সাদিপুর-শেরপুরের যুদ্ধ, সিলেট
মুক্তিযুদ্ধে সিলেট জেলার সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হলো সাদিপুর-শেরপুরের যুদ্ধ, যা ৫ এপ্রিল সংঘটিত হয়। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে
পাকিস্তান বাহিনীর বেশ শক্তিশালী অবস্থান সাদিপুর-শেরপুরের পতন হয় ও তারা সিলেটে সরে আসতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে স্বাধীনতাকামী কিন্তু অসংগঠিত মুক্তিবাহিনী নিয়ে প্রশিক্ষিত একটি পাকিস্তানী ইউনিটের বিরুদ্ধে শেরপুরের যুদ্ধ বিজয় ছিল বৃহত্তর সিলেট জেলার মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট মাইলফলক। এটি জনগণ, ইপিআর, প্রাক্তন সৈনিক, সেনাবাহিনী ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত সাহসী প্রয়াস, যা সিলেটের জনগণকে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার শেরপুর হলো সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার সংযোগস্থল। সড়ক পথে ঢাকা বা অন্য যে কোনো জেলার সাথে যোগাযোগ রক্ষায় শেরপুর ফেরি অতিক্রম করা ছিল অপরিহার্য। নৌপথেও এখান থেকে দেশের যে কোনো স্থানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। এসব কারণে শেরপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পাকিস্তানী এবং মুক্তিবাহিনী উভয় পক্ষের কাছেই বিবেচিত ছিল। শেরপুর কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত যা সিলেট শহর থেকে ৪০ কি. মি. দক্ষিণে ও মৌলভীবাজার থেকে ২২ কি. মি. উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। সাদিপুর শেরপুর থেকে ৩ কি.মি. উত্তরে সাদিপুর খালের তীরে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে কুশিয়ারা নদী ও সাদিপুর খালের ওপর ফেরি পারাপারের ব্যবস্থা ছিল (বর্তমানে নদী এবং খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে)।
সিলেট শহরকে দখলদার পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে গঠিত এই বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের ওপর। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ১ এপ্রিল রশিদপুর থেকে সদর দপ্তর মৌলভীবাজারে স্থানান্তর করেন। তিনি পরিকল্পনা করতে থাকেন সিলেট আক্রমণের।
৪ এপ্রিল পুরো বাহিনী মৌলভীবাজার থেকে শেরপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর হাতে তখনও ভারী কোনো অস্ত্র আসেনি। অস্ত্র বলতে শুধু .৩০৩ রাইফেল এবং সাথে ছিল কিছু গোলাবারুদ। মুক্তিযোদ্ধারা ৪ এপ্রিল রাত আটটার সময় শেরপুরের কাছাকাছি প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। পরিকল্পনা করা হয় যে, ৫ এপ্রিল ভোরবেলা মুক্তিবাহিনী শেরপুর আক্রমণ করবে।
শেরপুর পৌছার আগেই একটি গ্রুপ নদী অতিক্রম করে কুশিয়ারার উত্তর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করে। তিন দিকে তিনটি গ্রুপ অবস্থান গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পসহ প্রয়োজনীয় সমস্ত পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত হয়। চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত করে ভোর পাঁচটায় শুরু হয় আক্রমণ। সকাল পাঁচটায় শেরপুরে শত্রুর অবস্থানের সামনে আসতেই শত্রুরা গোলাগুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। মুক্তিবাহিনী পাল্টা জবাব দেয়। মুক্তিবাহিনী তখন সাদিপুর নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে এখন পুরোপুরি নিশ্চিত। আর এর পরপরই ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। অতর্কিত আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায় পাকিস্তানী সেনারা। রাতের শেষ প্রহরে স্বভাবতই তারা ছিল নিদ্রামগ্ন। তাছাড়া এত কাছ থেকে এ আক্রমণ তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পাল্টা আক্রমণের আগেই হতাহত হয়ে যায় অসংখ্য পাকিস্তানী সেনা।
এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। আধুনিক ভারী অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুরা তাদের মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে আক্রমণ করে। ফলে আশেপাশের গ্রামগুলোর বহু নিরস্ত্র মানুষ তাদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। মারা যায় অনেক গ্রামবাসী বাড়িঘরসহ বহু সহায়-সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শত্রু শেরপুর অবস্থান ছেড়ে কুশিয়ারার উত্তর পাড়ে শেরপুর নতুন বাজারে চলে আসে। সাত ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে সব সময়ই মুক্তিবাহিনী একটি ভালো অবস্থানে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। তাই অতি সাধারণ অস্ত্র দ্বারা সাধারণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে পুরো এলাকার দখল নিতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয়, তিন তিনটি প্লাটুনের অধিকাংশ সৈন্যই এই অদক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। বাকি সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। এই রকম একজন পাকিস্তানী সৈন্য ইলাশপুর গ্রামের জনৈক দালাল ছাওলা মিয়ার ধানের গোলায় লুকিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রামবাসী খুঁজে পেয়ে সেখান থেকেও তাকে বের করে এনে হত্যা করে।
সাদিপুর মেজর দত্তের দখলে এলে সাদিপুর থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা পালিয়ে সিলেটের দিকে যাচ্ছিল। তাদের পিছু ধাওয়া উচিত হবে না মনে করে তিনি মুক্তিসেনাদের সংঘবদ্ধ করতে লাগলেন। মেজর দত্ত তার শক্তি বৃদ্ধির জন্য পূর্বেই মেজর সফিউল্লাহ্র নিকট এক কোম্পানি সৈন্য পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। মেজর সফিউল্লাহ্ ৪ এপ্রিল ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে ২ ইস্ট বেঙ্গলের সি কোম্পানিকে সিলেটের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন আজিজ তার দল নিয়ে কুলাউড়া-শেওলা-সুতারকান্দি-গোলাপগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ক্যাপ্টেন আজিজ তার সৈন্যদের নিয়ে বিনা বাধায় গোলাপগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে যান। কিন্তু সিলেট শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে যখন কদমতলীর কাছে পৌঁছেন তখন পাকিস্তানীরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। তিনি তার সমস্ত শক্তি নিয়ে পাকিস্তানীদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালান। তার পাল্টা আক্রমণে টিকতে না পেরে শত্রুসেনারা সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়।
মেজন দত্ত সুবেদার ফজলুল হককে তার কোম্পানি নিয়ে সাদিপুরের প্রায় ২ মাইল আগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন। এদিকে মুক্তিবাহিনী খবর পায় যে, বিশ্বনাথ এলাকার রাস্তার দু’পাড়ে পাকিস্তান বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মুক্তিবাহিনী বিশ্বনাথের ওপর আক্রমণ করে এবং বিশ্বনাথ দখল করে। রাতের অন্ধকারে আক্রমণে পাকিস্তানী বাহিনী টিকতে না পেরে বিশ্বনাথ ছেড়ে সিলেট শহরে পালিয়ে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন আজিজের সৈন্যদল পাকিস্তানী সৈন্যদের কদমতলী থেকে তাড়িয়ে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। এভাবে ৭ এপ্রিল সমস্ত সিলেট শহর (সিলেটের সালুটিকর বিমানবন্দর ছাড়া) মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আজিজের বাহিনী (২ ইস্ট বেঙ্গলের সি কোম্পানি ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা) শেরপুর এলাকা মুক্ত রাখে। ২৩ এপ্রিল শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। এক পর্যায়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনী ও আক্রমণে অংশ নেয়। ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে প্রায় পেছনের দিক থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করে। ঐদিন ক্যাপ্টেন আজিজ আহত হলে তাকে মৌলভীবাজার নিয়ে যাওয়া হয়। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী শেরপুরের অবস্থান ছেড়ে মৌলভীবাজারের দিকে চলে আসে। সাদিপুর- শেরপুর আক্রমণ ছিল সিলেট রণাঙ্গনে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রধান যুদ্ধ। শেরপুর বৃহত্তর সিলেটের চার জেলার সংযোগস্থল ও গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে কৃষক, প্রাক্তন সেনাসদস্য, শ্রমিক, ছাত্র, আনসার বাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সমন্বয়ে বেশ বড় একটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল। মেজর দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান শেরপুরের পতন হয় ও সিলেটে সরে আসতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে স্বাধীনতাকামী অসংগঠিত মুক্তিবাহিনী নিয়ে প্রশিক্ষিত একটি পাকিস্তানী নিয়মিত ইউনিটের বিরুদ্ধে সাদিপুর-শেরপুরের যুদ্ধ বিজয় ছিল বৃহত্তর সিলেট জেলার মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট মাইলফলক। এটি জনগণ ও ইপিআর, প্রাক্তন সৈনিক, সেনাবাহিনী ও ছাত্র-জনতার প্রয়াস যা সিলেটের জনগণকে শক্তিশালী পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে পরবর্তীতে লড়তে অনুপ্রেরণা দেয়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত