, সে ধারণা থেকে উদ্ভূত যে বাঁধন, পরিবারিক সদস্যদের অদৃশ্য মায়ায় এবং পরস্পর নির্ভরতার বাঁধনে আটকে রেখেছে । নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য বা অন্য কোনাে ইস্যু এসব পরিবারে। তাদের পারিবারিক একতায় ফাটল ধরাতে পারেনি। পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা এও পড়েছি কীভাবে রিবেইরােরা (মার্টিনের বাবা-মা) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একটি সুস্পষ্ট নৃতাত্ত্বিক পরিচিতির ইস্যুকে আর জোরদার না করার, যেটাকে তারা মনে করেছিলেন মার্টিনের সমন্বয়করণ এবং সামাজিক দিক দিয়ে সংযােজিত হতে অসুবিধা হবে, যেহেতু শিক্ষনীয়বিষয়ে মার্টিনের কিছুটা অক্ষমতা ছিল যার জন্য ডাক্তারি মতে। সে অনেকের মতাে পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় ছিল না। রিবেইরােদের ভাষ্যমতে, যদিও মার্টিন বাংলাদেশি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সংস্পর্শে যায়নি, সে অসুবিধে বােধ করেনি, তেমনি তার। জন্মদেশ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবহেতু সে কখনাে নিরাপত্তার অভাবে ভুগে নি। একই রকম। ব্যাপার যা আমরা আগেও পড়েছি, তা ঘটেছে রাজিব সিমসনের জীবনেও। রাজিব ভগ্নমনস্ক অর্থাৎ এক ধরনের মানসিক রােগিবিশেষ যাতে চিন্তা, অনুভূতি এবং কাজের মধ্যে সম্বনয়ের অভাব লক্ষিত হয়। রাজিবের যখন ১৭ বা ১৮ বছর বয়স, তখনই তার চিকিৎসকরা তার এ রােগ নির্ণয় করেন। ফলে, যেহেতু তার বাবা-মা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ কিছু শেখানাের বিষয়টি কেবল এড়িয়ে যেতেন, স্বভাবতই রাজিব উদাসীন ও অনাগ্রহী থেকে যায়। আবার দেখা যায়, যে সব যুদ্ধশিশুরা কানাডাতে আসার পর আর কখনাে বাংলাদেশে যায়নি, তারা বাংলাদেশের প্রতি তেমন আগ্রহ না থাকলেও উদাসীন নয়। ওর অর্থ এ নয় যে এ গ্রুপের কোনাে ইতিবাচক নৃতাত্ত্বিক চেতনা নেই । কানাডাতে বাবা-মায়ের কাছ থেকে তারা।
যে মূল্যবােধ ও অধিকার লাভ করেছে সেগুলাে কীভাবে তাদের কানাডীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য। অংশ হিসাবে তাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিচিতিতে স্থান পেয়েছে সেটা তারা উল্লেখ করেছে। একই সাথে তাদের জন্ম যে বাংলাদেশে এবং কী অবস্থায় যে তারা জন্মেছিল, সেসব ঐতিহাসিক সত্যকে তাদের জীবনের একটি বিয়ােগান্তক কিন্তু উল্লেখযােগ্য ঘটনা হিসাবে গ্রহণ করেছে। যুদ্ধশিশুদের জীবনের আরেকটি বিক্ষণীয় দিক যে তারা তাদের বহুমুখী পরিবারগুলােতে একেবারে অতি ক্ষুদ্র পর্যায়ে গিয়ে বিভিন্ন রকমের আকর্ষণীয় বৈচিত্রতা সনাক্ত করে তারা তাদের বাবা-মায়ের থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তারা সফলভাবে শিখেছে কীভাবে জীবনে সেগুলােকে মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের নিজস্ব মূল্যবােধের চেতনাটি, যেটা মূলত কানাডীয় মূল্যবােধের চেতানায় পরিবেষ্টিত, সম্পর্কে তারা আরও জ্ঞান বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এ মূল্যবােধের সাথে তাদের পরিচয় তারা বড় হয়ে ওঠার সময় থেকে। তাদের কানাডীয়। মূল্যবােধই তাদের দিক নির্দেশক, তাদের দৈনন্দিন জীবনের পাথেয়, যেটাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গী করেনিয়েছে। এ বিষয়ে অনুধ্যান করে এবং তার নিজ পরিবারের থেকে নানা উদাহরণ নিয়ে যুদ্ধশিশু আমিনা উলসি তাদের সবার পরিবারের সঙ্গে তাদের অবিস্মরণীয় বাঁধনে তার উদীয়মান ভাবনা অভিব্যক্ত করেঃ “আমাদের বাবা-মায়েরা মানবিকতা উদযাপন করেছেন, তারা সকল মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করে তাদের চিন্তা ভাবনা ও কাজে সাম্যের জয়গান গেয়েছেন। হাতে কলমে সবাইকে নিয়ে কাজ করা শিখিয়েছেন, যে মূলধারায় নিয়ে গিয়েছেন। সে রাস্তা আমাদেরও দেখিয়ে দিয়েছেন। সেখানে চিরদিনই পথিকের সংখ্যা কম ছিল। পরীক্ষা আমাদের পদে পদে, উতরে যাচ্ছি। সামনে এগিয়ে যাবাে নতুন বিপদ তাড়িয়ে তারপর প্রমাণিত হবে আমরা কারা।” সমস্বরে তাদের পরিচিতির কথা বলতে গিয়ে সে আরও বলে: “দৃষ্টিগােচরতার দিক দিয়ে আমরা সংখ্যালঘুদের মতাে কানাডীয় সংস্কৃতিতে মিলেমিশে গিয়েছি। আমরা এক নতুন কানাডীয় প্রজন্ম ছিলাম, আমরা তখন এক ইতিহাস সৃষ্টি করি।”
