শচীনকর্তার তাকদুম তাক্দুম
বাঙালিরা খুন হচ্ছে, পালিয়ে আসছে লাখ লাখ মানুষ। তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য ভারতবর্ষের মানুষজন এগিয়ে আসছে। বোম্বাই বা মুম্বাইর বাঙালিরা কি পিছিয়ে থাকতে পারেন? মুম্বাইর বিভিন্ন সমিতি, ক্লাব একত্রিত হয়ে গঠিত করল ‘বৃহৎ বোম্বাই বাঙালি সমাজ’। ৩ মে তাঁরা আয়োজন করল এক সঙ্গীতানুষ্ঠানের। আহ্বায়ক নির্বাচিত হলেন হিতেন চৌধুরী। তাঁর অনুরোধে অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন শচীন দেববর্মন বা শচীনকর্তা, হেমন্ত কুমার, মান্না দে, শর্মিলা ঠাকুর, সলিল চৌধুরী, হেমা মালিনী, দিলীপ কুমার, রাজেশ খান্না, সায়রা বানু, বিশ্বজিৎ প্রমুখ। কলকাতা থেকে এলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৩০০০ দর্শক।
অনেকেই গেয়েছেন, মঞ্চে উঠেছেন কিন্তু মাতিয়ে দিলেন পূর্ববঙ্গের শচীনকর্তা। তিনি বললেন, “আমার মনেই হচ্ছে না যে আমি এখানে ৩০০০ শ্রোতার সম্মুখে বিস্তৃত বিরাট প্রেক্ষাগৃহে বসে আছি। মন চলে গেছে ৫০ বছর আগে যখন ১২ বছরের এক বালক ‘শচীন’ কুমিল্লার ময়নামতীর ধারে ঘুরে বেড়াত, সরস্বতী পূজার জন্য ফুল চুরি করত। সে সব স্থানে এই মুহূর্তে ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈন্যরা সেই সোনার বাংলার শান্তিপূর্ণ, শান্ত, সবুজ পরিবেশকে ধ্বংস করছে, নিরস্ত্র, নিরপরাধ অসহায় স্ত্রী পুরুষ শিশু বৃদ্ধদের হত্যা করছে, অতি আধুনিক সব মারণাস্ত্র দিয়ে।”
প্রথমে শচীন দেব গাইলেন তাঁর জনপ্রিয় গান-নিশীথে যাইও ফুলবনে’। বললেন, গানটি লিখেছেন তাঁর বন্ধু কবি জসীমউদ্দীন। সুর দিয়েছিলেন তাঁর আরেক বন্ধু, কুমিল্লার মনসুর আলী।
গানটি হিন্দিতে অনুবাদ করেন জাকির হোসেন। শচীনকর্তা তারপর বললেন, “বাংলাদেশের ঢোল তাঁর এক অতি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র। ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্রে নানারকম বৈচিত্র্যে ভারতবর্ষের তুলনা নেই। শত শত ধরনের যন্ত্র আছে এ দেশে, যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না।” তিনি আরো বলেন, তাঁর পুরনো একটি গানের নতুন সংস্করণ তৈরি করেছেন তাঁর স্ত্রী মীরা দেবী। সে গানটি তিনি গাইবেন। আর সঙ্গে ঢোল বাজাবেন অবনী দাশগুপ্ত। তারপর গলা তুলে গাইলেন শচীন দেববর্মণ-
(আমি) তাক্দুম তাকদুম বাজাই
অখন্ড এই ঢোল
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না,
বাংলা মায়ের কোল
(আমি) তাকদুম তাকদুম বাজাই
বাংলাদেশের ঢোল।
যে জমিন জনম দিল আমারে
মায়ের পরাণ আমার পরাণ
সেই জমিনেই বাঁধা রে
সেই সোহাগের ডোর ছিঁড়িবার সাধ্য
কারো নাই
সব ভুলে যাই, তাও ভুলি না
বাংলা মায়ের কোল।
আমাদের মশাল কভু নেভে না
মুজিবুরের ভাই আমরা বাঁচতে জানি মরি না
মেঘনা, তিতাস আর আমাদের
পদ্মার গান গাই
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না,
বাংলা মায়ের কোল।
গাইতে গাইতে শচীনকর্তা তাঁর প্রিয় শিল্পী মান্না দে-কে ডাকেন যোগ দিতে, বলরাজ সাহানীকে ডাকেন গানের মানে বুঝিয়ে দিতে। মাতিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে সেদিন শচীনকর্তা। তাঁর কণ্ঠের সঙ্গে মিলিয়ে অবনী দাশগুপ্তের বাংলা ঢোলের তাকদুমা দুম্, ঢ্যান্ কুড়কুড় বম্বের প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ পালটে দিয়েছিল।
এর পরেই উল্লেখ করতে হয় নির্মলেন্দু চৌধুরীর চারটি গান। এই শিল্পী বাংলাদেশের পূর্বউল্লিখিত উন্নত সেই সংস্কৃতির আরেক প্রতিনিধি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী ডা. রফিক জাকারিয়া বলেন— “আমাদের অসহায়ভাবে নিশ্চেষ্ট হয়ে পাকিস্তানি বর্বরতার দিকে তাকিয়ে বসে থাকা অতি লজ্জার কথা। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।”
সূত্র: সলিল ঘোষ, ‘বোম্বাইয়ে সংগীতানুষ্ঠানে শচীন দেব বর্মণ’, দেশ, পৌষ, ১৩৭৮
একাত্তরের বন্ধু যাঁরা- মুনতাসীর মামুন