You dont have javascript enabled! Please enable it!
অরুণ-সাবিত্রী -যুদ্ধশিশু
অরুণ (যুদ্ধশিশু ‘ক’)

পূর্ণগর্ভ মেয়াদ না পেরােতেই ২৭ মে ১৯৭২ এ ঢাকার শিশু ভবনে যুদ্ধশিশু ‘ক’-এর জন্ম। তখন শিশুটির ওজন ছিল ২.৪ কেজি । তিন মাস বয়সে শিশুটি আরও রােগা হয়ে যায়, ওজনও কমে গিয়ে ১৮ কেজি হয়। জানা যায় কারণ ছিল চরম অপুষ্টি। অন্যান্য যুদ্ধশিশুর মতাে একই পরিবেশে ক’-এর জন্ম। ওর মা গােপনে এসে অরুণকে অনাথ আশ্রমে প্রসব করে রেখে চলে যান। আশ্রম কর্তৃপক্ষ ছেলেটির নাম রাখেন অরুণ। নার্স ও ধাই তাকে রীতিমতাে খাওয়া দিয়ে, যত্ন করে রাখেন। দুর্ভাগ্যবশত তখন যথেষ্ট পরিমাণে গুড়াে দুধ, ফমূলা বা নিয়মিত দুধ পাওয়া যেত না। তখন সেখানে কোনাে ঔষধপত্র ছিল না। সে কারণে প্রতিদিনই যেমন শিশু জন্মগ্রহণ করছিল, তেমনি মৃত্যুবরণও করছিল । নার্সরা চালের পানি ছাড়া অন্য কোনাে খাবার শিশুদের খাওয়ানাের জন্য সরবরাহ পেতেন না।

কানাডা পৌছানাের পর ফেরিরা ছেলের নাম বদলে দেন। আমরা তাকে ‘ক’ বলে ডাকব। সে (অর্থাৎ ‘ক’) বলে, অন্টেরিওর বার্লিংটন-এ সে যখন বড় হচ্ছিল, ফেরিদের শিশু হিসেবে, তাতে অসাধারণ কোনাে উপাদান ছিল না । ওটাই একমাত্র জীবন যার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল । ‘ক’ এর ছেলেবেলার কথা যা মনে পড়ে, তার দত্তক নেয়া মা-বাবার সুখ্যতি ও সুনাম। ওর বাবা-মা দুজনেই সবার মধ্যে মাথা উঁচু দুজন মানুষ কমিউনিটিতে লােকে শ্রদ্ধাভরে তাদের মানত। ‘ক’ ফেয়ারভিউ এলিমেন্টারি স্কুল, বার্লিংটনে যেত। তারপর ভারতে দুবছরের জন্য গিয়েছিল। তার বছরগুলি প্রাথমিক থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত বেশ মজার সময়। ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে বিচিত্র সংস্কৃতির মেলা । ওর মা ওদের, অর্থাৎ ‘ক’ এবং ‘খ’কে, ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের সুযােগ করিয়ে দেবার জন্য ভারতের উত্তর প্রদেশের মুসৌরিতে বাের্ডিং স্কুল ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুলে পড়তে পাঠান।
‘দত্তক ব্যপারটি সে তখন পুরােপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। তবে তার পরিবার যে বহুজাতিক এটা সে বুঝতে পেরেছিল। আশে পাশে প্রায় সব পরিবারের সঙ্গেই এদের জানাশােনা। ‘ক’ বিশ্বাস করে যে ওর মা-বাবার উৎসাহ ছাড়া ও এত বিষয়ে জড়িত থেকে ভালাে করতে পারত না। পুনর্মিলনী, চড়ুইজাতি, বার্বিকিউ এবং খেলাধুলা যেসবে ‘ক’ খুব মজা করত, ফেরিদের বাড়িতে সেসব সাধারণ ব্যাপার ছিল। ক’ এসব মনে রেখেছে তার শৈশবের মূল্যবান স্মৃতিরূপে। উত্তর প্রদেশে আসার পরই ‘ক’ ভারতের এ বিখ্যাত জায়গাটির প্রেমে পড়ে যায়। স্কুলে সে আগের মতােই কঠোর পরিশ্রমী হয়ে ওঠে, অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে খেলাধুলায় সে খুব ভালাে করে। মুসৌরিতে সে বাংলাদেশের কিছু ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশায়ও উৎসাহ দেখায়। সে ভারতে দুবছর ছিল, ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯। তখন যদিও তার বয়স মাত্র ১৭ বছর, ‘ক’ তার পরিচিতি সম্পর্কে প্রায়ই ভাবত  ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল একরাশ প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, যেগুলাের সম্মুখীন হয়ে সে জব আবেগিকভাবে অঙ্গীভূত হওয়া বা সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্টতা এবং আন্তর্জাতিক
মানসিকভাবে আরও পরিপক্ক হয়। এ সময়টুকুতে সে প্রচুর চিন্তাভাবনা করে। সৌভাগ্যবশত সে কানাডাতে তার অবস্থানের বাস্তবতা মেনে নিয়ে সহজভাবেই এ বিষয়াদি নিয়ে। আলােচনাতে অংশগ্রহণের সুযােগ খুঁজে বের করে । সে এতে লজ্জিত হয়নি আবার গর্ববােধও করেনি। তার জন্মবৃত্তান্ত জানার পর, সে ব্যাপারটার সেখানে ইতি টানে। ওটা নিয়ে আর অতিরিক্ত কিছু জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। ক’ বলে যখনই তার মনে কোনাে প্রশ্ন জেগেছে তার মা-বাবা সে প্রশ্নের উত্তর দিতে সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন। সে নিজেকে অন্য সব ছাত্র যারা বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ ছিল, তাদের মতােই মনে করত। তার শ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের থেকে সে কখনই আলাদাবােধ না করায় বা নিজেকে সবদিক বিবেচনায় কানাডীয় হিসেবেই বড় হতে দেখেছে । স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সে। অকপটে কথাগুলাে বলে ।
‘ক’ যখন ১৭ থেকে ১৯ বছরে, সে নির্মাণ কাজে জড়িত হয়। দুস্থ ও স্বল্প আয়ের লােকের বাড়ি তৈরির প্রকল্পে ‘ক’ আট মাস কাজ করে । বেকার যাতে না থাকতে হয়, সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করে সে সম্ভাব্য কর্মীর খাতায় নাম রাখে । একই সময়ে অন্টেরিও প্রদেশের টিমিন্স শহরের কাছে উত্তর কানাডার আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা (সাধারণত ইন্ডিয়ান বির্জাভ বলে আখ্যায়িত করা হয়) শ্যাপেলােতে কয়েকটি প্রকল্পে সে স্বেচ্ছাশ্রম দেবার জন্য নাম লেখায়। সেখানে মজুরি বলতে কেবল খাওয়ার খরচটা পেত, কিন্তু তবুও সে কাজ করেছে, যে কোনাে পদে, যে কোনাে শর্তে। স্বাভাবিকভাবেই তাকে শীঘ্রই কমিউনিটির সকলের কাছে অন্য এক পরিচিতি লাভ করে। ছেলেবেলা থেকে সে বাবা-মা ও ভাইবােনদের বিপুল চ্যারিটির কাজ করতে দেখে বড় হয়েছে। ব্যক্তিগত কাজের সময়সূচি এবং স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ দুটিই, চালাতে কোনাে অসুবিধে হয়নি। কারণ ছােটবেলা থেকে সে দেখে আসছে এ ভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত তার মা-বাবা। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও তাই করেছেন।
১৯৯২ এর গ্রীষ্মকালে ‘ক’ হসপিটালিটি (অথিথিসেবা) বিষয়ে পড়াশােনা করে জীবিকা উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর সে বাড়ি ছেড়ে টরন্টো শহরে যায় জর্জ ব্রাউন কলেজে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে হলেও ‘ক’ মানিয়ে নেয় তার নতুন অবস্থান। সে বিভিন্ন রেস্তোরায় কাজ নেয় পড়ার ফাকে ফাকে কাজ করে তার আয় বাড়ানাের জন্য। সে সময়ে ডিপ্লোমা কোর্স নেবার আগে তাকে আরও কিছু কোর্স নিতে হয়েছিল মূলত তার সে সময়ের শিক্ষাগত যােগ্যতা উন্নীত করার জন্য । দেখা গেল ‘ক’ শীঘ্রই তার ভবিষ্যৎ পেশা নিয়ে মনস্থির করতে পারেনি। কোনাে পেশায় সে জীবিকার্জন করবে সেটা নিয়ে সে দোটানায় পড়ে যায় । অতঃপর কিছু চিন্তাভাবনার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় সে নার্সিং বিষয়ে পড়াশােনা করবে। সে অবগত ছিল যে সময় চলে যাচ্ছে, তাকে এগুতাে হবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে। সে সময়ে Ontario Student Assistance Program (OSAP)-এর ঋণ পরিশােধ করতে হবে বলে তাকে সবসময়ই খন্ডকালীন চাকুরি করতে হয়েছে। তাই সে সময়ে এক চাকুরি থেকে অন্য জায়গায় গিয়েছে ঘন ঘন শুধুমাত্র অতিরিক্ত কিছু টাকা রুজির জন্য। লক্ষণীয় যে ‘ক’ এমন ধরনের ছেলে যার কোনাে চাকুরি থাকা বা না থাকার কারণে আত্মমর্যাদা কখনাে খর্ব হয়নি।
 
কোনাে সন্দেহ নেই, এ ধরনের বাধা আসায় তার লাগতার শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়েছে যথেষ্ট। সে নানাকিছু ভেবে শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেয় যে তার শিক্ষার পরিকল্পনা যেমনই হােক, তাকে নিয়মিত খন্ডকালীন কাজ করে লেখাপড়ার খরচ মেটাতে হবে । তাকে স্কুলের ঋণ পরিশােধ করতেই হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে আবারাে তার পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হয়নি, পড়াশােনা বাদ দিয়ে তাকে অন্য প্রাধিকারের দাবি আগে মেটাতে হয়েছিল। কিন্তু এতকিছু স্বত্ত্বেও তার জীবনের ধারা একটুও পাল্টায়নি। সামাজিকভাবে বলতে ক’ তার বন্ধু এবং পরিচিতজনের সঙ্গে মেলামেশা বেশ সহজভাবেই করেছে। বন্ধুবান্ধবদের সবাই ছিল শ্বেতাঙ্গ । স্বভাবতই নিজেকে সে এমন জায়গায় দেখতে পায় যেখান থেকে বাংলাদেশিদের সঙ্গে তাদের একজন হিসাব মেলবার প্রশ্নই ওঠেনি তার মনে।
‘ক’ তার বাবা-মা ভাইবােন ও তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঘিরে থাকে। সে অনেকবার বলেছে একমাত্র ফেরিরাই তার বাবা-মা যাদেরকে দেখে এবং যাদের উষ্ণ আদরে সে বড় হয়েছে । এ কথাটি স্বীকার্য যে, বর্তমান যুদ্ধশিশুদের সবাই কানাডাতে লালিত পালিত হয়েছে। তাদের কানাডীয় (দত্তক নেয়া) বাবা-মায়ের বাড়িতে। সেজন্য তারা তাদের বাবা-মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ, সন্তানদের প্রতি তাদের বাবা-মায়ের অপার স্নেহ ভালােবাসার জন্য। ‘ক’ অনেকবার উল্লেখ করেছে তাদের পরিবারে ভালােবাসার কোনাে অভাব কখনাে ছিল না। সে। তার ছােটবেলার কথা স্মরণ করে বলে তার মা কখনাে বেশি রক্ষণশীল ছিলেন না; অথবা মা মুরগি তার ছানাদের যে রকম রক্ষা করে সে রকমও ছিলেন না। পরিবর্তে সে তার বাবামাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে তাদের সন্তানদের শর্তহীন ভালােবাসা দিয়ে বড় করে তােলার জন্যে। সে তার মায়ের উৎসহ উদ্দীপনাকে মুগ্ধভাবে অনুসরণ করেছে, সারাজীবন তারা একের পর এক অনাথ শিশুদের দত্তক নিয়ে লালন পালন করেছেন, শুধু অনাথ শিশু নয় যেসব অনাথ বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী সে ধরনের শিশুদেরকেও কোলে তুলে নিয়েছেন তাদের বাঁচবার সুযোেগ দেবার জন্য।
ক’-এর চরিত্রের একটি মজার দিক হলাে, বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, তার সঙ্গে বহু বাংলাদেশির আলাপ পরিচয় হয়েছে, সে তাদেরকে পছন্দ করেছে, ব্যস এ পর্যন্ত । সে যদিও কখনাে বাংলাদেশে যায়নি, তবে যুযােগ পেলে যে সে যাবে না, তা নয়। তার সাথে কথা বলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সে হয়তাে বাংলাদেশে স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ করবে। বর্তমানে ‘ক’ বার্লিংটন শহরে পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করার (recycling) এক কোম্পানিতে কাজ করে। ‘ক’ তার কাজ আনন্দের সাথে করে বলে দাবি করে। তার এখন অগণিত বন্ধু রয়েছে। সবাই শ্বেতাঙ্গ, ভারতীয় কোনাে বন্ধু নেই। ‘ক’ এর ভাষ্যমতে, কোনাে বন্ধুকেই সে খুঁজে বের করেনি। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তার বন্ধু হয়েছে। সে এখনও অবিবাহিত, সে বলে এ ব্যাপারে তাড়াহুড়াের কিছু নেই । আগে একটা স্থায়ী চাকুরি পেতে চায়, তারপর বিয়ের কথা ভাববে । সে একটু রসিকতা করে বলে এ মুহূর্তে বিয়ের ফাস গলায় পরতে তার মন চাচ্ছে না। এখন যে অবস্থায় আছে, মন্দ না – তাতেই সে সন্তুষ্ট। সে সবসময় ভাবে যদি লটারিতে একটা জ্যাকপট জিততে পারত তবে তার সব ঋণ পরিশােধ করে দিত।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!