জাতিগত বিদ্বেষের অভিজ্ঞতা
সে সময়ের স্মৃতির রােমন্থন করতে গিয়ে তাদেরকে বেশ সময় দিতে হয়েছিল সঠিকভাবে মনে করতে । যেমন তারা সময় নিয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেমন ছিল বন্ধু ও কমিউনিটির পরিচিত জনের সঙ্গে ইত্যাদি, ভেবে। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কমবেশি সবাই বারবার পেছনের দিকে চলে যায় তাদের প্রাথমিক স্কুল থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরগুলিতে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ওরা সম্পূর্ণরূপে খােলামনে কথা বলেছে তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে, স্কুল ও কলেজ ছাড়াও পথে ঘাটে যা লক্ষ্য করেছে বা নিজের বেলায় যা কখনাে ঘটেছে। আলাপের লক্ষণীয় বিষয়টি ছিল তাদের সহযবােধ্য আচার, বাচনভঙ্গি ও অমায়িকতা। তারা যেন কোনাে কিছু রেখে ঢেকে বলে নি। যেভবে যখন যা দেখেছে বা শুনেছে সেটাই ব্যক্ত করেছে কুষ্ঠাহীনভাবে । চাকুরি নিয়ােগের ক্ষেত্রে, কাজে পদোন্নতির ক্ষেত্রে, অথবা কাজের বাইরে কোনাে ধরণের আচরণ যাতে ওরা মনে করে বর্ণবাদের ছোঁয়া রয়েছে, সেগুলাে যতদুর মনে করতে পেরেছে সেটুকু বলেছে। সাক্ষাৎকারে যা জানা যায় তা হলাে কেউ কেউ বলে জাতিগত বিদ্বেষ নানাভাবে তাদের স্পর্শ করেছে নানা পরিস্থিতিতে। আবার কেউ কেউ এরকম কিছুই মনে করতে পারেনি । নানারকম পরিবার, অন্যরকম পশ্চাদপট, শৈশবে কানাডা এসে বাবা-মায়ের অপরিসীম স্নেহ আদোরে বড় হবার ফলে ওরা কখনাে ভাবেনি যে কানাডীয় বাড়ি ছাড়া যে তাদের আরেকটি বাড়ি বা পরিচয় রয়েছে। তারা তাদের শ্বেতকায় মা-বাবা, শ্বেতকায়, কৃষ্ণাঙ্গ ও আন্তঃবর্ণীয়। ভাইবােন এবং আত্মীয় স্বজন সবাইকে নিয়ে এমন সহজাতভাবে মিলেমিশে বড় হয়েছে যে তারা কখনাে ভাবেনি যে তারা দেখেতে আলাদা। তাদের মনে আছে নানা ইস্যু, যেমন- স্কুল। ও চারপাশের জনগােষ্ঠীর জাতিগত উপাদান, বাড়িতে অন্যান্য আন্তবর্ণীয় বা কৃষ্ণাঙ্গ ভাইবােনদের উপস্থিতি, মাম-বাবার দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনােভঙ্গি সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি, এসবের সমন্বয়ে কানাডীয় সমাজের উদ্ভাবনা ঘটেছিল। তারা এটাও লক্ষ্য করে যে এতকিছু সত্ত্বেও কানাডা পুরােপুরিভাবে জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্বেষমুক্ত সমাজ নয় ।
কখনাে ওদের বিরুদ্ধে শ্বেতকায় ছেলে মেয়েরা খােলাখুলি বিরুপ ব্যবহার, টিটকারি, ঠাট্টা, মশকারা, বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য, থুথু নিক্ষেপ অথবা সরাসরি গালি দেয়া, ইত্যাদি করেছে কিনা অথবা এসবের সম্মুখীন কেউ হয়েছে কিনা, এর জবাবে, কেউ কোনাে ঘটনার উল্লেখ করেনি। তারা মনে করতে পারেনি যে তাদেরকে কেউ কখনাে নীরবতার সাথে সম্ভাষন জ্ঞাপন করেছে বা কেউ বিচলিত সন্ত্রস্ত হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছে, ইত্যাদি। ওদের বয়স কম হলেও নিজেদের চেহারার ব্যাপারে কিছুটা সচেতনতা যে ছিল না, তা নয়। “মম স্কুলে আজ আরেকটি ক্রিসকে দেখেছি,” বনি বুনস্ট্রা (ক্রিসের মা) বলেন তাকে প্রথমদিনই স্কুল থেকে ফিরে এসে ক্রিস এ কথাটি বলেছিল। ক্রিস আসলে কী বলতে চেয়েছিল, ওর মা ওকে প্রশ্ন করে পরে বুঝেছিলেন। পাঁচ বছরের ক্রিস বলতে চেয়েছিল যে সেদিন ক্লাসে আরেকটি ছেলে ছিল যে ওর (ক্রিসের) মতাে দেখতে (দৃশ্যমান সংখ্যালঘু)। যদিও বয়স মােটে পাঁচ বছর, ক্রিস ত্বকের রং এ মিল বা পার্থক্যটি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল । ক্লাসে যে আরেকটি ছেলে আরও অতগুলাে ছেলের মধ্যে কারাে মতাে নয়, কেবল ক্রিসের মতােই অনেকটা, তা সে বুঝতে পেরেছিল পাঁচ বছর বয়সেই ।
