শিল্পীরাও পিছিয়ে ছিলেন না
শিল্পীরাও পিছিয়ে ছিলেন না বাঙালিদের সহায়তা করার জন্য। সারা ভারতের শিল্পীরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মকবুল ফিদা হোসেনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দিল্লি-কলকাতার বিশেষ করে কলকাতার শিল্পীরা বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। দিল্লির কথা ধরা যাক—
দিল্লি থেকে বিমল দাশগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী, জগদীশ দে, নীরেন সেনগুপ্ত ও শরদিন্দু সেন রায় কলকাতা এলেন বিড়লা একাডেমিতে চিত্র প্রদর্শনী করবেন বলে। উদ্দেশ্য, দুর্গতদের সাহায্য করা।
দিল্লির পাঁচ শিল্পীর জন্মই বাংলায় কিন্তু দীর্ঘদিন ছিলেন দিল্লিপ্রবাসী। কলকাতায় বাংলাদেশ উপলক্ষেই তাঁরা একত্র হয়েছিলেন। নতুন দিল্লির জি কে শাস্ত্রী লিখেছিলেন, This is the first professional home coming of the group of five. Long resident in the Capital, individually the five have established their renown in the art world where connote a high degree of achievment.”১
পাঁচজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন শরদিন্দু সেন রায় (জ. ১৯১৫)। তখন তিনি দিল্লির কলেজ অব আর্টে শিক্ষকতা করতেন। সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন বিমল দাশগুপ্ত (জ. ১৯১৭) তিনিও একই কলেজে অধ্যাপনা করতেন। কনিষ্ঠ ছিলেন জগদীশ দে (জ. ১৯৪২)। এঁদের একজনই পূর্ববঙ্গে জন্মেছিলেন তিনি হলেন ধীরাজ চৌধুরী (জ. ১৯৩৬)। খ্যাতিমান ছিলেন নীরেন সেনগুপ্ত। সবাই অধ্যাপনা করতেন দিল্লির কলেজ অব আর্টে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এস এস ধাওয়ান ২৫ মে বিড়লা একাডেমিতে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল ৪২টি শিল্পকর্ম। অধিকাংশ তেলরং ও কালিকলমের ড্রয়িং। জলরং ও গ্রাফিকসও ছিল কিছু। অধিকাংশ কাজ ছিল বিমূর্ত।
বিমল দাশগুপ্ত শিল্পকর্ম নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছিল, “বিভিন্ন উপযোগী উজ্জ্বল রং নির্বাচন, স্নিগ্ধ ও পরিচ্ছন্ন ব্যবহার কৌশল ও পরিমিত বরুশের টানের মধ্য দিয়ে তিনি ইমেজারি সৃষ্টি করেছেন।” ধীরাজ চৌধুরী সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, “নানা ক্ষেত্রে ক্যানভাস ভাগ করে সেগুলো তিনি উজ্জ্বল নীল, লাল, হলুদ ও সবুজ রঙ্গে ভরে ফেলেছেন।” জগদীশ দে সম্পর্কে বলা হলো, “বৃত্ত ও আয়তক্ষেত্র অবলম্বনে নানা রং ব্যবহার করেছেন, বিশেষ করে নীল, লাল ও হলুদ।” নীরেন সেনগুপ্ত বিষয়ে মন্তব্য, “প্রধানত রঙের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছেন। সোচ্চার লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা-নানা রং কৌশলে ব্যবহার করে তিনি যেন রঙের স্বপ্নলোক রচনা করতে চেয়েছেন।” শরদিন্দু সেনের ছবিগুলো ‘মিনিয়েচার জাতীয়’।
বাংলাদেশ নিয়েও বিমল দাশগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী ও নীরেন সেনগুপ্তের কিছু ড্রয়িং ছিল। “প্রত্যেকেই নানা চিহ্ন ও প্রতীকের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান বিভীষিকা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। সকলের ড্রয়িংই বিমূর্ত। তবে কম্পোজিশন ও প্রকাশ ভঙ্গিমার দিক থেকে বিমল দাশগুপ্তের ড্রয়িং খুবই বলিষ্ঠ— বিশেষ করে সংক্ষেপে তিনি বিষয়বস্তুর পরিচয় দিয়েছেন। হত্যালীলা, কবর, কারাগার, বিকলাঙ্গ মূর্তি প্রভৃতি নানা প্রতীক ব্যবহার করে ধীরাজ চৌধুরী তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেছেন।…. নীরেন সেনগুপ্ত প্রতীক ব্যবহার করেছেন, তবে সেই সঙ্গে বাংলাদেশের নির্যাতিত নরনারী যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বদ্ধপরিকর, তা-ও তিনি দৃঢ়মুষ্টি ও সবল কর্মক্ষম হাতের মধ্যে দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করেছেন।” ছবি বিক্রি করে দিল্লির ত্রাণ তহবিলে ৮৬২.৫০ দান করেছিলেন তাঁরা।২ ধীরাজ চৌধুরী দিল্লিতেও আগস্ট মাসে শুধু বাংলাদেশ সম্পর্কিত চিত্রকলা দিয়ে প্রদর্শনী করেছিলেন ‘বাংলাদেশ ৭১’ শিরোনামে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ক্যাটালগে লিখেছিলেন:
“How can the sensitive heart and mind of the artist not we touched by the travail of Bangladesh? I hope the exhibition in aid of Bangladesh will urge peole to help this great cause and to think deeply of the basic values involved?”৩
নয়াদিল্লিতে মভলস্কর হলে বঙ্গস্মৃতি মেলায় নয়াদিল্লির তরুণ শিল্পী ধীরাজ চৌধুরীর পরিকল্পনা অনুযায়ী শিল্পী কাশীনাথ ও জ্যোতিষ দত্তগুপ্ত একটি বিরাট প্রাচীর চিত্র (৪x২৮) আঁকেন বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে।
সূত্র:
১. G.K. Shastri, Exhibition of Paintings Drawings and Graphics in aid of Bangladesh, Calcutta, May, 1971.
২. চিত্রপ্রিয়, নয়া দিল্লির পাঁচজন শিল্পী’, দেশ, কলকাতা, ১৯৭১
৩. Dhiraj Chowdhury, Bangladesh, 1971 (ক্যাটালগ)
৪. দেশ, ৭ জ্যৈষ্ঠ, ১০৭৮
একাত্তরের বন্ধু যাঁরা- মুনতাসীর মামুন