You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার : মুজিবসহ সকলের মুক্তিলাভ : কারাগার রাজবন্দী শূন্য
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

পূর্ব বাংলার মাটিতে অবশেষে বাস্তিলের কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে। জনতার জয় হইয়াছে। গণদাবীর নিকট নতি স্বীকার করিয়া দোর্দণ্ড-প্রতাপ সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিয়া পূর্ব বাংলার অগ্নি- সন্তান, দেশগৌরব আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবর রহমানসহ এই মামলায় অভিযুক্ত সকলকেই কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনির বন্দীনিবাস হইতে গতকল্য (শনিবার) মধ্যাহ্নে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছেন।
আর মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছেন কৃষক নেতা মণি সিং, আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক জনাব ওবায়দুর রহমান ও একমাত্র মহিলা রাজবন্দী মতিয়া চৌধুরী সহ নিরাপত্তা আইনে আটক বা দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আরও ৩৪ জন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে। প্রদেশের কারাগারে কেবলমাত্র গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া অপর কেহই আজ আর বিনা বিচারে আটক নাই ৷
ফরাসী বিপ্লবের নায়করা যেমন করিয়া একদিন বাস্তিল কারাগার ভাঙ্গিয়া বন্দীদের মুক্ত করিয়াছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী ছাত্র- জনতা অসম্ভবকে সম্ভব করিয়াছে। ইতিহাসে নজিরবিহীন এই নিরস্ত্র অভ্যুত্থানের নায়ক ছাত্র-জনতা উদ্ধত রাজরোষ ফুৎকারে উড়াইয়া দিয়া স্বৈরাচারী শাসকের কারাগার হইতে যুক্ত করিয়া আনিয়াছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ও সকল রাজবন্দীকে।
অনেক বীরের রক্ত, অনেক বোনের হাহাকার আর অনেক মায়ের অনিরুদ্ধ অশ্রুপিচ্ছিল পথে, বুলেট আর বেয়নেটের উদ্ধত হুংকার আর ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গের বিষাক্ত ছোবল উপেক্ষা করিয়া ছাত্র-জনতা, কৃষক-মজুর, শিক্ষক মধ্যবিত্তের এই জীবনপণ সংগ্রাম সমানে আগাইয়া চলিয়াছে। আগরতলা মামলায় অভিযুক্তদের সকলেই মুক্তি পাইয়া স্ব স্ব পরিবার-পরিজনের মধ্যে ফিরিয়া যাইতে পারিলেও ফিরিতে পারেন নাই সার্জেন্ট জহুরুল হক আর ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক। সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দী অবস্থায় গত শনিবার প্রহরীর হাতে গুলীবিদ্ধ হইয়া দুনিয়া হইতে বিদায় লইয়াছেন এবং ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক গুরুতর আহত অবস্থায় কুর্মিটোলার সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, গত শনিবারে কুর্মিটোলায় সার্জেন্ট জহুরুল হক গুলীবিদ্ধ হইয়া নিহত হওয়ার পর আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি দাবীতে যে প্রচণ্ড গণ-বিস্ফোরণ হয়, তাহার ধারাক্রমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডঃ শামসুজ্জোহাসহ রাজশাহীতে ২ জন, ঢাকায় ৫ জন, নোয়াখালীতে প্রাথমিক স্কুল ছাত্রসহ ৩ জন, কুষ্টিয়ায় ১ জন, খুলনায় ৮ জন ও পাবনায় ২ জন অধিকার সচেতন ছাত্র, শিক্ষক ও মেহনতী মানুষকে প্রাণ দিতে হইয়াছে। দেশরক্ষা মন্ত্রী জনাব এ, আর খান এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করেন যে, দেশ হইতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের পর শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক অধিকারের সহিত সংঘাত এড়াইবার জন্য সরকার ১৯৬৮ সালের ফৌজদারী আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অর্ডিন্যান্সটি বাতিল ঘোষণা করিয়াছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, এই অর্ডিন্যান্সবলেই শেখ মুজিবর রহমান সহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আনীত তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার চলিতেছিল।
স্মরণ থাকিতে পারে যে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান ১৯৬৬ সালের ৯ই মে ভোরে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হইয়া ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক থাকেন। ডজন খানেক রাজনৈতিক মামলার আসামী হিসাবে কারাগারে তাঁর বিচারও চলিতে থাকে। পরে ১৯৬৮ সালের ১৮ই জানুয়ারী তাঁহাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামী হিসাবে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে আটক করা হয় ৷

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!