You dont have javascript enabled! Please enable it!

শৈলকূপা থানা অ্যাম্বুস, ঝিনাইদহ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মুক্তিপাগল মানুষ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুসংগঠিত হয়ে গড়ে তুলেছিল শক্তিশালী প্রতিরোধ বাহিনী। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে এসব বাহিনীর পরিচিত ছিল। এসব বাহিনীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় তাঁবেদার দোসররা। শৈলকূপা থানায় আকবর বাহিনী নামে এমনি এক সুসংগঠিত বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল। এই বাহিনীর একাধিক বীরত্বপূর্ণ অভিযান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। এ বাহিনী প্রধান ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আকবর হোসেন মিয়া ওরফে আকবর চেয়ারম্যান। যিনি ব্যক্তিগত জীবনে দীর্ঘ সময় ধরে ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের ঘটনা শুরু হলে মাগুরা শহরের আকবর হোসেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবন্দের উদ্যোগে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। আকবর হোসেন মিয়া সে সময় মাগুরা শহর ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি শ্রীপুর এলাকায় গিয়ে স্থানীয়ভাবে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ-প্রাপ্তরা ছাড়াও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্রসহ অনেকে এসে এই বাহিনীতে যোগ দেন। তাছাড়া বিভিন্ন ছোট বড় সফল অভিযানেও এই বাহিনী রাজাকার ও পুলিশদের পরাস্ত করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। আকবর বাহিনীর তৎপরতা ছিল মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি ও ফরিদপুর জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। অসম সাহসিকতার সঙ্গে শৈলকূপা থানা সদরকে মুক্ত করার কৃতিত্ব অর্জন করেছিল আকবর বাহিনী, যে সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। ৫ আগস্ট রাতে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে তাঁর বাহিনী শৈলকূপা শহরের সন্নিকটে দামুকদিয়া গ্রামে পৌঁছান। এই গ্রামের আকমল, বিশারত, হুবির, উছির আলী প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ৬ আগস্ট সারা দিন ধরে শৈলকূপা থানার অস্ত্রশস্ত্র, লোকবল ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নেন। নিজেদের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মুক্তিসেনাদের গ্রুপভিত্তিক দায়িত্ব বন্টনসহ থানা আক্রমণের পূর্ণ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। এ সময় থানা ভবনের চারদিকে বালির বস্তা ও কাঁটাতারের বেড়া ছিল। এছাড়া থানার দারোগা, পুলিশ, রাজাকারসহ আশ্রয়গ্রহণকারী সার্কেল অফিসার, বিহারি, সাবরেজিস্টার এবং স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গসহ ৫০/৬০ জন লোক ছিল। রাত এগারোটায় মুক্তিবাহিনীর আলমের নেতৃত্বে মূল আক্রমণকারী দল মাদুকদিয়া থেকে শৈলকূপা থানা অভিমুখে রওনা হয়। রাত দেড়টার দিকে থানা ভবনকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। পাল্টা জবাব আসে থানা ভবন থেকে। গুলি বিনিময়ের এক পর্যয়ে আলম থানা ভবনের কাছে পৌঁছে গেলে বিহারি সাব-রেজিস্টার আলমের চাইনিজ রাইফেল ধরে ফেলে এবং কেড়ে নিতে চেষ্টা করে। ফলে শুরু হয় উভয়ের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি ও টানা- হেঁচড়া। এক পর্যায়ে একটি গুলি আলমের নিজ হাতে লেগে গেলেও আলম বিহারি সাব-রেজিস্টারকে গুলিতে ধরাশায়ী করতে সক্ষম হন। দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময়ের পরও থানায় অবস্থানকারীদের আত্মসমর্পণ করাতে ব্যর্থ হয়ে মুক্তিসেনারা ফিরে আসে দামুকদিয়া স্কুলে তাদের পূর্বের অবস্থানে। সেখানে এলে বাহিনী প্রধান আকবর হোসেন সঙ্গে সঙ্গেই পুনরায় আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে অতি দ্রুত থানার দিকে রওনা হন। ইতোমধ্যে রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আকবর হোসেন থানা ভবনের কিছু দূরে পজিশন নেন এবং আক্রমণের আদেশ দেয়া মাত্রই চারদিক থেকে একযোগে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চলতে থাকে থানা ভবন লক্ষ্য করে। এই আকস্মিক সাঁড়াশি আক্রমণে থানায় অবস্থানকারীরা বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এই দুঃসাহসিক অভিযানে ৫৭টি রাইফেল এবং ৪ হাজার রাউন্ড গুলি আকবর বাহিনীর হস্তগত হয়। ভোরে আশপালের গ্রাম থেকে স্বতঃস্ফূর্ত লোকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন ও তাঁর বাহিনীকে আকাশ-বাতাস কাঁপানো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও উষ্ণ আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে অভিনন্দন জানায়। অবশ্য পরবর্তীকালে শৈলকুপা থানা ভবন আবার দখলদার বাহিনীর হাতে চলে যায়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!