You dont have javascript enabled! Please enable it!

হান্ডিয়াল নওগাঁ যুদ্ধ, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ থানার অন্তর্গত ইউনিয়নে নওগাঁ নামে একটি গ্রাম, এলাকাবাসী যাকে হান্ডিয়াল নওগাঁ হিসেবে জানে। হান্ডিয়াল নওগাঁ গ্রামটি তাড়াশ উপজেলার ৬ মাইল পূর্বে অবস্থিত। সিরাজগঞ্জ জেলায় যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তার মধ্যে এই যুদ্ধ অন্যতম বড় যুদ্ধ। এই এলাকার প্রধান বাজার ছিল হান্ডিয়াল নওগাঁ বাজার। এলাকাটি ছিল চলনবিলের একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম। এখানে নৌকাই ছিল চলাচলের প্রধান মাধ্যম। এলাকাটি বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে সংগঠিত হতে পেরেছিল এবং প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেছিল। ১০ নভেম্বরে মুক্তিবাহিনীর শেল্টার ছিল নওগাঁ থেকে ২ মাইল উত্তর দিকে প্রতাপ নামক জায়গায়। পাবনার ভাঙ্গুড়া থানার, ভাঙ্গুড়া হাইস্কুলের শিক্ষক আনিছুর রহমান (যিনি আধ্যাত্মিক লোক হিসেবে মুক্তিবাহিনীর কাছে পরিচিত) বুধবার রাতে বললেন আগামীকাল মুক্তিবাহিনী পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণে পড়বে। সাথে সাথে হাইকমান্ডের মিটিং বসল। শেল্টার চেঞ্জ করার জন্য শুরু হলো প্রত্যেক কোম্পানি, প্লাটুন, সেকশনের নৌকা ফলইন করা। পানি কিছুটা কমে যাওয়ায় নৌকা টেনে নিচে নামিয়ে শেল্টার মাস্টারের নির্দেশমতো নৌকা ভাসিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নওগাঁভিমুখে রওনা হলেন। রাত্রি ত্রি-প্রহরের সময় নওগাঁ হাটখোলায় এসে নৌকা থামল এবং যার যার সুবিধামতো অবস্থানে কোম্পানি কমান্ডারগণ অবস্থান নিলেন। কিন্তু সবাইকে সতর্ক অবস্থার নির্দেশ দেয়া হলো। যথানিয়মে ভোরে প্রত্যেক দিনের মতো কোম্পানি কমান্ডারগণ তাদের কোম্পানির প্যারেড পিটি শুরু করেছেন। প্রশিক্ষণ যথারীতি চলছে। হঠাৎ করে আব্দুল লতিফ মির্জা সাহেব, লুৎফর রহমান অরুণকে জরুরিভাবে তলব করে একটি চিরকুট পড়তে দিলেন, ‘যাতে লেখা ছিল: ‘লতিফ, বহুসংখ্যক পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর ওপর অ্যাটাক করার জন্য আসছে।’ চিঠিটি পাঠিয়েছিল সহযোদ্ধা হাজি আব্দুস সাত্তার। উনি ফজরের নামাজ পড়ার জন্য নওগাঁ মসজিদে যান এবং ওখানে গিয়ে পাক আর্মি দেখে এই চিরকুট লোক মারফত পাঠান। লুৎফর রহমান অরুণের চিঠি পড়া শেষ হতে না হতেই ভোরে নওগাঁ মাজারের কাছ থেকে অটোমেটিক হাতিয়ারের শব্দা শোনা গেল। অতঃপর যুদ্ধ শুরু। অরুণ, আব্দুল লতিফ মির্জা ও সোহরাব হোসেনসহ সবাই নৌকা থেকে নেমে পজিশন নিলেন। সারা নওগাঁ গুলি এবং মর্টারের আওয়াজে কাঁপতে লাগল। মুক্তিবাহিনী ছেলেদের মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা’ ধ্বনির আওয়াজে নওগাঁর মাটি-আকাশ-বাতাস কাঁপছিল। মুক্তিবাহিনী নওগাঁ মাজার থেকে আরম্ভ করে উত্তর দিকে প্রায় এক মাইলের মতো জায়গা নিয়ে একটি অর্ধচন্দ্র যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। শত্রুপক্ষ ধানক্ষেতের মধ্যে থেকে ফায়ার করছে। মুক্তিবাহিনী পুকুরের কান্দি, আইল এবং গাছের পেছন থেকে ফায়ার করছিল। মুক্তিবাহিনীর আব্দুল লতিফ মির্জা ২ নং কোম্পানি কমান্ডার বিনয় বাবুকে শত্রুপক্ষের এমএমজি-এর প্রতি মর্টার শেল নিক্ষেপ করার নির্দেশ অনবরত দিয়ে যাচ্ছেন। যদিও মুক্তিবাহিনীর কাছে শুধু একটা ২ ইঞ্চি মর্টার এবং শেলও কম ছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কোনো শেলই মিস হচ্ছিল না। ওই দিকে শত্রুপক্ষ বেশ কয়েকটা মর্টার একসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর দিকে নিক্ষেপ করে চলেছে। কিন্তু ওদের সব শেল পানির মধ্যে পড়ছে। বিডিআরের মোকাদ্দেস ব্রিটিশ এলএমজি নিয়ে শত্রুর এলএমজিকে ঠেকানোর প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে ব্যারেল গরম হয়ে যাচ্ছে। মোকাদ্দেস নিজের গায়ের গেঞ্জি খুলে ব্যারেল সাফ করে ঠাণ্ডা করে আবার ফায়ার করছে। লুৎফর রহমান অরুণ এবং সোহরাব হোসেনের কাছে চাইনিজ এসএমজি। এক প্রান্তে মির্জা খলিল, আজিজ মির্জা পান্না, আতাউর, আমজাদ হোসেন মিলন, সামাদ, খোরশেদ, শহিদুল্লা ও কাইঞ্চা ছিলেন। তারা জোরে জয়বাংলা ধ্বনি দিচ্ছিলেন। লুৎফর রহমান অরুণ সাথে গার্ড কমান্ডার হোসেন আলী ও কোম্পানি কমান্ডার বাছেদসহ অনেকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছিলেন। অরুণের লক্ষ্য ছিল শুধু এমএমজির প্রতি। ভোর থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বেলা ১০টা বাজার পরও কোনো ফল হচ্ছে না। যদিও শত্রুপক্ষ কিছুটা নিস্তেজ, কেননা ধানক্ষেতে পানি থাকায় ওদের পায়ের বুট কাদায় আটকে যাচ্ছে, যার ফলে পাকবাহিনী ঠিকমতো পজিশন চেঞ্জ করতে পারছে না। হঠাৎ আকাশের দিকে প্লেনের আওয়াজ শোনা গেল। মুক্তিবাহিনীর ওপর দিয়ে পাকিস্তানী ২টা জেট ফাইটার প্লেন চলে গেল। পরে জানা গেছে ওরা ভুল করে তখনকার মহকুমা নওগাঁয় গিয়ে বোম্বিং করেছে। অলৌকিকভাবে সবাই বেঁচে গেল। প্লেন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের পর শত্রুপক্ষ একেবারেই নিস্তেজ হয়ে গেল, শুধু মাঝে মাঝে দুই-একটি ফায়ার আসছে। অরুণ, মোকাদ্দেস এবং মোস্তফা একত্রে এমএমজি দখল করার জন্য ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তার পাশ দিয়ে সাইড রোলিং করে অগ্রসর হতে লাগল। একেবারে এমএমজির ১০ হাতের মধ্যে প্রবেশ করে তারা এমএমজির ২ নম্বরকে মারার জন্য ফায়ার করল কিন্তু ক্লিক আওয়াজ হলো, গুলি বের হলো না। গুলি নেই বুঝতে পেরে প্রাণে বাঁচার জন্য সবাই পেছন দিকে ছুটল। ততক্ষণে এমএমজি চালক দেখে ফেলেছে। মুক্তিবাহিনীদের তাক করে ব্রাশফায়ার করছে। সৌভাগ্যক্রমে সকলেই বেঁচে গেল। বেলা ১২টার দিকে শত্রুপক্ষ আবার ফায়ার শুরু করেছে। আস্তে আস্তে সবাই অগ্রসর হয়ে যে গ্রামে ওরা শেল্টার নিয়েছিল সেই গ্রামে উঠে পড়ল। যাওয়ার সময় পথিমধ্যে এমএমজির চালক দুজনকে দেখা গেল মুক্তিযোদ্ধার মর্টারের সেলে মৃত্যুবরণ করেছে। আশপাশে শুধু খাকি পোশাকের লাশ এবং এদের মধ্যে যারা জীবিত ছিল তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন সেলিমকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে এবং এদের পেছনে আব্দুল লতিফ মির্জার কাছে পাঠিয়ে দেয়। এরপর কৌশলগত কারণে ওদের নিশ্চুপ করানো হয়। যুদ্ধের পরে পাশের গ্রামের লোকজন প্রকাশ্যে একজন পাকসেনাকে ধরে মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে যায়। তার নাম ছিল আসলাম, বাড়ি ছিল পাকিস্তানের ঝিলামে। মুক্তিবাহিনী তিনদিন পর এ পাকসেনাকে মেরে ফেলে। ওই যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর প্রায় ৬০-৭০ সৈন্য নিহত হয়েছে। ক্যাপ্টেন সেলিমসহ ৯ জনকে জীবিত ধরা হয়েছে। প্রায় ৫০ থেকে ৭০ জন রাজাকারকে জনগণ পিটিয়ে মেরেছে। যে পাকসৈন্যরা নিহত হয়েছিল তাদের পরবর্তীতে পাকসেনারা উল্লাপাড়া হাসপাতালের সামনে মাটিচাপা দিয়ে রেখে দিয়েছিল। ওই যুদ্ধে পাকসেনার কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এলএমজিসহ বহু অটোমেটিক হাতিয়ার, মর্টার এবং চাইনিজ রাইফেলসহ প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে। এ যুদ্ধে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়নি। শুধু তিন নম্বর কমান্ডার আব্দুস সালাম ছদ্মনাম (ওয়াসিম বাবু) ও প্লাটুন কমান্ডার কাইঞ্চা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহন হন। মুক্তিবাহিনীর জন্য এই যুদ্ধ ছিল একটি বড় রকমের সফল যুদ্ধ।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!