You dont have javascript enabled! Please enable it!

বোম্বাইয়ে বাংলাদেশ

বোম্বাই বা বর্তমান মুম্বাই বিখ্যাত ভারতের বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে। আর হচ্ছে বলিউড। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে শরণার্থী ও গণহত্যা নিয়ে তেমন হৈচৈ না হওয়াই স্বাভাবিক। তারপরও দেখি এপ্রিলের গোড়াতেই গঠিত হয় বাংলাদেশ এইড কমিটি। মুক্তিযুদ্ধের ১৩ নং সেক্টরে আমি লিখেছিলাম এই এইড কমিটি গঠিত হয়েছে ২৩ এপ্রিল, এখন মনে হয় সেটি ভুল। নির্দিষ্ট তারিখ না জানলেও অন্যান্য বিবরণ থেকে ধরে নিতে পারি এপ্রিলের গোড়ার দিকেই সহায়তা কমিটি হয়েছিল। হরিশ মহিন্দ্র হন সভাপতি। একজন বাঙালির বাসায়ই প্রথম সভা হয়। ২১ জন উপস্থিত ছিলেন যার মধ্যে নয়জন বাঙালি।
১২ এপ্রিল পর্যন্ত দেখা গেছে ৬ দিনে ১৯৮ টাকা চাঁদা উঠেছে। এর অর্থ ৬ এপ্রিল কয়েকজন মিলে এইড কমিটি গঠন করেছিলেন। চাঁদার আবেদন জানিয়েছিলেন। ১২ তারিখ আরেকটি সভা হয়। সেখানে সুকু হামিদ তহবিলের ব্যাপারে রিপোর্ট দেন, চাঁদা যাঁরা দিয়েছিলেন—
১. এন আর বোস— ৩.০০
২. ইউ রাও— ২0.00
৩. এস আর ভট্টাচার্য— ২৫.০০
৪. জয়ব্রত ভট্টাচার্য- ১০০.০০
৫. সলিল ঘোষ— ৫০.০০
হিমানীশ গোস্বামী জানিয়েছেন, এন আর বোস সামান্য কাজ করতেন। তিনটি টাকাই বাড়তি ছিল তাঁর কাছে। “ঠিকানা দেখে খুঁজে খুঁজে এসেছেন ফিরোজ শা মেহতা রোডে। দিয়ে গেছেন তিনটি টাকা। দ্বিতীয়জন আরও অদ্ভুত। দেখলেই মনে হয় তাঁর দেবার কোনো সামর্থ্য নেই। কেউ তাকে দিলেই বেশি মানায়। কুড়ি টাকা কোত্থেকে যোগাড় করেছেন কে জানে।”
হিমানীশ আরো লিখেছেন—
‘আরও আছে। প্রথম মানিঅর্ডার আসে দশ টাকা। পোরবন্দর থেকে পাঠান গিরীশ বি চোকসি। ছোট্ট এক লাইন লেখা, ‘আমার এই ক্ষুদ্র দান গ্রহণ করুন।’ বোম্বাই থেকে কে এন মূর্তি লিখেছেন, ‘আমি শিগগীরই ৫১.০০ টাকা পাঠাচ্ছি—সমুদ্রের তুলনায় এতো একফোঁটা। আমার হৃদয় দুঃখে এবং বেদনায় ভরে গিয়েছে। ভাব প্রকাশের ভাষা নেই।’
শর্মা নামের একজন লিখেছেন, ‘আমি ফার্টিলাইজার করপোরেশনে কাজ করি। আমি কাপড় জামা খাদ্য ওষুধ টাকা এসব সংগ্রহ করতে চাই। আমার বয়স ২৯।’
সামুয়েল নামের একজন লিখছেন, তিনি সবরকম কাজ করতে প্রস্তুত আছেন ‘বাংলাদেশে-এর জন্য।’
একজন গুজরাটি ভদ্রলোক লিখেছেন তাঁর দুটো রাইফেল আছে—“একটি তিনি দান করতে চান। তাছাড়া প্রতি মাসে ৫১.০০ টাকা পাঠাতে চান। একজন অচেনা পারসী ৫০১.০০ টাকা পাঠিয়েছেন।”
ভারতবর্ষের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষও কীভাবে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের জন্য তার উদাহরণ হিসেবে গোস্বামীর লেখা উদ্ধৃত করলাম। এ ক্রাই পর হেল্প—এ শিরোনামে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছিল সেখানে টাকা পাঠানোর জন্য। পাঠিয়েছেনও অনেকে।
এই কমিটিতে তারপর অনেকে এসেছেন। চেয়ারম্যান হরিশ মহিন্দ্র। ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াহিদা রহমান ও শর্মিলা ঠাকুর। সম্পাদক বেগম নসরুল্লাহ। সলিল ঘোষ ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। তরুণ শিল্পপতি সুকু হামিদও ছিলেন সক্রিয়। সলিল ঘোষ লিখেছেন— “স্থানীয় মুসলমান সমাজ-এর বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন থাকলেও নানা কারণে এরা কিছুটা নীরব ছিল। কিন্তু বিখ্যাত উর্দু কবি আলি সর্দার জাফরী, কাইফি আজমী প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের নানাস্থানে আবেগপূর্ণ আবেদন বক্তৃতা বহু মুসলমানকে বাংলাদেশ এর পক্ষে এগিয়ে আসতে উদ্দীপিত করে। উর্দু ভাষীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় কাওয়ালি সঙ্গীতশিল্পী শ্রী ইউসুফ আজাদ ও শ্রীমতি রশিদা খাতুন বাংলাদেশ এর সাহায্য বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান করতে এগিয়ে আসেন। এরপর থেকেই সর্বত্র।’ এমন কি মুসলমান সমাজের মধ্যেও বাংলাদেশের সপক্ষে জনমত দানা বাঁধতে শুরু করে। নানাভাবে জনসাধারণ, বিশেষ করে তরুণ সমাজও এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কাছে।”
মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের অনেকে এইড কমিটিতে যোগাযোগ করে যোগ দিতে চেয়েছেন যুদ্ধে। হিমানীশ জানিয়েছেন, রাজেশখান্না ৫০০১ টাকা পাঠিয়েছিলেন। এক মুশয়েরায় মীনাকুমারী কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রদানের সময় সে সভাতে চাঁদা উঠেছে ৬০০ টাকার ওপর।
১৫ এপ্রিল ১ বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠান হয় চৌপাট্টির ভারতীয় বিদ্যাভাবনে। ১৫০০ এর মতো দর্শক এসেছিলেন। অনুষ্ঠান সূচিতে ছিল— ‘জয়বাংলা: কবিতা আবৃত্তি’। আবৃত্তি করেছিলেন—
উর্দু: আলি সর্দার জাফরি, কাইফি আজমী
হিন্দি: ধর্মবীর ভারতী
ইংরেজ: হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত ব্যানার্জি
বাংলা: সলিল চৌধুরী
মারাঠি: বসন্ত বাপাত
গুজরাটি: সুরেশ দালাল।
সুব্রত ব্যানার্জি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। সলিল চৌধুরী সঙ্গীত পরিচালক। “হরীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ইংরেজী কবিতা—এরকম তেজালো জোরালো কবিতা তিনি এই বয়সেও রচনা করেছেন এবং অসাধারণ আবৃত্তি করেছেন। হাততালির প্রচণ্ডতায় মনে হলো যে সব ভালো আমি বুঝি না, সেই সব অনেক ভারতীয় ভাষার কবিরাও শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করেছেন।”
৭ থেকে ১৪ মে পতাকা দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ৫ লক্ষ পতাকা মুদ্রণ করে বিক্রি করা হয়েছিল।

সূত্র: ১. হিমানীশ গোস্বামী, ‘বোম্বাই দ্বীপে ‘বাংলাদেশ’, দেশ, ১৩৭৮
২. আনন্দবাজার, ৬.৫.১৯৭১
একাত্তরের বন্ধু যাঁরা- মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!