You dont have javascript enabled! Please enable it!

হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্ত

[জাতিসংঘের শরনার্থী হাইকমিশনারের প্রতিনিধি জন. আর. কেলি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্ব মুহূর্তে ছিলেন ঢাকায়। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার বিবরণঃ]

এই লেখাটি ১৯৭১ সালের ১৪,১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় যা ঘটেছিল তার কিছু কিছু ঘটনা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ। এটি কোনোভাবে আমি যে সংস্থাটির সদস্য সেটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছিল সেসবের কিছু স্মৃতি, যা একান্তই আমার ব্যক্তিগত।
সেসব ঘটনার সঙ্গে আমার নিজের সম্পৃক্তি ঘটে আগস্ট মাসে যখন জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান আমাকে ঢাকায় পাঠান সেখানাকার শরণার্থীদের সম্ভাব্য সমস্যায় তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য। যেহেতু সেটা ছিল কঠোরভাবে একটি অরাজনৈতিক ও মানবিক সেবামূলক দায়িত্ব, আর যেহেতু এই লেখাটিও একটা অরাজনৈতিক বিবরণ, তাই আমি এখানে সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য লিখবো না এবং বলবো যে সম্ভবত আমি একজন আইরিশম্যান বলেই বাঙালি জনগণের প্রতি আমার বেশ সহানুভূতিবোধ হয়েছিল এবং তাদের একটা সুখী সমৃদ্ধিশালী ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ জীবন আমি দেখতে চেয়েছি।
ডিসেম্বরের শুরুতে যখন সহিংসতা শুরু হয় তখন এটা খুব পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে যতদিন এসব চলবে ততদিনের জন্য শরণার্থী সংক্রান্ত কাজকর্ম বন্ধই থাকবে। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মকাণ্ডের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন পল মার্ক হেনরি, জাঁদরেল ফরাসি ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন আমাদের সবার জন্য একটা উদ্দীপনা। ঢাকায় একটা সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছিলেন তিনি ডিসেম্বরে। তখন সহিংসতা শুরু হয়ে গেলে তিনি ঢাকায় আটকা পড়ে যান। স্বভাবতই এখানকার জাতিসংঘ গ্রুপের সকলের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে তার কাঁধে। তিনি আমাকে সামরিক সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব দেন। এসবের মধ্যে সবই ছিল একান্তভাবেই মানবিক কর্মকাণ্ড যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মানুষের জীবন রক্ষা করা ও দুর্ভোগ লাঘব করা। তবে এই লেখাটি শুধু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সহিংস ঘটনাবলির শেষ তিনটি দিন নিয়ে লেখা।
১৪ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার
১৪ ডিসেম্বর সকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক আমাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফোন করেন। হোটেলে আমি ও জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা পিটার হুইলার ছিলাম। ড. মালিক ফোনে আমাকে তাঁর অবস্থা দেখার জন্য গভর্নর্স হাউসে যেতে বলেন। আগে ঢাকায় জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনের প্রতিনিধি হিসেবে এবং যুদ্ধের সময় যখন আমি সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করছিলাম তখন অনেকবার ড. মালিকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। পতন ঘনিয়ে আসছিল আর ঢাকার ভিতর থেকে পরিস্থিতিটা মনে হচ্ছিল ১৯৪৫ সালের বার্লিনের মতো। আমি ও পিটার হুইলার যখন গভর্নর্স হাউসে ড. মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই তখন তিনি একটা ক্যাবিনেট বৈঠকে ছিলেন; কিন্তু তবুও বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর এডিসির অফিসে। তাঁর ব্যক্তিগত পরিস্থিতির ব্যাপারে তিনি আমাদের পরামর্শ চাইলেন।
আমি তাঁকে বললাম আমার মনে হয় তাঁর ও তাঁর মন্ত্রীদের সামনে এখন মৃত্যুর বিরাট ও প্রকট ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। আমি আরও বললাম যে, তাৎক্ষণিকভাবে তিনি যদি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিউট্রাল জোনে আশ্রয় না নেন তা হলে হয়তো ঐ রাতটায় ফাঁড়াই তিনি কাটাতে পারবেন না। তবে নিউট্রাল জোনে প্রবেশের অনুমতি পেতে হলে তাঁদেরকে সব সরকারি দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিতে হতো। তিনি বললেন যে, তার মন্ত্রিসভা ঐ মুহূর্তে ভাবছেন তাঁরা পদত্যাগ করবেন কি করবেন না, তবে তাঁরা তা করতে অনিচ্ছুকই ছিলেন। তিনি বললেন যে তিনি নিজে মনে করেন ঐ মুহূর্তে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত হবে না কারণ তা হলে ইতিহাসের দৃষ্টিতে রণেভঙ্গ দিয়ে পলায়ন বলে মনে হবে। তারপর তিনি জানতে চাইলেন তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে নিউট্রাল জোনে পাঠাতে পারবেন কি না। আমি জবাবে বললাম যে যদিও তাঁর স্ত্রী ও কন্যা অবশ্যই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিউট্রাল জোনে আশ্রয়ের অনুমতি পাবেন কিন্তু তাতে তাঁর লক্ষ্য অর্জিত হবে না। হোটেলটি তখন সাংবাদিকে ভর্তি, তাঁরা বলেন যে, ড. মালিক এতটাই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন যে, তিনি তাঁর পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন, এরপর তারা জানতে চাইলেন কখন ড. মালিক নিজে এখানে এসে উঠছেন।
সেই মুহূর্তে গভর্নর্স হাউসটি কয়েকটা প্রচন্ড বিস্ফোরণে ভয়াবহভাবে কেঁপে উঠলো। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণের কবলে পড়েছে ভবনটি। আমি ও পিটার হুইলার তক্ষুণি ঝুলবারান্দা টপকে পেরিয়ে বেরিয়ে এলাম এবং গজ পাঁচেক দূরে একটা জিপের নিচে আশ্রয় নিলাম। গোটা ছয়েক ভারতীয় বিমানের প্রত্যেকটা থেকে দু’বার করে রকেট ও কামানের আঘাত এসে পড়লো ভবনটির উপরে। আক্রমণের প্রথম পর্ব যখন চলছে তখন দেখতে পেলাম তৎকালীন মুখ্য সচিব মুজফফর হুসেইন বিমর্ষভাবে বেরিয়ে এলেন, আমাদের চোখাচোখি হলো এবং আমরা উদ্বিগ্ন অভিবাদন বিনিময় করলাম। গভর্নর্স হাউসের ওপর হামলা চলছে এরই মধ্যে আমি প্রায় ২০ গজ দৌড়ে চলে এলাম একটা ট্রেঞ্চ-এর কাছে, ট্রেঞ্চটা ততক্ষণে সৈন্যে ভর্তি, আমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। এই পুরোটা সময় ধরে আমি আমার হাতের ওয়াকিটকিতে আক্রমণটি সম্পর্কে ধারাবর্ণনা চালিয়ে যেতে থাকলাম পল-মার্ক হেনরির উদ্দেশে। তিনি তখন জাতিসংঘের লোকেশনে অবস্থান করছিলেন। জেনারেল ফরমান আলী নিরাপত্তার খোঁজে ছুটছিলেন, ছুটতে ছুটতে তিনি আমাকে বললেন, ভারতীয়রা আমাদের ওপরে এই হামলা করছে কেন? ২০ গজ দূরে গভর্নর্স হাউসের ওপর ভারতীয় বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রকেট আর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। এই পরিস্থিতিটা জেনারেল ফরমান আলির সঙ্গে গল্প করার উপযুক্ত নয় বলে আমার মনে হলো, তিনি তাঁর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকলেন। আক্রমণের আওয়াজে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা থামলো এবং আমি আমার গাড়িতে উঠে পিটার হুইলারকে তুলে নিয়ে জাতিসংঘের লোকেশনে
ফিরে এলাম।
জাতিসংঘ লোকেশনে এসে আমি ঘটনা সম্পর্কে পল-মার্ক হেনরিকে জানালাম এবং ‘দি অবজারভার’-এর গ্যাভিন ইয়াং-এর সঙ্গে দেখা করলাম। গ্যাভিন ইয়াং খুব আস্থার সঙ্গে আমাকে বললেন, যা পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল যে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর ভারত গিয়ে জ্বালানি নিয়ে ও রি-লোড করে ফিরে আসতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা লাগবে। তিনি গভর্নর্স হাউসে কী ঘটেছে তা দেখতে যাবার প্রস্তাব করলেন। আমি রাজি হলাম এবং আমার গাড়িতে করে তাঁকে নিয়ে গভর্নর্স হাউসে আবার গেলাম। সেখানে সামরিক সচিবের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো, তিনি আমাদের জানালেন যে ড. মালিক ও মন্ত্রিপরিষদ গভর্নর্স হাউসের বাম দিকে একটা বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি আমাদের সেখানে নিয়ে গেলেন। আমরা ড. মালিককে খুবই কাহিল দেখতে পেলাম, তাঁরা তখনও দ্বিধান্বিত পদত্যাগ করবেন কি না তা নিয়ে। আমি তাঁদের বললাম যে আমার মনে হয় তাঁরা কেবল অনিয়মিত সৈন্যদের হাতেই নিহত হবার বিপদের সম্মুখীন তাই নয়, তাঁদের নিজেদের রক্ষীদের ওপরেও তাঁদের আর নির্ভর করা চলে না, বরং ভারতীয় বিমানবাহিনী নিজেও তাঁদের জীবনের ওপর প্রত্যক্ষ হামলা করে বসেছে।
সেই মুহূর্তে ভারতীয় বিমানবাহিনী গভর্নর্স হাউসের ওপর দ্বিতীয়বারের মতো বিধ্বংসী হামলা চালালো। গ্যাভিন ইয়াং দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের ফিরে আসার সময়ের ব্যাপারে ভুল হিসাব করেছিলেন। বাংকারটি ভূমির ওপরে ছিল বলে সেটা খুব একটা নিরাপদ ছিল না, আর আমরা জানতাম না ভারতীয় বিমানবাহিনী সেটার অস্তিত্বের কথা জানত কি না। একটা সরাসরি আঘাত হলে সেটা নিশ্চিতই উড়ে যাবার কথা। আক্রমণ চলতে থাকলো। মন্ত্রীরা তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে পদত্যাগপত্র লিখলেন, ড. মালিক সকল মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সেটাতে স্বাক্ষর করলেন। তারপর তিনি বাংকারের আরও ভিতরে একটা ঘরে ঢুকলেন যেখানে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা অপেক্ষা করছিলেন। ড. মালিক অজু করলেন এবং নামাজে বসলেন। সদ্য সাবেক গভর্নর ও সদ্য সাবেক মন্ত্রীরা ঐদিনই একটু পরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিউট্রাল জোনে উঠে এলেন।
এটা স্পষ্টই মনে হচ্ছিল যে ১৪ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারের আগাগোড়াই ভেঙে পড়াতে পাকিস্তানের পক্ষে যারা যুদ্ধ পরিচালনা করছিল তারা ভীষণভাবে নাড়া খেয়ে গেছে এবং পরিস্থিতির গুরুত্বটা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এটা খুবই হতে পারে যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সম্মিলিত পদত্যাগ যুদ্ধকে এক বা তারো বেশিদিন সংক্ষিপ্ত করছে।
১৫ ডিসেম্বর, বুধবার
১৫ ডিসেম্বর খুব সকালবেলা ড. মালিক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আমার কাছে এসে বললেন যে ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হিসেবে তাঁর পদত্যাগ ও গভর্নর্স হাউস থেকে প্রস্থানের মাঝামাঝি সময়ে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটা টেলিফোন পেয়েছেন। আমি যতদূর জানি এই প্রথম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটা যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দিলেন।
ড. মালিক বললেন, প্রেসিডেন্টের নির্দেশনার ব্যাপারে তিনি জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ইয়াহিয়ার নির্দেশ: যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখন আপনাকে নিতে হবে। নিয়াজির সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারে ড. মালিক আমার সহযোগিতা চাইলেন। আরও প্রাণহানি ঠেকানোর উদ্দেশ্যে আমি আমার ব্যক্তিগত সাধ্য থেকে তাঁকে সহযোগিতা করতে রাজি হলাম। তারপর আমি নিউট্রাল জোনে পাকিস্তান সামরিক লিয়াজোঁ কর্মকর্তা (বেসামরিক পোশাকে) কর্নেল গাফফারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারপর আমরা তিনজন আমার রুমে গেলাম এবং সেখান থেকে জেনারেল নিয়াজিকে ফোন করলাম। ড. মালিক জেনারেল নিয়াজিকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রেসিডেন্টের নির্দেশের ব্যাপারে তিনি কী পদক্ষেপ নিয়েছেন। জেনারেল নিয়াজি উত্তরে বললেন যে এ ব্যাপারে তিনি ড. মালিকের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। তিনি ড. মালিককে হোটেল ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বললেন। আমি ড. মালিককে বললাম, যদি তিনি নিউট্রাল জোন ত্যাগ করেন তা হলে তাঁর আর কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। আর আগের দিন তার পদত্যাগ ও তার পরবর্তী পরিস্থিতিতে তার নিউট্রাল জোন ত্যাগ করা তাঁর জন্য বিপজ্জনকই হবে। আমি উল্টো তাঁকে পরামর্শ দিলাম জেনারেল নিয়াজিকে হোটেলে আসতে বলতে, কিন্তু নিয়াজি জানালেন তিনি তাঁর পক্ষ থেকে জেনারেল ফরমানকে পাঠাচ্ছেন।
জেনারেল ফরমান ঠিক সময়ে উপস্থিত হলেন। আমি একজন বিদেশী, আর যাই হোক না কেন, কোনো মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নয়, বক্তিগতভাবে কাজ করছিলাম, তাই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের এরকম একটা আলোচনা থেকে আমি সরে গেলাম। ড. মালিক. জেনারেল ফরমান ও কর্নেল গফুর আলোচনায় বসলেন। পরে তাঁরা আমাকে আবার আমন্ত্রণ জানালেন এবং তাঁদের প্রণীত কতগুলো প্রস্তাব দেখালেন যা জেনারেল ফরমান জেনারেল নিয়াজির কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর অনুমোদনের জন্য এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানোর জন্য।
প্রস্তাবগুলো এই
‘আরও প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি বন্ধ করতে আমরা সম্মানজনক শর্তে এই প্রস্তাবগুলো জানাতে ইচ্ছুক’:
ক. পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি এবং সকল সহিংসতা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ; খ. জাতিসংঘের আয়োজন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের হাতে প্রশাসনের শান্তি পূর্ণ হস্তান্তর;
গ. জাতিসংঘকে নিশ্চিত করতে হবে:
১. সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীগুলোর সকল সশস্ত্র সদস্যের পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ;
২. পশ্চিম পাকিস্তানী সকল বেসামরিক ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত নিরাপত্তা;
৩. ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত সকল অস্থানীয় ব্যক্তির নিরাপত্তা:
৪. ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে যারা পাকিস্তান সরকারের সেবা করেছে এবং পাকিস্তানের স্বার্থে সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যাঘাতমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবে না এই মর্মে নিশ্চয়তা।
জেনারেল ফরমান ঐদিনই পরে আমাদের কাছে ফিরে এসে তাদের প্রস্তাবের ব্যাপারে জেনারেল নিয়াজি ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া জানাবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন। রাত ৯টার দিকে তিনি ফিরে এসে আমাদের জানালেন, জেনারেল নিয়াজি প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করলেও ইসলামাবাদ (খ) প্রস্তাবটি, অর্থাৎ ‘পূর্ব পাকিস্তানের কাছে প্রশাসন হস্তান্তর’ প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়েছে।
যুদ্ধবিরতির আরও একটি উদ্যোগ এভাবেই শেষ হলো।
১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার
১৬ ডিসেম্বর খুব সকালে আমরা জানতে পেলাম ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঐদিনই ঢাকার সময় সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণের আলটিমেটাম দিয়েছে। কর্নেল গাফফার, লীগ অফ রেডক্রস সোসাইটিজ-এর সভেন ল্যামপেল ও আমি হোটেল থেকে টেলিফোনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে যোগাযোগের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমরা কোনো যোগাযোগ করতে পারলাম না। ব্রিটিশ আর্মির পদাতিক বাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপের ফ্রন্টে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বেশ ভালোভাবে জানি ঢাকার ওপর একটা সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণ কী মর্মান্তিক প্রাণহানি ও ধ্বংসলীলা ডেকে আনতে পারে। কর্নেল গাফ্ফার আমাদের বললেন যে, আগের দিন ভারতীয় বিমান- হামলায় পাকিস্তানী বাহিনীর কমুনিকেশন সেন্টার ধ্বংস হয়ে গেছে, আর তিনি নিশ্চিত জানেন না, প্রথমত, জেনারেল নিয়াজি আলটিমেটাম গ্রহণ করবেন কি করবেন না, দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আলটিমেটাম গ্রহণ করেছে কি করেনি সেটা তারা ভারতীয় বাহিনীকে জানাতে পেরেছে কি না।
ভারতীয় বিমানবাহিনী অলরেডি ঢাকার আকাশে চক্কর দিচ্ছিল, মনে হয় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর আমরা জানতাম যে শহরে উপকণ্ঠে ভারতীয় বাহিনী শক্তি সমাবেশ করছিল, তাও মনে হয় গোলন্দাজ ও পদাতিক বাহিনী দিয়ে একটা মারাত্মক হামলা শুরু করবার উদ্দেশ্যে। আমি এখানে আরও বলতে পারি যে পরে ভারতীয় বাহিনী যখন ঢাকায় প্রবেশ করে তখন তাদের অফিসাররা আমাদের বলেছিলেন, পাকিস্তানী বাহিনী যদি তাদের আলটিমেটাম গ্রহণ না করত তা হলে সত্যি সত্যি তারা ঢাকার উপরে একটা সর্বনাশা আক্রমণ চালাত। শহরটাকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। প্রায় সাড়ে ৮টার দিকে কর্নেল গাফ্ফার, ল্যামপেল ও আমি ঠিক করলাম, নিউট্রাল জোন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে করে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে জেনারেল নিয়াজির কাছ থেকে শুনবো কী হচ্ছে, তিনি ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন কি না।
ক্যান্টনমেন্টে যাবার পথে আমি আমার হ্যান্ডসেট রেডিওর (ওয়াকিটকি) মাধ্যমে জাতিসংঘ লোকেশনে অবস্থানরত পল-মার্ক হেনরিকে জানালাম আমরা কি করছি। তিনি ঢাকা ও নয়াদিল্লিতে জাতিসংঘ রেডিও সিগন্যালারগুলো সম্ভাব্য অতিশয় জরুরি মেসেজের জন্য অন করে সতর্কাবস্থায় স্ট্যান্ড বাই করে রাখলেন।
কিছুক্ষণ পরে আমরা কমান্ড বাংকারে পৌঁছলাম, কিন্তু জেনারেল নিয়াজিকে দেখা গেল না। তবে আমরা জেনারেল ফরমানকে বাংকারের ভিতরে পেলাম- স্পষ্টতই তিনি একজন প্রধান টার্গেট, তাঁর মুখটা ছাইয়ের মতো হয়ে গেছে, আর আগাগোড়াই ভেঙে পড়েছেন তিনি। আসমানের দিকে চেয়ে তিনি এমন একটা ভাব করলেন যে মনে হলো তিনি সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি আমাকে জানালেন, তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানালেন তাঁরা ভারতীয় আলটিমেটাম গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন। তিনি নিশ্চিত করে আরও জানালেন যে কম্যুনিকেশন সেন্টার ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তাঁরা আলটিমেটাম গ্রহণ করেছেন এই তথ্য ভারতীয় বাহিনীকে জানাতে পারেননি।
আমি জেনারেল ফরমানের কাছে জানতে চাইলাম পুরোপুরি একটা কম্যুনিকেশন চ্যানেল হিসেবে আমি জাতিসংঘের রেডিও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীর আলটিমেটাম গ্রহণের খবরটা প্রচার করি তা তিনি চান কি না। জেনারেল ফরমান হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলেন; আমি তাঁকে বাংকারের বাইরে নিয়ে এলাম যাতে আমার হ্যান্ডসেট রেডিওটি কাজ করতে পারে। আমি জাতিসংঘ লোকেশনে পল-মার্ক হেনরির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। জেনারেল ফরমানের উপস্থিতিতে আমি পল-মার্ক হেনরিকে মেসেজটা দিলাম এবং জেনারেল ফরমান আরও দুটি পয়েন্ট যোগ করলেন: এক, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভারতীয় বাহিনীর প্রতি যুদ্ধবিরতির সময় আরও ৬ ঘণ্টা বাড়ানোর অনুরোধ; দুই, ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্টাফ অফিসারদের একটা দলকে আরও সমঝোতা নিয়ে আলোচনার জন্য সম্ভব হলে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা বিমানবন্দরে আসার আমন্ত্রণ, যেখানে তাঁরা নিরাপদ আচরণ ও যথার্থ সৌজন্য লাভ করবেন। আমি পুরো মেসেজটা আমার রেডিওতে ঠিকমতো পল-মার্ক হেনরিকে জানিয়ে দিলাম, তিনি তৎক্ষণাৎ তা নয়াদিল্লি পাঠালেন। তখন সকাল ৯টা বেজে ২০ মিনিট।
তারপর কর্নেল গাফফার, ল্যামপেল ও আমি বাংকার এরিয়া ত্যাগ করলাম, মাথার উপরে ভারতীয় বিমানবাহিনী তখনও চক্কর খাচ্ছে। অবশ্য মেসেজটা সময়মতো ভারতীয় কমান্ডের কাছে পৌঁছে গেছে, ফলে ঢাকা আসন্ন প্রচণ্ড আক্রমণটির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
[৬৫] অনুবাদ: মশিউল আলম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!