You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ হিন্দু মহাসভা কর্তৃক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার বিরুদ্ধাচারণের জবাবে হসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
সুত্রঃ লুক ইন্টু দি মিররঃ সিরাজুল হোসেন , পৃষ্ঠা – ৯৫
তারিখঃ ৮ মে, ১৯৪৭

[অখণ্ড স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের পক্ষে এইচ এস সোহরাওয়ারদির অবস্থানের প্রতি হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধাচারোনের প্রতিবাদে প্রেস ০১১ থেকে ৮ মে, ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হোসেন সোহরাওয়ার্দীর লিখিত বিবৃতি।]
জনাব শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীসহ অন্যান্য নেতারা অখন্ড সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য আমার আহবানের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। এসব প্রতিবাদলিপিতে মুসলিম সমাজের প্রতি গভীর সন্দেহ এবং অবিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়, এছাড়াও এই মর্মে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যাতে অন্তত বাংলার একাংশে মুসলমানদের তুলনায় সংখ্যায় হিন্দুরা এত বেশি সংখ্যক থাকে যাতে তারা সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে।

গৌণ উপস্থিতি

এই স্বপ্ন তাদেরকে সকল যৌক্তিক চিন্তা ত্যাগ করার জন্য প্রলুব্ধ করছে, এবং মুসলিমদের সাথে সকল প্রকার আপোষ এবং সহযোগিতার ইচ্ছাকেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তারা এটা অনুধাবন করতে পারছেন না যে বিভক্ত ভারতের আইনসভায় তাদের এই বাংলাকে সবার পেছনে আসন দেওয়া হবে যা একটি গৌণ উপস্থিতি ছাড়া আর কিছুই না।

বিশেষত, জনাব শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী আক্রমণাত্মক উক্তি এবং অতিরঞ্জিত কূটবাক্যে প্রয়োগে নিজেকে নিম্নস্তরে নামিয়ে এনেছেন। তাঁর বাংলায় হিন্দুদের অসহায় অবস্থার এই পুনঃপুনঃ দাবী থেকে এই প্রতীয়মান হয় যে , তিনি হয়তো এই প্রসঙ্গে সমগ্র বিশ্বকে বোঝাতে চাইছেন যে বাংলার হিন্দুদের জন্য এটি দুর্ভাগ্যজনক হবে যদি বাংলা অবিভক্ত থাকে।

এমনকি তিনি বাংলায় হিন্দুদের অবস্থানকে তুলনা করেছেন নরকের সাথে, যদিও এটি এমনই একটি নরক যা প্রভূত সম্মানিত, সম্পদ, ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তিশালী, এবং যেখানে বসবাস করাকেই মুসলমানরা নিজেদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হিসাবে গণ্য করবে, এবং এরকম স্থানে বাস না করতে পারলেই বরং মুসলিমরা নিজেদের দুর্ভাগা মনে করবে।
কঠিন সত্যসমূহ
কটু এবং নিষ্ঠুর বাক্যবাণ প্রয়োগ করে কি লাভ ? আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে কি প্রাপ্তি হবে ? আমার সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, আমি যা করতে ব্যর্থ হয়েছি এবং যা করেছি তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় গিয়ে এবং বাংলার সকল দুর্ভাগ্যের জন্য আমাকে দায়ী করে কি হবে ? এতে বাস্তব অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না, বরং তা সেসব মানুষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করবে যাদের মুসলমানদের কটুবাক্য এবং ঘৃণা হজম করতে এবং প্রত্যেক মুসলিমকে খারাপ ভাবতে শেখানো হয়েছে।
তিনি এবং তাঁর মতো করে যারা ভাবছেন, তারা এই সত্যটুকু সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে, ভবিষ্যত স্বাধীন বাংলা ১৯৩৫ সালের আইন অথবা অন্য বহিঃশক্তির উপর নির্ভর করবে না। কিন্তু তাকে নির্ভর করতে হবে এর জনসাধারণের আন্তরিক সহযোগিতার উপর, যেখানে এই জনগণের মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠী এতটাই প্রভাবশালী যে এই প্রদেশে রাজনৈতিক মতপার্থক্য না থাকার কোন কারণ নেই। বর্তমান সরকার বা মন্ত্রনালয়ের যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতির অভিযোগ আনা হয়েছে তার সাথে, এবং আমার নিজের পদ এবং ব্যক্তিগত অবস্থানের সাথে বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে মিলেমিশে থাকলে যা অর্জন করতে পারবে তার কী সম্পর্ক আছে?

সাময়িক অভিমত

আমি তাদেরকে কোন কিছু দেবার কেউ না, বরং বাংলার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই গড়তে এবং পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এটি একটি অস্থায়ী মতামত, অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েই এটি স্বাধীন বাংলার ভবিষ্যৎ রূপরেখার একটি নির্দেশনা।

উপরন্তু , জনাব মূখার্জীর কি এটি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না যে বাংলা এবং ভারতের সমস্যার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে; কারণ, বাঙ্গালিরা এক জাতি এবং তাদের ভাষা অভিন্ন, তাদের অনেক বিষয়ে অভিন্নতা আছে এবং তারা একে অপরকে বুঝতে সক্ষম, আর তারা কাজ করে অভিন্ন স্বার্থে। তার মানে এই না যে ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী জনগণও একই জাতির অন্তর্ভুক্ত, একই ভাষায় কথা বলে, অভিন্ন স্বার্থ এমনকি অভিন্ন ইতিহাস বহন করে। ভারতে, এবং ভারতের বেশির ভাগ প্রদেশেই হিন্দুরা উল্লেখযোগ্যভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেখানে বাংলার মুসলিমরা অল্প ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং যুক্ত বাংলায় এই ব্যবধান আরও কমে আসবে।

বাংলার হিন্দুদের তাদের অবস্থান, মর্যাদা এবং সংখ্যার কারণে কোন বাড়তি প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ভারতের মুসলিমরা সংখ্যা এবং সম্পদের দিক থেকে নিচু অবস্থানে থাকার কারণে তাদের এ ধরনের নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে যেটা দেশভাগের মধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলার হিন্দুদের নিজস্ব ভাষা,সংস্কৃতি ,শিক্ষা ব্যবস্থা এবং স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার সুযোগ রয়েছে । কিন্তু ভারতে মুসলমানদের ভাষা এবং সাহিত্যরূপকে বিকৃত করা হচ্ছে, সেই সাথে তাদের শিক্ষাব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের পরিপূর্ণ এবং স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অধিকারকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

হিন্দুদের জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ

ভারতে এবং বেশিরভাগ প্রাদেশিক প্রশাসনে মুসলমানদের জন্য আদৌ যদি কোন বরাদ্দ থাকও তবে তার পরিমাণ অতীব নগণ্য, কিন্তু বাংলায় হিন্দুদের জন্য বরাদ্দ যথেষ্ট এবং মুসলমানদের প্রায় সমপরিমাণে। কাজেই যদি ভারতের বিভাগের লক্ষ্য হয় ভারতীয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা প্রদান, তার অর্থ এই নয় যে, বাংলার হিন্দুদের সুরক্ষা করার জন্য বাংলাও ভাগ হওয়া উচিত।

আমার এই সুস্পষ্ট বৈষম্যের ব্যাপারে নতুন করে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। জনাব মুখার্জীর মতামত অনুযায়ী দুটো বিভক্ত এলাকাই সমাধান যার একদিকে হিন্দুদের প্রাধান্য থাকবে এবং অপরদিকে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকবে। প্রকৃত সমাধান থেকে অনেক দূরে গিয়ে এই ব্যাপক সংখ্যাগত প্রাধান্য বরং সমাজে একটি অবদমিত অবস্থা সৃষ্টি করবে যা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নৈতিক মনোবলের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং জীবনপ্রণালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

আমি যে বিকল্প প্রস্তাবটি পেশ করছি, অর্থাৎ পারস্পরিক পূর্ণ সহযোগিতা যা প্রায় সমান সংখ্যার সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজ করতে বাধ্য এবং যেখানে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যালঘু অবস্থান তার প্রভাব দ্বারা ভারসাম্য পায়, সেই প্রস্তাবটি কি উভয় অংশের সংখ্যালঘুর মধ্যে একটি দমনমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেয়ে বহুলাংশে শ্রেয়তর নয়? আমার প্রস্তাবনায় যেকোন একটি দলের আগ্রাসন/শাসনের কথা উল্লেখ নেই। বাংলা প্রদেশকে কেন্দ্রের সাথে যুক্ত রাখার ইচ্ছা মূলত এই বিশ্বাস থেকে আসে বলে প্রতীয়মান হয় যে হিন্দু প্রধান কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলে বাংলার হিন্দুদের জীবন এবং সংস্কৃতি রক্ষা পাবে যা যুক্ত বাংলায় অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে।

নীতিগত দুর্বলতা

এটা কি একটা পরাজয় এবং ভয়ঙ্কর দুর্বল নীতিগত দুরবলতার পরিচয় নয় যে বাংলার হিন্দুদের তাদের নিরাপত্তার জন্য একটি দুর্বল কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানাতে হচ্ছে?
আমি তাদের কাছে জানতে চাই, অন্য কোন খানে এমন প্রভাব -প্রতিপত্তির বিস্তার লাভ কি আদৌ সম্ভব? পৃথিবীর এত জায়গার মধ্যে এই বাংলাতেই হিন্দুদের ভয় পাবার কারণ কি কিছু আছে ? প্রভাব বিস্তারের যে আশঙ্কা তা অচিরেই দূরীভূত হবে এবং ইতোমধ্যে তা হচ্ছেও। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠি যারা দীর্ঘকাল ভারত শাসন করেছে তারাও এটি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে এই ধরনের দমনের সম্ভাবনা অনেক আগেই অকার্যকর প্রমাণিত হয়ে গেছে। এবং কোন একটি জাতি বা কোন একটি দল দৃঢ়তা এবং ইচ্ছাশক্তির প্রতিরোধের মুখে কেবল একক ইচ্ছায় ক্ষমতার দাপট জাহির করতে পারেনা। যেখানে ব্রিটিশরা ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে ভারতে কি অন্য কারো সফল হবার কোন সম্ভাবনা আছে?
আমি আরো যোগ করতে চাই যে, বাংলার বেশ কিছু হিন্দু নেতা ভারতীয় হিন্দুদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করছে এবং, বাংলাভাগের অর্থ যে হিন্দু ও মুসলমানদের সমান সর্বনাশ সেটা পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করেও তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছে, ফলত তারা ভারতের অন্যান্য অংশের সে সমস্ত হিন্দু নেতাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে বাংলা বিভাগ মেনে নিচ্ছে যাদের বাংলার মানুষের ভবিষ্যতের প্রতি যাদের কোন নজর নেই।
তারা নিশ্চিতভাবে জানেন যে , যদি বাংলা বিভক্ত হয়ে যায় , তবে বাঙ্গলা ভারতের অন্যান্য প্রদশের জনগোষ্ঠীর শিকারে পরিণত হবে এবং সেইসাথে বাংলা তাদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহৃত হবে ।
এসকল কিছু বলা এবং করার পরও আমার বিবৃতির শেষ অনুচ্ছেদে আমি হুমকি দিয়েছি এই মর্মে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, অথচ যেখানে আমি কলকাতার উল্লেখ করেছিলাম কারণ আমি কেবলই বিপদগুলো চিহ্নিত করতে চেয়েছিলাম। আমি কেবল এটিই বোঝাতে চেয়েছি যে বাংলার বিভক্তির পেছনে হই হট্টগোলের মূল উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, শুধু কলকাতার মত একটি মূল্যবান পুরষ্কার হস্তগত করা এবং মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।
তবে আমিও এ বিষয়েও সমানভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি যে, এই মূল্যবান পুরস্কার এসব দম্ভোক্তির মাধ্যমে সহজে অর্জিত হবে না এবং যদি কলকাতাই বিতর্কের উৎস হয়ে যায় তাহলে আর কি বা অবশিষ্ট থাকে? বাংলার সকল অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উৎস হিসাবে বজায় থাকতে হলে, কলকাতার শান্তি এবং নিরাপত্তা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ন।
কোথাও আমি পড়েছি যে, যৌথ ভোটাধিকার এবং তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলেছি বলে কথা উঠেছে। বাংলায় জনসাধারণকে বেঁধে ফেলার মত ক্ষমতাশালী একনায়ক হয়ে আমি দায়িত্ব নেইনি। আমি এতো টুকুই পরামর্শ দিতে পারি যে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলার রূপরেখা নির্ধারনের জন্য হিন্দু এবং মুসলমান নেতাদের সরাসরি আলোচনায় বসতে হবে যদি তারা তাদের আশা-আকাংখাকে বাস্তবা রূপ দিতে চায়।
আমি এখনো সবাইকে আন্তরিক আহ্বান জানাই। আমি তাদেরকে অনুরোধ করছি, ক্রোধ ও দম্ভে অন্ধ না হয়ে বা নিজের বাঙ্গালী বন্ধুদের প্রতি ঘৃণায় নিমজ্জিত হয়ে বাংলাকে ধ্বংস করবেন না, বরং সাম্নের দিকে তাকান এবং বাংলাকে মুক্ত ও স্বাধীন করার স্বর্ণালী সুযোগটি গ্রহণ করুন, একে নিজের ভাগ্য এবং সম্পদের মালিক হতে দিন, একে স্বাধীন ইচ্ছায় যার সাথে খুশি ইউনিয়ন এবং চুক্তি করার মত সমর্থ হতে দিন, পৃথিবীর জাতিসমূহের মধ্যে সম্মানিত, ধনী, শক্তিশালী এবং সাধারণ মানুষের জন্য স্বর্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে দিন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!