You dont have javascript enabled! Please enable it! আন্তর্জাতিক দত্তকের গল্পের এক আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু জোয়েল - টুডি - সংগ্রামের নোটবুক
জোয়েল ও টুডি হার্ট
আন্তর্জাতিক দত্তকের গল্পের এক আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু, জোয়েল ও টুডি হার্ট দম্পতি কিউবেকের মানুষের কাছে এক পরিচিত নাম । ওদের কাজকর্মের যখন থেকে শুরু, তখন থেকেই এলাকার মানুষ ওদের চেনে। ১৯৭২ সালে দম্পতি যখন একটি যুদ্ধশিশু দত্তক নেন, তখন জোয়েল জন অ্যাবট কলেজে চেয়ারম্যান, হিউম্যানিটিজ ডিপার্টমেন্ট এবং স্যার জর্জ কলেজে (বর্তমানে কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) ফিলসফির লেকচারার। তার স্ত্রী ট্রডি তখন শিক্ষকতা করতেন। দম্পতি তখন বিকনসফিল্ড, কিউবেক-এ বাস করতেন। সে সময়ে তাদের চারটি সন্তানের মধ্যে চারটিই দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে নেয়া । শ্যামা ওদের পঞ্চম সন্ত নি । হার্ট দম্পতি অনাথদের গৃহ খুঁজে দিতে এতই দায়বদ্ধতা অনুভব করতেন যে, তারা একের পর আরেক শিশু দত্তক নিয়েছিলেন, একই উদ্দেশ্যে – সবাইকে আপন সন্তানে র স্নেহে বড় করে তােলার জন্য । ১৯৭৬ সাল নাগাদ হার্টস পরিবারের সন্তান সংখ্যা নয়ে পৌছায় (ছয় ছেলে এবং তিন মেয়ে) যাদের মধ্যে কেবল শেষ সন্তানটি পরিবারের ঔরস সন্তান । ছয় ছেলের মধ্যে পাঁচজনের জন্ম কানাডাতে। একজনের জন্ম হয়েছিল ভিয়েতনামে । মেয়ে তিনজনের মধ্যে একজন কানাডাতে, একজন বাংলাদেশে, আর একজন হাইতিতে। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশক জুড়ে দম্পতি তাদের পেশা ছাড়াও আরও অনেক স্বেচ্ছাশ্রমের উদ্দ্যোগে যােগ দিতেন। এছাড়া নয়টি সন্তানের দেখাশােনাতাে আছেই। সে সময়টিতে দায়িত্ব ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি)-এর সাথে জড়িত ছিলেন যেটা আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে আলােচনা করেছি। তারা শুরু থেকেই সংস্থার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন গেট টুগেদার, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, পটলাক ডিনার, কফির আসর এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন।
তাছাড়া সিটিজেন অ্যাডাপশন কোয়ালিশন এবং ওপেন ডাের সােসাইটি’র গেট টুগেদারে হার্টসরা বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। লক্ষণীয় যে, তারা সে সময়ে কানাডীয়দের মধ্যে তারা সক্রিয়ভাবে সাড়া জাগানাের জন্য বেশ সুনাম অর্জন করেন। ওপেন ডাের সােসাইটির মন্ট্রিয়ল চ্যাপ্টারের মাধ্যমে হার্টসরা তৃতীয় বিশ্ব থেকে অভিবাসনের জন্য লবিং করেন । তাদের দায়বদ্ধতা ওপেন ইমিগ্রেশনের জন্য এত গভীর ছিল যে, সাধারণ অভিবাসনের জন্য সমর্থন করতে গিয়ে বিশেষ করে ১৯৭২ সালে উগান্ডার অভিবাসীদের বিষয়ে জোয়েল এক আবেগী লড়াইয়ে লড়েছিলেন। স্থানীয় সংবাদপত্রে তখন তার নাম দিয়ে সংবাদ ছেপেছিল তার উদ্যোগের বিষয়ে। সেখানে জোয়েল এমনই এক কানাডীয় যে, কানাডার দায়বদ্ধতার কথা ভােলেননি কখনাে। এখন থেকে কয়েক পুরুষ আগে যে ইউরােপীয়রা কানাডাতে এসেছিল, তাদের কারােরই ইতিহাস ভুলে যাওয়া উচিত না বলে জোয়েল মন্তব্য করেন। সে সময়ে সবার কাছে জোয়েলের বক্তব্যের উপস্থাপনটি খুব সুন্দর ও সাবলীল মনে হয়েছেঃ “তাদের পিতামােহরা অনেকেই নিঃস্ব অবস্থায় এসে উঠেছিলেন। তাই সবারই উচিত অভাবী মানুষজনকে সহায়তা যােগানাে।
এ সাহসী এবং নিঃস্বার্থ দম্পতি বিশ্বাস করতেন যে, তৃতীয় বিশ্বে বহু শিশু মহাসঙ্কটে রয়েছে। এবং ওদের জন্য অন্তত কিছু না কিছু করতেই হবে। এফ এফ সি’র সচিব হওয়ার দায়ে ট্রডি তৎকালে বনি আর ফ্রেড যখন প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করতেন। স্বভাবতই তখন তাদের বাড়ির কাজকর্মে দুহাত বােঝাই থাকত, এজন্য যে বাড়িতে নয়টি শিশু বাস করত। হার্টস দম্পতি সর্বদাই সময় বের করেনিতেন দত্তক আইন, নাগরিক অধিকার, পাবলিক শিক্ষা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক দত্তকের সঙ্গে যেসব বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সেসব বিষয়ে আলােচনা যাতে সম্ভব হয়, সর্বাধিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেগুলাে সম্পন্ন করতেন।
১৯৭২ সলে যখন তারা আরেকটি শিশু নেবার চিন্তাভাবনা করেন তখন সিদ্ধান্ত নেন যে, সে শিশুও তারা নেবেন দত্তকের মাধ্যমে। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের অবস্থা সম্পর্কে তারা সে সময়ে জানতে পারেন একটি রেডিও সম্প্রচার শুনে পূর্ব পাকিস্তানে তখন যুদ্ধাবস্থা চলছে। খবরটি তাদের মনে তাৎক্ষণিক অভিঘাত তৈরি করে, “বেতারে খবরটা যখন আমি শুনি, আমি তখনই ভেবেছি যে বাংলাদেশে আমাদের জন্য একটি শিশু রয়েছে, স্মৃতিচারণে বলেন কোমলকণ্ঠা ট্রডি। ক্যাপুচিনােরা যখন দত্তকের জন্য আগ্রহীদের নাম সংগ্রহ করছিলেন, তখন হার্ট দম্পতিরা তাদের নাম সে লিষ্ট-এ যােগ করতে অনুরােধ করেন।
১৯৭২ সালে শ্যামা যখন হার্ট দম্পতিদের বাড়িতে এলাে, পরিবারের কোনাে প্রস্তুতির দরকার ছিল না। কারণ অন্য চারজন ছেলেমেয়ে যে কেবল দত্তক সন্তান তাই নয়, তারা সকলেই ছিল অন্তঃবর্ণীয় অর্থাৎ গােত্রের দিক দিয়ে তারা ককেশীয় মা-বাবার চেয়ে ভিন্ন ছিল। “আমাদের পরিবারে ইতােমধ্যেই বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির সন্তান তাে ছিলই,” বলেন ট্রডি । লক্ষণীয় যে, হার্টদের পঞ্চম সন্তান শ্যামার আগমন পরিবারে সকলের মনে খােদিত। হয়ে আছেঃ “আমার মা-বাবা আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন, শ্যামাকে অভ্যর্থনা জানাতে এবং বিমানবন্দরে তার ভাইবােনদের দেখাশােনা করার জন্য। তখন আমরা অভিবাসনের কাগজপত্র সই নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম,” বলেন ট্রুডি। যখন দম্পতি দুই মাস বয়সের মেয়েটিকে প্রথমবারের মতাে দেখলেন, টুডি যেন, তার নিজের কথায়, “ভেসে গিয়েছিলেন উত্তেজনা আর আনন্দে।” ঐ মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল তিনি “কেবল মেয়ের পানে তাকিয়ে রয়েছিলেন, এক দৃষ্টিতে কেবল । আমি ভেবেছিলাম আমি অত সুন্দর আর কাউকে কোনােদিন দেখি নি,” আবারও বলেন টুডি । সে দিনের সে উল্লসিত মুহূর্তগুলাে এমন মনে হয়েছিল যেন এর আগে আর এমন আনন্দের মুহূর্ত তার জীবনে আর কখনাে প্রত্যক্ষ করেননি। তিনি যখন শিশুটিকে তার বুকে দেন, তখন যেন স্বর্গীয় আনন্দে ভাসতে লাগেন।
এর পরেই তারা হুড়মুড় করে বেরিয়ে যান বিমানবন্দর থেকে। শুধু সাংবাদিকদের অনুরােধে ছবির জন্য পােজ দিলেন কয়েক মিনিট। তারা যখন লবিতে গেলেন, দেখলেন কীভাবে সেখানে শিশুর নানা-নানি ও ভাইবােন অপেক্ষা করছিলেন। তাদের বাকি ছেলেমেয়েরা শিশুটিকে দেখে এত অবাক ও রােমাঞ্চিত যে, ছােট্ট বােনটি তাদের বাংলাদেশ থেকে কানাডা এসে পৌঁছেছে তাদের বাড়িতে তাদের পরিবারের একজন হবে বলে। তারা সবাই যারপরনাই আনন্দিত, বিজয়ের আনন্দে।
হার্টস দম্পতির কাছে দত্তক বিষয়টি এত সহজাত ও সাভাবিক প্রক্রিয়া যে, ছেলে মেয়েরা কখনাে দত্তক বিষয়ে অবাক হয়নি। “আমরা পরিবার তৈরির জন্য দত্তক নেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বিবেচনা করি,” হার্ট দম্পতি বলেন। তাদের এ ধরনের মন্তব্য সাধারণত সন্তান উৎপাদনে অক্ষম কানাডীয় দম্পতিদের মন্তব্য থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন; এটাকে ভিন্ন বলা যেতে পারে এজন্য যে তারা শুরু থেকে তাদের পরিবার গড়েছেন দত্তকায়নের মাধ্যমে। হার্টসরা দত্তক নেয়াকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারূপে দেখেন, পরিবার তৈরি অথবা সম্প্রসারিত করার আরেক উপায়রূপে বিবেচনা করেন। অনেকে ভাবতে পারেন যে তারা সক্ষম দম্পতি না । দত্তকায়নের মাধ্যমে পরিবার বর্ধিত করার বিষয়টি তাদের কাছে এতই একটি সহজাত প্রক্রিয়া ছিল যে, তারা এটা নিয়ে অন্য কিছু ভাবার কথা মনেও করেননি।
হয়তাে এ কারণেই হার্ট দম্পতি কাঁধ ঝাকুনি দিয়ে বলেন যে, এটা তেমন কোনাে ব্যতিক্রমী বা অসাধারণ ব্যাপার নয়। তাদের বিনয়ের প্রশিক্ষণ এমনই রপ্ত যে, তারা অন্যদের বলেন যে তাদের এমন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা হােক যে আর দশজন কানাডীয় দম্পতির মতাে। তাদের পরিবারে অসাধারণ কিছুই তাে নেই। “আমরা দত্তক নিয়ে বিশেষ প্রশংসনীয় কিছুই করিনি,” বলেন ট্রডি । যখন কেউ তাদের ছেলেমেয়েদের অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে চেষ্টা করেছেন, হার্টরা তাদের ছেলেমেয়েদের দেখিয়ে বলতেন, “কানাডাতে হােক বা অন্য কোথাও হােক ওদের জন্ম, ওরা আমাদেরই সন্তান, ওরা কখনই নৈরাশ্যের সন্তান নয়” যেমনটি কোনাে কোনাে সংবাদপত্র লিখেছিল যুদ্ধশিশুদের অভ্যর্থনা জানানাের ছলে।
আমরা শীঘ্রই দেখতে পাব হার্ট দম্পতি কখনাে তাদেরকে নিয়ে কোনাে প্রচারণা হােক বা সংবাদপত্রে লেখা হােক সেটা চাননি । টুডি খােলাখুলি নিজের অনুভূতির কথা বলেন, “এসব ছাপা বা আমাদেরকে নিয়ে লেখা হচ্ছে দেখে আমি একটুও স্বস্তিবােধ করছি না। আমার যদি কোনাে গল্প থাকে তাহলে আমিই সেটা বলব । অধিকতর পছন্দ করব আমি নিজে সেটা লেখার, যেসব বিষয়গুলাে আমার কাছে জরুরি এবং যেগুলাের ভিত্তিমূলে থাকবে আমার পছন্দের বিষয়, যেমন – শ্রদ্ধাশীলতা। আপনার উদ্দেশ্য ঠিক কিন্তু ওগুলাে আমার বক্তব্য নয়।” তার মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে টুডি কথাগুলাে এভাবে উচ্চারণ করেন।
হার্ট দম্পতি এ ব্যাপারে সচেতন যে কানাডার ভেতরে এবং বাইরে অনেকে আন্তর্জাতিক দত্তক সমর্থন করেন না। যারা বিভিন্ন বর্ণীয় পশ্চাদপটের মধ্যে দত্তক নেয়া-দেয়ার বিরুদ্ধে, তারা বিশ্বাস করেন যে এটা শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে তার মা-বাবা তার আপন পশ্চাদপটেরই হলে ভালাে। নতুবা অনেকে মনে করেন যে, শিশুটি জাতিগত ও সংস্কৃতিগতভাবে বঞ্চিত হবে; অনেকে আন্তবর্ণীয় দত্তককে জাতিগত গণহত্যার শামিল বিবেচনা করেন।
একই সুরে গেয়ে তাদের অবস্থান জানাতে দম্পতি ইতােমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাদের বড় পরিবার হবে, এবং অন্ততঃপক্ষে সে পরিবারের এক অংশ হবে দত্তকের মাধ্যমে । সব রকমের বিরূপ সমালােচনা সয়ে তারা তাদের প্রিয় ভাবনা, ধারণাগুলির প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছেন। এত বছর অতিবাহিত হবার পরও হার্ট তখনকার ভাবনার কথা এখনও মনে রেখেছেন: “আমরা তখন কী ভাবছিলাম?” জিজ্ঞাসা করেন ট্রডি । তিনি নিজেই আবার এভাবে তার উত্তর দেন: “আমরা আর একটি সন্তান চেয়েছিলাম, একটি শিশুর জন্য একটি বাড়ির দরকার ।” দত্তক বিষয়ে তাদের এতাে অনুরাগ ও অনুভূতি যে তাদের আবেগপ্রবণতা লক্ষণীয় যখনি তারা দত্তকায়নের কথা বলেন।
স্মৃতিচারণের সময় হার্ট দম্পতি বলেন, ১৯৭২-এ যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে আসার পর একটি বিব্রতকর গুজব ঐ শিশুদের কেন্দ্র করে দ্রুত ছড়াচ্ছিল। তারা শুনতে পান যে, বাংলাদেশ দেশ থেকে সদ্য আগত শিশুরা কানাডাতে তাদের বাবা-মায়েদের দ্বারা অবহেলিত হচ্ছে। আমরা চতুর্থ অধ্যায়-এ তাদের ব্যাপারে পড়েছি। গুজব এত দ্রুত ছড়াচ্ছিল যে, দত্তকগ্রাহী শিশুদের বাবা-মায়েরা তাদের কোনাে যত্ন করছেন না। বাবা-মায়েরা এটা শুনে সংশ্লিষ্ট সবারই খুব খারাপ লেগেছিল যেহেতু ঐ গুজবের কোনাে ভিত্তি ছিল না । হার্টরা সাথে সাথে সংক্ষেপে ঢাকাস্থ সুপিরিয়র এবং যুদ্ধশিশুদের ‘সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক” সিস্টার মাগারেট ম্যারিকে চিঠি লিখেছিলেন। “আমি সিস্টারদের আশ্বস্ত করেছিলাম যে, উক্ত শিশুরা তাদের পােষ্যকারের বাড়িতেই আছে এবং তাদের যথােপযুক্ত আদর যত্ন হচ্ছে। আমি ছবি তুলেও চিঠি পাঠিয়েছিলাম”।
হার্ট দম্পতির ছেলেমেয়েদের লালন-পালনের বিষয়ে একটি বিশেষ দিক লক্ষণীয় যে, তারা ব্যক্তিগতভাবে কোনাে ধরনের অসত্য বা বিশেষ গল্পের ধার (storyline) করেননি তাদের ছেলেয়েদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে। সাধারণত দেখা যায় অনেক পােষ্যক পিতা-মাতা তাদের দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি কাল্পনিক বা অসত্য গল্প তৈরি করেন তাদের জীবনবৃত্তান্ত ঘিরে । তারা তাদের দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েদের ধারণা দেন যে, তারা খুব আলাদা অথবা বিশেষ ছেলেমেয়ে – অন্যদের চেয়ে তারা অনেক ভিন্ন। কিন্তু হার্ট দম্পতি এ বিষয়ে বেশ সতর্ক ছিলেন, যদিও শ্যামা একটি যুদ্ধশিশু, হার্ট দম্পতি তাদের সব সন্তানের মতাে ওকেও একইভাবে আদর যত্ন করেছেন। তাই তারা শ্যামাকে তাদের শিশু হিসাবে বড় করেছেন। তাকে যুদ্ধশিশু আখ্যা দিয়ে অন্যান্য শিশুদের সাথে কোনাে পার্থক্যের সৃষ্টি করতে চাইনি । “তা না হলে শ্যামার উপর অতিরিক্ত একটা লেবেল এঁটে দেয়া হতাে”, বলেন ট্রডি । তারা কখনাে চাইনি তাদের ছেলেমেয়েদের একজনকে অন্যজনের চেয়ে আলাদাভাবে দেখা হােক । টুডির মতে; “দত্তক নেয়া আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতি; এটা ধরে নেয়েই আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে”। পাড়া-প্রতিবেশিরা জানত শিশু দত্তক নেয়া হার্ট পরিবারে স্বাভাবিক ব্যাপার । জোয়েল বলেন, তাই প্রতিবেশিরা কখনাে তাদের ছেলেমেয়ে বা তাদের মা-বাবা সম্পর্কে কোনাে ব্যঙ্গোক্তি করেননি। সে অর্থে চারিদিকের সবাই হার্টস পরিবারকে স্বাভাবিক ও সহজাত পরিবার। হিসাবে গণ্য করেছে।
২০০৯-এর জুলাই মাসে জোয়েলের প্রয়াণ ঘটে। হার্ট পরিবারের সদস্যরা অন্যান্য শুভানুধ্যায়ীদের সাথে নিয়ে শােক পালন করেন। জীবিত থাকতে জোয়েল সকলের সঙ্গে আনন্দে মেলামেশা করতেন। তার প্রাক্তন ছাত্ররা তার বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে প্রশংসা করেন, যার মধ্যে লেকশাের ইউনিটারিয়ান চার্চও অন্যতম। ব্যক্তির বিশ্বাস করবার যে স্বাধীনতা, তার নীতি নির্ধারণী কাজের প্রতি হার্টস দম্পতির দায়বদ্ধতার প্রমাণ জোয়েলের নানা কাজের মধ্যেই প্রকাশিত । যারা জোয়েলকে চিনতেন, তারা জানেন।
মানুষের মঙ্গলের জন্য কী বিপুল দায়বদ্ধতা ছিল তার। তাকে একজন অসম সাহসী, স্থির প্রতিজ্ঞায় অটল মানুষ হিসাবে আখ্যায়িত করে অনেকে শান্ত, সৌম্য ভদ্রলােককে স্মরণ করেন । তিনি অনেকেরই অনুপ্রেরণাস্বরূপ ছিলেন যার স্ফুলিঙ্গ এখনও বেঁচে রয়েছে তার। চারধারের মানুষদের মধ্যে। ট্রডি তার শিক্ষকতার কাজ করে চলছেন। নয়টি সন্তান সফলভাবে বড় করে তােলার পর আজ তাদের এগারােটি নাতি-নাতনি । টুডি পরিবারের পূনর্মিলন হয় অন্তত বছরে একবার। সাধারণত সেটার ব্যবস্থাপনা তার ছেলেমেয়েদের সহায়তার টুডি সম্পন্ন করে থাকেন।
মলি
মেয়াদ শেষ হবার আগেই ৪ মে ১৯৭২ তারিখে মাদার তেরেসার ঢাকাস্থ শিশু ভবনে মলির জন্ম । ওর জন্মের সময় ওজন ছিল ১,২ কেজি। মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টাররা ওর নাম রেখেছিলেন মলি। যুদ্ধশিশুদের অন্যান্যদের বেলায় যেমন, তেমনি মলির মাও ওকে অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষের হাতে সঁপে দিয়ে আশ্রম ত্যাগ করেছিলেন গােপনে। কানাডাতে পৌছলে মেয়েটির অন্য যুদ্ধশিশুদের মতােই নাম বদল ঘটে। মজার ব্যাপার, যুদ্ধশিশুদের অন্যান্যদের মা-বাবা যেমন শিশুদের নামকে কানাডীয়করণ করেছিলেন, হার্টস দম্পতি ঠিক তার উল্টো কাজটি করেন। মন্ট্রিয়লে আনুষ্ঠানিক দত্তক নেবার সময় দম্পতি মলি নামটি, যেটি বাংলাদেশে রাখা। হয়েছিল, রেখে দেন, তবে বানান বদলে দেন । যেমন বাংলাদেশে ইংরেজিতে বানান ছিল Molly; সেটাকে হার্ট দম্পতি বদলে বানানটি রাখেন এভাবেঃ Mollie তারপর আরও দুটি নাম যােগ করেন – শ্যামা এবং জমিলা, কারণ তাদের পরিষ্কার অর্থ রয়েছে, শেষে পরিবারের নাম হার্ট তাে থাকলই । হার্ট দম্পতি যেমন বুঝেছিলেন, শ্যামা একটি হিন্দু নাম যা হিন্দি কবিতায় প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। তার অর্থ মােমের শিখা । আবার জমিলা একটি মুসলিম নাম, অর্থ সুন্দর । শেষ পর্যন্ত কানাডীয় দলিলপত্রে মেয়েটির নাম গিয়ে দাঁড়ায় শ্যামা জামিলা মলি হাট। দম্পতি বিশ্বাস করেন যে এভাবে মেয়েটির নাম রাখলে তারা যে প্রগতিশীল রীতির সমর্থক সেটাই ইঙ্গিত করবে। শুধু তাই নয়, তারা মনে করেন এর দ্বারা বাংলাদেশি বংশােদ্ভূত কানাডীয় হিসাবে শিশুটির একটি দ্বিমুখী পরিচিতি লাভ ঘটবে। বিকনসফিল্ড হাই স্কুল এবং CEGEP (College d’enseignerment general et professionnel) মন্ট্রিয়ল-এর জন অ্যাবট কলেজ শেষ করে শ্যামা টরন্টো ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সেখানে সে ইংরেজি সাহিত্যে বি এ ডিগ্রি লাভ করে; তারপর সে মন্ট্রিয়লের কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব এডুকেশন-এ ডিগ্রি নেয়। সে সঙ্গে ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে পড়ানাের লক্ষ্যে বিশেষ ডিগ্রির জন্য পড়াশােনা করে। সে মাস্টার্স করেছে কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৯০-এর শেষে শ্যামা প্রাপ্তবয়স্কদের। শিক্ষা সেক্টরে ইংরেজি পড়িয়েছে। শিক্ষা জীবনের আরম্ভ থেকে তার পেশাভিত্তিক কাজকর্মে তার মা ও বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করে শ্যামাও একজন শিক্ষক/প্রশিক্ষক হয়ে ওঠে। সে ছাত্রছাত্রীদের একটি বিকল্প সেন্টারে গ্রেইড-১০ এবং গ্রেইড-১১-এর ছেলেমেয়েদের ক্লাস।
নিয়েছে যারা অসুবিধাগ্রস্ত অথবা বিকলাঙ্গ যেমন নয়, আবার উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রাও নয়। কোনাে কারণে তারা হতাশাগ্রস্ত সিস্টেমের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় হয় শিক্ষাব্যবস্থা তাদের নিচ্ছে, অথবা নেতিবাচক লেবেল মেরে দিয়ে তাদেরকে এক বিশেষ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করেছে। শ্যামা বলে যে, সে তার অতীত নিয়ে সবর্দাই সহজ থেকেছে। সপ্তম অধ্যায়-এ আমরা দেখব, তাদের অতীত এবং জন্মদেশকে জানার ইচ্ছা শিরােনামের লেখায় “দত্তক” শব্দটা কেবল শ্যামার পরিবারের নয়, যুদ্ধশিশুদের সকলের পরিবারেই একটি নিত্য ব্যবহার্য শব্দ । অতএব এতে শ্যামা একটুও অবাক হয়নি, যখন বড় হবার সময় একদিন বা দুইদিনে সে কেমন করে যেন তার জন্মের যা রহস্য সেটা জেনে গিয়েছিল। সে সময়ের কথা মনে করে শ্যামা বলে, প্রকৃতপক্ষে ছােটবেলা থেকে তার আর বিশেষ কিছু জানার প্রয়ােজন ছিল না । তার মা-বাবা তাকে তার জন্মের ইতিহাস এবং দত্তক নেবার কাহিনী বলতে যেটুকু জানিয়েছিলেন, শ্যামা তার চেয়ে বেশি জানার ব্যাপারে কোনােদিন আগ্রহ দেখায়নি।
অনেক দত্তকায়িত ছেলেমেয়ে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে তেরাে-চৌদ্দ বছর বয়সে শারীরিক কিছু পরিবর্তনের কারণে মানসিকভাবেও চাপের উত্তেজনা এত বেশি থাকে যে তখন তারা তাদের উৎস অনুসন্ধান করে অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ঠান্ডা মাথার শ্যামার ওরকম কখনাে হয়নি। তার বয়স যখন কুড়ির ঘরে পড়েছে, সে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তখন সে তার পশ্চাৎপট নিয়ে কিছুটা ভেবেছিল । দত্তক নেয়া শিশুদের নিয়ে তৈরি একটি ছবি দেখে তার ওরকম অস্থির লেগেছিল যাতে শিশুদের জীবনবৃত্তান্তের উৎস খোঁজার একটি ব্যাপার উচ্চকিত করা হয়েছিল। তখন তার যথাযথ চিকিৎসা এবং সম্পর্কিত তথ্যের প্রয়ােজন ভেবে সে তার বংশলতা ও জীবনবৃত্তান্তের বিষয়ে জানতে আগ্রহী হয়েছিল ।
শ্যামা ওটাকে ঠিক জীবনবৃত্তান্তের ইতিহাসের তাগিদ হিসাবে তার অচেনা মা অথবা বাবাকে চেনা বা জানার যে প্রয়ােজন অনুভব করেছিল, ঠিক সে দৃষ্টিতে সে দেখেনি । শ্যামা বুঝেছিল তার তাকে ত্যাগ করা ভিন্ন তার মায়ের আর কোনাে উপায় ছিল না। তার ফাইলে যে জীবনবৃত্তান্তের শূন্যস্থান পড়েছিল, সে সেটুকুই পূরণ করতে চেয়েছিল কেবল । সে তাগিদে, শ্যামা ঢাকায় অনাথ আশ্রমে খোঁজ নিয়েছিল। কিন্তু তারা কেবল এটুকুই জানিয়েছেন যে তার জন্ম বিষয়ে আর কোনাে তথ্য তাদের কাছে নেই। তারপর থেকে শ্যামা তার পশ্চাদপট বিষয়ে যা জানে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখেছে। বিষয়টিকে আর খোঁচানাের প্রবৃত্তি তার হয়নি।
ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে যেহেতু শ্যামা এমন একটা বাড়িতে বড় হয়েছে যেখানে ন’টি ছেলেমেয়ে ছিল, সে কখনাে একাকিত্ববােধ করেনি। তার পরিবর্তে সে সর্বদাই উপলব্ধি করেছে যে, সে একটি বিশাল পরিবারের অংশ। আন্তবর্ণীয় এবং শ্বেতকায় ভাইবােন তাকে ঘিরে রেখেছে। জাতি ও জাতিগত সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার পর শ্যামা নিজেকে এবং তার পরিবারকে কানাডার মাটিতে স্বচ্ছন্দে আপন ভূমিকায় দেখতে পায়। যে সব অন্য পােষ্য শূন্যতার কথা বলে, অথবা একাকিত্ব বা নিরাসক্ত হয়ে তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি বৈরীভাব পােষণ করে সমস্যায় ভােগে, শ্যামা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। শ্যামা বলে, “আমার মনে পড়ে না কখনাে আমি পােষ্যক মা-বাবার কথা মনে করে অথবা আমার জন্মধাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবা নেই, সেসব কথা ভেবে কখনাে একাকিত্ব অনুভব করেছি এজন্য যে আমাকে দত্তকের মাধ্যমে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে,” শ্যামা স্থিরভাবে কথাটি বলে খুব আন্তরিকতার সাথে ।
বহুজাতিক পরিবারে বড় হওয়া শামার জন্য এত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে সে কখনাে বােঝেনি তার পরিবার “অনন্য” বা “বিশেষ” ছিল । যদিও শ্যামার মা-বাবা শ্বেতাঙ্গ ছিলেন, ছেলেমেয়েরা দাবি করে না যে, তারা শ্বেতাঙ্গ পরিবারে বড় হয়েছে। তারা সত্যিকারের বহুজাতি পরিবারের সন্তান, যে পরিবার কিউবেকের শ্বেতাঙ্গ প্রধান এলাকা বিকনসফিল্ডে বাস করে বছরের পর বছর । এটা ব্যাখ্যা করা শ্যামার জন্য কঠিন নয়, এজন্য যে, সে যে বয়সে। তার পােষ্যক মা-বাবার সঙ্গে বাস করতে এসেছিল, সে বয়সে তার আগের কোনাে স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়। বহুজাতিক এক পরিবারে বসবাস করায় আমি অভ্যস্ত।
সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের ওপর উচ্চশিক্ষা নেবার পর শ্যামা নৃতত্ত্ব, সংস্কৃতি ও জাতগােত্রের বিষয়ে আলাপে, প্রশ্নের উত্তর দিতে, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে আগ্রহবােধ করে, যদিও বিষয়বস্তুগুলি মাঝে মাঝে জট পাকিয়ে যায় । সুশিক্ষিত শ্যামা খুব ভালাে করে জানে সে কেমন দেখতে; তার চেহারা অথবা তৃকের রং বিবেচনায় অন্য মানুষ তাকে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু হিসাবে চিহ্নিত করবে। শ্যামা অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে বলতে পারে, কেমন করে অনেকেই তাকে কানাডীয় মনে করেন না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সে একজন বিদেশি। মজার ব্যাপার এতে শ্যামার কিছু যায় আসে না। আমরা সপ্তম অধ্যায়ে তার সবচেয়ে প্রিয় উদাহরণ জানব যেখানে ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক অধ্যাপক মনে করেছিলেন ইংরেজি তার মাতৃভাষা নয়। ঠান্ডা মাথার শ্যামা যেমন অবাক হয়নি, তেমনি আহতও হয়নি। শ্যামার বিগত বছরগুলিতে এমন অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে যে তার মনে হয়েছে অন্যেরা তাকে কানাডীয় মনে করে না, শুধু এ কারণে যে তার ত্বকের রং সাদা নয় । সমাজে বর্ণবাদের উদাহরণ অনেক এবং এ ধরনের প্রবণতা মানুষের স্বভাবে। নিহিত। “তাই মানুষকে শ্রেণিীবভক্ত করা এবং সাধারনী শ্রেণিভুক্ত করা অনেকের জন্যই সহজ ও আরামদায়ক কাজ” ।
শ্যামা অত্যন্ত খােলামনে বলে যে বাংলাদেশে যাবার সুযােগ পেলে সে একবার বেড়াতে যেতে অপছন্দ করবে না। সত্যি বলতে কি, আজ পর্যন্ত সে বাংলাদেশ ভ্রমণে যাবে বলেনির্দিষ্টভাবে না বললেও যেতে রাজি আছে। সে বলে, এখনও কোনাে সুযােগ এলে। বাংলাদেশে বেড়াতে যেতে পারে। হয়তাে তার ইচ্ছাটা বর্তমানে তেমন জাগরুক নয়। কে জানে, কবে কোনাে ঘটনায় ওটা বাস্তবতায় রূপ নেয়। এ মুহূর্তে শ্যামা অন্য যুদ্ধশিশুদের। মতােই প্রাধিকার বিচার করছে। সৎ ও খােলাখুলি মেয়ে শ্যামার জন্য তার জন্মভূমিতে ঘুরতে যাওয়া বােধহয় গুরুত্বপূর্ণ প্রাধিকারগুলির মধ্যে পড়ে না, যা নিরন্তর দিনরাত এখন ওলটাবে, পালটাবে, তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলি যেভাবে এগােবে ।
বিগত বছরগুলােতে, সে ছাত্রী থাকা অবস্থাতে যেমন, তেমনি কর্মজীবনেও ভালাে কাজের স্বীকৃতি পেয়েছে । হােমমেকার্স ম্যাগাজিনের ১৯৯৫-এর গ্রীষ্ম ইস্যুর এক রচনা প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণের জন্য শ্যামার নাম “অনারেবল” লিস্টে তালিকাভুক্ত হয়। আজ শ্যামা একজন সফল শিক্ষক, সে স্যার উইলফ্রিড লরিয়ের স্কুল বাের্ড-এর কর্মী । শ্যামা মাইক বনেলের সঙ্গে কমন ল সম্পর্কে বাঁধা পড়েছিল। ফরাসি কানাডীয় মাইকের সঙ্গে ওর পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে সেও একজন শিক্ষক। তাদের সুন্দর মেয়েটির নাম সাভানা বনেল। যা হােক, দম্পতিটি কয়েক বছর আগে আলাদা হয়ে যায়। শ্যামা ও সাভানা। কিউবেক-এর মন্ট্রিয়লের কছে জোলিয়েট-এ থাকে।
পিয়ের ও লিজ হােগ
পিয়ের ও লিজ ব্রাট্রান্ড মন্ট্রিয়য়েল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। সারা জীবন তারা কিউবেক-এ কাটিয়েছেন মাঝে ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ দুবছরের জন্য তারা লীনমাউথ, নিউ কাসল-এর উত্তরে, ইউনাইটেড কিংডম-এ অ্যালকার্ন ইউ-কে-এর ট্রেনিং ম্যানেজার হিসেবে, একটি এলুমিনিয়াম স্মেলটারে স্টার্ট-আপ-এ কাজ করতে যান। মন্ট্রিয়লস্থ অ্যালকান এলুমিনিয়ম লিমিটেড-এ চাকুরি শুরু করে পিয়ের পরবর্তী জীবনে মানব সম্পদে বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং কিউবেক-এ কয়েকটি সংস্থায় কাজ করে সুখ্যাতি অর্জন করে ২০০০ সালে বম্বার্ডিয়ার কোম্পানি থেকে অবসর গ্রহণ করেন অডিট পরামর্শদাতা হিসাবে। তার স্ত্রী লিজ ফেডারেল পাবলিক সার্ভিসে অধিকাংশ সময় কিউবেক অঞ্চলে কাজ করে ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন জাসটিস কানাডার ডিরেক্টর অব পলিসি এ্যন্ড প্রগ্রাম হিসেবে। বাংলাদেশে যুদ্ধ যখন চলছিল, দম্পতি খবরের কাগজে “অধিকৃত বাংলাদেশে বিশেষ করে সামরিক নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার বিবরণ পড়েন। গ্রেট ব্রিটেনের অনেক মানুয়ের মতাে তারাও আহত ও ক্ষুদ্ধ হন ধর্ষণ, জবরদস্তি গর্ভধারণ এবং যুদ্ধশিশুর জন্মগ্রহণে। এ সময়ে ঐ দম্পতি একটি সন্তান দত্তক নেবার কথাও ভাবছিলেন, তাদের ঔরসজাত সন্তান বেনওয়ার জন্য একটি ভাই অথবা বােন । ১৯৭২ সালে তারা বাড়ি ফিরে যখন খোজ খবর নিতে গেলেন, তখন তারা নিরাশ হলেন। তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, তারা যেহেতু সন্তান উৎপাদনক্ষম দম্পতি তারা যােগ্য দম্পতিদের তালিকায় তলার দিকে পড়ে থাকবেন,” বিশেষ করে যে মিউনিসিপ্যলিটির এলাকায় তারা তখন বাস করতেন। যখন তারা বাংলাদেশ থেকে একটি যুদ্ধশিশু পাবার সম্ভাবনা দেখলেন, ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি)-এর মাধ্যমে, তারা সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেড ও বনির সঙ্গে যােগাযােগ করেন । আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে তাদের পরিচিতি দেখেছি – তারা তখন এফ এফ সি’র সচিব এবং প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তারপর তারা তাদের বন্ধু ও বিভিন্ন পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে একটি বাংলাদেশি শিশু দত্তক নেবার সংবাদ সবাইকে জানালেন। বর্ধিত পরিবারের সবাই কথাটা জেনে সুখী হােন। তারা পিয়ের এবং লিজ-এর উৎসাহী কর্মকান্ডে সায় দিয়ে সকলেই সাহস, উৎসাহ ও সমর্থন যুগিয়েছিলেন। তারা বাংলাদেশ থেকে একটি যুদ্ধশিশু বাড়িতে নিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত হলেন ।
হােগ দম্পতির বেলায় প্রক্রিয়াটি আরও সুসার করা হয়েছিল এজন্য যে, শিশুর কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তারা খােলাখুলি তার লিঙ্গ, বয়স এবং স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে কোনাে ধরনের অগ্রাধিকার বা ব্যাক্তগত পছন্দের কথা বলেননি। এর অর্থ হলাে ক্যাপুচিনােরা যখন বাংলাদেশে যান তাদের হয়ে যুদ্ধশিশুদের বাছাই করে আনতে, তাদের নিজেদের বিচার বুদ্ধি প্রয়ােগ করে কিছু যােগবিয়ােগ করে শিশুদের নির্বাচন করেন। যখন হােগরা ক্যাপুচিনােদের কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম পেলেন যে, তারা তাদের জন্য একটি কন্যা সন্তান পছন্দ করেছেন এবং ডাক-এ তার একটি ছবি পাঠিয়েছেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে সেটা বিশ্বাস করেই মনে মনে আনন্দিত হন। হােগরা চার বছর বয়সী ছেলে বেনওয়া-এর সাথে তারা বেশ সময় কাটিয়েছিলেন তার বােনের সম্পর্কে কথা বলে যে, তার একটি বােন বাংলাদেশ থেকে যে কোনাে সময়ে আসার কথা। তারা যখন একসঙ্গে তাদের হবু মেয়ের শােবার ঘর সাজাচ্ছিলেন তাদের ছেলে বেনওয়া-ও তখন তাদের সাথে সাথে ছিল । তাদের মেয়ে আসার আগেই স্থানীয় চিকিৎসা সম্পদ ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তারা জানতে চেয়েছিলেন তার কী কী ওষুধপত্র লাগতে পারে। হােগরা থাকতেন সেন্ট ব্রুনােতে মন্ট্রিয়লের দক্ষিণ কলে। রাজিনা আসার এক মাস পরে আর্ভিড়াতে চলে যান। আর্ভিড়া হলাে সােগনেলেইক সেন্ট জা রিজিয়ন, সেখান তারা প্রায় তিন বছর বাস করেন। ফরাসি কানাডীয় ক্যাথলিক কমিউনিটি প্রধানত এখানে বাস করত, যেখানে সংখ্যালঘু পরিবার খুব কমই ছিল। প্রতিবেশিদের অনেকে ভাবত তাদের মেয়েটি হয়তােবা আফ্রিকা থেকে এসেছে যেহেতু তারা ভারতীয় উপমহাদেশের কাউকে কোনােদিন দেখেনি। “ঔৎসুক্য এমন ছিল যে ওদের অনেকে, বিশেষ করে ছােট ছেলেমেয়েরা ছােট গাঢ় রং-এর ত্বকের মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইত যে এত সুন্দর ।
পিয়ের বলেন এখনও তার মনে আছে সে দিনগুলাে। অমন অবস্থায় সর্বদাই তারা পাড়া-প্রতিবেশিদের কৌতূহল ও মন্তব্যগুলাে সহজভাবে নিতেন। হােগ দম্পতি বলেন সে সময়ে অনেকেই তাদের এ উদ্যোগের প্রসংশা করেছেন। অনেকে তাদেরকে আন্তবর্ণীয় দত্তগ্রহণের অগ্রদূত হিসাবে দেখেছেন । রাজিনার বয়স যখন সাড়ে চার বছর, হােগ পরিবার আবার মন্ট্রিয়লে ফেরত আসেন । স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দম্পতিরা বলেন তাদের পরিষ্কার মনে আছে, তাদের মেয়েটি বাংলাদেশ থেকে আসার পর তরল খাবার ছাড়া কোনাে শক্ত খাবার খেত না। যখন তারা রাজিনার খাবারের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন তখন খুব দ্রুত তার স্বাস্থ্য ভালাে হতে লাগে । শিশুর ওজন যখন বাড়তে লাগল এবং সার্বিক স্বাস্থ্য ভালাে হলাে, পিয়ের এবং লিজ দুজনেই খুব খুশি। সে সময় দম্পতি ফ্রেড ও বনির সঙ্গে তাদের আনন্দ ও সুখ ভাগ করেনিতে অস্থির হয়ে পড়েন। তারা চিঠি লিখে ক্যাপুচিনােদের জানিয়েছিলেন তাদের নতুন মেয়েটি খুব ভালাে আছে এবং তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে। যখন হােগ দম্পতি জানলেন বাংলাদেশে সিস্টার। মার্গারেট ম্যারি পােষ্যক বাবা-মায়েদের কাছ থেকে কোনাে চিঠি না পেয়ে খুব চিন্তিত হয়েছেন, এরাই প্রথম দম্পতি ছিল যারা তাকে চিঠি লেখেন। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে সেটা দেখেছি। অন্যান্য মা-বাবার মতাে তারাও তাদের পরিবারের নাম শিশুর নামের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। তারা এতিমখানা কর্তৃপক্ষের দেয়া রাজিনা নাম খুব পছন্দ করেছিলেন। তারা বলেনঃ “আমরা তার রাজিনা নাম রেখেছি কারণ এটা ওকে খুব মানায়। কিন্তু ওর নাম রেজিস্টার করা হয়েছিল রাজিনা হােজে। কয়েক বছর পর, রাজিনা নিজেই তার প্রথম নাম বদল করে ফেলে” । তার ব্যক্তিগত জীবনালেখ্য অংশে সেটা উল্লেখ করা হয়েছে ।
দম্পতির মনে নেই কবে তারা দত্তক শব্দটি প্রথম আলােচনা করেছিলেন। তারা মনে করেন বুদ্ধিমতী মেয়ে হােজে অল্প বয়স থেকেই বােধহয় ব্যাপারটা জানত । হােগ দম্পতি কোনাে রূপকথার গল্প তৈরি করে হােজেকে সে ধরনের কোনাে কল্প কাহিনী বলেননি। বর্তমান। গ্রুপের অনেক দম্পতিরা যেমনটি করেছেন, তারা যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবেই দত্তক নেয়ার কাহিনী তাদের মেয়েকে বলেছেন আস্তে আস্তে সহজাতভাবে। হােগ দম্পতি বলেন, তাদের মেয়েকে তাদের ছেলে বেনওয়ার মতােই মানুষ করেছেন। কোনাে বিশেষ আনুকূল্য দয়াধর্ম না দেখিয়ে, একদম নিঃশর্ত ভালােবাসা ও স্নেহ আদরে। তারা তৈরি থাকতেন যে কোনাে প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য যেটাই সে জিজ্ঞাসা করুক না কেন। কীভাবে এবং কেন ইত্যাদি সব অবশ্যই দত্তক বিষয়ে । পিয়ের বলেন, তারা সময়ে সময়ে বয়স উপযােগী বিষয়বস্তুর সহায়তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তবে হােগ দম্পতি। এমন পরিস্থিতি মনে করতে পারেননি যেখানে বিশেষ কোনাে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ হয়েছিলেন। যখন হােজে প্রথমবারের মতাে বুঝতে পারে যে তার ত্বকের রং তার মায়ের থেকে আলাদা, তখন সে খুবই ছােট। হােজের মার মনে নেই হােজের বয়স ঠিক তখন কত । তিনি অবশ্য ঘটনাটি পুরাে মনে রেখেছেন। লিজ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেনঃ “হােজে একথা বলল যখন আমি তার হাত মােজা পরাচ্ছিলাম; ওকে। বেবিসিটারের ওখানে পৌঁছে দেবাে বলে দেরি হয়ে গিয়েছিল, আমি তাড়াহুড়াে করছিলাম । সে নিজের হাত দেখিয়ে আমাকে বলেছিল: মম, দেখাে আমার হাতের রং তােমার মতাে। নয়।’ লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আমি সেটা ব্যাখ্যা করলাম বৈকি! তােমার ত্বক বাদামি, আমার ত্বক সাদা, যেহেতু তােমার জন্মদেশে সবার ত্বকের রং বাদামি, তােমার মতাে। ব্যস এ পর্যন্ত। ই। সে ঐ উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছিল”।
লিজ-এর আরও মনে আছে হােজে কখনাে আর ঐ। বিষয়ে আলাপ করেনি। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অধিকারী ওই দম্পতি খুশি ছিলেন দেখে যে হাসি খুশি হােজে তার আকর্ষণীয়। মুখচ্ছবি নিয়ে তার জন্মের ইতিহাস যেটুকু জানা ছিল তা নিয়েই খুশি। হােজে কখনাে অন্য পােষ্য ছেলেমেয়ের মতাে মায়েদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে দুঃখিত মনে বসে রয়নি। হােজে কখনাে তার অদেখা জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি কোনাে আকৃষ্টতা অনুভব করেনি। লিজ বলেন, তিনি হােজেকে তার জন্মদেশ ঘুরে আসতে উৎসাহিত করেছেন বহুবার। নিজেও সঙ্গে যেতে চেয়েছেন। দম্পতির কোনাে অধিসঞ্চারী ভীতি না থাকায় তারা তাদের ছেলে বেনওয়া এবং মেয়ে হােজেকে নিয়ে যে চারজনের সংসার, সেখানে কোনাে ভাঙনের ভয় দেখেনি, এমনকি হােজে তার জন্মের উৎস যদি অনুসন্ধান করেও | হােজের বাংলাদেশ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ তার জীবনালেখ্য দেয়া গেল। হােগ দম্পতির ভাষ্যমতে, হােজে তার পশ্চাদপট এবং তার জন্মকে ঘিরে যে ঘটনা যতটুকু জেনেছে, যদিও অত্যন্ত বিয়ােগান্তক, বর্তমানে সেটা একটি ফেলে আসা অধ্যায়। তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন, কীভাবে শক্তসমর্থ মেয়ে হােজে যুদ্ধের বিয়ােগান্তক গল্প, যৌন সহিংসতা, জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণ, জন্ম ও শিশুর পরিত্যাগ সংক্রান্ত যাবতীয় বৃত্তান্ত শুনেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি মােটেই। বাবা-মায়েরা বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছেন কী। সহজভাবেই বিরূপতা পরিহার করে হােজে সামনে এগিয়ে গিয়ে ছিল তার কানাডীয় বাড়ির চলমান জীবনস্রোতে । হােগ দম্পতি সবসময় বিশ্বাস করে আসছেন যে, তারা তাদের মেয়েকে একটি ইতিবাচক প্রেক্ষাপটের যােগান দিতে পেরেছিলেন, বিশেষ করে তার জন্মদাত্রী মায়ের নিরুপায়তা এবং তার শিশুকে পরিত্যাগের প্রেক্ষাপটে । হােগ পরিবারে এক নিরলস সক্রিয় মূলমন্ত্র যেটা কাজ করেছিল, বিশেষ করে ছেলেমেয়েরা যখন বড় হচ্ছিল, সেটা হলাে ‘তুমি যা পারাে, করাে’ । এ মনােভাবের আদর্শবাণী দ্বারাই প্রত্যেকে নিজেকে এবং একে অন্যকে সহায়তা যােগাতে সমর্থ হয়। বাড়িতে সবসময়ই হােগসূরা লালনকারী পরিবেশ বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন যাতে সবাই মনে করে। প্রত্যেককে সমানভাবে সমান চোখে দেখা হয়। সকলের সমান সুযােগ এবং ওটাই পরিবারের টিকে থাকবার মন্ত্র প্রমাণিত হয়েছে। তাদের দুসন্তানই আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মসীমা নির্ধারণে বিশ্বাসী।
তারা তাদের বাংলাদেশিয় কন্যাকে বিশেষ সন্তান” বা “রাণীর মতাে সবাইকে দেখিয়ে আদর করেননি। হােগরা ওটাও নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে তাদের বর্ধিত পরিবারে সকলেই যেন নিজ নিজ অবস্থান পরিবারের শিশুদের সঙ্গে বিবেচনা করে বুঝে নেন। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, বেনওয়া ও হােজে ভালােভাবেই মেলামেশা করেছে যখন তারা একসাথে বড় হয়ে উঠছিল। তাদের দুজনের সম্পর্ক ছিল যে কোনাে ভাই ও বােনের মতােই যা আজ পর্যন্ত তারা টিকিয়ে রেখেছে। সেদিনের কথা স্মরণ করে হােগসূরা বলেন; বেনওয়া একটু উত্তেজিত হয়ে সবসময় সবাইকে গর্বভরে বলতে চাইত যে সেও হােজেকে দত্তক নিয়েছে, একটি বােন বাংলাদেশ থেকে সারাটা পথ এসেছে। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য হােগ। দম্পতির ভালােবাসা ছিল সবকিছুর উর্ধ্বে, এমনকি দম্পতি যখন ১৯৮২ সাল বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হন। অন্যান্য সব কিছুর মধ্যে তারা দুজনেই ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব পালনে দায়বদ্ধ হন। পিয়ের এবং লিজ, বেনওয়া ও হােজের সবচেয়ে সেরা উপকার” যাতে হয়, সেজন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। দুজনেই এবিষয়ে একমত ছিলেন যে ছেলেমেয়েদের যেন কোনাে অসুবিধে না হয়। আমার বিবাহবিচ্ছেদ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে হয়েছিল। আমার সন্তানদের বাবা এবং আমি একই পাড়ায় বাস করছি যাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা এক জায়গা। থেকে অন্যত্র ইচ্ছামতাে যাওয়া আসা করতে পারে। আমরা আমাদের শিশুদের বিষয়ে আলাপ করেছি এবং তারা জানত তাদের মা-বাবা (দুজনই) তাদের ভালােবাসেন। একজন অন্যদের সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক বজায় রাখেন,” বলেন লিজ । বিবাহবিচ্ছেদের পর তারা যে বন্দোবস্ত করেন সে অনুযায়ি পিয়ের বেনওয়ার সঙ্গে এবং হােজে লিজের সঙ্গে থেকেছেন সে সময় থেকে। দুজনেই ব্যবস্থাটা পছন্দ করতেন। পরিবারের অন্যান্যদের জন্যও সেটা ছিল একটা উত্তম ব্যবস্থা যদিও দম্পতি আলাদা বাস করতেন। হােজের বয়স তখন মাত্র ১১ বছর ।
তার কিছু সময় লেগেছিল ব্যবস্থাটার সঙ্গে সমন্বয় করতে । যখন বড় এবং পরিপক্ক হলাে, সে ব্যাপারটার বাস্তবতা বুঝতে পারে এবং নতুন ঘটনার সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করে। বিবাহবিচ্ছেদ অত্যন্ত জটিল ব্যাপার এবং যখন এটা ঘটে তখন এর দ্বারা শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বলেন পিয়ের । দুজনেই প্রমাণ করেন। | যে তাদের সন্তান ব্যবস্থাপনার দক্ষতার কোনাে তুলনা নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দম্পতির ভালােবাসা যেমন সন্তানদের জন্য বেড়েছিল, তেমনি মা-বাবা | খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন স্বচক্ষে দেখে যে তাদের আদরের কন্যা হােজে সফলভাবে কানাডীয় নাগরিক হয়ে উঠেছে। আজ তারা নিজেদের সুবিধেভােগী মনে করেন কারণ তাদের সন্তানরা বড় হয়ে সম্মানজনকভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । লিজ ও পিয়ের তাদের একমাত্র নাতিকে নিয়ে (ছেলে বেনওয়ার সন্তান) আনন্দে ও ব্যস্ততায় সময় কাটান, নিজের ও অন্যের সুবিধামতাে। কাজের নানা ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও কোনাে না কোনােভাবে হােজে সময় বের করে মা-বাবা ও ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে কিছু উৎকৃষ্ট সময় কাটায়। কাজের ফাকে তাদের সঙ্গে সে দেখা করে। পারিবারিক বাঁধন তাদের চারজনকেই ভালােবাসার টানে বেঁধে রেখেছে। ওটাই তাদের দেখা করার শক্তি জোগায়, সময় জোগায় | এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে জীবনে চড়াই-উতরাই পার হতে সামথ্য জোগায়।
রাজিনা
রাজিনার জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে। কানাডাতে আসা বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের মধ্যে রাজিনা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বয়স্ক শিশু। তাকে চুপিচুপি শিশু ভবনে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং তখনকার সুপিরিয়র সিস্টার মার্গারেট ম্যারির প্রযত্নে দত্তক নেবার জন্য রেখে যাওয়া হয় । সিস্টার ম্যারি শিশুটির নাম রাখেন রাজিনা । যখন তাকে রেখে যাওয়া হয় তার ওজন তখন ছিল ৪ কেজি । ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাে, যারা শিশুদের তাদের কানাডীয় পােষ্যক মা বাবার সঙ্গে মেলানাের দায়িত্বে ছিলেন, রাজিনাকে হােগ দম্পতির জন্য নির্বাচন করেন । এতিমখানা কর্তপক্ষে যে নাম দিয়েছিলেন সেটি হােগ দম্পতি পছন্দ করেছিলেন। তারপরও তারা ভাবেন, যখন তাদের মেয়ে বড় হবে, সে হয়তাে অন্য একটা নাম চাবেই । তাই তার আনুষ্ঠানিক নাম রেজিস্টার করা হলাে রাজিনা হােজে হােগ হিসাবে কিউবেক-এর রেজিস্টার।
অফিসে । কিউবেক-এর ছােট্ট একটি শহরে বড় হবার কালে মেয়েটি হৃদয়ঙ্গম করে যে, তার। এ নামটি (রাজিনা) একটা পরিচিত নাম নয়। এ ধরনের নাম কোনাে ইঙ্গিত দেয় না যে, সে কে । তার মনে পড়ে, স্কুলে কোচ সে ফুটবলের হােক, বেইস বলের হােক, বা মেঠো হকির। হােক, প্রায়ই তার নাম জিজ্ঞাসা করতেন না; পরিবর্তে একবার ওর মুখের পানে তাকিয়ে কোচ বলে উঠতেন; “তুমি নিশ্চয়ই রাজিনা।” স্পষ্টত রাজিনার কোচ তার ত্বকের রং এবং “অচেনা” নামের সঙ্গে মেলাতেন। এটা এমন ব্যাপার ছিল যে, তাকে বিচলিত করত যেন তার স্নায়ুর উপর পীড়ন করত। ক্রমে সে নিজে থেকেই তার মধ্য নাম (হােজে) ব্যবহার করতে শুরু করে প্রথম নাম হিসেবে । ওর বয়স চৌদ্দ হতে না হতেই ওর প্রথম নাম হােজে হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ ধীরে ধীরে সে হােজে হিসাবে সবার কাছে পরিচিত হতে শুরু করে এবং একসময় দেখা গেল সবাই তাকে হােজে নামে চেনে। কিন্তু পিয়ের এবং হােজের ভাই ওর প্রথম নাম বদলানাের পক্ষে ছিলেন না। পিয়ের তাকে রাজিনা বলে ডাকতে পছন্দ। করতেন। হােভে বলে, চৌদ্দ বা পনেরাে বছর বয়সের সময়ে সে বাস্তবিক পক্ষে খুব অসন্তুষ্ট হতাে। এবং তার খুব রাগ হতাে। মাঝে মাঝে সে তার বাবাকে বলত, রাজিনা বলে ডাকলে সে সাড়া দেবে না; কিন্তু তাতে খুব কাজ দিত না। আরও কয়েক বছর অতিবাহিত হলে পিয়ের তার নামে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং তাকে হােজে নামে ডাকতে শুরু করেন। কিউবেক -এর এক ছােট্ট শহরে ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশক কাটিয়ে হােজে সেন্ট ক্লেয়ার এবং রাপাে এলিমেন্টারি স্কুল, লংগুই ও সেন্ট ল্যাম্বার্ট- এ, তারপর কলেজ এবং দুরােশের প্রাইভেট হাই স্কুল । হােজে সফলভাবে CEGEP (College d’enseignement général et professionnel) ইন হিউম্যান সায়েন্সেস উইথ ম্যাথম্যাটিক্স শেষ করে ১৯৯২ সালে । প্রথম কাজ নেয় ১৬ বছর বয়সে। তারপর থেকে কাজ করে যাচ্ছে এবং পড়াশােনা চালিয়েও কাজ করেছে। গ্র্যাজুয়েশনের পর সে পেশাদারি কাজ নেয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে আজ পর্যন্ত। বর্তমানে সে ফেডারেল পাবলিক সার্ভিসে কাজ করছে পাবলিক সেইফটি মন্ত্রণালয়ে। দেশে-বিদেশে তাকে কাজের জন্য ভ্রমণ করতে হয় । হােজে তার কাজ সম্পর্কে আবেগী ।
হােজের মনে আছে যখনি কেউ কখনাে তার উৎস বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন, সে বলেছে যে, সে বাংলাদেশ থেকে এসেছে এবং তাকে দত্তক নেয়া হয়েছে। সে যখন ছােট ছিল, তার উৎস। বিষয়ে, ত্বকের রং নিয়ে প্রশ্ন ছিল এবং সে ভাবত কেন সে পরিবারের অন্যদের মতাে নয়। হােজের পরিষ্কারভাবে মনে আছে সে তার বাবা-মাকে যখনই কোনাে প্রশ্ন করত, তার সব প্রশ্নের উত্তর তারা দিতেন। এ কথা বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, হেজে মনে করে তার মা-বাবা “অসাধারণ গুণের মানুষ” । সে বড় হয়ে এটা জেনেছে যে, কানাডা এসে পৌছবার আগে থেকেই তাকে তার বাবা-মা ভালােবাসতে শুরু করেছেন । হােজের ভাষ্যমতে, তার সঙ্গে তার (দত্তক গ্রহণকারী) মা-বাবার চেহারার এত সাদৃশ্য বর্তমান যে, সে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেত । বাবার মতাে আমার মাথায় কালাে চুল । দেখুন, মায়ের মতাে আমার মাথার চুল কোঁকড়ানাে; বাবার মতাে আমিও একগুঁয়ে। মায়ের মতাে আমি খুব সংবেদনশীল এবং আমি তার মতােই ধৈর্যশীল শ্রোতা। মা-বাবা আর আমার মধ্যে যে কত রকমের মিল! সবচেয়ে বড় কথা, আমি ওদের এক অংশ আর ওদের মেয়ে হওয়ায় ওরাও আমার অংশ হয়ে গিয়েছে।
প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর হােজে বাংলাদেশ সফরের জন্য হােজে কখনাে অস্থির হয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে সে তার কোনাে ধরনের বন্ধনও টের পায়নি, কেবল স্বীকৃতি দেয়া ভিন্ন যে। সে বাংলাদেশে জন্মেছিল। বড় হওয়ার সময় বুঝতে পেরেছিল, তার জন্মদাত্রী অসহায় মার। তাে অন্য কোনাে উপায় ছিল না। ধর্ষণের কলঙ্ক সঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়ালে সেটা যেকোন নারীর পক্ষে অসহনীয় হতো, এ বিষয়টি হােজে খুব ভালােভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল । এক অর্থে হােজে ভেবেছিল, ওর মায়ের পক্ষে যা করা সবচেয়ে সম্মানের তিনি সেটাই করেছিলেন – অর্থাৎ নবজাত শিশুকে মা মাতৃসদনে ছেড়ে গিয়েছিলেন যদি কেউ শিশুটিকে দত্তক নেয় এ আশায়। আত্মপরিচয়ের বিষয়ে হােজের মতে যারা তাকে চেনে না তারাই তাকে মনে করে যে সে কানাডার বাইরে থেকে এসেছে। তারা বলে, যেভাবে আমি কথা বলি এবং যেভাবে তাকাই, যেভাবে আমি চলাফেরা করে থাকি এসব কিছুই ঠিক মেলে না। যখন আমি বলি আমি আমার দত্তকগ্রাহী মা-বাবার সঙ্গে থাকি, তারা বুঝতে পারে আমি তাদের মতােই । তারা ভুলে যায় যে সে দৃশ্যত সংখ্যালঘু। তার নিকট এটাই আসল প্রমাণ যে সে কানাডীয় পরিচয় আর প্রমাণসাপেক্ষ নয়।”
হােজে নিজেকে দেখে একজন কানাডীয়রূপে, যে বাংলাদেশে জন্মেছে । অবাক হবার কিছু নেই যে অন্যান্য যুদ্ধশিশুরাও ঠিক তাই বলেছে এ প্রশ্নের উত্তরে । হােজে বলে সে কানাডীয় । সে ফরাসিভাষী মা-বাবার সন্তান অথবা একজন কুবেকোয়া (অর্থাৎ কিউবেকে প্রদেশের বাসিন্দা)। তার মা-বাবার ফরাসি পশ্চাদপটের কারণে সে সেটা তার পরিবারের কাছ থেকে সে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। আবার সে সাথে সে এটাও গর্ব করে বলে যে সে বাংলাদেশে জন্মেছে। অল্প বয়সে আমি জানতাম আমি অন্যদের থেকে আলাদা কারণ আমি পােষ্যক সন্তান এবং আমার ত্বকের রংও অন্যরকম সেজন্য”। তার যে বাংলাদেশে জন্ম, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। হােজে বলে, অতীত ঘাটতে তার মনে তেমন কোনাে কৌতূহল জাগেনি। হােজের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলাে কোথায় সে বড় হয়েছে, কে তাকে বড় করেছে এবং সে কে? মেয়েবেলা থেকেই সে লােককে বলত কোথায় এবং কীভাবে তার জন্ম হয়েছিল “অধিকৃত বাংলাদেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালে । “কিন্ডার গার্টেনের দিনগুলিতে, ওর হাতে গ্লোব থাকত, সে দেখাতে পারত কোথায় তার জন্ম এবং সে দেশের মানুষ কেমন, তার মা বলেন। বাবা-মায়েরা বাংলদেশ সম্পর্কে সাধারণ তথ্য যােগাড় করেছিলেন অটোয়ার বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে ১৯৭৭ সালে অথবা তার আশেপাশে কোনাে সময়ে । যদিও অতীত ঘাঁটাঘাটিতে, পশ্চাদপট বিশদভাবে অনুসন্ধানে হােজের আগ্রহ সেরকম ছিল। 
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে সে সচেতন ছিল। সাধারণ মানুষ যখন পাকিস্ত। নি ভারত ও বাংলাদেশ বলতে কখনাে বা একই দেশ ও জনসমষ্টি বােঝাতে চায়, হােজে তখন তাদেরকে জানিয়ে দিতে দ্বিধাবােধ করে না যে, নয় মাস রক্তে স্নান করে বাংলাদেশ কীভাবে স্বাধীনতা লাভ করেছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীনদেশ, সে দেশের মানুষ কষ্ট করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে,” এটাই ছিল হােজের সােজাসুজি উত্তর। এ ধরনের পরিস্থিতে হােজে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ এবং তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের কাহিনী বেশ বিশদভাবে বলত । তবে এটাও সত্য যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বেশি জানার কোনাে আগ্রহ তার মনে কখনাে জন্মায়নি। হােজের নিজস্ব ভাষ্যমতে, তার মনে এটা কখনাে উদ্রেক হয়নি যে, তার মা অথবা বাবা তাকে ভালােবাসেননি অথবা তার প্রতি মনােযােগ দেননি, যদিও তারা আলাদা থাকতেন ওর ১১ বছর বয়স যখন তখন থেকেই। সত্যিকারের পারিবারিক বাঁধন থাকায় হােজে পরিবারের সঙ্গে শক্ত বাঁধনে সম্পর্কিত সবসময়ই । তার ভাই বেনওয়া তাকে তার মেয়ের ধমর্মাতা (God Mother) হতে অনুরােধ করায় সে আনন্দে রাজি হয়েছিল দ্বিধাহীনভাবে। তাদের দুজনের সম্পর্ক আর দশজন ধর্মমতা ও ধর্মসন্তানের মতােই। “আমি নিশ্চিত যে সে (ভাইঝি) বুঝতে পারে, যদিও তার বয়স এখনও খুব অল্প। সে আমাদের দুজনের ত্বকের রঙ আলাদা, কিন্তু তবুও আমি তার ফুপি এবং সে আমাকে ভালােবাসে, যেমন আমি তাকে ভালােবাসি”। হােজে স্মৃতিচারণে বলে যে, একটা সময় ছিল যখন পুরাে পরিবার বাংলাদেশ সফরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু হােজে নিজেই বলে যে, যত বছর গড়াতে লাগে এবং পারিবারিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে, ততই এসব ব্যাপারে তার আগ্রহ কমতে লাগে । শেষ পর্যন্ত যেটা হলাে, হােজে এ যাবত বছরে দুবার বাংলাদেশ এসেছিল। সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালে সে মাত্র ৪৮ ঘন্টার জন্য অফিসের কাজে বাংলাদেশে এসেছিল। বাংলাদেশে পৌঁছেই সে জানতে পারে যে, তাদের ওখানে পৌছবার আগে থেকেই ঢাকার রাস্তায় জন অসন্তোষ ও মিছিল চলছিল। হােজে দুদিন যে জায়গায় ছিল, সেখান থেকে বেরােয় নি, হােজের বর্ণনায় তার সফর এরকম ছিলঃ “হােটেলের বাইরে হাঁটতে যাওয়াটা ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতাে। একটা ব্লক পুরাে হাঁটিনি তখনও। একদল মানুষ যারা আমার মনােযােগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছিল, কিছু একটা পণ্য বা সার্ভিস বিক্রির জন্য, আমাকে ওরা অপমান করে। আমার পরনে প্যান্ট, লম্বা হাতা। শার্টে গলা, কবজি পর্যন্ত ঢাকা, ওদের কাছে আমি আজব দেশের আজব পােশাক পরা মানুষ।
আমি সেখানে ৪৮ ঘন্টারও কম সময় ছিলাম । আমি ফিরে এসেছি, কিন্তু ভেবেছি। শীঘ্রই আবার যাব।” খুব সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, ওটা তার জন্য খুব উপভােগ্য সফর হয়নি, এটুকু বলা যায় । সে যা হােক, হােজে সম্পূর্ণ নিরুৎসহিত হয়নি যদিও ওর প্রথমদিকে ওরকম অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তারপরও বাংলাদেশে ফেরার ইচ্ছা ওর ছিল । জানুয়ারি ২০০৫-এ হােজে আবার বাংলাদেশে তার মাকে নিয়ে এক সপ্তাহের জন্য গিয়েছিল। তাকে আরও বলা হয়েছিল অনেকেই তার জীবনবৃত্তান্তের গল্পে বা বিষয়টিতে আগ্রহী ছিলেন। মা ও মেয়ে। দুজনেই ওই ব্যাপারে কী হয়, কী হয় উৎকণ্ঠায় ছিলেন ।
অনেক দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকায়, “সশস্ত্র প্রহরী অথবা সেনা বাহিনী দেখা অসাধারণ। কোনাে অভিজ্ঞতা নয়,” হােজে মন্তব্য করে । কিন্তু যেহেতু তার মার, যার জন্ম এবং বসবাস কানাডার মন্ট্রিয়লে, তিনি রাস্তায় নেমেই চারদিকে সশস্ত্র প্রহরী দেখে, এমনকি দূতাবাস ও ডিপ্লোম্যাটিক এলাকাতে থাকার নজ্য মনে মনে বেশ অপ্রস্তুত ছিলেন। “আমাদের বলা হয়েছিল, এমনকি ঐ বিশেষ এলাকায়ও আমরা যেন হেঁটে না বেড়াই, সর্বদা যেন গাড়িতে থাকি, নিরাপত্তার কারণে,” হােজে বলে।
ওদের ইচ্ছা ছিল, আরও লােকজনের সঙ্গে দেখা করবে, আরও কিছু জায়গা ও দ্রষ্টব্য বস্তু দেখে মজা করে বেশ সময় কাটাবে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তারা তেমন কিছুই দেখতে পারেনি। যা করেছেন বা দেখেছেন তা সবই সংক্ষিপ্ত সংস্করণে সেরেছিলেন। শেষের তিনদিন হরতালের কারণে একেবারে গৃহে বন্দির মতাে ছিলেন তারা যখন ঢাকা শহর পুরােপুরি অসাড় হয়ে গিয়েছিল। তার দুদিনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে হােজে বলেন, “দুঃখের কথা হলাে, ঐ সময়ে যে অনাথ আশ্রমে আমাকে শৈশবে রাখা হয়েছিল, সেখানে যেতে পারিনি, কারণ যাওয়ার ব্যাপারটা নিরাপদ ছিল না। লিজ এবং হােজে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন অনাথ আশ্রমটিতে যেতে না পেরে । তারা খুব চেয়েছিলেন সেখানে কিছুটা সময় কাটানাের জন্য। আক্ষেপের সাথে হােজে আবার বলে, “আমি তাদের সঙ্গে তাদের কাজের জায়গাতেই দেখা করতে চেয়েছিলাম, তাদের বলতে চেয়েছিলাম, তারা যে কাজ করেন, তার ভালাে ফলাফল দেখা যায়, এবং আমি তার জীবিত প্রমাণ। আমি তাদের বলতে চেয়েছিলাম, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে তাদের সেবাপরায়নতার কারণে আমি বেঁচে গিয়েছি এবং কানাডাতে আমি একটি স্নেহমাখা পরিবার এবং নিরাপদ বাড়ি পেয়েছি। প্রথম চারদিনে তারা উচ্চতর শ্রেণির কিছু বাঙালির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বস্তু, কিন্তু তাদের ঔৎসুক্য মেটানাের জন্য তাকে সামনে বসানাে হয়েছিল, বাংলাদেশে জন্ম অথচ বড় হয়েছে কানাডাতে। তাদের সংক্ষিপ্ত সফরে ড্রাইভার-কাম গাইড-এর বয়স ১৯৭১ সালে ছিল। মাত্র পাঁচ বছর, কিন্তু সে হােজেকে বলেছিল, তার মনে আছে কেমন করে সৈন্যরা রাস্তায় দৌড়াচ্ছিল, আগুনে বােমা নিক্ষেপ করছিল আর জনসাধারণ পালাচ্ছিল সবসময়, সে তখন জানত না তার বাবা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন, এমনকি সে জীবিত ছিলেন কিনা। তখন হােজে গাইডকে বলেছিল যে, বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জন যুদ্ধের সময়ে বাঙালি নারীর উপরে সৈনিকদের যৌন নির্যাতনের ফলশ্রুতিতেই তার জন্ম হয়েছিল; এবং সে কারণেই।
তাকে পােষ্যক গ্রহণ করে কানাডাতে নিয়ে গিয়েছিলেন এক কানাডীয় যুগল। হােজে এবং তার মা বেশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন ড্রাইভার যখন বলে যে সে জানে অনেক নারী ১৯৭১ সালে ধর্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু ধর্ষণ ও যৌন পীড়ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করার পরও সে সময় এবং ঘটনাচক্রের সঙ্গে হােজে আর তার মাকে বিষয়টির সাথে যথাযথভাবে সংযুক্ত করতে পারেনি। তার কাছে এটা অবাস্তব মনে হচ্ছিল যে আমি কানাডাতে বড় হয়েছি কোনাে এক শ্বেতাঙ্গ পরিবারে, আমার সঙ্গে যেমন মা ছিলেন, এটা তার কিছুতেই বিশ্বাস হবার উপায় ছিল না যে, তিনি হােজের মা,” বলে হােজে ।
সত্যি বলতে কি, হােজে এবং তার মার কাছে এটা একটা অবাক ঘটনা ছিল যাতে তারা বাস্তবিকপক্ষে বিস্মিত হয়েছিলেন। এটা অত্যন্ত উপহাসের ব্যাপার মনে হয়েছে যে, বহু মানুষ যাদের সঙ্গে ওরা দেখা করেছেন ও কথা বলেছেন, ঐ যুদ্ধের সম্পর্কে শুনেছেন তাদের থেকে; “অধিকৃত বাংলাদেশ”-এ যৌন সহিংসতার কাহিনী এবং তার ফলাফল সম্পর্কেও জেনেছেন। কিন্তু এক মিনিটের জন্যও তাদের চোখমুখ, হাবভাব দেখে মনে হয়নি যে তারা যাদের সঙ্গে কথা বলছেন, সে (অর্থাৎ হােজে) ঐ সময়ের সৃষ্টি, সরাসরি ঐ যুদ্ধাবস্থার। ফলাফল । সে জন্য তার পােষ্যক পিতামাতার সুদূর কানাডার বাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল। ১৯৭২ সালে যেসব লােকের সঙ্গে মা ও মেয়ের দেখা ও কথা হয়েছে সেসব লােকদের একটুতেই মনে হয়েছে কৌতূহলী । তাদেরকে বেশ উত্তেজিতও মনে হয়েছে এটুকু জেনেই যে, হােজের জন্ম বাংলাদেশে এবং লালিত পালিত হয়েছে এক শ্বেতাঙ্গ পরিবারে সুদূর কানাডেতে। এর গভীরে তারা কেউ যেতে পারেননি। যার ফলে হােজে ‘৭১ এর যৌন সহিংসতার প্রতক্ষ্য জ্বলন্ত প্রমাণ সামনে দেখেও সে ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির সাথে হােজেকে। সম্পৃক্ত করতে পারেনি। মা ও মেয়ে দুজনেরই বিস্ময়ের শেষ ছিল না। ঢাকাতে অনেকে হােজেকে দেখে কী রকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। তারা কোনােভাবেই হােজেকে সে সময়ের যৌন সহিংসতা, জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণ ও তার ফলাফলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে মনের মধ্যে কোনাে চিত্রই তুলে ধরতে পারেননি।
আরও মজার কথা হলাে, মানুষের ঔৎসুক্য হােজের সম্পর্কে বৃদ্ধি পেতে লাগে, যখন তারা। জানতে পারে তার জন্ম বাংলাদেশে যুদ্ধকালে। অবাক হলেও সত্য তারা ঘূণাক্ষরেও ‘৭১-এর সাথে কোনাে সংযােগ না করে অনেকটা অর্বাচীনতা ও অপরিপক্কতার দরুণ সম্পূর্ণভাবে অন্য আঙ্গিকে তাদেরকে কৌতূহলজনকভাবে জিজ্ঞাসা করে তাদের কি বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কোনাে ধারণা আছে? “তারা আমাকে বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে চেয়েছিল । আমি জানি না আমাকে কতবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, আমি ১৯১৩ সালের নােবেল পুরষ্কারে ভূষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কিছু পড়েছি কিনা, অনেকটা রাগতস্বরে বলে হােজে। হােজে বলে তার মনে আছে, তার কিছুই করার ছিল না। কেবল মাথা ঠান্ডা রাখা, চুপ করে থাকা, স্মিত হাসি হাসা এবং কথা কম বলা, ভেতরটা যতই তপ্ত ও তিক্ত বা বিরক্ত হােক না কেন। “এক অর্থে, আমার চেঁচাতে ইচ্ছা করেছিল! তােমরা কি অসম্ভব একদল ভন্ড! তােমাদের কী। সাহস! তােমরা সংস্কৃতিতে আমাকে ডােবাতে চাইছ যে সংস্কৃতি আমাকে, সব যুদ্ধশিশুকে ও তাদের মাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল? আমাদের বাঁচার অধিকার রক্ষার্থে আমাদের দূর দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন তুমি, তােমরা চাইছ আমি তােমাদের অংশ হব? আমার মতাে। আরও যারা ছিল তারা বাঁচেনি। তাদের কি হলাে? ওদের কথা কেউ ভেবেছে? আমার মনে হয় না কেউ ভেবেছে”। হােজে যখন বাড়ি (কানাডা) ফিরে, ওর মনে কোনাে সন্দেহ ছিল না যে, সে কানাডীয় । সে বলে, কানাডা তার বাড়ি, যেখানে সে বড় হয়েছে। বাংলাদেশে যাবার আগে সে কখনাে
বাংলদেশের প্রতি কোনাে টান অনুভব করেনি; যদিও ওটা তার জন্মদেশ। ফিরে আসার পরও সে বাংলাদেশের প্রতি কোনাে টান অনুভব করেনি। বরং বাংলাদেশে যে কদিন ছিল। তখন সে কানাডার কথা ভেবেছে। বাংলাদেশের দুচারজন মানুষের সঙ্গে আলাপ হওয়ায় এটা। আরও নিশ্চিত হয়েছে যে সে সত্যিকারের কানাডীয়। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তার কোনাে কিছুরই মিল নেই, শুধু এ সত্য ছাড়া যে, তার জন্ম হয়েছিল সেখানে। হােজের বাবা হােজের থেকে শুনলেন যে তার সফরটি তেমন সুখকর ছিল না এবং বাংলাদেশকে সে অপরিচিত ও ভিন্ন দেশ হিসাবে দেখেছে। তিনি এও শুনলেন যে বাংলাদেশিরাও তাকে তাদের চেয়ে ভিন্ন হিসাবে দেখেছে। হােজের মুখে এসব শুনে তিনি ।
একদমই আশ্বর্যান্বিত হননি। বিষয়টি যেমন আগ্রহ উদ্দীপক তেমনি চিন্তার উদ্রেককারী । অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে পিয়ের বলেন, “হােজের আশ্চর্য অভিজ্ঞতাগুলাে এবং অসহ্যভাবে সামনাসামনি হওয়া, বিশেষ করে প্রায় আপত্তিকর ঔৎসুক্য নিয়ে যারা তাকে নানা ধরনের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেছেন, এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে হােজের নেতিবাচক ধারণাগুলি এক অর্থে ওর কানাডীয় জীবনে শিকড় গজানাের সুফল বলা যায়” । বাংলাদেশে হােজে যতই নিজেকে সে দেশের একজন হিসাবে ভাবার চেষ্টা করেছে সে ততই উপলব্ধি করেছে যে সে । তাদের থেকে বিযুক্ত এবং বিচ্ছিন্ন। হােগ পরিবারের খুব ব্যস্ত দিনপঞ্জি, কিন্তু সবাই একসঙ্গে হবার জন্য সময় বের করে নেন। হােগ দম্পতির বর্ধিত পরিবারের সদস্যরাও কেউ না কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। যদিও হােজে কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যাস্ত থাকে তবুও সে পরিবারকে দেখার জন্য সময় বের কর ডেল এবং ডনা উলসি
প্রশিক্ষক ডেল ও ডনা উলসি দুজনেই ১৯৬০ দশকের শেষ থেকে অন্টেরিওর লন্ডনের নিকটস্থ ছােট্ট গ্রামীন শহর কোমােকায় বাস করে আসছেন। লন্ডন বাের্ড অব এডুকেশনে পড়াতে পড়াতে তারা ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টেরিও-তে পড়াশােনা করেন।
১৯৬৯ সালে স্নাতকের পরে তারা জার্মানিতে কানাডার জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে দু’বছরের শিক্ষকতা করেন। ফলে তারা পশ্চিমে ও পূর্ব ইউরােপ (লৌহ-যবনিকার আড়ালে), আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভ্রমণ করেন। উলসিদের বেলায় দত্তক নিয়ে পরিবার গড়ার স্বপ্ন নানা দেশ ভ্রমণ করে আরও দৃঢ় হয়েছিল, যা এতকাল গল্পের বইয়েই পড়েছেন। অবশেষে কানাডা ফিরে আমলাতান্ত্রিক, রাজনৈতিক আদর্শগত লড়াই শুরু হয় কানাডীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে। নগর সম্বন্ধীয়, প্রাদেশিক ও ফেডারেল এবং বিদেশি স্বাগতিক দেশগুলােতে (হােস্ট দেশ) তারা একই জটিলতা লক্ষ্য। করেন। “আমরা যে কখনাে আলাদা কিছু করব, সেটাই চেয়ছিলাম, মহৎ কিছু নয়। তাহলে সেটা আশ্চর্য প্রেষণা হতাে বটে।” উলসিদের ভাষ্যমতে, কানাডাতে তথন দত্তক ব্যাপারটাই এত সাধারণ ছিল না আজকের মতাে। আন্তর্জাতিক, আন্তর্দেশিক এবং অন্তবর্ণীয় তাে নয়ই।
ভ্রমণ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার ফলে তাদের এখন নিশ্চিত প্রমাণ হাতের কাছেই রয়েছে। সব শিশুরই রয়েছে কমপক্ষে পরিবারে বাস করার অধিকার এবং নিরাপদ বাড়ি,” বলেন ডেল । ডনা বলেন, অল্প বয়স থেকেই স্বপ্ন দেখতেন তিনি অনাথ আশ্রম পরিচালনা করবেন । অথবা নিজের একটি পরিবার হবে। যেখানে বাড়ি ভর্তি এক ডজন বিভিন্ন পশ্চাদপটের ছেলেমেয়ে থকবে। যতদূর ডনার মনে পড়ে, ‘The Dutch Twins এবং The Twins Series-এর আরও বই পড়ে Lucy Fitch Perkins-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মজার ব্যাপার ডনা একসময় একটি বিশেষ স্বপ দেখতেন যেখানে ছেলেমেয়েদেরকে তিনি জড়িয়ে ধরতেন, ভালােবাসতেন এবং বড় করে তুলবেন। ভাগ্যক্রমে ডনা জীবনসঙ্গী পেলেন ডেল উলসিকে। সময় যে তিনিও ডনার স্বপ্নকে বাস্তবরূপ দিতে সমপরিমাণ আগ্রহী ছিলেন। বিয়ের পর দম্পতি নিজ নিজ পেশাগত কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। সে সাথে বিভিন্ন পশ্চাদপটের ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার পাতবার কাজ। সেটা ছিল আন্তবর্ণীয় অনাথ ছেলেমেয়েদের খুঁজে তাদের নিরাপদ বাড়ি ও বাসস্থান যােগাড় করার মতাে বেশ কঠিন কাজ। আবেগী ডনা মনে রেখেছেন ১৯৭১ সালে কানাডা ফিরে খবরের কাগজে যখন এক হৃদয়বিদারক ছবি দেখেন, তখন অসহায় অনাথ শিশুদের ছবি তাদের কাজে উৎসাহ দেয় ।
আমিনা (বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু) ছিল তাদের প্রথম শিশু যাকে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে কানাডা আনা হয়েছিল। পরের বছরগুলি তাদের খুবই ব্যস্ত ছিল। তারা আমিনার দিকে। তাকিয়ে গর্ববােধ করেন আর ভাবেন কীভাবে জাতিগতভাবে ভিন্ন মেয়েটি তাদের নিজেদের মেয়ে হলাে । শীঘ্রই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন আরও কয়েকটি অনাথ শিশুকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন যাতে তাদের বহুজাতিক সন্তানের পরিবার গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে উলসিরা তিনটি মেয়ে দত্তক নেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের আমিনা এলাে, ১৯৭৪ সালে জুলি কোরিয়া থেকে এলাে এবং শারিনা এলাে ১৯৯০ সালে ভারত থেকে। আরও এসেছিল তিনটি ছেলে – জোনাথন ১৯৮৬ সালে এলাে সালডর থেকে, থাইলাে এলাে ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৪ সালে এবং দারিক মিত্র জাতের শিশু কানাডার টরন্টো শহর থেকে ১৯৭৬ সালে । সব মিলিয়ে সত্যিকারের বহুজাতিক, বহুসাংস্কৃতিক, বহুভাষাভাষী পরিবার তৈরি হয় মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। ছয়টি বিভিন্ন দেশের ছয়জন দত্তক সন্তান তাদের শিখিয়েছে প্রয়ােজনীয় কাজ করে হাত পাকানাের প্রক্রিয়ায় নিজেকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে নিজের জীবনকে ঋদ্ধ করে সেটাকে পূর্ণতর করা। একই সাথে মানবিক মূল্যবােধের অনন্য চৰ্চা চালিয়ে যাওয়া। দম্পতিটি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ ও আসা যাওয়া করেন, যেমন- ইউরােপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকা বহু দারিদ্র্যপীড়িত এশীয় দেশে যাওয়া আসার সুযােগে বঞ্চিত ও যুদ্ধপীড়িত শিশুদের দুরবস্থা সচক্ষে দেখে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে । অনাথ আশ্রমে কাজ করেছেন, আন্তর্জাতিক স্কুলে নয় বছর পড়িয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেন যে, শিশুদের নিরাপদ বাড়ি এবং উষ্ণ আদরে ভরা পরিবার প্রয়ােজন সর্বাগ্রে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দৃঢ়মনস্ক উনা তার হৃদয়ের কথা অনুসরণ করেছেন। | দম্পতি বিশ্বাস করতেন যে, “পৃথিবীতে সবার জন্য জায়গা আছে” । তারা তাদের জীবনে এ দায়বদ্ধতা আদায় করার লক্ষ্যে খেটেছেন। নানা সমর্থন গ্রুপের সহায়তায় ডনা সক্রিয় ছিলেন কিছু না কিছু করার জন্য। সৌভাগ্যবশত অনাথদের প্রয়ােজন মেটানাের জন্য সব সময়ে তার পাশে ছায়ার মতাে থেকেছেন ডেল, তার স্বামী। তিনি জানতেন তার স্বামী শর্তহীন সমর্থন যােগাবেন । এ প্রসঙ্গে তাদের বাংলাদেশি পশ্চাদপটের মেয়ে যুদ্ধশিশু আমিনা তার বাবা সম্পর্কে বলে তিনি এমন লােক যার: “জীবন কেটেছে পরিবার, কাজ, গির্জা নিয়ে এবং সাহায্য যার দরকার তাকে সহায়তা দিয়ে” (আমিনার গবেষণাপত্র পৃ: ৩৫)। তার বাবা। সম্পর্কে সে আরও বলে তিনি হলেন “এমন সে সব অনন্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন যারা হেঁটে কক্ষের ভিতর প্রবেশ করলে সকলে স্বস্তি ফিরে পান” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ৩৫)। আমিনা বলে, ডেল নিজেই তাকে বুঝিয়েছেন কীভাবে পরিবার বিশিষ্ট হয় তার ভূমিকার’ গুণে, ব্যক্তির কারণে নয়”। ওটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ছিল বটে, আমরা সবসময়। তােমাদের ডেকে কথা বলতাম; ঐ একই কথা, শুধু জন্ম দিলেই মা হয় না, মায়ের ভূমিকা পালন করতে হয়” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ১৬)। এ মৌলিক দর্শন অনুসরণ করেনি। এবং ডেল একে অন্যের ওপর নির্ভর করতেন এবং সামনে এগুতেন তাদের বৈচিত্র্যময় পরিবার গড়তে এবং সেটাকে টিকিয়ে রাখতে।
বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়েছে, তাদের কাছে এটা এত সঠিক মনে হয়েছে যে, তারা যে লক্ষ্যে কাজ করছে সেটা চালিয়ে যাওয়া । “আমাদের বেলায় এটা ছিল ‘চল, দত্তক নিই’ ।। আমার মনে হয় যদি অন্য কেউ জিজ্ঞাসা করে: বাংলাদেশের অনাথ আশ্রমে শুয়ে আছে যে ছােট্ট ছােট্ট পরিত্যক্ত শিশুরা এদের জন্য সেরা উপহার কী, আমি বলব, তার উত্তর হলাে পরিবার, স্নেহপ্রবণ ডেল বলেন (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ১৬)। আমিনার ভাষ্যমতে, “তার মায়ের দূরদৃষ্টি এবং অনাথ শিশুদের সাহায্যের যে তাগিদ তার পেছনের নীরব চালিকাশক্তি তার বাবা” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ১৭)। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ডেল তার স্ত্রীর “আলােকপ্রাপ্ত চিন্তাভাবনার” এবং “আন্তর্জাতিক দত্তকের জন্য হাহুতাশ ” দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। ডেল তার স্ত্রী যে আঙ্গিকে বা দৃষ্টিকোণে জগতকে দেখেছেন। কয়েক বছরের মধ্যে তারা দুজনই অগ্রপথিকরূপে খ্যাত এবং সংবাদ মাধ্যমের প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন। উলসিরা বলেন তাদের পরিবার হলাে “a family of choice”। সদস্যরা পারস্পারিক সম্পর্ক ও শ্রদ্ধার বাঁধনে বাধা। তারা নিশ্চিতভাবে একটি নতুন জীবন ধারার প্রবর্তন করেন। সে সময়ে যদিও আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক কনডতে বেশি দেখা যেত , তখন কম হলেও অনেককে বিষয়টি আকৃষ্ট করত। উলসিদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান স্কুলে হােক, স্কুলে বাইরে সামাজিক আঙ্গিনায় হােক, তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নিয়ে বিশ্বাস করতেন বহুসংস্কৃতিতে – বিভিন্ন জাতিগত পটভূমি থেকে উদ্ভুত নানা গােষ্ঠির অস্তিত্বে। বহুত্ববাদী হিসাবে তারা দুজনে এ মহৎ লক্ষ্যে কাজ করেছেন, পেশার ক্ষেত্রে যেমন তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে।
আমিনা নিজে তার বাবা-মায়ের জীবনের
স্বপ্ন, আকাঙক্ষা এবং উৎসর্জন নিয়ে বলতে গিয়ে লিখেছে: “মাল্টিকালচারারিজম (বহুসংস্কৃতি) ছিল তাদের জীবনের বাঁচার, চিন্তা ভাবনার এবং বিশ্বাসের এক অপহরণীয় পস্থা” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ১৩)। আমিনা তার মা-বাবার কাছে শিখেছে, একজন অন্যের মিল বা সাদৃশ্যগুলাে যেমন ভালােবাসবে তেমনি বৈসাদৃশ্যকে শ্রদ্ধা করবে । উলসি। ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সেই শিখেছিল কীভাবে প্রত্যেক ভাইবােন প্রত্যেককে উৎসাহিত করতে হবে যাতে তার পূর্ণ উন্নয়ন ঘটে। আজ সকল উলসি ছেলেমেয়েরা বেশ গর্ববােধ করে। কেননা ওদের মায়ের শক্ত দায়বদ্ধতা ওরা লক্ষ্য করেছে সাম্য ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণে। উলসিদের মনে আছে আমিনার প্রথম হােমকামিং এবং কেমন করে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে মা-বাবার ভূমিকায় পালন করতে হয়েছিল যেটা নিশ্চিতভাবেই জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার থেকে আলাদা একটা অভিজ্ঞতা। সন্তান হবার আগে কোনাে সামাজিক অথবা। পারিবারিক অনুষ্ঠান, যেমন স্বাদ বা “বেবি শাওয়ার” অথবা হবু মা-বাবার জন্য কোনাে প্রশিক্ষণ কোর্স ছাড়াই ওরা টরন্টো বিমানবন্দরে গিয়ে হাজির ওদের মেয়েকে তুলবে বলে, যে বাংলাদেশ থেকে আসছে। ডনার মনে আছে, তখনই তার মনে হয়েছিল যে, সংবাদটি তার বাবা-মাকে দেয়া উচিত যে তাদের একটি মেয়ে বাংলাদেশ থেকে আসছে। সেটার। প্রয়ােজন ছিল কারণ তারা তাদের পরিবারকে দত্তক নেবার কথা কিছু বলেননি আগে, আন্তবর্ণীয় দত্তক তাে দূরের কথা । ডনা এবং ডেল চেয়েছিলেন, তার মা-বাবা যাতে এত বিস্মিত না হন তাদের ভয় ও দ্বিধা কাটানাের উদ্দেশ্য যাতে তারা তাদের সিদ্ধান্তকে সর্বান্ত করণে সমর্থন দেন তাই খবরটা আগে থেকে বলতে হবে। তাদেরকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে যাতে তারা বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেন। যতটা তার মায়ের জন্য ঠিক ততটাই বাবার জন্য । ডনার মনে হয়েছিল তার বাবা হয়তাে আরও বেশি সময় নিবেন আন্তর্জাতিক দত্তক বিষয়টি বােঝার জন্য । ডনা বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে আলােচনা করার প্রস্তুতি নেন। তিনি চান নাই তার বাবা-মায়ের সাথে আন্তবর্ণীয় দত্তক নিয়ে যেন কোনাে ধরনের ভুল বােঝাবুঝি হয় । তার ব্যস্ত সময়ের মধ্যেই ডনা তার বাবাকে স্থানীয় কফি শপে নিয়ে খবরটা বলার জন্য যান । ওর বাবা যে নানা হতে যাচ্ছেন সে খবরটা শুনে ডনার গর্ভধারণের কোনাে দৃশ্যত চিহ্ন না দেখতে পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে তার মুখটা ঝুলে গেল । খবরটা হঠাৎ শুনে তার গলা শুকিয়ে। গেল। কোনাে রকমে গলা দিয়ে একটু শব্দ করতে পারলেন। কয়েক মিনিট তিনি কোনাে কথা বলেননি। একটু আত্মসংবরণ করে তিনি ডনাকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তারা (ডনা ও ডেল) অতদূর দেশ থেকে একটি শিশু আনতে গেলেন। অন্য আরেকজনের সন্তান এনে নিজের পরিবার তৈরি করার ধারণা তার কাছে একদমই স্বাভাবিক অথবা বাঞ্ছনীয় মনে হয়। , বলেন ডনার বাবা । স্থির প্রতিজ্ঞ ডনা শান্ত থাকেন তার বাবার বিপরীত তর্কের জবাব না দিয়ে । উলসিদের কথা হলাে, তারা মনে করেন, খবরটা দেয়া দরকার তাই দেয়া হয়েছে। ডনা তাে কারাে মতামত বা পরামর্শের জন্য খবরটি দেননি। একটি আন্তর্জাতিক এবং আন্তবর্ণীয় শিশুকে দত্তক নেবার সিদ্ধান্তটি তারা অনেক আগেই নিয়েছেন। ডনা মনে মনে শুধু বললেন সে সময়ে এ বিষয়টি নিয়ে পারিবারিক বিতর্কের কোনাে অবকাশ ছিল না।
কয়েকদিন গেল, আমিনা বাড়িতে এসে গিয়েছে। দম্পতি দৃশ্যত অত্যন্ত খুশি যে, ডনার বাবা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মেয়েটিকে ভালােবেসে ফেলেছেন। অল্প দিনের মধ্যেই ‘the little Ami’ (তারা আদর করে Amina কে Ami বলে ডাকতেন) সবার মন জয় করে নেয় । বিগত বছরগুলােতে উনার বাবা ছয়জন নাতি নাতনির সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেন। Grandpa উলসি তার মেয়ে ডনার বাড়িতে এত আরাম পেতে লাগলেন যে, অন্য কোনাে শ্বেতকায় পরিবারের সঙ্গে এর কোনাে পার্থক্য খুঁজে পাননি। বর্ধিত পরিবারে সকলেই দেখে খুশি হতাে যে গর্বিত Grandpa তার নাতিদের ছবি পকেটে টাকা রাখার চামরার ব্যাগে নিয়ে ঘুরতেন এবং পরিচিত সবাইকে গর্বের সাথে দেখাতেন। এদিকে তাদের সন্তানেরা বড় হতে শুরু করলেও উলসিরা তাদের জীবনের দুটি লক্ষ্য অর্জনে আগের মতােই ব্যস্ত থাকেন – এক, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা এবং দুই, বিশ্বকে আরও বসবাসযােগ্য করে রেখে যাওয়া । যখন তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছিল ডনা টেলিফোনে অগণিত ঘন্টা খরচ করেছেন, আশাবাদী পরিবারকে উৎসাহ দিয়ে আন্তর্জাতিক দত্তক নিয়ে অনাথদের জন্য একটু খানি আনন্দের যােগাড় বাড়িয়ে দিতে। একইসাথে কর্তৃপক্ষকে আন্ত জাতিক দত্তক নেবার আইন কানুন সরলীকরণ ও সুবিধা বৃদ্ধি করার জন্য লবি করার লক্ষ্যে কাজ করেন। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাবাে দত্তক পরিবারের নেটওয়ার্ক এবং সাপাের্ট গ্রুপ ক্যানাডপ্ট বিষয়ে। আমিনার আগমনের পরই ডনা উলসির উদ্যোগে প্রধানত ক্যানাডপ্ট প্রতিষ্ঠিত হয় – জাতিগত বিচারে বিভিন্ন দত্তক নেয়া বাবা-মায়েদের নেটওয়ার্ক। সত্যিকারের প্রশিক্ষক হিসাবে উলসিরা তাদের ছেলেমেয়েদের যে শিক্ষা দিয়েছেন, যে জ্ঞানে ঋদ্ধ করেছেন এবং মূল্যবান জীবন দক্ষতা দিয়েছেন সেটা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি । ওদেরকে ছােটবেলা থেকেই শেখানাে হয়েছে যে, অসহায়কে সহায়তা দিয়ে নিজে সহযােগিতা পাবার যােগ্য হতে হবে । উলসিদের পরিকল্পনা ছিল প্রত্যেক শিশুকে তার নিজ দেশে পাঠিয়ে সে মাটির দক্ষতা, দীক্ষা আর অভিজ্ঞতা অর্জন। এ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা তাদের সন্তানদের জন্মদেশ সফরে পাঠিয়েছিলেন নিজের সংস্কৃতিতে ডুব দেবার জন্য ।
শিক্ষার ক্ষেত্রে যেহেতু তাদের নিজেদেরও বিচরণ, উলসিরা নিশ্চিত করেছিলেন যে তাদের ছেলেমেয়েরা সবাই সুখী। জীবনযাপন করবে এবং সাধ্যানুযায়ী সেরা শিক্ষা পাবে। ছেলেমেয়েরা যখন বড় হচ্ছিল, সে সময়ে তাদের বাড়ির অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে আমিনা বলেঃ “তাদের বাড়িটি সব ধরনের মানুষের জন্য আশ্রয় স্বরূপ ছিল” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ২৮)। ফলে “ওখানে সবাই নানারকম মানুষ আসছে আর যাচ্ছে। নানা গল্প কাহিনী নিয়ে কথা হয়। এতে তাদের সুযােগ হয়েছিল শেখার, লােকজনকে সম্মান করার, ধৈর্য্যশীল হবার, অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতি বােঝার । শিশুরা যেহেতু ছােট ছিল উলসিরা তাদের প্রত্যেকের যােগ্যতা, দক্ষতা, সক্ষমতা বিচার করে শারীরিক প্রশিক্ষণ, সাঁতার, স্কেটিং, টেনিস, ডাইভিং, পিয়ানাে, বাঁশি, ক্যাম্পিং ইত্যাদি কার্যকলাপে জড়ায়ে রাখতেন । উলসি দম্পতি এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে, ভাইবােনেরা একে অন্যকে শ্রদ্ধা করে, একে অন্যকে।
মানিয়ে নিয়ে চলে। আজ তাদের ছয় জনেই ভালােভাবে শিক্ষিত, আত্মবিশ্বাসী এবং যেটাকে বলা যায় নানা দিক দিয়ে দক্ষ।
উলসিদের সবচেয়ে বড় অর্জন তাদের সফল সৃষ্টি এবং যত্ন আন্তর্জাতিক আন্তবর্ণীয় পরিবারের জন্য যখন এধরনের দত্তক গ্রহনে তখনও তত বেশি প্রচলন ছিল না। কিন্ত তারা বাস্তবে এতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, তারা জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে ঐতিহ্যের বেড়া ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক গ্রহণে এখনও তাদের প্রচেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তাদের পূর্ণ সময় কাজের থেকে অবসর নিয়ে এবং তাদের সর্বশেষ যে কাজের চুক্তি ছিল চীন দেশের তাইপে-তে, সেটা শেষ করে কানাডাতে ফিরে তারা এখনও আন্তর্জাতিক দত্তক বিষয়ে, ভিন্ন জাতের শিশুদের দত্তক গ্রহণের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন । কানাডাতে তারা রিস্ক-টেকার অর্থাৎ ঝুঁকি নেয়ার মাস্টার হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন যখন আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক ১৯৭০ এর প্রথমে অচেনা জলপথের মতাে ছিল। সে অর্থে উলসিরা। কানাডাতে সমবর্ণীয় দত্তকের সীমানা ভেঙে পরিবারের সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণ করে পরিবার। গঠনের এক নতুন দৃষ্টান্ত রাখেন। আজ দম্পতিদের চলমান কাজ হলাে ক্যানাডপ্ট কমিউনিটি সদস্যদের জন্য বাৎসরিক ডিনার এবং পারিবারিক বনভােজনের আয়ােজন করা যা সাধারণত করে থাকেন লন্ডন শহরের কোন্ডস্ট্রিম কনজার্ভেশন এরিয়াতে । সেখানে প্রায় ৭৫ থেকে ১০০ টি দত্তকগ্রাহী পরিবার এবং তাদের সন্তানেরা যােগ দেয়। উপরন্তু আট-দশ জন প্রথম গ্রুপের মায়েরা (যারা ১৯৭২ সালে। দত্তক নিয়েছিলেন) মাসে একবার মিটিং-এ বসে স্মৃতিচারণ করেন, নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলােচনা ও তথ্য বিনিময় করেন আর সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন।
আমিনা
গর্ভধারণ মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই আমিনার জন্ম হয়েছিল ৩ এপ্রিল ১৯৭২ তারিখে মাদার তেরেসার ঢাকাস্থ শিশু ভবনে। জন্মের সময় আমিনার ওজন ছিল ২ কেজি । সে কানাডা পৌছেছিল ২০ জুলাই ১৯৭২ সালে । অত্যন্ত ধীরে ধীরে দুর্বল আমিনা সেরে উঠতে থাকলেও তার পােষ্য মা-বাবার দুশ্চিন্তার কারণ ছিল বহুদিন । অন্টেরিওর লন্ডন শহরের কাছে কমােকায় তারা বাবা-মায়ের বাড়িতে বড় হয়। সে পার্কভিউ। এলিমেন্টারি স্কুল এবং লন্ডনের মেডওয়ে সেকেন্ডারি স্কুলে লেখাপড়া করে। স্কুলের পড়া শেষ করে আমিনা ইউনিভাসিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টেরিওতে ব্যাচেলর অব এডুকেশন শেষ করে । তারপর সে ইয়র্ক ইউনিভাসিটিতে আবার ব্যাচেলর অব এডুকেশন শেষ করে এবং এডুকেশন-এ মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করে ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে। টরন্টো এলাকায় কয়েক বছর থাকার পর সে কাজ নিয়ে প্রথমে চিলিতে যায়, সেখানে থেকে যায় চীনে এবং পরে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক ডাসেলডর স্কুলে । জার্মানির চুক্তি শেষ করে বর্তমানে সে মধ্য প্রাচ্যের দুবাইতে নবনির্মিত আন্তর্জাতিক স্কুল দুবাই-আল খাইল-এ শিক্ষকতা করছে। আমিনা বলে, ছােটবেলা থেকেই সে জানত, যে সে দত্তককায়নের মাধ্যমে কানাডাতে আসে। খুব সােজাসুজিভাবে আমিনা বলে: “ওটাতে লুকানাের কিছু নেই। আমার সৌভাগ্য যে আমার মা-বাবা জানতেন আমাদের একটা সমর্থনীয় সংশ্রয়ের প্রয়ােজন। সুতরাং আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম অনেক বন্ধুবান্ধব নিয়ে যারা আমার মতাে দত্তক নেয়া সন্তান।” আমিনা। আবারাে বলে, “আমি যে একজন পােষ্য সন্তান এটা আমার জন্য কখনাে কোনাে ইস্যু ছিল । আমার সবসময় নিজের ওপর আস্থা ছিল”। হয়তাে এ কারণে আমিনার এটা মেনে নিতে কোনাে অসুবিধে হয়নি যে, তাকে জন্মের পর ত্যাগ করা হয়েছিল এবং তারপরই আবার তাকে দত্তক নেয়া হয়েছিল। জীবনের রূঢ় সত্যকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে বড় হয়ে ওঠার জন্যই হয়তাে আমিনা এ বিষয়ে বিব্রতবােধ করেনি। এখন সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে তারপরও আমিনার মনে কোনাে দ্বন্দ্ব নেই ।
স্পষ্টভাষী আমিনা নিশ্চিতমনে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে; “দত্তক বিষয়টি কোনােদিনই কোনাে ইস্যু ছিল না আমার জীবনে। আমার মনে হয় জীবনে আমি একটা দ্বিতীয় সুযােগ পেয়েছি ফলে, আমি সেটা পূর্ণভাবে কাজে লাগাচ্ছি”। তার অসহায়া জন্মদাত্রী মাকে নিয়ে বিগত বছরগুলিতে আমিনা অনেক ভেবেছে। বিশেষ করে তার জন্মের পর তাকে যে অবস্থার ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছিল সে সম্পর্কেও সে ভেবেছে। আজ একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে সে সম্পূর্ণ ব্যপারটা এভাবে দেখে যে, বাঙালি সমাজের অবস্থা এ বিশেষ সময়ে কেমন ছিল সেটা আপনাকে বুঝতে হবে । এই শিশুদের যারা গর্ভে ধরেছিলেন তাদেরকে শত্রুরা (পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী) ধর্ষণ করেছিল। বাঙালি সমাজে বিবাহ ছাড়া নারীর সন্তান হলে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়। তাদের পরিবার তাদের ত্যাগ করে। তাদের জনগােষ্ঠী তাদের ঘরে জায়গা দেয়নি। ধর্মীয় দলপতিরাও তাদের জায়গা দেননি। ‘৭১-এর ঘটনার পর অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবনের জন্য নিজের এলাকা ত্যাগ করতে হয়েছিল। তরুণী মেয়েদের এবং নবজাত শিশুর জন্য তখন কোনাে সহায় সম্বল ছিল না । নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবন পাওয়া বস্তুতপক্ষে ছিল এক অসম্ভব প্রস্তাবনা। নবজাত শিশুকে ত্যাগ করা ছাড়া আর সেখানে কিছুই করার ছিল না”। বড় হবার সময় আমিনা তার অতীত সম্পর্কে টুকরাে কাহিনী শুনেছে, যখন সে বয়সে পরিপক্ক হলাে তখন সে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের যৌন সহিংসতা ও নির্যাতনের কাহিনী শুনেছে। সে জানে নির্যাতনকে সংবাদ মাধ্যম সংঘবদ্ধ নির্যাতন আখ্যা দিয়েছিল। যৌন সহিংসতার ফলে সন্তানসম্ভবা হওয়া, যুদ্ধশিশুদের জন্ম দেয়া, তাদের পরিত্যাগ এবং দত্তক নেয়ার ঘটনা, এসবই সে ঐতিহাসিক সত্য হিসাবে মেনে নিয়েছে। সে বুঝতে পারে ঐসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলির অভিঘাত তার জীবনেও পড়েছে। কিন্তু সে এটাও বলেঃ “ঐ সব তথ্য আমার সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলে না” । বিষয়টি নানা আঙ্গিকে চিন্তা করে আমিনা এমনও অনুভব করে যে তার জীবন সংক্রান্ত বংশধারার কিছুই কখনাে পাওয়া যাবে না কারণ তার বাবা-মা তার জন্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনাে তথ্য পাননি । সে নিজেকে নিজের মতাে দেখে। আমিনা তার মা-বাবার স্নেহভালােবাসায় স্নাত বাড়িতে যেভাবে নিজেকে দেখেছে তাতে সে কখনাে অনুভব করেনি সে।
অন্যের বাড়িতে আছে । আমিনা বড় হয়েছে এটুকু ভেবে যে এটা “তার বাড়ি” বা তাদের “সবার বাড়ি”। আত্মপরিচিতি বিষয়ে দৃঢ়োক্তির মাধ্যমে আমিনা তার আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করে এভাবেঃ “আমার জীবন পূর্ণ এবং আমি ব্যাখ্যা করেছি আমাকে আমার নিজস্ব যেসব অভিজ্ঞতা রয়েছে সে অভিজ্ঞতার আলােকে। অতীত অতীতই”। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই আমিনার পরিপক্কতা বেড়েছে। সে তার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতাবােধ করে যখনই নানা প্রতিবন্ধকতার কথা মনে করে। তার মা-বাবা যে শুধু তাকে বাংলাদেশ থেকে বের করে আনতে “যে কঠিন লড়াই” করেছিলেন আর অগণিত সময় এবং অজস্র ফোন কল, স্থানীয় এম পি, এম পি পি, আইনজ্ঞ, সরকারি কর্মকর্তা, চিলড্রেন’স এইড সােসাইটি এবং ইমিগ্রেশন কানাডাকে চিঠির পর চিঠি লিখেছিলেন, সেসব তথ্য সে যতটুকু জেনেছে সেটুকুই যত্নে তার স্মৃতিপটে রেখেছে । এখন মাঝে মাঝে অকপট ও মনখােলা আমিনা যখন পেছনে তাকায়, সে বলে পুরােপুরিভাবে তার মা-বাবার জীবনদর্শন ও তাদের ত্যাগের দৃষ্টান্ত তখন উপলব্ধি করতে পারেনি। সে সময় তার মা-বাবার নিবেদিতপ্রাণ দায়বদ্ধতা সম্যকরূপে বুঝে উঠতে পারেনি, যেটা এখন সে পারে। “শিশু হিসাবে আমি কখনাে বুঝতে পারিনি আমার মা-বাবা আমার জন্য কী ত্যাগ করেছিলেন। কিন্ত আমি একটু সময় বের করেনিয়ে তাদেরকে জীবনে আমাকে এত সুযােগ দেয়ার জন্য যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করব সেটাও করিনি” (আমিনার গবেষণাপত্র পৃ:২৬)। আমিনা তার নিজ অভিজ্ঞতার আলােকে বলে, “আমি আমার মা-বাবার মেয়ে এবং আমার বিশ্বাস ও কার্যকলাপ তাদেরই প্রতিরূপ। আমার বিশ্বসের সবটুকুই তাদের তৈরি করে দেয়া ছাঁচ সেখান থেকে প্রত্যক্ষভাবে এসেছে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতাসমূহ থেকে বেছে বেছে কিছু বিভিন্ন টুকরাে নিয়ে আমার শিক্ষকের ভূমিকায় কাজ করে যাই বলে গর্বিত আমি” (আমিনার গবেষণাপত্র; পৃ:২৭)। স্বাভাবিকভাবেই সে তার মা-বাবার প্রতি চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ যারা তাকে তার জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা সব তার সত্ত্বায় মিশিয়ে দিয়েছেন, আর সময় ও অর্থসম্পদ যে ব্যয় করেছেন কত তাকে মানুষ করতে তার তাে ইয়ত্তা নেই। নানা বিষয়ে আলাপের পর একজন প্রাপ্তবয়স্ক পেশাজীবী হিসাবে সচেতনতা প্রকাশ করে। একটি বিতর্ক ঘিরে প্রশ্নটি “প্রকৃতি বনাম লালন পালন”-এ দু’এর সংজ্ঞা এবং এদের পরস্পর সম্পর্ক নিয়ে ।
সে যে তাদের দত্তক নেয়া সন্তান এ জ্ঞান নিয়ে সে অনেক প্রশ্নের মুখােমুখি মেয়েবেলাতেই হয়েছিল। আমিনার বলে, সে এ সত্যকে শুরুতেই মেনে নেয় যে সে একজন দত্তকায়িত সন্তান । এটা সকলেই বােঝে যে, প্রাকৃতিকভাবে দম্পতির মিলন থেকে যে সন্তানের জন্ম হয় তাকে সাধারণত নানাভাবে, যেমন প্রাকৃতিক সন্তান, পরিবারের সন্তান, জৈব সন্তান অথবা ঔরসজাত সন্তান বলা হয়। অন্য কারাে সন্তানকে তার মা-বাবার অনুপস্থিতিতে অন্য আরেকজন দত্তক নিয়ে আপন সন্তানের মতােই ভালােবাসা ও যত্ন দিয়ে যখন মানুষ করেন তখন সে সন্তানকে পােষ্যক বা দত্তকায়িত সন্তান বলা হয়।
মায়ের মতাে দৃঢ় ইচ্ছা শক্তির অধিকারিনী আমিনা বলে: “আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমার ভাই। থাইলাে এবং আমার বােন শারিনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অবশ্য অনেকখানি আলাদা।” সে আরও বলে, কীভাবে থাইলাে এবং শারিনা তাদের শরীরের ত্বকের রং-এর বিষয়ে কি “যুদ্ধটাই না করেছে এবং যে সমাজে তারা নিজেদের সংশ্লিষ্ট করে সে সমাজের অনেকেই (শ্বেতাঙ্গ বন্ধুবান্ধব) তাদের নিয়ে কী ঠাট্টা উপহাসই না করেছে। সৌভাগ্যক্রমে আমিনার ব্যাপারটা ওরকম ছিল না কারণ আমিনা সর্বদা ভেবেছে সে ঐ পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ যে পরিবার। তাকে সবসময় তার জন্য ভালােবাসা ও সমর্থন দিয়েছিল” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ১০)।
আমিনা সবসময় উপলব্ধি করেছে যে, প্রাকৃতিক বন্ধন এবং অদৃশ্য মায়ার ভালােবাসার স্নেহের যে শক্ত বাঁধন, সেগুলাের দ্বারা সে তার মা-বাবা ভাইবােনদের সাথে বাঁধা পড়েছিল। আমিনা যখন সেগুলাে অনুভব করে তখনই তার ভেতরে তৈরি হয় এক ধরনের বাঁধন । তাদের বাড়ি ও পরিবার এবং সদস্যদের বৈচিত্রের প্রসঙ্গে আমিনা বলে যে, তাদের। পরিবারকে “পরিবার হিসাবে বেশ স্বাভাবিক মনে হলেও আরেক অর্থে ওটা একটা ছােটখাট জাতিসংঘের প্রতিনিধিত্ব করার মতােই” (আমিনার গবেষণাপত্র পৃ: ১০)। উলসি পরিবারকে তারা সবাই একটি অনন্য পরিবার হিসাবে গণ্য করে আসছে। তাদের পরিবারের গঠন। বিশদভাবে বলতে গিয়ে আমিনা বলে যে, সে বিশ্বাস করে তাদের পরিবারের মূল বৈশিষ্ট্য হলাে: বহুসংস্কৃতি, বিভিন্ন জাতিগত পটভূমি থেকে উদ্ভুত গােষ্ঠির অস্থিত্ব, বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্যের ধারা। আমিনা কোনাে সময়ে তার আত্মপরিচয় নিয়ে সাংঘর্ষিক অবস্থায় পড়েনি। তবে মিডলসেক্স কাউন্টির ছােট শহর কোমােকা থেকে টরন্টো যাওয়ার পর আমিনা যেন নতুন লেন্সের ভেতর দিয়ে হঠাৎ কানাডীয় সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের ঋদ্ধতা দেখতে ও বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে সে আরও জ্ঞান লাভ করে এবং এ বিষয়ে জানার আগ্রহী হয় । ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যলয়ে প্র্যাক্টিকাম করার সময় সে অবাক হয়ে দেখে কেমন করে নানা কৃষ্টির উদযাপন, বই, পােস্টার, অতিথি। ও আতিথেয়তা, পারিবারিক সংস্কৃতি ইত্যাদি তাদের শিক্ষকরা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। স্বভাবতই সে উৎসাহের সঙ্গে লক্ষ্য করে কোমােকার একরৈখিক সংস্কৃতির। পাবলিক স্কুল অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনায় টরন্টোর স্কুলগুলি নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে ঋদ্ধ সমাজের প্রতিফলন বটে। ডনা যে পরিবারভিত্তিক সমর্থন দানকারী নেটওয়র্ক ক্যানাডপ্ট ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ওটা তাদের জন্য কেবল বর্ধিত পরিবারই ছিল তা নয়।
ওটা আরও ছিল দত্তকগ্রাহী পরিবার ও তাদের ছেলেমেয়েদের বৈচিত্র্য ও বহুত্ব উদ্যাপন করার এক চমৎকার মঞ্চ। আমিনা বলে ক্যানাডপ্ট একটি “ভালােবাসা, শ্রদ্ধা, মায়ামমতা এবং সমর্থন” বিষয়ে মেলামেশার জায়গা যেখানে বহুজাতিক পরিবারেরা একত্রিত হন অনায়াসে” (আমিনার গবেষণাপত্র পৃ: ১৬)। দত্তকগ্রাহী পরিবারের নেটওয়ার্কের কথা বলতে গিয়ে আমিনা আবারও বলে: “সমবেতভাবে বহুসাংস্কৃতিক এক ক্ষুদ্রভাগ প্রতিনিধিত্ব করে বাবা-মা ও ভাইবােনকে নিয়ে যে আমাদের পরিবার সেটা যেন আমার মায়ের কীর্তিকান্ডে গর্বিত। (আমিনার গবেষণাপত্র; পৃ: ১)।
উলসি দম্পতির প্রতিটি ছেলেমেয়েই বড় হয়েছে বহু সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে । স্বযত্নে লালিত আমিনা মনে রেখেছে, কীভাবে তার মা-বাবা তাকে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও’র পি এইচ ডি বাংলাদেশি ছাত্র ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করে দিয়েছিলেন একটি মাত্র লক্ষ্যে – বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে তাকে আকৃষ্ট করার জন্য। আমিনা এখনও চৌধুরীদের সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছে। চৌধুরীরা এখন বাংলাদেশের (ঢাকায়) থাকেন। তাদের মেয়ে প্রিমা আমিনাকে প্রায়ই নিমন্ত্রণ করত, ওরা যখন লন্ডন অন্টেরিওতে ছিল। শৈশবে সে অনেকবারই চৌধুরীদের লন্ডনস্থ ফ্ল্যাটে বেড়াতে গিয়েছে । “চৌধুরীদের এ্যাপার্টমেন্ট সবসময়ই মশলা এবং ধুপের সুগন্ধে ভরপুর থাকত। আমার মনে হতাে দূরের ঐ সুগন্ধী দেশে আমি একদিন যাব” (আমিনার গবেষণাপত্র; পৃ:৯)। আমিনার মনে পড়ে চার বছর বয়স থেকেই সে সচেতন ছিল যে অন্যদের সে সহায়তা যােগাতে দায়বদ্ধ। সে তার মায়ের কাছ থেকে এটা শিখেছে, যিনি ওরকম বলতেন তার সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে বহু সাক্ষাৎকারে সেই ১৯৭৮ সালেও সেটা বলেছিলেন (আমিনার গবেষণাপত্র; পৃ: ৩০)। আমিনার মেয়েবেলার কোনাে একসময় ডনার সাথে আমিনার সংলাপের প্রসঙ্গ টেনে ডনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, “সে আমাকে বলে ওখানে গিয়ে সে লােকের সেবা করবে। সে সব সময়ে বাংলাদেশে যাবার কথা ভেবেছে এবং ওখানকার মানুষকে সহায়তা দেবার কথা বলেছে” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ৩০)। আমিনার সম্পর্কে এক সাক্ষাকারে ডনা The London Free Press-এর জর্জ হাচিসনের সঙ্গে আলাপকালে কথাটি উল্লেখ করেন। আমিনা তার শৈশবের সময় সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার মা-বাবার সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ। কথা ব্যক্ত করে যেগুলাে তাদের ভাইবােনদের নিয়ে বলা হতাে এবং যেগুলি পরবর্তী জীবনে তাদের কাজে লাগাবার কথা: “সুখ ভাগ করেনিতে হয়” (আমিনার গবেষণাপত্র পৃ: ৩০)। নিজেকে ভাগ্যবান যুদ্ধশিশুদের একজন বিবেচনা করে সে বড় হয়ে ওঠে এ বিশ্বাস করে যে, তাকে জীবন যা দিচ্ছে তার সর্বাধিক অংশ কাজে লাগাতে হবে, কারণ তার সাথে জন্ম নেয়া অনেক যুদ্ধশিশুর অপূর্ণ স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে বেঁচে থেকে কর্মবহুল জীবন কাটিয়ে। আমিনার প্রথম বাংলাদেশ সফরের অনেক প্রিয় স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা আমরা পরের অধ্যায়ে দেখতে পাবাে যেখানে আমিনার মা ডনা উলসি বাংলাদেশের অনাথদের নিয়ে তার সংগঠনের মাধ্যমে একটি সফরের আয়ােজন করেছিলেন।
সে অধ্যায়ে যুদ্ধশিশুদের অভিজ্ঞতাগুলাে বিশদভাবে যুদ্ধশিশুদের দেশে ফিরে যাওয়া উপশিরােনামাতে উল্লেখ করা হয়েছে । আমিনার ভাষ্যানুযায়ী শিশু ভবনে অন্যান্য অনাথ শিশুদের দেখে সবাই বাস্তবিকপক্ষে মানসিক অস্থিরতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অনাথ শিশুদের দেখে আমিনার মনে হয়েছিল ঐ ছেলেমেয়েদের মধ্যে কেউ একজন হয়তাে সেও হতে পারত – যদি না তাকে কেউ দত্তক না নিতেন। সে সত্যিই আশির্বাদপ্রাপ্ত মনে করেছিল নিজেকে ঐ মুহূর্তে। শুধু আমিনা নয় অন্যান্য পােষ্যরাও তাই ভেবেছিল । স্মৃতিচারণে আমিনা বলে, “আমার মনে হয় জীবনের এ মােড়ে দাঁড়িয়ে আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমি জীবন সুষ্ঠু এবং পূর্ণভাবে যাপন করব। এখন থেকে । শুধু তাই নয়, আগে যারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে না পেরে অনিশ্চয়তা ও অবহেলার জীবন কাটিয়েছে, আমি তাদের স্বপ্নও পূরণ করব” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ৩০)।
যদিও বাস্তবুদ্ধি সম্পন্ন আমিনা জানত সে তার জন্মদাত্রী মাকে কোনােদিন আর খুঁজে পাবে না, সে ২০০৫ সালে তার ভাই জোনাথন এর পুনর্মিলনীতে যােগ দেবার আনন্দ ও সন্তুষ্টি লাভ করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেনি। এল সালভাদর থেকে অল্প বয়সে দত্তক নেয়া। জোনাথনের প্রকৃত পুনর্মিলনী তার জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে হয়েছিল। আমিনার মনে আছে, মায়ের সঙ্গে জোনাথনের এক নজরের দৃষ্টি বিনিময় অত্যন্ত মর্মস্পর্শী দৃশ্যটি । আমিনা যা দেখেছিল তা কখনাে ভুলতে পারে না – কীভাবে রােগাটে, শীর্ণ জন্মদাত্রী মা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে জোনাথনকে জড়িয়ে ধরে যখন চুমু দিচ্ছিলেন তখন তার অশ্রুসিক্ত চোখ সবকিছু ঝাপসা করে দিয়েছিল। আমিনা পরিষ্কার মনে রেখেছে তিনি বারবার ফিসফিস করে বলছিলেন, “দয়া করে আমাকে মাফ করাে, আমি প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে বলি তুমি আরও ভালাে বাড়িতে গিয়েছ” (আমিনার গবেষণাপত্র; পৃ: ৩০)।
আমিনা ঐ মুহূর্তগুলি মণিমুক্তার মতাে যত্নে তার স্মৃতির মনিকোঠায় জমা করে রেখেছে। সে মুহূর্তে আমি নিজে এত আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিল যে, তার মনে হয়েছিল যেন সে নিজেও বৈকল্পিকভাবে তার জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে পুনর্মিলন উপভােগ করেছিল। আমিনার এ অভিজ্ঞতা সব ঘটনাকে আরও দৃঢ়সংবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল সে সময়ে তার জন্মদাত্রী মা সে দেশে অপ্রার্থিত শিশুকে নিয়ে বাঁচার কোনাে উপায় ছিল না। সে জন্যই তাকে তার মা নিরুপায় হয়ে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে এক অনাথ আশ্রমে রেখে গােপনে চলে গিয়েছিলেন। একথা বলে লাভ নেই, তবুও বলতে হবে যে অনেক অনুন্নত দেশে নারীরা সন্তানকে ত্যাগ করার পরও নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হন – যার অর্থ কেবলই জীবনের পর জীবন নষ্ট করা । চিন্তাশীল আমিনা বিশ্বাস করে যে, যুদ্ধশিশুদের ত্যাগ করা ভিন্ন জন্মদাত্রী মায়েদের আর কিছু উপায় ছিল না। মা-বাবার পদাঙ্ক অনুসরণে আমিনা শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছে। সে বিশ্বাস করে শিশুদের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা তাদের নিজেদের বিশ্ব নাগরিক হিসাবে দেখবে। আজ আমিনা একজন সফল পেশাজিবী হিসাবে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসন্মানের উপর গুরুত্বারােপ করে। আজ আমিনা প্রশিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক কর্মশালা পরিচালনা করে এবং বাবা-মা ও সহকর্মী শিক্ষকদের জন্য বহু বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে আমিনা তার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশে ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা করে যাতে তারা ‘সবার সেরা হতে পারে, সে লক্ষ্যে (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃ: ৩৪)। আমিনা নিজেই বলে সে তার মা-বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করছে। তার মা-বাবার মতাে আমিনা একজন শিক্ষক হয়েও নিরন্তর ছাত্র, যে তার অভিজ্ঞতা।
ও বিশিষ্টতায় শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখা শুরু করেছে। নিজের বর্তমান পেশা এবং দায়িত্ব প্রসঙ্গে আমিনা বলে: “আমি আমার মা-বাবার মেয়ে, পুরাে পৃথিবীতে প্রায়শ জেটবিমানে ভ্রমণ করি, নতুন জায়গা খুঁজছি অনুসন্ধানের জন্য, নতুন মানুষ খুঁজি কথা বলার জন্য এবং গল্প খুঁজেছি আমার জীবন কাহিনীর ভান্ডারে রাখার জন্য” (আমিনার গবেষণাপত্র; পৃ: ৩৪)। জীবনের সুযােগ সুবিধার সুবাদে আমিনা বাস্তবিকপক্ষে তার মা-বাবার মতাে, যারা সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমিনা তার পেশাজীবী জীবন সম্পর্কে আরও বলে, সত্যিই সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ না থাকলে এমন জীবনযাপন সম্ভব হতাে না” (আমিনার গবেষণাপত্র; পৃ: ৩৪)। নানা বিচিত্র পশ্চাদপটের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কয়েক বছর কাজ করার পর তার পেশাগত জীবন সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলছে। আজ, শিক্ষিতা ও আলােকপ্রাপ্তা আমিনার জন্য, পরিবর্তনের বাতাস নতুন দরজা খুলেছে । সেও এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষদের আলােকিত করার লক্ষ্যে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অচেনা কারাে সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথাই বলুক বা কোনাে কনফারেন্স-এ নৃতাত্ত্বিক অবস্থান ও নিজস্ব পরিচিতির বিষয়ে সংলাপে জড়িত হােক, আমিনা যেভাবে শৈশব থেকে নিজেকে দেখছে সেভাবে সে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। যখন যেভাবেই তাকে তার পরিচিতির কথা জিজ্ঞাসা করা হয়, সে সরাসরি উত্তর দেয় কোনাে ধরনের ডান না। করেই- “আমি পৃথিবীর সর্বত্র ঘুরেছি, যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি কোথা থেকে এলাম, অর্থাৎ আমি কোনাে দেশের, আমি বলি আমার বাড়ি কানাডা। তখন আমি বেশ মজা করে লক্ষ্য করি তাদের প্রতিক্রিয়া। তখন আমার শুধু হাসি পায়।” আরেকটু এগােলে। আমিনা আরও বলে, “আমার বাব-মা শ্বেতাঙ্গ, (কানাডীয়)। আমি বিশ্বাস করি যে, মা-বাবা হলাে সেসব মানুষ যারা সময় ব্যয় করে তােমাকে বড় করে তােলেন, তােমাকে আশ্রয় দেন।
এবং তােমার রক্তের সম্পর্কের খোঁজ না নিয়ে আদর যত্ন করেন” (আমিনার গবেষণাপত্র; পৃ: ৩৪)। এ কথা বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, আমিনার বাড়িতে বহুজাতিক ভাইবােন থাকায় এবং বহুসংস্কৃতিক পরিবেশে তারা বড় হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, পিয়ের এলিয়ট ট্রুডাে, স্বপ্ন দেখেছিলেন কানাডীয় এক সংস্কৃতি যে সংস্কৃতি হবে বিভিন্ন জাতিগত পটভুমি থেকে উদ্ভুত, নানা গােষ্ঠীর অস্থিতে একীভূত এক দেশ । গর্বিত আমিনা তার তার নানাবর্ণীয় ভাইবােনদের লক্ষ্য করে বলেঃ ‘ট্রিডাের একটা স্বপ্ন ছিল এবং আমি সে স্বপ্নের অংশ ছিলাম” (আমিনার গবেষণাপত্র পৃ: ৩৪)। ২০১০ সলের ফেব্রুয়ারি মাসে আমিনা আবার দ্বিতীয়বারের মতাে বাংলাদেশে আসে এক সংক্ষিপ্ত সফরে। আমিনা এসেছিল প্রধানত অনাথ আশ্রমের কর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে যাদের সে বহু বছর যাবৎ সহযােগিতা দিয়ে আসছে। যেহেতু সে বাংলাদেশে দারিদ্র্য, কষ্ট ও অভাব দেখেছে, এবার আসে সে মূলত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার লক্ষ্যে। আমিনা বাংলাদেশে এসে পুরােপুরি হতাশ হয়নি। তার ১৫ দিনের অবস্থানকালে সে মাদার তেরেসার অনাথ আশ্রমে গিয়েছিল যেখান থেকে তাকে দত্তক নেয়া হয়েছিল। সে শ্রীপুরস্থ শিশু পল্লীতেও যায় যেখানে ১৯৮৯ সালে ক্যানাডপ্ট-এর মাধ্যমে বেড়াতে এসেছিল। তারপর ঢাকাতে সে ফারুক ও পলিন চৌধুরীর বাড়িতেও তাদের সাথে দেখা করতে যায়। এ দম্পতির সাথে আমিনা এখনও যােগাযােগ রেখেছে।
আমিনা তার নিজের সুকৃতির জন্য তার দত্তক পরিবারকে কৃতিত্ব দেয়। করুণাময়ের কৃপায়। এমন এক পরিবার তাকে দত্তক নিয়েছিল যারা তাকে ভালােবাসা, স্নেহ আদর ও ভাইবােন দিয়েছে। তাকে পছন্দ করে কানাডাতে নিয়ে আসার জন্য সে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবতী মনে। করে । ঠিক একই সময় সে একটু বিষাদিতও হয় এ কথা ভেবে যে, তার মতাে কত যুদ্ধশিশু বাংলাদেশে পড়ে রয়েছে যাদের সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না। তার জীবন বৃত্তান্ত সংক্ষেপে বলতে গিয়ে আমিনা বিশ্বাস করে, উলসি ছেলেমেয়েদের একজন অহিতবিনাশী ও হিতসাধনকারী দেবদূত রয়েছেন। তাদের অসম্ভব ভালাে ভাগ্য কেননা তারা সবাই দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার জীবন থেকে উদ্ধার পেয়েছিল তাদের জন্মদেশ থেকে বেরিয়ে এসে। “আমাদের Good Samaritan-রা যারা দুস্থ মানুষের জন্য করুণাববাধ করেন এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন ছিলেন আমার মা-বাবা। তারা হাত বাড়িয়ে একজন অচেনা অসহায় শিশুকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। তার ভাই জোনাথনকে এল সালভাদর থেকে দত্তক দেয়া হয়েছিল সেটাকে ইঙ্গিত করে আমিনা কথাটি বলে) দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই তারা এটা করেছিলেন এবং আমরা তাদেরই যত্নের ফসল” (আমিনার গবেষণাপত্র, পৃঃ)।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী