You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.21 | বাংলাদেশ -কানাডাতে অনাথ শিশুর দত্তক নেবার প্রচলিত ব্যবস্থা - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ ও কানাডাতে অনাথ শিশুর দত্তক নেবার প্রচলিত ব্যবস্থা

‘দত্তক’ প্রথা এমন এক সামাজিক প্রক্রিয়া যার আওতায় একটি শিশুর লালন পালনের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব তার জৈব মা-বাবার পরিবর্তে অন্যতর, এক্ষেত্রে দত্তকগ্রাহী মা-বাবার হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের নানা দেশ ও সংস্কৃতিতে দত্তক দেয়া-নেয়ার বহুল প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশ। ও কানাডাতে দত্তক অথবা পােষ্য গ্রহণের অর্থ একই। দুদেশে দত্তক প্রথাকে একটি আইনসম্মত প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা হয়, যার দ্বারা অনাথ শিশুকে একটি সম্পূর্ণ পারিবারিক জীবনের নিশ্চয়তা ও পরিবেশে লালিত পালিত হওয়ার সুযােগ করে দেয়া হয়। পােষ্য গ্রহণের মাধ্যমে একটা অনাথ শিশুকে অন্য কোনাে পরিবারে সর্বোত্তম নিরাপত্তা ও পারিবারিক সম্পর্কের নিশ্চয়তা দেয়া হয়।বাংলাদেশ ও কানাডাতে প্রচলিত রীতিনীতি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, সামাজিক মূল্যবােধের পার্থক্যের কারণে দত্তক প্রথার আওতাধীন নীতিমালা ও প্রচলিত বিধিমালায় চোখে পড়ার মতাে বৈচিত্র্য ও পার্থক্য রয়েছে । কানাডাতে দত্তক নেয়াকে একটি নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক মঙ্গলকর ব্যবস্থা হিসাবে দেখা হয়, যা একজন অনাথ শিশুর জন্য পরিবার খোঁজার মাধ্যমে। সম্পন্ন হয়। অপরদিকে বাংলাদেশে সাধারণত শিশুর বর্ধিত এ ধরনের অনাথ শিশুর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । সে শিশুটির দায়িত্ব নেবার অনুপস্থিতিতে যদি পরিবারের বাইরে কেউ দত্তক নিতে ইচ্ছুক হােন অথবা কোনাে প্রতিষ্ঠান ঐ দায়িত্ব নেয়, সেটা আপাতদৃষ্টিতে ভালাে হলেও সমাজ তা সহজভাবে মেনে নেয় না। কথাটা এ অর্থে বলা হচ্ছে যে ঐতিহ্যগতভাবে, অজানা কোনাে পরিবারের পরিবর্তে ঘনিষ্ঠতর কেউ শিশুর দায়িত্ব নিলে। সেটা আরও সুব্যবস্থা বিবেচিত হয়। এ ব্যবস্থাকে দীর্ঘমেয়াদি পােষ্য নেবার সামিল ধরা হয়, যার দ্বারা শিশুর নিজস্বজনের দ্বারা লালিত পালিত হবার যে অধিকারের কথা বলা হয়, সেটাও রক্ষিত হলাে ধরে নেয়া যায় ।

দত্তক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অনাথ আশ্রম দত্তক নেবার বিষয়ে বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ও পরস্পরবিরােধী রীতি ও বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, পােষ্য দেয়া বা নেয়া একটি ভালাে কাজ, আবার কেউ কেউ মনে করেন সন্তানহীন দম্পতির জন্য এটি সৃষ্টিকর্তার উপহারের।  সামিল । দত্তকগ্রহণ করাকে পরিবার প্রতিপালনের জন্য দ্বিতীয় সুযােগ লাভের মতাে বিষয় মনে করেন অনেকে। তারপরও অনেকে নিজেদের” (জৈব মা-বাবা হওয়ার মাধ্যমে) সন্তানের সাহায্যে পরিবার তৈরি করার পক্ষপাতী। পাকিস্তান বা বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) দত্তক দেয়া নেয়া সম্পন্ন করার উপযােগী কোনাে আইন ছিল না। বাংলাদেশের যখন জন্ম হয় ১৯৭১ সালে, দন্ডবিধি অনুসারে দত্তক দেয়া অথবা নেয়া ও দত্তক নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনাে আইন চালু ছিল না। এ বিষয়ে পূর্বে প্রণীত আইন Guardian and Ward Act, 1890 এবং Muslim Family Ordinance, 1911 বাংলাদেশেও বতায় । এ আইন অনুসারে উপযুক্ত আদালত অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর দেখাশােনার ভার শিশুর সর্বোচ্চ মঙ্গলের স্বার্থে যে কারাে ওপর ন্যস্ত করতে পারে । সােজা কথায় বললে, মুসলমান আইনে দত্তক নেবার ব্যবস্থা নেই, যেরকম পশ্চিমে আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। মৃত্যু, অসুস্থতা এবং অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে শিশুদের মা-বাবার কাছ থেকে অভিভাবকত্ব সরিয়ে শিশুর বর্ধিত পরিবারের অন্য কারাে ওপর অথবা কোনাে নিকট আত্মীয়ের ওপর অথবা অনাথ আশ্রম অথবা ওই ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দিতে পারে। উল্লেখ্য যে, ১৯৮২ সালের Guardian and Ward Assessments Ordinance অনুযায়ী বাংলাদেশি শিশুদের অভিভাবকত্ব শুধুমাত্র বাংলাদেশি বাবা-মাকে দেয়া হয়। অন্য কোনাে দেশি নাগরিকদের দত্তকগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয় না । সাধারণভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে অথবা স্বামী-স্ত্রী পৃথকভাবে বসবাস করতে শুরু করলে মা-বাবার অধিকার, শিশুদের দেখাশােনা, লালন-পালনের দায়িত্ব আদালতের নির্দেশে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

আদালতের আদেশের অনুপস্থিতিতে, মা-বাবা নিজেদের সন্তান পালনের অভ্যাসমতাে কাজ চালিয়ে যান এবং বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলেমিশে সকলের জন্য সুবিধেজনক ব্যবস্থা মেনে নিতে রাজি হােন। সামাজিকভাবে বললে, একটি সর্বজনসম্মত ব্যবস্থা সমাজের চোখেও গ্রহণযােগ্য মনে হবে সহজেই। বাস্তবে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে অথবা মা-বাবার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শিশুর লালন পালনের দায়িত্ব বর্ধিত পরিবারের কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য নিজেরা পালন করেন। নিকট আত্মীয়ের কেউ অথবা বর্ধিত পরিবারের কেউ শিশুদের দত্তক নেন এমনটাই বেশি হয় । সাধারণত এ দত্তক নেয়া আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক ছোঁয়া বাঁচিয়ে করা হয়ে থাকে। সেখানে অনাথ বা এতিম শিশুকে আত্মীয়দের কেউ কোলে তুলে নেন এবং সে শিশু পরিবারের অন্য শিশুদের সঙ্গে বড় হতে থাকে। এ ধরনের দত্তক নেয়ার পেছনে কোনাে সামাজিক সংস্থা নেই, আত্মীয়রাই এটা সম্পন্ন করেন। এর উদ্দেশ্য, শিশুকে কোনাে আনুষ্ঠানিকতার বাইরে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে পরিবারের একজন হিসাবে বেড়ে উঠবার সুযােগ করে দেয়া হয় । আইন যদিও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম কখন এক জোড়া মা-বাবার ভূমিকা শেষ হয়, আরেক জোড়া মা-বাবা তাদের দায়-দায়িত্ব বুঝে নেন, এরকম আইনি ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশিরা এটাকে অভিভাবকত্ব হিসেবে বেশি দেখেন (দত্তক হিসাবে নয়)।

একথা আঙুল তুলে বলার দরকার নেই যে, বাংলাদেশে দত্তক বিষয়ে তিন ব্যক্তিকে (পােষ্য, জন্মদাত্রী মা-বাবা এবং পােষ্য  গ্রহণকারী মা-বাবা) ঘিরে নানা কুসংস্কার এবং বৈষম্যমূলক আচরণ প্রচলিত রয়েছে। তাই, বাংলাদেশে দত্তক ব্যাপারটা একটা কাগুজে” আত্মীয়তা হিসাবে দেখায় হয় যার ভিত্তিতে সন্তান গর্ভেধারণ এবং জন্মদানের ব্যাপার নেই । অন্য কথায়, দত্তক নেবার জন্য পছন্দ বা বাছাই করা হলে, তার সঙ্গে মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের সাংস্কৃতিক পূর্বধারণার সঙ্গে তা মেলে না। এ সামাজিক পটভূমিতে, কানাড়াতে আমরা স্বাভাবিক আইনি দত্তক নেয়া বলতে যা বুঝাই, বাংলাদেশে সেটা বহুল প্রচলিত নয় । বাংলাদেশে যেটা প্রচলিত এবং বাঙালি ঐতিহ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত তা হলাে, অনাথ শিশুর অভিভাবকত্ব, সেটা শিশুর বর্ধিত পরিবারেই ন্যস্ত থাকে ।

অনাথ শিশুর দায়িত্ব যার ওপর বর্তায়, সে আত্মীয়টি শুধুমাত্র শিশুর অভিভাবক হিসেবেই গণ্য হােন ঐ শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত । ঐ শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিষয়টি অন্যভাবে বিবেচনা করা হয়। অন্যকথায় সে অভিভাবক তখন আর অভিভাবক” হিসাবে গণ্য হােন না এ অর্থে যে বর্তমানে প্রাপ্তবয়সে পরিণত হওয়া প্রতিপাল্যের প্রতি তার আর কোনাে দায়দায়িত্ব থাকে না। সাধারণত দেখা যায় বাংলাদেশে নির্দিষ্ট অভিভাবক ছাড়াও একটি অনাথ শিশু তার চাচা, মামা, ফুফু, খালা, চাচি, তুতাে ভাইবােন বা দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের তত্ত্বাবধানেও বড় হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে এতিম শিশুর দায়িত্ব নেয়ার জন্য বর্ধিত পরিবারের কেউ না কেউ এগিয়ে আসেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যবস্থাই বেশি প্রচলিত। অর্থাৎ আত্মীয়স্বজনেরা আদালতে গিয়ে আইনসম্মতভাবে দত্তক নিতে অভ্যস্ত নন। সেজন্যই সাধারণত আনুষ্ঠানিক দত্তক ব্যবস্থা বাংলাদেশে দেখা যায় না। অনিচ্ছুক সন্তানহীন মা-বাবাও এটা করেন না, যেখানে অনানুষ্ঠানিক দত্তক নেয়া বাংলাদেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে এসেছে। বেশিরভাগ বাংলাদেশিরা আইনসম্মতভাবে দত্তক নেয়ার চেয়ে বর্ধিত পরিবারে অনাথ শিশুদের লালনপালনে বিশ্বাসী। সেজন্য এ প্রথার সামাজিক অনুমােদনও অনেকাংশে বেশি। মােটকথা, কানাডীয় রীতিনীতির সাথে এখানেই বাংলাদেশির প্রথার পার্থক্য। “অভিভাবকত্ব” বাংলাদেশে অধিকতর পছন্দের সামাজিক রীতি যাতে শিশু ও তার পরিবারের ওপরে আইনি ব্যবস্থার কোনাে অভিঘাত বর্তায়।
যে পরিবার একটি অনাথের দায়িত্ব নেবেন সে পরিবারই শিশুটিকে সুরক্ষা দেবেন, খাওয়াবেন, পােশাক পরাবেন, শিক্ষা দেবেন এবং নিজের সন্তানের মতাে ভালােবাসবেন । অবশ্য শিশুর প্রকৃত বংশগতি ও পিতৃপরিচয় রক্ষার দায়িত্ব দত্তক নেয়া দম্পতি পালন করবেন। নিজের ঔরসে জন্মগ্রহণ করা সন্তানের যে অধিকার শারিআহুতে যেমন বলা রয়েছে সেগুলাে পালিত সন্তানকে দেয়া উচিত নয়। বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, শারিআহূতে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে পিতৃমাতৃহীন শিশুকে পালনকারীর আদর-যত্ন দেবার বিষয়ে বলা হলেও অপরের সন্তানকে নিজের বলে দাবি করা যাবে না ।
সরল কথায়, ইসলাম পরিত্যক্ত শিশু উদ্ধারের বিষয়ে জোর দিলেও দত্তক নেবার বিষয়ে অনুমােদন দেয়নি। এরকম শােনা যায় যে, নবী মুহম্মদ (সঃ) দত্তক নেয়াকে সমাজকর্ম বলে উৎসাহ দিতেন। এমনকি এটা একটি দয়ালু মানুষের কাজ’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। নবীকে। আরও বলতে শােনা গিয়েছে, যে মুসলমান বাড়িতে একজন এতিমকে আদর-যত্ন করে। লালন-পালন করা হয়, সেটি নিঃসন্দেহে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ বাড়ি। উক্ত শিশুর কোনাে সম্পদের উত্তরাধিকার থেকে থাকলে তার দেখাশােনার ভারও অভিভাবককে নিতে হয়, যা অনাথের বয়ঃপ্রাপ্তিতে তার নিজের দায়িত্বে ফিরে আসে। পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত বয়সে পরিনত হওয়া এতিম ক্রমশ সকল কিছু নিজে নিজে পরিচালনা করতে সমর্থ হয়। ইসলাম ধর্মে দত্তক নেয়া বা দেয়া নিষিদ্ধ না হলেও বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বে, যেমন- কানাডা অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যে অর্থে দত্তক নেয়া দেয়ার বিষয়টি বােঝায় এবং চর্চা করা হয়, তার থেকে ইসলামি দত্তকের ধারণা বেশ অন্য ধরনের । যেমনটি দেখা যায়, ইসলামে দত্তক নেয়া দেয়ার ব্যাপারে শিশুর জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা পিতাকে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া জুড়ে উপস্থিত রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। একটি শিশুকে দত্তক নেয়ার অর্থ হলাে, এ প্রক্রিয়া সম্পাদনের মধ্য দিয়ে মুসলমান মা-বাবা একটি অনাথ শিশুর অভিভাবকত্ব অর্জন করেন। একটি পরিত্যক্ত শিশুর দেখাশােনার দায়িত্ব লাভ করেন বা একটি দরিদ্র যার সহায়তা প্রয়ােজন এমন শিশুর দেখভালের দায়িত্ব পান যার জন্মপরিচয় আছে অথবা নেই ।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় যে, একটি অনাথ শিশু লালন-পালনকালে শিশুর পরিচয় ও বংশধারা পরিবর্তন করে মেকি বংশধারা (দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের নাম) লেখার যে প্রচলন, সেটি ইসলামে নিষিদ্ধ । ইসলামে এটাও মনে করা হয় যে শিশুর জন্মদাতা পিতার নাম অনুসারে তার নামকরণ করা হলে শিশুর পরবর্তী জীবনে কোনাে মানসিক আঘাত এ নামপরিচয় সূত্রে হয়তাে আর আসবে না। অন্যকথায় বললে, বাংলাদেশে একটি শিশুর জন্মের কালে এবং স্থানে যে সাংস্কৃতিক পরিচয়ে সে স্বাভাবিকভাবে পরিচিত হয়, সে পরিবারের পরিবর্তন সহজে আর ঘটে না। কানাডাতে বিষয়টি অন্যভাবে হয়ে থাকে। আনুষ্ঠানিক দত্তক নেবার মাধ্যমে দত্তকগ্রাহী মা-বাবা সন্তানের জন্ম না দিয়েও সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবা হিসাবে পরিগণিত হন। বাংলাদেশি সমাজে, “রক্তের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী এবং তাকে ছিন্ন করা যায় না। বাংলাদেশে ধরে নেয়া হয় যে দত্তকায়িত ছেলেমেয়েকে সবসময় এক মাপকাঠিতে মাপা সম্ভব হয় না। সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়ে ঘাটতি থাকার কারণে তারা ঠিকঠাক কোথাও কখনাে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। তাই এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত দত্তক নেয়াটাকে স্থানীয় ঐতিহ্য বাইরের রীতি হিসাবে গণ্য করে দত্তক নেয়াটাকে সমর্থন করে না ।
বাংলাদেশি সমাজে “রক্তের সম্পর্ককে” অতএব সবার ওপরে গুরুত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি অনুসারে লােকে আগে জানতে চায় অমুকের মা-বাবা কারা, তাই দত্তকগ্রাহী মা-বাবা অথাৎ জন্ম না দিয়ে যারা মা-বাবা হয়েছেন, তাদেরকে কেউ সহজে মা-বাবা হিসাবে মেনে নিতে পারেন না। সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বলা যায়, বাংলাদেশে বিবাহিত মা-বাবার মানবিক ও শারীরিক স্বাভাবিকতা ও সুস্বাস্থ্য সন্তান ধারণ, প্রসব ও লালন-পালনের মাধ্যমে জীবনযাপনই সহজাত ও অনুকরণীয়। ১৯৭০ এর প্রথমদিকে দত্তক ব্যবস্থাকে ঘিরে বাজারে নানা রীতিনীতি, মূল্যবােধ ও অনুমান চালু ছিল, যার অধিকাংশ ছিল নেতিবাচক। আমরা আনুষ্ঠানিক দত্তক ব্যবস্থা, ঐতিহ্যবাহী জন্মদাত্রী মারা কীভাবে অদৃশ্য হয়েছেন । যুদ্ধশিশুরা তাদের জন্মদাত্রী মায়েদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়েছে, যখন তাদের জন্মদাতা পিতারা ভারতীয় সেনাদের হাতে বন্দি হয়ে পাকিস্তানে ফেরত গিয়েছেন তিন বছর পর। যুদ্ধশিশুদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে পরিত্যক্ত শিশুরদের যখন একসঙ্গে শিশু ভবন ও বিভিন্ন সেবা সদনে আনা হয়, দত্তক নেবার ইস্যুটি আবার আলােচনায় উঠে আসে। সে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক স-কারেন্ট হিসাবে দত্তক সমর্থনকারী, দত্তকের বিষয়ে কাজ করে সেসব সংস্থা এবং সমমনা দলগুলি তখন বাংলাদেশ জুড়ে আলাপ আলােচনার ঝড় তুলেন। দেখা যায় যে, সে সময়ে স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা দুরকম চিন্তাভাবনা করছিলেন। একদল যুদ্ধশিশুদের “অবাঞ্ছিত মনে করেছিলেন; অন্যদল তাদের সাধারণ শিশুদের মতােই তারাও “স্নেহ আদরের দাবিদার” ভেবেছিলেন। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান যাদের প্রত্যেকে একে অপরের ভূমিকা ও দায়দায়িত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন পৃথকভাবে, দত্তক নেবার ব্যাপারে অংশীদারিত্বের কথা বলেননি। কারণ যুদ্ধশিশুদের সামাজিক গ্রহণযােগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল ।
শিশুর কল্যাণের বৃহত্তর ক্ষেত্রের কথা ভেবে সাধারণ ইস্যুগুলিকে কেন্দ্র করে একজোট হয়ে কাজ করার কথা ছিল। অবশ্য এর নেপথ্য কারণ হলাে, তাদের মনােযােগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেসব অনাথ শিশু যারা তখনও তাদের পরিবারের সঙ্গে ছিল। তাদের তখন কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে সেটা ঠিক করা হয়নি, কিন্তু তাদের সেবার প্রয়ােজন ছিল। তারা ছিল অত্যন্ত দরিদ্র মা-বাবার সন্তান অথবা তাদের বাবা-মায়েরা ছিলেন তালাকপ্রাপ্ত। বেশিরভাগ শিশুর বাবা-মায়েরাই স্বেচ্ছায় এই শিশুদের পরিত্যাগ করেছিলেন অসুস্থতা এবং অসচ্ছলতার কারণে । তাদেরকেই অগ্রাধিকার দিয়ে সেবা দানে ব্যস্ত ছিলেন আশ্রমের কর্মীবৃন্দ। যেহেতু ১৯৭২ সালে যুদ্ধশিশুদের অন্যদৃষ্টিতে দেখা হয়েছিল, (যেমন- বেজন্মা বা অনীতি) তাদের প্রতি অনেকের কোনাে সহানুভূতি ছিল না। সেজন্য তাদের দত্তকায়নের বিষয়ে কারােরই তেমন মাথাব্যথা ছিল না । তৎকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রথার বিপরীতে যেতে প্রচন্ড ভীতিবােধ ছিল। তাই যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা দত্তক ব্যবস্থাকে কোনাে প্রাধিকার দেননি। মজার ব্যাপার হলাে, স্থানীয় ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার আলােকে দেখলে সামাজিক সংস্থাসমূহের পছন্দের শিশুরা প্রায় ক্ষেত্রেই জানাশােনা পরিবারের হতাে, বর্ধিত পরিবারেই যাদের অভিভাবক মিলে যেত । দত্তক বিষয়ে বাংলাদেশিদের মন-মানসিকতা বদলাতে পিছিয়ে থাকবে বছরের পর বছর । এটা বললে হয়তাে অত্যুক্তি হবে না যে, অনেকটা হেলির ধূমকেতুর মতাে ঘুরে আসতে আসতে যে, সময় নেবে সে সময়েও দত্তক প্রথা সম্পর্কে তাদের মনে কোনাে পরিবর্তন আসবে না। তবে একথা স্বীকার্য যে, মুজিব সরকার তখনকার প্রতিথযশা আইনজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীদের পরামর্শমতাে ইস্যুটাকে শিশুদের অভিভাবকত্ব নির্ধারণের প্রয়ােজনকে সর্বোচ্চ প্রাধিকার দিয়ে দত্তকের প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করেছিলেন।
মিশনারিজ অব চ্যারিটি এবং মাদার তেরেসার শিশু ভবন স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কলকাতা থেকে মাদার তেরেসা ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ঢাকা এসে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যখন তারা বাংলাদেশের অবমানিতা নারীদের অবস্থা বিষয়ে আলােচনা করেন, নতুন সরকারের কোনাে ধারণা ছিল না কী করবেন । দেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানে জেলে বন্দি ছিলেন। সময়ের গুরুত্ব বুঝে প্রেসিডেন্ট ইসলাম মাদার তেরেসাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মাদারকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার মনে করেন মাদার তেরেসার সঙ্গে অবমানিতা নারী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করবার উপযুক্ত সময় এটা। সরকার মাদার তেরেসার উপর সম্পূর্ণ অস্থাশীল ছিলেন। কারণ ততদিনে তিনি সারা বিশ্বে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছেন। পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে প্রেসিডেন্ট মাদারকে অনুরােধ করেন তিনি যেন দুস্থ নারীদের মুক্তি বিষয়ক কর্মসূচি নিয়ে সরকারের সহায়তায় এগিয়ে আসেন।
ঐ সময় পুরনাে ঢাকার ২৬ ইসলামপুরে অবস্থিত ৩৫০ বছরের পুরনাে পর্তুগিজ মনাস্টারিতে আটজন মিশনারিজ অব চ্যারিটির সন্ন্যাসিনী ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য একটি আশ্রয কেন্দ্র চালু রেখেছিলেন। তিন সপ্তাহের মাথায় মাদার তেরেসা আবার ঢাকায় এলেন ‘৭২ এর জানুয়ারি মাসে। সঙ্গে নিয়ে এলেন চারজন ভারতীয় সন্ন্যাসিনী এবং দুজন নার্স, প্রতিষ্ঠা করলেন শিশু ভবন, তাঁর সেবা কেন্দ্র। এখানেই বহু অবমানিতা নারীকে আসতে উৎসাহ দেয়া হয়, যাতে তারা সম্পূর্ণ গােপনীয়তার মাঝে সন্তান প্রসব করতে পারেন। তাদের আরও বলা হয়েছিল, তারা যদি চান নবজাতককে ওখানেই ত্যাগ করে যেতে পারবেন । শিশুর লালন-পালনের দায়িত্ব অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত থাকবে। অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসাবে বেশ ক’টি সেবা সদন (প্রতিষ্ঠানগুলি তৈরি করা হয়েছিল এ লক্ষ্যে যে ধর্ষণের শিকার নারীদের সেবার উপযুক্ত কেন্দ্রগুলিতে প্রয়ােজন মতাে গর্ভমােচন অথবা গর্ভস্থ সন্তান প্রসব করানাে যাবে) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ জুড়ে যাতে ধর্ষণের শিকার নারীরা সেখানে কোনাে পরিচয় না দিয়ে প্রয়ােজনীয় সেবা নিতে পারেন। এটা করার উদ্দেশ্য ছিল, গর্ভধারিণীমায়েদের ওরকম জায়গায় আসতে উৎসাহিত করা যাতে মা ও শিশুর জীবনে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয়। (আমরা প্রথম অধ্যায়ে যেমন দেখেছি) এ সময়ে অনেক গর্ভধারিণী মা আত্মহত্যা করছিলেন। ওসব ঘটনা সম্পর্কে অনেকের মধ্যে শুধু ফিসফিসিয়ে কথা হতাে।
১৯৭২ এ যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে যে দুজন বিশেষভাবে মাদার তেরেসাকে সাহায্য করেছেন, তারা হলেন থিওটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলী, সি এস সি, ঢাকাস্থ আর্চডায়ােসিস-এর আর্চবিশপ, যাকে শক্তি ও সহমর্মিতার স্তম্ভ বলা হয়; এবং ফাদার বেঞ্জামিন লাবুবে, কানাডীয় হােলি ক্রস অর্ডার, তখন তিনি Christian Organization for Relief and Rehabilitation (CORR)-এর পরিচালক ছিলেন। এ দুজন নেতৃত্বদানকারী মানুষ মাদার তেরেসা এবং অন্যান্য অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজকর্ম সমন্বয় যুগিয়ে কাজগুলাে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে অনেক অবদান রেখেছেন। নীরবে কাজ করার প্রয়াসে যাতে ব্যাপারটা নিয়ে হৈচৈ হয় এ দুজন ধর্মীয় নেতা আরও দুজন বিশপের সাহায্য নেন পালাক্রমে । সে দুজন ছিলেন জোয়াকিম রােজারিও এবং চট্টগ্রাম ও খুলনার অতুল ডি রােজারিও। এ চারজন ১৯৭২ জানুয়ারির প্রথমদিকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা (CORR)-এর রিলিফ কাজের সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করেন। তার মধ্যে বাংলাদেশ জুড়ে ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য নানারকম সহায়তা করার পরিকল্পনার কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে (CORR) ইতােমধ্যে প্রস্তাবিত কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমােদনও পেয়েছিলেন।
মুজিব প্রশাসনের প্রারম্ভিক কাজগুলি এমন একটা সময় যখন সরকার শক্তিশালী, তরতাজা ও স্বাধীন সােনার বাংলা গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তখনই আবার তাকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হতে হয়েছিল নিরন্তর। মূলত চ্যালেঞ্জগুলাে ছিল, নির্ভরযােগ্যতা, পারিবারিক ভঙ্গুরতা, ব্যক্তিগত দারিদ্রতা ও আশ্রয়হীনতার । স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশে যখন সবকিছুই কতকটা বেঘােরে চলছিল, সহিংসতার ঢেউ তখন আছড়ে পড়েছে বন্দুক, কামান, দলবাজি মাদকের মধুকর চক্রদের ঘিরে। রাজনীতির এলােমেলাে খেলায় নতুন গঠিত সরকার টালমাটাল হাতে হাল ধরে ছিলেন। শেখ মুজিবের মতে, দেশের জন্য শক্ত অর্থনীতি অত্যাবশ্যকীয় । সরকারের বুঝতে কষ্ট হয়নি যে, বাংলাদেশিরা যে সােনার বাংলা গড়তে চেয়েছিল, সে চড়াই পথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। সে সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এক বিপুল জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছিল একদিকে, অপরদিকে গৃহহীন মানুষের প্রয়ােজন মেটানাের মতাে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন হাতের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছিল।
একদিকে যেমন গৃহহীন মানুষের পুনর্বাসনের চাপ ছিল, তেমনি সরকারকে অন্যদিকে অনাথ ও “অবাঞ্ছিত” যুদ্ধশিশুদের নিয়ে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়েছিল । বছরের প্রথম থেকে যখন যুদ্ধশিশুর জন্ম হওয়া শুরু হলাে জন্মদাত্রী মায়েরা তাদের সাথে সাথে পরিত্যাগ করেছিলেন। যেহেতু সমাজ সে শিশুদের চায়নি, একমাত্র সরকারকেই তাদের লালন-পালন ও দেখাশােনার বিষয়ে ভাবতে হয়েছিল। অধিকৃত বাংলাদেশে যেহেতু সম্পূর্ণ অবকাঠামাে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, মুজিব সরকারকে প্রাধিকার আরােপ করে দেশ গড়ে তুলবার প্রয়াসে মনােনিবেশ করতে হয়। আমরা এ অধ্যায়ের শেষে দেখতে পাবাে কীভাবে সরকার দেশের। ঝুঁকিপূর্ণ মানবগােষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধশিশুদের ইস্যুটাকে তার পরিকল্পনাতে একটি জরুরি আলােচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেন।
জাতির সম্মুখে যে নতুন দেশ গড়বার চ্যালেঞ্জ সেটি চিনতে পারা এবং একই সঙ্গে দুর্নীতির অবসান ঘটানাে এবং গণতান্ত্রিক সুশাসনের প্রক্রিয়ার প্রবর্তন ঘটানাে যেমন সরকারের পক্ষে জরুরি ছিল, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাতীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে সকল বাংলাদেশি নাগরিককে স্বাধীন দেশের সমান অধিকারভােগী নাগরিক সদস্যের মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যবােধের নিশ্চয়তা প্রদান । বাঙালীদের জাতীয় স্বপ্নের দ্রষ্টা ছিলেন মুজিব। তিনি সকল বাঙালিকে বাঙালির সােনালি স্বপ্ন ভাগ করেনিতে শিখিয়েছিলেন। মুজিবের সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্য দূরীকরণের উপযােগী দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সমৃদ্ধি ও সুখের স্বপ্নভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু একই সময়ে পাকিস্তানি সেনাদল যে যুদ্ধশিশুদের পিতৃত্বের জন্য দায়ী, সমাজ ঐ মানবগােষ্ঠীকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে এবং তার ব্যবস্থাপনা কী হবে সেদিকেও সরকারের আন্তরিক নজর ছিল ।
যুদ্ধশিশুদের জন্ম ইতিহাসে যে গভীর সামাজিক কলঙ্কের দাগ লেগে রয়েছে, তাতে ঐ শিশুদের বাংলাদেশে গ্রহণযােগ্যতা বাড়ানাে অথবা দত্তক নেয়া একরকম অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল । উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় যেমনটি হয়, তার বিপরীতে বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে অনাথ শিশুদের লালনপালনের দায়িত্ব শিশুর বর্ধিত পরিবারের ওপর পড়ে, আরও বেশি যেটা ঘটে, সেটা হলাে কারাে ব্যক্তিগত দয়া বা দাক্ষিণ্যের ওপর এরকম এতিম শিশুর দেখভালের দায় পড়ে । শেখ মুজিব ব্যক্তিগতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, দেশ তখন নতুন মাটিতে পা রেখেছে, মােকাবিলা করছে অত্যন্ত গভীরভাবে প্রােথিত এক সামাজিক ইস্যুর।
শুরু থেকেই ব্যাপকভাবে যুদ্ধশিশুদের পরিত্যাগ সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। যে হারে যুদ্ধশিশুরা জন্ম নিচ্ছিল নানা মাতৃ সদনে, শহরে বন্দরে বিলে-কারে তার কোনাে হিসেবই কারাে কাছে ছিল না। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে যেমন শিশুর জন্ম ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কিন্তু বর্তমানের যুদ্ধশিশুদের বেলায় তাদের জন্মদাতা বাবাদের অনুপস্থিতিতে তাদের গ্রহণযােগ্যতা সামাজিকভাবে ছিল না বললেই চলে। এমতাবস্থায় তাদের জন্মদাত্রী মায়েরাও অনীতি শিশুদের পরিত্যাগের মাধ্যমে তাদের নিজেদেরকে জঞ্জালমুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
বলা যায় সরকার সহানুভূতির সাথেই জন্মদাত্রী মায়েদের সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত পােষণ করেন । জন্মদাত্রী মায়েদের অবস্থা বুঝতে সরকারের কোনাে কষ্টই হয়নি। ধর্ষিত নারীরা সমাজে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্তা হবেন কোনােরকম কাজ করার সুযােগ পাবে না, বিবাহ, শিক্ষা, সংসার, রুটি-রুজি তার নাগালের বাইরে চলে যাবে, এ বিষয়ে সরকার সচেতন ছিলেন যে জীবনের সকল সুযােগ সুবিধা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। বাস্তবিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, সরকার এ শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন। অভিজ্ঞতার আলােকে সরকার ধরে নিয়েছিলেন যে সমাজের দৃষ্টিতে শিশু ও তার মা দুজনই অবহেলিত হবেন। এ কথা বলা নিষ্প্রয়ােজন যে বাংলাদেশে তাদের জন্মকে ঘিরে যে “লজ্জা” বা কলঙ্ক, সে কলঙ্কের কারণেই তাদের এড়িয়ে চলবে ভবিষ্যতের সমাজ । সরকার তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে এ বিষয়ে যে ব্যবস্থা নেয়া হােক না কেন সেটা জন্মদাত্রী মা এবং যুদ্ধশিশু সকলের মঙ্গলের জন্যই হতে হবে। সার্বিক সামাজিক সেবা কর্মসূচির আওতাধীন এটা বুঝে সরকার তার কর্মসূচীর নীল-নকশা তৈরি করেন। এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না যে মুজিব এবং তার মন্ত্রীসভার সদস্যরা একান্তভাবে আশা করেছিলেন যে তাদের প্রস্তাবিত পদক্ষেপকে যুদ্ধশিশুদের মঙ্গলের লক্ষ্যে একগুচ্ছ সমম্বিত কর্মসূচির অংশ হিসাবে মূল্যায়ন করা হবে। নচেৎ যুদ্ধশিশুরা খাঁচায় পােষা পাখির মতাে অর্ধবাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থেকে সমাজের ভ্রু কুঁচকানি সহ্য করবে শুধু।
বাংলাদেশে দত্তক প্রথা
শুরু থেকেই সরকার এ বিষয়ে দুঃখজনকভাবে সচেতন ছিলেন যে হাজার হাজার শিশু পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক অধিকৃত পুর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নারীদের ধর্ষণের ফলে অক্টোবর ১৯৭১ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৭২ পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করে। সরকার দৃঢ়ভাবে মতপ্রকাশ করেন যে, নবজাতকেরা বাঁচার, সুরক্ষা পাবার ও সকল ধরনের উন্নয়নের অংশীদার হবার অধিকারী। সমস্যাটা এত ঘােরালাে হয়ে দাঁড়ায় যে, জনগণের এ বিষয়ক মূল্যবােধের পরস্পর বিরােধী মতামত ও ব্যাখ্যা খােলাখুলি আলােচনা হতে থাকে । আমরা (প্রথম অধ্যায়ে) লক্ষ্য করেছি যুদ্ধশিশুরা কী ধরনের অবমাননাকর পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছে। সেখানে বহু শিশুর মৃত্যুও ঘটে জন্মের সাথে সাথেই । দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল যার উত্তর কেউ দেয়নি: যুদ্ধশিশুদের প্রয়ােজনীয় নিরাপদ আশ্রয় পাবার উপায় কী? নতুন দেশের উদার সমাজে সরকার নিজস্ব জবাবদিহিতার জায়গা খুজবে। কোথায়? সরকারি তথ্য ও পর্যালােচনা অনুযায়ী সরকার মােটামুটিভাবে অবহিত ছিলেন যে, প্রগতিশীল মানুষের মনে দত্তক নেয়া সম্পর্কে ভাবনার পরিবর্তন ঘটছিল এবং তা নানাভাবে লক্ষণীয় ছিল। কিন্তু তা হলেও মােটের ওপর দেশের বেশিরভাগ মানুষ সে বিষয়ে নতুন কিছু ভাবেননি।
সরকারের অভিমত ছিল যে, দত্তক নেয়ার মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিয়ে দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং দত্তক সমর্থনীয় দলের সাথে সংলাপের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়াটাই শ্রেয় হবে। মুজিব মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য বলেন যে আরও স্পর্শকাতর ভাষায় জনগণকে পুনরায় এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। সাধারণভাবে বললে, সরকার দেশের অভ্যন্তরে ও একদেশ থেকে অন্য দেশে দত্তকের বিষয়ে জানতেন যে অনেক সময়ে আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক দত্তক দেয়া নেয়া হয় ।
সমাজের নানা কূপমুন্ডুকতার জন্য সরকার মােটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিলেন যে যুদ্ধশিশুদের জন্মকে ঘিরে যেহেতু সমাজ চুক্তির বাস্তবতা বর্তমান, এটা সম্ভব যে সকল লােকালয় ও জনগােষ্ঠীতেই তারা অনাহুত হবে, তাদের নিয়ে কথা উঠবে। বিদেশে দত্তক নেবার বিষয়টিও স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু সরকারের জানা ছিল এ প্রস্তাবনার উপরেও সানন্দ জনসমর্থন ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য উভয়ই আসবে। এর বিকল্প হিসেবে সরকার পরামর্শ এবং উপদেশের জন্য উচ্চ পর্যায়ের গণযােগাযােগ প্রয়াস চালিয়ে যাবার পক্ষে দৃঢ়মত পােষণ করেন।
কিন্তু দেখা গেল, সে সংকটময় সময়ে বিষয়টি যেন আরও ঘােলাটে হয়ে যায় । উত্তর পাওয়া যায়নি এমন অনেক কটি প্রশ্নের মাঝে দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক নেবার প্রশ্নটি এমন সময়ে উঠে আসে যে, তখন জনসাধারণ আশা করছিলেন সরকার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইস্যুটিকে অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন। অনেকে তখন অবশ্য নিজ নিজ মতামত দিয়ে এ বিষয়ে জবাব দিয়েছিলেন।
শুরু থেকে সরকার উপলব্ধি করেছিলেন যে, দত্তক সংক্রান্তে দেশের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিষয়টির তাৎপর্য ও জটিলতা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা উচিত। কার্যকর সমাধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য মনে রাখতে হবে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার ইস্যুটিতে যে জারজত্বের কালিমা লেপন করা হয়েছিল সে মন-মানসিকতা বাস্তবিকপক্ষে কতটুকু বদলানাে সম্ভব। একই সময়ে শিশুদের জরুরি প্রয়ােজন মেটানাের জন্য সরকারকে বিকল্প পথ
অবলম্বন করে দ্রুততার সাথে কাজ করতে হয়েছে। বিষয়টিকে উচ্চ প্রাধিকার দিয়ে মুজিব সরকার জেনেভাস্থ International Social Service (ISS)-কে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরােধ করেন যাতে আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক নেবার ব্যবস্থা বিষয়ে উপদেশ ও সুপারিশ ব্যক্ত করেন। ফলে এটি একটি মধ্যস্থতাকারী সংস্থা হিসাবে বিবেচিত হয় যারা বিভিন্ন দেশের হােম রিপাের্ট এবং ফলাে-আপ প্রতিবেদন, অনুরােধ সাপেক্ষে সরবরাহ করে থাকেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে সরকার এ বিষয়ে যথাসাধ্য সম্ভব বিজ্ঞাপন দেয়া বা আগ্রাসী প্রচারণা থেকে বিরত থাকেন। এর বিকল্প উপায় হিসেবে সরকার শান্তভাবে বিষয়টি নিয়ে ISS-এর সঙ্গে কাজ শুরু করেন, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ISS-এর সদর দপ্তর, সারা বিশ্বে এর শাখা-প্রশাখা ছড়ানাে। এ সংস্থার বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টামন্ডলী বিভিন্ন সরকারের অনুরােধে দুদেশের অভ্যন্তরে অনুসন্ধান ও অন্যান্য সেবা প্রদানের কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশ সরকার যখন ISS-এর পরামর্শ চান তখন বলতে গেলে সরকারের কাছে যুদ্ধশিশুদের জন্মানাের কোনাে নথি ছিল না (শুধুমাত্র শিশু ভবনের নথি ছাড়া)। এরকম চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সব কিছুই এত গােপনীয়তার সাথে ঘটছিল যে কেবল দুচারটে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জন্মদাত্রী মা অথবা তাদের পরিবারের কাছে পৌছাতে চেষ্টা করেছিলেন। এদিকে সরকার পুরােপুরিভাবে অবগত ছিলেন যে, যুদ্ধশিশুদের বিষয়টি নিয়ে কাজ করা আর তুষারের ওপর স্কেটিং করা একই রকম বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিষয়টির স্পর্শকাতরতার জন্য এবং জনগণের চিন্তাভাবনার কথাও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে । আদর্শগতভাবে শেখ মুজিব অন্তর্ভুক্তিকরণের পক্ষে সকলের অংশগ্রহণের সমতায় বিশ্বাস করতেন এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন নারী-পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধান মুখপাত্র। একইসাথে সরকারের সংশয় ছিল যে যুদ্ধশিশু ও দত্তক নেয়া-দেয়ার মতাে সংবেদনশীল বিষয়টি নিয়ে খােলামেলা আলােচনা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। বরং সংলাপ দীর্ঘায়িত হবে। সরকার তার দত্তক প্রক্রিয়া বিষয়ে জনগােষ্ঠীকে উৎসাহ দেয়া অথবা কোনাে ব্যাখ্যা দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না।
সরকার আশা করেছিলেন যে বিষয়টি কৌশল ও কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে একবারে সুসম্পন্ন করা সম্ভভ হবে। বহুধাবিভক্ত জনগণের ধারণা এতই পরস্পরবিরােধী ছিল যে, সরকার পরিস্থিতির জটিলতা জ্ঞানগােচরে আনার জন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞদের নিযুক্ত করে বিষয়টির সমাধান খােজার চেষ্টা করেন। সরকারকে জানানাে হয়েছিল যে, এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও সমর্থনকারী সংস্থাগুলাের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক পরামর্শসভা অনুষ্ঠান অপরিহার্য। ব্যক্তিগতভাবে মুজিব এমন এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছিলেন “যা শিশুর সবচেয়ে ভালাের জন্য হবে। সরকার প্রথমে শিশুদের জন্য যে আইন রয়েছে, সেটা পরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন যে দত্তক বিষয়ে আরও আলােচনার প্রয়ােজন। বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও কিছু গবেষণা করে মুজিব প্রশাসন বুঝতে পারেন, সম্মুখে যে রাস্তা, সেটা দীর্ঘ এবং বিপদসঙ্কুল। তিনি তার সৎসংকল্প বিষয়ে রসিকতা করে বলেন, তিনি কেবল talk করবেন না। মন্ত্রিসভায় মুজিব দত্তক ফাইলের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদেরকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন যে, আন্তর্জাতিকভাবে শুধু মুখে বড় বড় বুলি আওড়ালে চলবে।
না। যাদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তারা অবশ্যই যার যার দায়িত্ব মােচনে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবেন – শুধু কথায় ফুলঝুরিতে কাজ হবে না। মুজিব নিজে ছিলেন talk কে (অর্থাৎ যে কথাবার্তা আলােচনা হচ্ছে সেগুলােকে) walk করার বিষয়ে (অর্থাৎ প্রস্তাবিত কার্যাদি বাস্তবায়নের জন্য) বদ্ধপরিকর। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে শ্রম মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং আইন ও পার্লামেন্টারি এফেয়ার্স মন্ত্রণালয় যুদ্ধশিশুদের ছুঁয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যেসব কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণী উপস্থাপন করেন। বিষয়টির স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে সরকার বুঝে নেন, ওই বিবরণীতে কোনাে রূপপার বুলেট নেই। অর্থাৎ এ জটিল সমস্যার কোনাে দ্রুত সমাধান নেই। সরকার মত পােষণ করনে যে, “অভিভাবকত্ব পালনে যত্ন, সুরক্ষা এবং দত্তক প্রক্রিয়ার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার বিশেষ প্রয়ােজন রয়েছে। উপদেশ পরামর্শ নেবারকালে সরকার যেসব দেশে এ শিশুদের দত্তক নেয়া হবে, বাংলাদেশ থেকে সে দেশে শিশুদের ভ্রমণ ও সুরক্ষা প্রচলিত আইনি ও সামাজিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে আরও নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। সে সময়ে সরকার মােটেই স্বস্তিতে ছিলেন না, একইসাথে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় ছিলেন যাতে নিজের দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জড়িয়ে প্রকল্পের সলিল সমাধি না ঘটে । সরকারের তখন প্রয়ােজন সর্বাগ্রে সে বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞ পরামর্শ ও উপদেশ যারা আন্তর্জাতিক দত্তক প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়া। কারণ বিষয়টি ভাবাবেগতাড়িত স্পর্শকাতর বিষয় । মােট কথা, শিশুদের মঙ্গল ও যত্নকারী অগণিত প্রতিষ্ঠান এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের এখান থেকে ওখান পর্যন্ত বিস্তৃত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলির সহযােগিতা নিশ্চিত করার দরকার ছিল যাতে প্রয়াস সর্বসমন্বিত হয়।
যে তিনজন বিদেশি সংস্থার বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি পরিস্থিতি বুঝতে ঢাকায় এসেছিলেন তারা হলেন ওয়েলস সি ক্লাইন, তদানীন্তন জেনারেল ডিরেক্টর, আই এস এস সিডনি টালিসমেন, তদানীন্তন এসােসিয়েট ডিরেক্টর ISS এবং ম্যারি ডি লেভিন, ISS-এর জেনেভাস্থ উপদেষ্টা। ISs-এর সঙ্গে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পরামর্শ প্রদান ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে যে দুটি স্থানীয় বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করেছিল সেগুলি হলাে; ঢাকায় অবস্থিত Bangladesh Central Organazation for Women’s Rehabilitation (যাকে এক কথায় ‘দ্য বাের্ড বলা হতাে) এবং Bangladesh Family Planing Association. বাংলাদেশে ISS-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, শিশুর সুরক্ষা, অভিভাবকত্ব এবং নিরাপদ দত্তক প্রক্রিয়া বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষায়িত সেবাসমূহ প্রদান করা । উপদেষ্টা কমিটির প্রধান ক্লাইন এর উপরে দায়িত্ব ছিল পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা । বেশি গভীরে না গিয়েই ক্লাইন বুঝতে পেরেছিলেন, কেন বাংলাদেশিরা কখনাে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারবে না। যেহেতু এখানে ধরাবাঁধা পুরনাে বিশ্বাস ও কলঙ্ক লেপন করার ঐতিহ্য কাজ করেছে। লােকে কানাকানি করছিল, এ শিশুরা যেহেতু বারবার ধর্ষণের প্রক্রিয়ায় মায়ের গর্ভে স্থান পেয়েছে, বৃহত্তর দেশ ও সমাজে এদের গ্রহণযােগ্যতা নেই।
লেভিনের দায়িত্ব ছিল সরকারের সঙ্গে কর্ম সমন্বয় করা। উপদেষ্টারা যেসব ব্যবস্থা চালু করছিলেন, সরকার সেগুলির বাস্তবায়ন যাতে অনায়াসে করতে সমর্থ হন, লেভিনের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে সেটার নিশ্চয়তা বিধানও ছিল। নতুন ব্যবস্থাদি আন্তর্জাতিক দত্তক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, সেটা দেখার দায়িত্বও লেভিনেরই ছিল । ISS প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট আর্থিক বরাদ্দ পাচ্ছে কিনা এটা দেখাও তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেখা গেল প্রায় সাথে সাথে The Church World Service অবিলম্বে প্রকল্পের কাজ শুরু করার জন্য ৫০,০০০ ডলার প্রদান করেন। কিন্তু আমরা জানতে পারব কেমন করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন আরম্ভ হলে, উপদেষ্টাবৃন্দ একসঙ্গে বহু সমস্যার মুখােমুখি হয়েছিলেন; এবং কীভাবে সেসব সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারের জ্ঞানগােচরে আসে আরেকটি ভয়ানক সমস্যার কথা । শিশু ছিনতাইকারীরা ইতােমধ্যে যে বিস্তর অর্থ লুটপাটের উদ্দেশ্যে মাঠে নেমেছে এবং তারা তাদের পছন্দমতাে সুযােগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে আছে। শুরুর দিকে, উচ্চপদস্থ আমলা। যারা শিশুদের দত্তক প্রক্রিয়ার ফাইলের দায়িত্বে ছিলেন, ভাবেননি যে শিশু পাচার তাদের জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দেবে । শীঘ্রই দেখা গেল, এবিষয়ে বেশ ভুল বােঝাবুঝি ও ভুল তথ্য নেয়া দেয়া হয়েছে। ভুল বােঝাবুঝির যেখান থেকে শুরু সেটা হলাে: সরকার যেখানে কেবল যুদ্ধশিশুদের (পাকিস্তানি সৈন্যদের ধর্ষণে যে শিশুরা মায়ের গর্ভে এসেছিল) সরিয়ে দেবার বিষয়ে বিবেচনা করছিলেন; মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বশীল আধিকারিক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে বহুসংখ্যক বেশি বয়সী অনাথ শিশুদের তাদের বিবেচনায় আনেন। কারণ তারাও পরিত্যক্ত এ অর্থে যে তাদের অভিভাবুক তাদের পরিত্যাগ করেছে।
জেনেভাভিত্তিক আই এস এস-এর আমেরিকান শাখা এবং Holt International Agency কর্মীবৃন্দের দ্বারা চিহ্নিত ইস্যুটি আব্দুর রব চৌধুরী, তদানীন্তন কো-অর্ডিনেটর এবং আব্দুল ওয়াহেদ, নির্বাহী সচিব, Bangladesh Women’s Rehabilitation Programe-এর মনােযােগ আকর্ষণের জন্য বিষয়টি উত্থাপন করা হয় ঢাকায় কর্মরত কানাডীয় দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কর্মরত সমাজকর্মী জেরিনা রশীদ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ লেভিনের চিঠির মাধ্যমে । লেভিন লিখেছিলেন, “আউয়াল সাহেব বিশ্বাস করেননি যে এরকম ঘটছে এবং যদিও আমরা তাগিদ দিয়েছিলাম যে পাসপাের্ট ইস্যু করা পর্যায়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করা। হােক, তিনি কেবল গড়িমসি করেন।
যখন বিদেশি সংস্থাসমূহ বেবি হােম থেকে যুদ্ধশিশু না হলেও একটু বেশি বয়সের শিশুদের দত্তক নেবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাদের আউয়াল সাহেব বলেছিলেন, কেবল পাকিস্তানি পিতা যাদের, সেসব শিশুদের অনুমােদন দেয়া হয়েছে। সে সময়ে দেখা গেল ১৯৭২-এর গ্রীষ্মকালের প্রথমদিকে লােভী শিশু ছিনতাইকারীরা বিশ্বের নানা দেশ থেকে বাংলাদেশে আসতে থাকে। দলে দলে, যুদ্ধশিশুদের নামে তারা বেশি বয়সের অন্যান্য অনাথ শিশুদের তৃতীয় পার্টি দালালের মাধ্যমে নিয়ে যেতে থাকে। লেভিন সাথে সাথে সরকারকে এ ব্যাপারে সাবধান করেছিলেন এটা বলে যে “বিভিন্ন দত্তক প্রতিষ্ঠান যে বিপুল হারে দেশ থেকে শিশুদের নিয়ে যেতে থাকেন, সেটা থামানাে মুশকিল হয়ে পড়েছিল। যেসব কর্মকর্তা।
সহায়তা করতে চেয়েছিলেন, শীঘ্রই দেখলেন, তারা যেরকমটি ভেবেছিলেন, ব্যাপারটা তার চেয়েও বেশি জটিল হয়ে গিয়েছে। ঐ ইস্যুতে কাজ করতে গিয়ে, সরকার তার দেশবাসীকে কঠোর ভাষায় জানান যে। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কোনাে প্রবঞ্চনা চলবে না। সাথে সাথে ঠকবাজি করে শিশুদের দেশের অভ্যন্তরে অথবা বর্ডার পেরিয়ে বাইরে শিশু পাচার, বিক্রি, ক্রয় ইত্যাদি বাণিজ্যিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হলাে। দুঃখজনক হলেও সরকার অবগত ছিলেন যে, যুদ্ধশিশুদের বিরুদ্ধে যে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তাদের যে কখনাে কোথাও সাদরে অভ্যর্থনা জানানাে হয়নি।
এমতাবস্থায় সরকারের অভিমত ছিল যে দেশের বাইরে কোথাও এই যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিলে তাদের জন্য সেরা পছন্দের ব্যাপার হবে। তারা যে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হবেন সেসব সমস্যাগুলাে হয়তাে বিদেশে দত্তাকয়নের মাধ্যমে সমাধান হবে। জারজ সন্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে সামাজিক কলঙ্কের ধারণা কাজ করে, সে কারণে। ISS কর্মীরা প্রস্তাবিত কর্মসূচির জন্য ব্যাপক প্রচারণার কথা বলতে সঙ্কোচবােধ করেছে। ISS ১৯৭২ সালের ২৭ মার্চ তারিখে Inter-Country Adoption- a Solution for some Children in Bangladesh শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ রিপাের্টে বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুরা কেন “অবাঞ্ছিত” এবং তাদের মায়েরা কেন তাদের চাননি ক্লাইন সে কারণগুলি চিহ্নিত করেন। লক্ষণীয় যে, ধর্ষিত নারীদের গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম, যুদ্ধশিশুদের মায়েদের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়া এবং বাংলাদেশে ঐ শিশুদের অসহায়তা ইত্যাকার ঘটনাবলির সঙ্গে ক্লাইনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা তাকে একটি মানবিক অবস্থান থেকে ব্যাপকতর ও বাস্তবিক আবেদন নিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য ছিল: ঐ শিশুদের মধ্যে অন্তত কয়েকজনের জন্য দত্তক নেয়ার ব্যাপারটা কার্যকর হলে তারা প্রাণে বাঁচত। বাংলাদেশিদের চোখে যাদের সকলেই জারজত্বে কলঙ্কিত, কাজেই তারা অগ্রহণযােগ্য।
এখন আমরা লক্ষ্য করব, ISS-এর মতামতসমূহের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে প্রথম মন্তব্যটি ছিল: “ধর্ষণ এবং বিবাহবহির্ভূত জন্মানাে ছেলেমেয়ে যে কোনাে সমাজে স্পর্শকাতর বিষয়। একজন বহিরাগত হিসাবে আমার পক্ষে বলা কঠিন, দত্তক নেয়ার বিষয়টাকে বিজ্ঞাপিত করার কী পন্থা থাকতে পারে। এটা অবশ্যই অপরিহার্য যে শিশুদের মায়েরা এবং তাদের পরিবার জানবে যে সরকার বিষয়টি নিয়ে ভাবিত, বিঘ্ন, উদ্বিগ্ন ও যত্নশীল এবং শিশুদের জন্য পরিবার খুঁজে দেবে, নচেৎ এর কোনাে প্রকৃত বিকল্প থাকে না। প্রতিবেদনের গোড়ার দিকে ক্লাইন যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার প্রয়ােজন বিষয়ে বলেছেন, যুদ্ধশিশুরা “দুর্ভাগা এবং “অবাঞ্ছিত শিশু”। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে বাংলাদেশে প্রচলিত ধর্মীয় – সামাজিক মূল্যবােধের আলােকে ISs আন্তর্জাতিক দত্তক প্রক্রিয়াকে একটি কার্যকরি বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে সুপারিশ করেন। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ISS আন্তজাতিক দত্তক ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্যপ্রদ এবং দূরদর্শী বিকল্প ব্যবস্থাপনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন: “দখলদারিত্ব ও যুদ্ধের পর, এমনকি যে জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে আজ বাংলাদেশ চলেছে, সম্পদ যেখানে অপ্রতুল, আন্তর্জাতিক দত্তক প্রক্রিয়া অনাথ অথবা পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য, এমনকি দুস্থ বাঙালি নারীর সন্তানদের জন্যও স্পষ্টত সর্বোত্তম প্রাপ্তব্য বিকল্প ব্যবস্থা। বহুদিন যাবৎ আন্তজাতিক দত্তক ব্যবস্থা নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ক্লাইন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে এ কথাও বলেন যে, তার এত বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রক্রিয়া “অত্যন্ত সফল হয়েছে” যখন “যথােপযুক্ত সাবধানতার সঙ্গে পেশাদারিত্বের দক্ষতায় সম্পন্ন করা হয়েছে।” এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায়, ক্লাইন তার সুপারিশ প্রণয়নে প্রয়ােজনীয় সাবধানতা ও দৃঢ়তা অবলম্বন করেন: “শিশুর যত্নের জন্য স্থানীয় ও জাতীয় ব্যবস্থাদি গড়ে তােলার বিকল্প আন্তর্জাতিক দত্তক ব্যবস্থা নয়, একথা মনে রাখতে হবে। এটি একটি বিকল্প বটে, যেটা শিশুর লালন-পালনের অন্যান্য উপায়ের কোনােটি যখন পাওয়া যাবে না, তখন কাজে লাগাতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এপর্যন্ত হাজার হাজার পিতৃমাতৃহীন অথবা পরিত্যক্ত শিশু এবং জারজত্বের কলঙ্কলিপ্ত শিশু এবং মিশ্র মা-বাবার সন্তান নিজের দেশ ও সমাজের বাইরে অন্যান্য আশ্রয় ও পরিবার খুঁজে পেয়েছে।” যুদ্ধশিশুদের তাৎক্ষণিকভাবে দত্তক নেবার সুপারিশ করে ISS বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা করার পক্ষে তাগিদ দিয়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন: “বিলম্বে গর্ভমাচন এবং জীবননাশের বাস্তবমুখী বিকল্প যদি আন্তর্দেশিক দত্তক ব্যবস্থা হয়, তাহলে বাঙালি নারী ও তাদের সন্তানের রক্ষাকল্পে একটি তাত্ত্বিক বিকল্পকে বাস্তব সমাধানের রূপ দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে উঠে পড়ে লাগতে হবে, এবং সমাজ কল্যাণ পরিদপ্তরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির সহযােগিতার একটি জরুরি কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিতে হবে। এতে আরও সুপারিশ করা হয়, “এটা শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে, শিশুদের তাদের মায়েদের কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে সরিয়ে নিতে হবে, যাতে মা এবং তার পরিবারের ওপর অপ্রয়ােজনীয় চাপ না পড়ে।”
প্রতিবেদনটির শেষে সুপারিশ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেয়ার সকল প্রচেষ্টা নিম্নলিখিত শর্ত মােতাবেক করা হােকঃ ১. কেবলমাত্র যােগ্য ও অভিজ্ঞ সামাজিক সংস্থাসমূহ বাংলাদেশ থেকে শিশুদের নিয়ে বিদেশে দত্তকগ্রাহী দম্পতিদের বাড়িতে পৌছে দেবার ক্ষমতার অধিকারী হবেন। | ২. শিশুর প্রাক-দত্তক যত্ন আদর ও দত্তক প্রক্রিয়া সম্পাদনের দায়িত্ব অন্যদের ওপরে ন্যস্ত থাকলেও বাংলাদেশ সরকার ঐ শিশুদের সংবিধিবদ্ধ অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবেন। ৩. দত্তক প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব একটি মাত্র সরকারি অথবা ক্ষমতা প্রাপ্ত সংস্থার ওপর ন্যস্ত থাকবে; সংস্থার দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে:
ক) আন্তর্দেশিক দত্তক প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট শিশুদের যােগ্যতা নির্ধারণ; খ) শিশুদের প্রাক-দত্তক যত্ন নেয়া; গ) বাংলাদেশ থেকে শিশুদের দত্তক দেবার জন্য আন্তর্দেশিক অথবা অন্যতর সংস্থাকে ক্ষমতা প্রদান;
ঘ) অভিবাসনের দেশের জন্য প্রয়ােজনীয় দত্তক প্রক্রিয়া সংক্রান্ত কাগজপত্র, জন্ম বিষয়ক নথিপত্র, দত্তকের জন্য ছাড়পত্র, পাসপাের্ট, ভ্রমণের টিকিট ইত্যাদি তৈরি বা যােগাড় করা।
সরকারের অধীনে প্রস্তাবিত আন্তর্দেশিক দত্তক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়ােজনীয় অবকাঠামাে গড়ে তােলার বিষয়েও ISS গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। আন্তর্দেশিক দত্তক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত পাঁচটি প্রধান এলাকায় সংস্থা তার পরামর্শগুলিকে বিন্যস্ত করেঃ (১) প্রশাসন; (২) কর্ম পরিচালনাকালে যা প্রয়ােজন হবে; (৩) জনগণকে তথ্য জ্ঞাপনের কার্যক্রম; (৪) অভ্যর্থনা ও প্রাক-দত্তক যত্ন কেন্দ্র স্থাপন; (৫) কর্মপ্রক্রিয়া ও দত্তক রীতিনীতি। প্রশংসনীয় বিষয় যে, চূড়ান্ত পরামর্শসমূহ পাবার পর সরকার সেগুলির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করেন এবং সরকারের প্রশাসন ঐকমত্যে পৌছানাের লক্ষ্যে আরেক দফা আলােচনা করেন। বাস্তবিকই সরকার এক উভয় সঙ্কটে পড়েছিলেন। একদিকে শেখ মুজিবের সামাজিক সাম্যের আহবান বাস্তব পরিস্থিতির সাথে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক, তাই তেমন অভ্যর্থনা পায়নি। অন্যদিকে উদ্বিগ্ন প্রশাসন বেশ আশংকার সাথে এগােচ্ছিল এরকম ভেবে যে, জনগণের জন্য অতি বৈপ্লবিক অর্থাৎ আমূল সংস্কারের কর্মসূচি হাতে তুরে নিলে সেটা হয়তাে রাজনৈতিক বিস্ফোরণ হিসাবে গ্রাহ্য হবে। তাই হিতে বিপরীত হবে ভেবে সরকার আরও সাবধানতা অবলম্বন করে সামনে এগােনাের চেষ্টা করেন। কী করা উচিত” বা কী “না করা উচিত” ইত্যাদি বিষয়ে অযাচিত উপদেশ দিয়ে জনগণের মনে সরকারকে সদাশয় স্বৈরাচারী হিসাবে দেখার সুযােগ কখনাে দিতে চাননি। মােটকথা নতুন প্রকল্প হাতে নিলেও সরকার কোনাে অবস্থাতেই নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাননি। কয়েকদিন যাবত আলাপ আলােচনার পর শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে সুপরিশমালায় তার অনুমােদন দিয়েছিলেন, যদিও তিনি জানতেন যে, যারা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই। আন্তর্জাতিক দত্তকের বিরােধিতা করেছিলেন।
ISs-এর সুপারিশমালার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, সরকার অভ্যর্থনা ও প্রাক-দত্তক যত্ন কেন্দ্রের সেবাসমূহ যখন বিজ্ঞাপিত করতে যায় তখন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হােন। মজার ব্যপার, সেবা সদন, শিশু ভবন, নারী পুনর্বাসন বাের্ড এবং বেবি হােমস-এ কর্মরত সমাজকর্মীরা প্রায়ই তাদের কর্মস্থলে অনাহূত অতিথির দেখা পান।
যুদ্ধশিশুদের অবহেলার চোখে দেখলেও তাদের কথা লােকমুখে শুনে দর্শনার্থীরা ওখানে শিশুদের এক নজর দেখবার জন্য ভিড় করতেন। সরকারের স্পষ্ট ধারণা ছিল যে, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যুদ্ধশিশু ও তাদের জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি দুঃখজনকভাবে নেতিবাচক, যেটা সমাজের মনােভাবের প্রতিফলন। সে দৃষ্টিকোণ নিয়ে বাংলাদেশিরা নির্যাতনের শিকার জন্মদাত্রী মা ও যুদ্ধশিশুদের দেখেছে তাতে তারা শুধু নিগৃহীত হয়েছে। কাজেই এসব অবাঞ্চিত শিশুরা কোনাে অবস্থাতেই গ্রহণযােগ্য ছিল না। অনেক চিন্তাভাবনা ও আলােচনার পর সরকার শেষ পর্যন্ত এ স্বিদ্ধান্তে উপনিত হলেন যে, পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের বাঁচার মতাে মৌলিক অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশিরা তাদেরকে অকাম্য বা অনীতি বলে সরকার গণ্য করলেও এই শিশুদের দায়িত্বভার নিয়ে তাদেরকে
উপযােগী বাড়িতে দত্তকের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা ছিল মূল লক্ষ্য। সেটা করতে গিয়ে যদি বাংলাদেশের বাইরে তাদেরকে দত্তক দিতে হয় সে ব্যবস্থা করতে সরকার সম্মত হবেন। তার মূল কারণ এই শিশুদের সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন ছিল একটি নিরাপদ বাড়ি যেখানে তারা দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবার আদর স্নেহে লালিত পালিত হবে।
Iss-এর সুপারিশ অনুসারে আন্তর্দেশিক দত্তকের জন্য অনুমােদন পাওয়ার সাথে সাথে সরকার প্রয়ােজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আন্তর্দেশিক দত্তক প্রক্রিয়ার আইন কানুন তৈরির দায়িত্ব শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজ কল্যাণ ডিরেক্টরেটকে দেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় । সমাজ কল্যাণ পরিদপ্তরের অধিকার থাকবে শুরু থেকে আন্তর্দেশিক দত্তক প্রক্রিয়ার পুরােটা সমম্বয় ও বাস্তবায়ন করার, যেমন, শিশুর নথি তৈরি করা, আন্তর্জাতিক সংস্থা বাছাই, দত্তকের জন্য শিশুটিকে বাংলাদেশ ত্যাগের অনুমতি প্রদান ইত্যাদি। এ প্রক্রিয়াটিতে সরকারের একটি সুবিধা ছিল যে, চারটি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দত্তক প্রক্রিয়া বিষয়ে অংশীদারিত্বমূলক কাজের সম্পর্ক ছিল ১, শ্রম ও সমাজ কল্যাণ ২. ত্রাণ ও পুনর্বাসন ৩, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা এবং ৪, আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ের প্রতিনিধিদের সাথে আলাদা আলাদা এবং যৌথভাবে কাজ করেন।
কালক্ষেপণ না করে যাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল, তারা যখন সামনে এগিয়ে এলাে, তারা একঝাক প্রশ্নের সম্মুখীন হােন। ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, সামাজিক বাস্তবতাবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুজিব এ বিষয়ে নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। তার মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন; দত্তক প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রণ করা হবে কীভাবে? জন্মদাত্রী মায়েরা নবজাতকদের ছেড়ে দেবার ব্যাপারটা কীভাবে নেবেন? তার ফলাফল কী দাঁড়াবে? সরকারকে বলা হয়েছিল | যে, শিশুদের দত্তকগ্রাহী মা-বাবার নিকট হস্তান্তর চূড়ান্ত করতে সর্বপ্রথমে যা করতে হবে, সেটা হলাে এ বিষয়ক একটি নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা; অর্ডিন্যান্সটি যথাশীঘ্রই জারি করা। একটি আইনি নির্মাণ কাঠামাের প্রয়ােজন হবে যার সাহায্যে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়া আইনসম্মত করা হবে। একবার দত্তকায়নের উদ্দেশ্যে এই শিশুদের পরিত্যক্ত শিশু হিসাবে গণ্য করা হলে স্বাভাবিকভাবে সরকারকে আইনগতভাবে তাদের অভিভাবক হিসাবে গণ্য করা হবে। পিতৃমাতৃহীন শিশুদের আর কখনাে “পরিত্যক্ত শিশু” বলা হবে না। সরকার শুরু। থেকেই অবগত ছিলেন যে, এ বিষয়ক আইন তৈরির প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করতে হবে।
যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে আইনি উদ্যোগ (Bangladesh Abandoned Children (Special Provision) Order, 1972) পরিত্যক্ত শিশুদের আইন প্রণয়নটি এত জটিল যে, সরকার ঠিক সে মুহূর্তে স্পষ্ট সমাধানের জন্য নির্দিষ্টভাবে যে, আইনের প্রয়ােজন ছিল ঠিক সেটা প্রস্তুত করে কাজে লাগাতে পারেননি। ১৯৭২-এর মার্চ এবং অক্টোবরের মধ্যে নীতি-নির্ধারক এবং আইন প্রণেতাগণ অসংখ্যবার একত্রিত হয়ে বাংলাদেশিদের দৃষ্টিতে বিদেশি দত্তক প্রক্রিয়ার বিচার, যুদ্ধশিশু এবং সাধারণ অনাথ শিশুর সীমিত সুযােগ-সুবিধার আলােকে নানারকম ঝুঁকির প্রবণতা পরীক্ষা করেন।
বাংলাদেশে প্রয়ােজনীয় পরিবর্তন আইনসম্মতভাবে আনয়নের নিরিখে সকলেই মােটামুটি একই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বা ওয়েভ লেংথে ছিলেন। মন্ত্রিসভার সদস্যদের বলা হয়েছিল তারা তাদের প্রয়ােজনমতাে সময় নিতে পারেন; যারা আইন প্রণয়ন করবেন, তাদের বলা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে এবং আইন তৈরির কাজে পেছনে বেশি না তাকিয়ে আগাম ভাবনাকে প্রাধিকার দিতে। তখন উপর থেকে নিচে কথা ভেসে আসে নানা রকম: আইনটি লেখার কাজ যাদেরকে দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে পুরােপুরিভাবে এ কাজে মনােনিবেশ করার নির্দেশও দেয়া হয়েছিল এটা ভেবে যে, তাদেরকে আরও বাধা বিপত্তি কাটিয়ে সামনের দিকে এগুতে হবে। মুজিবের মন্ত্রিসভার সদস্যরা তার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন; তাদের অনেকের সন্ধানে বহু বিশেষজ্ঞ ছিলেন যারা জটিল বৈদেশিক দত্তক প্রক্রিয়া এবং এর প্রয়ােগবিধি সম্পর্কে জানতেন।
যে স্পর্শকাতর ইস্যুকে ঘিরে এত জল্পনা-কল্পনা, সরকার তখনও ISS-এর সুপারিশ পাবার পর বাংলাদেশের বাইরে আন্তর্জাতিক দত্তক প্রক্রিয়ার স্বরূপ মােটামুটিভাবে সরকার এ যুক্তিতে কাজ করেছেন যে, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে উন্নতির চেষ্টা করতে হলে যুদ্ধশিশু ও শিশুদের মঙ্গলকে প্রাধিকার দিতে হবে এখন থেকেই। বহু সরকারি কর্মকর্তাও এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, বাংলাদেশি সমাজে বর্ধিত পরিবারের দায়ভার ও সমর্থন থাকলেও যুদ্ধশিশুর মতাে পিতৃমাতৃহীনদের প্রতি মনােভাব তেমন বদলায়নি । পরিতাপের বিষয়, যদিও যুদ্ধশিশুদের আদর, যত্ন ও ভালােবাসার প্রয়ােজন ছিল, তাদেরকে বাঁচাবার জন্য কেউ কোনাে আগ্রহ প্রকাশ করেননি; বরং দেখা গেল, সব যুদ্ধশিশু ব্যাপকভাবে ঘৃণিত, অবহেলিত এবং প্রত্যাখাত হয়েছিল। বিশেষ করে আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে, যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার যাতে শিশুদের দত্তক পাঠানাে সম্ভব হয়, সে লক্ষ্যে আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার । প্রক্রিয়া চলাকালীন অবস্থায় যারা আইন প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন তাদের অনেকে দত্তক বিষয়টি নিয়ে মানসিক টানাপােড়নে ছিলেন নিজস্ব মূল্যবােধের প্রেক্ষাপটে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক নিহিতার্থের জন্য বিষয়টি এমন স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, কেউই এ বিষয়ে কোনাে খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেননি । মুজিবের সাক্ষরের জন্য সময়টি নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৭২-এর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে, যখন মুজিব দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। সে সময়ে কর্মকর্তারা ভয়ে ছিলেন খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করতে পারলে তারা ভৎসনা এড়াতে ব্যর্থ হবেন ভেবে। কাজ যতটুকু হয়েছে সে সবের উপর ভিত্তি করে মতামত নির্ণয়ের জন্য সরকারের কেউ একটি পরীক্ষামূলক বেলুন ওড়াতেও সাহস পাননি। মুজিব নিজে প্রেসিডেন্টকে এ কাজের দায়িত্ব দেবার পরও এরকম ঘটল । ইউরােপ থেকে ফিরে এসে মুজিব যখন দেখলেন কয়েক সপ্তাহের কাজ জমে গেছে, তিনি আইন প্রণয়নের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর মনােভাব ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি আইনটিকে জারি করার উপযােগী ঘােষণার জন্য অবিলম্বে তৈরি অবস্থায় দেখতে চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সরকার এবং দত্তক বিষয়ক সংস্থাসমূহ একত্রে কাজ করবার সময় তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, দত্তক হচ্ছে শিশুর জন্য পরিবার খোজা এবং পরিবারের জন্য শিশু খুঁজে আনা নয়। আমরা দেখতে পাবাে যে, এমতাবস্থায় উভয় সঙ্কটে পড়ে সরকার শেষ পর্যন্ত স্থির করেন যে, কোনাে আইন প্রণয়ন সম্ভব হবে না যদি কোথাও না কোথাও একটু ছাড় না দেয়া হয়। এ বিষয়ে কিছু অনুসন্ধানমূলক গবেষণার পর শেষ পর্যন্ত আইন প্রণেতাবৃন্দ যখন একমত হলেন যে, কাউকে দত্তক সন্তানরূপে গ্রহণ করলে দত্তক নেয়া শিশু ও দত্তক নেয়া পিতা-মাতা সকলেরই জীবন নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠতে পারে। এ অভিমতটি মাথায় রেখে তারা সঠিকভাবে দক্তক প্রক্রিয়ার নৈতিক দিকগুলাে বিবেচনার জন্য দ্বিগুণ সাবধান। হয়েছিলেন ।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সময়ে দত্তক প্রক্রিয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে বেশ বিতর্ক বিতন্ডা চলছিল। সমাজকর্ম এবং সংশ্লিষ্ট পেশাগুলির অভ্যন্তরীণ বিরােধ যে মতপার্থক্যের ইঙ্গিত দেয় সেগুলি মৌলিক শিশু যত্নের রীতিনীতির ব্যাপারে এখনও প্রযােজ্য । প্রস্তাবিত আইনটির খসড়া প্রণয়ন করার সময় দেখা গেল যে, জনগণের এক বিপুল অংশ মােটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। এ অবস্থায় বিষয়টি অনতিবিলম্বে সরকারের মনােযােগ আকর্ষণ করে যেহেতু এ বিষয়ে সময়ের “প্রয়ােজনে সেটা অনুভূত হয়েছিল এবং তারই জবাবে ঘটছিল। এমন এক প্রক্রিয়া যা জনগণের মানসিক রাডারে সবাই প্রত্যক্ষ করছিল এবং কোনাে মতৈক্য আপাতত না থাকলেও এটা একটি জাতীয় ইস্যু বলে বিবেচিত হয়েছিল। যেহেতু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে দত্তক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত কোনাে আইন ছিল না তাই প্রভিশনাল আদেশের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য Statutory Guardian (সংবিধিবদ্ধ অভিভাবকত্ব) প্রতিষ্ঠা করা এবং বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে দত্তক নেবার উপযােগী আইনগতভাবে স্বাধীন শিশুদের জন্ম সনদ প্রদান করা।
“সংবিধিবদ্ধ অভিভাবকত্ব”-কে সে ক্ষমতাও দেয়া হলাে যার বলে সে বিদেশের সম্ভাব্য দত্তকগ্রাহী বাবা-মাকে তাদের আইনসিদ্ধ অধিকার অর্পণ করবে, যারা ইতােমধ্যে তাদের নিজ নিজ সরকারের নিকট থেকে ঐ মর্মে ছাড়পত্র সংগ্রহ করেছেন। ঐ একই ব্যক্তি তাদের।
ক্ষমতায়িত করবেন জাতীয়তার বেড়া ডিঙিয়ে এই অনাথ শিশুদের (কারাে শিশু নয় যারা), সে সময় যাদের নির্ভরযােগ্য মা-বাবার প্রয়ােজন ছিল ।
সরকার এখানে প্রধানত যে বিষয়ে জোর দিলেন সেটা হলাে, একবার দত্তক নেয়া হলে। শিশুদের আইনি অধিকার বলে তারা দত্তকগ্রাহী মা-বাবার সন্তান হিসাবে বিবেচিত হবে, “যেন বা দত্তক বাবার ঔরসে জন্মেছে”- as-if-begotten, তারা সেটা পাবে যেটা সামাজিক মাদার ক্ষেত্রে জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মায়ের সন্তানের সমান হিসাবে গ্রাহ্য করতে হবে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক দত্তকের বলে অনাথ, দূরদেশ থেকে আসা শিশুর সঙ্গে তার দত্তকগ্রাহী মাবাবার সম্পর্ক পুরােপুরি জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার সঙ্গে সন্তানের যে স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে ঠিক সেরকম ধরে নিয়ে আচার আচরণ করতে হবে।
মিশনারিজ অব চ্যারিটির সুপিরিয়র সিস্টার মার্গারেট ম্যারি পরিত্যক্ত যুদ্ধশিশুদের “সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত হন। “একজন আইন অনুমােদিত অভিভাবক হিসাবে পরিত্যক্ত শিশুকে বাংলাদেশের ভিতরে অথবা বাইরে যে কোনাে দত্তক প্রতিষ্ঠানের নিকট দত্তক দেবার জন্য হস্তান্তর করতে পারেন । এসবের প্রয়ােজনীয় শর্তাবলি হলাে যা কিছু যেভাবে লিখিত সেই মতে তাকে আইনসম্মতভাবে দত্তক প্রদান করা হবে। উক্ত ঘােষণায় পরিত্যক্ত শিশু বলতে বােঝাবে যে, পরিত্যক্ত অথবা যাকে কেউ নিজের বলে দাবি করে না অথবা শিশুটি অবৈধ (যার জন্ম বিবাহবহির্ভূত)। সরকার এ বিষয়ে মনােযােগ দিয়ে নিশ্চিত করেন যে, একবার পরিত্যক্ত হলে এই যুদ্ধশিশুদের সঙ্গে তাদের জন্মদাত্রী মা জন্মদাতা বাবার কোনাে সম্পর্ক নেই। অতএব যুদ্ধশিশুটি আর যুদ্ধশিশু হিসাবে গণ্য করা হয় না। তখন থেকে যেহেতু সরকারের প্রযত্নে তারা তাই সরকার তাদের অভিভাবক হয়ে যান। এমতাবস্থায় সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল হিসাব রক্ষণের নিশ্চয়তা দান । বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুরা যেন কারাে ব্যক্তিগত স্থাবর সম্পত্তির মতাে একদেশ থেকে আরেক দেশে, এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে চলে যেতে না পারে। অর্ডিন্যান্সে যেমন বলা হয়েছে, পরিত্যক্ত শিশুকে পরিত্যাগ করা হয়েছে, যাতে সে আইনত দত্তক নেবার উপযােগী অবস্থায় থাকে।
সংবিধিবদ্ধ অভিভাবকত্ব পাবার পর সিস্টার ম্যারির প্রধান দায়িত্ব ছিল শিশুদের যে কলঙ্কের সাথে বর্ণনা করা হতাে সে কলঙ্কের দাগকে আস্তে আস্তে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলে দিয়ে দত্তকে ইচ্ছুক বাবা-মায়ের কাছে নতুন পরিচয়ে তাদেরকে উপস্থিত করা। এ কাজটি ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের । যেমন, অর্ডিন্যান্সটি সংক্ষেপে বর্ণনার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সামাজিক দৃষ্টিকোণ ও মনােভাবের বিষয়ে আলােচনা করে জনগণকে সচেতন করে তােলা। সে সঙ্গে যতটুকু সম্ভব জনগণের চিন্তাভাবনাকে উদারপন্থী করে তােলার চেষ্টা করা। এ অর্ডিন্যান্সের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলাে যে, একটি অনাথকে দত্তকায়নের মাধ্যমে অন্য দেশে নিয়ে লালন-পালনের দায়িত্ব থাকবে দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের উপর । একই সাথে এটা বলা হয়েছে যে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে সময়মতাে সে ঐ দেশে নাগরিকত্ব পাবে । এ বিষয়টির নিশ্চয়তাদান ছিল অর্ডিন্যান্সটি অপরিহার্য অংশ।
আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ দিক হলাে, প্রথমদিকে এটা কেবল পাকিস্তানি পিতৃত্বের শিশুদের বিষয়ে বলা হলেও আইনটি শেষে সকল পরিত্যক্ত শিশুর ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে বলে জানানাে হয় । সরকার আশা করেছিল যে, আইনটি বাংলাদেশি সমাজ যারা মুক্তচিন্তা এবং আলােকিত চিন্তার অনেক পেছনে, হয়তাে বর্তমান উদ্যোগ এক নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারে ।
তবে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, সে সময় দেখা গেল, অনেকে খােলাখুলিভাবে এ উদ্যোগের সমালােচনাও করছিলেন। যারা দত্তক নেবার পক্ষে তারা সরকারের প্রচেষ্টাকে দেখছিলেন। “অবাঞ্ছিত” ও “অনভ্যর্থিত” শিশুদের জন্য বড়জোড় একটি পরিবার তৈরির প্রচেষ্টারূপে; আবার নিন্দুকেরা শিশুর বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা না ভেবে প্রকল্পটিকে দেখেন বিদেশি দত্তক প্রক্রিয়ায় সরকারের দায়িত্ব মােচন। শুধু তাই নয়, তারা বরং এটাকে দেখেন সরকার। কর্তৃক নিজস্ব রাজনীতির এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা এবং লাল ফিতার দৌরাত্মে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া।
কানাডায় দত্তক প্রথা
কানাডীয় দত্তক প্রথা একটি প্রাদেশিক ও টেরিটরিয়াল দায়িত্ব যেখানে এর নিয়মকানুন প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক । প্রতিটি প্রদেশ ও টেরিটরিতে Child Welfare Act-এর অধীনে স্থানীয় চিলড্রেন’স এইড সােসাইটির (সি এ এস) দ্বারা পরিচালিত । দত্তক দেয়া নেয়ার হিসাব রাখা কঠিন, কারণ কানাডাতে কোনাে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে এমন দায়িত্ব দেয়া হয়নি যে, প্রতিটি প্রদেশ ও টেরিটরিতে প্রতি বছর মােট কতকগুলি দত্তক আদেশের কাজ সম্পন্ন হয়।” কানাডীয় প্রাদেশিক ও টেরিটরি চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট-এর অধীনে দত্তক নেবার ব্যবস্থা যে মৌলিক সূত্রের ওপর নির্ভরশীল সেটা হলাে, যে শিশুদের মা-বাবা দরকার তাদের জন্য দত্তক সবচেয়ে ভালাে ব্যবস্থা ।
১৯৭২ সালে যখন যুদ্ধশিশুদের দত্তক প্রক্রিয়ায় কানাডাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ফেডারেল সরকারের তদানীন্তন ন্যাশন্যাল হেলথ এ্যান্ড ওয়েলফেয়ার কানাডার বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রাদেশিক ও টেরিটরির চুক্তি ইত্যাদির প্রস্তুতি ও সম্পাদনে প্রাপ্তব্য ছিল। আরও ছিল Canada Welfare Council নামে একটি জাতীয় পরিকল্পনা সংস্থা যার পরামর্শ সহায়তা চাওয়া যেত। যদিও ওটা প্রাথমিকভাবে কানাডাতে একটি প্রাদেশিক ব্যাপার, ফেডারেল সরকারের ইমিগ্রেশন বিভাগ এতে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। যেহেতু শিশুটি এক্ষেত্রে কানাডীয় নয়। এরকম ক্ষেত্রে শিশুটি কেবল স্পন্সর্ড (নির্ভরশীল) রূপে আসতে পারবে যদি তার বয়স তেরাে বছরের নিচে হয় এবং যে ব্যক্তি তাকে দত্তক নিতে ইচ্ছুক সে যদি তাকে স্পন্সর। করে।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, কানাডাতে বিদেশ থেকে দত্তক আনা হয় জেনেভা International Social Service (ISS)-এর মাধ্যমে, যে সংস্থার নাম আমরা ইতােমধ্যে অনেকবার উল্লেখ করেছি । ISs মােটামুটি বিশ্বের সব দেশেই কাজ করে। এ ধরনের দত্তক নেয়াকে ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট দত্তক ব্যবস্থা বলা হয়। সম্ভাবনাময় দত্তক আবেদনকারী বা মা-বাবা যারা দত্তক নিতে ইচ্ছুক অবশ্যই প্রাদেশিক ও টেরিটরির নিয়মকানুন শর্তাদি পূরণ করবেন, যেখানে তিনি বাস করেন এবং যে দেশে শিশুটির বাস । শিশুর সুরক্ষা এবং পরিবারের দীর্ঘমেয়াদি স্বাচ্ছন্দ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যেতে পারে যে, দত্তক ব্যবস্থা সেসব সংস্থার মাধ্যমে হওয়া উচিত যাদের উভয় সরকার চেনেন এবং দু’পক্ষের হয়ে। যােগাযােগ রক্ষার দায়িত্ব উভয় দেশের পছন্দের একটি যােগ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারা হতে সম্ভাবনাময় মা-বাবা প্রাথমিকভাবে অবশ্যই প্রাদেশিক ও টেরিটরির শর্তাদি পূরণ করবেন। গ্রহণযােগ্য একটি হােম স্টাডির মাধ্যমে যা CAS-এর একজন এজেন্ট সম্পাদন করবে। এই এজেন্ট আবেদনকারীর প্রদেশ ও টেরিটরির প্রতিনিধিত্ব করবেন। যেসব পরিবার। শিশুদের দত্তক নিতে ইচ্ছুক, যে শিশুর পরিচিতি জানা নেই, তারাও স্থানীয় CAS-এর এজেন্ট দ্বারা ইন্টারভিউকৃত হােন এবং চাইল্ড ওয়েলফেয়ার ব্রাঞ্চ কর্তৃক ISS-এর কানাডা অফিসে তার ফাইল পাঠানাে হয় এবং কানাডীয় অফিস তখন দেশের অভ্যন্তরে দত্তক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন।
ISS-এর কার্যপ্রণালী অনুযায়ী সে সংস্থার প্রতিনিধি তখন দত্তক নেবার উপযুক্ত শিশুকে আরেক দেশে দত্তক নেবার জন্য যােগাযােগ করেন। যেসব শিশুদের পরিচিতি জানা গিয়েছে তাদের জন্য একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আইনের দৃষ্টিতে একটি শিশুর দত্তকে আগ্রহী মা-বাবার গৃহে উপস্থিত হলে দত্তক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য করা হয় না । সেটা হবে কেবল প্রকৃত দত্তক গ্রহণ সম্পন্ন হবার পরই । এখানে স্থানীয় কোর্টে বিচারকের সম্মুখে শপথ গ্রহণের একটি বিষয় রয়েছে। মা-বাবা যে শিশুকে দত্তক নেবেন বিচারকের সম্মুখে দৃঢ়ভাবে শপথ করে সে শিশুর সব ধরনের দায়দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমেই দত্তক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য করা হয় ।
আন্তবর্ণীয় ও আন্তর্জাতিক দত্তকের প্রেক্ষিত ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে, আন্তর্জাতিক আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রথা কানাডায় নতুন নয় । আবার এরকম যে, সেটা অনেক পুরনাে ঐতিহ্যও নয়। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কানাডাতে আন্তর্জাতিক দত্তক প্রথা বেশ প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরােপে ও এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বেওয়ারিশ শিশুদের সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়ায় আন্তর্জাতিক শিশুদের কানাডায় আন্তর্দেশিক দত্তক নেয়ার প্রচলন হয়। এ মহৎ ধারণা অনুসরণে দত্তক নেয়া দেয়া অত্যন্ত উপযােগী পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রায় ১২০০ অনাথ গৃহহীন শিশুদের ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে কানাডীয় সরকার কানাডাতে প্রবেশের অধিকার দিলে ইউরােপ থেকে কানাডাতে এসেছিল । অনাথ শিশুদের প্রথম ঢেউ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, অতঃপর কোরীয় ও ভিয়েতনামী যুদ্ধশিশু এবং সেসব শিশু যারা দখলদারী সৈন্যদের ঔরসে ঐ যুদ্ধকালে। জন্মেছিল।
উল্লিখিত সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ইতিহাসে সর্বপ্রথম জাতিগতভাবে ভিন্ন শিশুদের দত্তক নেয়া হয়। এটা স্মরণীয় বিষয় যে, আন্তবর্ণীয় দত্তকায়ণ একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অনেকে বলেছিলেন “এটা পাগলামির চূড়ান্ত এক সামাজিক পরীক্ষা। আবার অনেকে বেশ দুশ্চিন্তায় পরেছিলেন এটা ভেবে যে, স্পষ্টত দৃশ্যমান। সংখ্যালঘুরা পরিণামে আমেরিকান সমাজে অঙ্গীভূত হয়ে যাবে। ভাগ্যক্রমে কানাডীয়রা এরকম সমস্যার বিষয়ে ভাবেনি। মূলত এ কারণে যে, এ ধরনের দত্তক দেয়া নেয়া কানাডাতে খুব কম ছিল। আমেরিকাতে অনেকে বিস্মিত হয়ে দেখেছিলেন যে, মিশ্ররক্ত বেওয়ারিশ শিশুরা কীরকম দুঃখজনক পরিবেশের শিকার হয়ে পড়ে। এ ধরনের অনেকে এদেরকে যুদ্ধের ঘা” নামে অভিহিত করেছিলেন। এ কথা স্মরণ রাখা উচিত সে সময় আমেরিকান হ্যারি হােল্টকে সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে অনুসরণ করেছিলেন তার কার্যকলাপের মাধ্যমে। তিনি কোরিয়া গিয়ে Holt International Agency গড়েছিলেন ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি ২২ দত্তক নেয়া পরিবারের এসােসিয়েশন প্রায় একই সময়ে Open Door Sociaty (ODS) নামে পরিচিত ছিল। এসব পরিবারের মিশ্র বর্ণের শিশুরা বড় হয়েছিল উত্তর আমেরিকায় । তারা আন্তর্দেশিক ও আন্তর্জাতিক দত্তক নেবার পক্ষে এবং সচেতনতার বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন ১৯৫০ থেকে কানাডা এবং আমেরিকাতে । সংস্থাটির কাজ মূলত সংখ্যালুঘু মা-বাবর গৃহহীন শিশুদের দত্তক নিতে আগ্রহী পরিবার ও বাড়ি খুঁজে বের করা। মন্ট্রিলে তিনটি দত্তক পরিবার শুরু থেকেই এ সংস্থানের সাথে জড়িত ছিলেন । এদের প্রত্যেকেরই আগে থেকে মিশ্র বর্ণীয় ছেলেমেয়ে ছিল ।
শিশুদের প্রাপ্যতা এবং বিদেশে দত্তক ব্যবস্থা পরস্পর সম্পর্কিত এরকম আগ্রহের পেছনে বড় কারণ ছিল সন্তান সম্ভাব্য মা-বাবার খােলা মন এবং প্রশস্ততর দৃষ্টিভঙ্গি। এ কথা স্বীকার্য যে, ১৯৬০-এর দশক থেকে আস্তে আস্তে দত্তকের জন্য শিশুদের প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছিল। আবার যৌনাচারের বিধি বিধান ও নৈতিকতায় শিথিলতার জন্য এবং নারী স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে অনেক সুযােগ-সুবিধা নারীদের ক্ষমতায়ন করে। অনুমােদিত সমাজে যৌনতার অবাধ স্বাধীনতা এবং এ বিষয়ে সাধারণ গ্রহণযােগ্যতা বেশি হওয়াতে নারীদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়ে স্বাধীন হিসাবে কাজ করার সুযােগ অনেকাংশে বেড়ে যায়। অবশ্য একথা স্বতঃপ্রমানিত যে, কানাডাতে ১৯৭০ এর প্রথমদিকে গর্ভমােচন আইন ঢিলেঢালা হওয়ারও অভিঘাত ছিল। এ কারণে এটা দিবালােকের মতাে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, প্রতি বছর অবিবাহিত নারীরা যাদেরকে বলা হয় single woman, বেশি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। পরবর্তীকালে অবিবাহিত মায়েদের সন্তানকে রক্ষার দায়িত্ব নেয়ার হারও বেড়ে যাওয়াতে আস্তে আস্তে কানাডাতে দত্তক নেবার উপযােগী শিশুদের সরবরাহ কমে গেল ।
আন্তর্জাতিক শিশুদের দত্তক নেয়ার প্রক্রিয়া দেশ জুড়ে ধীর গতিতে চললেও মােটের উপর ১৯৭২ সালেও আন্তর্জাতিক দত্তক প্রথা কানাডা এবং কানাডীয়দের জন্য কিছুটা হলেও হালের ধারণা বৈকি! দত্তক গ্রহণযােগ্য শিশু কানাডাতে কম থাকলেও সে সময় আবেদনকারী দম্পতিদের তখনও একটি যুক্তিযুক্ত সময় অপেক্ষা করতে হতাে।
১৯৭২-এর শুরুতে উত্তর আমেরিকীয় বংশােদ্ভূত অথবা আংশিক ইন্ডিয়ান (যাদেরকে নেটিভ ইন্ডিয়ান অথবা এ্যাবরিজিনাল বলা হয়) অনাথ পাওয়া যাচ্ছিল বিভিন্ন কানাডীয় প্রদেশে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭২ সালে কানাডীয় নথিপত্র অনুযায়ী স্থানীয় শিশু ও ছেলেমেয়েদের সংখ্যা কেবল অন্টেরিও প্রদেশে “আনুমানিক ১,০০০ ক্রাউন ওয়ার্ড অব ইন্ডিয়ান হেরিটেজ” যাদের অনেকেই “স্কুলের উপযােগী বয়সী এবং ভাইবােনদের গ্রুপ”। ভিয়েতনামী যুদ্ধশিশুদের অবস্থা এবং মার্কিন সেনাদের পিতৃত্বের পরিচয় বহনকারী পরিত্যক্ত শিশুদের দেখে বহু সম্ভাবনাময় দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা আন্তর্জাতিক এবং আন্তবর্ণীয় দত্তক নিতে বিশষভাবে। আগ্রহী হােন।
কোনাে সন্দেহ নেই, আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রক্রিয়ায় প্রথম ঢেউ এবং পেছনে প্রণােদনা ছিল প্রধানত মানবিক । এখানে একটি জরুরি দিক উল্লেখ করা বাঞ্চনীয় যে, সম্ভাব্য দত্তকগ্রাহী মা-বাবা যে আবশ্যিকভাবে কানাডীয় অনাথ শিশু দত্তক নিতে চাননি, সেটা সত্য নয়। একটি আন্তবর্ণীয় শিশুকে দত্তক নেয়া এবং এশিয়ার শিশুদের প্রাপ্যতার কারণে তারা কানাডার বাইরে গিয়ে দত্তক নেয়ার সুযােগ খুঁজে বের করেন। তবে এটাও সত্যি যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য একটি শিশুর জন্য অপেক্ষায় থাকতে অনেকেরই অনিচ্ছা হতে পারে; হােম স্টাডিজ পরিচালনাকালে কোনাে কোনাে সংস্থা (লােকাল CAS অফিস) উত্তরােত্তর বর্ধিষ্ণু নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণমূলক স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করতে বলায় অনেকে ধৈৰ্য্য হারিয়েছিলেন। সে সময় এক সম্ভাব্য দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা ছুটে গিয়ে প্রাইভেট আন্তর্দেশিক দত্তক সংস্থার সাহায্য নিয়েছিলেন ।
সে সময়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা আন্তর্দেশিক দত্তক শিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন। সেগুলাে হলাে Tere Des Homme (TDH) একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যার সদর দপ্তর জেনেভায় এবং মন্ট্রিল অফিসে একজন স্বেচ্ছাসেবী দেখাশােনা করতেন। মন্ট্রিলে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবীরা পরবর্তীকালে ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি) প্রতিষ্ঠা করেন (আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানব)। ১৯৭০-এর শুরুতেই এফ এফ সি কিউবেকের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পেশাজীবীদের থেকে আন্তর্দেশিক, আন্তর্জতিক এবং আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রক্রিয়া নিয়ে কাজের জন্য কানাডাতে উচ্চসিতভাবে প্রশংসা লাভ করেন। এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ১৯৭২-এর আগে যদিও এর কোনাে আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব ছিল না, ১৯৬০ সাল থেকে এফ এফ সি অনাথ শিশুদের ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া এবং কোরিয়া থেকে কানাডাতে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করে আসছে ।
১৯৭২ এর শুরুতে, এফ এফ সি নিজেকে দ্রুত একটি বিশ্বাসযােগ্য সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে Inter-Agency Adoption Commitee (IAAC) নামক সংস্থার একটি অঙ্গ হিসেবে । IAAC ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এফ এফ সি বলতে বােঝাত কয়েকটি পরিবার যারা পূর্বে জাতিগতভাবে পৃথক শিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন, এর আগে অরিগন, ইউ এস এ-তে ১৯৭০-এর প্রথমদিকে কোরিয়ান অনাথদের নিয়ে Holt Adoption Agencyএর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজও করেছিলেন। আরও রয়েছে Council on Adoption Children (COAC) যা ১৯৬০-এ কানাডাতে কাজ শুরু করেছিলেন যারা বর্ডার পেরিয়ে দম্পতিদের জাতিগােষ্ঠীর পার্থক্য উপেক্ষা করে শিশুদের দত্তক নিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এ সময় তারা আন্তবর্ণীয় দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
দত্তকের ইতিহাসে একটি লক্ষণীয় দিক হলাে যে, কানাডীয় প্রদেশ এবং টেরিটরিগুলাের মধ্যে কিউবেক ছিল অন্য সকলের তুলনায় এগিয়ে নিজের লােকদের আন্তর্দেশিক ও আন্তর্জাতিক দত্তকে উৎসাহ দেবার কাজে। অল্প সময়ের মধ্যে এফ এফ সি কানাডাতে আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রথার বহুল প্রচলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হয়ে দাড়ায় । দত্তকে আগ্রহী বাবামায়েরা দেশের সরকার এবং কানাডার সংস্থাসমূহের মধ্যে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করে সহযােগিতার বৃদ্ধির লক্ষ্যে তথ্য বিনিময় প্রচারণা এমন জোরেশােরে চালাতে লাগেন যে শীঘ্রই এফ এফ সি’র নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে, ১৯৭০-এর পর থেকে কানাডীয় দম্পতিরা এটা বুঝতে পারেন। যে, দত্তক নেয়া, বিশেষ করে আন্তবর্ণীয়, একটি পরিচিত সামাজিক বিন্যাসে পরিণত হয়েছিল । কানাডাতে আন্তবর্ণীয় দত্তক নেয়ার ব্যাপারে কানাডীয়রা বেশ আগ্রহ নিয়ে দত্তক গ্রহণ শুরু করেন। দুটি ঢেউয়ে এসে পারিবারিক জীবনের সুর বদলে দেয়। প্রথম ঢেউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে এসেছিল । আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রথার অনুসরণে তার দ্বিতীয় ঢেউ এসে পড়ে ১৯৭৫-এ সায়গনের পতনের পর । অভিবাসন নীতির। পরিবর্তনের ফলে যে সব শিশুর দত্তক নেয়ার জন্য কাগজপত্র তৈরি শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং যাদের কানাডা যাবার কথা ছিল তাদের কানাডা সরকার প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। মূলত ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিয়ে কানাডা পাঠানাের ঘটনা (যেটা আমরা তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে পড়ব) উল্লিখিত দুটি ঢেউয়ের মাঝে ঘটেছিল।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে কানাডাতে দত্তক নেয়া
পাকিস্তানি (পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব ও পশ্চিমে থেকে) কানাডাতে বড়াে ধরনের দত্তক। নেয়ার ঘটনা নথিবদ্ধ নেই। আর্কাইভস-এ যে সব নথিপত্র রয়েছে সে সব ইঙ্গিত করে যে, পাকিস্তানে দত্তক প্রথার সমর্থনে কোনাে পরিষ্কার আইন না থাকায় কানাডাতে দত্তক নিয়ে। সমস্যার উদ্ভব হয়। পাকিস্তান থেকে দত্তকের অনুরােধ এলে কানাডীয় কর্মকর্তারা দত্তক প্রথার আইনসিদ্ধতা নিয়ে আরও ব্যাখ্যা দেবার তাগিদ অনুভব করেন। যে কয়েকটি নথিপত্র রয়েছে সেগুলাে থেকে দেখা যায় যে, কখনাে কোনাে অনুসন্ধানী প্রশ্ন কোনাে পাকিস্তানি বা কানাডীয় নাগরীকের কাছ থেকে আসলে দত্তক প্রথার আইনসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান ও প্রশ্নোত্তর নিয়ে কিছু চিঠি আদান-প্রদান হতাে। সে সময়ে ISS-এর কানাডীয় কর্মকর্তারা তাদের অটোয়া শাখার মাধ্যমে এ ধরনের জিজ্ঞাসার উত্তরে নানা ব্যাখ্যা পাঠাতেন। উদাহরনস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে ISS কানাডা কর্তৃক সরকারকে লেখার একটি প্রকৃত নমুনা: “পাকিস্তানি কোনাে দত্তক আইন নেই এবং তাদের সন্তান অমুসলিম দম্পতির আদর-যত্নে দত্তক সন্তান হিসাবে বিদেশের বাড়িতে বড় হবে, কর্তৃপক্ষ এটা চান না।”২৫
ISS কর্মকর্তার উপযুক্ত উত্তরের নমুনা আর্কাইভসে প্রচুর । এক কানাডীয় পাকিস্তানি দত্তক সন্তানের খোজে লিখে ঐ উত্তর পান । ISS-এর জেনেভা আর্কাইভস-এ সংরক্ষিত ১৯৬০ দশকের দলিল দস্তাবেজ থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, পাকিস্তান থেকে কানাডাতে দত্তক গ্রহণের কোনাে উধাহরণ নেই । নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে, মাঝে মধ্যে  শুধু দত্তক বিষয়ে। অনুসন্ধান করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলাে, একটি বিশেষ ক্ষেত্রে অটোয়া ISs অফিসও এ মর্মে জেনেভাস্থ দপ্তর কর্তৃক পাঠানাে চিঠিতে জানতে পারেন যে, “তারা পূর্ব পাকিস্তানে সমাজ কল্যাণ সম্পদসমূহের তেমন উন্নয়ন ঘটেনি যেমনটি নাকি পশ্চিম পাকিস্তানে হয়েছে।”২৬ উপসংহারে ISs তার সেবাগ্রহীতাকে এ মর্মে সতর্ক করেন যে, “পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনাে শিশু কানাডা গেলে IsS তার জন্য দায়ী হবে না। যেহেতু পাকিস্তান থেকে দত্তকের জন্য অনুরােধ সাধারণত পাঠানাে হয় না, ISS পরিষ্কার বলেছিলেন যে, কানাডা। থেকে কোনাে মা-বাবা পাকিস্তানি শিশু দত্তক নিতে ইচ্ছুক হলেও তার বিশেষ কারণ থাকবে । কিন্তু সাধারণভাবে এ সংস্থা “পাকিস্তানে আন্তর্দেশিক দত্তক শিশুর কেইসে” জড়াবে না।
যে সামান্য নথিপত্র পাওয়া যায়, তা থেকে বােঝা যায় যদি কখনাে দত্তকের জন্য অনুরােধ আসত ওটা সাধারণত পাকিস্তানে যে কর্মকর্তা বসতেন তাকে প্রতিটি কেইস পৃথক পৃথকভাবে (অর্থাৎ ওয়ান-অন-ওয়ান ভিত্তিতে) অবস্থা মূল্যায়নের জন্য বলা হতাে। ভিসা কর্মকর্তা। “অবস্থা সম্পর্কে জেনে তার বিচার ক্ষমতা প্রয়ােগ করবেন এবং রায় দেবেন কোনাে একটি বিশেষ কেইস আইনসম্মত দত্তক দেয়া যায় কিনা।” সে সময়ে যেসব আদান প্রদান হয়েছেল সেগুলি থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, কখনাে কোনাে অনুসন্ধান যদি বর্ডার লাইন কেইস হয় ভিসা কর্মকর্তা “তাহলে স্পন্সরকে অনুরােধ করবেন যাতে তিনি দালিলিক প্রমাণ। দেন যে দত্তকের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রদেশ জানে।”৩০ সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, ১৯৬০এর দশক থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত কানাডা ও পাকিস্তানের মধ্যে দত্তক নেয়ার বিষয়ে যেসব নথিপত্র রয়েছে সেসব থেকে এটুকু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ তথ্য জেনেভান্থ ISS -এর আর্কাইভস-এ প্রাপ্তব্য।
বাংলাদেশ আলাদা স্বাধীন দেশ হিসাবে সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে দত্তক বিষয়ে অবস্থা রাতারাতি বদলে যয়। দত্তকের জন্য চাহিদা এমনভাবে বেড়ে যায় যে, বাংলাদেশকে দত্তক বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন দিকনির্দেশ করতে হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেবার অনুরােধ আসে ভিন্ন ধরনের ঝড়ােবাতাস নিয়ে যা গতানুগতিক দর্শনকে তছনছ করে দেয় এমন সব সমাধানের দরজা খুলে যায় যা এতকাল রুদ্ধ ছিল ।
কানাডা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা যায়, মােটের উপর ১৯৬০-এর দশকে আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তকের ঘটনা কম ঘটেছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় থেকে অবাঞ্চিত ও আশ্রয়হীন শিশুদের নিয়ে কানাডাতে বেশ সচেতনতা লক্ষণীয় ছিল। ১৯৭২-এর জুন মাসে হেলকে ফেরি অনশন ধর্মঘট গণমাধ্যমে দখল নিয়ে নেয় (যে বিষয়ে আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে পড়ব)। সে অধ্যায়ে দেখব আন্তর্জাতিক দত্তকের পক্ষে অনেক বেশিসংখ্যক কানাডীয় ছিলেন বিশেষ করে বাংলাদেশ প্রকল্পের ক্ষেত্রে। তেমনি বহুসংখ্যক কানাডীয় বিষয়টির বিরােধিতাও করেছিলেন। তাদের অনেকে ব্যক্ত করেছিলেন যে, বাংলাদেশ থেকে দত্তক নিয়ে যাওয়াই “সর্বকৃষ্ট” সমাধান নয় । আন্তর্জাতিক দত্তক প্রথার বিরুদ্ধে যে যুক্তি (আজও যা বহাল) দেয়া। হয়েছিল দত্তক নেয়া শিশু তার সংস্কৃতি ও বিশেষ সংস্কৃতিক পরিচয় কী তা জানবে না। কানাড়াতে নানা অঞ্চলে জাতিগােষ্ঠীর অন্ধ সমর্থকদের হাতে তারা কেমন করে নাজেহাল হয়েছিলেন । (পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা বলেছি) কিছু সংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ কানাডীয় দম্পতি। কীভাবে বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার কথা ভাবেন এবং ঐ ভাবনার সফল বাস্তবায়নতার শেষে বেশ কিছু যুদ্ধশিশুকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী