শৈলাবাড়ির যুদ্ধ, সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার জোনগাছা ইউনিয়নের একটি গ্রাম শৈলাবাড়ি। এটি সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকা থেকে মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার দূরে। শৈলাবাড়ি হাইস্কুলসংলগ্ন ও সারদা বাঁধের ধারে একটি বিরাট শিমুলগাছের নিচেই পাক হানাদার বাহিনীর মজবুত ক্যাম্প ছিল। উক্ত ক্যাম্পের উত্তরে ছিল বয়রা স্টিমার ঘাট। সেখানেও একটা ছোট ক্যাম্প ছিল। সে সময় রেলপথই ছিল ঢাকার সাথে সিরাজগঞ্জের যোগাযোগের প্রধান ব্যবস্থা। রেলওয়ে ফেরি এই স্টিমার ঘাটের মাধ্যমে বাহাদুরাবাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। এই কারণে শৈলাবাড়ি এলাকায় স্টিমার ঘাটটি রক্ষা করার জন্য পাকসেনারা স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর রৌমারী ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনী তাদের নিজ মহকুমা হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করার জন্য এক কঠিন শপথ নিয়ে নদীপথে সিরাজগঞ্জ যাত্রা করে। ৮ ডিসেম্বর কাজিপুর থানায় তারাকান্দি নদী ঘাটে পৌঁছে বাংলা বাজারে মুক্তিযোদ্ধা নং ০৩১২০১০০২৮ আমীর হোসেন ভুলুর (সিরাজগঞ্জ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি), দেশের বাড়িতে রাত্রি যাপন করে, সঙ্গে ছিল ট্রেনিংপ্রাপ্ত ২৫০ জনের বাহিনী। সংবাদ এলো দুই-এক দিনের মধ্যে পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জ কওমি জুট মিল, সিরাজগঞ্জ ওয়ারলেস টাওয়ার এবং ট্রেজারি ব্যাংক ধ্বংস করবে। মুক্তিবাহিনী পরদিন অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের শৈলাবাড়ির অদূরে ছোনগাছা মাদ্রাসায় অবস্থান নেয়। স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর তিনটি ইউনিট যা ফ্রিডম ফাইটার, মুজিব বাহিনী ও রহমতগঞ্জের স্থানীয় গ্রুপ যার কমান্ডার ছিল ইসমাইল হোসেন, রৌমারী থেকে আসা অন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে আমির হোসেন ভুলুর নেতৃত্বে যৌথ অভিযান পরিচালনা করার লক্ষ্য স্থির হয়। ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধার তিন সদস্য সিরাজগঞ্জ শহরের পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান রেকি করে আসে। তার আলোকে ছোনগাছা মাদ্রাসায় সকল মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ লিডারদের নিয়ে এক পরিকল্পনা সভা হয়। সভায় সিরাজগঞ্জ মুক্ত করার জন্য পাকবাহিনীর ওপর আঘাত হানার পরিকল্পনা করা হয়। এরপর ১১ ডিসেম্বর সকালের নাশতা শেষ করে ছোনগাছা মাদ্রাসার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে শৈলাবাড়ি পাকবাহিনীর ক্যাম্পের অদূরে ছোট খাটের কাছে মুক্তিবাহিনী প্রাথমিক অবস্থান গ্রহণ করে। এরপর তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যান। মো. ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ খোকশাবাড়ি হাসপাতালে অবস্থান নেয়। হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের উত্তরে বয়রা হাটখোলা এলাকায় মো. ইসহাকের নেতৃত্বে আর একটি গ্রুপ অবস্থান নেয়। এরপর কমান্ডার আমির হোসেন ভুলুর নেতৃত্বে দুপুর ২টার সময় প্রথম গ্রেনেড নিক্ষেপের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, গ্রেনেড এবং এসএলআর, হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। এই যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন: মোঃ জুরান শেখ (এলএমজি ম্যান), শেখ আলাউদ্দিন (আরএল ম্যান), ওসমান শেখ, ওসমান আলী, আব্দুল আহম্মেদ, ফিরোজ ভূইয়া, শাহ আলম, রহমতই হুদা বকুল, সৈনিক খোকন, সৈনিক হামিদ (নং ৩৯৩৮৪০৫, 8 ইস্ট বেঙ্গল কুমিল্লা), ইসমাইল হোসেন, মো. ইসহাক আলী (ডেপুটি কমান্ডার), মো. আমিনুল ইসলাম, শেখ মো. আলাউদ্দিন (ডেপুটি কমান্ডার), মো. গোলাম হায়দার, মো. জহুরুল ইসলাম, মো. আব্দুল আজিজ খান, মো. তোতা মিয়া, মো. নায়েব আলী, মো. সোহরাব, মো. ফজলুল মতিন (মুক্তা), আমির হোসেন ভুলু (কমান্ডার), জুরাইন শেখ, হাসিনুর ইসলাম খান, সৈয়দ মোস্তাক, কাজী ফিরোজ, গাজী সানাউল্লাহ (নং ৬৬৮০৫০৫ এএসসি সেন্টার পাকিস্তান)। এ দিন শেষ রাতের দিকে গোলাবারুদ শেষ হতে থাকলে যুদ্ধের কমান্ডার আমিন হোসেন ভুলু, বকুল হোসেন চাকলাদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে তেকানির চর থেকে গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য নির্দেশ দেন। ১২ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় গোলাবারুদ সংগ্রহের পর আবার তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। শত্রুপক্ষের একটি বাঙ্কার মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয় এবং ১২ তারিখ মধ্যরাতে পাকবাহিনীর সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায় এবং রানী গ্রামের কোবদাস পাড়ায় তাদের স্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় এবং মুক্তিবাহিনী শৈলাবাড়ির স্কুল দখল করে নেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ১১ তারিখ বিকেলবেলা যারা শহীদ হন তারা হলেন আহসান, (মেছড়া ইউনিয়নের খাড়য়া গ্রাম), আহসান হাবিব, তোজাম্মেল, মকবুল হোসেন কালু (গ্রাম কুড়ালিয়া), আ. সামাদ (গ্রাম রঘুর গাতি), সুজাবত, সফর, রাজ্জাক। এরপর মুক্তিবাহিনী ১৩ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর পিছু নিয়ে কোবদাস পাড়ায় অগ্রসর হয় এবং সেখানে মুক্তিবাহিনী আঘাত হানে হানাদার বাহিনীর ওপর। মুক্তিবাহিনীর প্রবল চাপের মুখে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জ থেকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্বে তারা শহরের মুজিব সড়কে ট্রেজারি ব্যাংকের কাছে অবস্থিত ওয়্যারলেস টাওয়ার এবং কওমি জুটমিলের কিছু অংশ ধ্বংস করে দিয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, হানাদার বাহিনী রেলপথে যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনীর এক কমান্ডার আলাউদ্দিনের গ্রুপ দ্বারা আবার আক্রান্ত হয় কালিয়া হরিপুরে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর টিএম শামিম পান্নার নেতৃত্বে একটি রেলব্রিজ ধ্বংস করা হয়। এরপর উপায়ান্তর না পেয়ে হানাদার বাহিনী ট্রাকযোগে সিরাজগঞ্জ ত্যাগ করে। এই সময় মো. ইসহাক আলীর নেতৃত্বে হানাদার বাহিনী আবার আক্রান্ত হয় এবং ৪-৫ জন পাক আর্মি মারা যায়। মুক্তিবাহিনীর আজমল নামের এক যোদ্ধা আহত হয়। এরপর মুক্তিবাহিনী বিজয় ধ্বনি করে এবং সিরাজগঞ্জ কলেজের শহীদ মিনারে সকল মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত