সাধনপুর ইউনিয়ন রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, চট্টগ্রাম
বাঁশখালীর বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও দমন করার লক্ষ্যে একদল রাজাকার আস্তানা গাড়ে সাধনপুর ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে। এই আস্তানাকে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। বরিশাল নিবাসী সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একদিন ভোররাতে এই ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলেন। এই অভিযানে যাঁরা অংশ নেন তাঁরা হলেন-কমান্ডার খন্দকার মো. ছমিউদ্দিন, স্বপ্ন ভট্টাচার্য, দুলাল চন্দ্র দে, হরিপদ দাশ, শক্তিপদ দাশ, শক্তিপদ শর্মা, মনোরঞ্জন দে, আলী আহমদ, নীলরতন ঘোষ, আসহাবউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ হাসেম প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে অভিযানে অংশ নেন। সার্জেন্ট মহিউল আলম কমান্ডার খন্দকার মো. ছমিউদ্দিনসহ ৮ জনকে বাইরের আক্রমণ প্রতিহত করার দায়িত্ব দিয়ে এবং আসহাবউদ্দিন ও কয়েকজনকে নিয়ে নিজেই ঢুকে পড়েন রাজাকার ক্যাম্পের অভ্যন্তরে। শুরু হয় উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলিবিনিময়। একজন রাজাকার নিহত ও অপর দু’জন আহত হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হন সার্জেন্ট আলম। সাথে সাথে তিনি ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। মৃত সহযোদ্ধার লাশ কাঁধে নিয়ে বাণীগ্রামের পাহাড়ে গোপন আস্তানায় ফিরে আসেন অন্যরা। পরে খোর্দ মোজাফফরাবাদ গ্রামের আবদুর রহমানের সাহায্য নিয়ে ঈশ্বর বাবুর হাট থেকে কাফনের কাপড় এনে আসহাবউদ্দিনের ইমামতিতে জানাজা শেষে সম্পূর্ণ ইসলামি বিধানমতে বাণীগ্রাম পাহাড়ে সার্জেন্ট মহিউল আলমের লাশ দাফন করা হয়। সম্মুখযুদ্ধে মহিউল আলমের এই আত্মদান পরবর্তীকালে তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে আরো আত্মত্যাগ ও আত্মউৎসর্গের প্রেরণা যোগায়। অক্টোবর মাস থেকে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে সর্বাত্মক অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে হাজার হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার প্রবেশ শুরু হয়। অন্যদিকে ভারতে গমনকারী আবু ইউসুফ চৌধুরী এবং অন্যদের হরিণা ক্যাম্পে কিছুদিন রাখার পর তান্দুয়া বিএসএফ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জেনারেল উবানের নেতৃত্বে তিন মাসের ট্রেনিং শেষে আবু ইউসুফ চৌধুরীকে বাঁশখালী থানার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব পেয়ে আবু ইউসুফ চৌধুরী নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁর সাথে ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা স্বপন চৌধুরী (শহীদ), করিম (১৯৮৬ সালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত), দেওয়ানজী (উকিল), সুব্রত (ওয়্যাললেস অপারেটর) ও নুরুন্নবী। অক্টোবরের ৬ তারিখ ভোররাত আনুমানিক সময় ৩টা ৪০ মিনিট। বাঁশখালীর গুণাগরীস্থ পাক হানাদার বাহিনীর একদল সৈনিক আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে এলো বাণীগ্রামস্থ পূর্বদিকের সাধু অদ্বৈতানন্দ বাবুর পাহাড়ের খামারের পূর্বপার্শ্বস্থ গেরিলা ক্যাম্পে। ওই ক্যাম্পে কমান্ডার খন্দকার মো. ছমিউদ্দিনের নেতৃত্বে একদল যোদ্ধা অবস্থান নিয়েছিলেন। গুনাগলস্থি হানাদার বাহিনী যেকোনো মুহূর্তেই গেরিলা ক্যাম্পে আক্রমণ করতে পারে এই ধারণা কমান্ডার খন্দকার মো. ছমিউদ্দিনের ছিল বলেই ক্যাম্পের চতুর্দিকের আধ মাইলের দূরত্বের আগমন পথগুলোতে সার্বক্ষণিক গোপন অবস্থান থেকে পাহারার ব্যবস্থা ছিল। উক্ত দিবসে ৫ জন সহযোদ্ধা নিয়ে কমান্ডার খন্দকার মো. ছমিউদ্দিন টহলদানের সময় পি.এ.বি সড়ক হতে আনুমানিক ৩০০ গজ পূর্ব দিকে ক্যাম্পে যাওয়ার পথে হানাদার বাহিনীর আনুমানিক ৩০ জন সৈন্যের সাথে ২০ গজ দূরত্বে কমান্ডার খন্দকার মো. ছমিউদ্দিন ও তাঁর সহযোগীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শুরু হয়। আনুমানিক এক ঘণ্টা উভয়পক্ষের পাল্টা গুলিবিনিময়ে হানাদার বাহিনীর দু’জন সৈনিক আহত হওয়ায় ২টি রাইফেল এবং বেশ কিছু এ্যামুনেশন ফেলে পিছু হটে পি.এ.বি সড়কে রেখে যাওয়া গাড়ির দিকে চলে আসে। ওখান থেকে বাণীগ্রামের হরিহর চৌধুরী ও সূর্য কুমার ধরকে ধরে তাদের গওনাগরীস্থ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এই সম্মুখ খণ্ডযুদ্ধের বিবরণ জেনে স্বাধীনতাকামী মানুষের উদ্দীপনা বেড়ে যায় এবং কমান্ডার খন্দকার মো. ছমিউদ্দিনের বীরত্ব ও নেতৃত্ব তাদের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকে।
[৫৯৪] নূর নবী চৌধুরী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত