You dont have javascript enabled! Please enable it!

সন্দ্বীপ থানা ও টেলিগ্রাম অফিস আক্রমণ

১৯৭১ সালের ১ নভেম্বর আর এক স্মরণীয় দিন। এই সময় সন্দ্বীপের সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল, গুদাম ইত্যাদি পাক হানাদারদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, পুলিশ ও মিলিশিয়াদের পাহারায় ছিল সুরক্ষিত। এর মধ্যে দুটি শক্ত ঘাঁটি ছিল সন্দ্বীপ থানা ও টেলিগ্রাম-টেলিফোন অফিস। সন্দ্বীপ থানার পূর্ব দিকে ডাক্তার মনোমোহন দাসের পুস্করিণীর পশ্চিম পাড়ে, কার্গিল স্কুলের পশ্চাদ্দেশে থানার দক্ষিণ দিকে তৎকালীন সময়ে কার্গিল স্কুলের শিক্ষক দেবেন্দ্রকুমার পালের বাসভবনে, থানার উত্তর দিকে এতিমখানার পার্শ্ববর্তী কচুরিপানা পরিপূর্ণ ডোবার মধ্য হতে এবং থানার দক্ষিণ দিকে জেলা বোর্ডের ডাকবাংলোর ছাদের ওপর মেশিনগান বসিয়ে মুক্তিবাহিনী থানা আক্রমণের ব্যূহ রচনার পরিকল্পনা করে। স্থির হয়, এতিমখানার পার্শ্ববর্তী ডোবার ভেতর প্রায় বক্ষস্থল পর্যন্ত পানিতে নিমজ্জিত করে জনৈক সেনানী অকুতোভয় দাঁড়িয়ে থাকবে। আর তার কাঁধের ওপর মেশিনগান স্থাপন করে অন্য আর একজন সেনানী আবক্ষ পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় মেশিনগান চালাবে। কিন্তু পরে ঐ পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ঐ ডোবার উত্তর পাড় হতে মেশিনগান চালানো হয়। এতদভিন্ন স্টেনগান ও গ্রেনেড, হাতবোমা ইত্যাদি অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র চালনা করার জন্যও নিকট এবং দূরত্বে স্থান নির্বাচন করা হয়। টেলিগ্রাম ও টেলিফোন অফিসের চারদিকে যেই ঝোপঝাড় রয়েছে অন্ধকারে তার ভেতর থেকেই মেশিনগান এবং অন্যান্য অস্ত্র চালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মেশিনগান ভিন্ন অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতের ভেতর সুবিধাজনক স্থান হতে পরিচালনা করা হবে স্থির করা হয়। এভাবে রচনা করা হয় ব্যূহ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, কাটগড় অস্ত্রাগারে মুক্তিবাহিনীর সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র কেন্দ্রীভূত করা হয়। সে অস্ত্রাগার হতে বাটাজোড়া গ্রাম নিবাসী গ্রুপ কমান্ডার রফিকুল ইছলাম, সেলিম, মাহবুব, রছুল, শফিকুর রহমান প্রমুখের যৌথ কমান্ডে প্রায় ষাটজন যোদ্ধার এক বাহিনী পরিপূর্ণ সামরিক সজ্জায় ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সন্দ্বীপ টাউনে এসে উপস্থিত হয়। রাত তখন গভীর। উক্ত ষাটজন যোদ্ধার মধ্যে চল্লিশজন অসীম সাহসী যোদ্ধা সন্দ্বীপ থানা দখলের জন্য সেদিকে যাত্রা করে। গ্রুপ কমান্ডার রফিকুল ইছলাম স্বয়ং দশজন দক্ষ সেনানী সাথে নিয়ে টেলিগ্রাম ও টেলিফোন অফিস দখলের জন্য যাত্রা করেন। অবশিষ্ট দশজনকে পোস্ট অফিস, কোর্ট বিল্ডিং, ন্যাশনাল ব্যাংক, সরকারি গুদাম এবং থানা কাউন্সিলে অবস্থিত অন্যান্য সরকারি অফিস দখলের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে পাঠানো হয়। কমান্ডার স্বয়ং পাকবাহিনীর অতিশয় শক্ত ঘাঁটি সন্দ্বীপ থানা আক্রমণে কেন নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন, এই প্রশ্ন পাঠকবর্গের অন্তরে উদিত হওয়া স্বাভাবিক। এর উত্তর এই যে, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই যদি এই সংবাদ চট্টগ্রাম পাকবাহিনীর সামরিক কেন্দ্রে (সন্দ্বীপের) টেলিগ্রাম ও টেলিফোন অফিস হতে প্রদান করা হয়, তাহলে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর বিমান হতে বোমা বর্ষণ করতে পারে। সেজন্য বিদ্যুৎগতিতে সে স্থানে আক্রমণ চালিয়ে অফিস দখল করার ভার কমান্ডার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। আয়োজন সম্পূর্ণ হলে কার্যসূচি অনুযায়ী যোদ্ধারা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ স্থানে অবস্থান নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কমান্ডারের নির্দেশ ছিল ঘড়িতে একটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একসঙ্গে আক্রমণ শুরু করবে। পৃথক আর কোনো আদেশ দেয়া হবে না এবং যুদ্ধ জয়ের পর প্রত্যেকে সন্দ্বীপ থানায় এসে একত্রিত হবে পরবর্তী নির্দেশের জন্য। একটা বাজার সাথে সাথে রাতের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্যে বীর মুক্তিবাহিনীর সকল আগ্নেয়াস্ত্র সকল স্থান হতে এক সাথে গর্জন করে ওঠে। প্রতিরোধের সৃষ্টি হয় মাত্র টেলিগ্রাম-টেলিফোন অফিস এবং থানা হতে, অন্যান্য স্থানে পাঁচ-দশ মিনিট গুলি বিনিময়ের পর পাকবাহিনী পিছু হটে, পরে অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করে পলায়ন করে। এখানে উল্লেখ্য যে, কমান্ডার তার বাহিনীর প্রত্যেককে আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে, বিপক্ষের যোদ্ধাদের হত্যা না করে বন্দি করার জন্য বিশেষভাবে তৎপর হতে হবে। যুদ্ধে হত্যা ন্যায় অনুমোদিত হলেও জিঘাংসা পরবশ হয়ে কাউকে হত্যা করা যাবে না। স্মরণ রাখতে হবে, এদের মধ্যে অধিকাংশ পথভ্রষ্ট বাঙালি। ওরা তো আমাদেরই ভাই। তবে বিপথগামী। এই অপরাধ ক্ষমার চোখে দেখার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু আমাদের কার্যসিদ্ধির প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালে অবশ্যই হত্যা করা যাবে। বলাবাহুল্য, সেজন্যই পলায়নপর শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন করে মুক্তিবাহিনী তাদের হত্যা করেনি। তাদের পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক সকলে থানার বাহিনীর সঙ্গে এসে মিলিত হয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। এদিকে টেলিগ্রাম-টেলিফোন অফিসে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সর্বপ্রথম ওখানকার সংবাদ প্রেরণ যন্ত্র দখল করে নেয়। ওটা পুনরুদ্ধারের জন্য পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে আক্রমণ শুরু করে। এই সময় টেলিগ্রাম অফিসের চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড বেগে পাকবাহিনীর ওপর গোলাগুলি বর্ষণ করতে থাকে। পাক বাহিনী তাদের ভাবনাতীত চারদিক থেকে ওরকম আক্রান্ত হয়েও প্রায় আধা ঘণ্টা প্রবল বিক্রমে মুক্তিবাহিনীকে বাধাদান করে। কিন্তু আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে অবশেষে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রাতের অন্ধকারে যে যেদিকে পারে পলায়ন করে। মুক্তিবাহিনী শত্রুর পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও সংবাদ প্রেরক যন্ত্র সঙ্গে করে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে দিতে থানায় পৌঁছে ওখানে মোতায়েন বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবাদ প্রেরক যন্ত্রটি বাংলাদেশ সরকারকে ফেরৎ দেয়া হয়। এদিকে সন্দ্বীপ থানায় যুদ্ধারম্ভের সঙ্গে সঙ্গে বিপক্ষ বাহিনীর কোনো সাড়াই পাওয়া যায় না। তারা অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ও অস্ত্র চালনার পদ্ধতি অনুধাবন করার জন্য কয়েক মিনিট কালক্ষেপণ করে বুঝতে পারে যে, এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য থানা ভবনে অবস্থান কোনো দিক দিয়েই নিরাপদ নয়। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র থানায় রক্ষিত। এই স্থানকে কেন্দ্র করে যদি যুদ্ধ পরিচালনা করা হয় তবে বিপক্ষের আধুনিক উন্নততর অস্ত্রের মুখে থানা ভবনও ওখানে রাখা সমস্ত সামরিক উপকরণ ধ্বংস হয়ে যাবে। অধিকন্তু সে যুদ্ধে পাকবাহিনীর কারো প্রাণে বাঁচার আশা নেই। মুহূর্তের মধ্যে কর্তব্য স্থির করে পশ্চিমা মিলিশিয়া ও বিহারি ও বাঙালি পুলিশ বাহিনী থানা ভবন থেকে সমস্ত গোলাবারুদ এবং যাবতীয় সমর উপকরণ সাথে নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বিদ্যুৎবেগে থানার সামনে সন্দ্বীপ সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ত্রিতল ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ শুরুর চার মিনিটের মধ্যেই তারা সেখানে চলে যায়। অতঃপর ব্যাঙ্কের দ্বিতল ও ত্রিতলে ব্যূহ রচনা করে পাকবাহিনী প্রত্যুত্তর প্রদান শুরু করে। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে। সমগ্ৰ সন্দ্বীপ টাউন এক বিরাট রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। উভয় পক্ষের সকল প্রকার অস্ত্রের বিকট গর্জনে এবং সেই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর মুহুমুহু জয় বাংলা ধ্বনিতে রাতের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। সমগ্র সন্দ্বীপ টাউন এবং এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর সমস্ত বৃক্ষলতা, ভূমি, বাসগৃহ থরথর করে কাঁপতে থাকে। সমগ্র সন্দ্বীপে অস্ত্রের সে গর্জন ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এদিকে টেলিগ্রাম ও টেলিফোন অফিস ছাড়া অন্যান্য স্থানের মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা যুদ্ধ শেষ করে ক্রমে ক্রমে থানায় এসে তাদের দলের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। আক্রমণ ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। জয়-পরাজয়ের লক্ষণ কোনো দিক থেকেই দেখা যায় না। ওভাবে প্রায় চল্লিশ মিনিটের ওপর তুমুল যুদ্ধ চলার পর টেলিগ্রাম-টেলিফোন অফিস জয়ের উন্মাদনা নিয়ে ওখানকার সেনানীরা কমান্ডারের নেতৃত্বে থানায় উপস্থিত হয়ে সেখানে যুদ্ধরত বাহিনীর সাথে একত্রিত হয়। মুক্তিবাহিনীর সমস্ত শক্তি থানা কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় যুদ্ধ ক্রমেই মারাত্মক রূপ ধারণ করে। পাকিবাহিনী মরিয়া হয়ে আত্মরক্ষা করতে থাকে। জয়-পরাজয়ের কোনো চিহ্নই দেখা যাচ্ছিল না। রাতের গভীর অন্ধকারের মধ্যে কোনো পক্ষের হতাহতের সংখ্যা কত তাও অনুমান করা যাচ্ছিল না। আরও প্রায় এক ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। কিন্তু জয়-পরাজয় কিছুই নির্ধারিত না হওয়ায় মুক্তিবাহিনী জীবনপণ করে এবার শত্রুর ওপর চরম আঘাত হানতে উদ্যত হয়। তারা কমান্ডারের নিকট গ্রেনেড ও অতিবিস্ফোরক বোমাদ্বারা সন্দ্বীপ সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের ত্রিতল ভবন নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে হলেও উড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাব করে। এই বোমা নিক্ষেপ অতিবিপজ্জনক। নিক্ষেপকারীর জীবন প্রায় রক্ষাপ্রাপ্ত হয় না। কিন্তু কমান্ডার তাতে সম্মতি প্রদান করেন না। ঘড়িতে তিনটে পঞ্চাশ মিনিট বেজে যায়। উভয়পক্ষে তখনো যুদ্ধ চলছিল। এবার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সমগ্র বাহিনীকে ধীরে ধীরে যুদ্ধ বন্ধ করে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। নির্দেশ প্রতিপালিত হয়। একমাত্র থানার দক্ষিণ ও পূর্বদিকের দুটি অবস্থান থেকে শত্রুপক্ষের ওপর গোলাগুলি চলতে থাকে। উদ্দেশ্য শত্রুপক্ষের মনোবল সেদিকে আকৃষ্ট রাখা। অন্যান্য স্থান থেকে যোদ্ধারা অস্ত্র চালনা বন্ধ করে ও অবস্থান ত্যাগ করে কার্গিল ব্রিজের পাশে সমবেত হয়। ঘড়িতে চারটা বেজে যায়। রাত প্রভাত হতে আর বেশি দেরি নেই। লোক চলাচল শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যে৷ ক্রমে ক্রমে যুদ্ধরত দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের অবস্থানের যোদ্ধারাও যুদ্ধ বন্ধ করে পূর্বোক্ত সকল যোদ্ধার সাথে মিলিত হয়। সমগ্র বাহিনীর যোদ্ধারা কার্গিল ব্রিজের পাশে একত্রিত হলে দেখা যায় মুক্তিবাহিনীর কারো প্রাণহানি ঘটেনি, কেউ আহতও হয়নি৷ তখন ষাট জনের সমগ্র বাহিনী বিজিতদের নিকট থেকে অধিকৃত সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রসহ শেষ রাতের প্রায়ান্ধাকারে দক্ষিণ সন্দ্বীপের মাইটভাঙ্গা গ্রামের শিবের হাটে যাত্রা করে।
[১৮] এ.বি.এম. সিদ্দীক চৌধুরী

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!