আমিনার একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল বহুবছর আগে যখন ক্লাসে কেবল একটি মাত্র বাদামি শিশু ছিল । অন্টেরিওর লন্ডনের বাইরে ছােট কৃষক জনগােষ্ঠীর স্কুলে যখন সে গ্রেইড ওয়ান এর ছাত্রী, ক্লাসের একটি মেয়ে সব ছেলেমেয়েকে বলেছিল আমিনার পাশে যেন কেউ না দাঁড়ায়, কারণ সে “নােংরা মেয়ে। মেয়েটি বােধ হয় আমিনার গায়ের রং এর কথা। বলেছিল । স্বাভাবিকভাবেই আমিনা খুব দুঃখ পেয়েছিল। আমিনার মনে আছে তার মা সে মেয়েটিকে রাতে তাদের বড়িতে খেতে বলেছিলেন। আমিনার মার সদিচ্ছাজ্ঞাপক পদক্ষেপে ওই মেয়েটি এবং তার পরিবার যে তার কেবল বন্ধু হয়ে যায়, তা নয়, সে আর কখনাে ওকে এ ধরনের কথা বলে বিরক্ত করেনি। আমিনা এটাকে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা না বলে বরং একটি মজার অভিজ্ঞতা হিসাবে দেখে ।
যুদ্ধশিশুরা যখন বড় হয়ে উঠছিল, তারা কখনাে নিজেদেরকে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন বা কোনাে ধরনের একাকীত্ববােধ করেনি। তবে আরও অনুসন্ধানে জানা গেল, “অচেনা বা অবাক করা ব্যবহার’-এর সম্মুখীন হয়েছে কেউ কেউ । যখন জিজ্ঞাসা করা হলাে, কিশাের বয়সে ফুড কোর্টে, খাবারের দোকানে, হােটেলে, বিনােদন ক্লাবে বা শপিং মলে তাদের সাথে। কেউ কখনাে কোনাে অশােভন ব্যবাহার করেছে কিনা, উত্তরে তারা তেমন কিছু বলতে পারেনি। ছােটবেলায় যখন স্কুলে তারা সহপাঠীদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতাে, তখন তারা কখনাে নিজেদের মতাে দেখতে (দৃশ্যমান সংখ্যালঘু) তাদেরকে তেমন কোনাে বিশেষভাবে খোঁজে নি। উল্লেখ্য, যখন তারা বড় হয়ে উঠছিল, তাদের অধিকাংশই প্রধানত শ্বেতাঙ্গ এলাকায় যেখানে শ্বেতাঙ্গ ছাত্র ছাত্রীরা বেশি ছিল। তাই যুদ্ধশিশুরা মূলত মূলস্রোতের কানাডীয়দের স্কুলে গিয়েছে। ১৯৭০ এর দশকে কানাডীয় শহরগুলিতে জাতিভিত্তিক জনসংখ্যা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। বিশেস করে টরন্টো, মন্ট্রিয়ল এবং ভ্যানকুভার শহরে । কিন্তু এ তিন শহর ছাড়া বেশিরভাগ শহরে অশ্বেতাঙ্গ শিশুর সংখ্যা তখনও খুব অল্প ছিল । লক্ষণীয় যে, পােষ্যরা কেবল নয়, তাদের বাবা-মায়েরাও এটাকে কখনাে সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য মনে করেননি। এটা স্বাভাবিক যে বন্ধুত্ব গড়ার বিষয়টা পােষ্যদের মধ্যে এমনভাবে এগােয় যে কারাে স্বভাব যেদিক চালিত করবে, তার পছন্দ, অপছন্দ, স্বাভাবিক ঝোক এসব মিলিয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। বুনা পরিবার এখনও মনে রেখেছেন সে সব দিন, যখন তারা ক্রিসকে বাইরে নিয়ে যেতেন। সে সময়গুলােতে ওকে দেখে অনেকের মনােযােগ আকর্ষিত হত । ক্রিসের বয়স যখন ছয় অথবা সাত তখন বুনস্ট্রা পরিবার কিউবেক প্রদেশের পূর্বদিকের শহরতলিতে দুবছরের জন্য বাস করতে যান। সে সময়টুকুতে তারা সেখানে একটিও অশ্বেতাঙ্গ মানুষ দেখেননি, কারণ সেখানে সবাই ছিল মূলস্রোতের কানাডীয় । তখন তারা মাঝে মাঝে কানাডীয় বর্ডার পেরিয়ে আমেরিকাতে বেড়াতে যেতেন ইংরেজি ভাষাভাষী লােকের সাথে দেখা করতে ও কথা বলতে । টনি বলেন, “বাড়িতে অন্যবর্ণীয় কাউকে দত্তক নিলে অনেক সময় সেটাকে নেতিবাচকই মনে করা হত।” তখন বুনস্ট্রা পরিবারে ক্রিস ছাড়া আরেকটি বাংলাদেশি মেয়েও ছিল যাকে তারা অটোয়াতে দত্তক নেন। তাদের অন্য চারজন (শ্বেতাঙ্গ) সন্তান সম্পর্কে কেউ কখনাে কোনাে জিজ্ঞাসাবাদ করত না, হয়তাে তারা শ্বেতাঙ্গ ছিল বলে । টনি বলেন, বর্ডারের দায়িত্বে নিয়ােজিত গার্ডরা ক্রিস ও কারাকে (দুজনেই বাংলাদেশি পশ্চাদপটের) আলাদা করে দাঁড় করাত কিন্তু অন্য চারজনকে, কখনাে কোনাে প্রশ্ন করত না। আমার স্ত্রী বনি এতে খুবই রেগে যেতেন। আমরা অবশ্য আমাদের সন্তানদের সাথে এ বিষয়ে কখনাে কোনাে আলােচনা করিনি। তাই আমি জানি না। ক্রিস এ ধরনের অপ্রীতিকর ব্যবহার থেকে কিছু রপ্ত করেছে কিনা।” কথা প্রসঙ্গে অবশ্য আরেকবার যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, খেলার মাঠে বা স্কুলে কি কেউ কোনাে ধরনের ঘৃণা প্রকাশ করেছে; অথবা ভয় দেখিয়েছে বা ঠাট্টা তামাশা ও টিটকারি দেয়ার চেষ্টা করেছে কিনা, তখন উত্তরে তারা বলে তাদের একটি বা দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য কারােরই মনে পড়েনি তমেন কিছু।
ক্রিসের মনে পড়ে প্রথম অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল এডমন্টন-এ বুলউইংক ফ্যামিলি ফুড রেস্তোরাতে, যেখানে সে কাজ করত গ্রীষ্মকালে। সেখানে সব কিছুই ভালাে ছিল। কিন্তু একদিন সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, যে সব দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বাস বয় এবং খাবার পরিবেশকরা পেছনে রান্নঘরে কাজ করছিল এবং সামনের সারির সেবা দানে ছিল শ্বেতাঙ্গ। নারী-পুরুষরা । ক্রিসের ম্যানেজারের সাথে এ নিয়ে বাদানুবাদও হয়েছিল। খােশমেজাজি ক্রিস অবশ্য তার সহকর্মীদের মতাে চিন্তাভাবনার মানুষ নয় । বলতে গেলে অপরিপক্ক ছিল সে সময়ে । তাই সমস্যাটা সে তখন তেমন তলিয়ে দেখেনি। সে কখনাে ভাবেনি যে তার ত্বকের রং অনুসারে তাদের কর্ম বন্টন হচ্ছিল সে সময়ে । পেছনের দিকে তাকিয়ে ক্রিস বলে ব্যাপারটার অর্থ বােঝার মতাে পাকা বয়স তার তখনও হয়নি। বিদ্বেষ এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে মানবতার অপমান ইত্যাদি ধারণা তার তখনও হয়নি। সে তার আপন মনে কাজ করতে থাকে। বলা যেতে পারে সে আনন্দের সাথেই কাজ করে সে সময়ে। সে সতর্ক ছিল এটা ভেবে যে যদি সে কোনাে সমস্যার সম্মুখীন হয়, তবে সে নিজে সেটা সমাধানের পথ খুঁজবে।
বর্ণ ও জাতিগত পার্থক্যের বিষয়ে (অর্থাৎ তারা যে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু) বলতে গিয়ে অনেকে স্মৃতিচারণে তাদের অভিজ্ঞতা ব্যাক্ত করেঃ কোনাে উপলক্ষকে সামনে রেখে যখন তারা একত্রিত হতাে তাদের (শ্বেতকায়) মা-বাবার সঙ্গে অথবা নিজেদের গ্রুপে, তখন তারা বুঝতে পারত তাদের দিকে অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । কখনাে যদি কোনাে কাউন্টারে কিছু নেবার জন্য অপেক্ষা করতে হতাে, যেমন- স্থানীয় আইসক্রিম কাউন্টারে লাইনের সম্মুখভাগে দাড়িয়ে থাকলেও তাদের (যুদ্ধশিশু) উপেক্ষা করে পেছনে দাড়ানাে শ্বেতকায় পুরুষ বা নারীকে জিজ্ঞাসা করত তারা কী চায়। তারা বলে, সে সময়ে বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু ভাবেনি । ল্যারা এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা মনে রেখেছে যখন সে ছােট, তখন “নিষ্ঠুর, বােকা ছেলেমেয়েরা ওকে গালাগালি দিয়েছে, ‘নােংরা পাকি’ এবং ‘বাদামি গরু বলে।” একই রকমের অভিজ্ঞতার কথা হােজেও মনে রেখেছে। তার কী যে খারাপ লাগত যখন তাকে প্রথম নাম হিসাবে রাজিনা ডাকা হতাে। হােজের মনে হতাে ওটা যেন অনেকে ঠিকমতাে উচ্চারণ করতে পারছে না, বিশেষ করে তার চারপাশের সকলের নামই ছিল ফরাসি অথবা ইংরেজি। যদিও সে অল্প বয়সী তবুও নামের কারণে তার মনে হতাে লােকজন তাকে হয়তাে অন্যভাবে দেখছে। আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি কেমন করে রাজিনার কোচরা তাকে নাম ও ত্বকের রং-এর সাথে মিলিয়ে তার নাম চেক করতেন । যদুর হােজে মনে রেখেছে, এটা ছিল এক ধরনের ব্রিতকর অভিজ্ঞতা যা তার স্নায়ুর উপর পীড়ন করত। আমিনার একটি হাস্যরসাত্মক ঘটনা এখনও মনে আছে। যখন তার বয়স ২০, তাকে দেখাত ১৫ বা ১৬ বছর। তার ছােট বােন সরিন (যাকে ভারত থেকে দত্তক নেয়া হয়েছিল) সিদ্ধান্ত নিল সে তাদের সাপ্তাহিক রােববারের স্কুলের জন্য স্কুল থেকে দেয়া home work-এর জন্য যে শিমের বিচি দিয়েছিল সেটা নিয়ে সে নতুন কিছু করবে। তখন সে তার সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রাখতে গিয়ে তার নাকের ভেতর শিমের বিচিটি পুঁতে দেয় । অবাক হলেও সত্য, সেটা থেকে একটি চারা সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে লাগে । তক্ষুণি ডনা (তার মা) আমিনা ও সরিনাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে কর্মরত একজন নার্স তাদের অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। স্বাভাবিকভাবেই ডনা ঐসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। কিন্তু নার্স অনেকটা বিরক্ত হয়ে উঠেন যেহেতু প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তর ডনাই দিচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি না পেরে বলে উঠলেন, “মাফ করবেন, এখানে মেয়েদের মা কে? “উদ্বিগ্ন ডনা নিঃশ্বাস নিয়ে সুমিষ্ট স্বরে বলেছিলেন, “আমি, আমিই ওদের দুজনের মা।”*° উত্তর শুনে নার্স সাথে সাথে শান্ত হয়ে গেলেন। যদিও প্রশ্নটি অনেকটা আনন্দোচ্ছলে এবং পূরােপুরিভাবে অনােপকারী, তবুও নার্সের মনে একটি প্রশ্ন থেকেই ছিল – মেয়ে দুটি এবং তাদের মায়ের ত্বকের রং আলাদা হয় কী করে। মা ও বাবা পরে তামাশা করতেন। ওটা কি কোষের স্বাভাবিক রঞ্জনের অভাব ছিল? নাকি পাকা চুল? নাকি নার্সের আক্কেল গুড়ুম হয়েছিল? ডরিন গুড তার স্মৃতিচারণে বলেন: “রায়ান যখন গ্রেইড ওয়ান-এ তখন এক দুঃখের কান্ড হয়েছিল। সকালে স্কুল বাসে কোনাে অসুবিধা হলে ড্রাইভার সবসময় রায়ানকে সামনের সিটে বসিয়ে দিত। অনেকে আমাদেরকে বলেছে যে এটা সত্যিই অন্যায়াচরণ । আমরা বাস কোম্পানির সঙ্গে যােগাযােগ করে বলি, তারা ব্যাপারটার সমাধান করে।
ওটাই ছিল জাতিগত বিদ্বেষের খােলাখুলি প্রকাশ যা আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি।’ আবার অনিল মৌলিং বলে, “প্রাক কিশাের ও কিশাের বয়সের কিছু খােলাখুলি জাতি বিদ্বেয়ের ঘটনা আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে। ওটা সবসময়ই গালাগলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। আমি সর্বদা এসব উপেক্ষা করে হেঁটে চলে গিয়েছি। আমি দেখেছি যে সংঘাত এড়িয়ে যাওয়াতে সবচেয়ে ভালাে হয়েছে। অনেক সময় আমি আক্রমণকারীর সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করেছি। তাতে শত্রুতা অনেক সময় কমে যেত।” যদিও অনেক বছর আগের কথা তবুও অনিল অনেক ঘটনাই মনে রেখেছে। “যখন আমার বয়স কম ছিল, তখন ঐ সব মন্তব্য শুনে আমার মনে হত, ইস, আমিও যদি আমার মা-বাবার মতাে শ্বেতকায় হতাম! মৌখিক ঐ ঝগড়ার সময় আমি কখনাে মনে করিনি যে আমি ওদের মতাে দেখতে নই।* অনিল সবসময়ই ভাবতাে যে সে তার বাবা-মায়েরই ছেলে এবং সে তাদের মতােই শ্বেতকায় । বাস্তবিকপক্ষে অনিল ঐ সব ঘটনাকে তার শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা হিসাবে বিবেচনা করে যেমন মজা পেত তেমনি সামলে নিতেও পিছপা হতাে না। তার অনেক বন্ধু ছিল, যারা ডাকলে এগিয়ে আসত; কখনাে কখনাে এমন হত যে, আমি কিছুই করিনি, তখন হয়তাে দেখা যেত আমার চারপাশে যারা শ্বেতকায় ছেলেমেয়েরা, তারাই আমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসত। আবার অনেক সময় এমন ঘটত যখন অনিল তার ত্বকের রং নিয়ে বেশ সহজ ও সহজাত হয়ে যা করার করত, কোনাে ধরনের অস্বস্তিবােধ করত না। বয়স কম হলেও অনিলের এসব শান্তি বিঘ্নিত পরিস্থিতি সামলানাের উপযােগী কৌশল জানা ছিল: “যখন কোনােরকম ঝগড়া বা গালাগালির মুখােমুখি হতাম, আমি যে দৃশ্যতঃ] অন্য