You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাচনা জামালগঞ্জের যুদ্ধ, সুনামগঞ্জ

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায় নদীপথই যোগাযোগ এর প্রধান মাধ্যম। এর সাচনা বাজার বিখ্যাত নদী বন্দর। পাকবাহিনী জামালগঞ্জে সুদৃঢ় ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করছিল। জামালগঞ্জকে মুক্ত না করতে পারলে এ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল ছিল অসম্ভব। তাই জামালগঞ্জকে মুক্ত করার প্রয়োজন জরুরিভাবে উপলব্ধি হয়। তিন দলে বিভক্ত হয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ রচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে মতে ২৯ জুলাই, ১৯৭১ বিকেলবেলায় প্রতি দলে ৪০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মোট ১২০ জনের এক দুর্ধর্ষ বাহিনী গঠন করা হয়। এরা কোম্পানি কমান্ডার ও সেকেন্ডম্যান প্রতি নৌকায় ২০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অগ্রসর হবেন বলে স্থির হয়। প্রথম কোম্পানি কমান্ডার ই.পি.আর.-এর আব্দুল হাই এক নৌকায় ওঠেন অপর নৌকায় নিখলীর সিরাজ মিয়া ওঠেন। তাঁদের দায়িত্ব ছিল উত্তর দিক থেকে সাচনা বাজারে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে অতর্কিতে আক্রমণ করা। এ দলে বেশিরভাগ ছিল কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ও ই.পি.আর.-এর সৈনিক আতাউর রহমান প্রমুখ। দ্বিতীয় দলে ছিলেন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস। তিনি কম্পানি কমান্ডার হিসাবে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এক নৌকায় ওঠেন এবং সেকেন্ডম্যান হিসাবে জনাব আলী আমজাদ অপর ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দ্বিতীয় নৌকায় যাত্রা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব আবুল হোসেন, জিয়াউদ্দিন, জুবায়ের চৌধুরী, আতাউর রহমান, বদিউজ্জামান, ইলিয়াস, রমিজ উদ্দিন, আশক আলী প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের দায়িত্ব ছিল জামালগঞ্জ সিও অফিস এবং হাই স্কুলের পেছেন দিক থেকে জামালগঞ্জে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করা। তৃতীয় দলের কমান্ডার ছিলেন জনাব মুজাহিদ মিয়া এবং সেকেণ্ডম্যান হিসেবে ছিলেন ইব্রাহিম খলিল। তাঁরা দু’নৌকা করে যাত্রা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব মুজিব, মণীন্দ্র চন্দ্র, সাইফুদ্দিন, আলাল, আব্দুল বাছিত,শাহানুর, আঃ রউপ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের দায়িত্ব ছিল তেলিয়া শাহপুরের দিক থেকে জামালগঞ্জে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করা এবং এবং সুরমা নদী দিয়ে পাবাহিনীর যাতায়াত ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা। এভাবে জামালগঞ্জ আক্তমণের সকল প্রস্তুতি শেষ হলে জনাব আলী ইউনুছ অ্যাডভোকেট অভিযাত্রি দলসমূহকে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদপত্র আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে টেকেরঘাট ট্রলি লাইনের উপরস্থির এয়েটব্রিজের উত্তর পৃর্ব দিকে নৌকাঘাট থেকে বিদায় জানান। এ সময় মিত্র বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ বিশেষঞ্জ মেজর বাথ, আলী ইউনুছ অ্যাডভোকেটসহ ৬ নৌকোর কমাণ্ডার ও সেকেণ্ডম্যানসহ গ্রুপফটো তুলে নেন। এ ফটো জাতীয় দিনটিতে বার বার দেখানো হয়। রাতের গভীর অন্ধকারের যবনিকা ঠেলে মুক্তিবাহিনীর তিনটি কোম্পানি নির্বিঘ্নে নির্ধারিত স্থানে পৌছে যায়। বুকে তাদের বঞ্চনার ও প্রতিশোধ গ্রহণের তীব্র জ্বালা। তাঁরা দুর্বার হয়ে ওঠে এবং রাত্রির অন্ধকারের প্রথম সুযোগেই ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে। গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের মারণাস্ত্র। পাকবাহিনীও বাজারস্থ নিশি বাবুর ঘরের নিকটের বাংকার, হাই স্কুল ও থানার নিকটস্থ বাংকার হতে অবিরাম গোলাগুলি বর্ষণ করতে থাকে সারারাত ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে। ভোর রাতে আব্দুল হাই কোম্পানির টু.আই.সি মরণজয়ী মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ পাক-আর্মির ব্যাংকারে গ্রেনেড চার্জের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত ইনুযায়ী গ্রেনেড চার্জকালে সাচনা বাজার পুলের নিকট তিনি পাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। কিন্তু উক্ত গ্রেনেড চার্জের ফলে পাক বাহিনী সাচনা বাজার ঘাঁটি ছেড়ে যেতে বাধ্য এবং পেভূত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অপর দিকে জগৎজোতির প্রবল আক্রমণে পাকবাহিনী জামালগঞ্জের বাংকার ছেড়ে পলায়ন করতে থাকে। দক্ষিণ দিক থেকে মুজাহিদ তাঁর বাহিনী নিয়ে সুরমা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে পাকবাহিনী সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়ে দুর্লভপুর অভিমুখে পালিয়ে যায়। সাচনা ও জামালগঞ্জ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। এলাকাবাসীগণও দীর্ঘদিন পর হাফ ছেড়ে বাচেন। আব্দুল হাই কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারাও এসে পড়েন এবং শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের লাশ নিয়ে টেকেরঘাট সেক্টরে যান এবং তথায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর দাফন করা হয়। সাচনা-জামালগঞ্জের এ মুক্তিযুদ্ধ সবার স্মৃতির মণিকোঠায় দীর্ঘদিন দেদীপ্যমান থাকবে। উক্ত অভিযাত্রী দলের অধিনায়কদের নিয়ে তোলা ফটো যা টি.ভি.র পর্দায় বার বার দেখানো হয়ে আসছে তা টিভির সিনিয়র কর্মকর্তা জনাব এনামুল হকের সৌজন্যে পাওয়া যায়। [৭৬] মোহাম্মদ আলী ইউনুছ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!