বাংলার বাণী
১লা আগস্ট, বুধবার, ১৯৭৩, ১৬ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
পিন্ডির পর দিল্লী বৈঠক
ভারত-পাকিস্তান বৈঠক মূলতবী রাখা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে দু’সপ্তাহ পর এই বৈঠক পুনরায় বসবে। এবার বৈঠকের স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে দিল্লীতে। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বেশ কিছুদিন বিদেশ সফরের পর পাকিস্তানে এসে পৌঁছেছেন। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা শ্রী পি.এন. হাকসার দেখা করেছেন তার সঙ্গে। একটি সংবাদ সংস্থা খবর দিয়েছে পাকিস্তান তার অনমনীয় মনোভাব পরিত্যাগ না করলে কোন ঐক্যমতে পৌঁছানোই সম্ভব হবে না।
বৈঠকের বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও যে বিষয় দু’টির ব্যাপারে পাকিস্তান অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করছেন বলে প্রকাশ তা হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানীদের ফিরিয়ে নেওয়া। পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তাদের নাকি কোন আপত্তি নেই। ভারত-পাকিস্তান বৈঠকের যখন এই অবস্থা তখন যুগোশ্লাভিয়ায় পাঁচদিনব্যাপী সরকারী সফর শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করেছেন যে, প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর একগুঁয়েমিই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে বাঁধা সৃষ্টি করছে এবং উপমহাদেশে উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে। তিনি ভুট্টোকে আগুন নিয়ে না খেলে বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়ার সুপারিশ করেন।
আসলে যুদ্ধোত্তরকালে দক্ষিণ এশিয়ার এতদঞ্চলের রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে মহলবিশেষ বরাবর একটা অযৌক্তিক মনোভাব পোষণ করে আসছে। শান্তির মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাই আমাদের তরফ থেকে যে প্রস্তাবই দেয়া হয়েছে তাকেই প্রত্যাখ্যান করবার স্বভাবসুলভ একটা মানসিকতা এই মহলের ভিতর কাজ করেছে। ভুট্টো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার পরামর্শদাতা ও মদদদাতাদের ইচ্ছেয় সেই একই সুরে গান গেয়ে চলেছেন।
উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক—নিজ স্বার্থেই সেটা আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী গোষ্ঠী চায় না। তারা নানা ছল-ছুতোয় এই অঞ্চলে উত্তেজনা বজায় রাখতে আগ্রহী। এই উত্তেজনা কোন অবস্থায়ই সাধারণ মানুষের জন্যে কল্যাণকর হতে পারে না। বর্তমান বিশ্বে সমৃদ্ধির জন্যেই অব্যাহত শান্তির প্রয়োজন। একে অস্বীকার করা সমৃদ্ধির পথে অন্তরায় সৃষ্টিরই নামান্তর। আমরা এখনো আশাবাদী। ভারত-পাকিস্তান বৈঠক ব্যর্থ হোক এটা কোন অবস্থায় শান্তিকামী মানুষ চাইতে পারে না। পিন্ডি বৈঠকে ঐক্যমতের যে অভাব লক্ষ্য করা গেছে তা দিল্লী বৈঠকে অবসান হবে বলে আমরা আশা করি।
টিসিবি কর্তৃপক্ষ চোখ কান খুলবেন কি?
গ্রাম বাংলার একটি সুপ্রচলিত প্রবাদ ‘বক আর ঝক কানে দিয়েছি তুলো মার আর ধর পিঠে বেঁধেছি কুলো।’ এই অতি পরিচিত প্রবাদটি বোধকরি আমাদের সরকারী একমাত্র আমদানীকারক সংস্থা টিসিবি’র অস্থিমজ্জায় পর্যন্ত জড়িয়ে আছে। এবং সেই জন্যেই বোধ হয় তাদের ‘মহান কেলেঙ্কারীর’ খবরাখবর যতই দেশের প্রতিটি দৈনিকে প্রকাশ পাক না কেন, তাতে তাদের কিছু এসে যায় না।
যখন গ্রাম বাংলার মানুষেরা বস্ত্রের অভাবে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় জীবনযাপন করছে, অনেকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে বলে খবর বেরুচ্ছে, যখন সূতোর অভাবে কাপড়ের মিলগুলোতে বা তাঁত শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে খবর প্রকাশ পাচ্ছে ঠিক সেই সময় তারই পাশে খবর ছাপা হচ্ছে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় করে টিসিবি’র আমদানী করা হাজার হাজার বেল সূতো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
গতকালকের স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে জানা যায়, গত এপ্রিল-মে মাসে জাপান ও হংকং থেকে টিসিবি’র আমদানী করা সূতার শতকরা ত্রিশ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু সূতা নয়, কয়েকদিন আগে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, টিসিবি’র আমদানী করা প্রায় পাঁচশ’ অটোরিক্সা ও জীপ, ট্রাক ইত্যাদি অর্থাৎ কয়েক কোটি টাকার মূল্যবান জিনিস যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিনষ্ট হবার পথে। এ সমস্ত জিনিস খোলা জায়গায় অযত্নে পড়ে আছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। জাপান, হংকং থেকে আমদানী করা তিন হাজার বেল সূতার মধ্যে সমবায় শিল্প সমিতি কর্তৃক ১,৭৭০ বেল সূতা তাঁতীদের কাছে পৌঁছানো বাদে বাকী ১,২৩০ বেল সূতা এখনো খোলা জায়গায় পড়ে আছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বর্তমান বন্দরে পড়ে থাকা ১,২৩০ বেল সূতার ডেমারেজ হয়েছে তিন লাখ টাকা। এই ডেমারেজ বাবদ ব্যয়িত অর্থ কাপড়ের উচ্চতর উৎপাদন মূল্যের অন্যতম কারণ। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার সব জিনিসই বিদেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর মাসের পর মাস পড়ে থাকে এবং স্বভাবতঃই ডেমারেজের পরিমাণও দিন দিন বাড়তে থাকে। উপরন্তু টিসিবি’র প্রয়োজনীয় গুদাম না থাকার ফলে এই সব দ্রব্য রোদে পুড়ে এবং বৃষ্টিতে ভিজে বিনষ্ট হচ্ছে। অবশ্য এজন্য কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত রেলওয়ে ওয়াগনের অভাব এবং প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে থাকেন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্যকে অবশ্য আমরা একেবারে উড়িয়ে দিইনা। কিন্তু তবু কথা থেকে যায়। এবং তার পরিপ্রেক্ষিতেই উল্লেখ করা যায় টিসিবি’র অতীত ন্যক্কারজনক কার্যকলাপগুলোর কথা যা নতুন করে বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না।
পর্যাপ্ত রেলওয়ে ওয়াগনের অভাব এবং প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থাই টিসিবি’র আমদানীকৃত দ্রব্য বিনষ্ট হবার একমাত্র কারণ তা আমরা সমর্থন করি না। বরং কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করার জন্যে অনেক দিন ধরে বন্দরে মাল ফেলে রেখে অধিক ডেমারেজ লাগিয়ে তা আরো অধিক মূল্যে বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা লাভের একটা সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে বললে কি মিথ্যে বলা হবে? বোধকরি না।
সুতরাং আমাদের বক্তব্য, দয়া করে টিসিবি কর্তৃপক্ষ কানে দেয়া তুলো বের করে এবং পিঠে বাঁধা কুলো খুলে ফেলে চোখ মেলে দেখে আপামর জনগণের বর্তমান নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের প্রেক্ষিতে অনুগ্রহ করে অধিক মনোযোগী এবং কর্মতৎপরতা হবেন কি? হলে তা মানবতার কাজ হবে, ন্যায়নিষ্ঠ কর্তব্য বোধেরই পরিচয় বহন করবে। বাংলার দুঃখী মানুষের সাথে আমরাও আপনাদের কাছে সেই প্রত্যাশাই করি।
বন্ধুরে তুমি বিহনে—
‘বন্ধুরে, তুমি বিহনে বন্ধু,
মুনোব্যথা কাহারে জানাই—
পাষাণে কুটিয়া মাথা
কালে বোবা পীরিতি’—
অনেক অনেক দিন আগে শুনেছিলাম এ গানটি একটি ছবিতে। গায়ক অবশ্য তার মানস প্রিয়ার প্রতি করুণ আতি নিয়ে হয়ত গানটি গেয়েছিলেন। বন্ধু, প্রেমিক, প্রিয়া, মানসপ্রতিমা সর্বকালে সর্বদেশে সকল মানবমানবীরই কাম্য। যে কোন মানবই একজন মানবীর কামনা করেন—একান্তভাবে পেতে চান একজন মানস প্রিয় এবং তারই বিপরীতে একজন মানবীও তাই কামনা করেন। এটা সৃষ্টির প্রথম থেকে হচ্ছে এবং হবে অনাদিকাল পর্যন্ত-সৃষ্টির সর্বশেষ প্রলয় পর্যন্ত। এটা স্বাভাবিক। কাজেই কোন মানব বা কোন মানবী যদি কারো প্রেমে হাবুড়বু খায়- আমাদের এদেশে এখন কখনো কখনো কারো কারো মনে হয়ত বা কিছু রসের খোরাক জোগাতে পারে-তবে রসাল হয় বেশী যে প্রেমের যখন কোন গোপনীয়তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এ ব্যাপারটি নিয়ে এখন আর অনেকেই তেমন কৌতুহলী হয়ে উঠেন না।
কিন্তু কোন মানব-মানবীর কোন চাওয়ায় যদি বিচিত্ৰতা কিছু কেউ খুঁজে পান তবে তা সাধারণ্যে একটি কোতুহলী হয়ে ওঠে অবশ্য। যেমন সম্প্রতি রোমের একটি মহিলা কারাগারের অভ্যস্তুরে একটি বিক্ষোভ-একটি তীব্র অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছে। কারাগারের বন্দীনীর দাবী তুলেছেন, তারা পুরুষ সঙ্গী চান। পুরুষ সঙ্গী না হলে তাদের আর দিন কাটছে না। কতৃপক্ষ যদি তাদের জন্য পুরুষ সঙ্গীর ব্যবস্থা না করতে পারেন, তবে যেন তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। আর এই বিক্ষোভ জানানোর জন্য তারা জেল খানার ছাদে উঠে থালা-বাটি পিটিয়ে গান গেয়ে বাইরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মহিলা জেলখানায় পুরুষ সঙ্গীর দাবী ও চাহিদার খবর এ কিন্তু নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগে খবর পাওয়া গেছে যে, লেবানন বা ইসরায়েলের একটি মহিলা জেলখানায় আবদুল্লাহ নামক একজন লোক মহিলার ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েন। দীর্ঘ তিন মাস তিনি সেই জেলখানায় এক মেয়ের ছদ্ম নামে অবস্থান করেন। প্রতি রাতে জেলখনার মেয়ে কয়েদীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো কে আগে সেই ছদ্মবেশীর ঘরে যাবে। এই প্রতিযোগিতা শেষটায় চুলো চুলিতে পরিণত হবার পর ঘটনাটি কতৃ’পক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়। এবং আবদুল্লাহ ধরা পড়েন। কিন্তু তখন কর্ম কাবার। কিছুদিন পরে দেখা গেল যে, ওই জেলখানার অধিকাংশ মেয়ে কয়েদীই অন্তসত্বা।
এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় মানব-মানবী একে অপরের প্রতি কতখানি আগ্রহী। সত্যিতো বন্ধু বিনে মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা যা ব্যথা অথবা আনন্দের খোরাক কেইবা দিতে পারে। রোমের মহিলা কয়েদীদের পুরুষ সঙ্গী পাবার দাবী কি তাই অসঙ্গত কিছু ?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক