You dont have javascript enabled! Please enable it!

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত কলেজের শিক্ষকবৃন্দ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সবাই মিলে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায়তা করার জন্য গঠন করেছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি। এর উদ্যোক্তা ছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ সালে যুক্ত ছিলেন সোশালিস্ট পার্টির সঙ্গে। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সভার সদস্য। সমিতির উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ সেন। সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তী। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যুক্ত ছিলেন সমিতির সঙ্গে।
সমিতি শরণার্থী বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের জন্য কাজ করেছিলেন। বইপত্র পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চল ও বিদেশে জনমত সংগঠনে কাজ করেছিলেন। এসব নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে বিভিন্ন গ্রন্থে। আমি শুধু দু’একটি বিষয় আলোচনা করব।
আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত সমিতির অফিসে আসতেন তাঁদের একটি বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। জ্ঞানেশ পত্রনবীশ বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঙ্গে ১৯৪৯ সালে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। পি.ডি. সেন শর্মা ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে এমএসসি পাস করেছিলেন। আরও ছিলেন সৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যতীন চট্টোপাধ্যায়, সন্দ্বীপ দাশ, যোধপুর পার্ক গার্লস স্কুলের মৃন্ময়ী বসু। সব সময়ই অফিসে আসতেন অধ্যাপক অনিল সরকার ও অনিরুদ্ধ রায়।১
সমিতি প্রথমেই স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের সহায়তা দানের ব্যবস্থা করে। মঞ্জুরি কমিশনের প্রধান ছিলেন ড. ডি এস কোঠারি। কমিটি সবকিছু জানিয়ে তাঁর কাছে আবেদন পাঠায়। ড. কোঠোরি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজশিক্ষকদের অনুরোধ জানালে তাঁরা এক দিনের বেতন সমিতিকে দান করেন। ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল তাতে। ১৪ লাখ টাকা পাওয়া গিয়েছিল শিক্ষকদের তরফ থেকে।
ব্যক্তি. প্রতিষ্ঠান অনেকে কবিসসকে সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছিলেন। বিদেশের অনেকেও। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ মুভমেন্ট, লন্ডনের ফ্রেন্ডস অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কাউন্সিল, শ্রীলঙ্কার আউট অব দ্যা পিপল ও লন্ডনের বাংলাদেশ গ্রিন ক্রস। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পুনে ও বোম্বের বাংলাদেশ এইড কমিটি ও অন্যরা সহায়ক সমিতির মাধ্যমেই কাজ করত।
কবিসস সমান্তরালভাবে অনেকগুলো কাজে হাত দিয়েছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার ও সমর্থন, শিক্ষকদের কর্মসংস্থান, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সাহায্য।২
সমিতির সভাপতি সত্যেন্দ্রনাথ সেন ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ইউনেসকোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে আবেদন জানান।
সমিতির পক্ষে তিনজন প্রতিনিধি ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যান বাংলাদেশের পক্ষে সহায়তা প্রদানের আবেদন নিয়ে। ফাদার পি ফ্যালো ভ্যাটিকান যান পোপের কাছে। পোপ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের শরণার্থীদের পক্ষে এগিয়ে আসেন। কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অরুণ কুমার দাস নিজের খরচে লন্ডনসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশের রাজধানী সফর করেন। ইলা মিত্র যান সোভিয়েত ইউনিয়ন। দিলীপ চক্রবর্তী ও মৃন্ময়ী বোস যান বোম্বে। সেখানে তাঁরা অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সফল হন। যেমন গায়ক ও সুরকার সলিল চৌধুরী, মান্না দে ও সবিতা চৌধুরী ‘বাংলা আমার বাংলা’ শীর্ষক একটি গানের রেকর্ড করেছিলেন। তাঁরা রেকর্ডের সম্পূর্ণ রয়্যালটি দান করেন। হৃষীকেশ মুখার্জি, হিতেন চৌধুরী, ইন্ডিয়ান মার্চেন্টস চেম্বারের সম্পাদক সিএল থিওয়ালা নিয়মিত অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। কমিটির নানা কাজে সহায়তা করেন মনোবীণা রায়, ড. অশোক মজুমদার, গিরীশ মুনশি, বংশীভাই মেহতা, সুশীলা মেহতা, আর সি জাবেরী। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বিশেষ করে এর উপাচার্য বিচারপতি গজেন্দ্রগদকর। তাঁকে প্রভূত পরিমাণে সহায়তা করেন দন্তওয়ালা, আলী দস্তুর, উষা মেহতা প্রমুখ। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ৭৫ হাজার টাকা দান করে। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো হয় শ্রীলঙ্কায়। ইউরোপে প্রচারের জন্য পাঠানো হয়েছিল বংশীভাই মেহতা ও সুশীলা মেহতাকে। শিবনাথ ব্যানার্জি গিয়েছিলেন কাবুল। বাদশা খানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। পূর্ণেন্দু নারায়ণ রায়ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে আমেরিকায় যান।
প্রচারের এই উদ্যোগ সফল হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পথে সমর্থন বেড়েছিল। শরণার্থী ও শিক্ষকদের জন্য অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে এসেছিলেন। সমিতি প্রায় ২০০ বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ব্যক্তিপর্যায়ে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির এগারোজন, অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক এ এল ব্যাশাম, অধ্যাপক অতীন্দ্র মজুমদার (মেলবোর্ন), অধ্যাপক এ মাজেদ খান (ভিক্টোরিয়া), ফ্রান্সের কলেতো দুতিন্না, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক প্রদীপ মিত্র, ব্যাংককের ড. নীহার সরকার, ফ্রান্সের এডগর লেওরা, লন্ডনের মোজাদ্দেদ আলী, বেলজিয়াম ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির নীপা ব্যানার্জি প্রমুখ।৩

সূত্র:
১. আনিসুজ্জামান, আমার একাত্তর, ঢাকা, ১৯৯৭
২. দুলাল ভৌমিক, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান’, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান, ঢাকা।
৩. ঐ
একাত্তরের বন্ধু যাঁরা- মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!