বাংলাদেশ-কানাডা দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ
বাগাড়ম্বর পেরিয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ
১৯৭১ এর ডিসেম্বরে যখন বাংলাদেশে যুদ্ধাবস্থার ইতি ঘটল, সারা বিশ্বের মনােযােগ এসে পড়ে বাংলাদেশের উপর – দারিদ্র, যুদ্ধপীড়িত কোটি কোটি মানুষ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে ব্ৰতী হয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগােলিক আয়তন ছিল ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিমি, ১৯৭০ সালে লােকসংখ্যা আনুমানিক ৭৫ মিলিয়ন, মাথা প্রতি জিডিপি ১২৯ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের তুলনায় কানাডাতে প্রায় ৭০ গুণ বেশি ভৌগােলিক আয়তন ছিল। (৯,৯৮৫,০০০ বর্গ কিমি), লােকসংখ্যা বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ (২১ মিলিয়ন) এবং মাথা প্রতি জিডিপি প্রায় ৪০ গুণ বেশি (১৯৭০-এ ৪০০০ মার্কিন ডলারের উপর)। বাংলাদেশে মানবিক বিপর্যয় যেটা ঘটেছিল, তার ব্যাপকতা সংখ্যা দিয়ে বােঝানাে যাবে না। বহু আন্তর্জাতিক দর্শকের জন্য ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সংবাদ শিরােনাম ছিল এরকম: ধর্ষণে যুদ্ধশিশুদের জন্ম এবং প্রসবের পর জন্মদাত্রী মায়েদের দ্বারা অত্যধিক পরিমানে পরিত্যক্ত ।
১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন। তার প্রশাসনের সর্বোচ্চ প্রাধিকার ছিল বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা। জাতি তখন সর্বতােভাবে বিধ্বস্ত । প্রশাসন আরও পাঁচটা জরুরি বিষয়ের মতাে যুদ্ধশিশুদের এবং ধর্ষিত মায়েদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার প্রয়ােজনের কথা ভাবছিলেন । অবশ্য মুজিবের পক্ষে ধর্ষিতা নারী ও তাদের পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য সুসংগঠিত পন্থায় কিছু করার মতাে তখনও পরিবেশ তৈরি হয়নি। সরকারের সম্পদ ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। বাস্তবিকই, বাংলাদেশের সর্বত্র মানুষ তখন সরকারের কাছ থেকে জরুরি সহায়তা পাবার আশায় উদগ্রিব। সরকার অসংখ্য বিষাদিত ঘটনা নিয়ে লেখার প্রতিবেদন পাচ্ছিলেন প্রতিদিন, বিষয় – যুদ্ধকালে নারীদের আটক রেখে যৌনদাসীরূপে ব্যবহার, দলে দলে ধর্ষণ, অনাহারে রেখে মেরে ফেলা, বারবার যৌনসেবা দিতে ও গর্ভধারণে বাধ্য করা ইত্যাকার বিষয়। কিন্তু এ বিপুল সংখ্যক প্রতিবেদনের সবই ছিল অসমর্থিত অর্থাৎ এদের সত্যতা যাচাই করা হয়নি। কিছু কিছু তদন্তের পর এর অনেকাংশই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়, যদিও এতে কিছুটা অতিশয়ােক্তি ছিল। শিশু পাচার থেকে যারা দুপয়সা কামাচ্ছিল, তারাও এসব খবরকে ব্যবহার করে তাদের লাভ নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছে।
সরকার যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে নীতিমালা নির্ধারণের লক্ষ্যে লােকমুখে শােনা লােমহর্ষক ধর্ষণের প্রতিবেদনের উপর নির্ভর না করার সিদ্ধান্ত নেন। সরকারের দরকার ছিল নির্ভরযােগ্য তথ্য যার উপর ভিত্তি করে যাতে ধর্ষিত নারী এবং পরিত্যক্ত শিশুদের প্রয়ােজন মেটানাের উপযােগী কার্যক্রম হাতে নেয়া । সে সময় সম্পদের অভাব হেতু ব্যয়ের যথার্থতা প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক ছিল। সরকার আন্তর্জাতিক মহলে খোঁজখবর নিলেন। মুজিব সরকার শুরুতেই কানাডার নিকট সহায়তা চান কারণ কানাডীয় বেসরকারি সংস্থাসমূহ যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন অভ্যর্থনা কেন্দ্রে এবং অনাথ আশ্রমে খোঁজখবর নেয়ার মাধ্যমে । কানাডীয় সংস্থাগুলাে তখনও সতর্ক করে দিয়ে ব্যক্ত করেন যে, নিশ্চয়ই জন্মদাত্রী মায়েরা নবজাত শিশুদের পরিত্যাগ করবেন এবং দক্তকায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে দাড়াবে।
শুরু থেকেই বাংলাদেশ ও কানাডীয় প্রতিনিধিবৃন্দ সহমত ছিলেন যে, শিশুর সুরক্ষা এবং দত্তক পরিবারের দীর্ঘমেয়াদি স্বচ্ছলতা হবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় । দত্তক ব্যবস্থা যত শীঘ্রই সম্ভব বাস্তবায়ন করা যাতে নবজাত শিশুরা সুরক্ষা পায় (অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু পাচারকারীদের হাত থেকে)। একই সাথে সরকারের লক্ষ্য ছিল কানাডীয় পরিবারেরা যেন সুখ ও সমৃদ্ধির সাথে বাস করেন তাদের দত্তকায়িত ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তাকারী নির্বাচিত সংস্থাটি ছিল একটি অলাভজনক, অসাম্প্রদায়িক সংগঠন।
ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি)-এর কানাডীয় কর্মোদ্যোগ যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার ব্যাপারে কানাডীয় এনজিও-দের নেতৃস্থানীয় সমর্থক ছিল এফ এফ সি। ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত, এফ এফ সি কয়েকটি কানাডীয় দম্পতির একনিষ্ঠ পরিশ্রমের ফসল। মন্ট্রিয়লের পশ্চিম শহরতলিতে অবস্থিত এ সংস্থা দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মাকে দত্তক নেবার আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে আসছে। জাতিগতভাবে ভিন্ন শিশুদেরও দত্তক নিতে ওরা সহায়তা দিয়ে আসছে।
এফ এফ সি’র প্রধান লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল সংস্থাটির বিশেষ সফলতা ও দক্ষতার সাথে “দত্তক দেয়া কঠিন” শ্রেণির অনাথদের জন্য নিরাপদ বাড়ি খুঁজে পাওয়া। “কঠিন” শ্রেণির মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক এবং আন্তবর্ণীয় দত্তক; অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী শিশু; এবং মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে যে সব শিশু চ্যালেঞ্জ মােকাবিলা করে। ১৯৬০ দশকের শেষ এবং ১৯৭০ দশকের শুরুতে এফ এফ সি স্বেচ্ছাসেবকেরা অস্ট্রেলিয়ার রােজম্যারি টেইলরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। তিনি তখনও ভিয়েতনামে এক অনাথ আশ্রম চালাচ্ছিলেন, শত শত গৃহহীন শিশুকে ভিয়েতনাম থেকে উদ্ধার করে টের ডেজ অম-এর (টি ডি এইচ) মাধ্যমে ইউরােপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দত্তক পরিবারে আশ্রয় তৈরি করে দেবার পেছনে ছিলেন তিনি। ১৯৭২-এর শুরুতে এফ এফ সি এক বিশ্বস্ত সংস্থারূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে । তার আগে ১৯৭১-এ ইন্টার এজেন্সি অ্যাডাপশন কমিটি তৈরি হয় এবং এফ এফ সি এ কমিটির সদস্য হয়।
প্রথম সারির কানাডীয় এনজিও যেমন, ক্যানাডিয়ান ইউনিসেফ, ক্যানাডিয়ান রেড ক্রস সােসাইটি, ক্যানাডিয়ান সেইভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড, অক্সফ্যাম কানাডা, ওয়ার্ল্ড ভিশন অব কানাডা এবং কেয়ার কানাডা বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের ঘিরে যে মানবিক বিপর্যয় চলছিল, তাতে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে যে বিপুল সাড়া দেয়। মুজিব প্রশাসন তাতে অত্যন্ত ভরসা পান ।
১৯৬৮ সালের শেষদিকে কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডাে কানাডীয় পরিবার ও শিশুমঙ্গল ও সাহায্য সংস্থাগুলিকে নাইজেরীয় সংঘাতে অনাথ শিশুদের দত্তক নিয়ে আলিঙ্গন করার আহবান জানিয়েছিলেন। তিন বছর পরও কানাডীয় জনগণ ট্রুডাের আহবানের কথা ভােলেন নি, যখন বাঙালীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের কথা ভাবতে ভাবতে দত্তকে ইচ্ছু বাবা-মায়েরা পিয়ার এলিয়ট ট্রুডাের আশ্বাসবাণীর কথা ভাবছিলেন যেটা বায়াফ্রা সংঘাতের কালে শােনা যেত “দরকার হলে সরকার ত্রাণের উড়ােজাহাজে শিশুদের উড়িয়ে নাইজেরিয়া থেকে কানাডা নিয়ে আসবে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে কানাডীয় এনজিওদের প্রতিনিধিরা “অধিকৃত বাংলাদেশ” (মার্চ ১৯৭১ ডিসেম্বর ১৯৭১) সফর করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে কী ঘটছে, সেটা সরেজমিনে দেখা (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন)। তারা অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন, “বিশেষ করে, ধর্ষিত মায়েদের এবং তাদের শিশুদের, যাদেরকে দেশের লােকে গ্রহণ করবে না; এদের কী হবে?” সরকার আশা করেননি যে এনজিওরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমর্থ হবে, কারণ তারা গৃহহীন মানুষের সহায়তায় কাজ করতে প্রাথমিকভাবে সংকল্পবদ্ধ; সে যা হােক, এনজিওরা বাংলাদেশব্যাপী অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে এবং তারা তাদের প্রতিবেদনগুলিতে উল্লেখ করে যে “উত্তর আমেরিকা ও কানাডাতে বাংলাদেশি পরিত্যক্ত শিশুদের দত্তক নেয়ার ব্যাপারে জোর প্রচারণা চলেছে ও চলবে।
বাংলাদেশের জরুরি প্রয়ােজন এবং কানাডার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক দত্তকের জন্য বিদেশি। অনাথ শিশুর চাহিদা পূরণের জন্য এফ এফ সি বাংলাদেশে যেসব যুদ্ধশিশু জন্ম নেবে, তাদের দত্তক নেবার জন্য একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে। জানুয়ারি ১৯৭২ নাগাদ ফ্রেড এবং বনি ক্যাপুচিনাে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক দত্তক প্রক্রিয়া অনুসরণে অনুসন্ধানী। তৎপরতা চালিয়ে এতদসংক্রান্ত কীভাবে এবং কেন এসব প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত করেন। উপরন্তু এ বিষয় সম্পর্কিত আইন এবং আইনের অভাব, যেমনটি বাংলাদেশে ছিল, এসব নিয়েও কাজ করেন। তারপর তারা বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিয়ে কানাডীয় পরিবারে পৌঁছে দেবার অভিযাত্রার বিভিন্ন পর্ব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে প্রস্তাবনাটি পাকাপােক্ত করার চেষ্টা করেন।
এফ এফ সি স্বেচ্ছাসেবকদের দত্তক প্রস্তাবনার বাস্তবায়নে উৎসাহ দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করেন। রােবের্তো রিবেইরাে, তদানীন্তন প্রধান, এনজিও ডিভিশন, ক্যানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডিভেলপমেন্ট এজেন্সি (সি আই ডি এ)। কানাডা ও বাংলাদেশ উভয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে পারস্পরিক তথ্য বিনিময়ে রিবেইরাে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তিনি এনজিওগােষ্ঠীর সঙ্গেও যােগসূত্র রক্ষা করেন। বিশেষ করে, তিনি ওয়ার্ল্ড ভিশন কানাডাকে লেখেন যাতে কানাডীয় এনজিওগুলাে যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসে (আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে দেখতে পাবাে)। তিনি নিজেও একটি যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেন।
বাংলাদেশ সরকারের কোনাে প্রতিনিধি না থাকায় ক্যাপুচিনােরা কিউবেক-এ ইউনিভার্সিটি অব শেরকের অধ্যাপক মুয়াজ্জম হুসাইনের কাছে যান। অধ্যাপক হুসাইন-এর জন্ম বাংলাদেশে হলেও তিনি কানাডীয় নাগরিক ছিলেন । হুসাইন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লবি করে কানাডীয়দের সমর্থন লাভ করেন এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনসাধারণকে প্রভাবান্বিত করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই এভাবে তিনি শীঘ্রই কানাডাতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের পক্ষে অনানুষ্ঠানিক মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনের কাজ শুরু করেন। আলােচনায় প্রধান বিষয় ছিল, এফ এফ সি’র প্রস্তাবনার মূল বিষয় পুনরীক্ষণ করা এবং কীভাবে কানাডীয় আগ্রহী দম্পতিদের বাংলাদেশি যুদ্ধশিশু দত্তক নিতে সহায়তা যােগানাে যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপগুলাে স্পষ্ট ভাষায় রূপদান করা।
১৯৭২ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ, আব্দুল মােমিন কানাডাতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার নিযুক্ত হওয়ার কিছুদিন পরেই অটোয়ায় পৌঁছে গেলে হুসাইন তার সঙ্গে এফ এফ সি’র স্বেচ্ছাসেবকদের এক সাক্ষাৎকারের আয়ােজন করেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই । তারা কমিশনারকে একজন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, সুবেশ, সুভাষ ভদ্রলােক” হিসাবে গ্রহণ করেন । “যুদ্ধশিশু বিষয়টাকে ঘিরে যে স্পর্শকাতরতা রয়েছে সেটা গণমাধ্যমে কীভাবে উপস্থাপন করা যায় সে বিষয়ে তারা আলােচনা করেন। মােমিন পরামর্শ দিলেন, “যুদ্ধে অনাথ” হয়তাে একটা নরমগােছের নাম ব্যবহার মন্দ হবে না “যুদ্ধশিশু’র তুলনায়।
এ বইয়ের ভূমিকায় আমরা “যুদ্ধশিশু” ও “যুদ্ধে অনাথ” শব্দবন্ধের পার্থক্য আলােচনা করেছি। যেখানে যুদ্ধে অনাথ একটা সাধারণ বর্ণনা যার দ্বারা যুদ্ধে যেসব শিশু পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়ে, তাদের সকলকে বােঝানাে হয়েছে। এফ এফ সি মােমিনের সঙ্গে একমত হন এ সংক্রান্ত যে কোনাে প্রচারণা সুরুচিজ্ঞাপক হতে হবে এবং বাংলাদেশিরা যাতে কোনােক্রমেই ক্ষুব্ধ না হন সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা এবং মন্তব্য সকল এফ এফ সি কর্মীকে জানান। তিনি তাদেরকে লিখেন, “ওদের সবাই (অর্থাৎ, অটোয়ার হাই কমিশন কর্মীবৃন্দ) অত্যন্ত সহযােগিতার সুরে ও উৎসাহের সঙ্গে কথা বলেছেন।
হাই কমিশনারের ইতিবাচক জবাব ক্যাপুচিনােদের দ্বিতীয় পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করেঃ বনি সাথে সাথেই একটি ত্রিমুখী কর্মকৌশল প্রণয়ন ও প্রস্তাবনা এফ এফ সি’র নিউজলেটারএর মাধ্যমে সেটা সকল এফ এফ সি’র সদস্যদের পাঠান। প্রস্তাবিত কর্মকৌশলের প্রথম অংশে ছিল কানাডাতে হুসাইনকে বাংলাদেশের মুখপাত্ররূপে সত্যায়ন করা। তিনি বাংলাদেশের কত শিশু কানাডাতে অভিবাসনে আসার জন্য পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করবেন। কানাডাতে কতজন মা-বাবা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে আগ্রহী সেটা জানা । সবশেষে, এফ এফ সি কানাডা সরকারের বিভিন্ন স্তরে, যেমনফেডারেল, প্রাদেশিক এবং মিউনিসিপ্যাল সরকারকে প্রশ্ন করে জানবেন, দত্তক প্রক্রিয়া এবং যুদ্ধশিশুদের অভিবাসন বিষয়ে কোন্ সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য কতটুকু।
বনি সম্ভাব্য এবং দত্তক নিতে ইচ্ছুক মা-বাবা এবং দত্তক সংস্থাসমূহকে খােলা চিঠি দিয়ে জানালেন । সাদাসিধে, বাস্তবনির্ভর ভঙ্গিতে যুদ্ধশিশুদের বর্ণনা করেঃ “তারা বাংলাদেশি মা এবং পশ্চিম পাকিস্তানি পুরুষের সন্তান। আমরা ব্যাপারটা যেমন বুঝেছি, এসব শিশুরা তাদের মায়েদের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না অথবা তাদের দেশের কাছেও না। ভালােভাবে বাঁচতে হলে তাদের একমাত্র আশা বাংলাদেশের বাইরে দত্তক সন্তানরূপে যাওয়া। আজ এটা তামাদি মনে হতে পারে কিন্তু ১৯৭২ সালে শ্বেতাঙ্গ কানাডীয় পরিবারের নিকট এটা। বিশেষ করে বলার তাৎপর্য ছিল যে, যাদের অনেকে উপমহাদেশের মানুষকে কখনাে হয়তাে আগে দেখেনি তাদের উদ্দেশ্যে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যে শিশুরা আসছে তাদের চেহারা এক ধরনের নয়: “শিশুর গায়ের রং কতখানি হালকা বা গাঢ় হবে, সেটা যেহেতু বলা যাবে, তাই আমরা বলব যে দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা শিশুর ত্বকের রং যা হােক, তাকে গ্রহণ করবেন। তাদের আরও সতর্ক করে দেয়া হয় যে, এই যুদ্ধশিশুদের বংশধারা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত ইতিহাসও থাকবে না।
সে সময়ে ক্যাপুচিনােরাও পর্দার আড়ালে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ও কানাডা উভয়। সরকারের সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন। মিচেল শার্প, তদানীন্তন মিনিস্টার অফ এক্সটার্নাল এফেয়ার্স (কানাডা)-কে বনি লিখেছিলেন: “যে বাংলাদেশকে (সরকার) লেখা চিঠিতে আমরা চেয়েছি, বাংলাদেশ সরকার কিছুসংখ্যক গৃহহীন শিশু অথবা বালক-বালিকা কানাডীয়। পরিবারে দত্তক নেবার জন্য অনুমােদন দেবেন কিনা। যদি অনুমােদন দেয়া হয় তাহলে আমাদের খোঁজ নিয়ে জানতে হবে এ সংক্রান্ত দ্রুততম কার্যপ্রক্রিয়া কী ধরনের হতে পারে এবং হােমস্টাডি ও শিশুদের জন্য অভিবাসনের কাজ কী হবে সেটাও জানতে হবে। নবজাতকদের যত তাড়াতাড়ি যাওয়ার অনুমােদন দেয়া হয় ততই ভালাে হবে। কোরিয়ান ও ভিয়েতনামী শিশুদের কার্যক্রম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব ভালাে হয়েছে। বর্তমান ক্ষেত্রে কাজটি যদি দ্রুত সম্পন্ন করা যেত, তা হলে আমাদের জন্য অত্যন্ত সুবিধা হতাে।” বনি এরপর তার সংস্থার সদস্যদের এও জানান, কীভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ফেডারেল অভিবাসন ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন যাতে শিশুদের জন্য কানাডার ভিসা দ্রুত পাওয়া যায়। যাতে, যদি সম্ভব হয়, পছন্দের শিশুদের সবাই অথবা কয়েকজন অন্তত আমাদের সঙ্গে কানাডায় আসতে পারে। মােটামুটিভাবে বনি এখানে সরকারের সহযােগিতা ও সদিচ্ছার উপর জোর দিয়ে লিখেন ।
আবার ১৯৭২ এর মে মাসে, এফ এফ সি নিউজলেটার-এ ক্যাপুচিনােরা প্রস্তাবিত বাংলাদেশ প্রকল্প বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে পাঠকদের মনোেযােগ আকর্ষণ করেন। লেখা পড়ে পাঠকেরা বুঝতে পারেন, কীভাবে এফ এফ সি’র সদস্যরা কানাডাস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনারের সঙ্গে এ বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন, তারা জানতে পারেন যে বাংলাদেশি হাই কমিশনার এফ এফ সি-কে আশ্বস্ত করেছেন যে শীঘ্রই তিনি এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ অবস্থান জানবেন । নিউজলেটার-এর ৪০০-এর বেশি কপি কানাডীয় দত্তক সংস্থা, কানাডীয় প্রাদেশিক ও টেরিটরিও সরকার, সমাজকর্মী, পরিচিত দত্তকগ্রাহী মাবাবা, এবং অন্যান্য দত্তক সমর্থক গ্রুপকে পাঠানাে হয়, বাংলাদেশ প্রকল্প সম্পর্কে তাদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে।
চলার পথে আরও যে বিপদ আসতে পারে, সেসব কথা ভেবে এফ এফ সি’র প্রেসিডেন্ট জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে তার পৃষ্ঠপােষক ও সদস্যদের জানান। মানবিক কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় শিশুদের দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার কাছে কানাডায় পৌছে দেয়ার মধ্যে একটি সনির্বন্ধ ভাব কাজ করছিল, লেখেন বনি কাপুচিনাে। দেখা গেল, কয়েকমাসের মধ্যই এ এফ সি যে কয়েকজন শিশুর জীবন বাঁচাবার জন্য এ জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন সেটা সংশ্লিষ্ট সকলের জ্ঞানগােচরে আসে।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ক্যাপুচিনােরা বাংলাদেশে হাই কমিশনার মােমিনের নিকট থেকে জানতে পারেন যে, আব্দুর রব চৌধুরী, তদানীন্তন সচিব কোঅর্ডিনেশন ডিভিশন, এক্সটারনাল এসিস্ট্যান্স ফর রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, বাংলাদেশ সরকার, জবাবে লিখেন: “আপনারা যে কয়েকজন শিশুর বিষয়ে বলেছেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের বিষয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নীতিগতভাবে আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থা অনুমােদন করেছেন। যদিও এটা কাটছাট সংক্ষিপ্ত ন্দ্র জবাব, এটা ক্যাপুচিনােদের জন্য অনেক অর্থবহ ছিল । ঐ সময়ে এফ এফ সি কানাডার নানা এলাকার দম্পতিদের কাছে থেকে অজস্র অনুরােধ পেতে থাকেন, সব প্রদেশ থেকে বাবা-মায়েরা দত্তক নিতে আগ্রহী। এ ইতিবাচক উন্নয়ন এফ এফ সি-কে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দিতে উদ্বুদ্ধ করে।
বাংলাদেশ প্রকল্প এবং তথ্য সঞ্চালন বাংলাদেশ প্রকল্পে-এর দুটি লক্ষ্য ছিল: প্রথমত বাঙালি নারী এবং পশ্চিম পাকিস্তানি পুরুষদের সন্তান কোনাে শিশু কানাডীয় পরিবারে দত্তক নেবার জন্য পাওয়া যাবে কিনা, সেটা নির্ধারণ করা; এবং দ্বিতীয়ত যদি সম্ভব হয়, দত্তক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রস্তাবনা অনুসারে দুটি দল থাকবে – দলপতি ফ্রেড ক্যাপুচিনাের তত্ত্বাবধানে – একটি মন্ট্রিয়ল থেকে, অপরটি টরন্টো’র। মন্ট্রিয়ল দলে ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাের সাথে থাকবেন আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক । টরন্টোর দলে ছিলেন ড. রবার্ট ফেরি এবং তার স্ত্রী হেলকে ফেরি, যারা প্রত্যেকে নিজের খরচ বহন করবেন। এখানে অংশগ্রহণকারী দত্তকে ইচ্ছুক পরিবারসমূহকে কী খরচ বহন করবে তাও লেখা ছিল। “দত্তক পরিবার অবশ্যই তাদের শিশুর রাহা খরচ বহন করবে, যদি না কানাডীয় কোনাে সংস্থা একটি বিমান ভাড়া করে দলসুদ্ধ সবাইকে নিয়ে আসে। আমাদের হিসাব মতে খরচ হবার কথা তিনশ থেকে পাঁচশ’ ডলার ।
ক্যাপুচিনােরা আরও ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, তারা কয়েক ডজন পরিবারের নথিপত্র নিয়ে যাবেন, যারা একটি বা দুটি যুদ্ধশিশু দত্তক নিতে তৈরি।”১৬ ক্যাপুচিনােরা এও জানালেন যে,তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭২ এর জুলাই তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে তারা এই শিশুদের নিয়ে বাড়ি ফেরার আশা রাখেন। তাদের কাছে ইতােমধ্যে যােগ্য, অর্থাৎ চিলড্রেন্স এইড সােসাইটি অনুমােদিত বাবা-মায়েদের একটি তালিকা তৈরি ।
কিউবেক প্রদেশের পয়েন্ট ক্লেয়ারস্থ লেইকশাের ইউনিট্যারিয়ান চার্চ এর পরিচালকবৃন্দ কাপুচিনাে দম্পতিদের এ মর্মে অনুমােদন দেন: “এ বাের্ড মন্ত্রীকে রেভারেন্ড ফ্রেড কাপুচিনাে| সস্ত্রীক বাংলাদেশ ভ্রমণে যাবার জন্য অনুমােদন দিচ্ছে। মন্ত্রী ওখানে উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি শিশু দত্তক আনার জন্য ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করবেন । ওইসব কাজ করার জন্য মন্ত্রী ইউনিটারিয়ান ইউনির্ভাসালিস্ট মুভমেন্ট-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমুন্নত রাখার জন্য যেসব কার্যক্রম প্রয়ােজন সম্পন্ন করবেন।
তহবিল গঠন কার্যক্রম ক্যানাডীয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি-এর রােবের্তো রিবেইরাের দ্বারা উৎসাহিত ও সহায়তাপ্রাপ্ত হয়ে এফ এফ সি সাথে সাথে বাংলাদেশ প্রকল্প-এর জন্য এক তহবিল তৈরি ও কর্ম পরিকল্পনা ছকে দেয়। প্রকল্পের বাস্তবায়নে যথেষ্ট পরিমাণ টাকার প্রয়ােজন ছিল । এফ এফ সি তখনও কানাডীয় জনগণকে সাহায্যের হাত বাড়ানাের জন্য আবেদন করে। মে। মাসের নিউজলেটার-এ তাদের প্রকল্পটি সাধারণ মানুষের ভাষায় ব্যাখ্যা করেন । হচ্ছে সেটা উল্লেখ করে ত্রাণ পুনর্বাসন সংস্থার সঙ্গে যে তাদের কাজ চলছে তারও বিবরণ দেন।
এফ এফ সি অর্থ জোগানের জন্য নানা ধরনের কার্যক্রম যেমন, পট লাক ডিনার, র্যাফল ড্র ইত্যাদির আয়ােজন করত এবং হাতের কাজের বিভিন্ন সামগ্রি বিক্রির মাধ্যমে বিক্রির মাধ্যমেও তহবিল বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। মাসের শেষের দিকে প্রকল্পটিতে অনেকে আগ্রহ দেখান এবং নানা সমাজ সেবা সংগঠন সহায়তা করার আশ্বাস দেন ব্যক্তিগত দানের মাধ্যমে । দ্য প্রাইমেটস ওয়ার্ল্ড রিলিফ এন্ড ডেভেলপমেন্ট, অ্যাংলিকান চার্চ অব কানাডা (২০০০ ডলার), অটোয়া ইউনিটারিয়ান কংগ্রিগেশ্যন (২০০ ডলার), প্ল্যান নাগুয়া (১০০০ ডলার), এছাড়া ব্যক্তিগত দান (ছয়জন ব্যক্তি), যারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ৫০০০ ডলার দিলেন সাধারণ তহবিলে। তাছাড়া, প্রতিটি দত্তকে ইচ্ছুক পরিবারও আশ্বাস দেন যে, তারা তাদের শিশুর জন্য প্রয়ােজনীয় বিমান ভাড়া ও অন্যান্য খরচের টাকা দেবেন । ১৯৭২-এর জুন মাসের শেষ নাগাদ যখন এফ এফ সি’র দলের সদস্যরা বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় ৫,১০৫ ডলার বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার নিকট থেকে সহায়তা হিসাবে সংগ্রহ করে । এফ এফ সি স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য এটি একটি নৈতিকতা দৃঢ় করার মতাে ইতিবাচক ঘটনা । তারা তাদের তহবিল গঠন উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখেছেন মনে করে উল্লসিত হয়।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এবং বাধাসমূহ বাংলাদেশে পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের বৃত্তান্ত শুনে বহু কানাডীয় অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করেন। অনেকের আবার ভিন্নজাতের মধ্যে দত্তক নেয়া দেয়ার ব্যাপারটা ভালােলাগে নি । এফ এফ সি সদস্যরা কানাডীয় পরিবারের সংজ্ঞাকে সম্প্রসারিত করে জাতপাত ও ত্বকের রং পেরিয়ে বৃহত্তর মানসিক পরিসরে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ফ্রেড যখন তার মন্ট্রিয়লের সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রকল্পের কথা তুলেছিলেন, উপস্থিত দ্রজনের মধ্য থেকে কয়েকজনকে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে শােনা গিয়েছিল । ঐ জামাতের পুরনাে সদস্যদের অনেকে আন্তর্জাতিক দত্তক নেয়া কেবল অপছন্দই করতেন যে তা নয়, তারা বিষয়টির রীতিমতাে খােলাখুলি বিরােধী ছিলেন। মন্ট্রিয়ল এলাকার খবরের কাগজ এবং গির্জার নিউজলেটারে ধারাবাহিকভাবে চিঠি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার যৌক্তিকতা। বিষয়ে । অনেকের বক্তব্য ছিল, দত্তক নিতে হলে কানাডীয় শিশুই প্রথম নেয়া উচিত বিতর্ক যেসব ইস্যু ঘিরে, তাদের মধ্যে ছিল: দত্তক নেবার সংখ্যা; কানাডীয় শিশু ও প্রাপ্যতা; স্থানীয় এবং এস্কিমােদের শিশু; বেশি বয়সের শিশু,“যে সব শিশুকে দত্তক দেয়া কঠিন (অর্থাৎ, বৈকল্যদুষ্ট ও বিশেষ যত্নের প্রয়ােজন এমন শিশু), আইন কানুন কানাডার ভেতরে এক প্রদেশ থেকে অন্যত্র দত্তক দেয়া নেয়া সহর্জতর করার প্রয়ােজনীয়তা। স্থানীয় শিশুদের (কানাডীয়) নেবার প্রয়ােজন বিষয়ে জোর দিয়ে ঐ জামাতের এক সদস্য। বলেন, যদি তার পাশের বাড়ির মানুষের সহায়তা প্রয়ােজন হয়, তিনি সময় ও অর্থ ব্যয় করে দেশের আরেক প্রান্তে কেউ বিপদে পড়েছে কিনা সেটা দেখতে যাবেন কেন। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশ থেকে শিশু আমদানি করার বিষয়টিকে আমার কাছে অর্থহীন মনে হয় । * মন্ট্রিয়ল থেকে আগত একজন কথাটি বলেন, যিনি বিদেশ থেকে দত্তক আনার বিপক্ষে ছিলেন। ঐ ব্যক্তি আরও জানালেন, “ভারতের সমস্যা কখনাে মিটবে না যতদিন না তারা নিজের দেশের দুস্থদের কষ্ট দূর করার জন্য কিছু না করে,”।
শান্ত মাথায় এফ এফ সি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারেন এ বিশেষ ব্যক্তি বাংলাদেশ যে একটি নতুন স্বাধীন দেশ সে বিষয়ে তার অজ্ঞতাই প্রকাশ করেছেন। কেননা বাংলাদেশ একটি সদ্যস্বাধীন দেশ যেটি পাকিস্তান নামক দেশের একটি অংশ ছিল, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে যার জন্ম হয়েছিল। আবার অনেকে বিতর্ক করেন যে কানাডা অনুমােদন করলেও আন্তর্জাতিক দত্তক প্রথায় সমস্যার সমাধান হবে না কারণ এখানে বহুসংখ্যক শিশুর জন্ম হতে পারে – ৫০০০ অথবা ঐ রকম । তর্কবিতর্কে না গিয়ে এফ এফ সি’র সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল: “যে ক’টি শিশুকে বাঁচানাে যায়, তার জন্য চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?” ক্যাপুচিনােরা চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে যাই ঘটুক কানাডা যেন বাংলাদেশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে না রাখে।
এদিকে ১৯৭২ সাল জুড়ে অটোয়াস্থ কানাডিয়ান কাউন্সিল অন সােস্যাল ডেভেলপমেন্ট (সি সি এস ডি) জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক কল্যাণকর কাজকর্মে নানা সংস্থা ও ব্যক্তিকে নিয়ে যারা ব্যাপৃত ছিল, বাংলাদেশের শিশুদের অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে আসছিল। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি জেনেভা ইন্টারন্যাশন্যাল সােস্যাল সার্ভিস (আই এস এস) কানাড়তেও সি সি এস ডি’র কাজের ব্যাপারে সম্পৃক্ত ছিল এবং আই, এস, এসএর সুপারিশের বিষয়ে অবগত ছিল।
ইতােমধ্যে সি, সি, এস, ডি বাংলাদেশের দুস্থ নারী ও শিশুদের কল্যাণে প্রস্তুত বিভিন্ন প্রকল্প। বাস্তবায়নে কানাডার অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনেক পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ সবাইকে। অবাক করে দিয়ে হঠাৎ সি সি এস ডি থেকে এমন কতকগুলাে বিজ্ঞপ্তি ইস্যু হয়েছিল, যা দত্তক সমর্থনকারী গ্রুপের জন্য কেবল যে নিরুৎসাহিত করেছিল তা নয়, ক্ষতিকরও মনে হয়েছিল। অদৃষ্টের পরিহাস, মিশ্র জাতির শিশুদের আন্তর্দেশিক এবং আন্তবর্ণীয় দত্তকের বেলায় প্রথম আপত্তি আসে সি সি এস ডি’র কাছ থেকে যার পরিচালক এ মর্মে সতর্ক করে দেন যে, যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার পক্ষে “তাড়াহুড়াে করে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।”২২ এতে আরও বলা হয়: “বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু আন্তর্জাতিক দত্তক বর্তমানে অবশ্যম্ভাবী হলেও পরিবারেরা যেন মনে রাখেন যে, দত্তক একটি জীবনভরের সিদ্ধান্ত দত্তক না নেবার ফলে নিজেকে অপরাধী ভাববেন না ।”২৩ দত্তক নেবার পক্ষপাতী যারা তারা সি সি এস ডি’র এ ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারেননি, একে দ্ব্যর্থবােধক বলা ছাড়া উপায় কী । সি সি এস ডি’রও প্রকৃত অবস্থান নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছিল। যেহেতু কানাডা ও বাংলাদেশ উভয় দেশের সরকার ইতােমধ্যে দত্তক দেয়া নেয়ার বিষয়ে সহমত হয়েছিলেন, কাজেই ফ্রেড এবং বনি এসব মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করে তাদের বিশ্বাসে অটল থেকেছিলেন যে, ওগুলাে কুসংস্কার, গোঁড়ামি এবং ঈর্ষার ওপর দাঁড় করানাে অভিমত।
অন্টেরিওর দম্পতিদের সমস্যা
অন্টেরিও সরকারের অভ্যন্তরে এফ এফ সি’র উদ্যোগের বিরােধিতা ইতােমধ্যে বেশ কিছুটা নেতিবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ প্রকল্প-এর বিরুদ্ধে নেতৃস্থানীয় সরকারি অফিসার ছিলেন তদানীন্তন ডিরেক্টর অব চাইল্ড ওয়েলফেয়ার, মিনিস্ট্র অব কমুনিটি এন্ড সােস্যাল সার্ভিসেস, বেটি গ্রাহাম (গ্রাহাম), ব্যক্তিগতভাবে যার অবস্থান ছিল আন্তর্জাতিক দত্তকের বিপরীতে সেটা প্রমাণিত হয়েছিল এক বছর পরে । দত্তক প্রক্রিয়ায় সহায়তা যােগানাে এবং প্রক্রিয়ায় আওতাধীন হােমস্টাডির বিষয়ে কাজ ত্বরান্বিত করার পরিবর্তে তার মন্ত্রণালয়ের সরকারি সমাজকর্মী দত্তক নেবার প্রক্রিয়ায় ইচ্ছাপূর্বক বাধার সৃষ্টি করেছিলেন। ব্যাপারটাকে দ্বিতীয় প্রাধিকার দিয়ে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি, বিপদ এবং অস্থিতিশীলতার কারণ দর্শনের মাধ্যমে ।
দত্তক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার জন্য প্রয়ােজনীয় হােমস্টাডি সম্পাদন প্রক্রিয়ায় অন্টেরিওর কর্মকর্তারা নানা অজুহাত তুলে দেরি করানাের চেষ্টা করেছিলেন। তারা দম্পতির কাছ থেকে আরও বেশি এবং অনাবশ্যক তথ্য জানতে চান যার ফলে আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থা বিষয়ে। ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ বিষয়ে অন্টেরিও অটোয়াকে (ফেডারেল সরকারকে) এ মর্মে দোষারােপ করেন যে, বাংলাদেশ তার শিশুদের বিদেশে দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রে অনুমােদন দেবে কিনা সেটা অটোয়া প্রথম সবাইকে জানানাে উচিত। ১৯৭২-এর বসন্তকালের পুরােটা এবং গ্রীষ্মকালের শুরুতে অন্টেরিও’র আবেদনকারীরা অনেক হয়রানির মধ্য দিয়ে যান, কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনাে পরিষ্কার দিকনির্দেশ পাননি । প্রশ্নের উত্তর লিখিত বা ফোনে সুচিন্তিতভাবে বিলম্ব করছিলেন। তখনও অনুসন্ধানকারীদের বলা হত তথ্যের গােপনীয়তা রক্ষার জন্য অনেক সময় অনেক তথ্য দেয়া সম্ভব নয়। হােমস্টাডি বিষয়ে নানা চিঠি আদান প্রদান সত্ত্বেও কেউই এ বিষয়ে বেশি এগুতে পারেননি।
একে অন্যের সঙ্গে প্রাপ্ত তথ্য বিনিময় করে অন্টেরিওর আবেদকারীরা জানতে পারলেন যে অন্টেরিও সরকার নয়, গ্রাহাম নিজেই সকল অসহযােগিতার মূলে। যাহাম এর মতে, অন্টেরিও প্রদেশে দত্তক নেবার উপযােগী শিশুর অভাব নেই। বিদেশি শিশু, বিশেষ করে, এশীয় শিশুরা অপুষ্টিতে ও নানা রােগে ভােগে। তাদের মাথা ভর্তি উকুন । এ্যাহামের আন্তর্জাতিক দত্তকের বিপক্ষে আওড়ানাে যুক্তির কয়েকটি ফ্রেড ক্যাপুচিনাে দত্তক সমর্থনকারীদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন।
এ্যাহামের অসহযােগিতা এবং চিঠির অসঙ্গতিপূর্ণ জবাবে আবেদনকারী গুড়’রা (ডেল ও ডরিন গুড) কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন, যখন তারা অর্থহীন কয়েকটি চিঠি পেয়েছিলেন। অবাক হবার কিছু নেই, গুড় পরিবারকে গ্রাহাম লেখেন: “আমরা যাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পেরেছি তারা ইঙ্গিত করছেন যে এ শিশুদের যে সহায়তা দরকার সে বিষয়ে আমাদের খবরের কাগজে বেশি বেশি করে বাড়িয়ে লেখা হয়েছে। সম্প্রতি যে দুঃসময় পার হয়েছে, তার থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় ধরনের প্রয়াস চলেছে; উল্লেখযােগ্য পরিমাণে কানাডীয় সহায়তা এ প্রক্রিয়ায় কাজে লেগেছে।”২৪ আর্কাইভস-এ সংরক্ষিত চিঠিপত্র পরীক্ষা করলে দেখা যায় গ্রাহাম একই আবেদনকারীকে আবার লিখেছেন, “আমরা ফেডারেল কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে যা জানতে পেরেছি, তাতে বােঝা যায় বাংলাদেশ সরকার এ মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে বাইরে শিশু দত্তক আনার জন্য অনুমােদন নাও নিতে পারে। বাংলাদেশের শিশুদের প্রাপ্যতা বিষয়ে আমরা আর কিছু জানতে পারি নি।”২৫ একই চিঠিতে গ্রাহাম আবেদনকারীকে আবারও জানিয়েছেন যে, “যদি তারা অন্টেরিও’র কোনাে শিশু দত্তক নিতে চান, তাহলে তিনি নিশ্চিত যে তাদের “স্থানীয় চিলড্রেন’স এইড সােসাইটি দ্রুততার সাথে এ বিষয়ে সহায়তা করে।
যদিও আশ্চর্যান্বিতভাবে আহত, গু দম্পতি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এরকম আরেকটি চিঠি পান গ্রাহামের নিকট থেকে যাতে লেখা ছিল: “আমি কোনাে অনুমােদন দিতে পারব না যতক্ষণ না আপনাদের স্থানীয় চিলড্রেনস এইড সােসাইটি থেকে ইতিবাচক কোনাে হােমস্টাডির রিপাের্ট না আসে।”২৭ অন্টারিও’র দম্পতিরা গ্যাহামের ক্রমবর্ধমান কানাডিয়ানিজম, দেশপ্রেমের জোয়ারে উদ্বেল হওয়া দেখে অবাক হয়েছেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু তারা গ্রাহাম এর সাথে একমত না হয়ে অন্যান্য দত্তকে ইচ্ছুক দম্পতিদের মতাে গ্রাহামের যুক্তিগুলােকে অসার হিসাবে গণ্য করেন।
গুড়সদের মতে গ্রাহামের বক্তব্যসমূহ নৈরাশ্যজনক এজন্য দীর্ঘায়িত সময় নেবার জন্যই এসব বলা, যাতে তারা কানাডাতেই দত্তকের জন্য শিশুর খোঁজ করেন। গ্রাহামের যুক্তি যে তাকে অটোয়া থেকে জানতে হবে এজন্য যে, যুদ্ধশিশুদের দত্তকের জন্য ফেডারেল সরকার কানাডাতে ঢুকতে দেবে কিনা, অন্টেরিওর আবেদনকারীদের কাছে সেটা মনে হয়েছে শুধুমাত্র নিরুৎসাহিত করার জন্যই ঐ কথা তিনি বলেছেন।
মজার ব্যাপার, অসংখ্য অভিযােগ ও অনুসন্ধানের অনুরােধ পাওয়ার পর অন্টেরিও তার এক্সটার্নাল এফেয়ার্সে-এর মাধ্যমে অটোয়ার সাথে (অর্থাৎ ফেডারেল সরকার) যােগাযােগ করেন এভাবে লিখে: “বাংলাদেশ সরকার কি তার নাগরিকদের দেশত্যাগের অনুমােদন করেন? এই শিশুদের যুদ্ধশিশু অন্যদের সঙ্গে মিলনে কি স্বাস্থ্য, অভিবাসন কিংবা অন্য কোনাে সমস্যার কারণে বাধা আসবে? এসব শিশুরা যে এখানে আসুক বা আসতে দেয়া হােক আমরা ঠিক সেটা বলতে চাচ্ছি না। বরং আমরা কেবল আমাদের নিকট যে সব প্রশ্ন আসছে সেগুলাের উত্তর দেবার জন্য তথ্য চাচ্ছি।
এটা স্পষ্ট যে, অনুসন্ধানী পত্রের বার্তাটি হলাে, যেহেতু অন্টেরিও আগ্রহী নয়, এরা বাংলাদেশ থেকে দত্তক নিতেও চায় না, কিন্তু বেশ কয়েকটি অন্টেরিও দম্পতির কিছু জিজ্ঞাসা রয়েছে, তারা সেগুলিরই ব্যাখ্যা চাচ্ছেন । মজার ব্যাপার হলাে, আবেদনকারীরা কোনাে দিক দিয়েই নিরুৎসাহিত হননি। বরং সর্বতােভাবে সজ্জিত হয়ে গ্রাহামের। একগুঁয়েমির জবাব দিতে তৈরি হয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল, যেহেতু বাংলাদেশ ও কানাডা সরকার যেখানে সহমত হয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশে কানাডাস্থ হাই কমিশনার এফ এফ সি-কে জানিয়েছেন, সেক্ষেত্রে মিনিস্টারের কর্মকর্তারা সব জানার পরও মিনিস্টার কেনই বা ফেডারেল সরকারকে সে বিষয়ে জানাবার জন্য চিঠি লিখতে যাবেন, সেটা কিছুতেই তাদের বােধগম্য হচ্ছিল না।
প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে তারা প্রতিজ্ঞা করেন, তারা তাদের পছন্দের শিশুদের অবশ্যই বাড়ি নিয়ে আসবেন। প্রতিটি দম্পতির প্রতিদিনের শেষে এ বিষয়ক শপথ আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। ১৯৭২ এর ৮ জুন নাগাদ রেনে ব্রুনেল, তদানীন্তন মিনিস্টার অব কমুনিটি এন্ড সােস্যাল সার্ভিসেস, গভর্নমেন্ট অব অন্টেরিও বলেন যে, তার সরকার ফেডারল সরকারের বিদেশি দত্তক বিষয়ক অবস্থান, বিশেষ করে বাংলাদেশি শিশু দত্তক আনার বিষয়ে জ্ঞাত নন; গুড় দম্পতি যােগাযােগ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জোর দিয়ে বলেন যে, হােমস্টাডি করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে এটা কারাের পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হয় না যে তারা তাদের যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে আসার জন্য অনুমােদন দেবেন কিনা। এ কথা সত্য যে, ফেডারেল সরকার ১৯৭২-এর জুনের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে এ মর্মে কিছু জানতে পারেননি। কিন্তু অন্টেরিও সরকার অবগত ছিলেন যে বাংলাদেশ সরকারের অভিপ্রায় বিষয়ে বনি কাপুচিনাে সবাইকে পরিষ্কার লিখে বিজ্ঞাপিত করেছিলেন যে, তারা নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন। ১৯৭২-এর জুনের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ ব্রুনেল এবং অন্যান্য দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা মিচেল শার্প (মিনিস্টার অব এক্সটার্নাল এফেয়ার্স)-এর একটি চিঠি পান, যেটা তিনি প্রধানমন্ত্রী পিয়ের এলিয়ট ট্রুডাে’র পক্ষে লিখেছিলেন: “আপনি শুনে সুখী হবেন যে আমাকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন যে, বিদেশি নাগরিকেরা যাতে বাংলাদেশি শিশুদের দত্তক নিতে পারেন, সে মর্মে নীতিগত অনুমােদন দেয়া হয়েছে ।”২৯ প্রাদেশিক সরকারের নিকট লেখা চিঠিতে শার্প এ প্রক্রিয়া-ও ব্যাখ্যা করেন যেটা আবেদনকারীরা অবশ্য ইতােমধ্যে বারবার নানা সূত্রে শুনে বিষয়টি সম্পর্কে মােটামুটিভাবে অবগত হয়েছেন।
তার পরপরই একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল মিনিস্টার ব্রুনেল-এর অফিস থেকে, তারিখ ১৯ জুন, ১৯৭২, অন্টেরিও সিটিজেন্স। বিজ্ঞপ্তি থেকে নিশ্চিতভাবে জানা গেল যে বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেয়া যাবে। কিন্তু এ খবরটা জানার পরপরই সবাই আবার অবাক হয়ে গেলেন গুডস্ পরিবারের নিকট পাঠানাে একটি টেলিগ্রামের বিষয়ে শুনে। সেটাতে লেখা ছিল, যেহেতু স্থানীয় সি এ এস এখনও হােমস্টাডি করেনি, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার ডিরেক্টর সে বিষয়ে আর কিছু করতে পারবেন না।
অন্টেরিও আবেদনকারীদের দুশ্চিন্তার মাত্রা পারা আরেক ডিগ্রি উপরে উঠে যখন গুজব রটে যে, বাংলাদেশি শিশুদের জন্য হােমস্টাডি সকলের কাজ বন্ধ থাকবে যতদিন না টরন্টো থেকে গ্যাহাম তাদের সে কাজ সম্পন্ন করার আদেশ দেন। গুজবটি শীঘ্রই সত্য বলে যখন প্রতিষ্ঠিত হলাে অন্টেরিওর ক্রুদ্ধ আবেদনকারীরা তখনও আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন যে দত্তকের জন্য সংগ্রাম তারা চালিয়েই যাবেন।
এ ধরনের এলােমেলাে অবস্থার মাঝে সবাইকে আবারাে অবাক করলেন বেটি গ্রাহাম। ইতােমধ্যে অন্টেরিওর এসপানােলা নিবাসি ফিল এবং ডায়ান হঠাৎ করে গ্রাহামের নিকট থেকে সত্যিকারের একটি দত্তক অনুমােদনের পত্র পেয়ে তারা বিশ্বাস করতে পারেননি সত্যিকার অর্থে কী হচ্ছে সেটা ভেবে। সবাই খুব বিস্মিত হয়েছিলেন এজন্য যে, কোনাে আবেদনকারা তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে কোনাে তথ্য তখনও পর্যন্ত পাননি। সকল আবেদনকারীর জন্য হােম স্টাডি এতদিনে সুসম্পন্ন হয়ে যাবার কথা ছিল।
বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক জবাব পেয়ে এফ এফ সি’ও প্রায় তৈরি, বাংলাদেশে যাবার জন্য দিন গুনছে। অনন্যোপায় হয়ে সরকারের প্রয়ােজনীয় হােমস্টাডির। প্রয়ােজন মেটাতে, অন্টেরিওর আবেদনকারী অন্টেরিওর স্বনামখ্যাত সমাজকর্মী ক্রিষ্টিন জনসটন-কে গিয়ে ধরলেন, তিনি যদি মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সময় বাঁচাতে অন্তবর্তীকালে হােমস্টাডিগুলাে অনুগ্রহ করে সম্পন্ন করে দেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল গ্রাহামের অফিস। থেকে তাদের জানানাে হয়নি। অন্টেরিওর আবেদনকারীরা জানতে পারেননি জনস্টন কর্তৃক সম্পন্ন হােম স্টাডি গ্রাহামের দপ্তর গ্রহণ করবেন কিনা; অথবা কত তাড়াতাড়ি মন্ত্রণালয়। দত্তকের জন্য নিজস্ব মূল্যায়ন সম্পন্ন করবেন। এসব বিষয়ে তাদেরকে কিছুই জানানাে। হয়নি ।
অন্টেরিও’র অফিস কেবল আবেদনকারীদের বিষয়ে কালক্ষেপণ করে বাংলাদেশ সরকার। এবং ফেডারেল সরকারের ওপর দোষ চাপাচ্ছিলেন। আবেদনকারীরা বুঝতে কোনাে কষ্টই হয়নি যে, অন্টারিওর অসহযােগিতা, দীর্ঘসূত্রিতা এবং ঢিলেমি কৌশল-এর সবটাই উদ্দেশ্য প্রণােদিত। ১৯৭২ সালের জুলাই প্রথম সপ্তাহের আগে অন্টেরিও আবেদনকারীদের জানানাে হয় যে, কোনাে দম্পতি বাংলাদেশ থেকে শিশু দত্তক আনতে আগ্রহী হলে তারা সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের মিনিস্ট্রি অব সােস্যাল ওয়েলফেয়ার-এর সচিব জনাব হামান উজজামানকে এ মর্মে চিঠি লিখতে পারেন বলে বিষয়টি এভাবে অবগত করেন: বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের শিশুদের বিদেশি নাগরিকদের দ্বারা দত্তক নেবার সুবিধার জন্য কর্মপ্রক্রিয়া এবং নিয়মকানুন তৈরির কাজ করছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রয়ােজনীয় তথ্যাদি সকলে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, সেগুলি হস্তগত করে বসে থাকা সত্ত্বেও অন্টেরিও ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়ে আবার খোজ নিতে লাগলেন যাতে তারা “ঐ বিষয়ে তারা। বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন; এবং আবেদনকারী অভিবাসন আইন অনুসারে এ বিষয়ে কোনাে প্রত্যয়নপত্র জমা দেবেন কিনা।” এটা বুঝতে কারােরই কোনাে অসুবিধা হয়নি যে এ
সব কালক্ষেপণের কৌশল।
এদিকে জুলাই-এ মন্ত্রী প্রকাশ্যে সহযােগিতার আশ্বাস দিলেও কার্যত তাদের ফাইল ইচ্ছা। করে আটকে রেখেছিলেন। ফলে আবেদনকারীরা একই সঙ্গে চূড়ান্ত হতাশ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। গ্রাহামের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মনােভাব, সম্রাজ্ঞীর মতাে ভঙ্গি এবং প্রগলভ মন্তব্য তাদের অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করে তােলে। আশ্চর্যের বিষয় এতকিছুর পরও, এফ এফ সি এবং আবেদনকারীরা ধৈর্য হারিয়ে হাল ছেড়ে দেননি, তারা তাদের বাংলাদেশ প্রকল্প নিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করেই এগােচ্ছিলেন।
ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্বসমূহ শেষ পর্যন্ত সবাই এরকম প্রশ্ন করা শুরু করেন: ফেডারেল সরকারের ভূমিকা কী? একটি শিশু যে প্রদেশে যাচ্ছে এবং যে প্রদেশ থেকে আসছে সেখানকার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অথরিটির। পরস্পরের সহযােগিতায় কী ভূমিকা পালন করবে? অন্টারিও আবেদনকারীদের অভিযােগ ছিল যে, সরকার তাদের অবহেলা ও নাজেহাল করেছিলেন অভীষ্ট লক্ষ্যে; অর্থহীনভাবে এটা ওটা বলে একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে পাঠাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, পরস্পরবিরােধী তথ্যও সরবরাহ করা ও সংগ্রহের অভাব ছিল না। প্রথম থেকেই আবেদনকারীরা যে জবাব পেয়েছেন, তাতে ভুল বােঝাবুঝি বেড়েছে, শেষ পর্যন্ত অন্টেরিও প্রদেশে কর্মকৌশল নেয়ার বিষয়টি ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল । আন্তপ্রাদেশিক ইস্যুর বিরােধগুলি সাধারণ, এ কথা বুঝে প্রধানমন্ত্রীর অফিসও ইতস্তত করেননি একথা বলতে যে, (ফ্রেডের চিঠির উত্তরে যাতে তিনি অন্টেরিওর দত্তক ইস্যুতে দেরি করার কারণ জানতে চেয়েছিলেন) “প্রদেশগুলাে তাদের আইনি অধিকার ও সক্ষমতা নিয়ে অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত এবং ফেডারেল কার্যব্যবস্থাকে পরিবর্তন না বলে পরিবর্তনের বিরােধিতা নিবেদিত অনড় ভাব’ বলা যায় ।
ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারি নথি পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ফেডারেল সরকার বিদেশ থেকে দত্তক আনার প্রক্রিয়া সবসময় স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। দুপায়ের সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্বসমূহ বিস্তারিত বলতে গিয়ে ব্যক্ত করেন যে, দত্তক একটি প্রাদেশিক দায়িত্ব এবং অভিবাসন ফেডারেল দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ প্রকল্প-এর গুরুত্ব বুঝে ফেডারেল সরকার গােড়া থেকেই এ বিষয়ে ইতিবাচক মনােভাব দেখিয়ে সহায়ক ভূমিকা। পালন করেছেন।
১৯৭২-এর মার্চ, যখন ক্যাপুচিনোেরা দত্তকের জন্য তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজ চালান, ব্রাইস ম্যাক্যাসি, তদানীন্তন মিনিস্টার অব ম্যানপাওয়ার এন্ড ইমিগ্রেশন পরিষ্কার জানিয়েছিলেন যে, তার অফিস বাংলাদেশে প্রচলিত কোনাে দত্তক বিষয়ক আইনের সম্পর্কে। অবগত নন। মন্ত্রী ম্যাকাসে তথাপি প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে ক্যাপুচিনােদের এ মর্মে আশ্বস্ত করার জন্য লিখেন যে একটি শিশুকে দত্তক নিতে হলে সেখানে ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকার এবং ক্যানাডিয়ান কাউন্সিল অন সােস্যাল ডেভেলপমেন্ট এবং ইন্টারন্যাশন্যাল সসা
স্যাল সার্ভিস-এর সম্পৃক্ততা ও সংশ্লিষ্টতার প্রয়ােজন ।
আবার, ফেডারেল নথিপত্রও ইঙ্গিত করে যে, বাংলাদেশ থেকে বহু প্রতীক্ষিত খবর আসার পর জুনের প্রথমদিকে ডিপার্টমেন্ট অব এক্সটার্নাল এফেয়ার্সের উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকেরা শার্পকে (মন্ত্রী) এভাবে অবগত করেন: “অটোয়ার বাংলাদেশ হাই কমিশন আমাদের এ মর্মে জানিয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশি শিশুদের বিদেশি নাগরিকের দ্বারা দত্তক নেওয়ার প্রস্তাবনা অনুমােদন করেছেন। তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সংক্ষিপ্ত নির্দেশ ও উপদেশাবলির প্যাকেজ পাওয়ার পরই শার্প প্রাদেশিক সরকারদের অবগত করেন।
ফেডারেল পর্যায়ে অগ্রগতি লাভের পর, অন্টেরিও যে দীর্ঘসূত্রিতার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন সেটা আরও পরিষ্কারভাবে সবাই বুঝতে পারে। কারণ এত চিঠিপত্রাদি আদান। প্রদানে এবং সবকিছু অবগতির পরও মন্ত্রনালয় দত্তকে ইচ্ছুক অন্টেরিও দম্পত্তিদেরকে জানালেন যে, তারা এ বিষয়ে বিশদ তথ্যাদি এখনও পাননি। আদর্শগতভাবে অন্টেরিও ইতােমধ্যে অবগত হওয়ার কথা যে, কানাডীয় ফেডারেল সরকারও এ বিষয়ে নীতিগতভাবে সহমত হয়েছে। প্রচলিত নিয়মানুসারে, হােমস্টাডি পরিচালনা করার জন্য অন্টেরিও সরকারের এ তথ্য জানার কোনাে আবশকতা নেই। কারণ হােমস্টাডি সম্পন্ন করার উদ্দেশ্য হলাে, যােগ্যতা যাচাই করা । যদি আবেদনকারী মা-বাবার বাড়ি উপযুক্ত হয়, তাহলে তাদের দত্তক নেবার অনুমােদন দিয়ে দেওয়া। পরিবর্তে, অন্টেরিও’র নিকট প্রয়ােজনীয় সব তথ্য। থাকা সত্ত্বেও, প্রাদেশিক অফিস আবেদনকারীর নিকট একের পর এক অতিরিক্ত তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছিলেন। আবার একই সময়ে আবেদনকারীদের লিখে জানালেন যে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে অন্টেরিও সরকার সহযােগিতা করতে সবসময় প্রস্তুত। এ ধরনের নিশ্চয়তা যে পুরােপুরি ভিত্তিহীন সেটা বুঝতে কারােরই সময় লাগেনি।
বস্তুতপক্ষে প্রয়ােজনের অধিক সময় নেয়ার যে কৌশল অন্টেরিও অনুসরণ করে আসছিল, সেটা আরও পরিস্কার হয়ে যায় প্রাদেশিক ও ফেডারেল সরকারের চিঠি পত্রাদির মাধ্যমে। অন্টেরিও সরকার যে, আরও তথ্য জানার প্রয়ােজন দাবি করে আবেদনকারীদের হয়রানি। করেছেন মাসের পর মাস এ বিষয়ে আর কারাে সন্দেহ থাকেনি। উদাহরণস্বরূপ সংক্ষিপ্ত অভ্যন্তরীণ নির্দেশাবলি যেভাবে ম্যানপাওয়ার এবং ইমিগ্রেশন মন্ত্রীকে প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে অবগত করা হয়েছিল সেটা উল্লেখ করা যেতে পারে: “সংযুক্ত মেমােরেন্ডামে যেমন ইঙ্গিত করা হয়েছে, নিয়মকানুন অনুসারে শিশুদের আসবার ব্যাপারে কোনাে বাধা নেই, একথা যেমন সত্যি, তেমনি একথাও সত্যি যে এ ডিপার্টমেন্ট কোনাে ব্যবস্থা নিতে পারবে না যতক্ষণ না প্রাদেশিক সরকারের অনুমােদন পাওয়া যায়। একবার এটা দেয়া হয়ে গেলে, হংকং এর অভিবাসন দপ্তর তখনও একটি একটি করে কেইস প্রক্রিয়াকরণ শুরু করে।
প্রসঙ্গত এ বিষয়ে রেফারেন্স ছিল, অন্টেরিও সরকারের যাতে হােমস্টাডিগুলাে সম্পূর্ণ করতে অপরিমিত সময় নেয়া হচ্ছিল, যদিও মিনিস্টার হেলকে ফেরির অনশন ধর্মঘটের পর আবেদনকারীদের আশ্বস্ত করেছিলেন । বাস্তবিকপক্ষে সেটা একদমই হয়নি। ফেডারেল সরকারের দলিলাদি থেকে জানা যায় যে, ১৯৭২-এর জুলাই-এর প্রথম সপ্তাহে শার্প এবং ম্যাক্যাসে ফেডারেল সরকারের আবেদনকারীদের নিশ্চিতভাবে জানাতে সক্ষম হন। যে তারা বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে সরাসরি দত্তক বিষয়ে জানতে পেরেছেন। কালক্ষেপণ না করে তারা দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা এবং প্রাদেশিক সরকারদের জানিয়েছিলেন যে “বাংলাদেশ সরকার তাদের জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নীতিগতভাবে বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশি শিশু দত্তক নেয়া অনুমােদন করেছেন। ঢাকাস্থ মিনিস্ট্রি অব সােস্যাল ওয়েলফেয়ারকে সহায়তা করছেন হােল্ট অ্যাডাপশন প্রােগ্রাম এবং ইন্টারন্যাশন্যাল সােস্যাল সার্ভিস অগানাইজেশন ।”৩৫ এত সবের পরেও গ্রাহামের দপ্তর যথারীতি এটা-ওটা বলে মূল কাজে বিলম্ব ঘটাতে থাকেন। কাউকে হােমস্টাডির তারিখ নিয়ে, আবার সে তারিখ বদলিয়ে আরেকদিন ধার্য করে নানা অজুহাত দেখিয়ে । মােটামুটিভাবে তারা সবাইকে যা বলেছিলন সেটা ছিল অনেকটাই এ ধরনের যে, তারা এখনও বাংলাদেশ থেকে আরও তথ্য। অটোয়া মাধ্যমে পাবার অপেক্ষায়। কিন্তু(আমরা এ অধ্যায়ের বাকি অংশটুকুতে দেখতে পাবাে) কেমন করে অবস্থা আরও শােচনীয় আকার ধারণ করে। অঙ্গীকারবদ্ধ অন্টেরিও। দম্পতিদের ধৈৰ্য্য ও দৃঢ়সংকল্পের দৃষ্টান্ত পরিস্কারভাবে ফুটে উঠবে এ অধ্যায়ের শেষে। আমরা জানতে পারব কীভাবে তারা ঐকমত্যে সংঘবদ্ধ কাজ করে প্রাদেশিক সরকারকে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করেন।
সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা এবং নেটওয়ার্ক ফ্রেড ও বনি এফ এফ সি’র পক্ষ থেকে ফেডারেল এবং প্রাদেশিক পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রেখেছিলেন। প্রাদেশিক পর্যায়ে এফ এফ সি প্রথমদিকে অন্টেরিও মিনিস্টার অব কমিউনিটি এন্ড সােস্যাল সার্ভিসেস-এর নিকট বনি সরাসরি আপিল করেন অন্যান্য দত্তক নিতে ইচ্ছুক মা-বাবার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
তার প্রধান যুক্তি ছিল। এটাই যে, কানাডার বাকি প্রদেশগুলাে, যেমন- কিউবেক, নােভা স্কোশিয়া এবং সাসক্যাচিউয়ান সরকার ইতােমধ্যে আবেদনকারীদের অনুমােদনপত্র দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অন্টেরিওতে গ্রাহাম এ বিষয়ে ভিন্নমত পােষণ করে বারবারই বলার চেষ্টা করেছেন যে, যদি বাংলাদেশ থেকে শিশু দত্তক নেবার ঘটনা ঘটে এবং সেটা যদি কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের অনুমােদন লাভ করে, অন্টেরিও’র কোনাে আপত্তি সে ক্ষেত্রে থাকবে না। তার মন্তব্যের মধ্যে যে এক ধরনের কপটতা ছিল সে বিষয়ে আবেদকারীদের কোনাে সন্দেহ ছিল । কারণ এ কথা সবারই জানা ছিল গ্রাহাম ইতােমধ্যে লিখিতভাবে কানাডীয় এবং বাংলাদেশি সরকারের নিকট থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন যে দুদেশই এ ব্যাপারে একমত, যদিও বাস্তবায়নের ব্যাপার চূড়ান্ত তখনও হতে বাকি।
এমতাবস্থায় এফ এফ সি আবারও নিজে অন্টেরিও কমিউনিটি এন্ড সােস্যাল সার্ভিসেস মস্ত্রিকে অনুরােধ করে অন্টেরিও দম্পতিদের হয়ে অবিলম্বে এ কার্যব্যবস্থা নিতে: “যদি মিজ গ্রাহাম প্রাদেশিক চুক্তিনামা স্বাক্ষর না করেন, তাহলে কি আপনি মানবিক স্বার্থ বিবেচনায়, চিঠিগুলাে সই করে পাঠাবেন? বাংলাদেশে শীঘ্রই বর্ষা শুরু হবে। আমরা আশা করব, কানাড়াতে যাদের আসার কথা, সেসব শিশুরা বর্ষা এবং তার মহামারী রােগে আক্রন্ত হওয়ার। আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে আসতে পারবে।” একই সঙ্গে বনি কাপুচিনােও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে হাত বাড়ান । এফ এফ সি, শেরব্রুকস্থ প্রফেসর হুসাইন এবং অটোয়া’র বাংলাদেশ হাই কমিশনারের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে একটি আবেগপূর্ণ চিঠি লিখেন। সেটা ছিল এমন; “যুদ্ধে নিপীড়িত নারীদের দুর্দশার কথা শুনে, যে শিশুরা অত্যাচারিতা মায়েদের গর্ভে এসেছিল, তারা যখন জন্ম নিচ্ছে, এখন তাদের ভবিষত ভেবে এবং অপরাপর নিস্পাপ অনাথ শিশুদের কথা ভেবে আমরা কয়েকজন শিশুকে দত্তক নিয়ে তাদের প্রয়ােজনীয় আদর ভালােবাসা দিয়ে নিজেদের সন্তানের মতাে বড় করে তুলব, আশা করি।” আর্কাইভস-এ সংরক্ষিত নথি অনুযায়ী বনি একই রকম চিঠি লিখেছিলেন বাংলাদেশ সরকারেকেও, যেমন, সেখানে রয়েছে এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং আব্দুস সামাদ আজাদকে, তদানীন্তন মিনিস্টার অব রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন (বাংলাদেশ) এবং মিনিস্টার অব ফরেন এফেয়ার্স (বাংলাদেশ)। ঐসব চিঠিতে এফ এফ সি-এর পক্ষে বনি লিখেছেন, কানাডাতে তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং এফ এফ সি কী অর্জন করতে চায়, ইত্যাদি। বনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন কারাে যেন তাদের সংস্থার মহৎ উদ্যোগ সম্পর্কে ভুল ধারণা না জন্মে। লক্ষণীয় যে একই সময়ে বনি আবেদনকারীদেরকে উপদেশ দিয়ে কীভাবে চিঠি লিখতে হবে, সে বিষয়েও উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন একাধিকবার । যদি বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের চিঠি লিখতে হয়। তবে নিচে বর্ণিয় নমুনা অনুযায়ী লেখার চেষ্টা করা উচিত জানিয়ে বনি আরও লিখেন: “চিঠিতে লিখবেন যে, আপনি মনে করেন বাংলাদেশি শিশু দত্তক নিয়ে সম্মানিত হবেন, বাংলাদেশের অনুন্নত অবস্থা বিষয়ে কিছু লিখবেন না, ইত্যাদি। বাংলাদেশ। থেকে একটি শিশু দত্তক নিতে পারলে আপনাদের পরিবার এতে যারপরনাই সম্মানিত হবে। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে, দত্তক শিশুকে আমরা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। বিষয়ে সচেতন করে তুলব।
সাস্ক্যাচিউয়্যন প্রদেশের সাসকাটুন শহরস্থ ড. রবিন ও বারবারা মরাল ছিলেন প্রথম আবেদনকারী যারা বাংলাদেশ সরকারকে বাংলাদেশ থেকে একটি যুদ্ধশিশু দত্তক নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে লিখেছিলেনঃ “আপনাদের অনুমতি পেলে আমরা আপনাদের দেশের একটি শিশুকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসে আদর-যত্নে লালন করার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। কারণ আমরা তখনও ধরে নেবাে যে, আমাদের ওপর আপনাদের সে বিশ্বাস ন্যস্ত করেছেন যে আমরা শিশুকে লালন করতে পারব।”৩৯ বারবারা তার চিঠি শেষ করেছিলেন এইভাবেঃ সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমাদের সৌভাগ্যে যা জুটেছে সেগুলােই ভােগ করতে পারবে এরকম একটি শিশু” । আমরা এখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও এ নিয়ে আলাপ করেছি। আমাদের ওপর এদের মা-বাবা হিসাবে বিশ্বাস ও ভরসা আছে বলে তারা এতসব কাগজপত্র দিয়েছেন আমাদের অনুরােধের গ্রহণযােগ্যতা বাড়াবার জন্য। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি, আপনারা আমাদের ওপর উপযুক্ত বিশ্বাস স্থাপন করবেন ও প্রয়ােজনীয় অনুমােদন দেবেন এবং আমাদের শুভেচ্ছা নেবেন।” আবার ফিরে আসা যাক অন্টেরিও প্রদেশের জটিল অবস্থানে। যদিও মে ১৯৭২ নাগাদ এফ এফ সি কানাডীয় ফেডারেল সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারকে সাফল্যের সঙ্গে লবি করে দত্তকের অনুমােদন নীতিগতভাবে পেয়েছিল, তবুও অন্টেরিওর প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে ওরা কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না।
অথচ অন্টেরিও প্রদেশে দত্তক নেয়ার কাজ বন্ধ করা হয়নি। কিন্তু আবেদনকারীদের আবেদন অনুযায়ী দত্তক প্রক্রিয়ার কাজ কিছুতেই এগােচ্ছিল। এলিজাবেথ মৌলিং এফ এফ সি’র একজন সক্রিয় সদস্য (যিনি প্রথম ব্যাচের একটি যুদ্ধ শিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন) একটি হাতে লেখা চিঠি সকল অন্টেরিও দম্পতিদের পাঠান, যারা হােমস্টাডির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একই সময়ে চাপ একটুও না কমিয়ে রেভারেন্ড মার্ভিন জি ম্যাকডারমট, টরন্টো এলাকার ধর্মীয় গােষ্ঠীর গণ্যমান্য ব্যক্তি, হেলকে ফেরি, চেয়ারপার্সন অব এশিয়ান অ্যাডাপশন এবং সচিব-কোষাধ্যক্ষ, অন্টেরিও এফ এফ সি ব্রাঞ্চ এবং ম্যারি জেইন টার্নার, যিনি তখনও আবেদনকারীদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলােচনা করেন। টার্নার এবং রেভারেন্ড ম্যাকডার্মট মিনিস্টার ব্রুনেলের সঙ্গে ৩১ মে ১৯৭২ তারিখে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের ভাষ্যমতে, আলােচনা ফলপ্রসু হয়েছিল। তারা মিনিস্টারকে বিশেষ। অনুরােধ করেন, যাতে তিনি হােমস্টাডিজগুলাে দ্রুত শেষ করার জন্য ব্যবস্থা করেন। এফ এফ সি নিজস্ব কর্মকৌশলের অংশরূপে, ১৯৭২ সালের জুন মাস জুড়ে আরও দম্পতি যারা দত্তক নিতে আগ্রহী তাদের তালিকাভুক্ত করেন। ইতােমধ্যে অন্টেরিও দম্পতিরা নিজেদের সংগঠিত করেন, ডনা উলসি তখনও তাদের নেতৃত্বে। তারা অন্টেরিওর ‘ধীরে চলাে নীতির বিরুদ্ধে সমর্থন জোগাড় করেন। তারপর সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসে তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার ফেডারেল এম পি, এবং প্রাদেশিক এমপি পি’র সঙ্গে দেখাও করছিলেন। অন্টারিও’র এহেন হাল দত্তক আবেদনকারীদের মনােভাবকে আরও হতাশাগ্রস্ত করে তােলে। গ্রুপটি সরকারের সঙ্গে লৰি করে যুক্তি উপস্থাপন করেন এটা বলে যে, আরও দেরির অর্থ। হলাে আরও বেশি সংখ্যায় জীবননাশ । এদিকে, ব্র্যান্টফোর্ড, অন্টারিওর জন এবং ডরেথি মরিস ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ থেকে দুটি অনাথ শিশু দত্তক নেবার জন্য আবেদন করার পর সংবাদ মাধ্যমে চেনাজানা মানুষ হয়ে উঠনে । প্রথম থেকেই তারা তাদের পছন্দমতাে যে কোনাে দেশের শিশু চেয়েই তাদের। অধিকারচর্চা করেন।
তখন তাদেরকে এটাও বলা হয় যে, “বাংলাদেশের শিশুরা দারুণ অসুস্থ, ডায়েরিয়া আক্রান্ত, মাথায় উকুন এবং নানা সংক্রমণে ভােগে ।”> অন্টেরিও’র কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ছাড়া অন্য শিশুদের ব্যাপারে এমনি পক্ষপাতী ছিলেন যে, যুদ্ধশিশুদের আগমনের এক সপ্তাহ আগেও, স্থানীয় সি এ এস থেকে একজন প্রতিনিধি মরিসদের বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের পছন্দের বাংলাদেশি শিশুর পরিবর্তে তাদের ১৮ মাস বয়সী বহুজাতিক এক কানাডীয় শিশুকে গ্রহণ করতে বলেন। দম্পতির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। মরিস দম্পতি শ্রদ্ধার সঙ্গে জবাব দেন “তাদের সেখানেই যেতে হবে যেখানে প্রয়ােজন সবচেয়ে বেশি।
এত কিছুর পর নিরুৎসাহিত না হয়ে বরং নতুনভাবে অঙ্গীকার নিয়ে মরিস দম্পত্তি চালিয়ে যান তাদের চেষ্টা। তারা বেটি গ্রাহামকে লিখেন: “কানাডীয় অনাথদের জীবনযাপন পদ্ধতি কতখানি মঙ্গলদায়ক, সে কথাটাই আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বলি, এ কানাডীয় শিশুরা জীবনে অপরিহার্য যা কিছু, যেমন- আশ্রয়, পােশাক, খাদ্য, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকে । আপনাদের সঙ্গে আমরা সহমত যে, তারা পরিবারের ভালােবাসা, নিরাপত্তা যা। জীবনচর্যার গুণগত উৎকর্ষের মাপকাঠি, সেগুলাে থেকে তারা অনেকাংশে বঞ্চিত।” মরিসরা বেটি গ্রাহামকে তারপর আবার জোর দিয়ে লিখেন: “এখন আমাদের প্রধান সমস্যা কানাডীয় অনাথদের জীবনযাপনের উৎকর্ষ নয় অথবা বাংলাদেশি বা ভিয়েতনামী শিশুদের জীবনযাপনের উৎকর্ষ নয় । আমাদের বর্তমান প্রধান সমস্যা বাংলাদেশি বা ভিয়েতনামী শিশুর জীবন নিয়ে।””” জন এখনেই থামেননি। তিনি আরও লিখেন, “আমরা খুঁজে বের করার পর সব ব্যবস্থা হবার পর কেবল প্রদেশ কর্তৃক আমাদের আবেদনপত্র ফিরিয়ে দেবার কারণে আবার পুরাে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে অবশ্যই আমরা ঘৃণা করব।* মরিসেরা, অন্যান্য দম্পতির মতােই এটাকে অন্টেরিওর সকল কর্মকর্তার ব্যর্থতা নয়, কেবল বেটি গ্রাহামের নেতিবাচক আপত্তির কারণে অন্টেরিও-তে জাতিগতভাবে অন্যতর শিশুদের দত্তক নেয়ার বিষয় বাস্তবায়িত হতে বাধা পাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে যেমন ক্রোধােন্মত্ত হন তেমনি এ বিষয়ে উদ্দেশ্য সাধনের সংকল্পে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হােন।
জুনের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ (১৯৭২) কানাডীয় এফ এফ সি টিমের বাংলাদেশে দত্তকের জন্য কয়েকজন যুদ্ধশিশু বাছাই করে আনতে যাবার কথা ছিল। অথচ তখনও পর্যন্ত অন্টেরিওর দম্পতিদের হােমস্টাডি সম্পন্ন করার কোনাে ব্যবস্থা কেউ করেনি। এতে অন্য কোনাে উপায় পেয়ে ডেল এবং ডরিন গুড সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ট্রুডােকে লিখে তাকে তাগিদ দেন যাতে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিষয়টির খোঁজখবর করেন। প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক এবং ইতিবাচক হস্তক্ষেপ কামনা করে গুডস দম্পতি জানান যে, “সময় অত্যন্ত কম” এবং এটা “অপরিহার্য। যে সরকার “দ্রুত শিশুদের মঙ্গলের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তারা চিঠিটিতে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, এ পর্যন্ত, তারা যা যা প্রয়ােজন তার সবই করেছেন, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাইভেট সমাজকর্মীর সহায়তায় (যেহেতু সি এ এস হােমস্টাডি বন্ধ রেখেছে) হােমস্টাডিও করিয়েছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে অত্যন্ত আবেগের সাথে তার “সবচেয়ে জরুরি বিবেচনার আলােকে বিষয়টি দেখতে অনুরােধ করে ফেরত ডাকে জবাব দিতে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন।
সম্মিলিত এবং একক প্রচেষ্টা সাধারণত শুরু থেকেই যতটুকু সম্ভব এফ এফ সি যােগাযােগ মাধ্যমকে এড়িয়ে কাজ করেছে। তাদের অবস্থান এরকম ছিল: দত্তক প্রক্রিয়া স্পর্শকাতর ব্যাপার, সুতরাং এ ব্যাপারে বেশি হৈচৈ করে কাজ করার দরকার নেই। গ্রীষ্মের শুরুতে লয়েড ও স্যান্ড্রা সিমসন (মন্ট্রিয়ল) অন্টেরিও দম্পতিদের প্রয়াসকে গুছিয়ে। দেবার কাজে এগিয়ে আসেন। তারা একটি প্রচারাভিযানে নামেন যেখানে সকল সম্ভাব্য মাবাবা একসঙ্গে অন্টেরিওর কমিউনিটি ও সােস্যাল সার্ভিসেস-এর মন্ত্রী রেনে ব্রুনেলকে ফোন করবেন ঠিক করা হলাে। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী মন্ত্রীকে গ্রাহাম এবং তার অফিস যেভাবে তাদের ভ্রান্ত ধারণা দিয়েছেন ও ভুল তথ্য দিয়ে প্রক্রিয়াতে বিলম্ব ঘটাচ্ছেন, তার উদাহরণসহ একটি করে মিডিয়া লাইন বলবেন।
বাবা-মায়েদের যুক্তিটি ছিল যে, মন্ত্রণালয় তাদের সঙ্গে যতই সহযােগিতা করার গল্প বলেন।
কেন প্রকৃতপক্ষে কোনাে কাজই করা হয়নি। তারা ১৯৭২ জুনের প্রথম দিকের প্রচারণা মন্ত্রণালয়ের টেলিফোন লাইন সব ব্যস্ত রাখেন। সে সময় আবেদনকারীরা তাদের হােমস্টাডির অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। তারা ভেবেছিলেন এটাই একমাত্র উপায় যার দ্বারা। জিজ্ঞাসা করা যায় তাদের কাজের উন্নতি কতদূর, আর কত বাকি ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের। চূড়ান্ত বক্তব্য কী।
তাদের পরিকল্পনায় কাজ হয়েছিল । স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম ঘটনাগুলাের বিবরণ পুরােপুরিভাগে কানাডীয়দের সামনে তুলে ধরাতে মন্ত্রণালয়ে যেন একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত যাকে বলে, তাই হলাে! পরিস্থিতিতে আরও চাপ তৈরি করার জন্য, ইতােমধ্যে এফ এফ সি টিম বাংলাদেশে রওনা হয়ে যায়। এদিকে রবার্ট কার্টসেন সে সময়ে (মিনিস্ট্রি অব কমিউনিটি এন্ড সােস্যাল সার্ভিসেস-এর) নথি অনুসারে মন্ত্রীকে নিয়মিত সব বিষয়ে অবহিত করার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সময়ে সময়ে মন্ত্রীকে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে দেরি হচ্ছে কেন, সে বিষয়ে একদম খােলাখুলিভাবে বিলম্বের কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে অবগত করেন এটা বলে। যে, গ্যাহাম এমন সব তথ্যের দাবি করছেন যেগুলাে হােমস্টাডি সম্পন্ন করার জন্য প্রয়ােজন হয় না । কার্টসেন মন্ত্রীকেআরও জানান যে, “একথা প্রমাণিত যে আমরা জন্মের সনদপত্র চাচ্ছি, ফর্ম ১০০৯ চাচ্ছি, যেটা হচ্ছে একটি ইমিগ্রেশন স্পন্সর ফর্ম এবং বারবার দাবি করছি শিশুর নামের শেষাংশ। দিল্লি হাই কমিশনারের অফিস জন্ম সনদপত্র রেখে দিচ্ছে । অভিবাসন কর্মকর্তারা ফর্ম ১০০৯ বিষয়ে প্রমাণিতরূপে সন্তুষ্ট । মনিক পার্সন (ফোন: ৪১৮৬৪৩-৩০১৬), কিউবেক প্রদেশ, ইতােমধ্যে এতে অনুমােদন দিয়েছেন যে ঐ প্রদেশের জন্য যেসব ছেলেমেয়েদের পাঠানাের কথা, তাদের অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন আমলাতান্ত্রিক অতিশয়তা ছাড়াই যার উপর আমরা চাপ দিচ্ছি । মিসেস সিমসন মনে করেন আমরা এটাকে অহেতুক জটিল করে তুলছি।”৮৮
অন্টেরিও সরকার এরপরও দম্পতিদের আবেদনপত্রগুলি প্রক্রিয়াকরণের কাজে হাত দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। এর ফলে সংশ্লিষ্ট শিশুদের বিপন্নতার ঝুঁকি যে বেড়ে যাবে নিময়কানুনের উপর জোর দিয়ে দীর্ঘসময়ব্যাপী শুধু কথাবার্তা চালিয়ে গিয়ে, তারপরও তারা রাজি হননি। এবার বাধ্য হয়ে আবেদনকারীরা দ্বিতীয়বারের মতাে মিডিয়ার কাছে গেলেন। সংবাদ মাধ্যমে খুঁটিনাটি তথ্য দিয়ে তারা জানালেন অন্টেরিও সরকার তাদের সঙ্গে কীভাবে অসহযােগিতা করে আসছেন খােলাখুলিভাবে সহযােগিতার প্রতিশ্রুতিদানের পরও।
শুধু তাই নয়, সংবাদ মাধ্যম জনগণের মনােযােগ আকর্ষণ করে জানালেন, গ্রাহাম-এর অভিমত যে নিজের দেশে দত্তক নেবার মতাে শিশু পাওয়া গেলে বিদেশ থেকে দত্তক আনা ঠিক নয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ডিরেক্টর সবসময়ই বলে আসছেন যে ভিন্ন জাতিগত বৈশিষ্ট্যের বিশিষ্ট বাংলাদেশি শিশু কানাডীয় জীবনে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হবে। কোনাে উপায় পেয়ে সংবাদ মাধ্যম এক নতুন কৌশলের অবলম্বন করে মন্ত্রণালয়ে বেশ আলােড়ন সৃষ্টি করে । এবারে ডিরেক্টরের অফিসে টেলিফোন আসতে থাকে আবেদনকারীর নিকট থেকে নয়, বরং রেডিও টেলিভিশন প্রতিবেদকদের কাছ থেকে, পেরেক ঠোকা প্রশ্ন নিয়ে – যেমন: “আমরা বুঝতে পারছি, আপনারা এই শিশুদের কানাডাতে ঢুকতে দিবেন না, কথাটা কি সত্যি? এটা কি সত্যি যে আপনারা ১৫ জন বাংলাদেশি অনাথ শিশুকে কানাডাতে আসতে দিচ্ছেন না? ৪৯
তাৎক্ষণিকভাবে দেবার মতাে জবাব না থাকায় এবং দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার মহৎ উদাহরণ হাতের নাগালে থাকায় মিডিয়া তখনও উপসংহার টানে এটা বলে যে, সরকারের এখন অনেকদিন ফেলে রাখা হােমস্টাডিগুলাে অনতিবিলম্বে করে ফেলা উচিত। আবেদনকারীদের একজন, বার্লিংটন, অন্টেরিওর হেলকে ফেরি খােলাখুলিভাবে গ্রাহামকে অভিযুক্ত করে বলেন যে, তিনি একজন জাতিগত বিদ্বেষের প্রবক্তা। হেলকে গ্রাহামকে প্রকাশ্যে তিনটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে বলেন। প্রথমত, গ্যাহামের আবেদনকারীকে পাঠানাে উত্তর এবং কিউবেক, নােভা স্কোশিয়া এবং সাসক্যাচিউয়ান প্রদেশের সমপর্যায়ের সহকর্মীদের পাঠানাে উত্তরের মধ্যে এত তফাৎ কেন যখন অন্য প্রদেশের কর্মকর্তারা ইতােমধ্যে হােমস্টাডি শেষ করে মে ১৯৭২-এর মধ্যে তারা তাদের মূল্যায়নের ফলাফল জানিয়ে দিয়েছেন এবং দত্তক নেয়ার অনুমােদন দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ সকল সম্ভাব্য দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মাকে ফেডারেল সরকার ইতােমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে, কানাডা বাংলাদেশ এ বিষয়ে সহমত তাহলে অন্টেরিও আরও কী দলিলপত্র চাচ্ছে? ক্রুদ্ধ হেলকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তৃতীয়ত, হােমস্টাডির উদ্দেশ্য দত্তক প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান অথবা গ্রহণ করা নয় মােটেই। অন্টেরিও যেসব তথ্যাদির দাবি জানাচ্ছে। সেগুলাের সবই এ্যাহামের হস্তগত হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু তবুও একের পর এক তথ্য জমা দেয়ার দাবি করে আসছেন। হতাশাগ্রস্ত হেলকে রাগতস্বরে গ্রাহামকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন: তাহলে সঠিকভাবে বলেন কোনাে কারণে প্রক্রিয়াকরণে দেরি হচ্ছে?
হেলকের মতে গ্রাহাম বারবার একই কথা বলছেন যে অন্টেরিও ও অটোয়ার নিকট থেকে তিনি পাকাপােক্তভাবে শােনার অপেক্ষায় যে বাংলাদেশ তার যুদ্ধশিশুদের দেশের বাইরে আসার অনুমােদন দেবে, সে দাবিগুলাে মূলত “ধােয়ায় শুকননা হেরিং,” অর্থাৎ অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরানাের জন্য উত্থাপিত অবান্তর প্রসঙ্গ। ব্যক্তিগতভাবে হেলকে ‘না’ উত্তর গ্রহণ করবার মতাে ব্যক্তি নন। হেলকে প্রথমে সকল আবেদনকারীর পক্ষ থেকে অন্টিরিও’র মিনিস্টার ব্রুনেলকে এবং পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী পিয়ের এলিয়ট ট্রুডােকে চিঠির পর চিঠি লেখেন।
প্রধানমন্ত্রী ট্রুডােকে হেলকে তার তাৎক্ষণিক ও ব্যক্তিগত কার্যব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে লেখেন: “স্যার, আমার চিঠির জরুরি মেজাজ দেখে কিছু মনে করবেন না। আমি দুজন সন্তানের জননী এবং একজন স্বাভাবিক মা হিসাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আপনাকে লিখছি । আমার স্বামী এবং আমি দুজনেই বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম থেকে দুটি করে শিশু দত্তক নেবার জন্য আবেদন করেছি, তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করছি। আমি ঐ হতাশাগ্রস্ত পরিবারগুলির প্রতিনিধিরূপে আপনাকে লিখছি। বাংলাদেশ থেকে যে শিশুদের দত্তক দেয়ার জন্য দেশ ছাড়তে অনুমােদন দেয়া হবে, তাদের দত্তক নিতে ইচ্ছুক দম্পতিদেরও আমি। প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি জার্মান বংশােদ্ভূত এবং দুটি বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে যা জানি তাতে যুদ্ধ যে শিশুদের জন্য কী ভয়ংকর হতে পারে তাও বুঝতে পারি । ভারতে ১২ বছর কাটিয়ে আসার পর বলতে পারি, জুলাইয়ের বর্ষাকাল ওখানে কী শােচনীয়ভাবে খারাপ ঋতু হতে। পারে । এ প্রয়াসে অটোয়ায় ইন্টারন্যাশন্যাল সােস্যাল সার্ভিসেস প্রতিনিধি এবং সম্মিলিত জাতিসংঘের অর্থায়নে সমর্থিত সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান অর্গানাইজেশন ফর রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন (সি ও আর আর)-এর রিলিফ কার্যক্রমের ব্যবস্থাপক, ফাদার লাবে আমাকে সমর্থন করেছেন।”৫০
হেলকে জোর দিয়ে বলেন, মানবিকতার বিচারে শিশুদের দত্তক নেবার জন্য যারা আবেদন করেছেন, তাদের হােমস্টাডি অবিলম্বে সমর্থন করার যথেষ্ট আপতপর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে, তা হলে এফ এফ সি’র পক্ষে দ্রুত কানাডা থেকে বাংলাদেশে উড়ে গিয়ে শিশুদের নিয়ে আসা কখনাে সম্ভব হবে না। তার অনুরােধ রক্ষিত না হলে তিনি অনশন ধর্মঘট করবেন বলে হেলকে তার চিঠিটি শেষ করেন এভাবে: “আমি ঘােষণা করছি যে, আমাদের সব মা-বাবার আবেদন অনুযায়ী যদি কাৰ্যব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, অথবা পুনরায় দেরি করা হয়, এবং আপনাদের সঙ্গে টেলিফোনে এ বিষয়ে কোনাে কথা না হলে, অথবা মিসেস বনি ক্যাপুচিনােকে পাঠানাে অনুমােদনের বৃত্তান্ত না শুনলে আমি শনিবার, ১৭ জুন, ১৯৭২ তারিখ। থেকে অনশন ধর্মঘট করব। মিসেস বনি কাপুচিনাের ঠিকানা: প্রেসিডেন্ট, কিউবেক ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন ১০, বাউলিং গ্রীন, পয়েন্ট ক্লেয়ার, ৭২০, কিউবেক।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিউজ এজেন্সিগুলাে এ চিঠির একটি করে ফটোকপি এবং আমাদের তাবৎ প্রচেষ্টার ওপর একটি সারসংক্ষেপ এক্সপ্রেস মেইলে শনিবার পাবেন, যাতে আমার অনশন ধর্মঘটের সম্পর্কে জানানাে হবে। আমি অনশন ধর্মঘট শেষ করব না এ দম্পতিরা তাদের আইনি অধিকার বলে বাংলাদেশ থেকে শিশু দত্তক নেবার অনুমােদন না পাওয়া পর্যন্ত । আমি চাচ্ছি, যাতে জুলাই নাগাদ এসব শিশু যাদের এরা স্পন্সর করতে চায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে চলে আসতে পারে।” তিনি। কানাডার প্রধান প্রধান সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের একটি প্রেস কনফারেন্সে ডাকেন ১৯৭২। এর ১৭ জুন, শনিবারে এটা ভেবে যে তিনি যখন সত্যি সত্যি অনশনে যান, সংবাদ মাধ্যম।
যেন এ সংবাদটি প্রকাশ করে। একই সাথে হেলকে আবার গ্রাহামের টরন্টো অফিসে নিজ হাতে করে চিঠির একটি ফটোকপি জমা দেন। সে চিঠিতে তিনি লেখেন: “দুঃখজনক হলেও জরুরি এ চিঠিতে দাবির সুরে যা লিখেছি, সেজন্য আমি ব্যথিত হলেও যাদের জন্য লিখছি, আমরা সেই শিশুদের দত্তক নিতে চাই। বাংলাদেশ, নতুন একটি স্বাধীন দেশ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাধা দিতেই দেশটার জন্ম হলাে, ওদের অবস্থা আজ দু’টি বিশ্বযুদ্ধের পরে। ইউরােপের যে হাল হয়েছিল, তেমনই। ওরা আশা করছে, দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল। সরকারেরা এ ধরনের দত্তক নেবার জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবেন।
পরিকল্পনা অনুসারে শনিবার, ১৭জুন সকাল ৯ টায় হেলকে তার অনশন আরম্ভ করেন তার বার্লিংটনস্থ বাড়িতে। তিনি মন্ত্রণালয়ের কমিউনিটি এন্ড সােস্যাল সার্ভিসেসকে এ অনশনের কারণ হিসাবে বলেন: অন্টেরিও ডিরেক্টর অব চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অফিস দত্তকে ইচ্ছুক মাবাবার হােমস্টাডি সম্পন্ন করার বিষয়ে গড়িমসি করতে করতে বন্ধ করে রেখেছেন, এ অভিযােগের নিষ্পত্তি নিশ্চিত করে যতদিন না কানাডা সরকার যুদ্ধশিশুদের ছাড়পত্র না দেবেন, তিনি এ অনশন চালিয়ে যাবেন। হেলকে একটি প্রাইভেট ডিটেক্টিভ ফার্মকে স্বাধীনভাবে সাক্ষ্য দেবার জন্য নিযুক্ত করেন । তিনি অনশন শুরু করবার মুহূর্ত থেকেই গার্ডটি সর্বক্ষণ তার পাশে ছিল। হেলকে দিনে কেবল এক গ্লাস দুধ পান করবেন বলেছিলেন – মােট ১৬০ ক্যালােরি, যতদিন না তার দাবি না মানা হয়। তার পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ ভিভিয়ান ম্যাকক্রেন তাকে পরীক্ষা করে বলেন, তিনি সুস্থ আছেন।
১৯৭২ সালে কানাডাতে অনশন ধর্মঘটের দৃষ্টান্ত ছিল না বললেই চলে। হেলকে বলে আসছিলেন যে তিনি রীতিমতাে শঙ্কিত যে শিশুদের প্রাণ সংশয় হতে পারে এরকম ভয় তিনি। পেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন কানাডার লােকজন নিজের চোখে দেখুক অন্টেরিওর কর্মকর্তারা আন্তবর্ণীয় দত্তকের বিষয়ে কেমন বিদ্বিষ্ট। তার মতে, এ সংকটময় মুহূর্তে সরকারের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল।
খবরের কাগজের প্রতিবেদন অনুসারে হেলকে তার অনশন চালিয়ে যাবেন “যতদিন না তিনি। বুঝতে পারবেন যে তার কাজ হাসিল হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম খবরটির আগাগােড়া অনুসরণ করেছিল । টিভিতে তার অনশন ধর্মঘট জাতীয় শিরােনামে উঠে। খবরের কাগজে এবং রেডিও’র মাধ্যমে সারা দেশের লোেক হেলকের অনশনের খবর জানতে পেরেছিল। সেদিন হেলকে-কে “সাহসী স্ত্রী লােক” আখ্যা দিয়ে খবরের কাগজে লেখা হয়: “২৪ বছর বয়স্কা ২ সন্তানের মা অনশন ধর্মঘটে গিয়েছেন এর প্রতিবাদ করতে যে বেটি গ্রাহাম, অন্টেরিও, ডিরেক্টর অব চাইল্ড ওয়েলফেয়ার, বিদেশি শিশুদের দত্তক অনুমােদনে অযথা বিলম্বিত করে আবেদনকারীদের নাজেহাল করছেন।” টরেন্টোর The Globe and Mail পুরাে খবরটি এভাবে ছাপায়: “গত ছ’মাস মিজ গ্রাহামের কাছ থেকে গড়িমসি ছাড়া আর। কিছু পাননি । আমাদের সেবা না দিয়ে অযথা সময় নষ্ট করার তার কোনাে অধিকার নেই । আমরা বাংলাদেশ হােক, আর টিমবাকটু হােক, যেখান থেকে খুশি দত্তক আনতে পারি । তার কাজ হলাে, চিলড্রেনস এইড সােসাইটিকে আমাদের হােমস্টাডি সুসম্পন্ন করতে বলা,” বলেন ক্রুদ্ধ রবার্ট ফেরি (তার স্বামী) এক মিডিয়া সাক্ষাৎকারে । অযৌক্তিক বিলম্বে তার বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি পরিস্থিতির সারমর্ম তুলে ধরলেন: “আমার মনে হয় আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আর কেউ যেন আমাদের মুখে বালু ছুঁড়ে মারছে কেবল।
“আমার স্বামী এবং আমি জানুয়ারি থেকে চেষ্টা করছি যাতে কুইন’স পার্ক (সরকারি অফিসগুলাে যেখানে অবস্থিত) থেকে একটা সিদ্ধান্ত পাই যে আমরা দত্তক নিতে পারব। কিনা, ক্রুদ্ধ হেলকে একজন সংবাদপত্র প্রতিবেদকের নিকট অভিযােগ করেন । “যতই চেষ্টা করি না কেন, আমাদের ভাগ্যে নেই। কিন্তু আমরা হাল ছেড়ে দিচ্ছি না, যদিও দেরি। করবার যেন আর শেষ নেই মনে হচ্ছে। আমরা এই শিশুদের কানাডায় আনবই, যত দুর্ভোগই থাক আমাদের কপালে,” বলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হেলকে এক সংবাদপত্রকর্মীকে। শেষ পর্যায়ে দেখা গেল ব্যাপক মিডিয়া কভারেজের ফলশ্রুতিতে অন্টেরিও সরকারকে যেন জনসম্মুখে নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিল । ফেডারেল ও প্রাদেশিক দুসরকারই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান । বিস্মিত হবার কিছু নেই, এতকিছুর পরও দুর্দমীয় গ্রাহাম তখনও বলছিলেন, কোনাে অন্যায় বা ভুল কাজ করা হয়নি। তিনি আরও যুক্তি দিলেন যে, ফেরি দম্পত্তির কেইসে কোনােরকম দেরি হয়নি।
হেলকের অনশন ধর্মঘটের খবর গণমাধ্যমে আসার পরও একটি হাস্যকর ঘটনা ঘটে। পরিবার ও সােস্যাল পরিকল্পনার ডেপুটি মিনিষ্টার-এর নির্বাহী সহকারি গর্ডন ম্যাকলেল্যান এক মিডিয়া সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তার মন্ত্রণালয় অটোয়া থেকে এ মর্মে কোনাে আনুষ্ঠানিক বার্তা পাননি যে, বাংলাদেশ নিজ দেশের বাইরে তার অনাথ শিশুদের দত্তক নেবার অনুমােদন দিতে রাজি হয়েছে। তিনি নিঃসংকোচে বলেন যে, তার জানা মতে হােমস্টাডির জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন তেমন কোনাে তালিকা নেই। বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কে ম্যাকলেল্যানের বক্তব্য আগাগােড়াই মিথ্যে । ফেরি দম্পতি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেন যে হােমস্টাডির জন্য কাউকে ভােগানাে হচ্ছে না, একথাও সর্বৈব মিথ্যা। আবেদনপত্রের ওপর কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে কয়েক মাস আগে থেকেই। ফেরি দম্পতি এটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি। তারা দাবি করেন যে, তাদের ফাইলটি কখনাে হাতেই নেয়া হয়নি কারণ, যতবার এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন ততবার গ্রাহাম তাদের জানিয়েছেন যে, অন্টেরিও কর্মকর্তারা এখনও অটোয়ার কাছ থেকে শােনবার প্রতীক্ষায় রয়েছেন।
শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা একটি প্রশ্ন ঘিরে দাঁড়াল: প্রক্রিয়াটা কী? হেলকে বারংবার সংবাদপত্র প্রতিবেদকদের বলেছেন যে দত্তক প্রক্রিয়ামতে স্থানীয় সি এ এস কর্মী আবেদনকারীর হােমস্টাডি সম্পন্ন করেন, যাতে আবেদনকারীর যােগ্যতা ও দত্তক নেবার সামথ্য বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। এখানে শিশুটি, হেলকে ব্যাখ্যা করেন, পৃথিবীর যে কোনাে জায়গা থেকে আসতে পারে। অন্টেরিও কর্মকর্তাদের জানার প্রয়ােজন নেই যে বাংলাদেশ অথবা অন্য কোনাে দেশ নিজ শিশুদের অন্য দেশে যাবার ছাড়পত্র দেবে কিনা।
এ কথা বলা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গ্রাহামের অসংলগ্ন বিভ্রান্তিকর বর্ণনাদি সংবাদ মাধ্যমে মােটামুটিভাবে অগ্রাহ্য করে হােমস্টাডির কাজ যেন দ্রুত সম্পন্ন করা হয় সেটার উপর জোর দেয়া হয় । কিন্তু দেখা গেল গ্রাহাম জেদ ধরে তার স্বভাবানুগত দুর্দমনীয়তার দৃষ্টান্ত রাখেন। সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ না করে গ্রাহাম আবারাে অনাবশ্যক। যুক্তিচ্ছলে তার পুরনাে অজুহাতের পুনরাবৃত্তি করে বলেন তিনি বিশ্বাস করেন যে, যেসব দেশের শিশুদের আসবার কথা, তাদের সরকার হয়তাে তাদের অন্য দেশে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি করছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিবেদকেরা লক্ষ্য করছিলেন, গ্রাহাম তার অকার্যকর অবস্থান। ব্যাখ্যা করার মতাে যৌক্তিকতা হাতড়ে পাচ্ছিলেন না।
হেলকের অনশন ধর্মঘট (এবং তার সম্পূর্ণ মিডিয়া কভারেজ) উচ্চবর্গীয় রাজনৈতিক মহলে আশানুরূপ অভিঘাত সৃষ্টি করে। কানাডীয় জনসাধারণ এবং অন্টেরিও কর্মকর্তাদের জন্য তার প্রধান বার্তা ছিল: যে সমাজকর্মীদের সঙ্গে তারা কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তারা যে কেবল অসহযােগী ছিলেন, তা নয়, আন্তবর্ণীয় দত্তকের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা রীতিমতাে ক্ষতিকর। বস্তুতপক্ষে গ্রাহামের প্রতিনিধিরা তাদেরকে নিরুৎসাহিত করায় যারপরনাই চেষ্টা করেছেন। নিঃসন্দেহে সরকারি কর্মকর্তারা যখন হেলকের বহুল আলােচিত অনশন ধর্মঘট নিয়ে লজ্জায় পড়েছিলেন বিশেষ করে মন্ত্রী মহােদয়রা এভাবে সংবাদ প্রচারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় ছিলেন। বস্তুত হেলকের অনশন ধর্মঘট আমাদেরকে এক আরবীয় প্রবচন। “এক টুকরাে খড়ে উটের পিঠ ভেঙে পড়ার কাহিনীটি স্বরণ করিয়ে দেয়।
দেখা গেল, আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই চিঠি আসে কমিউনিটি এন্ড সােস্যাল সার্ভিসেস-এর মন্ত্রীর কাছ থেকে। তিনি সংবাদকর্মীদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা সাথে সাথে পরিষ্কার। করে বুঝিয়ে দেন যে, আন্তর্জাতিক দত্তক প্রথা আইনসিদ্ধ এবং সবাইকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, অসমাপ্ত হােমস্টাডিগুলাে শুরু করা হবে অগ্রাধিকার দিয়ে। মন্ত্রী ব্রুনেলের অস্বস্তিকর অবস্থায় সম্মুখীন হওয়া দেখে কানাডীয়দের কাছে মনে হয়েছিল এতদিনের ধামাচাপার। উৎসের ঢাকনাটি যেহেতু হঠাৎ করে সরে গিয়েছে, তিনি সেটাকে ঠিক জায়গায় রাখবার। আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারেননি।
সকলেই আশ্চর্য হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন, বিশেষ করে অন্টেরিও কর্মকর্তারা যেভাবে। তড়িঘড়ি ফেলে রাখা কাজ সারতে চেষ্টা করেন। মিডিয়াতে প্রতিবেদকরা লিখলেন, “অন্টোরিও কর্মকর্তারা লাল ফিতার দৌরাত্ম কেটেকুটে পরিষ্কার করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে | লেগেছেন। মিডিয়া কভারেজ এবং সরকারের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে, অনশনের তৃতীয় দিনে হেলকে রাত ৮টায় তার অনশন ভঙ্গ করেন। ততক্ষণে চারদিকে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করে সবাই । ডাঃ গর্ডন আসকউইথ, তদানীন্তন নির্বাহি পরিচালক, হ্যালটন সি এ এস, যিনি এতদিনে বলে আসছিলেন জানুয়ারি ১৯৭২-এর পর তার ফেরি দম্পতিদের সঙ্গে দেখা বা কথাবার্তা হয়নি, সবাইকে অবাক করে তিনি রাতারাতি সুর পাল্টিয়ে ফেলেন। বিস্মিত। হয়ে কানাডীয়রা শুনতে পায় মিডিয়ার সাথে তারা কথাবার্তা, যেন অনভিপ্রেত কোনাে কিছু কখনাে হয়নিঃ “নীতিমালা অনুযায়ী হ্যালটনে বিদেশি শিশুদের দত্তক নেয়ায় বাধা দেবার মতাে কোনাে কিছু নেই। নিঃসন্দেহে “আরও নথিপত্র লাগবে বলে গ্রাহাম যে কেইসগুলাে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে এরকম বিপরীতার্থক পিলে চমকানাে। ব্যাপার ঘটবার ছিল!
হেলকে তখন মন্ত্রী ব্রুনেলকে দ্রুত কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানালেন: “আপনি সংবাদ মাধ্যমকে যে দুটো বক্তব্য দিয়েছেন, সেজন্য আমি এবং আমার স্বামী আপনাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমরা সেগুলি প্রধান খবরের কাগজে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছিলাম । ফলে আমি মঙ্গলবার রাত ৮টায় অনশন ভঙ্গ করি। আমি তাতে বুঝে নিয়েছিলাম যে, আমি যে বিষয়ে আপনার এবং জনসাধারণের মনােযােগ আকর্ষণ করেছিলাম । আমি ধরে নিয়েছি যে, যে বক্তব্য দুটির কপি আপনার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানাে, সেটাই আনুষ্ঠানিক উত্তর।”৬০
তারপরে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম লক্ষণীয় পদক্ষেপ ডিরেক্টর অব চাইল্ড ওয়েলফেয়ার ইস্যুকৃত ১৯৭২ এর ৫ জুলাই এর চিঠিটা সি এ এস-এর প্রেসিডেন্টবৃন্দ এবং স্থানীয় ডিরেক্টরদের পাঠানাে হয়। বাংলাদেশ সরকার নিজ দেশের শিশুদের বিদেশিদের দ্বারা দত্তক নেয়ার ব্যাপারে নীতিগতভাবে রাজি হয়েছেন। অনেক মাস যাবত হতাশায় নিরাশভাবে অপেক্ষা করবার পর দম্পতিরা কিছুটা স্বস্তিলাভ করেন। কিন্তু তারপরও তারা কর্তৃপক্ষকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকেন। তারা শপথ নিলেন, তাদের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে যতদিন না তারা তাদের পছন্দের শিশুটাকে যেখান থেকে তােক নিয়ে আসতে পারেন। হেলকে, যিনি গোঁ ধরে প্রমাণ করলেন যে, তিনি যা চান তাই করেন। আবার শপথ নিলেন, যে কোনাে সময়, উপযুক্ত কাজে কখনাে পিছু হটবেন না।
কানাডীয় সরকার যেসব কাগজপত্র চান
বাংলাদেশ সরকার, প্রাদেশিক সরকার এবং কানাডা সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েকবার বসার পর এফ এফ সি বিভিন্ন ফর্মের এক তালিকা তৈরি করে, সেগুলাে কানাডার বিভিন্ন জায়গা থেকে সকল আবেদনকারীকে সংগ্রহ করার উপদেশ হয় হয় । আবেদনকারীর জন্য সবচেয়ে ঝামেলার ফর্ম ছিল আবেদনকারীর স্পন্সরশিপ (# ১০০৯) ফর্ম যেটা ম্যানপাওয়ার ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়ের জন্য অপরিহার্য । ইমিগ্রেশন ফর্মে যেসব তথ্য চাওয়া হয় সেগুলাে হলাে: শিশুর নাম, জন্ম স্থান, জন্মের তারিখ, লৈঙ্গিক চিহ্ন এবং বাংলাদেশে শিশুর ঠিকানা। এ কাজটি করতে গিয়ে দেখা যায় যে আবেদনকারীরা নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে শিশুর মূল বৃত্তান্তশুদ্ধ নথি খুঁজে পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া তখনও কিছু কিছু শিশুকে এফ এফ সি চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করেনি। আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশুর জন্মও তখনও হয়নি।
স্বাভাবিকভাবেই অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষ তখনও অনেক শিশুর জন্য জন্ম সনদপত্রও তৈরি করেননি। যেমনটি দেখা গিয়েছিল, কিউবেক, নােভা স্কোশিয়া এবং সাসক্যাচিউয়্যন প্রদেশ কর্তৃপক্ষ তথ্যের অভাবের ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন। তারা আবেদনকারীদের জানালেন, তাদের আবেদনপত্র ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট অব ম্যানপাওয়ার ও ইমিগ্রেশনে বরাবর পাঠানাে হয়েছে আরও বিবেচনার জন্য এ শর্তে যে, শিশুর সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য যত শীঘ্র সম্ভব সংগ্রহ করে জমা দেয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসেও অন্টেরিও আবেদনকারীরা আরও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। সহযােগিতার নিশ্চয়তা দানের পরেও ওরা শিশুদের বাকি তথ্য সরবরাহ করার জন্য চাপ দিতে থাকে, যদিও মন্ত্রী ব্রুনেল সে ব্যাপারে তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সহযােগিতার পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছিলেন। অন্টেরিও সরকার শিশুদের নামের শেষাংশ জানার জন্য বারবার চাপ দিতে থাকে যখন ঐ শিশুদের প্রথম নাম কারাে জানা ছিল না।
ভাগ্যক্রমে, যেহেতু ফেডারেল সরকার বাংলাদেশ প্রকল্প সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন তাই অটোয়া অফিস প্রত্যেক দত্তকে ইচ্ছুক দম্পতির জন্য স্পন্সর্ড ইমিগ্র্যান্ট এ্যাপ্লিকেশন, কোন কোন্ ফর্ম পূরণ করা কর্তব্য সে বিষয়ে অবহিত করে। প্রায় একই সাথে তখনও ক্যাপুচিনােরা পুরাে তথ্যের নির্দেশাবলির একটি প্যাকেজ নিজ হাতে সংগ্রহ করে আবেদনকারীদের নিজ নিজ ঠিকানায় পাঠান। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে নানা রকমের ফরম পুরণ করা বেশ জটিল কাজ, বিশেষ করে যেখানে শিশু বিষয়ে অনেক তথ্যই আবেদনকারীদের তখনও জানা ছিল না। কাজটা যাতে একটু সহজতর হয় সে লক্ষ্যে নির্দেশাবলির প্যাকেজটি পাঠানাে হয়। তাদেরকে বলা হয় যে, বর্ণিত ১৩টা দলিল সংগ্রহ করে দাখিল করার জন্য যাতে তাদের আবেদনপত্র সঠিক ও জোরদার হয়: ১. হােমস্টাডি দত্তক সংস্থা থেকে; ২. মা-বাবার জন্ম সনদপত্র; ৩. বিবাহ সনদ; ৪. স্বাস্থ্য সনদ; ৫. ব্যাংকএ লেটার অব ক্রেডিট; ৬. প্রাদেশিক অনুমােদনের চিঠি; ৭. পাওয়ার অব এটর্নি; ৮, লেটার্স। অব রেফারেন্স; ৯, পরিবারের ছবি, ১০. শিশুর জন্য কানাডীয় অভিবাসনের দলিল ১১. দত্তকের জন্য নির্বাচিত শিশুর মেডিক্যাল রিপাের্ট; ১২. অভিবাসন ফর্ম-ও এস ৮ (সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ করতে হবে), মেডিক্যাল প্রয়ােজনানুসারে আইন সম্মত জাতীয় ভ্রমণ দলিলপত্র এবং ১৩, স্পন্সরশিপ ফর্ম আই এস এস ১০০৯, (যে ফরম-এর কথা একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে)। তাছাড়া যথােপযুক্ত চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অথরিটির অনুমোদন ও প্রমাণপত্রাদি।
বাংলাদেশে যাবার জন্য প্রস্তুতি
এফ এফ সি’র টিমে বা দলে ছিলেন সর্বমােট ৫ জন সদস্য। তারা হলেন, রবার্ট এবং হেলকে ফেরি, ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাে এবং এলিজাবেথ মৌলিং। দলনেতা ছিলেন ফ্রেড ক্যাপুচিনাে। দলের প্রধান দায়িত্ব চারটি:
১. আবেদনকারীদের জন্য নাে অবজেকশন সনদপত্র ইস্যু করিয়ে নেয়া।
২. বাংলাদেশ ও কানাডার প্রতিনিধিত্বকারী পার্টিদের মধ্যে যােগাযােগের কাজ গুছিয়ে নেয়া
যাতে এফ এফ সি উপদেষ্টা সার্বিক সমন্বয়ের জন্য দায়ী থাকবেন।
৩.বাংলাদেশ থেকে শিশুসহ ভ্রমণের বিষয়ে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা করা।
৪. শিশুরা যখন
কানাডার পথে ভ্রমণে করবে, তখনও শিশুদের জন্য প্রয়ােজনীয় পােশাক,
খাদ্য ও ওষুধপত্র যােগাড় করা ।
সৌভাগ্যবশত ফ্রেডের তালিকায় সে সব প্রয়ােজনীয় সামগ্রী পােষাক, ঔষধপত্র, নগদ অর্থ ও আনুষাঙ্গিক কাজ সময়মতাে এসে পৌঁছায় এবং দায়িত্বের কাজগুলাে তারা ঠিকমতাে করতে সক্ষম হন। কানাডীয়রা সে সময়ে যুদ্ধশিশু এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমে যা শুনেছিল বা দেখেছিল, তারই প্রতিক্রিয়ায় তারা প্রাণভরে দান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা সময়মতাে সেসব পৌছে দিয়েছিল সব এফ এফ সি’র দোরগােড়ায় ।
কিন্তু স্বভাবতই এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ এক উড়ানে অতগুলি শিশুকে আনতে গড়িমসি করছিল । তাদের রীতি অনুযায়ী অন্ততপক্ষে আরও একজন স্টিউয়ার্ডেস-এর আবশ্যক ছিল । এফ এফ সি’র ট্রাভেল এজেন্ট অ্যাগনিস হেনচির বাংলাদেশ প্রকল্প-এ বিশেষ আগ্রহ থাকায় তিনি বিমানের বন্দোবস্ত করার সময় এদের সুবিধামতাে বিমান ভাড়া করে দেবার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করে দর কষাকষির পর মূল্য হ্রাসে টিকেট কিনতে সক্ষম হন। এয়ার ইন্ডিয়া এ শর্তে রাজি যে, কমপক্ষে একজন প্রাপ্তবয়স্ক থাকবে প্রতি তিনজন শিশুর জন্য । এলিজাবেথ মৌলিং, যার কথা আমরা ইতােমধ্যে বলেছি এবং যিনি একটি দত্তক সন্তানের জন্য আবেদনও করেছিলেন, নিজ খরচে স্বেচ্ছাসেবিকারূপে বাংলাদেশ টিমে ওদের সঙ্গে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
হেলকে ফেরি অন্টেরিও দম্পতিদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। তিনি দলের কাজের অগ্রগতি বিষয়ে দম্পতিদের অবহিত রাখেন। হেলকে ভাবাবেগে সমর্থন জানানাের জন্যও এক পা এগিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতে যাবার আগে তার এক এক চিঠিতে অন্টেরিও পরিবারদের “dear expectant parents” আখ্যা দিয়ে একটি চিঠি লিখেন যেটা পড়ে সবাই প্রচুর হেসেছিলেন। তখন তারা একটু হাসির জন্য ছলছুঁতাে খুঁজছিলেন, সবারই মুখভার হয়ে থাকত সে সময়ে (কারণ অন্টেরিও সরকার তাদের আবেদনপত্র আটকে রেখেছিলেন যা আমরা ইতােমধ্যে আলােচনা করেছি)। তাদের আশ্বাস দিয়ে যে তারা তাদের শিশুদের শিঘ্রই পেতে যাচ্ছেন, হেলকে লিখেন যে “তারা তাদের দত্তক সূত্রে গর্ভধারণের শেষ পর্যায়ে আছেন, যেখানে এটা অবশ্যই প্রয়ােজন যে মি, কোপল্যান্ড, এফ এফ সি নিযুক্ত আইনজ্ঞ, সদস্যদের সকল বিষয়ে সহায়তা দিবেন যাতে সব কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।”
তিনি তাদের সর্তক করে দেন যে, ঢাকা থেকে কানাডা ফেরার কালে, শিশুদের অতিরিক্ত মনােযােগ ও সেবার প্রয়ােজন হবে। শীঘ্রই যে শিশুরা এসে নামবে, তাদের জন্য কেনাকাটা করার উপদেশ দিয়ে বলেন, “বিমানে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকবে, আমরা চাই না ওদের আমাশয় ও অপুষ্টির ওপর যেন আবার নিউমােনিয়া হােক।”উই তিনি তাদের একটি বিশাল তালিকা দেন অনেক প্রয়ােজনীয় সামগ্রী কিনে রাখার জন্য, যাতে শিশুরা বাড়ি পৌছে সেগুলি ব্যবহার করতে পারে। সবাইকে শিশুদের জন্য নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বলে। হেলকে তাদেরকে জানালেন যে, তিনি নিজেও “বাংলাদেশে নিয়ে যাবার জন্য ডায়াপার, প্ল্যাস্টিক প্যান্ট এবং মাইপােষ কিনেছেন।”৬৩ পাঁচ সদস্যের এফ এফ সি টিম দুটি আলাদা গ্রুপে রওনা হয়। ফেরিরা টরন্টো ত্যাগ করেন ২৫ জুন ১৯৭২ তারিখে । তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতে পৌছে তারা কয়েকদিন উত্তর প্রদেশে মুসৌরিতে কাটিয়ে তারপর ঢাকায় গিয়ে ক্যাপুচিনােদের সঙ্গে মিলিত হবেন। ক্যাপুচিনাের টিম ২৮ জুন ১৯৭২ তারিখে নিউ ইয়র্ক হয়ে নিউ দিল্লি এবং সেখান থেকে ঢাকার পথে ঢাকা রওনা হন। কানাডাতে ফিরে আসার দিন ১৯ জুলাই ১৯৭২ ধার্য করে ১৭ জন শিশুর জন্য বিমানের টিকেট সংরক্ষণ করা হয়। ২৯ জুন তারা ঢাকায় পৌঁছেন।
ঢাকায় ২১ ব্যস্ত সমস্ত দিনরাত (২৯ জুন – ১৯ জুলাই, ১৯৭২)
সে সময়ে বাংলাদেশে জা পেলেতিয়ে, প্রথম কিউসাে (ক্যানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি সার্ভিসেস ওভারসিজ)-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি এফ এফ সিকে বাংলাদেশের অস্থির, এলােমেলাে অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। টিমকে জানানাে হয় যে, মুজিব প্রশাসন দত্তক প্রক্রিয়া সম্পর্কে এমন মত পােষণ করেন যে এটাই বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে রক্ষা করার সবচেয়ে সেরা পন্থা । কানাডীয় টিমকে এ বলে অভিহিত করা হয় যে বাংলাদেশিরা মনে করে, যুদ্ধশিশুদের জন্ম “লজ্জা এবং “অসম্মান”-এর মধ্য দিয়ে। কাজেই বাংলাদেশের বাইরে তারা অপেক্ষাকৃত সামাজিকভাবে গ্রহণযােগ্য জীবনযাপন করতে পারবে।
কানাডীয় টিম প্রথম যােগাযোেগ করেন ফাদার বেঞ্জামিন লাবের সাথে। তিনি ছিলেন তদানীন্তন রিজিওনাল ডিরেক্টর অব ক্রিশ্চিয়ান অর্গানাইজেশন ফর রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন (সি ও আর আর)। তার নাম ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে । দলটি দুইমাস আগে মে মাসে কিউবেকের মন্ট্রিয়ল-এ ফাদার লাবের সঙ্গে দেখা করেছিল। তিনি বাংলাদেশে বহু বছর কাজ করেছেন, যুদ্ধের নয়মাসও তিনি ওখানে ছিলেন। দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ভালাে সম্পর্ক ছিল। তিনি ফ্রেডকে তার ব্যক্তিগত টাইপরাইটার, ফটোকপি মেশিন এবং টেলেক্স সুবিধাদির উল্লেখ করে সেসব ব্যবহারে উৎসাহিত করেন যাতে তারা তাদের কানাডীয় পার্টনারদের সঙ্গে সহজে যােগাযােগ করতে পারে।
তাদের দ্বিতীয় যােগাযােগের ব্যক্তিটি ছিলেন এমিল ব্যারন, ক্যানাডিয়ান ইন্টারন্যাশন্যাল ডেডেল্যপমেন্ট এজেন্সির কর্মকর্তা। তখন তিনি নিযুক্ত ছিলেন ঢাকাস্থ কানাডীয় হাই কমিশনার-এর অফিসে। হাই কমিশনার জেমস বার্টলম্যান-এর নির্দেশ অনুসারে ব্যারন টিমটির সঙ্গে কাজ করতে লেগে যান। সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে শুরু থেকেই হাই। কমিশনার চেয়েছিলেন বাংলাদেশের শিশুরা যেন নিঃশব্দে এবং বিনা বাধায় কানাডীয়। পরিবারে স্থানান্তরিত হতে পারে। হাই কমিশনের কর্মকর্তারা তাদের সংক্ষেপে মুজিব প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় কীভাবে কাজ করে সেটা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেন।
মন্ত্রিসভার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দিয়ে ব্যারন তাদেরকে আবার কথা বলার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেন, যেহেতু যুদ্ধশিশুর বিষয়টি স্পর্শকাতর । ব্যারন কানাডীয় দলকে খােলাখুলিভাবে বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভিন্ন, অনেক কিছুই তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ মনে হতে পারে। বিষয়টি অনেকটা পাতলা তুষারের ওপর। স্কেটিং করার মতাে, কাজেই তাদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। হাই। কমিশনের নাম ঠিকানা ছাপানাে চিঠির কাগজে ব্যারনের চিঠি নিয়ে ঘুরে ঘুরে দলটি শ্রম ও সমাজ কল্যাণ ডিরেক্টরেট এবং ল এন্ড পার্লামেন্টারি এফেয়ার্স-এর সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বেশ কয়েকটি মিটিং-এর ব্যবস্থা করেন প্রায় সাথে সাথে ।
দলের তৃতীয় সংযােগ ব্যক্তি জেরিনা রশীদ, একজন স্বেচ্ছাসেবক সমাজকর্মী যিনি তখন অসুবিধাগ্রস্ত নারীদের সহায়তায় কাজ করছিলেন। ক্যানডাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার আব্দুল মােমিন তাকে কানাডীয় টিমের নিকট সুপারিশ করেছিলেন। আত্মত্যাগী সমাজকর্মী হওয়ার বাইরে জেরিনা ছিলেন কানাডাতে বাংলাদেশের হাই কমিশনারের বড় ভাইয়ের স্ত্রী। জেরিনা ওদের তার স্বামী আব্দুর রশীদের সঙ্গে সবার আলাপ করিয়ে দেন। রশীদ পাকিস্তান সরকারের যােগাযােগ সচিব হিসাবে চাকরি করে অবসর নিয়েছেন দুবছর আগে (১৯৭০)। দলটি হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ (বর্তমানে রূপসী বাংলা) উঠে প্রথম দুরাত সেখানে কাটান। পরে রশীদ দম্পতির সহায়তায় তারা হােটেল পূর্বাণীতে দুটি ঘর নেন। সরকারের বিভিন্ন কাজে রশীদের টিমকে নানাভাবে সহায়তা করেন। জেরিনা দলের সবাইকে নানাভাবে সংক্ষিপ্ত বিবরণীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সব বিষয়ে অবহিত করেন, কখন, কীভাবে এবং কোথায় বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে উপসংহার টানতে হবে, এ বিষয়ে তাদেরকে অবহিত করেন । তিনি আরও বলেন, নানা ধরনের কর্মকর্তা রয়েছেন যেমন, কেউ কেউ অতি উৎসাহী, কেউ বা উদাসীন, কেউ বা অশ্লীল, আবার কেউ বা জনসাধারণের ওপর ক্ষিপ্ত। তাদের স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের একটি তালিকা দিয়ে জেরিনা বাংলাদেশের লােকাচার এবং রীতিনীতির ওপরে ছােটখাটো একটি বক্তৃতা দেন। তিনি তাদের আরও বলেন, বাংলাদেশিরা পরস্পর কীভাবে কথাবার্তা বলেন, সেটা লক্ষ্য করতে ।
টিমের সদস্যরা নিজেরাও লক্ষ্য করেন যে, রশীদ যে কেবল ক্ষমতার করিডােরে ঘুরে বেড়ান তা নয়, তিনি এবং সরকারের উপর মহলে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার বিষয়েও চিন্তাভাবনা করছেন। মুজিব সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, এর প্রেরণা, পেষণ এবং দৃষ্টিপথ সম্পর্কেও তারা এফ এফ সি-কে জ্ঞাত করেন। ক্যাপুচিনােদোর কৌশল ও পরিকল্পনা ছিল মােটামুটিভাবে এরকম: প্রথমত, কিছুটা চাপ প্রয়ােগ করে সেটা যুক্তি দিয়ে প্ররােচিত করে এবং বিবেকের তাড়না দিয়ে তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলতে হবে। তারপর নিদারুণ বেদনা ও চরম দুর্দশার কথা অভিব্যক্ত করে এবং আলাপ আলােচনা ও পরামর্শের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কয়েকজন যুদ্ধশিশুকে কানাডীয় মা-বাবার দ্বারা দত্তক নেয়ার বিষয় চূড়ান্ত করতে হবে। ঢাকাস্থ কিছু অনাথ আশ্রম থেকে প্রাপ্তব্য কয়েকটি যুদ্ধশিশুদের তারা নিজেরা নির্বাচন করবেন । দুটো কাজই সরকারি কর্মকর্তা ও অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষের রাজি হওয়ার ওপর নির্ভর করবে । রশীদ দম্পতি এফ এফ সি’র টিমের পরিকল্পনা পরীক্ষা করে দেখেন টিমটি কী ভুলবশত উদোর পিন্ডি বুধাের। ঘাড়ে চাপানাের চেষ্টায় ।
শেষ পর্যন্ত টিম ডাঃ ফেরিকে (চিকিৎসক) যুদ্ধশিশুর চিকিৎসক হিসাবে নিযুক্ত করে। ডিপার্টমেন্ট অব ম্যানপাওয়ার এন্ড ইমিগ্রেশন থেকে অনুমতি নিয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য। তখন তার স্ত্রী হেলকে ফেরিকে দায়িত্ব দেয়া হলাে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করার নয়া দিল্লিস্থ কানাডীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে । কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফ্রেড ও বনি কাপুচিনােকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজকর্মী, উর্ধ্বতন আমলা, আই এস এস এবং ঢাকাস্থ অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এলিজাবেথ মৌলিং তার ইচ্ছা ও সুবিধামতাে ক্যাপুচিনােদের যেখানে খুশি সহায়তা করতেন। সন্ধ্যাবেলা। দুটো গ্রুপ একত্রিত হয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ, পুনরীক্ষণ এবং কর্মকৌশল নির্ধারণ করতেন।
মুজিব প্রশাসনের দুজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সদস্যের সঙ্গেও টিম সদস্যরা ঢাকায় দেখা করেন। এদের একজন ছিলেন ড. কামাল হােসেন, তখনও আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ক মন্ত্রী এবং অপরজন আব্দুর রব চৌধুরী, তদানীন্তন সমন্বয়ক, রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন, প্রধান মন্ত্রীর সচিবালয় । দুজনেই টিমকে দুহাত খুলে বুকে জড়িয়ে অভ্যর্থনা জানান। কানাডাতে বাংলাদেশ হাই কমিশনার মােমিন আগেই চৌধুরীকে লিখেছিলেন, এ টিমটির বাংলাদেশে আসার বিষয়ে । হােসেন এবং চৌধুরী দুজনেই জানালেন মুজিব নিজে বিশ্বাস করেন, যুদ্ধশিশুদের বিষয়টা জাতীয় আঙ্গিক থেকে অবলােকন ও ব্যবস্থাপনার দাবি রাখেন কানাডীয় টিম হােসেন এবং চৌধুরীর দ্রতা, উদারতা এবং পরিশীলিত আচরণ ও মনােভাবে মুগ্ধ হন। পরবর্তী কয়েক দিনে বাংলাদেশের আরও অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। তারা ক্রমশ স্বস্তি পেলেন যে, তাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্যকে অনেকেই ইতিবাচক ইস্যু হিসাবে দেখছেন। চৌধুরী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কানাডীয় টিমের সদস্যদের আন্তর্জাতিক দত্তকের খুঁটিনাটি বিষয় এত গভীর জ্ঞান দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। টিমের সদস্যদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিরও তারা প্রশংসা করেন। টিমের আমরা করতে পারি মনােভাবে চৌধুরী মুগ্ধ হন। বিশেষ করে ফ্রেড যেভাবে তার কঠোর কাজের সময় পঞ্জিকা উপস্থাপন করেন এবং ভ্রমণের পরিকল্পনা শােনান, তাতে সকলেই বিস্ময় প্রকাশ করেন।
কিন্তু যুদ্ধশিশুদের ছাড়পত্র দেয়া, দত্তক প্রক্রিয়ার আইনি শর্তাদি পূরণ, এসবকে নিশ্চিত করবে কে সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কেউই কিছু বলতে পারেননি। এগুলাে কী রিলিফ ও রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ? না কী শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের? না কী আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজ? চৌধুরী অবশ্য জানালেন, তারা ধীরে ধীরে এগােচ্ছেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথা, তারা একটি আইন প্রণয়ন করতে চলেছেন “যেটা শিশুদের সর্বোচ্চ মঙ্গলের স্বার্থে হবে।” পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে কাজ করে সমাজকর্মী দত্তক সংস্থা, চিকিত্সক, আইনজ্ঞ এবং কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা মিলে আইনটি তৈরি করবেন। সরকার এ বিষয়ে একমত যে, কোনাে তাড়াহুড়াে করলে হবে না। সরকারের আইনি সার্ভিসসমূহ, আই এস এস এবং অনাথ আশ্রমের প্রতিনিধি যাদের সরকার সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক (Statutory Guardian)” আখ্যা দিয়েছেন, তাদের সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে আইন প্রণয়ন চূড়ান্ত করা হবে ।
দৃশ্যত স্নায়ুদৌর্বল্যে বিচলিত কানাডীয় দলের প্রত্যেক সদস্যই তখনও চাপা উত্তেজনায়। ভুগছিলেন। তাদের কষ্টকর পরিস্থিতি দেখে চৌধুরী টিমকে শান্ত হতে বলেন বিষয়টিকে হাল্কা করার জন্য রসিকতাচ্ছলে তাদেরকে অনুরােধ করেন: “অনুগ্রহ করে শিশুদের না নিয়ে আপনারা যাবেন না। তারা উপলব্ধি করেন যে বাংলাদেশ সরকার সত্যি সত্যিই তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছে অভ্যর্থনার হাত প্রসারিত করে । চৌধুরী এবং মুজিব ক্যাবিনেটের সবাই নতুন দেশটায় নতুন কিছু ঘটুক সেটাই আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন।
স্বভাবতই একটু উত্তেজিত ও আশান্বিত হয়ে ক্যাপুচিনােরা আই এস এস-এর ম্যারি লেভিনের সঙ্গে দেখা করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে মাত্র কিছু সময়ের জন্য হলেও ক্যাপুচিনােদের জন্য লেভিনের সাথে তাদের সংলাপটি ছিল উল্টো এবং এক অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা। ক্যাপুচিনােরা ম্যারিকে শুধু জিজ্ঞাসা করছিলেন “যুদ্ধশিশুদের কানাডাতে নিয়ে যেতে হলে যে। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার দরকার সেসবের ব্যবস্থা করতে ম্যারির জন্য ঠিক কতদিন লাগবে।” উত্তরে ক্যাপুচিনােরা যা শুনলেন সেটা তাদের একদম পছন্দ হয়নি: “বহুমাস লেগে যাবে মাত্র তিন শব্দাংশের উত্তরের মধ্যেই প্রতিফলিত হয় লেভিনের বিরক্তি, অসন্তোষ এবং বৈরীতা।” লেভিন তার মনােভাব লুকিয়ে কথা বলেননি। সরকার দীর্ঘসূত্রিতা করছেন, সে। অভিযােগ করেন লেভিন। প্রস্তাবিত খসড়া লেখালেখির কাজ প্রায় কিছুই নাকি হয়নি। আই এস এস এখনও একটা প্রাথমিক অনুসন্ধানী গবেষণা কাজে সময়ক্ষেপণ করছে। আন্তর্জাতিক দত্তকের নীতিমালা রচনার আগে একটি কাঠামাে হয়তাে দেয়া যাবে। লেভিন সেখানেই থামেননি, আরও বলেন, “তার একটা ফটোকপি মেশিনও নেই যা আমেরিকা থেকে আনতে কয়েক মাস লাগবে।” লেভিনের চাপা উত্তেজনা ও অসন্তোষে রীতিমতাে বিচলিত হয়ে যান পুরাে সদস্যবৃন্দ। ক্যাপুচিনােদের কানাডীয় টিম যে শক্ত মনােবল নিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছিল, সে জন্যই আই এস এস’র কাঠখােট্টা আচরণ এবং অসহযােগিতা তাদেরকে কোনােভাবেই পুরােপুরি নিরুৎসাহী করে উঠতে পারেনি। ইতােমধ্যে আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাদের দত্তক বিষয়ক প্রস্তাবিত আইন প্রণয়নে নেতৃত্ব করার কথা, আই এস এস বিশেষজ্ঞ, টের ডেজ ওম (টি ডি এইচ); গণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা, কোয়েকার পিস সার্ভিস (কিউ পি এস)-এর।
সঙ্গে যৌথ প্রকল্প, আন্তর্জাতিক কোয়েকার আন্দোলনের একটি শাখা; কোয়েকার সার্ভিস অব বাংলাদেশ (কিউ এস বি), ক্রিশ্চিয়ান অর্গানাইজেশন ফর রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন (সি ও আর আর) এবং অন্যান্য তৃণমূল সংস্থা যারা সমাজ কল্যাণ ও জনগােষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করে তাদের সঙ্গে এক সর্বাত্নক আলােচনায় বসলেন। বাংলাদেশ কোয়েকার সার্ভিসও (বি কিউ এস) ঘনিষ্ঠভাবে অনাথ আশ্রমে কাজ করেছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে প্রভাবিত করার। লক্ষ্যে এবং যুদ্ধশিশুদের ছাড়পত্র দেয়ার বিষয়ে অনেক সময় ব্যয় করেছে। প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী কানাডীয় টিম সাধারণত জেরিনা রশীদকে সাথে নিয়ে সকালে উর্ধ্বতন সরকারি আমলাদের সঙ্গে দেখা করতেন । তারপর ঢাকার বিভিন্ন অনাথ আশ্রমে যেতেন। মাদার তেরেসার হােমের সুপিরিয়র, একই সঙ্গে “সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক” সিস্টার ম্যারি ব্যক্তিগতভাবে টিমকে অভ্যর্থনা জানান। তার অবস্থান এবং কর্ম প্রক্রিয়া নিখুতভাবে ব্যাখ্যা করার পর যুদ্ধশিশুর প্রাপ্যতা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে অভিভাবকত্ব পরিবর্তন করার লক্ষ্যে যে আইন তৈরি হবে সে বিষয়ে আলাপের ফলে টিম টিমের সদস্যরা চমকৃত হয়েছিলেন। তারা জানলেন সিস্টার ম্যারি ১৯৬৫ সাল থেকে ভারতে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। যে বর্ধিত হারে নবজাতকেরা আসছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের যত্নের ব্যবস্থা করা অতি বড় চ্যালেঞ্জের মােকাবিলা করা, তারা বুঝতে পারেন। ক্যাপুচিনােরা সচক্ষে দেখেন যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলােেশর বেশিরভাগ শিশুই অল্প ওজনের যেখানে সম্পদ খুবই সামান্য। এবং ওষুধপত্রও বলতে গেলে নাই।
ঢাকাস্থ অনাথ আশ্রমগুলাে সচক্ষে দেখার পরে কানাডীয় টিমের প্রথম বক্তব্য ছিল শিশুদের ঘর সম্পর্কে, যেখানে শিশুরা ঘুমাত। সে জায়গাটায় ছিল গাদাগাদি করে রাখা শিশুদের বিছানা আর বাক্সে ভর্তি (নানা জিনিষের গুদাম); সেখানে প্রচুর পরিমাণের স্তুপীকৃত খেলনাও ছিল। আসবাবপত্র বলতে ছিল পুরনাে বিছানা, ছােট ছােট খাট এবং বিবর্ণ মেঝেতে পাতা ম্যাট, খেজুর পাতা বা তালপাতার তৈরি । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একই পাত্রে শিশুদের বারবার খাবার দেয়া হত । শিশুরা তাদের ছােট ছােট খাটে শােয়ানাে হতাে, বেশিরভাগ সময় ভিজে বিছানায়, কান্নাকাটি করত; মলের দুর্গন্ধ পেলেও যত্নের কোনাে ইতরবিশেষ হতাে না । টিমের সদস্যরা নবজাতকদের যে শুধু দেখতে পেতেন তা না, তাদেরকে অতি আদরে কোলে নেয়ার সুযােগ হতাে প্রতিদিন।
লক্ষণীয় দিকটি ছিল যে, শিশুদের বেড়ে উঠবার জন্য যে বিষয়টির সবচেয়ে প্রয়ােজন সে বিষয়টির প্রতি শিশু ভবন কর্তৃপক্ষ বিশেষ নজর রাখতেন। কর্তব্যরত কর্মীদের অসাধারণ আত্মত্যাগের মহিমায় কানাডীয় দল অনেকটা নতজানু হয়ে স্তম্ভিত নতজানু হয়ে গিয়েছিল । তারা বিস্ময়াভীভূত হয়ে দেখেন, কীভাবে আয়া, ধাই, নার্স, সেবিকা এবং ডাক্তাররা কেবল দায়সারাভাবে কাজ না করে কর্তব্যের বাইরে গিয়েও অনেক সময় মানবিকতার টানে পরিশ্রম করে চলেছিলেন। যদিও মল-মূত্রের দুর্গন্ধে পরিবেশ ভার হয়ে থাকত, স্পষ্টত শিশুদের জন্য। ভালােবাসা আদোরের কোনাে অভাব হয়নি; আয়া ও কর্মীরা কোনাে অভিযােগ না করে মুখ বুজে পরিশ্রম করেছেন, নির্দেশমতাে ইনজেকশন ও ওষুধ দিয়েছেন।
আজ পর্যন্ত টিমের সকলের ঢাকাস্থ অনাথ আশ্রমে যাওয়া এবং কাজ করার অভিজ্ঞতা মনের পটে অমােচনীয় ছবির মতাে আঁকা হয়ে রয়েছে। এখনও রবার্ট, হেলকে, এলিজাবেথ, ফ্রেড এবং বনি একা একা মনে করেন, কেমন করে সিস্টারদের অনুমতি নিয়ে শিশুদের কোলে তুলে নিয়েছিলেন! কেমন করে আলিঙ্গন করেছিলেন। তারা শিশুদের কোলে তুলে নিয়েছিলেন। সে সময়ে শিশুদের দলাই মলাই করে একটু ছোঁয়া নিতে চেয়েছিলেন। একদিক দিয়ে দেখলে, টিমের সদস্যরা অনাথ আশ্রমে গিয়ে যে সময় কাটাতেন, সেটাই তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবার শক্তি যুগিয়েছে। সব রকম টেনশন এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ঐ সপ্তাহগুলাে কাটানাে অবশ্যই অসহ্য হয়ে উঠতে পারত, যদি আমরা ঐ শিশুদের সঙ্গে রােজ সময় কাটাবার কোনাে সুযােগ না পেতাম। সত্যি বলতে কি, আমরা অনেক কিছু পাবার আশায় রােজকার ঐ সময়টার পানে চেয়ে থাকতাম। এই ছােট শিশুদের এমন বাঁচার ইচ্ছা যেন এরা আমাদের শপথকে প্রতিদিন নবায়ন করত, ফ্রেড পুরনাে কথা মনে করে বলেন।
রশীদ দম্পতির সহায়তা নিয়ে টিমের সদস্যরা প্রকল্পের ফাইল প্রতিদিন নিজ হাতে করে সরকারের এক অফিস থেকে অন্য অফিস অথবা এক অফিসারের টেবিল থেকে অন্য অফিসারের টেবিলে নিয়ে যেতেন অনুমােদনের কাজ ত্বরান্বিত করার জন্যে। কিছুদিনের মধ্যেই ক্যাপুচিনােরা জানতে পারলেন যে, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম বৃথা যায়নি। হঠাৎ খবর এলাে যে ছাড়পত্র তৈরি এবং টিম সময়সূচি অনুযায়ী তারা কানাডা ফিরে যেতে পারবেন, বেশ কিছু সংখ্যক যুদ্ধশিশু সঙ্গে নিয়ে যদি তারা চিকিৎসকদের মতে সুস্থ থেকে থাকে। এ উত্তেজক খবরে টিমের সদস্যরা আনন্দে আত্মহারা। তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে এত তাড়াতাড়ি তারা অনুমতিপত্র পেয়ে যাবেন। ক্যাপুচিনােদের হাতে যে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছিল, সেটা কেড়ে নিয়ে আনন্দে বিহ্বল ফ্রেড হুড়ােহুড়ি করে মন্ট্রিয়লে স্যান্ড্রা সিম্পসনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে এগিয়ে যান ।।
বাংলাদেশ সরকারের প্রয়ােজনীয় দলিলাদি
সরকারের প্রথমত দরকার ছিল জারিকৃত Bangladesh Abandoned Children (Special Provision) Order 1972-টি হাতে পাওয়া, যার দ্বারা যুদ্ধশিশুদের অভিভাবকত্ব হস্তান্তর করা ও দত্তক দেয়ার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন সম্ভব হবে (দ্বিতীয় অধ্যায় দেখুন)। তখনও ছিল মাত্র জুলাই মাস। প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখব যে অক্টোবর ১৯৭২-এর। আগে অর্ডারটি রীতিমাফিক কোনাে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তখনও আসেনি। সরকার নানা চিন্তাভাবনা করে মানবিক দিক দিয়ে বিচার করে যুদ্ধশিশুদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত নেন। বলা যেতে পারে, শােচনীয় ঘটনা প্রবাহই সরকারকে এ সিদ্ধান্তে পৌছতে সহায়তা করে। তাই বাংলাদেশ সরকার কানাডীয় টিমের অনুরােধে জারীকৃত খসড়া অর্ডারের আওতায় ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে কানাডাতে দত্তক নেবার জন্য ছাড়পত্র দেবার অনুমতি দেন। সরকারের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যুদ্ধশিশুদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানাের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন।
পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রয়ােজন ছিল একটি অনুমােদনপত্র যা আবেদনকারীর হােমস্টাডি সম্পন্ন করে সরকার তাদের দত্তকগ্রাহী পিতা-মাতা হবার যােগ্যতা প্রতিপন্ন করবে। এ চিঠি সাধারণত স্থানীয় চিলড্রেন’স এইড সােসাইটি (সি এ এস) পাঠায়; আমরা ইতােমধ্যে বেটি গ্রহাম-এর সম্পর্কে পড়েছি। এটা আইনসম্মত দত্তক প্রথায় প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপ। ঢাকাস্থ কর্মকর্তা এ কাগজটি দেখে যাচাই করে বুঝে নেবেন আবেদনকারী কানাডীয় হােমস্টাডি রিপাের্ট ও যাবতীয় প্রাসঙ্গিক দলিলাদি পরীক্ষা করে দেখবেন যে যােগ্যতা ও সক্ষমতা সত্যায়ন করা হয়েছে, সেটা আসলেই ঠিক কিনা; কানাডীয় আবেদনকারী বাংলাদেশি শিশুর দত্তক মা-বাবা হতে পারবেন কিনা।
সে সময়ে ঢাকাস্থ কর্মকর্তারা International Adoptions-Some Essential Principles শীর্ষক একটি পুস্তিকা কানাডাতে প্রাদেশিক সরকার ও সরকারি সংস্থাসমূহ দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ঘনিষ্ঠভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। ঐ দলিলে। পরিষ্কারভাবে লিখা রয়েছে কীভাবে দুটি দেশই এ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট হয়েছিল । দত্তক দেয়ার জন্য মা-বাবার নির্বাচন যুদ্ধশিশুদের “সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক” হিসাবে সিস্টার ম্যারিকে আবেদনকারীদের মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তার ব্যক্তিগত সুখ্যাতি এত ব্যাপক যে, স্বাস্থ্য পেশাজীবী এবং নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি যাদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন, তাকে যে কেবল একজন “agent of the state” রূপে দেখেন তা নয়, তারা তাকে একজন দয়ালু কর্মব্ৰতী নারী হিসেবেও দেখেন। তিনি জানতেন একটি শিশুকে বাঁচতে সাহায্য করা আর একটি শিশুকে প্রাণে বাঁচানাের মধ্যে তফাৎ কী, বিশেষ করে যে শিশুকে তার জন্মদেশে কেউই চায়নি।
দত্তক সুসম্পন্ন হবার জন্য তিনটি ঘটনা ঘটবার ছিল । সিস্টার ম্যারির প্রয়ােজন ছিল (১) যুদ্ধশিশুরা দত্তক নেবার উপযুক্ত হয়েছে কিনা সেটা বিবেচনা; (২) বাংলাদেশের বাইরে দত্তক প্রক্রিয়া “যুদ্ধশিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থে” সুপ্রচলিত কিনা তা নির্ধারণ করা এবং (৩) কানাডীয় প্রাদেশিক সরকার বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার মতাে আন্তবর্ণীয় আবেদনকারীকে যােগ্য কিনা সেটা বিবেচনা করা । সংক্ষেপে, কানাডীয় যে দলিলপত্রগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনাে আপত্তি নেই’ বলে সনদ পাঠানাে হয়েছে, সেগুলাের সত্যতা যাচাই করা । তাকে আরও দেখতে হয়েছে, দত্তক প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করার জন্য প্রাদেশিক আইন কানুন কানাডীয় ফেডারেল সরকারের রীতিনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা এবং সেগুলি এ ক্ষেত্রে পালন বা পূরণ করা হয়েছে কিনা।
কানাডাতে সমাজকর্মীরা যেভাবে এক একটি শিশুকে তাদের দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার সঙ্গে মেলান, কঠোরভাবে যে প্রক্রিয়া অনুসরণে প্রাপ্তব্য প্রচুর তথ্য হােমস্টাডি ও বাইরে থেকে সংগৃহীত, যেগুলি মিলিয়ে দেখা হয়, সেটা স্বভাবতই বাংলাদেশে সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে দত্তকে ইচ্ছুক দম্পতিদের নির্বাচনের সময় সিস্টার ম্যারি আশ্চর্যান্বিত হয়ে লক্ষ্য করেন যে, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি কানাডীয়দের সংখ্যা তখনও নেহাত কম ছিল না; কিন্তু কোনাে বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি কানাডীয় যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার জন্য আবেদন করেননি । অতএব, ঘটনাচক্রের সংযুক্তি মাথায় রেখে প্রথম থেকেই সিস্টার ম্যারি কিছু বিষয় বিবেচনা না করার সিদ্ধান্ত নেন। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক আবেদনকারীই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ কানাডীয় আর যুদ্ধশিশুরা ছিল দৃশ্যমান সংখ্যালঘু – অর্থাৎ ভিন্ন বর্ণীয় । তিনি সম্ভাব্য মা-বাবার তথ্যে পরিপূর্ণ ফাইলসমূহ যথেষ্ট তথ্যবহুল ও সঠিক কিনা সেটা নিরীক্ষণেই ব্যস্ত থাকেন।
তিনি এটা জানতেন যে সুদূর কানাডীয়বাসী একদল শ্বেতাঙ্গ মা-বাবা নির্বাচন করার অর্থ হলাে, বর্ণের দিক দিয়ে একেবারে অচেনা, অজানা একটি শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরা, তাকে আদর ও ভালােবাসা দেয়া । সিস্টার ম্যারি অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন যে বিষয়টি যত ভাবনা ও অনুভূতি দিয়ে ব্যক্ত করা হলেও একটি ঘনিষ্ঠ ও অকৃত্রিম সম্পর্ক গড়ে তােলার কাজগুলি যে কী কঠিন, কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে অসম্ভব, সেটা ভুক্তভােগীরা জানেন। সুপারিশপত্র যতই বিশিষ্ট হােক, প্রতি পদে খুঁটিনাটি অনুসরণ করে তাকে এগুতে হয়েছে দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার দলিল পুনরীক্ষণের কাজে, যাতে নিঃসন্দেহে কাজটি তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে করতে পারেন । তিনি আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন কাজটিতে যাতে বিন্দুমাত্র ফাক থেকে যায়, প্রক্রিয়া ফাকিতে না পড়ে।
সে সময় সিস্টার ম্যারিকে অনেক আঙ্গিকে চিন্তা করতে হয়েছিল এটা ভেবে যে, কিছু যুদ্ধশিশুদের বিদেশে দত্তক দেয়াকে যেন কেউ ভাবেন না যে বাংলাদেশ সরকার শিশুদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার দ্বার খুলে দত্তকের বাজার তৈরি করতে চাচ্ছে। বিষয়টিকে যেন এভাবে না দেখা হয় যে তিনি কারাে বাড়িতে একটি খালি শিশুর বিছানা (শিশুর ক্রিব) থাকলে সেখানেই একটি শিশুর স্থান করেনিচ্ছেন। তখনকার সময়ের প্রয়ােজনে তিনি কিছু সময় কাটান বিষয়টি পুরােপুরি হৃদয়ঙ্গম করার জন্য। একটি হৃদয়বান যুগল একটি বিপন্ন শিশুকে উদ্ধার করা; এবং একটি শিশুকে ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে গর্ভে ধারণের ঘটনার বিষয়টিতে যে পার্থক্য বিরাজ করে সেটা তিনি তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধির চেষ্টা করেন ।
সিস্টার ম্যারি শংকিত ছিলেন এটা ভেবে যে, এমনকি সবচেয়ে অভিজ্ঞ সমাজকর্মীও অমােঘ বিচার করতে ব্যর্থ হতে পারে। মানুষের স্বভাব এত অনিশ্চিত যে, অনেক সময় জাতিগােষ্ঠীর পার্থক্যের জন্য সম্পর্কে জটিলতা দেখা দেয়। এমনকি মা-বাবার চূড়ান্ত বাছাইয়েও ভুল হতে পারে । সিস্টার ম্যারি ক্যাপুচিনােদের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ব্যাপী কাজ করেনিশ্চিত হন যে দত্তক নিতে ইচ্ছুক মা-বাবার আইনি দায়িত্ব সম্পর্কে কারাে কোনাে ভুল বােঝর অবকাশ না থাকে।
তিনি ফাইলগুলাে বারবার পড়েছেন, বুঝতে চেষ্টা করেছেন, তিনি কি যথেষ্ট মানসিক ভারসাম্যের প্রমাণ পেয়েছেন? বৈবাহিক সম্পর্ক কি টেকসই মনে হচ্ছে? তাদের অর্থনৈতিক নির্ভরতা আছে কি? কানাডীয় টিমের দলপতিকে এ ব্যাপারে সিস্টার ম্যারি সচেতন করে দিয়েছিলেন যে আশ্রয়হীন দরিদ্র সাধারণ শিশুরা বাস্তবিকপক্ষে অত্যন্ত দুর্বল স্বাস্থ্যের শিশু।
সিস্টার ম্যারি আরও অনুভব করেন যে, শিশুর এবং দত্তকগ্রাহী মা-বাবার প্রয়ােজনের দুদিকটাই বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক। কানাডীয় পারিবারিক ইউনিট, যেটা সাধারণত মা-বাবা ও শিশু নিয়ে গঠিত এবং বর্ধিত পরিবারের সদস্যরাও যেন এ উপলক্ষে প্রস্তুত থাকেন নবজাতকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য। তিনি শুধু জানতেন যে, এ দম্পতিরা আকুল আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন কখন তারা তাদের পছন্দের শিশুকে জড়িয়ে নিতে পারবেন । নিঃসন্দেহে, প্রতিদিন বিকেলে ক্যাপুচিনােদের আগমন ও সিস্টার ম্যারির সঙ্গে প্রাত্যহিক ‘কথােপকথন সিস্টারকে এফ এফ সি’র উদ্দেশ্যাবলি বুঝতে এবং দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়েদের জানতে সাহায্য করেছে।
পুনরীক্ষণের পুরাে সময়টা জুড়ে সিস্টার ম্যারি নিজেকে প্রশ্ন করেন: দত্তক আবেদনকারীর অনেকেই যেখানে নিজ বর্ণ, গােত্রের সীমানা ভেঙে দত্তক নিয়েছেন, তার পরিবারের অভ্যন্তরীণ গতি-প্রকৃতি বােঝার জন্য তিনি কতটুকু সাবধানতা অবলম্বন করবেন? দত্তকায়িত শিশু ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মেলামেশা ও সম্পর্ক বিষয়ে তিনি কতটুকু জানেন? জারজত্বের সঙ্গে যে কলঙ্ককথা জড়িত, সেটাকে পাশ কাটিয়ে কতটুকু আলােকিত হবে তাদের হৃদয়? আবেদনকারীদের জীবনবৃত্তান্তের দলিল নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি নিজেকে বুঝবার জন্য এ প্রশ্নগুলাে জিজ্ঞাসা করেছেন।
তিনি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছেন: “শিশু ভবনে” বড় হওয়াটা কি শিশুর সর্বোচ্চ মঙ্গলের জন্য” সমর্থন করা উচিত? নাকি বিদেশে দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার আদর স্নেহে বড় হয়ে ওঠা শিশুর জন্য মঙ্গল? তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, শিশু পাচারের মতাে অপরাধ থেকে শিশুকে রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। আবেদনকারীদের ফাইলবন্দি বৃত্তান্তগুলাে সিস্টার ম্যারির কাছে ছিল হৃদয়গ্রাহী । ব্যক্তিগতভাবে সেটা তার মনে গভীর ছাপ ফেলে। তার অনুভূতিগত প্রতিক্রিয়া ছিল যে, আবেদনকারীদের ইচ্ছাসমূহ খাঁটি, তাদের কানাডীয় গৃহসমূহ তৈরি তাদের দত্তকায়িত সন্তানদের জন্য। তাছাড়া সিস্টার জানতেন কানাডীয় দম্পতিরা মানসিকভাবে যুদ্ধশিশুদের তাদের নিজের সন্তান বলেই গ্রহণ করার অঙ্গীকার নিয়ে সেসব -দেখা-সন্তানদের গ্রহণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের খুঁটিনাটি পরীক্ষার পর সিস্টার ম্যারি ১৪টি দম্পতিকে নির্বাচন করেন।
যুদ্ধশিশুদের নির্বাচন
সিস্টার ম্যারি যতদিনে মা-বাবার সংক্ষিপ্তসার পরীক্ষা করে শেষ করেন, ক্যাপুচিনােদের ঢাকায় ততদিনে প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে যায়। ইতােমধ্যে যেসব শিশু মেয়াদ পূর্ণ হবার আগে জন্মেছিল, তারা আর বাঁচেনি। ওখানে উপস্থিত থাকায় ক্যাপুচিনােদের স্বচক্ষে দেখার সুযােগ হয়েছিল কীভাবে শিশু ভবন ও সেবা সদনে সিস্টাররা নবজাতকদের বাঁচাবার জন্য কী কষ্টই করেছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সেসব দুর্বল শিশুদের বাঁচাতে পারেননি।
যুদ্ধশিশু বাছাইয়ের জন্য এফ এফ সি টিম সচারাচর যা করে সেরকম কিছু করেনি। সাধারণত সম্ভাব্য মা-বাবা শিশুদের পেছনের কথা এবং জীবনবৃত্তান্ত জেনে তারপর একটি শিশু বেছে নেন। বিদেশি একটি সংস্থা সাধারণত শিশুদের একটি প্রােফাইল তৈরি করে, যাতে শিশুর একটি ছবিও এঁটে দেয়। পরিবর্তে সাধারণত ক্যাপুচিনােরা সাধাসিধেভাবে দেখে শুনে ওদের যে শিশুগুলাে ভ্রমণের কষ্ট সহ্য করে প্রাণে বাঁচবে মনে হয়েছে, সেগুলােকে বাছাই করেন। দত্তক গ্রহণে ইচ্ছুক দম্পতিদের নির্বাচন করলেও সিস্টার ম্যারি যুদ্ধশিশু নির্বাচনের দায়িত্ব পুরােপুরি কানাডীয় দলের ওপরে ছেড়ে দেন।
সে সময় এত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সিস্টার ম্যারি একটি সাংঘর্ষিক অবস্থায় পড়ে যান। বস্তুতপক্ষে এমনি শােচনীয় পরিস্থিতে পড়েন যে, সামনে বা পেছনে, কোথাও যেতে পারছিলেন না। (আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখেছি) আই এস এস’র সুপারিশ ছিল যে, বাংলাদেশি অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষ “অবাঞ্ছিত” নবজাতকদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন। “বাইরে পাঠিয়ে দেন। এ কথা সিস্টার ম্যারির জানা ছিল যে, সাধারণত পরিত্যক্ত শিশুদের যত আগে দত্তক নেয়া মায়েদের সাথে যােগাযােগ সৃষ্টি করা ততই ভালাে । কিন্তু তিনি নিজের কাছে নিজে শপথ করেছিলেন যে, তিনি যুদ্ধশিশুদের ততদিন রাখবেন যতদিন না তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন যেসব দম্পতিদের ফাইল পরীক্ষা করছেন তারা যেন হয় সবচেয়ে আদর্শ মা-বাবা।
সিস্টার ম্যারির মতে, আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় ছিলে যে তিনি বিশ্বাস করতেন যে “একটি জীবন্ত পরিবার যে কোনাে সুখ্যাত প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বেশি উপকারী।”৬৭ সবশেষে, ক্যাপুচিনােরা ১৫টি যুদ্ধ শিশু ১৪টি দম্পতির জন্য নির্বাচন করেন; প্রত্যেকের জন্য একটি করে, শুধুমাত্র রবার্ট ও হেলকে ফেরি দুটি যুদ্ধশিশু দত্তক নেবার জন্য নির্বাচন করেন।
দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়েদের চূড়ান্ত নির্বাচন সেরে এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য তাদের পছন্দের শিশুকে মিলিয়ে দিয়ে, ভাবাবেগী সিস্টার ম্যারি টিমকে জানালেন যে, যদিও অপুষ্ট এবং ওজনে কম, এ শিশুদের বিদেশে দত্তকের জন্য দেয়া যেতে পারে। সংক্ষেপে, সিস্টার ম্যারি তার বক্তব্যটি আরও পরিষ্কার করে বলেন যে, সরকারের দেয়া কথা অনুসারে এবং কানাডীয় ও বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রয়ােজন অনুসারে যুদ্ধশিশুদের নির্বাচন ক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। এতে উভয় পক্ষই খুশি এবং আনন্দে আত্মহারা।
যুদ্ধশিশুদের বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা
কানাডীয় সরকার শিশুদের দুর্বল শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে পুরােপুরি অবগত ছিলেন শিশুদের অপুষ্ট অবস্থায় দেখার পর। একই সাথে কানাডীয় টিমের সদস্যরা ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফলের বিষয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন এটা ভেবে যে, কম ওজনের শিশুদের যদি স্বাস্থ্যগত কারণে অযােগ্য বলে নাকচ করে দেয়া হয়। সে জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়ােজনে যা যা করা হয়, কানাডীয় ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট অব ম্যানপাওয়ার এন্ড ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাদের কাজে ততখানি আনুষ্ঠানিকতার ধার ধারেন নি। আমরা ইতােমধ্যে দেখেছি, ম্যাকাসে, ম্যানপাওয়ার মন্ত্রী তাদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন প্রথমে-ই। বাংলাদেশে ইমিগ্রেশন সম্পর্কিত কাজগুলাে ব্যাঙ্ককস্থ কানাডীয় দূতাবাস সম্পন্ন করে আসছিল।
স্পষ্টত, ডিরেক্টর অব অপারেশন নিয়মবিধির ভিতরে থেকে যাতে যতটুকু সম্ভব কমিটি কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করা যায় সে দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে আইনের নমনীয়তার পথ খুঁজে বের করেন। “যেভাবে এই শিশুদের ইমিগ্রেশনের জন্য প্রক্রিয়াকরণ সম্ভব একটুও দেরি না করে সেদিকে চিন্তাভাবনা করার নির্দেশ দেন। সাথে সাথে এ ফাইলে দায়িত্বে নিয়ােজিত অফিসাররা হাতের কাজে মনােনিবেশ করে ক্যাপুচিনােদের জানালেন এভাবে: “যেহেতু এসব ছােট ছােট শিশুদের হংকং-এ নিয়ে যেতে আপনারা নানা অসুবিধার সম্মুখীন হবেন, এবং আপনাদের মতে এদের নতুন দিল্লিতে নিয়ে যেতে কোনাে বিশেষ অসুবিধে হবে না, সেজন্য মানবিক কারণে কাজটি দিল্লি অফিস থেকে সম্পন্ন করা হবে। তাদের আরও জানানাে হলাে যে, এ ব্যাপারে মন্ত্রী ম্যাকাসের কর্মকর্তারা তাদের সর্বোচ্চ সহযােগিতা করবেন।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সে মুহুর্তে ক্যাপুচিনােরা আশ্বস্ত হয়ে আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু পরমুহুর্তে তারা আবারও দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। স্বাস্থ্য পরীক্ষা যেখানেই হােক, ক্যাপুচিনােরা আশঙ্কিত ছিলেন এটা ভেবে যে পরীক্ষকরা খুব খুঁটিনাটি জিনিস অত্যন্ত কড়া মানদন্ড ব্যবহার করে পরীক্ষা করবেন, তাতে ঐ স্বল্প ওজনের শিশুরা স্বাস্থ্য পরীক্ষাতে টিকতে পারবে এরকম মনে হচ্ছিল না। ডাক্তাররা কি ওদের শেষ পর্যন্ত কানাডায় ঢুকতে
দেবেন? ক্যাপুচিনোেরা এ প্রশ্নটি অনেকবার নিজেদেরকে করেছেন । লিঙ্কন আলেকজেন্ডার তদানীন্তন হ্যামিলটন ওয়েস্ট-এর একজন কনসার্ভেটিভ মেম্বার অব পার্লামেন্ট অন্টেরিও’র সম্ভাব্য দত্তক নেয়া বাবা-মায়েদের পক্ষে এ বিষয়ে খোঁজ নেন। ম্যাকাসে তাকে এ মর্মে জানিয়েছিলেন: “ওই শিশুদের জন্য স্বাভাবিক অভিবাসন আবেদনকারীদের যেমন হয়, তার তুলনায় সহজ একটি পরীক্ষার বিষয়ে আমরা অনুরােধ করেছি । ওই শিশুদের ডাক্তারি পরীক্ষা। নয়াদিল্লি করবে, অথবা সংগঠকদের জন্য যদি সুবিধা হয়, তাহলে কুয়ালালামপুর ।
এর ফলে। একটি শিশুকে আলাদা করে নয়াদিল্লি অথবা কুয়ালালামপুর পরীক্ষার জন্য নিয়ে যেতে হবে। আরও কথা হলাে, বাংলাদেশ সরকারের যেহেতু ডাঃ ফেরির দ্বারা শিশুদের ডাক্তারি। পরীক্ষায় কোনাে আপত্তি নেই, অভিবাসন মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ তার পরীক্ষার ফলাফল সরকারি কাজের প্রয়ােজন মেটাবার উপযােগী বলে গ্রহণ করবেন।” কানাডীয় টিমের সদস্যরা জেনে আরও আশ্বস্ত হলেন যে, তাদেরই দলের অন্যতম সদস্য ডাঃ রবার্ট ফেরি, রয়েল কলেজ অব সার্জনস, এর ফেলাে এবং বার্লিংটন অন্টেরিও জোসেফ ব্রান্ট মেমােরিয়াল। হাসপাতালের একজন সুযােগ্য শল্য চিকিৎসাবিদ, যুদ্ধশিশুদের আনুষ্ঠানিক পরীক্ষার জন্য অনুমােদিত চিকিৎসকরূপে কর্তব্য পালন করবেন। ডাঃ ফেরিকে বলা হলাে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষ করার পর, তিনি নয়া দিল্লিস্থ মেডিক্যাল অফিসারকে শিশুদের মেডিক্যাল রিপাের্ট (এক্স-রে, টিউবারকিউলিন পরীক্ষার রিপাের্ট, ইত্যাদি) দেখাবেন যাতে উনি সেগুলাে পুনরীক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে পারেন। তাকে আরও জানানাে হলাে যে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়ে গেলে এবং কানাডা থেকে আই এস এস ১০০৯ (স্পন্সরশিপের জন্য মূল ফর্ম) পেয়ে যাবেন। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমােদন ও পাসপাের্ট ইস্যু করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচিত শিশুরা কানাডার ভিসা পেয়ে যাবেন। ডাঃ ফেরি সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব গ্রহণ করে অনাথ আশ্রমে শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগেন, ঢাকা শহরের ভাড়াক্রান্ত এলাকায় শিশু ভবনে যেখানে অনেক যুদ্ধশিশুদের জন্ম হয়েছিল; সে সময়ে সেখানে অনেক যুদ্ধশিশুকে নিয়ে আসা হয়েছিল দত্তক দেয়ার জন্য । ডাঃ ফেরি তখন কানাডীয় হাই কমিশনে সংশ্লিষ্ট নয়া দিল্লিস্থ ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাশন্যাল হেলথ এন্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার-এর অস্থায়ী মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ লেক্লার্ক-এর সঙ্গে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করেন । ডাঃ ফেরি শিশু ভবনে ১৫ জন শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন এবং প্রত্যেক শিশুর বিবরণ আলাদা ভাবে নথিবদ্ধ করেন। যেহেতু ডাঃ ফেরির এ শিশুদের গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা ছিল না তিনি সামান্য তথ্য দিয়ে তার প্রতিবেদন তৈরি করেন। তারপর পর তিনি সব রিপাের্ট নয়া দিল্লিস্থ ন্যাশন্যাল হেলথ এন্ড । ওয়েলফেয়ার-এর কর্মীর নিকট পাঠিয়ে দেন। ডাক্তারি পরীক্ষা ব্যাপারে বিষয়টি জরুরি হিসাবে গ্রাহ্য করে কানাডীয় ফেডারেল সরকার আরেকটি ছাড় দিলেন, সেটা হলাে দ্বিতীয় দফা স্বাস্থ্য পরীক্ষার আর প্রয়ােজন হলাে না। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ডাঃ ফেরি যুদ্ধশিশুদের যে স্বাস্থ্য পরীক্ষার যে রিপাের্ট পাঠিয়েছিলেন, সেটাই চুড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হিসাবে গ্রহণ করেন, এটা বলে যে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল ছয় মাসের জন্য আইনসম্মত বলে বলবৎ থাকবে এবং শিশুদের ঐ সময়ের মধ্যে কানাডা নিয়ে যেতে হবে।
ভ্রমণ পারমিট ইস্যু করা
ডাক্তারি পরীক্ষা হয়ে গেলে কানাডীয় টিমকে ১৫ জন শিশুর জন্য পাসপাের্ট এবং সফরের কাগজ সংগ্রহ করার জন্য উঠেপড়ে লাগতে হলাে। বাংলাদেশ সরকার সিস্টার ম্যারি নির্বাচিত শিশুদের নাম পেয়েছিলেন, ১৫ জন শিশুর জন্য ইতিবাচক ডাক্তারি ছাড়পত্রও পেলেন। এখন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে যুদ্ধশিশুদের কানাডা যেতে দেবেন কিনা। যুদ্ধশিশুদের সবসেরা স্বার্থে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকার তখন ১৫ জন শিশুর জন্য ছাড়পত্র দিলেন, সেটা সম্ভব হয় স্পেশাল প্রভিশন অর্ডার-এর আওতায় (যে বিষয়টি আমরা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলােচনা করেছি)। কিন্তু বস্তুতপক্ষে জুলাই মাসেও সে আইনটি প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে জানানাে হলাে যে আগামী কয়েক মাসে এটা কার্যকর হবে। সরকারের লক্ষ্য ছিল কোনাে ঢাকঢোল না পিটিয়ে, কাউকে না জানিয়ে কোনাে ধরনের প্রচারণা ছাড়াই আইনসম্মতভাবে দত্তক গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে কানাডা নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়া ।
সরকারের বিশ্বাস ছিল যে, এভাবে কাজটি করলে প্রচারণা ও সম্ভাব্য অশান্তি এড়ানাে যাবে । এমতাবস্থায় অন্য ধরনের ঘটনা সমাজকে বিচলিত বা অস্থির করে তুলবে না । ঝুঁকি বাস্তবিক ছিল, কারণ দেশটা সদ্য রক্তে স্নান করে উঠেছে। সেখানে কেউ আরও রক্তপাতের কথা ভাবতে চায়নি। সারাদেশে ও, সমাজে, তখন এমন অস্থিরতা, এমন টালমাটাল অবস্থা যে, যুদ্ধশিশুদের মতাে আরেকটি স্পর্শকাতর ইস্যু সেখানে জনগণের সামনে উপস্থাপন হােক সেটা কেউ চাইনি।
সরকারি নথি অনুযায়ী প্রায় সাথে সাথেই শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ১৭ জুলাই ১৯৭২ তারিখে একটি চিঠির আকারে যুদ্ধশিশুদের ভ্রমণ পারমিট দেয়া হয়। এ পারমিট তৈরিকালে সরকার প্রত্যেক নির্বাচিত পরিত্যক্ত শিশুর নাম কপি করেন শিশু ভবন প্রদত্ত জন্ম সনদপত্র থেকে।
অনুমােদন পত্রটি এম, শারাফাতউল্লাহ, তদানীন্তন ডেপুটি সচিব, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি নিখুঁত দলিল যাতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান চিঠিতে পুনবার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি চিঠিটি লিখেছেন মাদার তেরেসাকে। আমরা প্রথম অধ্যায়ে দেখেছি কেমন করে তেরেসা তার শিশু ভবনে পরিত্যক্ত শিশুদের রেখেছিলেন। দত্তক দেয়ার উদ্দেশ্যে। পনের জন যুদ্ধশিশুর ছাড়পত্র একটি ৮.৫০”x১৪” সিঙ্গল লিগ্যাল সাইজ কাগজে ছাপানাে তথ্য বিশেষ। চিঠিতে শিশুদের নাম, তাদের জন্ম তারিখ, লৈঙ্গিক চিহ্ন, কানাডাতে প্রস্তাবিত প্রাদেশিক সরকার অনুমােদিত এবং দত্তক নিতে অঙ্গিকারবদ্ধ মাবাবার নাম-ঠিকানা ছিল।
এ দলিলটি কেবল পাসপাের্ট হিসেবেই গণ্য করা হয়নি, বরং এটা গ্রুপ পাসপাের্ট, ভ্রমণ দলিল, ভ্রমণ পারমিট, ছাড়পত্র, দেশ ত্যাগের পারমিট ইত্যাদি নামে গণ্য করা হয়েছিল – যার প্রয়ােজন যেভাবে মেটে আর কি! যুদ্ধশিশুদের জন্য বাংলাদেশের বাইরে যাবার একমাত্র দলিল ছিল এটা। সরকার এ দলিলটি ইস্যু করেছিলেন এটা ভেবে যে, এটাই ঐ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দ্রুত করা সম্ভব ছিল, যেটা এককভাবে কতগুলাে পাসপাের্ট তৈরি করার চেয়ে সহজতর হয়েছিল ।
একই সাথে তার চিঠির মাধ্যমে পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের “সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক” হিসাবে ডেপুটি সেক্রেটারি আবার মাদার তেরেসাকে সরকারের শর্তের কিছুটা অংশ স্মরণ করিয়ে দেন, “কানাডীয় আইনের আওতায় যথাসময়ে এরা (অর্থাৎ যুদ্ধশিশুরা) কানাডীয় নাগরিক হিসাবে পরিচিতি লাভ করবে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকারের আর কোনাে দায়দায়িত্ব রইল এই শিশুদের ব্যাপারে।” এখানে ধরে নেয়া হয় যে, কানাডার প্রাদেশিক সরকারগুলির ফলাে-আপের দায়িত্ব থাকবে যার যার প্রদেশে যে দত্তক হিসাবে যাবে সে প্রদেশের, আবার বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করে বলা হলাে যে, উপরােক্ত শিশুদের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে এটা আশা করে যে, তারা স্থানান্তরিত হবার যেসব পরিবার পরবর্তী সেবাসমূহ যা সাধারণত প্রদেশগুলাে সরবরাহ করে থাকে, বাংলাদেশি শিশু দত্তক যারা নিতে যাচ্ছে, সেসব সেবাগুলাে পরিবারদের কাজে লাগবে।
গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছিল, যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনাে দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতে কোনাে পরিস্থিতিতে আর থাকবে না । ঐ হিসাবে শ্রম ও সমাজকল্যাণ এবং আইন ও পার্লামেন্ট বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল এটা নিশ্চিত করা যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দত্তকগ্রাহী মা-বাবার আইনি শপথ সর্বোচ্চ প্রতিপন্ন হবে। শারাফাতউল্লাহ মাদার তেরেসাকে আরও বলেন যে, ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে বাংলাদেশ থেকে কানাডা যেতে দেয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে, ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাের দায়িত্বে যাদের সঙ্গী থাকছেন আরও তিনজন টিম সদস্য, রবার্ট ও হেলকে ফেরি এবং এলিজাবেথ মৌলিং।
এ প্রসঙ্গে আমরা গবেষক জি, আর, এলটন ইতিহাস এবং প্রামাণিক দলিলাদির বিষয়ে আলােচনা করতে গিয়ে যা উল্লেখ করেছেন সে উক্তিটি পুনর্ব্যক্ত করা যেতে পারে। এলটনের কথামতাে আমরা যদি, প্রমাণকে “ঐতিহাসিক ঘটনার বেঁচে থাকা অংশ হিসাবে গণ্য করি, বর্তমানের এ ভ্রমণ দলিল (ছাড়পত্র অথবা গ্রুপ পাসপাের্ট যেমন অনেক ক্ষেত্রে বলা হয়েছে), যাতে শিশুদের নাম রয়েছে; তবে সে ১৫ জনের জন্ম, পরিত্যাগের ঘটনা, পরবর্তী। সময়ে ১৯৭২ সালে কানাডাতে দত্তক নেয়ার পর্যাপ্ত প্রমাণ হিসাবে পরিগণিত করতে পারি । মূলত ভবিষ্যৎ গবেষকদের কাছে এ মূল্যবান দলিলটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বর্ণনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে গ্রাহ্য হবে চিরকাল।
এফ এফ সি দলপতি ফ্রেড ঐ একই দলিলের ১৫টি ফটোকপি তৈরি করেন এবং তাতে শিশু্যত্রীর ছবি সংযুক্ত করেন। তিনি একেক পাতায় একটি ছবি লাগান যাতে ১৫ টি শিশুকেই পৃথকভাবে চেনা যায়, এমনভাবে ভ্রমণ দলিল তৈরি করেন। ফ্রেড প্রত্যেক শিশুর জন্য নামের ট্যাগও তৈরি করেন, ডাক্তারি নথিপত্র গুছিয়ে নেন, এবং আবশ্যক সনাক্তকারী তথ্যাদি তৈরি করেন। ফ্রেড লক্ষ্য করেন যে, বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বেশি সময় নিলেও কাজগুলাে মনােযােগ দিয়ে করেছেন। স্বভাবতই কানাডীয় টিম তখনও মহাআনন্দে বিহ্বল ।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে হর্ষোৎফুল্ল ফ্রেড তার মনের কথা ব্যক্ত করেন: “এটা এক অসাধারণ ঘটনা যেখানে প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র গুরুত্বের সাথে মানুষের জরুরী অবস্থায় তার প্রকৃত চাহিদার বিষয়কে সত্যিকার অর্থে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।”* চোখে আনন্দাশ্রু আর হাতে ভ্রমণ পারমিট নিয়ে ফ্রেড কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সবাইকে।
বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়া
চূড়ান্ত ছাড়পত্র হাতে পেয়ে যাবার পর, তাদের নির্ধারিত ফেরত যাত্রার দুদিন আগে ফ্রেড ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসকে বাংলাদেশ ত্যাগ করার সময়সূচি সরবরাহ নিশ্চিত করতে বলেন। ফ্রেড একই সাথে জোর দিয়ে বললেন যে, এ বিষয়টি যেন আরও নিশ্চিত করতে যে এয়ারলাইনস ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে নিতে তৈরি । যেহেতু প্রায় সব নির্বাচিত যুদ্ধশিশুই তাদের | মেয়াদের আগে জন্ম নিয়েছিল, টিম সদস্যরা শঙ্কিত হলেন যে তাদের অনেকেই হয়তাে দীর্ঘ | যত্রার ঝাকুনি সামলাতে পারবে না। উড়ােজাহাজের ভাড়া এবং সেবাসমূহ নিয়ে কথাবার্তা বলার সময় তারা তাদের শুধু একটি প্রশ্নই বারবার জিজ্ঞাসা করেন: অল্প ওজন ও দুর্বল শিশুদের জন্য ভ্রমণ সহনীয় করবার কোনাে উপায় আছে কি তারপর তারা ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল এবং নয়া দিল্লিস্থ কানাডীয় হাই কমিশনের সঙ্গে | যােগাযােগ করেন। হাই কমিশন কর্মকর্তারা ঢাকা ও দিল্লির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তাদের দায়িত্ব | মােচন শেষে জানালেন যে, সকল আনুষ্ঠানিকতার কাজ শেষ। সব ধরনের লেখালেখির কাজ, যেমন বাংলাদেশ ও কানাডীয় সরকার, কানাডীয় প্রাদেশিক সরকারবৃন্দ এবং নির্বাচিত দত্তকগ্রাহী বাবা-মাসহ সবাইকে তাদের কানাডা ফেরত যাত্রার পরিকল্পনা বিষয়ে অবগত করে ফ্রেড এবং দলের সদস্যরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
একই সাথে কানাডীয় হাই কমিশনের নয়াদিল্লিস্থ অফিস এফ এফ সি’র প্রধান যােগসূত্র মন্ট্রিয়লের স্যান্ড্রা সিম্পসনকে টেলেক্স পাঠান যাতে তিনি কানাডাতে টিমের ফেরত যাত্রা সমন্বয় করতে পারেন। কালক্ষেপণ না করে স্বভাবতই উত্তেজিত স্যাভ্রা সকল অনুমােদিত বাবা-মাকে জানালেন টিম ২০ জুলাই ১৯৭২ তারিখে ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে নিয়ে কানাডাতে পৌছুনাের বার্তা। তিনি পৃথকভাবে মন্ট্রিয়াল ও টরােন্টোতে কারা কারা আসছে সেটাও বিস্তারিতভাবে জানান । যুদ্ধশিশুদের অবিদিত ভ্রমণ ও দত্তকায়নের কাহিনী আমরা পরের | অধ্যায়গুলােতে আলােচনা করব।
সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী