ম্যারিয়েটা
ম্যারিয়েটাকে আমাদের মনে আছে, বর্তমান জেনারেশনের কাছে নামটি সম্পূর্ণ অচেনা। লন্ডনে ১৯৭১ সালে ম্যারিয়েটা প্রকোপেই বিদেশিদের মধ্যে “রিকগনাইজ বাংলাদেশ ‘জয় বাংলা’ ‘স্টপ জেনোসাইড’ শ্লোগান দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক লিখেছেন, এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পিস নিউজ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক রজার মুন্ডি একটি বৈঠক ডেকেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে তাতে বিদেশিদের অনেকে বিচলিত। লন্ডনের ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের শামসুদ্দীন চৌধুরী, খন্দকার মোশারফ হোসেন ও মাহমুদ আবদুর রউফ সেই সভায় গেলেন। সেখানে তাঁরা পরিচিত হলেন পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্নস, পল কনেট এবং ম্যারিয়েটা প্রকোপের সঙ্গে। পল জানালেন, তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষে এবং বিয়েফ্লার পক্ষে জনমত সংগঠনে সহায়তা করেছেন। ম্যারিয়েটা জানালেন, ফজলে হোসেন আবেদের কাছ থেকে তিনি সব শুনেছেন। এই গণহত্যার বিরুদ্ধে কিছু একটা করা দরকার। প্রতিবাদ হওয়া উচিত।
এভাবে জন্ম হলো ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর। পল কনেট হলেন এর প্রধান। তাঁর স্ত্রী অ্যালেন কনেটও যোগ দিলেন। ম্যারিয়েটা তখন পিএইচডি করছিলেন অক্সফোর্ডে। তিনি হলেন এর সম্পাদক। তখনকার ছাত্রনেতা শামসুদ্দীন চৌধুরী তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলেন, পিএইচডি ছেড়ে কেন তিনি এসব কর্মকাণ্ড যোগ দিতে চাচ্ছেন? ম্যারিয়েটা বলেছিলেন-“যেখানে একটি পশুশক্তি এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিঃসহায় মানুষগুলোর ওপর, সেখানে কী করে অন্য দেশের মানুষ বসে থাকতে পারে? মানুষকে তার দেশ গোত্রের ভিত্তিতে আলাদা করে দেখাটা মস্ত বড় অন্যায় নয় কি?”
ম্যারিয়েটার বাবা ছিলেন রাষ্ট্রদূত। উত্তর ক্যামডেনে ছিল একটি বহুতল ভবন। সেই ভবনের একটি তলা ম্যারিয়েটা প্রদান করেন অ্যাকশন বাংলাদেশ-এর কাজ চালাবার জন্য। নিজের গাড়িটিও দিয়ে দিলেন। অ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য যে অর্থের দরকার তার ভারও তিনি নিলেন।
অ্যাকশন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বহু বাঙালি এবং বিদেশি এতে যোগ দেন। অ্যাকশন বাংলাদেশের প্রধান সাফল্য পাকিস্তানে বিশ্ব ব্যাংকের সাহায্য বন্ধ করা। প্যারিসে এই এইড কনসোর্টিয়ামের বৈঠক ছিল। অ্যাকশন বাংলাদেশের ৭৫ জন সদস্য নিয়ে পল. ম্যারিয়েটা হাজির হন প্যারিস। সেখানে বিশ্বব্যাংক দফতরের সামনে তাঁরা জমায়েত হয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকলে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ পলও, ম্যারিয়েটা ও বাঙালি আবদুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জুকে ভেতরে আলোচনার আহ্বান জানান। এই প্রতিবাদের পর পাকিস্তান আর বিশ্বব্যাংকের সাহায্য পায়নি। এছাড়া অ্যাকশন এইড প্রতিনিয়ত পুস্তিকা প্রকাশ, মিটিং মিছিলের আয়োজন করেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ম্যারিয়েটা বাংলাদেশে আসেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ দেখেন, ফিরে গিয়ে মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন। পল কনেট এ সম্পর্কে বলেছেন, “ম্যারিয়েটার কোমল হৃদয় বাংলাদেশের গণহত্যার কাহিনি সহ্য করতে পারেনি। মানুষ এত নির্মম হতে পারে ম্যারিয়েটা তা চিন্তাও করতে পারেনি”।
বর্তমান স্টেডিয়ামের নিচে প্রয়াত জনাব খালিদ ১৯৭২ সালে একটি ছোট বইয়ের দোকান খুলেছিলেন। সেই দোকানের নাম রেখেছিলেন ম্যারিয়েটা।
সূত্র: শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ‘মেরিয়েটাকে যেন ভুলে না যাই”,
দৈনিক জনকণ্ঠ ৩০.৩.২০১৯
একাত্তরের বন্ধু যাঁরা- মুনতাসীর মামুন