You dont have javascript enabled! Please enable it!
দত্তকগ্রাহী বাবা-মা এবং যুদ্ধশিশু একটি আভরণ চিত্র
শ্রেণিবিন্যাস করলে ১৪টি দম্পতি যারা বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন, তাদের সকলেরই বয়স ছিল ৩০ এর কোঠায়, সমসত্তায় মধ্যম শ্রেণির নাগরিক, সকলেরই নিজস্বভাবে রােজগারপাতির ব্যবস্তা ছিল। কেউ কেউ একাধিক পেশার পেছনে ছুটলেও কয়েকজন আবার ঘরবাসী হােমমেকার ছিলেন। কিন্তু সবাই ছিলেন মধ্যম শ্রেণি বা মধ্যবিত্তের মনস্কতা বা মূল্যবােধের অধিকারী। কোনাে কোনাে মা খন্ডকালীন কাজকর্ম। করলেও অধিকাংশ মা ঐতিহ্যবাহী গৃহকর্মী এবং ছেলেপুলেদের প্রধান যত্নকারী ছিলেন । তাদের স্বামীরা পুরােপুরি চাকুরিজীবী অথবা ব্যবসায়ী হিসেবে অন্যা আরও দশজন সাধারণ কানাডীয়দের মতাে ছিলেন। তারা চেয়েছেন সন্তানদের মধ্যে তাদের গুণাবলি বিকশিত হােক, আত্মমর্যাদা প্রখর হােক, মূল্যবােধ ও ন্যায়নীতিবােধ জাগ্রত হােক, যাতে তারা সৎ,  দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল কানাডীয় হিসাবে যেন ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখে। দম্পতিদের মধ্যে একটি ইহুদি পরিবার ব্যতীত সবাই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন ।
দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের দুটো সাধারণ বৈশিষ্ট্য শুরুতেই উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথমত, তাদের সবাই ছিলেন ককেশীয় বংশােদ্ভূত, সন্তান উৎপাদনে কোনাে অসুবিধা ছিল না। হবু দত্তক নেয়া বাব-মা হিসাবে তাদের অনুর্বরতা নিয়ে কোনাে সমস্যা বা ঝামেলায় পড়তে হয়নি। জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবা হিসেবে স্বপ্ন দেখা বা স্বপ্নভগ্ন হওয়ার ভয় তাদের ছিল না ।
আমারা দেখতে পাবাে যে বর্তমান গ্রুপের বাবা-মায়েরা অন্যান্য দত্তক নেয়া মা-বাবা থেকে অনেকাংশে আলাদা। তাদের নিকট তাদের মূল্যবােধের প্রতি আনুগত্য এবং পরিবারের সংশ্রয় সর্বদাই প্রাধিকারের বিষয় ছিল এবং এখনও আছে। দুটি পরিবার বাদে ওদের ঔরসজাত সন্তান রয়েছে। সত্যিকারের বিচিত্র এবং আন্তর্জাতিক দত্তক প্রথার বা প্রক্রিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধানে এদের গভীর ও বিপুল আগ্রহ বর্তমান। দুটি দম্পতির বিবাহ | বিচ্ছেদ ঘটে। যে দুইজন বাবা বাড়ি ছেড়ে যান, তারা যথাযথ তাদের অর্থনৈতিক ও পারিবারিক দায়িত্ব পালন করে চলেছেন আজ অবধি। সব শ্বেতাঙ্গ পরিবার অন্তত একজন কৃষ্ণাঙ্গ, মূলাটো, কোরিয়ান, ভিয়েতনামী, কম্পােচীয়, হাইতিও, ভারতিয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি এবং কানাডীয় আদিবাসি শিশু দত্তক নেন।

প্রত্যেক বাড়িতে দত্তক শব্দটি দৈনন্দিন কেজো ভাষা ও শব্দের মতাে পরিচিত, যেহেতু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দত্তকায়নের মাধ্যমে আসা শিশুদের কাছে ওটা ছিল অত্যন্ত অতিপরিচিত শব্দ । প্রত্যেক পরিবারের ইতিহাসে উল্লেখযােগ্য সাদৃশ্য রয়েছে, মা-বাবা, বিকল্প পরিবার গঠনের ঝোকে, যেখানে কোনাে বিশেষ দেশ বা জাতিগােষ্ঠীর শিশুকে দত্তক আনার কোনাে তাগিদ নেই । ঐতিহ্য উপায়েই যে কেবল পরিবার গড়া যাবে তা নয়, অন্যভাবেও পরিবারের সম্প্রসারণ ঘটানাে যায়। এটা এজন্য তাৎপর্যপূর্ণ যে, তখনকার দিনেও গতানুগতিক দত্তক প্রথায় না গিয়েও বিকল্প পন্থায় পরিবার গড়া যেত । এখানে দেখা যাবে কীভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল ওদের সেই কাঙ্ক্ষিত শিশুদের দত্তক নিতে।

কোনাে নেতিবাচক প্রচারণা অথবা প্রতিবেদন তাদের অভীষ্ট থেকে তাদেরকে নড়াতে। পারেনি, এ ব্যাপারে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বাংলাদেশের ১৫ টি যুদ্ধশিশুর প্রথম দল, ৮টি মেয়ে শিশু এবং ৭টি ছেলে শিশু, যারা ২০ জুলাই ১৯৭২ সালে কানাডাতে আসে, তারা বাংলাদেশ সরকার অনুমােদিত প্রথম গ্রুপের যুদ্ধশিশুও বটে। বস্তুত তারা Families For Children (FFC)-এর এক দত্তক কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলশ্রুতি । এটা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যেসবের নথিপত্র কানাডীয় জাতীয় আকইিডস, International Social Service (ISS) 47€ International Planned Parenthood Federation (IPPF)-47 আর্কাইভস-এ সংরক্ষিত রয়েছে। এ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাবাে, দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের নাম পরিবর্তন করে পরবর্তী সময়ে দত্তকের আনুষ্ঠনিকতা সেরে নিজের পছন্দমতাে নাম। রেখেছেন। আরও একটু এগুলে দেখা যাবে কীভাবে কত সাবধানতার সঙ্গে দত্তকগ্রাহী মাবাবা তাদের প্রতিটি শিশুর নাম নির্বাচন করেছিলেন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমির আঙ্গিনায় তাদের নামকে “কানাডীয়করণের মাধ্যমে পরিবারের নাম (নামের শেষাংশে) যুক্ত করা বাধ্যতামূলক ছিল।
বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের মধ্যে মানবিক মূল্যবােধের উপর নির্ভরশীল এক বলিষ্ঠ। আত্মপরিচিতি বিকশিত হােক এটাই চেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি করে, তা সে তাদের বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুই হােক অথবা অন্য কোনাে দেশ থেকে আগত অনাথ হােক, তার দরকার কোথাও সংশ্লিষ্ট বা একীভূত হবার । তার সবচেয়ে বেশি দরকার একটি নিরাপদ বাড়ি এবং মমতায় জড়ানাে এক পরিবারের উষ্ণতা । ঐ শিশুদের জীবনী লেখার দিকে এক নজর। তাকালে আমরা দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের আরেক উদ্দীপক দিক সম্পর্কে জানতে পারব। নিচে দম্পতিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং তাদের বাংলাদেশি শিশুদের বিবরণ বর্ণমালার অক্ষরে ক্রমানুযায়ী দেয়া হলাে ।
টনি বুনস্ট্রা ও বনি বুনস্ট্রা বুনস্ট্রাদের জীবনালেখ্য একই সঙ্গে কৌতুহলােদ্দীপক এবং রহস্য ও নাটকীয়তায় চমকপ্রদ। টনি, হল্যান্ডের অধিবাসী আট বছর বয়সে কানাডা এসেছিলেন এবং ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় বড় হয়ে ওঠেন । অপরপক্ষে ধীরে কথা বলা উষ্ণ হৃদয়ের বনি আমেরিকায় মিশিগানের গ্র্যান্ড র্যাপিড অঞ্চলের মেয়ে । টনি যখন গ্ৰন্ড র্যাপিডস-এর ক্যালভিন কলেজে আন্ডারগ্রাজুয়েট ক্লাসের ছাত্র, তখন বনির সাথে তার পরিচিয় হয়। ১৯৬৭ সালে স্নাতক হবার পর টনি।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে তাদের সাথে থাকতে এসেছিল। সংসারের কাজকর্মে সে সাহায্যকরেছিল । ১৯৭১ এর ১ জুন তাদের তৃতীয় সন্তান লুক জন্মগ্রহণ করে।  এ সময়ে তারা মন্ট্রিয়ল ফেড ও বনি কাপুচিনাের সঙ্গে দেখা হয়, তারা তখন FFC-এর  প্রধান ছিলেন। তারা সাথে সাথে বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধশিশুদের দত্তক আনার ব্যাপারে সমর্থন  জানান। তারা ক্যাপুচিনােদর সঙ্গে যােগ দিয়ে সরকারকে লবি করতে লেগে যান । যদিও তাদের তখন তিনজন দত্তকায়িত শিশু ছিল, তারপরও তারা বাংলাদেশ থেকে আর একটি শিশু দত্তক নিতে স্থির প্রতিজ্ঞ, যাকে নিয়ে তাদের সন্তান সংখ্যা দাঁড়াবে চার-এ। যদিও তাদের আবেগী ব্যাপারটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল । শীঘ্রই দম্পতি বাংলাদেশ থেকে একটি যুদ্ধশিশু দত্তক নেবার পরিকল্পনা ছকে ফেলেন।আজও টনি ভূলতে পারেন না তিনি এবং অন্যান্য দত্তকে ইচ্ছুক দম্পতি হােমস্টডি সম্পন্ন। করানাে এবং আরও কোনাে কোনাে আনুষ্ঠানিকতার শর্ত পূরণ করার প্রক্রিয়ায় কী কষ্ট করেছিলেন। তারা আজও বুঝতে পারেননি অন্টেরিও কর্মকর্তাদের কেউ কেউ আবেদনকারীদের এরকম একটি মহৎ কাজে অর্থাৎ একটি অনাথ শিশুকে আশ্রয় দেবার প্রয়াসে, বাধা দিয়ে কী পূন্য অর্জন করেছিলেন । তাদের মনে গেঁথে রয়েছে, যেদিন অনেক। অপেক্ষার পর তাদের ছেলেকে আরও ১৪ জন যুদ্ধশিশুর সঙ্গে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। যথন তারা নিজ হাতে ছেলেকে ধারণ করেছিলেন, তখনই কেবল তারা অনেক কষ্ট ও প্রতীক্ষার পর যেন স্বস্তির আরাম পেয়েছিলেন অনেক মাস অতিবাহিত করার পর।পরের বছরে, ১৯৭৩ সালে ঐ দম্পতি ব্রায়ান নামের আট বছর বয়স্ক একটি ছেলেকে দত্তক  নেন।
তারপর আসে কারা, জন্ম অটোয়ায়, যাকে তারা ১৯৭৬ সালের জুন মাসে ৪ মাস বয়সে দত্তক নেন। পাঁচ বছর পর ১৯৮১ সালে বুনস্ট্রা দম্পতি একসাথে দুই ভাইয়ের আইনসম্মত অভিভাবক নিযুক্ত হন – একজন ছিল টড এবং আরেকজন টমি। আট বছর বুনস্ট্রা পরিবারে লালিত পালিত হয়ে তারা তাদের জন্মদাতা বাবার নিকট ফেরত যায় ।  তিন বছর পর ১৯৮৪ সালে তারা তাদের ছােট ছেলে জশুয়াকে দত্তক নেন। তার জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে । জশুয়াসহ বুনস্ট্রাদের ছেলেমেয়েদের সংখ্যা (দত্তক এবং ঔরসজাত। মিলিয়ে) ৯ এ পৌছায় যতদিন না টমি ও টড তাদের ছেড়ে ক্যালগারিতে তাদের জন্মদাতা। বাবার কাছে ফেরত যায় ১৯৮৯ সালে।তাদের সন্তানদের (সে দত্তক নেয়াই হােক বা ঔরসজাতই হােক) সম্পর্কে দম্পতি যখন কিছু বলেন, এটা তারা মাথায় রেখে বলেন যে, প্রত্যেক শিশু অনন্য। প্রত্যেকের এমন গুণ, সক্ষমতা এবং চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা বাবা-মায়েদের বুঝতে হবে, গ্রহণ করতে হবে এবং মান্য। করতে হবে। বুনস্ট্রা দম্পতিদের সাথে কয়েকবার সংলাপের পর এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে | তাদের সারাটা জীবন তারা সন্তান লালন পালনে নমনীয় থেকেছেন, অন্ততপক্ষে প্রথম দিকেতাে অবশ্যই। তাদের সাত সন্তানদের মধ্যে ক্রিস এর বেলায় বাংলাদেশি মাতৃত্ব ও পাকিস্তানি পিতৃত্ব;  আবার কারার বেলায় বাংলাদেশি মাতৃত্ব ও পিতৃত্ত বর্তমান । তফাৎ হলাে ক্রিস বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা যুদ্ধশিশু, কারার জন্ম অটোয়ায়, বাংলাদেশি পরিবারে, যে পরিবার তাকে রাখতে চায়নি। তাদের কনিষ্ঠ পুত্র জশুয়া ভ্যানকুভারে জন্ম নেয়া আদিবাসী (অ্যাবরিজিনাল), বাকিরা শ্বেতাঙ্গ কানাডীয় । অন্যান্য দত্তক নেয়া পরিবারের মতাে বুনস্ট্রারাও সত্যিকারের বহুজাতিক পবিবার যেখানে সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে মান্য করা হয়, মূল্যায়ন করা হয় – প্রত্যেক পরিবার সদস্যই এ মূল্যবােধের প্রেক্ষাপটে বুনস্ট্রারা পরিবারে বড় হয়েছে।
১৯৭৩ সালে যখন টনি অটোয়া ক্রিশ্চিয়ান স্কুলে (অটেয়া, অন্টেরিও) অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন, পরিবার তখন অটোয়ার কাছেই অ্যাশটন শহরে চলে আসেন। এসময়ে পরিবারের জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত সময় ছিল যখন বনি বড় হয়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিনরাত কর্মরত ছিলেন। তার বেশিরভাগ সময় ওদের নিয়ে কাটত। মা-বাবা হিসাবে তারা নিজেরাও পরিপক্ক হচ্ছিলেন। মা-বাবার কর্তব্য ও দায়িক্ত পালনের বহুবিধ রীতিনীতিতে তারা ক্রমশ সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। পরিবারটি একত্রে অ্যাশটনে দুবছর বাস করার পর টনি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রেসবিটেরিয়ান কলেজে হাজিরা দিতে ছুটে চলেন। বছরখানেক বনি এবং ছেলেমেয়েরা অ্যাশটনে থাকেন। সে সময় টনি থিওলজি ও ডিভিনিটি বিষয়ে অধ্যয়নে মগ্ন ছিলেন। ১৯৭৭ সালে পুরাে পরিবার কিউবেক প্রদেশের পূর্বদিকের শহরতলিস্থ স্কটটাউনে গিয়ে উঠেন। ততদিনে বনি আরও বেশি পারিবারিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বড় হয়ে ওঠা ছেলে মেয়েদের নানা ধরনের চাহিদা একক ও সম্মিলিতভাবে উপস্থাপন ও মেটানাের কাজ চলে; যেখানে পরিবার প্রধান কেবল সপ্তাহান্তে বাড়িতে উপস্থিত থাকতেন। টনি। যখন অধ্যয়ন করছিলেন, বনি তখন এককভাবেই সবগুলাে ছেলেমেয়েদের দেখাশােনা করেন।
বুনস্ট্রাদের একটি বড় গুণ ছিল যে পরিবারটি একতাবদ্ধ থেকেছে যখন টনি তিন বছর ম্যাকগিল-এ লেখাপড়া করেন। যদিও পরিবারটি ক্রমাগত এক শহর থেকে অন্যত্র গিয়েছে, বুনস্ট্রা দম্পতি এটি নিশ্চিন্ত করেছেন যে ছেলেমেয়েদের প্রয়ােজন যেন মেটে, তাদের কারাে লেখাড়ায় ফঁাক না পড়ে। ১৯৭৮ সালের গােড়ার দিকে টনি থিওলজিতে ব্যাচেলর ও ডিভিনিটিতে মাষ্টারস শেষ করেন। তার সাথে সাথেই কার্লটন প্লেইস-এ সেইন্ট এনড্রিউজ প্রেসবিটেরিয়ান চার্চে ১৯৭৮-এ পুরােহিতরূপে অভিষিক্ত হন। তার ডিগ্রিপ্রাপ্তি এবং যাযকবৃত্তিতে বরনের অনুষ্ঠানের পরই টনি ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ, পার্কসভিল, ভ্যানুকভার আয়লান্ডে মিনিস্টার নিযুক্ত হন। আট বছর ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় বসবাস করার পর আরেকবার স্থানান্তরিত হবার সময় হয় ১৯৮৭ সালে যখন টনি সেইন্ট এ্যান্ট্রিউজ প্রেসবিটেরিয়ান চার্চে মিনিস্টার হবার ডাক পেলেন। এটা এলবার্টা প্রদেশের এডমন্টন শহরের এর এক ইনার সিটি চার্চ। এবারও কানাডার পশ্চিম থেকে কিছুটা পূর্বে ভ্রমণ করেন পুরাে বুনস্ট্রা পরিবার। নতুন শহরে এসেই তাদের প্রথম কাজ ছিল ছেলেমেয়েদের স্কুল ও কলেজে ভর্তি করানাে এবং খেলাধুলায় নিয়ােজিত রাখা।
১৯৮০ এর দশকের শেষে বুনস্ট্রা ছেলেমেয়েরা কেবল লেখাপড়া নয়, অনেকে খন্ডকালীন কাজেও লেগে যায়। বিভিন্ন মৌসুমি খেলাধুলায় ব্যস্ত। কোনাে কোনাে ছেলেমেয়ে বসবাসের জায়গায় নানা পেশাদারি কাজে লেগে পড়ে। এডমন্টনে আট বছর বাস করার পর ১৯৯৪ সালে বুনস্ট্রা পরিবার অন্টেরিওর রিচমন্ড শহরে চাকরি নিয়ে আসেন। রিচমন্ড অটোয়ার শহরতলি এলাকা। এবারও টনি সেইন্ট এনড্রিউজ প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ এর মিনিস্টার । রিচমন্ডে আসার কিছুদিন পরেই বুনস্ট্রা পরিবারের বড় ছেলেমেয়েরা অটোয়া ও অন্যান্য শহরে তাদের যার যার পেশার কাজে যােগ দেয়। যারা বাড়ি ছেড়ে গেল, তারা মা-বাবা ও অন্যান্য ভাইবােনদের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রাখে ।
