বাংলার বাণী
ঢাকা : ৮ই অক্টোবর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ২১শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
পরামর্শের প্রহসন নয়—
অবস্থার কি নিদারুণ বৈপরীত। একদিকে খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় শিশুদের জন্য খাদ্যের অভাবে আটা গোলা খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন আর একদিকে গুদামে পচে নষ্ট হচ্ছে পাঁচ হাজার বস্তা গুঁড়া দুধ। এমনি বৈপরীত্য সবখানে। দুর্ভিক্ষের আসল চেহারাই হয়তো তাই। একদিকে বিলাস বাসনের প্রাচুর্য আর একদিকে অনাহার, ক্ষুধা, মৃত্যু। বাংলাদেশের আজ এটাই বাস্তব ছবি।
পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ, পাবনা জেলা ত্রাণ গুদামে পড়ে থাকা পাঁচ হাজার বস্তা গুঁড়া দুধ পচে গেছে। এ দুধগুলো দুর্গত মানুষের মধ্যে বিতরণের জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু গুদাম থেকে তা আর বের হয়নি। গুদামেই থেকেছে আর জলে ভিজে যত্নের অভাবে তা খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
গ্রামগ্রামান্তর থেকে অনবরত আসছে মৃত্যুর খবর। সে খবর এমনকি এমন যে কর্মঠ আর ত্বড়িৎকর্মা সরকার সেও আর অস্বীকার করতে পারছে না। সব বয়সের নর-নারী মরছে, কিন্তু শিশু আর বৃদ্ধদের মৃত্যুর সংখ্যাই সর্বাধিক।
শিশু খাদ্যের অভাবের ফলে মন্ত্রী মহোদয় সুস্থ এবং বয়স্ক লোকদের দুধ না খেয়ে তা লঙ্গরখানায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি শিশুদের দান করবার আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু শিশুদের বেলায়ই নয়, আজকের এ দুর্ভিক্ষ শুরু হবার কাল থেকেই ঊর্ধ্বতন মহলের তরফ থেকে বিত্তশালীদের প্রতি কৃচ্ছ্রতা পালনের আহ্বান জানানো হচ্ছে। উদাত্ত কন্ঠে তারা আহ্বান জানিয়েছেন সমাজের উঁচু মহলের মানুষের প্রতি, তারা যেন খাদ্য গ্রহণে সব রকম বিলাসিতা বর্জন করে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেন।
সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে উঁচুতলার ক’জন লোক অনাহারক্লিষ্ট মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছেন তা মন্ত্রী মহোদয়ই বলতে পারেন; কিন্তু এত কিছুর পরও বিলাস ভোজনের নানা খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। এমনকি সরকারী মহলেও খানাপিনার ব্যাপারে কোনো প্রকার রাশ টানা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
আমাদের কাছে এই আহ্বান, এই উদাত্ত কন্ঠ সবকিছুই কেমন প্রহসনের মতো মনে হয়েছে। সরকারী মহল থেকে বার বার বলা হয়েছে দেশের এই সংকটের জন্য মূলতঃ মওজুতদার, কালোবাজারী এবং চোরাচালানকারীরাই দায়ী। আর কে না জানে সংকট সৃষ্টিকারী এই মানবেতর জীবগুলোই বর্তমান সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা। সরকারী কর্তৃপক্ষেরও এটা জানা। জনৈক মন্ত্রীর কথা অনুযায়ীই এদের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবার আগে অজু করে নিতে হয়। সবকিছু জেনে শুনেও যখন আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা এদের প্রতিই কৃচ্ছ্রতা পালনের আহ্বান জানান, অনাহারক্লিষ্ট মানুষের সেবায় এগিয়ে আসবার জন্য ঘন ঘন অনুরোধ-উপরোধ করেন তখন তা প্রহসনের মতো দেখায় বৈ কি?
দুর্গত শিশুদের আটা গোলা খাবার পরামর্শ দেবার আগে মন্ত্রী মহোদয় কি তদন্ত করে দেখবেন পাবনায় পাঁচ হাজার বস্তা গুঁড়া দুধ কাদের গাফিলতির ফলে নষ্ট হয়ে গেছে? তিনি এবং তাঁর সরকার যাদের এই সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী মনে করেন তাদের কি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে পারেন?
বাড়ী ভাড়া সংক্রান্ত উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকারের ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বাড়ী ভাড়া সমস্যার সমাধানের জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বনের কথা ঘোষণা করেছেন। বাড়ীওয়ালা ও ভাড়াটেদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট মতামত নেবার জন্য কিছু প্রশ্নমালা নির্ধারণ করেছেন। এই প্রশ্নমালার কিছু বাড়ীওয়ালাদের জন্য এবং কিছু ভাড়াটেদের জন্য। গত পরশু দিনের এক সংবাদে জানা গেছে, প্রশ্নগুলো বিতরণ বা প্রচারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাকি তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। তাছাড়া ইংরেজীতে প্রশ্নগুলো সাইক্লোস্টাইল করা হয়েছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় তা অত্যন্ত কম। প্রশ্নগুলোর উত্তর গ্রহণ করার পর ভূমি সংস্কার ও রাজস্ব মন্ত্রণালয় কিভাবে বাড়ী ভাড়া সমস্যার সমাধান করবেন তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে প্রশ্নগুলো কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্নের সমাহার আমরা লক্ষ্য করেছি। বাড়ীওয়ালাদের কাছে যে সকল প্রশ্ন করা হয়েছে তার মোট সংখ্যা বারো এবং ভাড়াটেদের কাছেও বারোটি প্রশ্ন করা হয়েছে। প্রশ্ন সমূহের উত্তর ভাড়াটে বা বাড়ীওয়ালারা যা দেবেন সেটাই সত্য। কোনো যাচাই বা পরীক্ষা করার পদ্ধতি রাখা হয়নি। যেমন ভাড়াটেদেরকে বলা হয়েছে—‘আপনার বাড়ীওয়ালা কি গৃহের পুনঃর্নির্মাণ, জরুরী সুযোগ সুবিধা প্রদানে তার দায়িত্ব মেনে চলছে? এ প্রশ্নের উত্তর নিঃসন্দেহে বাড়ীওয়ালাদের সঙ্গে মতদ্বৈত হবে। ভাড়াটেদের নিকট অন্য একটি প্রশ্নে বলা হয়েছে, ‘আপনার এলাকায় কি আপনার নিজস্ব বাড়ী আছে? থাকলে কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে? যদি ভাড়া দেয়া হয় তাহলে মাসিক ভাড়া কতো?’ এ প্রশ্নটিরও সদুত্তর পাওয়া যাবে না। কেননা, ইতিপূর্বে সরকার এক নোটিশ জারি করে বলেছিলেন—যে সকল সরকারী কর্মচারীর ঢাকায় নিজস্ব বাড়ী রয়েছে তারা সরকারী বাসায় থাকতে পারবেনা। সরকারের সে আদেশ বা কতটুকু কার্যকরী হয়েছে তাতে প্রচুর সন্দেহ রয়েছে। বাড়ীওয়ালাদের নিকট যে সকল প্রশ্ন করা হয়েছে, তার মধ্যে একটিতে রয়েছে ‘বাড়ী নির্মাণের তারিখ ও মোট খরচের হিসাব সম্বলিত একটি প্রশ্ন।’ অন্য একটি প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়েছে যে, গত দশ বছরে এ পর্যন্ত কতবার ভাড়াটে বদল হয়েছে এবং তারিখসমূহ ও কারণ কি কি? ভাড়াটের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য আছে কি? অথবা এ সম্পর্কিত কোনো সমস্যা? অনুরূপ আরও একটি প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়েছে—‘যদি প্লটটি অন্য কারো কাছ থেকে কেনা হয় তাহলে এর মূল্য কত দিয়েছেন এবং এর উন্নয়নের জন্য কত খরচ করেছেন?’ আমাদের ধারণা, বাড়ীওয়ালারা এ ধরনের প্রশ্নের সটিক কোনো উত্তর দেবেনা। উত্তর যাচাই করার মতো কোনো ব্যবস্থাও সরকার রাখেননি। তাছাড়া বাড়ীওয়ালাদের সঙ্গে ভাড়াটেদের উত্তরের মতদ্বৈততা নিঃসন্দেহে দেখা দেবে। কর্তৃপক্ষ কোনো পথ রাখেননি তা বিচার করার। সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটি হবে সেটা হলো—এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে এবং তা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বহু সময় অতিবাহিত হবে। তারপর ভাড়াটিয়া একদিন ভুলেই যাবে কর্তৃপক্ষের এহেন প্রচেষ্টার কথা। সঠিক উত্তর পাবার জন্য যে যাচাই করার পদ্ধতি অবলম্বন করা দরকার ছিল তা অবলম্বন না করে কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টিই প্রহসনে রূপ দিয়েছেন। তার উপর ইংরেজীতে প্রশ্নগুলো বিতরণ করায় ইংরেজী পড়তে জানেন যারা অর্থাৎ শিক্ষিত মানুষরাই প্রশ্নের উত্তর দানে সক্ষম হবে। অথচ লক্ষ লক্ষ ভাড়াটে রয়েছেন যারা অল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষ। তাদের নিঃসন্দেহে কর্তৃপক্ষের এ প্রচেষ্টার প্রতি আগ্রহ কম থাকবে। তবু আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবো বাড়ী ভাড়া সমস্যার একটা আশু সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে। এবং যে পথই কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করুন না কেন তা যেন দ্রুত বাস্তবায়িত হয়—সেটাই সবার দাবী।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক