বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৪ই এপ্রিল, রোববার, ৩১শে চৈত্র, ১৩৮০
গোদের ওপর বিষফোঁড়া
দেশ স্বাধীন হবার পর চাল-ডাল সহ নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি তে এমনিতেই জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্ভাবনাও যেন ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। আর তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়িভাড়ার সমস্যা। ফলে অবস্থা আরো সঙ্গীন।
বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত একটি আইন আমাদের দেশে আছে। কিন্তু সেই আইনের বদৌলতে বাড়িওয়ালারই লাভবান হচ্ছে এবং অসহায় ভাড়াটিয়ারা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত উক্ত আইনের বর্মের আড়ালে ভাড়াটিয়ারা আত্মরক্ষা করতে পারছে না। তাহলে ওই আইন কাদের জন্য বা কাদের স্বার্থে?
এছাড়া বক্তব্য আছে। বাড়িওয়ালারা তাদের খুশিমতো বাড়িভাড়া দাবি করে এবং ভাড়াটিয়ারা বাধ্য হয়েই সেখানে গিয়ে পেটে পাথর বেঁধে মাথা গুঁজে। সেক্ষেত্রে কোন অবস্থার বাড়ির যে কত ভাড়া হওয়া দরকার তার কোন মানও এ পর্যন্ত স্থির করা হয়নি। যার ফলে বাড়িওয়ালাদের অমানুষিক দৌরাত্ম্য একদিকে বাড়ছে এবং ভাড়াটিয়াদের দুরবস্থা ক্রমশঃই নিম্নমুখী হচ্ছে। এরই বা প্রতিকার কোথায়?
এরই প্রেক্ষিতে বলা যায়, স্বাধীনতার পর ঢাকার জনসংখ্যা বাড়লেও সরকার কর্তৃক নিম্নমূল্যে বহুতলবিশিষ্ট বাসস্থান নির্মাণের উদ্যোগ এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। অর্থাৎ বাড়ির সংকট যখন বেড়েছে, বাড়িওয়ালারা যখন অসাধু ব্যবসায়ীর মতোই দু’হাতে টাকা রোজগারের সস্তা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একবারেই চুপ রয়েছেন।
এমনিভাবে চারিদিকের অবস্থায় যখন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে তখন নিয়ন্ত্রণ নামক পদ্ধতি প্রতিরোধ না এলে সীমিত আয়ের লোকেরা যে প্রাণে বাঁচার আশা ত্যাগ করতে বাধ্য হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই প্রশ্ন রাখতে হচ্ছে এর শেষ কোথায়?
আমরা এও জানি যে, বাড়িওয়ালাদের দুর্ব্যবহার ও দৌরাত্ম্যে বাড়িভাড়া শুধু দফায় দফায় বাড়েনি বহু ভাড়াটিয়া অপমানিত ও প্রহৃতও হয়েছেন। নিঃসন্দেহে এসকল বিষয় লজ্জাজনক। অথচ অসহায় ভাড়াটিয়ারা যে বেশি ভাড়া দিতে একবারেই অপরাগ একথাও মিথ্যে নয়। জন-জীবনের নিরাপত্তা ও স্বস্তি তাই আজ চূড়ান্ত রকমের বিপন্ন। একথা উপলব্ধি না করে থাকবার জো নেই। এই প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হল, বাড়ি ভাড়া প্রসঙ্গে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট মহলের কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকার শহরে কতগুলো বাড়ি ভাড়া আছে এবং সেই বাড়িগুলির ভাড়া কত হওয়া উচিত সে বিষয়ে সরকারের পরিষ্কার বক্তব্য রাখতে হবে। একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এই সংঘের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যারা বাড়িভাড়ার সঠিক মূল্যায়ন করবেন। এবং ভাড়াটিয়ারা যেন প্রয়োজন বিশেষ তাদের সক্রিয় ও দ্রুত সহায়তা লাভ করতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।
অপরদিকে নিম্নমূল্যে বহুতলবিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে সরকারকে সমস্যার বাস্তব সমাধান করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। কারণ একথা সত্য যে, চাহিদার তুলনায় যদি সরবরাহ কম থাকে তাহলে সংকট দেখা দেবেই। সুতরাং শুধু আইন করে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করলেই সমস্যার বাস্তব সমাধান হতে পারে না। এর জন্য চাই দ্বি-মুখী। উদ্যোগ সবচেয়ে বড় কথা হল নাগরিক জীবন সরকারের কার্যকলাপের সততায় একটু আস্থা খুঁজে পেতে চায়। অন্ন-বস্ত্র ও ঠাঁই এর মৌলিক চাহিদা পূরণে ন্যূনতম আশ্বাস চায়। অতএব অবিলম্বে এ ব্যাপারে সুষ্ঠু ও কার্যকরী পরিকল্পনা কাজে নামতে হবে।
সরকারকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অন্ন-বস্ত্রের চিন্তায় ব্যাকুল রাজধানীর নাগরিকদের জন্য বাড়িভাড়া সমস্যাটি গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে না দাঁড়ায়।
এক্সরে ফিল্ম ও ওষুধপত্রের অভাব প্রসঙ্গে
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে এক্স ফিল্ম সহ বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদির দারুন সংকট চলছে। ফলে, হাসপাতালের আবাসিক আগমনকারী হাজার হাজার রোগীর জীবন এখন দারুণভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অনেকের ধারণা, এসব সংকট সৃষ্টির পেছনে অসাধু কর্মচারী ও স্বার্থান্বেষী মহলের প্রত্যক্ষ সুপরিকল্পিত কারসাজি আছে। তা না হলে পর্যাপ্ত ওষুধ ইত্যাদি সরবরাহ দেয়া সত্ত্বেও এত ঘন ঘন সংকট দেখা দেয়া সম্ভব নয়। গত ছ’মাসে শুধুমাত্র এক্সরে ফিল্মের সংকট তো তিন তিনবার দেখা দিল।
গত ২৫শে ফেব্রুয়ারির স্টকের হিসেব অনুসারে কিছুদিন আগে খবরের কাগজে বেরিয়েছিল যে, টিসিবির ৫টি গুদামে নাকি প্রায় ৪ টনেরও বেশি এক্সরে ফিল্ম মজুদ আছে।
অথচ মাত্র দেড় মাস যেতে না যেতেই শোনা যাচ্ছে ফিল্মের স্টক প্রায় শেষ। শুধুমাত্র অত্যন্ত জরুরি এক্সরে করার মত খুবই সামান্য পরিমাণ ফিল্ম আছে। তাও নাকি যে কোন মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। মেডিকেল স্টোরেও নাকি নেই বলে তারা সরবরাহ দিতে পারছেন না।
তাহলে এত অল্প দিনে এত ফিল্ম কোথায় কিভাবে ব্যবহৃত হল? যারা এই ফিল্ম বিভাগের দায়িত্বে আছেন তারা কি নিজের বুকে হাত রেখে একথা শপথ করে বলতে পারবেন যে, উল্লিখিত ফিল্ম অত্যন্ত সৎ ভাবেই সৎপাত্রে ব্যবহৃত হয়েছে? অনেকের বিশ্বাস, এ প্রশ্নে হয়তো তাদের অনেকেরই মনেই এক অজানা হৃদ কম্পন শুরু হবে।
শুধু ফিল্ম কেন বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নিয়েও নানা গুণীর কতো না তেলেসমাতি খেল। আর মাঝখানে নিরীহ দরিদ্র রোগীদের হয়রানি-জীবন-মৃত্যুর অনিশ্চিত দোলায় হাবুডুবু। জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য যেসব এন্টিবায়োটিক ওষুধের একান্ত প্রয়োজন, তার মধ্যে হাসপাতালে বর্তমানে শুধুমাত্র পেনিসিলিন আছে। কিন্তু টেট্টাসাইক্লিন, এম পিসিলিস, ক্লোরাম ফেনিকল ইত্যাদি জীবাণু প্রতিষেধক ওষুধ একেবারেই নেই।
সর্দি-কাশি ছাড়াও প্রতিটি অস্ত্রোপচারের আগে রোগীকে এন্টি হিস্টামিল ট্যাবলেট বা ইনজেকশন দেয়া প্রয়োজন কিন্তু সেই ইনজেকশন হাসপাতালে নেই।
যারা পেপটিক আলসারে ভুগছেন তাদের জন্য কোন এন্টাসিড নেই। এর পরিবর্তে ট্রিপল কার্ব নামে যে এন্টাসিড দিয়ে বর্তমানে রোগীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে তা নাকি ট্রিপলই নয়। আসলে একটি কার্বনেট লবণ দিয়েই কাজ সারা হচ্ছে।
শতকরা প্রায় একশো জন শিশু কৃমিতে আক্রান্ত। অথচ হাসপাতালে নাকি কোন কৃমি এর প্রতিষেধক নেই। আমাশয় এর প্রতিষেধক ফ্ল্যাজল, মেন্ট্রাফস ট্যাবলেট অথবা এন্টারো ভায়োফর্ম ইত্যাদি তো বহুদিন থেকেই নেই। প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ প্রতিরোধের জন্য প্রসূতি বিভাগের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ওষুধ মেথারজিল ইনজেকশন। অথচ হাসপাতাল এ বস্তুটি একবারে নেই বললেও চলে।
আগে হাসপাতাল থেকে রোগীকে নানা ধরনের ভিটামিন ট্যাবলেট সরবরাহ করা হতো। কিন্তু কর্তাদের মেহেরবানীতে সে জিনিস এখন আর রোগীর নাগালে যায় না।
কতকগুলো মিক্সচার জাতীয় ওষুধও দেয়া হতো। যেমন, মিক্সড কারজিলেটিভ, মিক্সড ডায়রিয়া, মিক্সড এজমেটিকাজ কিম্বা এরগট মিক্সচার। অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতে এগুলো অত্যন্ত কার্যকরী ওষুধ ছিল এবং এসব তৈরি করতে খরচও খুব কম। অথচ, এগুলো এখন আর রোগীদের দেয়া হচ্ছে না। কারণ নাকি সরবরাহ নেই।
ইদানিং দেশে খোস-পাচড়ার অত্যন্ত প্রকোপ দেখা গেলেও এদের প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক ওষুধও হাসপাতালে নেই। যেমন এ্যাম ক্যারিয়ল অথবা সালফার অয়েন্টমেন্ট। সালফার অয়েন্টমেন্ট সম্পর্কে জানা গেছে যে, যখন সালফার পাওয়া যায় তখন ভেসলিন থাকে না, আবার যখন ভেসলিন পাওয়া যায় তখন আবার সালফার থাকে না। ফলে অয়েন্টমেন্ট তৈরি সম্ভব হয়না।
ক্যান্সার, মানসিক রোগ, চোখ-নাক-কান-গলা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই।
এছাড়া হাসপাতালে অস্ত্রোপচারকক্ষে এন্টিসেপটিক ক্রিম লোশনেরও দারুণ অভাব। মারফিউ রোক্রোস, মারবায়োলেট, আয়োডিন ইত্যাদি জীবাণু নাশক ওষুধের বোতলের নাকি অস্ত্রোপচারের বর্তমানে ডেটলের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ক্ষতস্থানে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। অস্ত্রোপচারকক্ষে গ্রাউস এবং স্পিরিটেরও অভাব।
অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির দারুণ করুণ অবস্থা। ছুরিতে ধার নেই, কাঁচি ভোতা, আরো কত কি। এ বাদে রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব তো চিরন্তন আছেই।
যাহোক, সব মিলিয়ে আমাদের মনে কয়েকটি প্রশ্ন জাগছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি তার বার্ষিক ষান্মসিক বা দৈনিক কী পরিমাণ ফিল্ম ওষুধ ইত্যাদি প্রয়োজন তা জানেন? আর যদি জেনে থাকেন তাহলে তারা কি উপযুক্ত সময়ে আগে টিসিবি’র কাছে তাদের রিকুইজিশন দিয়েছিলেনম যদি দিয়ে থাকেন এবং টিসিবি যদি তদানুসারে সরবরাহ না দিয়ে থাকেন তবে নিঃসন্দেহে ঘাড়েই বর্তায়। কিন্তু যদি একথা সত্যি হয় যে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই সময়মতো রিকুইজিশন দেন নি, তাহলে অবহেলা সম্পূর্ণ দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই। এই আগে না হয় আমদানি নেই বলে একটা ফ্যাকড়া ছিল, কিন্তু এখন কোন ফ্যাকড়ার জন্য মানুষের এ দুর্গতি? তবুও বলা যায় পাটা-পুতোর এ ঘষাঘষির মাঝে মরিচের জীবন শেষ না করে ঠিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে রোগীকে বাঁচানোই আজকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ জন্য যাবতীয় দুর্নীতি, আমলার ঘাপলা অবহেলা পরিহার করতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটু কঠোরভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে মানুষেরে দুর্গতি আর থাকে না বলেই সবাই ধারণা করেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক