You dont have javascript enabled! Please enable it!

বনফুলের একাত্তর

বনফুলের ছোট গল্প স্কুলে আমাদের পাঠ্য ছিল। আরো পরে তাঁর এ ধরনের আরো অনেক গল্পের মুখোমুখি হই। ছোট গল্পের যে সংজ্ঞা আমাদের পড়ানো হতো বনফুলের গল্প ছিল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যৌবনে পড়ি তাঁর অন্যরকমের উপন্যাস জঙ্গম। পড়ে একেবারে মুগ্ধ। বনফুল যে কবিতা লিখতেন তা জানতাম না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কবি সাহিত্যিকরা কী লিখেছেন তার খোঁজ করতে করতে সন্ধান পাই বনফুলের কবিতার। পরে তাঁর আত্মজীবনী পড়ে জানতে পারি, যৌবনেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। কবিতার বইও প্রকাশ করেন। দু’খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর রোজনামচা মর্জি মহল-এ প্রতি পাতায় পাতায় আছে কবিতা।
বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় [১৮৯৯-১৯৭৯] এর জন্ম বিহারের পূর্ণিয়ায়। ১৯১৮ সালে শনিবারের চিঠি-তে প্রথম কবিতা লেখেন। ছদ্মনাম দেন বনফুল। তারপর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত লিখেছেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। ১৯৭১ সালে কলকাতায় বসবাস করতেন। সেই সময় কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের জন্য রাস্তায় মিছিল করেছেন, অর্থ সংগ্রহ করেছেন, লিখেছেন। বনফুল দু’একটি কবিতা লিখেছেন বটে কিন্তু সক্রিয়ভাবে কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করেননি।
২০১১ সালে দু’খণ্ডে প্রকাশিত হয় তাঁর রোজনামচা মর্জিমহল। ১৯৭১-৭৩ পর্যন্ত এর ব্যপ্তি। ১৯৭১ সালের রোজনামচায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু ভুক্তি আছে। সেগুলো সংকলন করেছি ১৯৭১ সাল সম্পর্কে একজন বনেদী বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাবার জন্য।
প্রথম ভুক্তিটি ২৬ মার্চের। সন্ধ্যায় এম.সি. সরকারের দোকানে গেছেন আড্ডা দিতে। সেখানে ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ স্যান্নাল প্রমুখ।
“একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে তুষারকান্তি (ঘোষ) প্রবেশ করলেন। তাঁর হাতে দুখানা কাগজ—অমৃতবাজার পত্রিকা আর যুগান্তর। যে সংবাদ আনলেন তা রোমহর্ষক। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ইয়াহিয়া খাঁ আর ভুট্টো চম্পট দিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও সৈন্য এসে পৌঁছেছে। মিলিটারি ধর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের লোকেরা খুব লড়ছে। মুজিবর রহমান কোথায় কেউ জানে না। মিলিটারি পুলিশ তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কাগজে আমার অনেক সাহিত্যিক বন্ধুদের ‘তীব্র প্রতিবাদ’ পড়লুম বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক হামলার বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ যতই তীব্র হোক না কাগুজে প্রতিবাদ। ওর একটি মাত্র সার্থকতা, নিজেদের নাম জাহির করা। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কোনও উপকারই হবে না কথার ফুলঝুরি কেটে বা রঙিন বচনের আতশবাজি উড়িয়ে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের পাশে যদি দাঁড়াতে পারি, তা হলেই সেটা কাজের মতো কাজ হবে। কিন্তু তা আমরা পারব না। আমরা বাক্য-বীর মাত্র, তার বেশি আর কিছু নই।
এসব জেনেও যে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করতে ছুটে যাই, তার একমাত্র কারণ, আমাদের অন্তঃসারশূন্য অহঙ্কার। আমরা নানাভাবে নিজেদের জাহির করতে চাই, আর বেগতিক দেখলে পালাই।”
বনফুল লিখেছেন ২৬ তারিখে পত্রিকায় তিনি বিবৃতি দেখেছেন। কিন্তু, এটি সম্ভব নয়। গণহত্যা শুরু হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতে। সে খবর ছাপা হয়েছে ২৬ তারিখে। এর আগে লেখক/বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না গণহত্যা সম্পর্কে খবর পাওয়ার। তবে, মার্চ মাস থেকে পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের খবরা-খবর ছাপা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে তা সমর্থনও করেছেন। ২৮ মার্চ প্রথম বিবৃতি দেন তাঁরাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, আবু সাঈদী আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুশোভন সরকার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, শম্ভু মিত্র, প্রবোধচন্দ্র সেন, তাঁরাপদ মুখোপাধ্যায়, অম্লান দত্ত, গৌরকিশোর ঘোষ। তাঁরা এক বিবৃতিতে জানান, পূর্ববাংলার জনগণ সাহস, অফুরন্ত প্রাণশক্তি এবং সীমিত অস্ত্ৰবল নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েক ডিভিশন সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করছে। তাঁরা আশা প্রকাশ করেন, পূর্ববাংলার মানুষের জয় হবেই।”১
বনফুল এঁদের ব্যাপারে তেমন আশাবাদী ছিলেন না। কিন্তু, দেখা গেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁরাও বড় একটি ভূমিকা রেখেছিলেন। বনফুল জীবনের সিংহভাগ কাটিয়েছেন বিহারে। ছিলেন অরাজনৈতিক ফলে, তিনি হয়ত এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন।
২৬ মার্চের এক সপ্তাহ পর বনফুল ৩ এপ্রিলের ভুক্তিতে বাংলাদেশের কথা এনেছেন।— “পূর্ব বাংলায় যা হচ্ছে, তা অতি শোচনীয় ব্যাপার সন্দেহ নেই 1 মুজিবর রহমান এবং তাঁর অনুগামীরা বীর পুরুষ। মুজিবরকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি একটি কবিতায়। কবিতার নাম, ‘সহস্র সেলাম’। বেরিয়েছে ‘অমৃত’ পত্রিকায় ২৬ মার্চ তারিখে।
একটি কথা কিন্তু ভুলতে পারছি না। পূর্ববাংলার মুসলমানরা এই কিছুদিন আগেই ‘ইসলাম’ এর দোহাই দিয়ে হাজার হাজার হিন্দু বাঙালিকে খুন করেছিল, গৃহহারা করেছিল, তাদের নারীদের ধর্ষণ করেছিল, শিশু হত্যাও করেছিল। নোয়াখালি, ক্যালকাটা কিলিং এসবও দেখেছি আমরা।
গ্রিকপুরাণে প্রতিহিংসার অধিষ্ঠাত্রী দেবী তারই পুনরাবির্ভাব ঘটল নাকি ! হিন্দুদের Nemesis। হিন্দুদের ওপর মুসলমানরা অত্যাচার করেছিল, তখন সেটাও একটা Nemesis কারণ, তার আগে হিন্দুরাও মুসলমানদের ওপর কম অত্যাচার করেনি। এই অত্যাচার আর পাল্টা অত্যাচারই আমাদের ইতিহাস। Nemesis এর লীলাই কি ইতিহাস তা’হলে? আমরা যে ভগবানকে ডাকি তাঁর স্থান কি কোথাও নেই। না, ভুল বললাম। স্থান আছে, ধর্মগ্রন্থে।”
এখানে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। নোয়াখালী, ১৯৪৬-৪৭, ১৯৫০-এর দাঙ্গা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গে একটি বয়ান তৈরি হয়েছে যে একতরফাভাবে হিন্দুরা নিহত হয়েছে, মার খেয়েছে, দেশান্তরী হয়েছে। নোয়াখালি ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে কিন্তু এটি প্রযোজ্য নয়। ১৯৪৬-১৯৫০ উভয় বঙ্গ থেকে মানুষজন বসতি বদলেছে, দাঙ্গায় উভয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বনফুলের প্রায় প্রতিটি ভুক্তিতে একটি কবিতা আছে। কিন্তু অমৃত-তে যে কবিতা দিয়েছিলেন, ‘সহস্র সেলাম’ নামে সেটি নেই। এখানে সেটি উদ্ধৃত করছি—
“পলে পলে মোরা যবে পঙ্ককুণ্ডে ডুবিতেছিলাম,
নিরুদ্ধ আক্রোশে যবে আমাদের পুঞ্জিত পাতল
আমাদেরই হত্যা করি নিঃসঙ্কোচে ঘোরে অবিরাম
আমাদেরই আত্মবন্ধু পুত্ৰ-ভ্রাতা কশাই ঘাতক
গুণ্ডা ও ডাকাত যবে, মহত্ত্বের মানিক্য ভান্ডার
চুর্ণিত লুণ্ঠিত করি মহোল্লাসে মেতেছে তাণ্ডবে
প্রমত্তে প্রথম দল, সুখ স্মৃতি পুণ্য বাংলার
অসম্মানে মুহ্যমান, স্বার্থ-বহ্নি আদর্শ-খাণ্ডবে
দগ্ধ করি লেলিহান দিগ্বিদিকে, বিগলিত যবে
সর্ব সুখ সাধ আশা পশুত্বের অহং-আহবে
তখনও ওপার হতে দৃপ্তকণ্ঠে শুনিলাম কার
জয় বাংলার!
আমার তোমার নয়, চাও তুমি বাংলার জয়
তারই লাগি মৃত্যুমুখে আগাইয়া গিয়াছ নিৰ্ভয়,
তোমার বিরাট সত্তা আজি তাই হিমাদ্রি সমান
বাঙালির সর্বগর্ব তোমাতেই আজি দ্যুতিমান।
আমি বাংলার কবি তাই বন্ধু ছুটিয়া এলাম।
মুজিবর রহমান লহ মোর সহস্র সেলাম।”

শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালির সর্ব গর্ব’ বলে উল্লেখ করেছেন, যে স্তুতিতে কোনো ভনিতা নেই এবং সে কারণেই তাঁকে জানিয়েছেন ‘সহস্র সেলাম’।
পরের দিন, অর্থাৎ ৫ এপ্রিলের ভুক্তিতে খানিকটা উল্লেখ আছে, লিখেছেন বই পড়ছিলেন, পড়তে ভালো লাগছিল না দেখে রেডিয়ো খুললেন। “দেখলাম কে একজন বুদ্ধিজীবী পূর্ববাংলার দুর্দশা নিয়ে গলাবাজি করছেন। বন্ধ করে দিলাম। এ এক উৎপাত হয়েছে নতুন রকম। রাস্তায় দলবেঁধে কতকগুলো ছোঁড়া জোর করে চাঁদাও আদায় করছে শুনলাম।”
বুদ্ধিজীবীদের ‘গলাবাজি’ ও যুবকদের চাঁদা তোলায় বনফুল বিরক্তি প্রকাশ করছেন ঠিকই কিন্তু পূর্ববঙ্গে গণহত্যায় বিচলিতও হচ্ছেন। ২০ এপ্রিল লিখছেন—
“পাইকারি হত্যাকাণ্ড চলছে পূর্ববঙ্গে। পৃথিবীর সবাই নির্বাক হয়ে দেখছে। প্রতিবাদে টু শব্দটি করছে না কেউ। যেটুকু করছে সেটুকু না করলেও চলত। হায় রে, মানব সভ্যতা! শুক্র গ্রহের অভ্যন্তরীণ তাপ কত তাই নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। মানুষের প্রতি মানুষের পাশবিক অত্যাচারে তাদের টনক নড়ছে না। ভ্রুক্ষেপই করছে না কেউ।” ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছেন ছোট একটি কবিতা-
“ওরে মুখোশ,
পশুটাকে আর কেনরে বৃথাই লুকোস!
যাচ্ছে দেখা দন্ত, লালায়িত জিউভা—
সাক্ষী দিচ্ছে ভিয়েতনাম ও কিউবা।
ওরে মুখোশ addict
তোঁরা যে সব saddist.”

ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি।’ সংক্ষেপে বুদ্ধিজীবী সমিতি। বনফুলের সঙ্গে তাঁর সমবয়সী যাঁদের দেখা সাক্ষাৎ হতো তাদের অনেকেই যুক্ত ছিলেন সমিতির সঙ্গে। বনফুল যোগ দেননি। যেদিন তিনি এই ভুক্তি লিখছেন-
সেদিন বুদ্ধিজীবী সমিতি এক মিছিলের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। নবীন-প্রবীণেরা যোগ দেন মিছিলে। সেদিন ছিল প্রবল বৃষ্টি, সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মিছিলটি শুরু হয় চৌরঙ্গীর টাটা বিল্ডিং থেকে। শেষ হয় বাংলাদেশ মিশনের সামনে। পথে তাঁরা স্মারকলিপি দিতে যান ব্রিটিশ, তারপর মার্কিন ও সোভিয়েত দূতাবাসে। ব্রিটিশ ও মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিকরা স্মারকলিপি গ্রহণ করেছিলেন কিনা জানা যায়নি, তবে সোভিয়েত কনসাল জেনারেল ওই স্মারকলিপি সহৃদয়চিত্তে গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী ও তাঁর স্ত্রী মিশনের বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। হোসেন আলী বলেন, ‘আমরা আপনাদের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। আপনারাই আমাদের ভরসা জুগিয়েছেন।’ এরপর সমবেত শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা একযোগে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে শুরু করলে জনাব ও বেগম আলী অভিভূত হয়ে পড়েন।
মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সরযু দেবী, মনীন্দ্র রায়, মনোজ বসু, ড. ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সাধনা রায় চৌধুরী, দক্ষিণারঞ্জন বসু, শঙ্খ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সন্তোষকুমার ঘোষ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সিদ্ধেস্বর সেন, তরুণ সান্যাল, চিত্ত রায়, প্রসূন বসু, ধনঞ্জয় দাশ, গণেশ বসু, রমেন আচার্য প্রমুখ।৩
মিছিল মিটিং সমর্থন করেননি বটে কিন্তু পরের দিনের ভুক্তিতে আবার পূর্ববঙ্গ সম্পর্কেই লিখেছেন কিন্তু ২০ তারিখের মিছিল নিয়ে কিছু লেখেননি, মন্তব্যও করেননি। ২১ এপ্রিল লিখেছেন—“সমস্ত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। পূর্ববঙ্গে নাকি খুব বৃষ্টি হচ্ছে। হানাদার পাকি সৈন্যরা খুব বিব্রত নাকি। ভগবান দয়া কর। বলছি তো, কিন্তু তুমি সত্যি দয়া কর কি? সে ক্ষমতা কি আছে তোমার? কিংবা তোমার আইনই হয়ত অন্যরকম। আমাদের দয়ার দাবি হয়তো তোমার বিচারে অন্যায়। হয়তো— না, ‘হয়তো’র তালিকা বাড়িয়ে লাভ নাই। আবোল-তাবোল যা তা লিখলাম খানিকটা। মাপ করবার ক্ষমতা যদি থাকে মাপ করো। কিন্তু তাও পারবে কি? সর্বশক্তিমান হয়েও তুমি অক্ষম।”
পূর্ববঙ্গের গণহত্যা তাঁকে সত্যিই বিচলিত করেছিল। না হলে পরম ধার্মিক বনফুল ভগবানের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন না যা এক ধরনের ব্ল্যাশফেমি।
৬ মে লিখেছেন— “বাংলাদেশ থেকে একটি মুসলমান যুবক এসেছিল। বলল, রংপুর থেকে এসেছে। বাংলাদেশের কিছু খবর তার মুখে শুনলাম, বাংলাদেশ সম্বন্ধে আমি যে তিনটা কবিতা লিখেছিলাম তা টুকে নিয়ে গেল। বলল, একটা বই ছাপাবে।” বনফুল কোন তিনটা কবিতার কথা বলেছিলেন জানি না। একটি ‘সহস্র সেলাম’ যার কথা আগে উল্লেখ করেছি। আরেকটি কবিতা খুঁজে পেয়েছি যা ছাপা হয়েছিল ২০ এপ্রিল—
“কোথায় আবার
রক্ত হয় রক্ত-জবা
রক্ত হয় রক্ত কমল
কোথায় শেষে
কোথায় আবার?
বাংলাদেশে, বাংলাদেশে।
কুসুম-সম কোমল প্রাণ
বজ্র হয় গর্জমান।
কোথায় শেষে।
কোথায় আবার
বাংলাদেশে, বাংলাদেশে।
চির শ্যামল মাঠের তলায়
অগ্নিগিরির খবর মেলে।
কোথায় শেষে।
কোথায় আবার?
বাংলাদেশে, বাংলাদেশে।”৪

তৃতীয় কবিতাটি পাইনি। কিন্তু ১৩ই মে ও ১৮ মে দু’টি কবিতা লিখেছেন পাকিস্তানি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে, আরেকটি রাষ্ট্রপুঞ্জের কাজ কারবার নিয়ে। এ কবিতাগুলোর শিরোনাম নেই, কোথাও মুদ্রিতও হয়নি। ১৩ মে লিখেছেন—
শূকরের ঔরসে শকুনির গর্ভে জন্মায় যেই জীব
তার নাম জান ঠিক?
জান না? সত্যিই জান না? সেইটেই স্বাভাবিক।
বহু নাম আছে তার ইতিহাসে কেতাবে
ভূষিতও হয় তারা বহুবিধ খেতাবে
দুনিয়াটা মাৎ করে করে ছাদ-ছোঁয়া গর্বে।
শূকরের ঔরসে শকুনির গর্ভে জন্মিল যাহারা
দুনিয়ার থিয়েটারে নায়ক যে তাহারা।
এরোপ্লেনে ছুটছে, ট্যাংকেতে দলছে, ক্র
মাগত লুটছে, ক্রমাগত ছলছে
ফতোয়াও দিচ্ছে ‘যা করছি তাই ঠিক
পোষা টিকটিকিরা সায় দিয়ে বলছে, টিক্ টিক্ টিক্ টিক্।
ধিক্ ধিক্ ধিক্ ধিক্ বলছে না কেউ তো
স্তব্ধ হয়নি আজও পেজোমির ঢেউ তো। ওরে বুড়ো বেম্‌মা !
কি সৃষ্টি করলি এম্‌মা-এম্‌মা।”

রাষ্ট্রপুঞ্জ সম্পর্কে কবিতাটি লিখেছেন ১৮ই মে—
“ররাষ্ট্রপুঞ্জ কোন্ কুঞ্জে লীলা খেলা করেন,
কোথায় কেন গদা ঘোরান, কোথায় ধামা ধরেন
সব জানিতো—
তবুও আমরা চড়া গলায় বলে যাচ্ছি ঠিক,
দয়া করুন দয়া করুন ধর্ম মানবিক
পালন করা উচিত নয় কি?
তারা শুধু হাসছে খিক খিক। ”
১ জুন কলকাতায় নকশালদের খুন খারাবি নিয়ে কবিতা লিখেছেন যার এক লাইনে উল্লেখ আছে ইয়াহিয়ার—
“পয়লা জুন পয়লা জুন হচ্ছে আজও অনেক খুন
ওপারেতে ইয়াহিয়া এপারেতেও অনেক মিঞা ……..
আবারও বুদ্ধিজীবীদের একহাত নিলেন ৫ জুলাই। অথচ ৩ ও ৪ জুলাই রবীন্দ্রসদনে বুদ্ধিজীবী সমিতির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল রূপান্তরের গান।
অর্থ সংগ্রহের জন্য এটি করা হয়েছিল। টাকাও উঠেছিল এবং প্রচারও হয়েছিল যথেষ্ট। কিন্তু বনফুল ৫ জুলাইয়ের ভুক্তিতে এসব কিছু না লিখে লিখলেন— “হাস্যকর ব্যাপার করতে আমরা ওস্তাদ। শুনলাম কাল অনেক জায়গায় নাকি মেকি-আদালত বসিয়ে ইয়াহিয়া খাঁ ও বিশ্ববিবেককে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। কি আর বলব।’
সেপ্টেম্বরের দিকে বনফুলের মত বদলেছে। ১৮ সেপ্টেম্বর লিখেছেন— “এপার বাংলা ওপার বাংলার লেখকদের সম্মেলনে গিয়েছিলাম। বেশ ভালো লাগল। ওপার বাংলার লেখকদের মধ্যে যে আগ্রহ মনে হল তা আন্তরিক তাঁদের ভাষণগুলোও তথ্যপূর্ণ, প্রাণময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে কি হলো তা এখনও অজানা। আগুন জ্বলছে, আগুনের মধ্যে লোহা পুড়ছে, সেই পোড়া লোহা কোনো হাতুড়ির আঘাতে কি মূর্তি নেবে তা জানি না। আজকের সভাটি কিন্তু ভালো লাগল। প্রত্যেকের ভাষণ ছাপা হওয়া উচিত।”
নভেম্বরের দিকে দেখি, বনফুল বেরুচ্ছেন, বাংলাদেশ সংক্রান্ত সভা সমিতিতে যাচ্ছেন, একটির তো সভাপতিও হলেন। ২১ নভেম্বরের ভুক্তিতে লিখেছেন— “এপার বাংলা ওপার বাংলার সংস্কৃতি সংসদ স্থাপিত হলো আজ। সেখানে সভাপতিত্ব করতে গিয়েছিলাম। ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ নামটায় আপত্তি করলাম। বললাম, ওতে আমাদের অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন হয়। ওর নাম রাখা হোক বাঙালি সংস্কৃতি সংসদ। দক্ষিণারঞ্জন বসুরও তাই মত। পরবর্তী একটা সভায় এ নিয়ে আলোচনা হবে ঠিক হলো।”
২৯ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখি, আসন্ন যুদ্ধের, যুদ্ধ জয়ের আশায় তিনি উত্তেজিত। এতদিন পর তিনি এখন উদ্বেলিত। ঐ কয়দিনের বিবরণ ২৯ নভেম্বর।
“ও নিকসন দাদা
কেন ভাবছ বল দিকি
আমরা সবাই গাধা?
আমাদেরও বুদ্ধি আছে
আমাদেরও চক্ষু আছে
কোনটা কালো, শাদা
বুঝি আমরা দাদা।
ইয়াহিয়া দিচ্ছে তেল
খেলছ তাই অনেক খেল
কিন্তু সেটা হয়ে যাচ্ছে পষ্ট
সম্পর্কটা হচ্ছে তোমার নষ্ট।”

২ ডিসেম্বর
“কাগজে কাগজে যুদ্ধের দামামা
বাজছে। দামামা পিটছে ইয়াহিয়া
সীমান্তের চারদিকে বোমা ফেলছে।

বালুর ঘাটে বোমা পড়ছে। মন্মথ রায়ের খুড়িমা সেখানে থাকেন। বড্ড ঘাবড়ে গেছে বেচারা।” যুদ্ধ জানতাম শুরু হয়েছে ৩ ডিসেম্বর।”
কিন্তু জানা গেল ২ তারিখেই সীমান্তে বোমা ফেলা হয়েছে।

৩ ডিসেম্বর
ইন্দিরাজি আজ কলকাতায় এসেছেন। মাঠে বক্তৃতা দিলেন। রেডিওতে শুনলাম। খুব ভালো লাগল। আজই ফিরে গেলেন সন্ধ্যাবেলা। সীমান্তে পাকিস্তান খুব বোমা ফেলছে। ওরা যুদ্ধ না বাধিয়ে ছাড়বে না। মনে হচ্ছে যুদ্ধ লাগে লাগে। হঠাৎ নজরে পড়ল দর্জি পাখিটা ল্যাজ ফুলিয়ে বুক ফুলিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে ডালে ডালে। ওই যেন ইয়াহিয়াকে ঠাণ্ডা করে দেবে।

৪ ডিসেম্বর
যুদ্ধ বেধে গেল।
ইয়াহিয়া war declare করেছে। আমাদের জোয়ানরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলাদেশে। এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম সীমান্তে। আমরা জিতবই।
আশাবরী রাগিণীতে
সুর দিনু গানটিতে
সে সুরের মূলকথা
জিতবে সত্য ন্যায়
অনেক রক্ত ব্যয়
অনেক অর্থ ব্যয়
হবে জানি তবুও
আশাবরী সুর মোর
নামবে না কভুও।

৬ ডিসেম্বর
বগুড়া, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ সব আমাদের হাতে এসে পড়েছে। সৈন্যবাহিনী এগিয়ে চলেছে। যশোরের দিকে।
হঠাৎ মনে হলো যশোরের কই মাছ কি এখনও আছে? না খান সেনারা সব শেষ করে দিয়েছে!
বাংলাদেশের সব ঐশ্বর্যই তো লুটেছে ওরা এতদিন।”
৭, ৮, ৯ ডিসেম্বর বোঝা যাচ্ছে বনফুল উৎফুল্ল। যৌথ বাহিনী এগিয়ে চলছে। বনফুলের ভাষায় তা যৌথ বাহিনী নয় ‘আমাদের বাহিনী’ অর্থাৎ ভারতীয় বাহিনী। ৭ ডিসেম্বর লিখেছেন, “যশোরের পতন হয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনীরা গিয়ে দেখে কেউ নেই। সব পালিয়েছে, খালি শহর দখল করল তারা।”

৮ ডিসেম্বর
যুদ্ধ খুব চলেছে। যশোর আমাদের হাতে। জঙ্গী সেনারা যশোর ছেড়ে পালিয়েছে। ঢাকায় গিয়ে জমায়েত হচ্ছে বোধ হয়। কিন্তু ঢাকাও বেশিদিন ঢাকতে পারবে না পাষণ্ডদের। হয় আত্মসমর্পণ, না হয় মৃত্যু- এ ছাড়া গতি নেই তাদের। আমেরিকা তার কেরদানি দেখাতে চেষ্টা করছে U.N. মারফৎ। রুশ ভিটো দিয়েছে। বলেছে- এ যুদ্ধে বাইরের কোনও শক্তি নাক গলিও না।

৯ ডিসেম্বর
বাংলাদেশে আমাদের সৈন্যরা
খুব জিতছে। পালাচ্ছে খান সেনারা।
দেবতা জিতছে দৈত্য হারছে
ধর্ম এবার পাপকে মারছে
ইয়াহিয়াদের গদি যে টুটল
পদ্মার জলে পদ্ম ফুটল।
নতুন পদ্ম— রক্ত কমল
টকটকে লাল বিমল অমল
সে লাল রঙের নাই যে তুলনা
বুকের রক্ত সে কথা ভুলো না
লড়ছে জোয়ান বইছে খুব সে
দীপক রাগিণী বাজছে খুন কে
আগুন জ্বলছে আগুন জ্বলছে
ধর্ম এবার পাপকে দলছে।

১০ ডিসেম্বর
কি অপূর্ব কাহিনী
ঢাকার দ্বার প্রান্তে
আমাদের বাহিনী
অপরূপ কাহিনী
মন উঠছে দুলে
বুক উঠছে ফুলে
আশা নদীর কূলে
আজ ভাঙছে ঢেউ
অগণিত উচ্ছসিত
আনন্দদায়িনী
জয়তু জয়তু জয়
সৈন্যবাহিনী।

এরপর ১৫ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ণনা আছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। ১৫ই ডিসেম্বর লিখেছেন— “ঢাকার ভিতরে আমাদের সৈন্য ঢুকছে। ঢাকার গভর্নর মালিক নমাজ পড়ে কাজে ইস্তফা দিয়ে সাঙ্গোপাঙ্গসহ আশ্রয় নিয়েছেন Inter continental Hotel-এ: Red cross-এর আশ্রয়ে। অনেক সেনা আত্মসমর্পণ করছে। নিয়াজি কিন্তু হুঙ্কার ছাড়ছে শেষ পর্যন্ত লড়ব। মিঞার দৌড় কতটা দেখা যাক। হাতে উঠে টেলিস্কোপ লাগিয়ে বোধ হয় দেখতে পেয়েছে নিকসনের জাহাজ আসছে।”
যুদ্ধ থামাও— U.N. এই প্রস্তাব ‘পাস’ করতে চাইছিল। আবার ভিটো দিয়েছে। এই নিয়ে তৃতীয়বার হল।
খান সেনাদের অধিনায়ক নিয়াজি আমাদের সেনাধ্যক্ষ ম্যানেকশর কাছে যুদ্ধ বিরতির জন্য আবেদন জানিয়েছেন। ম্যানেকশর উত্তর-যুদ্ধ থামাচ্ছি, কিন্তু কাল নটার মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে হবে। যদি সক্রিয় সাড়া না পাওয়া যায় আবার প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ শুরু হবে ঢাকার উপর।

১৬ ডিসেম্বর
প্রধান খবর আজ ঢাকার পতন। নিয়াজি সাহেব বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন জেনারেল ম্যানেকশর কাছে। আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্রে সই করেছেন নিয়াজি এবং আমাদের পক্ষে অরোরা। জয় বাংলা।
পশ্চিম রণাঙ্গণে যুদ্ধ কিন্তু চলছে
এখনও তড়পাচ্ছে
ইয়াহিয়া মিঞা
ধর্ম-সত্য ন্যায়ের পথে জিগির দিয়া
দু’কান কাটা ভদ্রলোক
থ্যাতলানো নাকটিকে
বাঁচাবার চেষ্টা করছেন
অ্যান্টিবায়োটিকে।
কোলাপসিবল টিউব কিনে
চীনা এবং মার্কিনে
শুনেছি নাকি প্লেনে করে
পাঠাচ্ছে ওটিকে।
থ্যাতলানো নাক গোটা হবে
অ্যান্টিবায়োটিকে
এই আশাহত
এই তুফানে ফুটো তরী
চাচ্ছে ভাসাতে।

১৭ ডিসেম্বর
ইন্দিরা গান্ধীর জয়। তিনি পশ্চিম রণাঙ্গনেও যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছেন কাল। ইয়াহিয়াও অবশেষে সেটা মেনে নিয়েছে। মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সারা ভারত জুড়ে আজ উৎসব। দারুণ দুর্যোগের অবসান হলো।
এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। কিন্তু ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গ যা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক। ডিসেম্বরে দুটি প্রসঙ্গে এসেছে—গণহত্যা ও যুদ্ধ নিয়ে কবিতা

২২ ডিসেম্বর
যে শয়তানরা বাংলাদেশের অগণ্য নরনারীর উপর অকথ্য অত্যাচার করেছে, সেখানকার বুদ্ধিজীবীদের গুলি করে মেরেছে তাদের জন্য বিচার দাবি করছে অনেকে। মানুষই মানুষের বিচার করে। ওরা কি মানুষ। ওরা সাপ, বাঘ, নেকড়ের মতো। আমরা সাপ বাঘ নেকড়ের বিচার করি না। নাগালের মধ্যে পেলেই তাদের মেরে ফেলি। রাজনীতির দাবা খেলায় অনেক সময় ভণ্ডামির মুখোশ পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রেও হয়তো তাই পড়তে হবে। কিন্তু Kill the snake, shoot the tiger at once. এই হলো সনাতন রীতি।

৩০ ডিসেম্বর
১৯৭১ হল শেষ
বেশ বেশ বেশ বেশ।
সারা বছর জ্বালাল
শেষ কালেতে পালাল।
স্বাধীন হল বাংলাদেশ
এ খবরটি করবে পেশ
ইতিহাসের দপ্তরে
রক্তমাখা অক্ষরে
স্বয়ং মহাকাল।
চীন-মার্কিন জাল
ছিন্ন করে বেরিয়ে এলেন ইন্দু
উম্মলিত সিন্ধু
দিন যেন আবার
লক্ষী উপহার
স্বর্ণাক্ষরে থাকবে লেখা এটা।
আর লাগবে রাজনৈতিক
এটা ওটা সেটা
বিশেষ করে কুকুরগুলোর
খেয়োখোয়ি সারাটা দেশময়।
থাকবে, কিন্তু স্বর্ণাক্ষরে নয়।
আর থাকবে হীরক দ্যুতিময়
আমাদের জোয়ানদের বীরত্ব অক্ষয়।
ভারতের দুর্বার যৌবন,
মনে রাখব তুমি মোদের
গর্ব চিরন্তন।

ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বনফুলের ছিল অসীম আস্থা। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হলেও দেখি বনফুল আক্ষেপ করছেন, অপেক্ষা করছেন কবে ইন্দিরা গান্ধী ফিরবেন।
১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান সম্পর্কে একটি ভুক্তি আছে। এবং ৯ জানুয়ারি আছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দু’টি ভুক্তি। ৯ জানুয়ারি লিখছেন -“শেখ মুজিবর রহমান কারামুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ভুট্টো তাঁকে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন লন্ডনে [ঠিক নয়] ভারতে ছেড়ে দিতে কি লজ্জা করল! ভুট্টোরও তাহলে লজ্জা আছে। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন লন্ডনে ছেড়ে দিলেও বাঘ বাঘই থাকবে। কুকুর হবে না। হীথ-এর সঙ্গে মোলাকাত হলেও হবে না।”

১০ জানুয়ারি
আজ শেখ মুজিবর রহমান সকালে দিল্লিতে এসে পৌছলেন। রেডিওতে ধারা-বিবরণী শুনলাম। চোখে জল এসে গেল। মনে পড়ল অগ্নিযুগের বীরদের। মনে পড়ল নেতাজীকে। তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পাননি। একজন বীরকেও আমরা তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে পারলাম এতেই মন ভরে উঠেছে। ইন্দিরা গান্ধীর ভাবমূর্তি মনে ক্রমে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
এ সাফল্যের মূলে তিনিই। রেডিওতে বলল তিনি একটি কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে এসেছিলেন বিমানবন্দরে মুজিবকে সংবর্ধনা জানাতে। সবুজ রঙইতো ওঁকে মানায়, উনিতো চিরসবুজের প্রতীক।
ঢাকা রেডিও খুলেছিলাম। সেখানে শুনলাম তুমুল গোলমাল। লক্ষ লক্ষ লোকের বিপুল জয়ধ্বনি। বিকেল চারটা নাগাদ মুজিবের বক্তৃতা শোনা গেল। বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি কাঁদছিলেন। পাকিস্তানি শয়তানরা যাদের খুন করেছে, তাদের শোকে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। বললেন— ওদের আমরা বিচার করব, বিচার করে শাস্তি দেব। মুজিবের সম্বন্ধে একটা কবিতা লিখে অমৃত সাপ্তাহিকে পাঠালাম। বললে— এই সপ্তাহেই বের হবে।
ফেব্রুয়ারিতে মুজিব এলেন কলকাতা। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। বিকেল তিনটায় দু’জনই বক্তৃতা দেবেন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। ৬ ফেব্রুয়ারি বনফুল লিখেছেন— “পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাকে কার্ড পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ করেছে যেতে। ভিড়ে ঠেলাঠেলি করার সামর্থ্য নেই। তাছাড়া আমার কল্পজগতে শ্রীমতী গান্ধী ও শ্রীযুক্ত বঙ্গবন্ধুর যে মূর্তি এঁকে রেখেছি তার সঙ্গে বাস্তবের যদি অমিল হয় তা’হলে বড় কষ্ট পাব—তাই যাব না।
ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী সাহিত্যিকদের একটি দল ঢাকা সফরে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। এ নিয়ে বনফুল একটি ভুক্তি লিখেছেন। বলা যেতে পারে বাংলাদেশ সম্পর্কে এটিই সবচেয়ে বড় ভুক্তি।

১৪ ফেব্রুয়ারি
কাল রবিবাসরে মনোজ বসু দুঃখ করছিল বাংলাদেশে সাহিত্যিকদের যে ইজ্জত আছে পশ্চিমবঙ্গে সে ইজ্জত নেই। মুজিবর রহমানের সঙ্গে আলাপ করার জন্য যেসব বুদ্ধিজীবীদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিমন্ত্রণ করেছিলেন তাদের মধ্যে নামজাদা সাহিত্যিক একজনও ছিলেন না। সত্যিকারের সাহিত্যিকদের সঙ্গে কোনও সরকারের বনিবনা হয় না, কারণ তারা যে সত্য কথা বলে। সরকারের সঙ্গে বনিবনা হয় সেই সব সাহিত্যিকদের যাঁরা সাহিত্যিকের মুখোশ পরে তৈল-নিষেক করতে পারে। মনোজ ওদের দলে যেতে চায় নাকি? তাছাড়া সাহিত্যিকরা সত্যি কি বুদ্ধিজীবী? উকিল, মোক্তার, প্রকাশক, ডাক্তার এরা বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধি থাকলে কেউ কি সাহিত্যিক হয় এ দেশের যে দেশে প্রকাশকরা অসাধু, পাঠক-পাঠিকারা বেরসিক, দেশের সিনেমা-সাহিত্যই জনপ্রিয় সে দেশে সাহিত্যিক হওয়া কি বুদ্ধির পরিচয়? মনোজ অবশ্য বুদ্ধিজীবী, কারণ সে প্রকাশকও। সাহিত্যিকরা বুদ্ধিজীবী নয় ক্ষীণজীবী। মুজিবের সভায় ক্ষীণজীবীদের ডাকবে কেন? ডাকলেই আশ্চর্য হতাম।

২৩ ফেব্রুয়ারি
“বঙ্গবন্ধু মুক্ত আজ মহামন্ত্রী তিনি
হাতকড়ি খুলে গেছে, নেই আর কোনও রসারসি
চল মোরা এই বার দলে দলে এক ফাঁকে গিয়ে
তাঁর সাথে করি আসি কাঁধ ঘষাঘষি
আর দর কসাকসি।”৫

সূত্র:
১. দৈনিক কালান্তর, ২৮.৩.১৯৭১।
২. মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক অবদান, ঢাকা, ২০২০।
৩. দৈনিক কালান্তর, ২১.৪.১৯৭১।
৪. মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তরের সাহিত্য ও পশ্চিমবঙ্গ, ঢাকা ২০২১।
৫. রোজনামচার ভুক্তিগুলো উদ্ধৃত হয়েছে, বনফুল রচিত মর্জিমহল, কলকাতা, ২০১১-থেকে।

একাত্তরের বন্ধু যাঁরা- মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!