রকম, সে ভাবনা থেকে আমার মনােযােগ সরিয়ে নিতাম। আমার যখন মনে কষ্ট হতাে, আমি সে বিষয়ের উপর মনােসংযােগ করাতাম।” বাস্তবতা ছিল এরকম: যদিও সে নিজেকে তার মা-বাবার সদৃশ বিবেচনা করত (তার ত্বকের রং তার বাবা-মায়ের ত্বকের রং থেকে আলাদা এটা জানা সত্ত্বেও), দেখা যেত, অনেক সময়ে তার দৃশ্যতঃ পৃথক রং এর চেহারার জন্যেই তাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে (অর্থাৎ অশ্বেতকায় হিসেবেই) দেখত । ইতােমধ্যে আমরা ল্যারার উদাহরণ দিয়েছি। সে খুব ভালাে করে জানে অন্যরা তাকে কী চোখে দেখে। ক্যাসিনাে নায়াগ্রায় প্রায়ই ভারতীয়, পাকিস্তানি অথবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত অনেক পুরুষ পর্যটকরা ল্যারাকে ঐ এলাকার মেয়ে মনে করেনিয়ে সরাসরি আঞ্চলিক ভাষায় বাক্যালাপ শুরু করে দিতেন। ল্যারা বলে: “প্রায়ই দেখি যখন আমি এমন লােকদের সামনাসামনি হই যাদের ত্বকের রং আমার মতাে, তারা সাধারণত মনে করে আমরা একই জাতি, গােষ্ঠী, ধর্ম এবং সংস্কৃতির অনুসারী। তারা তাকে কেবল যে নিজেদের এলাকার
অধিবাসী ভাৰত না নয়, তাকে একটুখানি অযাচিত উপদেশও দিতেন: “পুরুষের রােজাগারে ভাগ বসানাে তােমার কোনাে দরকার তাে নেই, তােমার বাড়িতে থেকে ছেলেমেয়ে লালনপালন করা উচিত।” ল্যারা এরকম নির্দোষ ভৎসনার অর্থ বােঝে, যেহেতু তারা মনে করেন ল্যারা “একই পশ্চাদপটের মানুষ। তাই অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের উপদেশ দিতেন। আবার তার জাতিবিদ্বেষী অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে ল্যারা বলে ১৯৯১ সালে যখন সে এ্যালবার্টায় এক লজে কাজ করত, তখন তাকে ফোনে সাক্ষাক্তারের পর নির্বাচন করা হয়েছিল। যখন সে প্রথমবার তার নিয়ােগকর্তাদের দেখে, তখনই সে কেমন যেন একটি বাধা মাঝখানে অনুভব করে। সময় যেতে থাকে কিন্তু ল্যারা লক্ষ্য করে যে তার উর্ধ্বতন তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে সম্পর্ক এগােননি। ল্যারা এও খেয়াল করে যে, তার কর্তৃপক্ষ সে ছাড়া অন্য সকলের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভালাে ছিল। কিন্তু ল্যারার বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সে অনুভব করে যে তিনি তাকে ঠিক অন্যদের মতাে গ্রহণ করতে পারেননি।
শুধু তাই নয়, ল্যারা বলে: “আমাকে প্রায়ই অন্যের ভুলের জন্য অভিযুক্ত করা হত। উৎসাহ দেয়া হতাে না বললেই হয়, ভালাে কাজ করলেও প্রশংসা মিলত না।” এতে আহত হয়ে হতাশগ্রস্ত ল্যারার মনে হতাে কর্তৃপক্ষ যেন সবসময়ই তার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ল্যারাকে খাবার চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। তার বক্তব্য কর্তৃপক্ষের কেউ শােনেননি, অর্থাৎ কানে তােলেননি। এ ধরনের ব্যবহারে ল্যারা দুঃখ পেয়েছিল। তথাপি সে কখনাে খারাপ মেজাজে থাকেনি। সে কখনাে কোনাে বিশ্রী ঝগড়াতেও জড়িয়ে যায়নি। দেখেও না দেখার ভান করে ল্যারা কোথাও কোনাে অভিযােগ না করে সামনে তাকিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে চলেছে। স্মৃতিচারণে যুদ্ধশিশু ‘ক’ (ডাঃ রবার্ট এবং হেলকে ফেরির দত্তক সন্তান) তার স্কুলের প্রথম বছরগুলাের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করে যে, জাতিগত বিদ্বেষের কোনাে অভিজ্ঞতা তার হয়নি। ১৯৯০ এর দশকে টরন্টো যাবার পর সে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে লাগে । কীভাবে জাতি বিদ্বেষ সময় অসময়ে তার কুদর্শন মাথা তুলে দাঁড়ায়। সে সময়ে জীবনে প্রথমবারের মতাে অনুভব করে কীভাবে কিছু লােক তাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে” যদিও ছােটবেলা থেকে এ পর্যন্ত তার এরকম অভিজ্ঞতা আর কখনাে হয়নি। জর্জ ব্রাউন কলেজে লেখাপড়া করারকালে ‘ক’ এর কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় যেগুলি সে প্রত্যক্ষ করে শুধুমাত্র সে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বলেই। ক্লাসে প্রায় ২০ জন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তার যথেষ্ট ভালাে সম্পর্ক ছিল কেবল একটি ছেলে (সেও অন্যদের মতাে শ্বেতকায়) ছাড়া যাকে ‘ক’ এর মনে। হয়েছে আচার ব্যবহারের দিক দিয়ে অন্যরকম তার প্রতি বিরূপভাবাপন্ন । ক’ সে ছাত্রটির নাম মনে করতে পারেনি, কিন্তু তার পরিষ্কার মনে আছে সে ছেলেটি ‘ক’ কে কানাডীয় হিসাবে দেখেনি। ক’ তার কাছে মনে হয়েছে একজন বিদেশি ছাত্র । ব্যাপারটি বুঝতে পেরে সে মােটামুটিভাবে ছাত্রটিকে এড়িয়ে যেত । নিজের মাথা সে ঠান্ডা রেখেছে এ আশায় যে ঐ একই মানুষটি হয়তাে ফিরে দাঁড়াবে এবং সময়মতাে পরিপক্ত মানুষের মতাে আচরণ করবে। দুর্ভাগ্যবশত সেশনের শেষ দিনেও সে প্রথম দিনের মতােই মাথা বিগড়ে রয়েছিল।
তার সহপাটি সম্পর্কে ‘ক’ এর শেষ মন্তব্য “কোন কোনাে মানুষ বদলায় না, কারণ ওরা। অসংশােধনীয় ।১১ শ্যামা হার্টের মতে, “যেহেতু আমরা বহুজাতিক পরিবারে বড় হয়েছি, তখন জাতি বিদ্বেষের মুখােমুখি হয়েছি। আমি বুঝতে পারি নি মানুষ অমন আচরণ কেন করে। আমার ইউনিভার্সিটি যাবার আগে খােলাখুলি জাতিবিদ্বেষের অভিজ্ঞতা হয়নি। যেসব পরিস্থিতিতে শ্যামা জাতিবিদ্বেষের মুখােমুখি হয়েছে, তাতে সে সবসময়ই হতচকিত হেয়েছ। শ্যামা বলে, সাধারণ লােকে এগুলাে মন্তব্য হিসাবে উচ্চারণ করে। যারা এরকম করে, তাদের যদি জাতিবিদ্বেষী বলে অভিযুক্ত না করা হয়, তারা জানে না তারা কী বলেছে অর্থাৎ তারা দায় স্বীকার করে না। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্যামার সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা যেটা হয়েছিল ওর অধ্যাপকসহ অন্যরা ওকে যে চোখে দেখতেন সেটা ছিল অনেকটা এরকম: “এর মানে এ নয় যে আমি সত্যটা জানিনা যে অন্যেরা আমাকে কানাডীয় হিসাবে দেখে না যখন একদিন ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের অফিসে বসে আছি, তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ইংরেজি আমার দ্বিতীয় ভাষা কিনা; অর্থাৎ নিহিতার্থ অনুযায়ী ত্বকের রং সাদা নয় কাজেই এ জিজ্ঞাসা । এরকম অভিজ্ঞতা আমার অনেক হয়েছে, যা আমাকে মনে করিয়ে দেয় অন্যেরা আমাকে কানাডীয় ভাবে না। কারণ আমার ত্বক সাদা নয় । এমতাবস্থায় আমার সােজাসুজি উত্তর রয়েছেঃ এক, কে পরােয়া করে অন্যেরা কী ভাবছে? এবং দুই, কী বড় মাপের শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা সেটা!” এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না য়ে, শ্যামার অধ্যাপকের ধারণা যে শ্যামার প্রথম ভাষা ইংরেজি নয়, সেটার একমাত্র ভিত্তি হলাে তার ত্বকের রং যদিও সে নিখুত ইংরেজি বলে। যে কোনাে কানাডীয়ের মতাে, কোনাে জোর বা ঝাক দিয়ে উচ্চারণ না করা সত্ত্বেও। তবুও শুধুমাত্র শ্যামার ত্বকের জন্য তার অধ্যাপক ধরে নিয়েছিলেন যে, যেহেতু শ্যামা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সে হয়তাে অভিবাসীই হবে। মােট কথা পরিপূর্ণভাবে সমন্নিত এবং বিকশিত কানাডীয় পরিচিতির অধিকারী যুদ্ধশিশুদের মতে বর্তমান কানাডীয় সমাজ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ভালােবাসার পরিবারকেও কুসংস্কার ও জাতিগত বিদ্বেষের কঠোর বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রাখা কখনাে সম্ভব নয়। অনেক শ্বেতাঙ্গ কানাডীয়রা প্রায়ই তাদেরকে এমনভাবে প্রশ্ন করেন (বা করেছেন) যা শুনে উপলব্ধি করা যায় যে তারা যেন ধরেই নেন যে এসব যুদ্ধশিশুরা কানাডীয় নয়। যেমন অনেকেই তাদেরকে এও জিজ্ঞাসা করেছেন কখন তারা ফিরে যাচ্ছে, অর্থাৎ তাদের দেশে, যেখান। থেকে তারা এসেছে। শৈশব থেকে কানাডাতে বড় হওয়ার জন্যে তারা এ ধরনের প্রশ্নে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তারা এতে উত্তেজিত হয় না মােটেই। যখন এ ধরনের আচরণের মুখােমুখি তারা হয় তারা জানে যে সব লােক অনেক সময় জাতিবিদ্বেষের আভাস ছড়ায়। তাই তারা চেষ্টা করে ওই পরিস্থিতি এড়িয়ে ওপরে ওঠার এ কথা ভেবে যে একজন জাতিবিদ্বেষী যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার উল্টোও আরেকজন যিনি জাতিগতভাবে। বৈরীতামুক্ত মাথায় এরকম একটা ভাবনা কাজ করায় পরবর্তীকালে এসব পােষ্যরা তখন। দত্তকদের পক্ষে শান্তভাবে যুক্তি দিয়ে জাতিবিদ্বেষী আচরণের মােকাবিলা করতে সক্ষম হয়।
যুদ্ধশিশুদের বর্ণনা থেকে আরও বেরিয়ে আসে ওদের নানা অভিজ্ঞতার অংশ। তারা এ বিষয়ে সচেতন যে ঐ বহিরাবরণের নিচে অনেক লােকেরই এমন সব অনুভূতি হয় যেগুলি কল্পকথা, গত্ত্বাধা অভিমত ও নেতিবাচক বিশ্বাস মিলেমিশে তৈরি করে। শিশু অবস্থা থেকে কানাডাতে বাস করার পর তাদের ধারণা এরকম হয়েছে যে যারা মনে বিদ্বেষ পুষে রাখে, তারা সাধারণতঃ শ্রদ্ধাভক্তির অভাবে কষ্ট পায়, এমন কি মায়া মমতা তাদের কম এবং বুদ্ধিমত্তার দুর্বলতাও তারা স্বীকার করে। কারণ তারা আরেকজন মানুষের শারীরিক অবয়বের বেশি আর কিছু ধারণা করতেও অসমর্থ হয়। এক কথায়, বিভিন্নভাবে ব্যক্ত করলেও যুদ্ধশিশুদের একটি বক্তব্য পরিষ্কার যে, অনেকেই এটা বােঝে না যে নানা বর্ণীয় ও গােষ্ঠীয় হলেও তাবৎ পৃথিবীর লােক মানবজাতির অংশ। উপসংহারে বলা যেতে পারে ঘন ঘন সংলাপের মাঝামাঝিতে বুঝতে কষ্ট হয়নি যে আমার অনেক ব্যক্তিগত ধারণাই অমূলক। গবেষনাকালে আমি ভেবেছিলাম হয়তাে তারা জগৎ জনমের নিরেট সম্বন্ধ ও অপ্রাপ্তির নিরন্তর দাহজুালা থেকে মুক্তি খুঁজবে আর হয়তাে বা “যা পেয়েছে” আর যা পায়নি তার মিমাংসা নিয়ে ব্যস্ত। আমার অনুসন্ধিৎসু মন দিয়ে বারবারই প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি তাদের যাতনা-তাড়না-বাসনা-চেতনা; কিন্তু যতই তাদের জীবনের গভীরতার সাথে পরিচিত হয়েছি, ততই বুঝতে পেরেছি যে তারা কখনওই নিজেদের “পরিত্যক্ত” শিশু হিসাবে দেখেনি। একথা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে প্রকৃতভাবেই তারা কানাডীয় । তাদের শ্বেতকায় বাবা-মা ও নানা জাতীয় ও বর্ণীয় ভাইবােনদের প্রতি রয়েছে তাদের অপরিশিম শ্রদ্ধা, স্নেহ এবং অফুরন্ত ভালােবাসা। তারা নিজেদেরকে কতটুকু কানাডীয় ভাবে এ প্রশ্নের জবাবে তাদের খােলামেলা ও কুষ্ঠাহীনভাবে দেয়া জবাবে তারা বলে যে কানাডা তাদেরকে জীবনরক্ষণের অধিকার দিয়েছে । স্বদেশ ও সমাজ বলতে তারা কানাডাকে নিজের দেশ ও নিজের সমাজ ভাবে যেখানে রয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবােধ । পিতৃ-মাতৃবৃত্তান্তে যে আগ্রহ নেই তা নয়, তবে মাতৃভূমি বলতে তারা কানাডাকেই ধরে নেয়। তারা কানাডাতে পেয়েছে সম্পত্তিভােগ, সংস্কৃতি এবং ভাষা সংরক্ষণের অধিকার । কানাডাতে তারা এমন কোনাে অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি যে তাদেরকে দুর্বারভাবে কানাডীয়দের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়েছে। স্বাধীনভাবে কর্মসংস্থান ও শিক্ষালাভের অধিকারও তারা পেয়েছে কানাডাতে। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুরা কে কোথায় আছে, সে সম্পর্কে তাদের কোনাে জ্ঞান নেই। তবে তারা নিশ্চিত জানে যে তারা বাংলাদেশে থাকলে বাস্তবিকপক্ষে তাদের জীবন বিকাশের জন্য এসব মৌলিক অধিকারগুলাে পেত কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান। সব শেষে, যুদ্ধশিশুদের কথা লিখতে গিয়ে অনুভব করলাম আমার নিজের অক্ষমতার কথা, আমার কলম বরাবরই থেমে যাচ্ছিল । কী লিখব? কেমন করে লিপিবদ্ধ করব তাদের মনের কথা? আমি কি তাদের মনের কুন্দরে প্রবেশ করতে পেরেছি?
সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী