গুডবাই সামার
বাংলাদেশ নিয়ে কনসার্টের কথা উঠলে আমরা জর্জ হ্যারিসনের কনসার্ট ফর বাংলাদেশকেই বুঝি। কিন্তু না, বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কনসার্ট হয়েছে, একক গান পরিবেশিত হয়েছে। আজ ৫০ বছর পর এ ধরণের একটি কনসার্টের খোঁজ দিয়েছেন মতিউর রহমান। এর নাম গুডবাই সামার কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ওভাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কনসার্টটি হয়েছিল। এর উদ্যোক্তা ছিল কস্তুর নামের একটি দাতব্য সংগঠন।
কনসার্টে যোগ দিয়েছিল দা হু, দা ফেসেস, মট দা হুপল, লিন্ডিসফার্ন, কুইনটেসেন্স, অ্যাটমিক রুস্টার, ইউজিন ওয়ালেস, দা গ্রিস ব্যান্ড, কোচিস এবং যুক্তরাষ্ট্রের অ্যামেরিকা
দেড় পাউন্ড ছিল টিকেটের দাম। কনসার্ট থেকে আয় হয়েছিল ১৮, ৩৩৬ পাউন্ড। হু তার প্রাপ্য থেকে ২৫ ভাগ দান করেছিল বাংলাদেশের জন্য। সারে ক্রিকেট ক্লাব-কে দেওয়া হয়েছিল ৩০০০ পাউন্ড। শরণার্থীদের জন্য খুব সম্ভব ১৫০০০ পাউন্ড দান করা হয়েছিল। বেলা ১১টায় শুরু হয়ে রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত চলেছিল কনসার্ট। প্রায় ৩৫০০০ দর্শক হয়েছিল। সে হিসাব ঠিক হলে প্রায় ৫২,৫০০ পাউন্ড আয় হয়েছিল।
ইংল্যান্ডের ব্যান্ড দল কোচিস। কান্ট্রি রক ব্যান্ড। এর প্রধান গায়ক ছিলেন স্টুয়ার্ট ব্রাউন। এলটন জনের সঙ্গে পরে তিনি ক্রুসোল নামে একটি দলও গড়েছিলেন। দা গ্রিস ব্যান্ড ব্রিটিশ রক ব্যান্ড। কোচিস এর পর তারা মঞ্চে পরিবেশনা করেছিল। ব্রিটিশ আরেকটি রক ব্যান্ড অ্যাটমিক রুস্টার। তাদের সেই সময় আমেরিকা সফর করার কথা। কিন্তু, বাংলাদেশের জন্য কনসার্টের আমন্ত্রণ পেয়ে তাঁরা মার্কিন সফর বাতিল করেন। ১৯৭১ সালে তাদের পরিবেশিত দুটি গান ‘টুমরো নাইট’ ও ‘ডেভিল’স আনসার’ ইংল্যান্ডের বেল্ট সেলিং রেকর্ড তালিকায় স্থান পেয়েছিল।
কুইন্টিসেন্স ছিল ভিন্নধর্মী ব্যান্ড। ভারতীয় জ্যাজ, রক সব মিলিয়ে ছিল দলটি। এর রিদম গিটারিস্ট ছিলেন মহাদেব, বেস গিটারিস্ট শম্ভু বাবাজি, লিড গিটারিস্ট অ্যালান মস্টার্ট, পার্কসনিস্ট ও ভোকাল শিবশঙ্কর জোনস, ড্রামার জ্যাক মিল্টন ও বাঁশী রাজা রাম। ৪৫ মিনিট ধরে তাঁরা পরিবেশন করেছিলেন। ঐ সময় জনপ্রিয় ব্যান্ড দল হিসেবে পরিচিত ছিল কুইন্টিসেন্স।
বিকেলে গান পরিবেশন করেছিল আরেকটি ব্রিটিশ দল মট দা হুপল। সময় ‘অল দা ইয়ং ডিইডস’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
লিন্ডিসফার্ন গড়ে উঠেছিল অ্যালান হান্স ও রড ক্রেসেন্ট। তিনবছরের মধ্যে প্রকাশিত দুটি অ্যালবাম ‘ফগ অন দা টাইন’ ও ‘নাইসলি আউট অব টিউন’ খ্যাতিমান করে তুলেছিল। এদলের গায়ক ছিলেন অ্যালান হাল।
এদের মধ্যে খানিকটা অপরিচিত আইরিশ গায়ক ইউজিন ওয়ালেস। তবে, কনসার্টের আকর্ষণ দা হু এবং দা ফেসেস।
১৯৬৯ সালে গায়ক রড স্টুয়ার্ডের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে দা ফেসেস। রড স্টুয়ার্ড তখন তুমুল জনপ্রিয়। এই দলের কী বোর্ডে ছিলেন আয়ান ম্যাকলাগান, বেস গিটারিস্ট ও ভোকাল রনি লেন,ড্রামার কেনি জোনস, গিটারিস্ট রনি উড। তবে, চিনতেন সবাই রড স্টুয়ার্ডকে [পরবর্তীকালে স্যার]।
সবশেষে মঞ্চে এসেছিল দি ফেসেস। দর্শকদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। রড স্টুয়ার্ট একটি চিতাবাঘের চামড়ার স্যুট পরেছিলেন। পরে এটি নিলামে তুলেছিলেন। ৫০০ পাউন্ডে তা বিক্রি হয়েছিল। মতিউর রহমান নিয়াজ আলমের এক সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত করেছেন, “সেদিন রড ভিড়ের মধ্যে ৫০০ ফুটবলে লাথি মেরেছিলেন, যা দর্শকদের অনেকক্ষণ ধরে মাতিয়ে রেখেছিল।” রড স্টুয়ার্ট বলেন, “তাঁরা ছিলেন আমাদের সেবক।… লন্ডনে নানান জাতির লেখকজন এসেছে। দ্বিতীয়ত বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় ১০ হাজার সোমালীয় এসেছে। সুতরাং সেখানে আসলে ছিলেন আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই। বাংলাদেশিরা কাজ পাগল। কঠোর পরিশ্রম করতে পারে তারা। এ কারণে আমরা তাদের শ্রদ্ধা করতাম, ভালোবাসতাম। আমরা মূলত তাদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। এ পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্য করতে পেরে আমরা সম্মানিত বোধ করছি।’
হু গড়ে উঠেছিল লন্ডনে, ১৯৬৪ সালে। এদের ভোকাল বা গায়ক ছিলেন দু’ জন রজার ডাল্ট্রে ও পিট টাউনশেন্ড। বেস গিটারিস্ট জন এটউইসল ও ড্রামে ছিলেন কিম মুন। হু সেদিন মাতিয়ে দিয়েছিলেন নতুন সাউন্ড সিস্টেম ব্যাবহার করে। এই সাউন্ড সিস্টেমের কারণে, অনেকে বিপাকে পড়েছিলেন। খুব আগ্রাসী ভঙ্গিতে তাঁরা পরিবেশন করেছিলেন। শুধু তাই নয় তাদের অধিকাংশ গান ছিল নতুন। ‘সামারটাইম লুজ’ দিয়ে তাঁরা শুরু করেছিলেন। ‘জেনারেশন’ গাওয়ার সময় টাউন্ডশেল্ড গিটার ভেঙে ফেলেন।
সঙ্গীত সমালোচক ক্রিম চার্লসঅর্থ হু কে কনসার্টের বিজয় মুকুট দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন তিনি— “Not that the faces played badly, The warmed up into one of their spontaneous chunks of exitement comfortably- but the who played and sounded better. Comparisons with groups like the who are unfair, but the sight of the audience cheering and waving their areas when the who’s gigantic are light were switched on is a sight I shall remember for many a year.
মতিউর রহমান আরো কিছু ব্লগ ও সঙ্গীত রসিকদের বক্তব্যের সারমর্ম করেছেন এভাবে “সৌভাগ্যক্রমে পুরো সন্ধ্যাটা আক্ষরিকভাবেই পাল্টে দিয়েছিল ব্যান্ড দল হু এবং দা ফেসেস। আগত দর্শকদের রঙ্গিন বর্ণাঢ্য এই পোশাকের মতোই গুডবাই সামার কনসার্ট টিও হু এবং ফেসেসের কারণে হয়ে উঠেছিল তুমুল কোলাহলপূর্ণ, উন্মাদনাময় ও বর্ণাঢ্য। রাতে যখন বিস্তীর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল রংধনুর মতো আলো, দর্শকেরা চিৎকার করে, দুহাত নাড়িয়ে উল্লাস করছিলেন।
বাংলাদেশের এক চরম দুঃসময়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশ্বনন্দিত শিল্পী, সাহিত্যিক কবি বা গায়কেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন হৃদয় দিয়ে। তাঁরা গলা খুলে চিৎকার করে গান করেছেন বাংলাদেশের পক্ষে। সে চিৎকারে এগিয়ে এসেছেন বিদেশিরা। বাংলাদেশকে নিয়ে বাঁধা তাঁদের সুর পৌঁছেছে বিশ্ববাসীর কাছে।”
সূত্র: মতিউর রহমান, “গুডবাই সামার কনসার্ট ফর বাংলাদেশ”, প্রথম আলো, সংখ্যা, ২০২১
Chris Charleswarth. The Who and the Faces at oval, blog, internet.
www.ukrockfestivals.com/goodbye-summer-1971.html.
একাত্তরের বন্ধু যাঁরা- মুনতাসীর মামুন