উদার প্রকৃতির বুনস্ট্রা মা-বাবা ও ছেলেমেয়েদের পছন্দমত কাজকর্ম করতে দিতেন। বস্ত তপক্ষে বুনস্ট্রা দম্পতিরা এতই মুক্তমনা যে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের এক ধরনের স্বাধীনতা দিতেন তাদের বয়স ও পরিপক্কতা অনুযায়ী । আরেকটি লক্ষণীয় দিক যে যদিও দম্পতি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, তারা কখনাে নিজেদের বিশ্বাস ছেলেমেয়েদের ওপর চাপাননি। ছেলেমেয়েদের শেখানাে হয়েছিল, তারা যেন দয়া, ভালােবাসা, সহানুভূতি ও মায়ামমতার চর্চা। বজায় রাখে একে অন্যের খোজ খবর রাখে। বুনস্ট্রা পরিবার আন্তরিকভাবে নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছেন যে, তারা যা বলবে, তাই করবেঃ যেমন, অন্যের প্রতি শদ্ধা, ভালােবাসা এবং ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা, ভােলামন, ইত্যাদি। আমরা এ অধ্যায়ে অন্যান্য দম্পতিদের মধ্যেও দেখব যে এসব দত্তকগ্রাহী পরিবার অন্যান্য কানাডীয় বহুসাংস্কৃতিকতা, বহুজাতীয়তাবাদ ও প্রশস্ততর সামাজিক মূল্যবােধের সমর্থক।
বুনা ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে বলতে গেলে উভয় ধরনের সন্তানদের (ঔরসজাত এবং দত্তকায়নের মাধ্যমে আনা) পরিবারে সব বড় হয়েছে যেখানে কখনাে মা-বাবার আদরভালােবাসার কোনাে অভাব ছিল না। যেহেতু বহুত্বের (পুরলিজম) ধ্বজাধারী এবং বৈচিত্রকে মূল্য দিতে অভ্যস্ত, নানা জাতের মানুষের মধ্যে মেলামেশাকে উৎসাহিত করা ও সমর্থনদানের প্রক্রিয়ায় ছেলেমেয়েরা শৈশব থেকেই এসব চর্চায় সহজ হয়ে উঠেছে। মা-বাবার অশেষ প্রচেষ্টায়, ছেলেমেয়েদের জাতিগােষ্ঠীর ভিন্নতা সত্ত্বেও সকল বুনস্ট্রা ছেলেমেয়েরা শিখেছিল কীভাবে অন্যকে ভালােবাসতে হয়, বন্ধুত্ব করতে হয় । খুব ছােট বয়সেই ওদের মা-বাবা সে গুনাবলি ওদের মধ্যে চাপিয়ে দিতে পেরেছিলেন ।
বুনস্ট্রারা তাদের ছেলেমেয়েদের দত্তক নেয়া এবং পরিত্যাগ করার অর্থ ও গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। অল্প বয়স থেকেই সব বিষয়ে সবাইকে ঢাক-ঢােল পিটিয়ে না বলার প্রয়ােজন সম্পর্কেও বুঝিয়েছেন। গােপনীয়তার তাৎপর্য কী সেটা শেখানাের চেষ্টা করেছেন। ফলে ছেলেমেয়েরা যখন বড় হয়, দত্তক নেবার বিভিন্ন ঘটনা বিষয়ে শুনে এবং জেনে তাদের মনেও দত্তক বিষয়ে কেন এবং কীভাবে সম্পন্ন হয়েছিল সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের ঢেউ উটেছিল। টনি। বলেন এখনও তার মনে আছে তাদের ছেলেমেয়েরা দ্বিধা না করে প্রশ্ন করেছে অনেক সময় । মা-বাবার উত্তর শুনে তারা মােটামুটিভাবে সস্তুষ্ট ছিল। বাবা-মা ধৈর্য্য ধরে তাদের প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তরের জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনে ছেলেমেয়েরা কখনাে উপেক্ষা। করেননি।
বুনস্ট্রা দম্পতি প্রতিটি সন্তানের বিষয়ে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সেগুলাে তারা আগ্রহ নিয়ে দেখেছে । আরও বেশি জানতে যারা আগ্রহী হয়েছে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর পারিবারিক তথ্য ভান্ডার ঘাটার অনুমােদন পেয়েছে। বনি নানা কাজের মধ্যেও সেসব তথ্যাদি অত্যন্ত যত্নসহকারে গুছিয়ে রেখেছিলেন তাদের সন্তানদের জন্য। এক অর্থে ওই তথ্য ভান্ডার, যেটাকে তারা বুনস্ট্রা ফাইল বলে থাকেন, সেটা একটি ক্ষুদ্রায়তন পারিবারিক আর্কাইভস যেখানে নানা ধরনের ছবি, চিঠিপত্র, জন্ম সনদপত্র, হােমস্টাডি অনুমােদনের চিঠি, দত্তক। সংক্রান্ত নথি এবং খবরের কাগজের কাটিং রয়েছে।
যতদূর বনির স্মরণে আছে, তাদের ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ তাদের অতীত অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, আবার কেউ কেউ কোনাে উৎসাহ দেখায়নি। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কেউ কেউ তাদের বাবা-মায়ের গ্রন্থাগার বা আর্কাইভস-এ ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছে। তাদের মা-বাবার কথা হলাে, তারা জ্ঞাতব্য বিষয় সম্পর্কে যা জানতেন, সেটা দায়িত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করেছেন, স্বচ্ছ থেকেছেন, “কেন এবং কীভাবে দত্তকায়ন হয়েছিল সেসব প্রশ্নের উত্তর গুছিয়েছেন। এখন ঐ টুকরাে তথ্য নিয়ে কাজ করে, খোঁড়াখুঁড়ি করলে, তারা উৎসাহভরে বলেছেন, “মিলিলেও মিলিতে পারে অরূপ রতন।”
বুনস্ট্রা দম্পতিদের নীড় এখন একদম শূন্য – তাদের আদরের পাখিগুলাে যেন উড়ে চলে গিয়েছে নিজ নিজ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। অ্যাশটনের বাড়িতে শুধু টনি ও বনি বাস করছেন। তারা সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ যে তিনি এসব সন্তানসন্ততি দিয়েছেন। তাদেরকে । তাদের ভুলভ্রান্তি বাবা-মা ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখেছেন যখন তারা বেড়ে উঠছিল। তারা জীবনের প্রথম ভাগেই বুঝেছিলেন যে প্রত্যেকটি শিশু অনেকগুলাে মানবিক চরিত্রের সমষ্টি এবং এর মধ্যে রয়েছে নানা গুণাবলী বিকাশের ধাপ বা মাত্রাবিন্যাস। বর্তমানে বুনস্ট্রা দম্পতি বলতে গেলে বেশ পরিতৃপ্ত শুধু এটুকু ভেবে যে তাদের ছেলেমেয়েদের স্নেহ আদরে বড় করার পরে তাদের প্রতি বাবা-মায়ের পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে যাদের সবাই এখনও স্বেচ্ছাচালিত, স্বনির্ভর।
আজ বুনস্ট্রাদের ৯ জন নাতি-নাতনি সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রায়ই বুনস্ট্রারা পারিবারিক মিলনমেলার আয়ােজন করেন। তখন সবাই মিলে সুন্দর সময় কাটাবার সুযােগ ঘটে । বনির সঙ্গে উলসি দম্পতিদের যােগাযােগ রয়েছে। ২০১০ সালে বনি ক্রিসকে নিয়ে বাংলাদেশি পুনর্মিলনীতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের খুব আমােদ হয়েছিল। যুদ্ধশিশুদের ব্যাপারে ক্রিসের আগের চেয়েও উৎসাহ বেশি, জানা গেল ।
ওমর
২৯ এপ্রিল ১৯৭২ সালে ঢাকায় জন্ম, বাংলাদেশে মাদার তেরেসার শিশু ভবনে। তখন তার নাম দেয়া হয়েছিল ওমর, জন্ম ওজন ছিল ২.৫ কেজি। আড়াই মাস বয়সে যখন কানাডাতে আসে, তখন তার ওজন ছিল ২.৭ কেজি। ছয় সপ্তাহে মাত্র ০.২ কেজি বেড়েছিল। কয়েকদিন। পর যখন ওর মা-বাবা এক বিপনি কেন্দ্রের পরিচিত স্টোর সিয়ার্স-এ ওর ছবি তােলার জন্য ওকে নিয়ে গেলেন ও দেখতে তখনও নবজাতকে মতাে। টনির মনে আছে সে তখন বড়দের মতাে খুব হাসত । বনি বলেন, “আশেপাশের মানুষ ওকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছিল। এতটুকু মানুষের এতবড় হাসি, তখন ওরাও হাসত।। মেয়াদের আগে জন্মগ্রহণ করা অন্যান্য যুদ্ধশিশুর মতােই এ শিশুটিও এত দুর্বল স্বাস্থের ছিল। যে, যারা ওর যত্ন নিতেন, তারা কেবল ভয় পেতেন যে ও বাঁচবে না শেষ পর্যন্ত । ভাগ্যক্রমে সে খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করতে শুরু করে। অবশ্য যে কানাডীয় ডাক্তার তাকে ঢাকায় স্বাস্থ পরীক্ষা করে বাছাই করেছিলেন তার মনে হয়েছিল যে দুর্বল হলেও শিশুটি বেঁচে যাবে। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় টিকে যাওয়াতে ওমরকে বেছে নেয়া হয়েছিল দত্তকের জন্য। তাই অন্যান্য শিশুদের সাথে ওমরও ক্যানাডা আসার সুযােগ পায় । আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তক ক্রিয়া সম্পাদনের সময় তার বাবা-মা তার নামকরণ করেন ক্রিস্টোফার ওমর বুনস্ট্রা নামে।
একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭৬ এর সেপ্টেম্বরে বুনস্ট্রা পরিবার কিউবেক এর স্কটটাউন শহরে জায়গা বদল করেন। ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি হয় যেহেতু তারা কিউবেক এর স্থায়ী বাসিন্দা নন। ক্রিস ছাড়া অন্য ছেলেমেয়েদের প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র ছিল। তাই ওরা ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছিল। ঐ প্রদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অভিমত ছিল যে কিউবেকের ছেলেমেয়েরা ফরাসি ভাষার মাধ্যমে পড়াশােনা করবে। যেহেতু বুনস্ট্রা পরিবার ইংরেজি ভাষাভাষী এবং তারা অস্থায়ীভাবে কিউবেক-এ বাস করছিলেন, তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুলে যেতে দেয়া হলাে এক শর্তেঃ ছেলেমেয়েদের যথাযথ জন্ম সনদপত্র জমা দিতে হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে ক্রিস-এর জন্ম। সনদপত্র বলতে কোনাে পাকা কাগজ ছিল না। এমনকি তার জন্মদাত্রী ও জন্মদাতা মা-বাবার নাম, তাদের নাগরিকত্ব এবং মাতৃভাষা সম্পর্কে কোনাে সংশ্লিষ্ট তথ্যই ছিল না । বস্তুতপক্ষে আমরা অন্যান্য অধ্যায়গুলােতে দেখেছি হাতে লেখা একটা জন্ম সনদপত্র । যে শিশুকে দত্তক নেয়া হয়েছিল তাকে বিমানে করে কানাডাতে নিয়ে আসা হয়েছিল ঢাকাস্থ মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার মার্গারেট ম্যারির স্বাক্ষরিত কাগজের ওপর ভরসা করে । তার জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার নাম-ঠিকানা নেই। যদিও সে দত্তকের মাধ্যমে ইতােমধ্যে বুনস্ট্রা দম্পতির ছেলে । কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ অন্যকিছু বিবেচনা করতে রাজি নন। তখনকার মতাে ক্রিসকে একটি ফরাসি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করাতে হয়। যদিও তার পােষ্য। বাবা-মা ইংরেজি ভাষাভাষী। ক্রিসকে স্কুলে ভর্তি করাতে দম্পতির যে কষ্ট করতে হয়েছিল সেটা তারা এখনও মনে রেখেছেন, ভুলতে পারেননি। তাদেরকে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছিল সেটার জন্য টনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও অসন্তোষ্ট হয়েছিলেন। কারণ যা হােক, ক্রিস কোনােদিনই ফরাসি ভাষা শিখে উঠতে পারেনি। বুনস্ট্রাদের সাতটি ছেলেমেয়েদের জন্য কেবল ক্রিসকেই ওরকম দুর্ভোগ পােহাতে হয়েছে। অথচ তার নিজের কোনাে দোষ ছিল না । ওর জন্ম সনদপত্র না থাকা কিংবা ফরাসি ভাষার প্রতি ভালােবাসা না জন্মানাের জন্য। কিউবেক স্কুল কর্তৃপক্ষের মতে, ক্রিসের জন্ম সনদপত্রটি যথাযথ নয়।”
ক্রিস ঘটনাচক্রের শিকার হয়েছিল, বনি কথাটি এক উত্তরে স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন । স্কটটাউন স্কুলে যেতে আরম্ভ করলে ক্রিস একের পর এক বাধার সম্মুখীন হয়, যাতে তার মাবাবার মনে হতাশা ও দুঃখ জমা হতে থাকে। এই দম্পতি পুরনাে কথা মনে করে বলতে গিয়ে একটু একটু তাদের চেপে রাখা অসন্তোষের বাষ্প বেরিয়ে যেতে লাগে । যদিও ক্রিসকে। ফরাসি মাধমে স্কুলে না দিয়ে উপায় ছিল না, তাতে কিন্তু ক্রিসের উপকারের চেয়ে অপকার হয়েছে বেশি। ”ক্রিস তার বয়সের তুলনায় এত রােগা যে, সে দর্শনীয় তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছিল । সে মাঝে মাঝে সে স্কুলের ডেস্কের নিচে লুকিয়ে স্কুলের সময়টা পার করে দিত” । যেহেতু ক্রিসের মা-বাবা ইংরেজি বলতেন, সে স্বভাবতই বাড়িতে ইংরেজি প্রথম ভাষা হিসাবে শিখেছে । কাজেই ইংরেজি ভাষা দ্রুত শিখতে পেরে, অপরিচিত ফরাসি ভাষা শিখতে একেবােরই পিছিয়ে পড়েছিল। ফলে স্কুলে সময়ের অনেক অপব্যবহার হয়েছিল। “আমার মনে হয় ঐ একটা বছর তার জন্য পুরাে সময়টা নষ্ট হয়েছে। টনি রাগান্বিত স্বরে। কথাটি লেখককে ই-মেইলে লিখেন। এই দম্পতির জন্য আরও অসন্তোষের কথা হলােঃ ক্রিসের যে কিউবেক-এ স্কুলের এক বছর। নষ্ট হলাে, শুধু তা নয়, ভ্যানকুভার দ্বীপে যখন পরিবার বাস করবার জন্য গেলেন, তখন । পরিবারের সকলেই আশ্চর্য ও আহত হয়েছিলেন ক্রিসকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি। করতে হয়েছিল বলে ।
ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক চিন্তিত হয়ে অনেকগুলাে পরীক্ষার পর বুঝতে । পারেন যে “ক্রিসের কিডনি থেকে মূত্রনালির পথে কিছুটা আটকে যাচ্ছে।” দম্পতি শিউরে উঠেন এটা ভেবে যে, যদি কোনাে জটিল ব্যাধি হয়! “যদি টের না পাওয়া যেত, তাহলে ক্রিস বােধ হয় একটি কিডনি হারিয়ে ফেলত, তার মা বলেন। চিকিৎসার পর ক্রিস এবার। পুরােপুরিভাবে সুস্থ হয়ে ওঠে। লেখাপড়া ও খেলাধুলায় আগের মতাে ঠিক জায়গায় ফিরে আসে। পরবর্তী বছরগুলাে ক্রিসের জন্য অন্যরকম শুরু হতে লাগে, যখন সে লেখাপড়ায় আগ্রহ হারাতে শুরু করে । আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া তার আর ভালাে লাগছিল না, সে খােলাখুলি জানায় যে আনুষ্ঠানিক বিদ্যার্জন সে কখনাে পছন্দ করেনি । আগ্রহ না থাকলেও তাকে স্কুলে। পড়তে হয়েছে। পরিবার যখন এডমন্টনে এলাে, ইস্টউড কমিউনিটি স্কুলে গ্রেইড ৬ থেকে গ্রেইড ৮ শেষ করতে গেল। তারপর সে ভিক্টোরিয়া কম্পােজিট হাই স্কুলে ফাইনাল হাই স্কুল ডিপ্লোমার জন্য যায় । “স্কুল এবং পরিবেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই আমার ভালাে লাগেনি,” বলে ক্রিস । আশ্চর্য হবার কিছু নেই, অতঃপর ক্রিস হাই স্কুল ছেড়ে দেয় তার বয়সী অন্যান্য। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের মতাে। বুনস্ট্রা পরিবার ক্রিসের লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়াতে আশাহত হয়েছিলেন। কিন্তু বাবা-মা অন্যান্য বাবা-মায়ের মতাে তাদের ছেলের সঙ্গে রাগারাগি করেননি। তার বাবা-মা তাকে কিছু বলার আগে দশবার চিন্তাভাবনা করতেন, একান্ত আবশ্যক না হলে কখনাে গালমন্দ করতেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের কোনাে। ছেলেমেয়ের সঙ্গে রাগারাগি করতেনই না । ক্রিসের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের মা-বাবা তাদের সর্বদাই একটু সমীহ করতেন। পড়াশােনা ছেড়ে ক্রিস একের পর এক ছুটকো ছাটকা কাজ, সামনে যা আসে তাই করেছে। সামনে কী হয় এখন, দেখা যাক ক্রিস কী বলে?
প্রথম কিছুদিন কাজের সুযােগ হয়েছিল এডমন্টন শহরের নানা রেস্তোরায়, যেমন- বুলউঙ্কল। ফ্যামিলি ফুড, বনি ডুন শপিং সেন্টার, গ্রান্ড লিজ বেকারি, ইটিং প্লেস এবং কিংসওয়ে গার্ডেন। মলের নিউ ইয়র্ক ফ্রাইস-এ। গেল বছরগুলিতে গ্রীষ্মকালে ক্যানাউইন, প্রেসবিটারিয়ান সামার ক্যাম্প, সিলভার লেইক, অ্যালবাটায় কাজ করে । কয়েক বছর কাজ করে সে ক্যাম্পের বাবুর্চি হয় । অল্প বয়সে কাজে ঢুকে সে ছুটি না নিয়ে মন দিয়ে কাজ করে। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সে পর্যন্ত এসব কাজ করেছে। ক্রিস বলে সে নিজে অনুভব করে যে, জীবনের অভিজ্ঞতা দেখে বাস্তব বিশ্বের পরিচয় পেয়ে সে জীবন রােধে ঋদ্ধ হয়েছে। কাজ করতে করতে ব্যবসা ও চাকুরি জীবনের কৌশল আয়ত্ত হয়ে যায় ।
বিগত বছরগুলােতে সে নানারকম পদে কাজ করেছে । পূর্ণ সময়ের জন্য তাে বটে, আবার খন্ডকালীন কাজও করেছে। বাসবয় থেকে প্রধান বাবুর্চি পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালে সে সহকারী বাবুর্চি নিযুক্ত হয় গ্রেইসফিল্ড ক্যাম্প এন্ড কনফারেন্স সেন্টারে, গ্রেইসফিল্ড কিউবেক-এ । সিলভান লেইক এর অন্যান্য ক্যনাউইন ক্যাম্প-এর মতাে এ ক্যাম্পও একটি প্রেসবিটোরিয়ান ক্যাম্প, যার পরিচালক এবং মালিক ক্রিসকে বিশেষভাবে পছন্দ করতেন । ক্রিসও তাদেরকে পছন্দ করত । ক্রিসের দক্ষতার মধ্যে বিশেষ একটি হলাে সে নিমিষেই লজ্জার বা মৌনতার ভাব কাটিয়ে যে কোনাে পরিবেশে যে কারাে সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করে ফেলতে পারে। তার আত্মবিশ্বাস তাকে যে কোনাে পরিবেশে সহজে একজন কাজের মানুষ হয়ে উঠতে কেউ বা কিছু আটকাতে পারে না।
এ ক্যম্পে ক্রিস ক্যাম্প পরিচালকের কন্যা লিন্ডা হার্বারট এর সাথে পরিচিত হয়। এখানেই সে তার হবু স্ত্রী লিন্ডার সাথে রােমান্স এবং ভালােবাসার পর অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার বিভিন্ন পর্যায় পার হয়। লিন্ডার মার বাড়ি আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে এবং বাবার বাড়ি ইংল্যান্ড । বহুদিন হলাে তারা কানাডাতে। ১৯৯৭ সালে ক্রিসের বাগদান হয়। ১৯৯৯ এ বড়সড় বিয়ের পার্টিরও পরিকল্পনা চলতে থাকে । ক্রিস স্বপ্ন দেখে বিবাহিত জীবনের । পেছনের বছরগুলাের দিকে তাকিয়ে টনি বলেন, তার ছেলের বিয়ের দিনটি পরিবারের সবার জন্য উত্তেজনাকর ছিল বটে! অল্পদিনের মধ্যে গ্রেইসফিল্ড ক্যাম্পে ক্রিস সহকারী বাবুর্চি থেকে হেড বাবুর্চি এর পদে প্রমােশন পায়। পদোন্নতির সঙ্গে কাজের দায়িত্ব যে বেড়ে যায় ক্রিস সেটা সাথে সাথে উপলব্ধি করে। সে কাজে ব্যস্ত থাকে, কাঁধে ক্যাম্পের জোয়াল । ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে তাকে খুব কর্মব্যস্ত থাকতে হয়, বাবা-মাকে দেখতে যাওয়ার বিশেষ সময় হয়নি। ভাবনাচিন্তা করে ক্রিস তার পছন্দের চাকুরিটি ছেড়ে দেয়। ১৯৯৮-এর হেমন্তকাল নাগাদ ক্রিস আবার অটোয়াতে ফিরে আসে, বাগদত্তা লিভাকে নিয়ে। নিপিয়ান, অন্টেরিওতে তারা একটি অ্যাপার্টমেন্ট নেয়। সে তখন কাজ নেয় ওয়েডিজ ফাস্টফুড রেস্তোরাতে। স্বভাবে একগুয়ে ক্রিস কিছু অসুবিধার জন্য নতুন পরিবেশে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও অদম্য শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আবার জীবন গড়তে লেগে যায়। বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ক্রিস চারিদিক যাচাই করে বুঝতে পারে যে ভালাে একটি কাজ যােগাড় করা হঠাৎ করে হয়ে উঠবে না। এ ধরনের কাজ করতে গিয়ে ক্রিস দেখতে পায় যে প্রায়ই সেসব কাজ বেশিদিন করা যায় না, কোনাে না কোনােভাবে কাজ থেকে ছাটাই হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিল, সে বৃত্তাকারে ঘুরে মরছে, কোথাও আসলে এগুচ্ছে না। কিছুটা হতাশবােধ মনে করলেও সে চেষ্টা চালিয়ে যায় । সে কখনাে চেষ্টা ছেড়ে দেয়নি বা পরিত্যাগ করেনি। সে এমন প্রকৃতির ছেলে যে সবসময় সাহসের সাথে বিপদ মােকাবিলা করায় প্রস্তুত। সে তার অভিজ্ঞতার ওয়গাগুলােতে মনের মতাে কাজ খুঁজতে থাকে ঠিকই । মাঝে মাঝে আশা কুহকিনী তাকে আধাে ঝলক আলাে দেখাচ্ছিল বৈকি!
সাময়িক অসুবিধা থাকলেও তার রান্না ও পাকপ্রণালি বিষয়ে যেহেতু আগ্রহ, ঐ ক্ষেত্রে সে ভবিষ্যতে ভালাে করবে সে বিষয়ে ক্রিস নিশ্চিত ছিল। নানা বিকল্প পন্থার কথা ভেবে সে এবং তার বাগদত্তা স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা স্কুলে ফিরবে । বিশেষ করে সামনে বিপুল খরচপত্রের কথা ভেবে সে কথাটি মাথায় রেখে তারা তাদের অবস্থানের মূল্যায়ন করে। ততদিনে লিন্ডা অটোয়াতে অ্যালাগনকুইন কলেজ অব আর্টস এন্ড টেকনােলজিতে বেকারির বিশেষ কোর্স নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আরম্ভ করে। ক্রিস একই কলেজের রান্নাবান্না সম্পর্কিত বিষয়ে দুবছরের ডিপ্লোমা করবে ঠিক করে । শেষ পর্যন্ত ওরা দুজনের কারাের জন্যই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৯৯ সালে পা দিতে না দিতেই লিন্ডা এবং ক্রিস তাদের জমজমাট বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়ােজনে তৈরি হতে লাগে। বিবাহ অনুষ্ঠান গ্রেইসফিল্ড ক্যাম্পে উদযাপন করা হয় । বহুদিন যাবৎ ক্যাম্পে কাজ করে আসছে তাদের প্রায় সবাই আমন্ত্রিত ছিলেন। বহিরাঙ্গনে ক্যাম্পের সুন্দর পরিবেশে লম্বা পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে কাঠের বেঞ্চি পেতে, সামনে লেকের টলটলে জল। ক্রিসের বাবা টনি নিজেই বিবাহ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। বিয়ের পর সে ক্যাম্পে এক সন্ধ্যার খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল; সে সাথে বিয়ের উৎসবও উদযাপন হয়েছিল।
ব্যক্তিগতভাবে ক্রিস আবেগের সংগীত খুব ভালােবাসে। কাজ ও পরিবারের বাইরে ক্রিস সংগীতের প্রতি টান অনুভব করে একদম ছােটবেলা থেকেই। ক্রিস নিজে অনেকবারই বলেছে যে সংগীত তার জন্য অপার আনন্দের উৎস। বড় হয়ে ওঠার সময় ক্রিস নিয়মিত সংগীত বাজিয়ে শ্রোতাদের মনােরঞ্জন করত। বাড়ি ছেড়ে যাবার পরও সে সুযােগ পেলেই সংগীতবাদ্যে অংশগ্রহণ করে সকলের আনন্দ বিধান করত। ওর মা-বাবা বলেন, কাজের চাপে ক্রিস অত্যন্ত ক্লান্ত থাকলেও সংগীতের জন্য সময় ও শক্তি বের করেনিত।
শিখা, রুফিয়া রিজা, মার্টিন এবং অন্য আরও যুদ্ধশিশু যারা ১৯৭২ সালে একসঙ্গে কানাডাতে এসেছিল, ওদের মধ্যে ক্রিসও নিজের জন্মবৃত্তান্ত ও পরিবার সম্পর্কে কোনাে আগ্রহ দেখায়নি। সে কোনাে কুণ্ঠাবােধ না করে বলে যে, অনুপস্থিত বাবা সম্পর্কে তার কোনাে আগ্রহ নেই। স্মৃতিচারণের সময় সে বলে যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তার মা-বাবার কাছে শুনেছিল তার জন্মদাত্রী মা এবং তার অনুমিত বাবা সম্পর্কে কোনাে নথিপত্র বাংলাদেশে বা কানাডাতে কোথাও নেই। ক্রিস এ সত্যকে গ্রহণ করে মােটামুটিভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে তার জন্মসংক্রান্ত সকল অনুসন্ধান বৃথা হবে। অথবা যে মা তাকে জন্মকালে পরিত্যাগ করেছিলেন। তার সম্পর্কেও সে কিছু জানতে চায় না। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার আগ্রহের অভাব বিষয়ে সে কিছু বলেনি। তার একশ একটা কারণ থাকতে পারে অবশ্যই। হয়তাে কানাডাতে ক্রিসের সবচেয়ে অশান্তির ব্যাপারটা তার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও কানাডীয় নাগরিকত্ব নিয়ে, যা তার সাথের অন্য কোন যুদ্ধশিশুদের বেলায় ঘটেনি। যে দেশ তাকে জন্মের পর রাখতে চায়নি, সে। দেশের প্রতি তার অনাগ্রহ আরও বেশি থাকতে পারে। আমরা দেখতে পাবাে অন্যান্য যুদ্ধশিশুও তাদের জন্মবৃত্তান্ত খুঁজতে বা নতুন তথ্য জানতে অনাগ্রহী । কিন্তু তাদের কারােরই জন্ম নিয়ে কোনাে ধরনের সমস্যা হয়নি যদিও প্রত্যেকটি জন্ম সনদের উৎস এবং তথ্য এক। ক্রিসের সনদ ছাড়া একই আশ্রমে দেয়া কাগজপত্র অন্যান্যদের ব্যাপারে যথেষ্ট বিবেচিত। হয়েছিল ।
কেবল ক্রিসের বেলায় কিছু অভিবাসন কর্মকতা তার জন্ম সনদপত্রে সন্তুষ্ট হননি। যেহেতু ক্রিস কানাডাতে বড় হয়েছে একদিক দিয়ে বলা যায় যে সে কানাডীয়; আবার অন্যদিক দিয়ে বলা যায় যে সে কানাডীয় নয়। ক্রিসের নাগরিকত্ব লাভের জন্য জমা দেয়া আবেদন পত্র ফেরত দেয়া হয়। এ কারণে ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়ের কাছে তার বাংলাদেশি জন্ম সনদপত্র গ্রহণযােগ্য ছিল না নাগরিকতা বিবেচনার জন্য । বুনস্ট্রা পরিবার অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন যখন নাগরিকত্ব ও অভিবাসন কানাডা কর্তৃপক্ষ ক্রিসের কাগজপত্র ফিরিয়ে দিয়েছিল নথিপত্রের অভাবে । এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, আজও ক্রিস কানাডীয় নাগরিকত্ব পায়নি। যদিও সে আজ চল্লিশ বছরের ওপর কানাডায় বসবাস করছে । এতসব কিছুর পরও ক্রিস আনন্দে থাকে, তার বাবা-মায়ের প্রতি সে কৃতজ্ঞ যে আজ সে যেখানে পৌঁছেছে সেটা তার বাবা-মায়ের জন্যই হয়েছে। কারণ তারা সবসময় তার সাথে রয়েছেন। অতীত অনুসন্ধানে আগ্রহ না দেখিয়ে নিজেকে ভাগ্যবান বিবেচনা করে স্নেহশীল ও যত্নকারী দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে পেয়েছে বলে । সে কখনাে অনুভব করে না যে তার জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে যা জানে তার চেয়ে বেশি জানার কোনাে প্রয়ােজন আছে ।
আমরা সপ্তম অধ্যায়ে দেখৰ, কানাডাতে বড় হওয়া প্রত্যেক যুদ্ধশিশুই তাকে কানাডীয় হিসাবে দেখে, যা তাদের নিজস্ব ভাষায়, “বাংলাদেশে জন্মানাে কানাডীয়।” ক্রিস অবশ্যই অবগত যে জাতিগত বিচারে সে তার কানাডীয় শ্বেতকায় বাবা-মা থেকে আলাদা। শুধু তাই নয়, সে জানে তার জন্ম বাংলাদেশে অচেনা বাবার ঔরসে বাঙালি মায়ের গর্ভে । কিন্তু এ সত্য তাকে তার কানাডীয় বাবা-মা, ভাইবােন আত্মীয়স্বজন ও তার বাড়ি থেকে তাকে পৃথক করে দিতে পারেনি। বাস্তববাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী ক্রিস পরিবারের সকলের ভালােবাসায় সিক্ত হয়ে এতকিছুর পরও অতীতের হাড় জ্বালানাে ব্যথা মনে রাখেনি। স্কুলে পড়রকালীন যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কানাডীয় নাগরিকত্বে পাবার যে হয়রানি, সেসব যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছে। তাদের ১৪ বছরের মেয়ে ক্রিসচিয়ানকে নিয়ে ক্রিস ও লিভা। সুখে আছে। ক্রিস অটোয়ার ব্রিজহেড-চক্চকে উঁচুশ্রেণিয় কফি শপে কর্মরত । লিন্ডা ডাউনটাউন অটোয়ায় স্থানীয় একটি ব্যাংকে কাজ করে । দুজনেই নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ক্রিসের এখন সময় নেই পেছনে তাকিয়ে দেখবার। কানাডীয় সব সুবিধা পুরােপুরি উপভােগ করে। সে তার সময় কাটায় পরিবারের সঙ্গে, স্ত্রীর সাথে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে। রেভারেন্ড ফ্রেড ক্যাপুচিনাে ও বনি কাপুচিনাে কানাডাতে সবচেয়ে নামী পরিবারগুলাের একটি হলাে ক্যাপুচিনাে পরিবার। এ পরিবারটি এমনই যে সমগ্র বিশ্বের দত্তপােযােগী অনাথদের তাদের বাড়িতে জায়গা দিতে পারলে তারা তাই করতেন খুশিমনে। তাদের বিয়ের আগে দুজনে ঠিক করেছিলেন তারা দুটি শিশুর বেশি নিজেরা নেবেন না। যেহেতু তারা “শূন্য লােকসংখ্যা বৃদ্ধি” তে বিশ্বাসী ছিলেন, আর যদি চান তাহলে একটি বা দুটি শিশু দত্তক নেবেন । ফ্রেড শিকাগােতে মেথডিস্ট মিনিস্টারের কাজ করতেন। তার স্ত্রী বনি নাসিং এ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ১৯৫৩ তাদের বিয়ে হয় । ১৯৫৪ সালে, তাদের প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর বনি ১০৩টি দত্তক সংস্থাকে চিঠি লেখেন যেসব জায়গায় তাদের শিকাগাের বাড়ি থেকে দিনে দিনে পৌছানাে যেত। চিঠিতে লেখা ছিল, তারা এমন একটি শিশু দত্তক নিতে ইচ্ছুক যাকে কোনাে কারণে দত্তক নিতে অসুবিধে হচ্ছে, জাতিগােষ্ঠীর মিশেলের কারণে অথবা বিকলাঙ্গ হবার কারণে, যদিও তারা মহার্ঘ চিকিৎসা ব্যয়ের বােঝা বইতে অপারগ ছিলেন ।
ফ্রেড ও বনি এখনও মনে রেখেছেন ১০৩ টি সংস্থার এক-তৃতীয়াংশ সাড়া দিয়েছিলেন। তারা সবাই যা বলেছিলেন, সেটা মােটামুটিভাবে এরকম: “যেসব দম্পতির প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তানলাভের সুযােগ রয়েছে, আমরা তাদের দত্তকের জন্য কোনাে শিশুকে দেই না।”° ঐ সময় ক্যাপুচিনাে দম্পতি জানতে পারেন যে একটি সংস্থা জাপানে মার্কিন সেনাদের ঔরসজাত (জি আই শিশু নামে পরিচিত) অনাথদের সগ্রহে ব্যস্ত। ফ্রেড ও বনি প্রথমে জাপান থেকে পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। মেয়েটির মা জাপানি, বাবা কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সেনা। এ ছােট মেয়েটি ফ্রেড যে মেথডিস্ট গির্জায় মিনিস্টার ছিলেন, সেখানে রীতিমতাে ঝড় তুলেছিল, জামাতের এক-তৃতীয়াংশ বিরােধিতা করে ধর্মস্থান ত্যাগ করেছিলেন। ওরা ভয় পেয়ে বােধ হয় বলেছিলেন: “কৃষ্ণাঙ্গরা আমাদের ঘরবাড়িতে ঢুকে পড়বে।” মজার কথা হলাে, জামাতের বাকি অংশ দত্তক নেয়াকে সমর্থন করেছিলেন এবং গীর্জা তহবিল একই পর্যায়ে টিকে গেল । কয়েক মাস পরে ফ্রেড এবং বনিকে বলা হলাে “এ ধরনের শিশুকে নিয়ে যদি আরও বিতর্কের সৃষ্টি হয়, তাহলে ঐ গির্জায় তাদেরকে থাকতে দেয়া হবে না।” অবশ্যই ক্যাপুচিনােরা ওরকম অপমানকর শর্ত মানতে রাজি হননি। তাই ১৯৫৬ সালে আরেকটি মেথডিস্ট গির্জায় ডাক পেয়ে যান, যাদের মনােভঙ্গি একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। ক্যাপুচিনােরা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন এজন্য যে এ চার্চ বর্ণ বিষয়ে সবসময়ই শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে সমর্থন করে আসছে। সে সময়ে ক্যাপুনিনারা আবার জাপান থেকে একটি কৃষ্ণাঙ্গ শিশুকে দত্তক নেন এবং তাদের ঘরে আরেকটি সন্তানের জন্ম। হয়। তার কিছুদিন পরই কোরিয়া থেকে একটি জি আই শিশু হাঁটি হাঁটি পা-পা করে পৌছল ক্যাপুচিনেদের বাড়ি। এত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও ক্যাপুচিনােরা নীরবে নানা ধরনের কমিউনিটি কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
এ সমাবেশে কাজ করার সময় বনি তাদের শিকাগাের বাড়িতে ভবঘুরেদের জন্য আনুষ্ঠানিক স্যুপ কিচেন চালাতেন। শিকাগাের কুক কাউন্টি হাসপাতালে কালাে শিশুদের পরিত্যাগ করে যাওয়ার কাহিনী পড়ার। পর বনি এবং ফ্রেড আবারও একটি শিশু দত্তক নেবার জন্য আবেদন করেছিলেন। একজন। সমাজকর্মী পরিদর্শন সফরে এসে ওদেরকে বলেন, “আপনারা বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আমরা আশ্চর্য হচ্ছি দেখে যে আপনাদের দুজনেরই উল্টো কুসংস্কারে ভােগার প্রবণতা রয়েছে।” বনি এবং ফ্রেড সমাজকর্মীর কথা শুনে হতভম্ব। ক্যাপুচিনােদের তখন মনে হয়েছিল যে সমাজকর্মী এবং তার তত্ত্বাবধায়ক বর্তমান বিশ্বে জনবিস্ফোরণের বিষয়ে সম্পর্কে কিছু শােনেন নি ।
তিনটি মেথডিস্ট চার্চে কাজ করার পর ফ্রেড ইউনিটারিয়ান মিনিস্ট্রিতে বদলি হলেন এবং সিলভার স্প্রিং ম্যারিল্যান্ডের ইউনিটারিয়ান চার্চে কাজের ডাক পেলেন । ক্যাপুচিনাে দম্পতি। এখানে খুব আগ্রহ নিয়ে যান। কারণ এ চার্চের সম্মেলন জাতিগত সুবিচারে যে গভীরভাবে উৎসুক ছিল, সেটা কারােরই অজানা ছিল না। প্রায় প্রত্যেকেই মার্টিন লুথার কিং এর বিখ্যাত বক্তৃতা “I had a dream” শুনতে গিয়েছিলেন। তারা ২০০,০০০ লােকের সঙ্গে চোখে অশ্রু নিয়ে আনন্দধ্বনি জ্ঞাপন করেছিলেন। সে সময়ে বনি এবং ফ্রেড তাদের সপ্তম সন্তানকে নিয়ে আসেন দত্তকগ্রহণের মাধ্যমে – সে ছিল ৪ দিন বয়সের এক শ্রীলঙ্কান অনাথ শিশু।
১৯৬৭ সালে ক্যাপুচিনােরা তাদের জীবনের আরেক নতুন অধ্যায় আরম্ভ করেন। এবারে তারা তাদের দৃঢ়সংকল্প অসহায়কে সহায়তা দেবার অবস্থানকে সবার উপরে ঘােষণা করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ক্যাপুচিনোেরা পয়েন্ট ক্লোয়ার, কিউবেক, কানাডাতে বসবাস করেন এবং কয়েকজন সমমনা বন্ধু মিলে Families For Children একটি অলাভজনক অসাম্প্রদায়িক সংস্থা গঠন করেন। সে সংঘের লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক ব্যবস্থার কাজে উৎসাহ প্রদান করা। আমরা সেটা তৃতীয় অধ্যায়ে পড়েছি। ক্যাপুচিনােরা তাদের অবসর সময়ে এফ এফ সি’র সেবায় নিয়ােগ করেন যতদিন কিউবেকে ছিলেন। বনি এফ এফ সি’র প্রেসিডেন্ট এবং ফ্রেড সচিব হিসাবে কাজ করেন। সম্ভাব্য দম্পতি পরিবারকে বিদেশ থেকে শিশু দত্তক নিয়ে আসার ব্যাপারে সহযােগিতা দেন। ফ্রেড যে লেকশাের ইউনিটোরিয়ান চার্চে কাজ করতেন যেখানে তারা নিয়মিত মিটিং ও আলােচনা অনুষ্ঠানও করতেন। সাধারণ ও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে নানা আলাপ আলােচোনা হতাে, যেমন মিশ্র মা-বাবার সন্তানদের মা-বাবার ভূমিকা পালন, এক জাতি থেকে আরেক জাতিতে দত্তক দেয়া-নেয়া, মানবাধিকার ইত্যাদি।
১৯৭০ সালের প্রথমদিকে, দম্পতি রােজম্যারি টেইলরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। তিনি অস্ট্রেলীয় শিক্ষক ও সমাজকর্মী ছিলেন, তিনি সায়গনে একটি অনাথ আশ্রম চালাতেন। তিনি শত শত মিশ্র জাতির কৃষ্ণাঙ্গ ভিয়েতনামী এবং বিকলাঙ্গ অনাথদের জন্য ইউরােপ ও উত্তর আমেরিকায় নিরাপদ আশ্রয় যােগাড় করেন। ঐ সময়ে ক্যাপুচিনোেরাও সংবাদ মাধ্যমে। পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন স্থানীয়ভাবে এবং জাতীয় পর্যায়ে। সংবাদ মাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকায় ক্যাপুচিনােরা একসঙ্গে বহু কাজ করেছেন এবং তারা যে তাদের জীবনাদর্শে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেটা প্রমাণ করেন । পয়েন্ট ক্লেয়ার-এ সাত বছর থাকার পর ক্যাপুচিনােদের অবাধ সুযােগ আসে শহর বদলানাের । ১৯৭৪ সালে ১০০ একর জমির ওপরে এক খামার বাড়িতে উঠলেন ক্যাপুচিনোেরা। যেখানে ছিল নতুন পদ্ধতির একটি কাঠের ছাদের দেয়াল বিশিষ্ট কেবিন, অটোয়া শহরের কাছেই পূর্ব অন্টেরি’র গ্রাম্য কমিউনিটি। এ জায়গা ম্যাক্সভিল নামে পরিচিত । তখন ফ্রেড রিমেটিভেশনাল থেরাপিস্ট হিসাবে কাজ করেন বয়স্কদের সঙ্গে ম্যাকডনেল মেমােরিয়েল হাসপাতালে, একইসঙ্গে তিনি অটোয়াস্থ ইউনিটেরিয়ান ফেলােশিপ অব অটোয়ার মিনিস্টার হিসেবেও কাজ করেন। বনি যদিও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স, তখন বাড়িতে পূর্ণ সময়ের জন্য গৃহস্থালির কাজে নিয়ােযিত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে দম্পতি তাদের ৭টি সন্ত নি নিয়ে শ্রীলঙ্কা ও ভারতে যান। সেখানে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়েলফেয়ার এর সাহায্যে এফ এফ সি’র দুস্থ শিশুদের জন্য দুটি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেন।
ভারতে ক্যাপুচিনােদের বেশি সময় থাকা হয়ে ওঠেনি। তাই দেখা গেল মাত্র ১৮ মাসের পর পরিবারটি কানাডার ম্যাক্সভিলে ফেরত আসে, প্রধানত ছেলেমেয়েদের তাগিদে। মহাত্মা। গান্ধীর শিক্ষা অনুযায়ী ক্যাপুচিনােরা ১৯৮৫ সালে কর্নওয়ালের ডাঃ নাথু ভাই শাহ এবং তার স্ত্রী কালা শাহ-এর সহায়তায় Child Haven International (www.childhaven.com) প্রতিষ্ঠা করেন। এ অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান গান্ধীবাদী দর্শন অসুসারী নারী ও শিশুদের জন্য ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও তিব্বতে দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালায় নারীরা। ফ্রেড এবং বনি সেখানে মূল ব্যক্তি। বনি বছরে চারবার ওদের ১১টি প্রকল্প পরিদর্শন করেন। বর্তমানে ভারত, তিব্বত, নেপাল ও বাংলাদেশে Child Haven International যে নয়টি দুস্থ শিশুদের আশ্রয় পরিচালনা করেন, বনি পালা করে সেগুলাের কাজর্ম-তত্ত্বাবধান করেন। সে সময় থেকে ক্যাপুচিনােরা পুরােপুরিভাবে গান্ধীবাদ অনুসরণ করা শুরু করেন। অল্প সময়ে তারা গভীরভাবে সে দর্শনের অনুসারী হন ।।
ক্যাপুচিনােদের ভারতপ্রীতির ইতিহাস খুঁজলে পেছনে ১৯৬০ এর দশকে যেতে হবে, যখন তারা ভারত থেকে তাদের দুটি ছেলে দত্তক নিয়েছিলেন । ওদের একজনের নাম ছিল মােহন; মােহন দাস করম চাঁদ গান্ধী-এর (১৮৬৮-১৯৪৮) নাম অনুসারে । গান্ধীর শিক্ষাদীক্ষা বিশ্বজুড়ে অহিংসা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। তাদের আরেক ছেলের নাম রেখেছেন, খলিল বিখ্যাত লেবাননীও আমেরিকান শিল্পী, কবি ও লেখক খলিল জিব্রান-এর (১৮৮৩-১৯৩১) নাম অনুসারে। স্বাভাবিকভাবেই ক্যাপুচিনােদের শ্রদ্ধার পাত্র মার্টিন লুথার কিং এবং মহাত্মা গান্ধী তারা তাদের কাজের ক্ষেত্র হিসাবে ভারতকে বেছে নিয়েছেন।
ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে ক্যাপুচিনােরা সবসময় একমত ছিলেন যে তারা নিজেরা পৃথিবীতে বেশিসংখ্যক সন্তান আনবেন না কারণ তারা মনে করেন বিশ্বের জনসংখ্যা এমনিতেই বেশি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে দেখা গেল বছর যতই গড়াতে লাগল, ক্যাপুচিনাে পরিবারের আকার লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেতে লাগে । ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে যখন যুদ্ধশিশু শিখা ক্যাপুচিনাে পরিবারে আসে, তখন সে ছিল তাদের ১০ম সন্তান। এক অর্থে
যিশু খ্রিস্টের বাৎসরিক বছরের সময়ের দেয়া-নেয়ার বাণী অনুসারে ১৯৫৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সময়ে ক্যাপুচিনােরা তাদের পরিবারকে ২১টি শিশুর পরিবারে উন্নীত করেন, তাদের ভাষায় বাড়িতে তৈরি দুটি ছেলে।
তাছাড়া পরিবারে ছিল আরও দুটি সেইন্ট বর্নারড কুকুর, বাটার কাপ ও পানজি, তাদের ছেলেমেয়দের সকলেরই প্রিয় । ১৯টি শিশু এসেছিল বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মােট ১১টি দেশ বা জাতির প্রতিনিধি যেমন ভারতীয়, জাপানি, পাকিস্তানি, কম্বােডিয়ান, কোরিয়ান, বাংলাদেশি, ইত্যাদি। তাদের দত্তক নেয়া শিশুদের মধ্যে যাদের দত্তক দেয়া কঠিন ও দুরূহ সমস্যাজড়িত’ এমন সন্তানও ছিল। যেহেতু ওরা বিদেশে যুদ্ধের শিকার, তাদের হয়তাে কোনাে অনাথ আশ্রমেই কাটাতে বাধ্য হতাে, যদি না তাদেরকে দত্তকায়নের মাধ্যমে কানাডাতে না আনা হতাে। মানবিক ও অন্যবিধ দুশ্চিন্তায় দিন কাটানাে ছাড়াও তাদের তিনটি দত্তক সন্তানের স্পষ্টতই শারীরিক অসুবিধা ছিল। প্রথমটির পােলিও হয়েছিল এবং তার পায়ে সংশােধনযােগ্য শৈল্য চিকিৎসার প্রয়ােজন হয়েছিল। দ্বিতীয়টির দুকানে শতকরা ৩০ভাগ শ্রবণশক্তির ঘাটতি ছিল; এবং তৃতীয় শিশুর শব্দান্ধতা থাকার দরুণ পড়তে বা বনািন করতে বিশেষ অসুবিধা হতাে। এসব মিশিয়ে ক্যাপুচিনােদের অনন্য আন্তর্জাতিক, আন্তবর্ণীয় ও বহুজাতীয় মিশ্রণে তৈরি পরিবার বিকশিত হয়েছিল অপরিমিত স্নেহ ও ভালােবাসার মধ্য দিয়ে । অতগুলি শিশুর দত্তক নেয়া কেন এবং কী ভাবে ঘটেছিল জিজ্ঞাসা করলে ফ্রেন্ড বিনীত উত্তর দেন: “আমরা কখনাে কোনাে সন্তান চাইনি। যেটুকু প্রয়ােজন ছিল আমরা সেটুকু করেছি । আপনার দোরগােড়ায় কেউ একটি শিশুকে রেখে গেলে আপনি তাকে নিজের মনে করে ভালোবাসতে শিখে নেন।” শিখার আগমনের পর এক সাক্ষাৎকারে ক্যাপুনিনােরা বলেছিলেন তারা সমগ্র পৃথিবীতে জনসংখ্যার বিস্ফোরণে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন; এ উদ্বিগ্নতা তাদের পরিবার তৈরির এক বিকল্প উপায় সম্পর্কে ভাবনাচিন্তায় ফেলে, দিনের পর দিন ।
ক্যাপুচিনেরা তাই তাদের দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা নিজেরা বৃহৎ পরিবার তৈরি না করে,”* দত্তকায়নের মাধ্যমে তাদের পরিবার গড়বেন। যতবারই দম্পত্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তারা অতগুলি সন্তানকে দত্তক নিয়েছেন কেন, তারা মােটামুটি একই রকম উত্তর দিয়েছেন যে, তারা সন্তানদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে ভালােবাসেন। “আমরা বিশিষ্ট বােধ করি যখন আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের ঘিরে থাকে, কারণ ওদের প্রত্যেকের মধ্যে এত এত সম্ভাবনা উঁকিঝুঁকি মারে যে কী বলব,” বলেন ফ্রেন্ড এক সাক্ষাৎকারে । (The Montreal Star 29 November 1972)। তারা যখন একের পর আরেক শিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন, তখন এত স্বাভাবিক ও সহজ মনে হয়েছে যে তারা সত্যিই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন অত সহজে । বনিও স্বীকার করেনঃ “আমরা কখনাে সপ্নেও দেখি নি যে আমরা একদিন অতগুলাে ছেলেমেয়ের মা-বাবা হবাে।” (The Montreal Star 29 November 1972)। কিন্তু তারপরও তাদের পক্ষে এটা এত স্বাভাবিক লাগত যে তারা একের পর এক সন্তান দত্তক নিয়ে তাদের স্বপ্নের দিন-রাত যাপন করেছেন।
এখানে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই যে, ফ্রেডকে এ সম্পর্কে কোনাে প্রশ্ন করলে তিনি সবসময় দার্শনিক জবাব দেন। “পৃথিবীর অন্যান্য অংশে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবা হয়, আমরা সচেতনভাবে চেষ্টা করেছি একটা জিনিস করতে; সবচেয়ে বেশি দরকার যার সে শিশুকে একটি নিরাপদ বাড়ি উপহার দিতে চেয়েছি যেসব শিশু মিশ্র জাতের অথবা অন্য কোনাে কারণে অসহায় । আমরা সবাই শেষ পর্যন্ত একই নৌকায়, বিশ্বের এক অংশ যদি মৃত্যুবরণ করে, আমরা একসঙ্গেই উঠি এবং পড়ি।” (The Citizen 26 March 1990) ক্যাপুচিনােদের ম্যাক্সভিলের পুরনাে দোতালা বাড়ির ১৩টি ঘুমনাের জায়গা (সেগুলিকে ঠিক শােবার ঘর বলা যায় না)। কয়েকটি যমলশয্যা এবং দুটি বাথরুম ব্যবহার করে ছেলেমেয়রা যখন বড় হচ্ছিল, অনেকের কাছে মনে হতাে ওটা একটা ছােট-খাট জাতিসংঘ। পরিবারে সাধারণ নিয়ম ছিল, একে অন্যকে শ্রদ্ধা করতে হবে। শর্তানুযায়ী একজন অপরের সমান মর্যাদা পাবে । এখনও সে নিয়ম কাপুচিনাে পরিবারে প্রচলিত রয়েছে। যখন বাড়ি তে নতুন একটি শিশুকে দত্তক নেয়া হতাে, ক্যাপুচিনোেরা নিশ্চিত করতেন যে বাড়ি তে ঐ শিশুর দেশের ওপর বই, খাবার, ছবি, সংগীত ইত্যাদি ছড়ানাে থাকবে তাদের এত এত বড় পরিবারকে একাত্ববদ্ধ রাখা এবং একজনের প্রতি অপরকে শ্রদ্ধাশীল রাখার উপায় – নিরন্তর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে যখন ছেলেমেয়েরা ছােট ছিল, কানাডার বিভিন্ন অংশ থেকে সংবাদপত্র কর্মীরা আসতেন, দম্পতির অন্যান্য পারিবারিক জীবন কেমন তার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য কেবল । অটোয়া সিটিজেন প্রতিবেদক জুলিয়া এলিয়ট জিজ্ঞাসা করেছিলেন বিভিন্ন বয়সের অতগুলাে সন্তান সর্বদা ঘিরে রাখলে কেমন লাগে । উত্তরে বনি বলেছিলেন; “বাড়িতে প্রাক-স্কুল ছেলেমেয়ে সবসময় থাকত। ২৬ বছরে এমন হয়নি যে কেউ নেই, ভদিন তাদের ছেলে) কিন্ডার গার্টেনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। সে দিনগুলাে কী সুন্দরই না ছিল!” (The Citizen 26 March 1990) সংবাদপত্র প্রতিবেদক এবং সাংবাদিক যারা এ অসাধারণ দম্পতির সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন তারা তাদের ব্যক্তিগত ধারণা বিষয়ে লিখেছেন। সংক্ষেপে, সবাই একই কথা। লিখেছেন যে এ দম্পতির আত্মত্যাগের সীমা নেই।
১৯৭২ সালে যখন তাদের ১৩টি সন্তান ছিল, যখন শিখা এলাে বাংলাদেশ থেকে, তখন ক্যাপুচিনােদের বাড়িটা শিশুদের জিনিসপত্রে ভর্তি একটি পাগলাগারদের মতাে জায়গা মনে হয়েছিল; “গাদা গাদা নােংরা পােশাক, খেলনা, সাইকেল, ছবি, দস্তানা, ওভারকোট এবং আধাভাঙ্গা আসবাবপত্র চারিদিকে ছড়ানাে।” (The Montreal Star 29 November 1972) স্বাভাবিকভাবেই অনেকে বণিকে জিজ্ঞাসা করতেন কীভাবে তিনি রান্না ও সাংসারিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করেন। বহু সংবাদপত্রকর্মরি জন্য সেটা ছিল অনেকটা “seeing is believing” এর মতাে ব্যাপার। তারা অনেকেই বণিকে “bionic” বা এক “wonder woman” মনে করতেন। ক্যাপুনিনােদের জীবনালেখ্য থেকে আরেকটি বিশেষ দিক বেরিয়ে আসে যেটা তারা প্রমাণ করেন যে, কোনাে দম্পতিকে বড় পরিবার পালনের জন্য ধনী হতে হবে না। তবে ভালাে অর্থ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে হবে। একবার ভেবে দেখা যাক এত বড় পরিবারের

লজিসটিকস- যেমন, মালপত্রের সরবরাহ, বন্টন, লন্ড্রি ও কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি দেয়া, ইত্যাদি। এ ধরনের বিশাল পরিবারের জন্য দরকার যথেষ্ট নমনীয়তা, স্থিতিস্থাপকতা আর দৈনন্দিন গৃহকর্মের শৃঙ্খলা, যেমন- বাজারাদি রান্না-বান্না, বাসন মাজা ইত্যাদি। যখন ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছিল, গতানুগতিক সকালের নাশতা বলতে কয়েক ডজন ডিম, তিনটি পাউরুটি, দুই তিন গ্যালন দুধ এবং ধূমশােধিত পিঠ বা পাশের শুকরের মাংসের স্তুপ। আর রাতের খাবার কী হতাে? বনি অনর্গল বলতে থাকেন তাদের দৈনন্দিন খাবারের লিস্ট থেকে, সাধারণত রাতের খাবার হতাে বিশাল এক পাত্র স্প্যাগেটি অথবা চপ সুয়ে অথবা চাও মিইন এবং চার-পাঁচ পাউন্ডের চালের ভাত। পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা আজও মনে রেখেছে তারা কীভাবে নিজেদের বাগানের স্ট্রবেরি, আলু বােখারা এবং আপেল ফলের ক্ষেত, সারা গ্রীষ্মকাল জুড়ে তার বাড়ির চাষ করা তরকারি ক্ষেত, সারা বছর সরবরাহ করার মতাে তরকারির বাগানও তাদের ছিল ।
সবচেয়ে বড় কথা, ক্যাপুচিনােদের যা যা ছিল, তাতেই তারা সন্তুষ্ট ছিল। ফ্রেড সামান্য থেরাপিস্টের কাজে যে বেতন পেতেন মেকডােনেল মেমােরিয়াল হাসপাতালে মানসিক অবসন্ন রােগীদের সহায়তা দিয়ে, তাতে আয় যা হতাে, আর সরকার প্রদত্ত মাসিক পারিবারিক Family Allowance থেকে কিছু টাকা আসত । যেখানে কিছুটা সাশ্রয় হতাে সেটা ছিল বাড়ির নিকটে আলেকজানড্রিয়ায় এক ফুড কো-অপ থেকে বেশি পরিমাণে খাবার কেনার জন্য । ফ্রেড কাজ থেকে ফেরার সময় রাতে অতিরিক্ত যা লাগত তা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। ক্যাপুচিনােরা নিজেদের পশু পালন করতেন, তিনটে গরু তাদের যত দুধ দরকার সে পরিমাণ দুধ পেতেন নিজেরা খেয়ে মাখনের জন্য ব্যবহার করতেন। পশুপালন ও দুগ্ধজাত পন্য উৎপাদনের কাজ তাদের ছেলেমেয়েদের ওপর ন্যাস্ত ছিল। টেলিভিশন দেখতে। দেখতে গ্যালন কাচের জারে ক্রিম ঝাঁকিয়ে ওরা মাখন তৈরি করত। তারা বড় বড় স্কুপে সবজি হিমায়িত করে রাখতেন। এ কথা বলা নিপ্রয়ােজন যে, বনির সংসারে সব ঠিকমতাে সংগঠন করা এক হারকিউলিসের কাজ ছিল বটে। দৈনন্দিন গৃহকর্ম, যেমন- কাঠকাটা, বাসন মাজা, কাপড় শুকানাে, ঘরের মেঝে পরিষ্কার করা, কুকুরকে খাবার দেয়া ইত্যাদি কাজ বিভিন্ন টিমের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। ফ্রেডের মনে পড়ে, এতগুলি সহায়ক হাত চারিদিকে এবং ৩জন তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক হাতের কছে কাজ তুলে দেয়া কোনাে ব্যাপার ছিল না। “আমরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে যেতাম, বড় ছেলেমেয়েরা ওদের নেতৃত্ব দিত, কেউ কেউ কাঠ চিরতে চলে যেত, গােলাঘর কেউ পরিষ্কার করত, এরকম” (The Ottawa Jarnal 12 December 1979)। পরিবারে প্রত্যেকের কিছু না কিছু কাজ ছিল, এভাবে ক্যাপুচিনােরা দলে দলে কাজ করার অভ্যাস তৈরি করেন, যার ওপর ভিত্তি করে ভাইবােনদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এবং বাবা-মায়ের সঙ্গেও একই রকমের সুসম্পর্ক।
এ নীতি পরিবারের একে অন্যকে সাহায্য করতে সহায়ক হতাে, আবার একক কাজের অংশও যাতে সম্মানজনক হয়, সেদিকে একজনকে উৎসাহিত করত। আবার এ পরিবারের আরেকটি বিক্ষণীয় দিক যে ছেলেমেয়েরা শুরু থেকেই বড় হয়েছে একে অন্যকে সমান চোখে দেখে। মজার ব্যাপার হলাে, কখনাে বা তারা তাদের ছেলেমেয়েদের ঠিক একইভাবে মনােবিচার করেননি। অর্থাৎ মমতার কথা বললেও তারা জানতেন তাদের সন্তানদের প্রয়ােজনীয়তার ভিন্নতা। ফ্রেড বিষয়টি সহজবােধ্য ভাষায় বলার চেষ্টা করে বলেন যে, একই লক্ষ্যে পৌছানাের জন্য কেউ বা বেশি মনােযােগ আকর্ষণ করে, আবার কেউ বা কম সময়েই অন্যের সাহায্য ছাড়া তাদের নিজ কাজ সম্পন্ন করতে পারে। সেজন্য ফ্রেড বলেন তাদের ছেলেমেয়েদের আলাদাভাবে ব্যবহার ও বিবেচনা করতেন একই ফল পাওয়ার জন্য। তারা জানতেন যে অনেকের বেলায় সব কিছুই সমতল নয় অনেক ক্ষেত্রে অনেক উঁচু-নীচু রয়ে যায়।
ক্যাপুচিনাে পরিবারের ছেলেমেয়েদের মতে তাদের কাছে আশ্চর্যের কিছু ছিল না যে নানা ধরনের দত্তক নেয়া শিশু (শক্ত সমর্থ দেহ এবং অসুবিধাগ্রস্ত দুধরনেরই) একসঙ্গে বড় হয়েছে একই বাড়িতে। বড় হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা একতার ধারণাটিকে খুব কাছে থেকে জেনেছে এবং শ্রদ্ধা করেছে। বাড়িতে এতগুলি ছেলেমেয়ের উপস্থিতিতে যখন বড় হচ্ছিল, একে অন্যের সঙ্গে জড়িত ঘনিষ্ঠভাবে যে একবারও মনে হয়নি যে তারা নানা দেশ থেকে এসেছে নানা বৈচিত্র নিয়ে। তাদের পারস্পরিক গভীর সম্পর্ক স্পষ্টত ইঙ্গিত করে ক্যাপুচিনোেরা কতই ওদের প্রাণ দিয়ে ভালােবাসেন।
ক্যাপুচিনােদের সাধারণভাবে সজ্জিত এবং পরিচ্ছন্ন কিন্তু আবার বেশ এলােমেলাে দেখাতে বাড়িটা যে কারাে চোখে পড়বে। আগ্রহের বস্তুর মধ্যে দম্পত্তির গবেষণা লাইব্রেরি, ফটো। সংগ্রহ, খবরের কাগজের কাটিং এবং বাংলাদেশ ও ভারতের নৃতাত্তিক বস্তুসমূহ। পারিবারিক গ্রন্থাগারে ৫,০০০ এর উপর টাইটেল, একক দেশের ওপর ফাইল অনাথ শিশুরা যেসব দেশে জন্মগ্রহণ করেছিল সেসব দেশের উপরে তথ্য ফাইল। ক্যাপুচিনােদের ছেলেমেয়েরা জানে যে তাদের মা-বাবার ফটোগ্রাফ এবং সঙ্গে পত্র আদান প্রদানের মতাে নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং এক এক আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তকের ওপরে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা লাইব্রেরিতে রয়েছে।
লাইব্রেরীর ক্যাবিনেটে রয়েছে বাঁধাহীন পুস্তকাদি প্রদর্শনীর ছবি, সার্ভে রেকর্ড ইত্যাদি। শিশু ও দত্তকের ওপর গবেষণামূলক তথ্য প্যামলেটের বাক্সের মধ্যে ছেলেমেয়েরা এগুলাে সবাইকে দেখাত এবং আলাপ আলােচনা করবার সুযােগ পেত । শিশুদের সকলের সব তথ্য ভান্ডারে অবাধ প্রবেশ ছিল শুরু থেকেই । দেখতে দেখতে ক্যাপুচিনােদের জন্য বছরগুলাে। দ্রুতই কেটে গিয়েছে আর তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যার যার সংসার গড়তে শুরু করে ।
দত্তক নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে তারা সারা দেশ জুড়ে কানাডীয়দের মনােযােগ আকর্ষণ করেন। তার মধ্যে রয়েছে কিউবেক ডিপার্টমেন্ট অব সােসাল ওয়েলফেয়ার । যখন ক্যাপুচিনােরা কানাডীয়দের মিশ্র জাতির শিশুদের দত্তক নিতে উৎসাহিত করেছিলেন, কিউবেক কর্মকর্তারা তখন তাদের কাজের স্বীকৃতি দেন এটা বলে যে তাদের কাজ সরকারের কাজকে জোরদার করেছে। তাদের অবিশ্রাম প্রচেষ্টার ফলে সরকার ও দত্তক সমর্থন গ্রুপদের। কাজে ১৯৭০ সালের প্রথম থেকেই অনেক ধরনের সুবিধা পাওয়া সম্ভব হয় প্রত্যেক।
সুযােগে কিউবেক সরকারের কর্মকর্তারা ক্যাপুচিনােদের নিরলস কাজের প্রসঙ্গ টেনে এনে। তাদের প্রশংসা করেছেনঃ “তারা পারিবারিক প্রাথমিক অবস্থায় খাপ খাইয়ে নেবার সময়ে খুব সাহায্য করেছেন, তারা সেটা করতে পেরেছেন। কারণ তাদের সে অভিজ্ঞতা ও উৎসাহ রয়েছে। তার জন্য শিশুরাও শিখতে পারে তাদের নিকট থেকে কীভাবে পরবর্তী সময়ে তারা নিজেরা বড় পরিবারের অংশ হতে পারে। এলিজাবেথ বিসেট, হেড, এডপশন সার্ভিসেস, ক্যাপুচিনােদের। সম্পর্কে এভাবে প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছেন একাধিকবার, যখন প্রয়ােজন মনে করেছেন। নিঃসন্দেহে এ ধরনের প্রশংসাপত্র ক্যাপুনিনােদর নানাভাবে সাহায্য করেছে যখন তারা। অন্যান্য সরকারের নিকট নিজেদের ভূমিকা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ঐদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যেতে পারে যে, যখন তারা বাংলাদেশ ও কানাডাতে দত্তকায়নের জন্য সরকারকে লবি করতে আরম্ভ করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের কানাডাতে আনার জন্য, তখন তারা একটি গ্রহণযােগ্য সংস্থার প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য হয়েছিলেন। একথা অত্যুক্তি হবে না যে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে দত্তক আনার বিষয়ে ক্যাপুচিনাে যুগলকে অগ্রদূত হিসাবে গ্রাহ্য করা হয়। যদিও একটি বিশাল পরিবার, ২১টি শিশুর পরিবার, ওরা প্রত্যেকেই এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, যা একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ক্যাপুচিনােদের সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হলাে, তারা আগাগােড়াই যা করে আসছিলেন, প্রত্যেকের সাথে যােগাযােগ রাখা, তা আজ অবধি করে যাচ্ছেন। যদিও তাদের খাচা খালি, ক্যাপুচিনােরা এখনও দুস্থ সদস্যদের দিকে।
সহায়তার হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। বহির্বিশ্বে ম্যাক্সভিল এলাকার বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশিরা ক্যাপুচিনােদের গভীর প্রতিশ্রুতি ও নিঃস্বার্থ সম্পর্কের কথা আলােচনা করেন আর বলেন, ক্যাপুচিনােরা তাদের সন্তানদের ভােলেননি, সন্তানরাও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে, তাদের সারা জীবনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে। বিগত বছরগুলােতে ক্যাপুচিনােদের সকলে “a unique couple” (এক অদ্বিতীয় যুগল) বলে। আখ্যায়িত করেছেন। তারা এ যাবৎ অজস্র পুরষ্কার ও প্রশংসা লাভ করেছেন; যেমনFriends of Peace Award, Ottawa Mayor (2004); Friends of Children Award (2004); the Order of Canada (1996); North American Council on Adoptive Children (1992); South Asian of the Year Award, Ontario Federation of South Asian Studies (1992); UNESCO Honor for Teaching Human Rights (1989); the Canada Volunteer Award for Contributions to Children (1986); and Ontario Medal for Good Citizenship (1985).
এ সমস্ত সম্মানের প্রতীক তাদের বাড়ির সব দেয়ালকে ঢেকে দিয়েছে। নানা সংস্থা ও ব্যক্তি তাদের বর্ণনা করেছেন “সাহসী,” “বুদ্ধিমান,” “সামাজিক কর্মী,” “অসাধারণ পরিবার এবং “অতি আশ্চর্য এক পরিবার” আখ্যায় । তাদের পক্ষে দুস্থদের প্রতি “হাত বাড়িয়ে দেয়া” সহজাত জীবনযাপনের একটি উপায় এবং একটি আবেগ। ক্যাপুচিনােরা এক রকমের “আন্ত র্জাতিকভাবে একসঙ্গে থাকার চর্চা করে পরিবারের ভেতর উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন । আশ্চর্য হবার কিছু নেই, ক্যাপুচিনোেরা এমন এক দম্পতি যারা কোনাে অনাথকে “না” বলতে পারেননি, বিশেষ করে যাদের নিরাপদ বাড়ির দরকার ছিল।
ক্যাপুচিনােরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দক্ষতা, মা-বাবার দুঃখ কষ্ট ও আনন্দ ভাগ করে নেয়ার পক্ষপাতী। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তারা একে অপরের নিকট থেকে অনেক কিছু শিখেছেন এবং ছেলেমেয়েদের সন্তোষজনকভাবে দায়িত্বশীল হিসাবে গড়ে তুলেছেন। ছেলেমেয়েদের নানা দক্ষতা, নানা রহস্যের ব্যাখ্যা ও বাস্তব পৃথিবীর মুখােমুখি হবার যেসব। কৌশল সে সবের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তারা তাদের সে বিশ্বাসের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। যে বিশ্ব কখনাে নিষ্ঠুর, অসুবিধাগ্রস্তের প্রতি যে বিশ্ব অকারণে দয়ালু নয়, তারা তাকে উন্নয়নে সহায়তা করেছেন। যখন শিশুরা বড় হচ্ছিল, প্রত্যেক পরিবার সদস্য বা শিশুকে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল যে সে যেন নিজেকে বাঁচিয়ে চলে। আত্মবিশ্বাস ও খুশির উৎস হয়ে ওঠে অপরের জন্য।
বনি মাতৃত্ব ও সংসারের কাজ সামলাতে ব্যস্ত, ছেলেমেয়েরা পরিবারের নিয়মকানুন, শৃঙ্খলা, মূল্যবােধ, সর্বোপরি, সাংস্কৃতিক প্রত্যয় ভুলে যায়নি। বিশেষ করে, তারা খুঁজেছে এবং একজন আরেকজনকে উদ্দীপিত করেছে। এভাবে বাড়িতে একসময় নৈরাজ্য নির্বাসনে চলে যায় এবং ক্রিয়াশীলতা পূর্ণরূপে জাগরূক হয় । আজও ক্যাপুচিনােরা সে একই খামার বাড়িতে বাস করেন, যেটা তাদের বাড়ি এবং অফিস ঘরও। বর্তমানে তাদের ২৭ জন পৌত্র-পুত্রী এং ৫ জন্য প্রপৌত্র। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের যে ভালােবাসার বাঁধন দিতে পেরেছিলেন সেটা। তারা আর কারাে কাছে পায়নি। এ কথাটি আমরা সপ্তম অধ্যায়ে যুদ্ধশিশুদের নিজ নিজ বিবরণীতে শুনতে পাবাে, বাবা-মায়ের দেয়া অদৃশ্য বন্ধনে আজ তাদের দত্তক নেয়া সন্তানের পৃথিবীজুড়ে মানুষকে সে বাঁধনে বেঁধে বেড়াচ্ছে। কেউ আশ্চর্য হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীতে অনাথ গৃহহীন শিশুর জন্য নিরাপদ গৃহ খোঁজার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে! ক্যাপুচিনােরা সাধারণত Easter Day Weekend (যিশুর পুনরুত্থান উপলক্ষে ছুটির দিনে সাধারণত মার্চ অথবা এপ্রিলে), Thanksgiving (কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের দিন, অক্টোবর এ) ও Christmas (বড়দিন)-এর ছুটিতে পারিবারিক পুনর্মিলনীর আয়ােজন করেন। এ কথা বলা। নিপ্রয়ােজন যে, প্রত্যেক ক্যাপুচিনাে প্রতি পুনর্মিলণীতে আসতে পারে না। যারা পারে আসে। তাদের গল্প বাকি ক্যাপুচিনােদের শােনাবে বলে। ক্যাপুচিনােরা “হাত বাড়িয়ে যার প্রয়ােজন তাকে ছোঁয়ার” আদর্শবাণী প্রত্যেক পারিবারিক পুনর্মিলনীতে আরেকবার উচ্চারণ করে নবায়ন করেন। Child Haven International এর নিরাপত্তার পতাকাতলে ক্যাপুচিনোেদের সন্তান (যাদের ক্যাপুচিনােদের অন্যান্য সন্তান বলে। সাধানণত উল্লেখ করা হয়) রয়েছ শতশত । হায়দারাবাদ, জোশফার্ম এবং কালিয়ামপুরির আশ্রমে ক্যাপুচিনােদের এসব অন্যান্য সন্তানরা সাধারণত জন্মের পরপরই পরিত্যক্ত অথবা অনাথ যাদের মা-বাবা অসুস্থ বা অতি দরিদ্র যে একবেলার খেতে দিতে পারেন না। আরেকটি লক্ষণীয় দিক যে ক্যাপুচিনাে দম্পতির নাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লেও তারা তাদের। বিজয় বিনয় রেখেছেন।
তাদের অর্জিত জয় ও সাফল্যে তৃপ্ত হয়ে তারা বসে থাকতে চাইনি। স্বভাবতই তারা এখনও কাজ করে চলছেন। তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা বহু প্রকল্পে কাজ করছেন। তারা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে একত্রিত হওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক বিষয়ে আগ্রহীদের প্রয়ােজনীয় তথ্য প্রদান ও উপদেশ দেন। আরও বিশেষ করে যাদের নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য দত্তক দেয়া কষ্টকর সেসব শিশুদের সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেন। আজও তারা যৌবনের শক্তি ও বয়সের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে দত্তক নিতে ইচ্ছুক যুগলদের সহায়তা যােগানাের কাজে ব্যস্ত। তাদের সবচেয়ে বড় মাহাত্ম্য, তারা বিভিন্ন জাতি ও গােষ্ঠীর মানুষের মিলনকে সমর্থন দিয়ে আসছেন আজীবন। ক্যাপুচিনােদের জন্য যােগাযােগ মাধ্যমের প্রতিবেদন প্রচারগুলাে জাতিবিচারে পৃথক শিশুর দত্তক নেবার। স্বপক্ষে অনেক সচেতনতা ও সমর্থন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়তা করে আসছে আজও।
मिथी এ শিশুটি সাত মাসের গর্ভধারণের পর জন্মগ্রহণ করেছিল, ১২ মার্চ ১৯৭২ সালে, ঢাকা, বাংলাদেশ। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ২.৭ কেজি। যিনি তাকে সঙ্গে সঙ্গে মাদার। তেরেসার শিশু ভবনে নিয়ে আসেন, তার নাম অজ্ঞাত । নথিপত্রে সঙ্গীর পরিচয়পত্র নেই । শিখাকে অনাথ আশ্রমে দত্তক দেবার জন্য রেখে যাওয়া হয়েছিল। সিস্টার মার্গারেট ম্যারি। শিশুটির নাম দেন শিখা। তিনি সাথে সাথেই শিশুটির যত্ন নিতে শুরু করেন কারণ ভগ্ন স্বাস্থের শিশুটি অস্বাভাবিকভাবে রােগা ছিল । দেখে মনে হয়েছিল সে হয়তাে বাঁচবে না । ক্যাপুচিনােরা যখন ঢাকা এলেন কানাডা থেকে বাংলাদেশ প্রকল্পে-এর কজে, তখন কানাডীয় দল শিখাকে কানাড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্বাচন করে । ক্যাপুচিনােদের যখন কিছু জিজ্ঞাসা করা হলাে, শিখার মতাে ক্ষীণ স্বাস্থ্যের মেয়েকে তারা কেন পছন্দ করেছিলেন, যখন সেখানে খুঁজলে হয়তাে আরও স্বাস্থ্যবান শিশু পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ক্যাপুচিনােদের উত্তর ছিল এরকম; “ও ছিল সবচেয়ে সুন্দরী শিশু। ওর মুখচ্ছবি অতি মনােমুগ্ধকর । ওর ছােট ছােট হাত-পায়ের ওপরের দিকটা তামাটে, নিচের অংশ ফর্সা” । ক্যাপুচিনােদের মতে সব শিশুর মধ্যে শিখা ছিল প্রশ্নাতীতভাবে “সবচেয়ে সুন্দরী শিশু।” ওরা কয়েকটি যুদ্ধশিশুদের মধ্য থেকে ওকে পছন্দ করে বের করেছিলেন।
পেছনের দিকে তাকিয়ে ক্যাপুচিনােরা বলেন তাদের জন্য ওটা ছিল শিশু মেয়েটিকে এক নজর দেখেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতাে ব্যাপার । দুর্বল স্বাস্থের মেয়েটিকে বেছে নেবার পর ক্যাপুচিনােদের পরবর্তী চিন্তা ছিল দীর্ঘ যাত্রা শেষে ঐ শিশুটিকে নিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরা। বনি এখনও মনে রেখেছেন তারা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। কারণ ক্ষীণস্বাস্থ্যের মেয়েটিকে নিয়ে তাদের শঙ্কা ছিল, যাত্রাকালে যে কোনাে কিছু ঘটে যেতে পারে । তারপর সকলের উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূর করে শিখা ধীরে ধীরে সেরে ওঠে । সুন্দর ঝকঝকে মেয়ে হিসাবে প্রস্ফুটিত হয়, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কথাগুলাে বনি ব্যক্ত করেন। মন্ট্রিয়লে দত্তকের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নকালে ক্যাপুচিনােরা শিখার নাম দেন – শিখা দীপা মার্গারেট ক্যাপুচিনাে। মা-বাবা অবশ্য শিশু ভবনে সন্যাসিনীর দেয়া নাম “শিখা” খুব পছন্দ হয়েছে বলে সেটা না বদলিয়ে নামটি রেখে দিয়েছিলেন। বদলানাের কথা ভাবেননি। তাদের বলা হয়েছিল, বাংলা ভাষায় শিখার অর্থ আগুনের দীপ দর্শনীয় রূপ, যার সঙ্গে ক্যাপুচিনােরা।
যােগ করেন “দীপা” এবং “মার্গারেট” সে দুজন সন্ন্যাসিনীর সম্মানে যারা অত ভালােবাসা ও আদর দিয়ে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন প্রথমদিন থেকেই যখন মারাত্বকভাবে রুগ্ন। শিশুটিকে সেখানে দত্তক দেয়ার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছিল। আবার শিখার বড় আন্টের নাম। ছিল “মার্গারেট ট্রেভিস” যিনি ক্যাপুচিনাে শিশুদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন যখন তারা বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের আনতে গিয়েছিলেন। আর স্বাভাবিকভাবেই শিখা তার শেষ নাম ক্যাপুচিনাে পেয়েছে তার মা-বাবার কাছ থেকে ।
গড়পড়তা কানাডীয় প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ বা তরুণীর মতাে শিখাও তার হাই স্কুল ডিপ্লোমার জন্য লেখাপড়া শেষ করেনি । ম্যাক্সভিল এলিমেন্টারি স্কুল থেকে পড়া শেষ করে শিখা গ্লোনগ্যারি। ডিস্ট্রিক স্কুলে পড়তে যায় । কিন্তু তখনকার পড়া শেষ না করেই সে স্কুল ছেড়ে দেয়। এর পরপরই শিখা বুঝতে শিখে যে জীবনে সামনে যেতে হলে তাকে হাই স্কুলের ঘাট পেরােতে হবে। সে প্রাপ্তবয়স্কদের কোর্স নিতে আরম্ভ করে যাতে সে হাই স্কুলের সমার্থক ডিগ্রি নিতে পারে। তারপর শিখা নানা জায়গাতে নানা ধরনের কাজ করে ক্রমশ বাস্তব জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করে। একের পর এক চাকুরি বদলিয়ে শিখা তার চেনা-জানা পরিধির ব্যাপ্তি ঘটিয়েছে ।
তাদের পারিবারিক পরিবেশের কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই শিখা জানায় যে সে এমন একটি বাড়িতে বড় হয়েছে যেখানে কোনাে উষ্ণতা এবং পারস্পরিক ভালােবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আদরের ঘাটতি ছিল না। সে পরিবারে একে অপরকে মূল্যায়ন করত স্নেহ-ভালােবাসার মধ্য দিয়ে । শিখা বড় হতে হতে বুঝতে শেখে তারা যেন জীবনে চলার পথে সে বােধ কাজে প্রয়ােগ করে লাভবান হতে পারে। শিখা বলে, তার মা-বাবা তাদের প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে একটি সত্যিকারের পরিচিতি দিয়েছেন তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের জন্য। বনি বলেন, শিখাকে সকলেই জানত। কারণ সে ছিল হর্ষোৎফুল্ল, সামাজিক, বন্ধুসুলভ এবং জনপ্রিয় তার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনের মাঝে।
এখনও শিখার মায়ের মনে পড়ে, তার এলিমেন্টারি শিক্ষক ক্লেয়ার বেজনেরকে, যিনি শিখাকে বর্ণনা করেছিলেন, ছােট্ট, কিন্তু শক্তিশালী মেয়ে বলে । আশ্চর্য হবার কিছু নেই, শিখার সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল যা, সেটা হলাে শিখার বিচারবােধ, ভদ্রতা ও আন্তরিকতা যা তুলনা করলে দেখা যাবে সে শৈশব থেকে তার পরিবেশে মিশিয়ে যেত সকলের অলক্ষ্যে। আমরা আরেকটু পরেই দেখতে পাবাে কেমন করে শিখা যেসব যুদ্ধশিশুর সাথে একসাথে বাংলাদেশ থেকে কানাডা এসেছিল, তাদের চেয়ে বেশ অন্য রকম মেয়ে । তার মা-বাবার চেষ্টা ছিল যে তাকে তারা নিজের ঐতিহাসিক অথবা জন্মবৃত্তান্তের অতীত। সম্পর্কে অনুসন্ধান বা খোজখবরের কাজে সংযুক্ত হতে সহায়তা বা উত্সাহ দেবেন, কিন্তু দেখা গেল সেদিকে যে কোনাে কারণেই হােক, সে আকৃষ্ট হয়নি, যেমনটি রানীর এবং রায়ানের ক্ষেত্রে হয়েছিল। সে তার জন্ম এবং দত্তক নেয়ার ইতিহাস শােনার পর কোনাে অস্বস্তিবােধ করেনি অথবা প্রত্যক্ষিত হওয়ার জন্য কোনাে অস্বাচ্ছন্দতার অনুভূতি তার। হয়েছিল কখনাে, এরকম ঘটনা তার মনে পড়ে না। সে জানে, যুদ্ধশিশুদের কেউ কেউ ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিল এবং ১৯৯০ এর দশকেও আবার যায় । শিখা নিঃসঙ্কোচে বলে যে সে কখনাে মনের মধ্যে কোনাে তাগিদ অনুভব করেনি যে সে তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবা সম্পর্কে আরও কিছু জানা উচিত যাতে সে নিজেকে বিশদভাবে জানাতে পারবে এবং অন্যদেরকেও জানাতে পারবে । বছরগুলাে অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনের পরিবর্তন যথেষ্ট হয়েছে, সে টের পেয়েছে তার মনের ভেতরটা বেশি পাল্টে যাচ্ছিল। তার পরিবারে দত্তক নেয়ার গল্প এত স্বাভাবিকভাবে প্রচলিত যে, সকালের নাস্তার কফি আর পাউরুটির মতাে ব্যাপারটা। বড় হয়ে ওঠার সময়, শিখার কখনাে মনে হয়নি যে সে একা এবং আলাদা, যেমনটা অন্যান্য দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েদের হয়ে থাকে। তাদের অনেকেই ভাবে তাদের নিজের কোনাে পরিবার। নেই অথবা তাদের কোনাে উৎস” নেই। কিন্তু স্পষ্টত শিখা তার মা-বাবার সঙ্গে একটি সুন্দর সহজাত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা উল্লেখ করতে গিয়ে শিখা বলে যে প্রথম থেকেই তাদের মধ্যে এক আলাদা বাঁধন ছিল, যেটা সবাইকে একসঙ্গে ধরে রেখেছে। শিখা তার বাবা-মাকে তার একমাত্র বাবা-মা হিসেবেই দেখে আসছে ।
শিখা আগে এবং বর্তমানে ক্ষণিকের জন্যও ভাবে না যে তার জীবনে কোনাে শূন্যস্থান রয়ে গিয়েছে যেহেতু সে তার জন্মবৃত্তান্ত বিশদভাবে জানে না। সে জানে যে জন্মকে ঘিরে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু সে এসব নিয়ে কখনাে মাথা ঘামায় নি। শিখা অনেকবার উল্লেখ করেছে যে তার দত্তক নেয়ার কাহিনী সম্পূর্ণ শুনে সে বড় হয়েছে । যতদূর সে মনে করতে পারে ক্যাপুচিনােদেরকেই সে তার বাবা-মা এবং তাদের নানাবর্ণীয় ভাইবােনদেরকে নিয়ে তাদের বৈচিত্রময় পরিবার। সে কোথা থেকে এসেছে বা তার অতীত বিষয়ে সে গবেষণা করার ব্যাপারে কখনাে গভীরভাবে আগ্রহবােধ করেনি । শিখার মা বলেন। তার বয়ঃপ্রাপ্তির পর তরুণী শিখাকে দেখে মনে হতাে যে সে নিঃসন্দেহে বেশ সন্তোষ্টচিত্তে দিনরাত কাটাচ্ছে। তার জন্মবৃত্তান্তের বিষয়ে তার কোনাে আগ্রহ হয়নি যে সে এসব নিয়ে। কারাে সাথে আলাপ করবে। তার জীবনের সত্য কথাটি সে বলতে পেরে খুশি যে সে যা জানে তার চেয়ে বেশি জানতে চায় না। এক অর্থে শিখা দেখিয়ে দিচ্ছে যে বাবা-মায়ের স্নেহ এত গভীর যে জীবনে মায়ামমতার ঘাটতি অনুভব করেনি । অন্য কাউকে খুঁজে পাওয়ার কথা তার মাথায় কখনাে আসে না।
একদিকে শিখা যেমন নিজেকে কানাডীয় ভাবে, অন্যদিকে সে অন্যেরা তার সম্পর্কে কীভাবে, সেটাও ভাবে বৈকি! রাস্তায় যে কেউ যখন তার দিকে তাকায়, সে জানে অনেকেই তাকে দেখে হয়তাে ভাববে সে তাে কানাডীয় নয়। কিন্তু শিখা নিজে জানে সে কে। সে ক্যাপুচিনাে পরিবারের মেয়ে। বস্তুতপক্ষে শিখার কাছে তাতে কিছুই যায় আসে না। সত্যিকারের বহুজাতিক, আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় পরিবেশে বড় হওয়ার ফলে শিখা এবং তার ভাইবােনেরা শিখেছে যে তারা সবাই মূলত কানাডীয় বহুসংস্কৃতির বহুবর্ণিল কৃষ্টির বেদিতে নিবেদিত । এ দৃষ্টিভঙ্গি শিখাকে শিখিয়েছে কীভাবে এক ধরনের আবেগ তাদেরকে একাঙ্গীভবনের মধ্য দিয়ে নিজেকে একজন কানাডীয় হিসাবে গণ্য করতে । অতঃপর একজন কানাডীয় হিসাবে তার নৃতাত্ত্বিক পটভূমি রয়েছে, সে একজন দৃশ্যমান কানাডীয় সংখ্যালঘু । শিখা এও ভাবে যে তার প্রথম পরিচিতির পর রয়েছে তার দ্বিতীয় পরিচিতির অংশটুকু (অর্থাৎ বাংলাদেশে জন্ম ও জন্মবৃত্তান্ত) যদিও সেটা খুবই সামান্য।
এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, জন্মদেশের প্রতি শিখার কোনাে আবেগসংক্রান্ত টান নেই, কখনাে সেটা গড়ে ওঠেনি। পরিবর্তে তার আবেগসমূহ কানাডার মাটি এবং আকা
শ বাতাসেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । শিখার মনের মধ্যে কোনাে ধরনের কুণ্ঠা নেই যে সে তার জন্মদেশে যাবার ব্যাপারে কখনাে কোনাে আগ্রহ বা আবেগ প্রকাশ করেনি। অবশ্য কথাটি সে বলতে গিয়ে আরও স্পষ্ট করে বলে যে সে যদি কখনাে বাংলাদেশে যায়, সে মাদার তেরেসার শিশু ভবনে কিছু সময় কাটাবে। কারণ সেখান থেকেই সে কানাডাতে এসেছিল। সে শিশু ভবনের কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ । কিন্তু সে বাংলাদেশকে তার বাড়ি বলতে প্রস্তুত নয়। শিখার ভাষ্যমতে, কানাডা তার বাড়ি কারণ কানাডার মাটিতেই সে বড় হয়েছে ক্যাপুচিনাে দম্পতির স্নেহ-আদরে।
শিখা কখনাে জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হয়নি । অর্থাৎ ওর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কোনাে ঘটনা জমা পড়েনি এ পর্যন্ত। তবে শিখা বলে সে এও জানে যে দৃশ্যমান সংখ্যালঘুরা বর্ণবৈষম্যের শিকার হচ্ছে অনেক সময়। শিখা তার মা-বাবার অফিসে (Child Haven International)-এ কাজ করেছে, সেখানে সে বিশেষ করে গণসংযােগ ও প্রশাসনিক কাজে তাদেরকে সহায়তা করেছে। তাছাড়া অন্যান্য তহবিল যােগানের কাজে ও নতুন প্রকল্পের কাজে সাহায্য করেছে। যেমন- অটোয়া ফ্রেন্ডস ফর টিবেট-এর বেনিফিট ডিনার আয়ােজনের সময় নানা অভিজ্ঞতার দরুণ শিখা আজ সত্যিকার অর্থে বাস্তববাদী। তাই আজ সে সুযােগ সৃষ্টি করতে উৎসুক, খুঁজে বার করতে নিরলস । শিখা এমনই এক ব্যক্তিত্বের লােক যে সে কখনাে অন্যের অনুগ্রহের পাত্র হয়ে থাকতে চায়নি।
ব্যক্তিগত জীবনে শিখা অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে । তার ছেলেবন্ধু মারা যাওয়ার পর যখন সে তার মেয়েকে নিয়ে একা পড়ে যায়, তখন সে দ্রুত জীবনের বেদনাদায়ক দিনগুলির সামনাসামনি হয়। স্বভাবতই সাথে সাথে শিখা তার মা-বাবা ও ভাইবােনদের কাছে ফিরে যায়। তারপর শিখা আবার বিয়ে করে তার স্বামীর সাথে কয়েক বছর কাটায় । কিন্তু সে বিয়ে পরে বেশিদিন টেকেনি। তার দ্বিতীয় মেয়ে হওয়ার কয়েক বছর পর তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বর্তমানে শিখা আবার কানাডীয় পারিভাষিক শব্দাবলি অনুযায়ী একজন “single mom,” সে একাই তার দুটো মেয়েকে মানুষ করে তুলেছে। সে তার জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা পেয়েছে। তার ২০ বছরের মেয়ে কাটারিনা ও ১০ বছরের মেয়ে কারমাকে নিয়ে শিখা বেশ ব্যস্ত থাকে। বাড়ির কাজ তাে আছেই। আবার কখনাে বাড়িতে অবস্থান করেই অফিসের কাজ করে। কারমা গ্রেইড ৬-এ পড়ে আর কাটারিনা কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেছে। এখন সে মাস্টার্স করবে, এ তার পরিকল্পনা।
শিখা বলে, তার জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট বিগত বছরগুলােতে মসৃণ হয়ে গিয়েছে । খন্ডকালীন এবং মাঝে মাঝে কাজ করে আয় বৃদ্ধি করলেও সে কোনাে স্থায়ী কোনাে কাজ পেলে খুশি হতাে। তার যে অবস্থা, তাতে বাংলাদেশের কথা কল্পনা করার অবকাশ নেই। বর্তমানে একা single morm হিসাবে দুটি মেয়েকে মানুষ করার চ্যালেঞ্জ তার সামনে শুধু আর কোনাে স্বপ্ন দেখা নয়। যদিও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে বা বাংলাদেশি কানাডীয়দের সঙ্গে মিশতে

শিখার তেমন কোনাে আগ্রহ নেই, অটোয়াস্থ কানাডা বাংলাদেশ মুসলিম কমিউনিটি আয়ােজিত ২০১২ সালের ইফতার-মাহফিলে সে তার দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। সেখানে তারা বাবা ফ্রেড ক্যাপুচিনাে ছিলেন প্রধান বক্তা। কাটারিনা ও কারমা দুজনেই শিখার মতাে। ঐ সমাবেশটি উপভােগ করে। শিখা বলে সে আগামীতেও এ ধরনের অনুষ্ঠানে যােগ দিতে আগ্রহী।
ডাঃ রবার্ট ফেরি ও হেলকে ফেরি
ডাঃ রবার্ট ফেরি এবং তার স্ত্রী হেলকে ফেরির গল্প পুরােটাই মায়া-মমতার গল্প না, সেটাতে রয়েছে তাদের সক্ষমতার গল্পও। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের বিশ্বাস ও লক্ষ্য অর্জনে সরকারের অচলায়তন নিয়মকানুনের বেড়া ভেঙে তার সব তছনছ করে দেবার যে ক্ষমতা রাখেন, সেটা আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি । ১৯৭২ সালে ডাঃ ফেরি, শল্য চিকিৎসক এবং ইউরােলজিস্ট, জোসেফ ব্রান্ট হাসপাতাল, বার্লিংটন, অন্টেরিও, কানাডাতে নিযুক্ত ছিলেন । তার স্ত্রী হেলকে ফেরি মন্ট্রিয়লের Families for Children (FFC)-এর আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থা নিয়ে কর্মরত একটি সংস্থার দ্বারা অনুরুদ্ধ হন, তারা FFC-এর কিছু বিশেষ কাজের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হােন।
হেলকে ফেরির জন্ম জার্মানিতে, তিনি বড় হন ভারতে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশােনা করেন। ১৯৬৯ সালে হেলকে ও রবার্ট বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হন। সেখানে হেলকে ছিলেন ছাত্রী এবং রবার্ট শল্যবিদ্যার অধ্যাপক। হেলকে এবং রবার্ট ১৯৭০ সালে কানাডাতে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
সামাজিকভাবে বিবেকবান দম্পতিটি সবসময়ই জাতিগােষ্ঠীর সীমাবদ্ধতার ওপর বিচরণ করে এসেছেন। যখন দত্তক নেবার কথা ওঠে, তারা তখন কোনাে বিশেষ জাতি বা গােষ্ঠীর কথা। ভাবেননি। ঐতিহ্যবাহী দত্তক প্রথা বর্জন করে তারা পরিবার ও অনাথ শিশুকে এক জায়গায় করার প্রয়াসে ব্রতী হন, পৃথকীকরণে নয় ।
যেসব শিশুকে কেউ দত্তক নিতে চান না, যাদের সাধারণতঃ সমাজকর্মী ও সম্ভাব্য দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মা সকলেই এড়িয়ে যেতে চান, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থায়ই ঐ দম্পতির অতিরিক্ত আগ্রহ ছিল। যেহেতু এ ধরনের শিশুদের পাশ কাটানাের, একবারে সরিয়ে দেবার ঝোঁক ছিল সবার, ফেরিরা নিজেরা খুঁজে খুঁজে এই শিশুদের বের করতেন। তাদের বয়স একটু বেশি হওয়ার দরুণ অথবা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার ফলে তাদের জন্য। নিরাপদ ও নির্দিষ্ট বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । সাধারণত কেউ তাদেরকে দত্তক নিতে চান না।
যখন তাদেরকে কেউ জিজ্ঞাসা করেছেন তারা কেন এ ধরনের শিশু বা অনাথ খুঁজছেন, মমতাময়ী ও সাহসী হেলকের ঝটপট উত্তর ছিল; “আমরা বিশ্বাস করিনিয়মিত সাধারণ অনাথ শিশুরা ঠিকই দত্তকে ইচ্ছুক বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে যায় । তাই যাদের স্থানান্তর করতে অসুবিধা হয় নানা কারণের জন্য, আমরা তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ নেই । অনন্যোপার। যে কোনাে সংস্থায় পড়ে থাকবে, তাই আমরা ওদের জন্য নিরাপদ বাড়ি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি।”
সমাজকর্মী হেলকে প্রায়শ জিজ্ঞাসা করতেন, “আমরা কি সমাজে ইতােমধ্যে বর্জিত শিশুদের জন্য আরও সব বাধা বসিয়ে আটকে দিতে চাই?” ফেরিরা কখনাে তাই নীল চোখ ও সােনালী চুলের শিশু (blue ribbon) খুঁজেননি, তারা এমন শিশুদের খুঁজে বের করতে, শাদের জাত, গােষ্ঠী বা লৈঙ্গিক বিষয় নিয়ে বাছাবাছির কোনাে প্রয়ােজন মনে করেনি। কারণ তারা জানতেন অসুস্থ, কৃষ্ণাঙ্গ, দৃশ্যমান সংখ্যালঘু শিশুদের দত্তকায়নের সম্ভাবনা অনেকাংশে কম।
আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি কীভাবে অন্টেরিও প্রদেশ ইচ্ছাকৃতভাবে দত্তকায়নের প্রক্রিয়াকে ঝুলিয়ে রেখেছিল । আবেদনকারীদের হােমস্টাডি সম্পন্ন না করে গড়িমসি করছিলেন। কারণ আবেদনকারীরা অন্টেরিও প্রদেশের সােস্যাল সার্ভিসেস ডিরেক্টরের বেটি গ্রাহামের কাছ থেকে তারা সেরকম কিছু পাচ্ছিলেন না। তারা ধরে নিয়েছিলেন যে তারা পাবেনও না। হেলকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। গ্রাহামের প্রতিটি কাজ দেখে তাদের কাছে মনে হয়েছিল যে দত্তক নিতে ইচ্ছুক বাবা-মায়েদের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিপরীতে গ্রাহাম বাধার সৃষ্টি করছিলেন। বিশেষ করে বাধ্যতামূলক হােমস্টাডি যেটা দত্তক প্রক্রিয়ার অপরিহার্য অংশ হিসাবে দেখা হয়, সেটা যেভাবেই হােক ঠেকিয়ে রাখতেই যেন গ্রাহাম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন।
হেলকে এবং অন্যান্য আবেদনকারীদের মনে হয়েছিল অবুঝ বালিকার মতাে ব্যবহার তার মতাে উচ্চ পদাধিকারীর পক্ষে অত্যন্ত বেমানান ও অর্থহীন। যদি গ্রাহামের কাছে কোনো যুক্তি থেকেও থাকে, তাদের কাছে মনে হয়েছিল সেটা তাৎপর্যহীন, বিদ্রুপাত্মক এবং অগ্রহণযােগ্য। তারা গ্রাহামের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন যে মনে হচ্ছিল তিনি এক চপলতা বা লঘুতাদুষ্টে দুষ্ট উচ্চপদাধীন আমলা। হেলকে তার লড়াই চালিয়ে যান। হেলকে উচ্চ পর্যায়ের ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারি কর্মকর্তাদের চিঠি লিখে জানান যে কয়েকজন কর্মকর্তা দত্তক প্রক্রিয়াকে ইচ্ছা করেই দেরি করছিলেন। হেলকে তাই রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন যে এ ধরনের লােকদের তিনি “জাতিগতভাবে বিদ্বিষ্ট” বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধা করেননি। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে পড়েছি কেমন করে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হেলকে লড়াই থেকে উঠে যেতে কখনাে রাজি হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, “a quitter never wins” (যে ছেড়ে দেয় সে কখনাে বিজয়ী হতে পারে না) এবং “a winner never quits” (যে বিজয়ী সে কখনাে ছেড়ে দেয় না)। তিনি তার স্বামীকে পাশে নিয়ে সবসময় লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি নিজেকে নিজে বলেছেন যে তাকে কেউ নাচাতে পারবে না অনর্থক, কারণ তিনি জানেন যে অন্টেরিও কর্মকর্তারা কেবল বলার জন্যই ওদের সাথে কথা বলছে, মূলত কিছু করতে অনিচ্ছুক। ব্যক্তিভাবে দুঃসাহসী ছিলেন ফেরি দম্পতি । সে করনেই সাহসী হেলকে নেতৃত্ব নিয়ে, ফায়ারিং লাইনে দাঁড়িয়ে, অন্যান্য আবেদনকারীদের সঙ্গে স্বর্গ আর মর্ত্য এক করে ফেলেছিলেন, যারা তার সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে একসঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন অন্যান্য আবেদনকারীরা। তারা গ্রাহামের গা জ্বালানাে মন্তব্য শুনে রাগে আগুন হয়ে যেতেন। তারা বুঝেছিলেন গ্রাহাম একদিকে ছিলেন যেমন নির্লজ্জরকমের কর্তৃত্বলােভী, তেমনি অন্টেরিও সরকারের ক্ষমতার উৎসের ধারেকাছেই ছিল তার অবস্থান। হেলকে সে সময়ে এক ঢেউয়ের জোয়ার তােলেন যখন তিনি জাতীয় টেলিভিশনে সাড়ে তিন দিনের অনশন ধর্মঘট পালন করেন। তার বক্তব্য জাতির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সকলে শুনে তার দাবির মর্মকথা বুঝতে পারেন এবং সাথে সাথে তাকে সমর্থন দেন।
হেলকে ও রবার্ট তখন দত্তকের পক্ষে মূলত কয়েকটি যুক্তি দিয়েছিলেন; আন্তর্জাতিক দত্তক কেবল এক দয়ার্দ্র কাজই নয় । বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক এলাকায়, বহুজাতি ও সংস্কৃতির মানুষ বিচরণ । অন্টেরিও কর্মকর্তাবৃন্দ তাদের অমানবিক উদাসীনতা দ্বারা দত্তক প্রক্রিয়াকে বিশেষায়িত করে সকলের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। সে সময়ে দেখা গেল হেলকে বিভিন্ন গােষ্ঠী এবং চ্যারিটি গ্রুপ থেকে চিঠি পেতে লাগেন – তাদের লক্ষ্য হেলকেদের লক্ষ্যের মতােই ছিল। হেলকের ৩.৫ দিনের অনশন ধর্মঘট এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ, কানাডাতে এক জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত হিসাবে এখনও দেখা হয়। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে সেটা বিস্তারিতভাবে পড়েছি। ১৯৭২ এর জুন মাস বাংলাদেশে তারা নিজ খরচে গিয়ে কানাডীয় দলের সাথে ফ্রেড ক্যাপুচিনাে ও তার স্ত্রী বনির সাথে যােগ দেন। কানাডীয় জনশক্তি ও অভিবাসন বিভাগ ডাঃ ফেরিকে অনুরােধ করেন যে, তিনি যেন যুদ্ধশিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। ঐ যুদ্ধশিশুদের অনেকেই যেহেতু গর্ভকালীন মেয়াদ শেষ হবার আগে জন্ম নিয়েছিল এবং বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন ছিল, ডাঃ ফেরিকে তাদের পরীক্ষা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তাদেরকে দত্তকের জন্য নির্বাচিত শিশু হিসাবে কানাডাতে যাবার উপযুক্ততা বিষয়ে মতামত দেবার দায়িত্ব দেয়া হয়। সে সময়ে ফেরি দম্পতি দূর্বলতম একটি ছেলে ও একটি মেয়ে নিজেদের জন্য নির্বাচন করেন। আমরা যুদ্ধশিশু ‘ক’ এবং ‘খ’ নামে অভিহিত করব। যেহেতু তারা তাদের আসল নামে পরিচিতি দিতে চায়নি। ডাঃ ফেরি মনে রেখেছেন তখন বাংলাদেশ সরকারের দুশ্চিন্তা – নবজাতক যে হারে জন্মগ্রহণ করছিল, সে হারে মৃত্যুবরণও করছিল । দত্তকের মাধ্যমে পরিবার গড়তে গিয়ে ১৯৭২ ও ১৯৮৫ সালের মধ্যে ফেরি দম্পতি ১০জন অনাথ শিশুকে দত্তক নেন।
তাদের তিনজন ঔরসজাত আগেই ছিল। তারা মােট ১৩টি সন্তানকে লালন পালন করেন। ১৯৭২ সালে তারা তাদের বার্লিংটন বাড়ি থেকে একই এলাকায় ১৪০ বছরের পুরনাে একটি খামার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। বাড়িটিকে আগাগােড়া পুরােটাই মেরামত করে অতিরিক্ত ঘর নির্মাণ, পশুপাখিদের নিজস্ব জায়গা এবং ছেলেমেয়েদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেন। প্রথমদিকে যখন ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছিল, তখন পরিবারে অনেক কুকুর, বেড়াল, একটি বানর এবং অনেকগুলাে পােষা মুরগি ছিল। সময়ের। সাথে পরিবারের আবার স্বভাব নিরন্তর পাল্টাচ্ছিল । বাস্তবিকপক্ষে ফেরি পরিবার নৃতাত্ত্বিকভাবে হয়ে ওঠে এক বৈচিত্রময় পরিবার। ফেরি পরিবারে তাদের সন্তানদের মধ্যে। পাঁচজন সন্তান শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিল।
এবাট ও ফেরি তাদের সন্তানদের নিয়ে এত ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তাদের মানবিক সহনীয়তা কখনাে ভেঙে পড়েনি। তাদের চিন্তাভাবনা তাদের বিশ্বাসের দ্বারা প্রভাবিত ছিল এরকম যে, একক ব্যক্তিত্ব সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সীমা পর্যন্ত উন্নয়নের সুযােগ ও সময় দাবি করতে পারে । সংবাদ মাধ্যমের নিকট আকর্ষণীয় খবর ছিল দুর্বলতম দুটি যুদ্ধশিশু ফেরিদের বাড়িতে। আসা। সে সময়ে ফেরি দম্পতি সংবাদ মাধ্যমের মনােযােগ আকর্ষণ করেন তাদের।
নবণীয় সন্তাদের লালন পালনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। দেখতে দেখতে শিশুরা-ও বড়। এতে থাকে এবং স্বাস্থ্যবান শিশুতে পরিণত হয়। তাদের আগমনের দুমাসের মধ্যে ঐসব লােগা ও অসুস্থ্য শিশুদের নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন লেখা হয়। এমনকি এক প্রতিবেদনে তাদেরকে “নীল চোখের শিশু যাদের “মিষ্টি আভা ঘিরে আছে বলে আখ্যায়িত করে সংবাদ মাধ্যমে বেশ কয়েকদিন লেখালেখি হয়েছিল” (The Toronto St/’ Tebruary 1973)।
ফেরি দম্পতির আরেকটি প্রশংসীয় গুণ যে, তারা তাদের ছেলেমেয়েদের জীবন রক্ষার প্রাথমিক দক্ষতা শিখিয়ে দিয়েছেন। সে জন্য তারা আরও আত্মকর্মশীল, আরও স্বাধীন ও স্বনির্ভর হতে পেরেছে। তারা প্রত্যেক সন্তানের সঙ্গে আলাদা করে পরিশ্রম করেছেন। গত তারা হােট অবস্থায় সর্বদাই একজন অভিভাবকের খবরদারিতে সময় কাটাতে পারে। নচেৎ। তাদের প্রয়ােজনমতাে বৃদ্ধি বা উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হতাে না। হেলকে অনেকবারই বলেছেন একজন অভিভাবক সর্বদাই শিশুর ধারে কাছে থাকলে শিশুর সামান্যতম কষ্টও কারাে নজর এড়াতে পারে না। শিশুদের বড় করে তুলতে দম্পতি সর্বদা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার কথা ভেবেছেন। যেমন- কোনাে শিশু যতই অসুবিধাগ্রস্ত হােক অনেকদিন থেকে। তার মধ্যেও অনেক অনুভূত বৃত্তিশক্তি রয়েছে।
যদিও তারা সবসময়ই একসাথে প্রকল্পের কাজ কাজ করেন, হেলকে তার স্বামীকে এক। মূল্যবান সম্পদ হিসাবে দেখেন । রবার্টও হেলকে সম্পর্কে ঠিক তাই ভাবেন । রবার্ট অত্যন্ত। স্পষ্টবাদী। তিনি তার জীবন নিবেদন করেছেন পরিবার ও পেশার অনুসরণে দুক্ষেত্রেই সফলকাম মানুষ তিনি। বিগত বছরগুলিতে রবার্ট ও হেলকে একই টিমে কাজ করেছেন, ঐতিহ্যবাহী মা-বাবার মতাে নয়। রবার্ট ঠাট্টা করে বলেন, “হেলকে আমাদের পারিবারিক। সেনাবাহিনীর কমান্ডার”। তিনি অবশ্য সর্বদাই আরও আরও সন্তান নিতে চেয়েছেন। হেলকে তখন রবার্টকে স্মরণ করিয়ে দিতেন যে তাদের পরিবারটি ইতােমধ্যে অনেক বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। হেলকে বলেন যে প্রত্যেক মানুষের মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। তারা যা অর্জন করার লক্ষ্যে তাদের জীবনের অভিযান শুরু করেন, সে লক্ষ্যে তারা অবিচল। হেঁটে চলেন বছরের পর বছর। প্রয়ােজনমতাে পরিবার ও আত্মীয়তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে এগিয়েছেন। জাতগােষ্ঠীর কোনাে পার্থক্য না মেনে যখনই ভেবেছেন একটি অনাথকে তারা। নিজেরা লালন করতে পাবেন, তখনই তাকে বুকে তুলে নিয়েছেন নিজ সন্তান হিসেবে।
ফেরিরা বাংলাদেশ প্রজেক্ট-এর সম্ভাবনা ও দ্রুত সাফল্যের নানা চিন্তা-ভাবনা করে আরও কিছু করার পরিকল্পনা মাথায় রাখেন। বাংলাদেশ থেকে ফেরার পর থেকে তারা সংবাদ মাধ্যমে যে ইতিবাচক প্রচার পেতে শুরু করেন, সেটা তাদেরকে আরও অনুপ্রাণিত করে। সে সময়ে দেখা গেল, কানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অনেক দম্পতি ওদের খুঁজে খুঁজে বের | করেন। এমনকি আমেরিকা থেকে অনেকে তাদের শরণাপন্ন হন দত্তক নেয়ার আশায় । কানাডীয়রা তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে আরও বলেন যে তাদের আশা ফেরিরা অদূর ভবিষ্যতে আরও অনাথ শিশুদের নিয়ে আসবেন। ফেরিরা বাংলাদেশ থেকে ফেরার ১ মাসের মধ্যেই কুয়ান-ইন-ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। আন্তর্জাতিক ও আন্ত ৪বর্ণীয় দত্তক ব্যবস্থার সুবিধার্থে ফেরিরা অবিলম্বে ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে বেশি বয়সের অনাথ শিশুদের দত্তকের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসে কাজ করতে আরম্ভ করেন।
১৯৭২ এর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে হেলকে নিরলসভাবে বাংলাদেশ থেকে আরও অনাথ শিশু আনার ব্যাপারে কাজ করে যান। অক্টোবরে হেলকে আবার বাংলাদেশে যান তখন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে। এবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করেন। তিনি দত্তক বিষয়ে কয়েকটি জরুরি ইস্যুর উপরে অসাধারণ অন্তদৃষ্টি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে আলােচনা করেন । রবার্ট এবং হেলকে দুজনেই দাবি করেন যে, এটা একটা নৈতিক কর্তব্য এবং তারা তাই করতে এসেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে মুজিব হেলকের অনাথদের বিষয়ে জ্ঞান ও তাদের জন্য মায়ামমতা লক্ষ্য করে মুগ্ধ হলেছিলেন সেদিন। সৌভাগ্যবশত তাদের এমন এক সময়ে দেখা হয়েছিল যখন সরকারের মনেও পরিবর্তনের একটা শক্তিশালী আশার বাতাস বইছিল । দেখা গেল, মাত্র তিন মাসের মধ্যেই অক্টোবরে হেলকে বাংলাদেশ থেকে আরও আটজন অনাথ শিশু নিয়ে এলেন কানাডাতে । কিন্তু তাদের মধ্যে সবাই যুদ্ধশিশু ছিল না। কেউ কেউ ছিল যুদ্ধশিশু, কারাে জন্মের পর মায়েরা তাদের ছেড়ে চলে যায়; আবার কেউ বা যুদ্ধের সময় অনাথ হয়ে যায় অর্থাৎ তারা ছিল পরিত্যক্ত এবং পিতৃমাতৃহীন। এ গ্রুপের এতিমদের বয়স ছিল আটমাস থেকে ছয় বছর। এদের মধ্যে একজনকে প্রধানমন্ত্রী মুজিব ঢাকার রাস্তায় পড়ে রয়েছে দেখেনিজে কুড়িয়ে নিয়ে এনে আদেশ দিয়েছিলেন যেন শিশুটিকে অনাথ আশ্রমে পৌছে দেয়া হয় (হেলকে লেখককে সাক্ষাৎকারের সময় এ কথাটি উল্লেখ করেন)। হেলকের জানা মতে, অনাথ শিশুটি বড় হয়ে বর্তমানে ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে সমাজকর্মী হিসাবে কাজ করে। সম্ভবত তিনি যুদ্ধশিশু মনােয়ারা ক্লার্ক-এর কথা বলছিলেন যে ডিসেম্বর ২০১৪-তে বাংলাদেশে এসেছিল। তাকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যম বেশ লেখালেখিও করেছিল। এ নিবেদিতপ্রাণ দম্পতি নানা “অবাঞ্ছিত” অনাথকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। ভিক্টেরিয়া লীচ, অ্যাডাপশন, কো-অর্ডিনেটর, কমিউনিটি এন্ড সােসাল সাভিসেস মন্ত্রণালয়, অন্টেরিও, ১৯৭০ সালে অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক আনা কিছু অনাথদের সঙ্গে দেখা করেন। ফেরিদের বাড়িতে ভিয়েতনামী দুটি অনাথকে তিনি বার কয়েক তত্ত্বাবধানের অংশ হিসাবে প্রদর্শন করতে গিয়েছিলেন। লীচ তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেখে ফেরিদের সম্পর্কে প্রশংসা ছাড়া আর কিছুই ব্যক্ত করতে পারেননি। ফেরিদের বাড়ি পরিদর্শনের সময় বাড়িতে তাদের ৭টি  ছেলেমেয়ে ছিল। তাদেরকে দেখে সাথে সাথেই মনে হয়েছিল কী স্বাভাবিকভাবেই ঐ ভিয়েতনামী পশ্চাদপটের দুটি ছেলে বাড়ির অন্যান্য আন্তবর্ণীয় ও শ্বেতাঙ্গ ভাইবােনদের সঙ্গে মিশে গিয়েছে ।
লীচ ছেলে দুটির মধ্যে লক্ষণীয় ইতিবাচক আচার ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়ে কমিউনিটি এন্ড সােসাল সার্ভিসেস মন্ত্রণালয়কে ফেরিদের প্রশংসা করে লিখেছিলেন: “আমি। কয়েকঘন্টা ওখানে ছিলাম । ওদের মেলামেশা লক্ষ্য করি। আমি খুব নিশ্চিতবোধ করছি। এটা ভেবে যে, এ পরিবারে অসাধারণ মমত্ববােধ, উষ্ণতা ও দায়বদ্ধতা সক্রিয়।” এক সঙ্গে। কাজ করে ফেরি দম্পতি প্রমাণ করেছেন এমন একটি জিনিস যা তারা বিশ্বাস করেন সদাই দৃঢ়ভাবে – বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তি হলাে মানুষের ইচ্ছা।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ফেরিদের ভাষ্যমতে, তাদের সব সন্তানই পুরােপুরি সুখী হয়নি। তাদের দুটি। সন্তান বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে যাদের কোনাে খোঁজ খবর ফেরিরা জানেন না। “ওকে। ফলাফল বিচিত্র হতে পারে, যেমন হতে পারে ঔরসজাত সম্পর্কের হেরফের,” বলে। হেলকে। ফেরিদের প্রধান বার্তা যেটি সবাইকে দিতে চেয়েছেন সেটার অর্থ হলাে পওনের মাধ্যমে অন্ততপক্ষে কিছু কিছু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল । ১৯৯৯ নাগাদ, তাদে সব ছেলেমেয়ে বড় হয়ে ওঠে, বাড়ি ছেড়ে যার যার পেশা এবং লেখাপড়ায় চলে যায় । কি স্বভাবতই মা-বাবা ও সন্তানদের যে বাঁধন তাদের জীবনে শুরু থেকে তৈরি হয়েছে, এখ-২৪। তা শক্ত রয়েছে। ওদের অনেকের এখন নিজস্ব পরিবার হয়েছে; ফেরিদের এখন আট ৩া। নাতি নাতনি এবং একজন প্রপৌত্র রয়েছে।
চাইল্ড ওয়েলফেয়ার থেকে অবসর নেয়ার পর হেলকে বর্তমানে মেডিকেল সায়েন্স বিষয়ের লেখক, আর রবার্ট সাইকোথেরাপি এবং EDMR (Eye Desensitization Movement and Repressing) অনুশীলন করেন। যারা পােস্ট Post Traumatic Disorder’ এ। ভুগছেন, তাদের নিয়েও নানা বিষয়ে ব্যস্ত রাখেন দুদিকেই – পেশাগত ও সামাজিকভাবে তাদের ছেলেমেয়েরা যখন আসে তারা নিজেদের নিয়ে নানা বিষয়ে আলাপ করেন তাদের। ছেলেমেয়েদের সম্পৃক্ত করে, ফেরিদের বিশ্ব বেশ হাসি আনন্দে ভরপুর জমজমাটই বলতে হবে।
দম্পতি লেখকের খসড়া জীবনালেক্ষ্য (ফেরিদের সম্পর্কে লেখা) পড়ে তার প্রতিক্রিয়া ব্যও। করেন এটুকু বলে যে তারা অসাধারণ নন। তারা নিত্যন্ত সাধারণ কানাডায় যাদের একটুখানি দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবারের মতােই হয়েছে – কেউ কে কারাে কারাের চেয়ে ভালাে করেছে। যদিও তারা প্রমাণ করেছে কেবল ভালােবাসা নিয়ে কেউ অচ্ছেদ্য বাবা-মা সন্তান বাঁধন তৈরি করতে পারেন। আমার কাছে এটা বির। আমাকে যখন এ প্রশংসা আর ভালােলাগার কথা বলা হয়। আপনার ইচ্ছা যেমনই হোক, আমার কথাটাও তাে ভাববেন একটু। আমি বিশ্বাস করি না যে, আমরা অত প্রশংসা পাওয়ার। মতাে কিছু করেছি। শিশুদের কষ্টে আমাদের দুঃখ হয়েছিল, তাই বাড়িতে দুটি শিশুকে এনে রাখলে এমন কী ব্যাপার হলাে? আমার বাড়ি জার্মানি, তাতে কী? ওরা বাংলাদেশের, ৩াতে কী হলাে? আপনি যে গল্প বলতে চাচ্ছেন, তাতে লােম দাঁড়িয়ে যাবে। সন্দেহ নেই, সেট বলার মতাে একটা গল্পও মানুষের জন্য, হেলকে তার বিনীত রচনাশৈলীতে লেখক। এভাবে তার অভিমত ব্যক্ত করেন।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!