You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোমণির যুদ্ধ, খুলনা

মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনা শহরের শিরোমণি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশলগত স্থান (নোভাল পয়েন্ট)। এলাকাটি জাহানাবাদ সেনানিবাসের নিকটবর্তী এবং এই এলাকার ভেতর দিয়েই যশোর-খুলনা রেলওয়ে ও যশোর-খুলনা মহাসড়ক চলে গেছে। এই শিরোমণিতে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর সাথে পাক-বাহিনীর কয়েকপর্বের এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
শিরোমণি যুদ্ধে একদিকে পাকবাহিনীর ১৫ এফ এফ রেজিমেন্ট ও অজানা সংখ্যক রাজাকার এবং অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর ৩২, ৪২ ও ৩৫০ পদাতিক ব্রিগেড ও মুক্তিবাহিনী অংশ নেয়। যুদ্ধের পূর্বে পাকবাহিনী শিরোমণির টিঅ্যান্ডটি ক্যাবল ফ্যাক্টরিতে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে দু’তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে এবং মুক্তি ও মিত্রবাহিনী (বিশেষত মেজর মঞ্জুর রাজপুত ডিভিশন ও শিখবাহিনী) ফুলতলাতে অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ মিত্রবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের সাহায্যে ভারী অস্ত্র ও ট্যাঙ্কসহ ভৈরব নদ পার হয়ে ব্যারাকপুর, লাকুহাটি, সিদ্দিপাশা এবং ধুনল নামক গ্রামে বকিং পজিশন স্থাপন করে। একইভাবে খুলনা দৌলতপুরের পশ্চিমেও তাঁরা সমাবেশ ঘটায়। ১২ ডিসেম্বর মুক্তিও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে কলারোয়া এলাকা থেকে চুকনগর দিয়ে খুলনার উদ্দেশে (সড়ক পথে) রওনা দেয়। পথিমধ্যে ‘বিনেরপোতা ব্রিজ’ পাকসেনারা ধ্বংস করে দেয়। মিত্রবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোর একটি ভাসমান ব্রিজ তৈরি করে। মূলত এই যৌথবাহিনীই ফুলতলা থানার প্রায় ১৪ মাইল এলাকা জুড়ে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থা গ্রহণ করে। একই দিনের বিকেলে ৪২ পদাতিক ব্রিগেড অগ্রাভিযান শুরু করে এবং ১৩ ডিসেম্বর শ্যামগঞ্জ ফেরি এলাকা দখল করে নেয়। পাক-বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে খুলনার দিকে চলে গিয়েছে মনে করে ১৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ৩০-৩৫টি গাড়ির একটি বহর মেজর গণি এবং মেজর মহেন্দ্র সিং-এর নেতৃত্বে যশোর হয়ে শিরোমণি এলাকাতে প্রবেশ করে। কনভয়টি ইস্টার্ন, আলীম ও আফিল জুট মিল অতিক্রম করে বাদামতলা চক্ষু হাসপাতালের কাছে আসামাত্রই প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রগুলো একযোগে কনভয়ের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। ওই ফায়ারে আনুমানিক আড়াই-তিন শ’ মিত্রবাহিনীর সৈন্য নিহত হয়। অতঃপর ১৪ ডিসেম্বর ৩৫০ পদাতিক ব্রিগেড কর্তৃক তিনটি পর্বে শিরোশণি আক্রমণ সংগঠিত হয়। প্রথমপর্বে মাত্র ৪ ঘণ্টার যুদ্ধে (১৫ ডিসেম্বর) ১ জাঠ রেজিমেন্ট সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আক্রমণ চালিয়ে শ্যামনগর দখল করে নেয়। দ্বিতীয়পর্বে ৪ শিখ রেজিমেন্ট পূর্ব শিরোমণি এলাকা দখল করে। এবং তৃতীয়পর্বে ১৬ ডিসেম্বরে অন্য একটি ব্যাটালিয়ন পশ্চিম শিরোমণি এলাকা নিজ দখলে নেয়। এই যুদ্ধের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সমগ্র দেশে আত্মসমর্পণ করলেও খুলনাতে তার ব্যত্যয় ঘটে। তবে ১৬ ডিসেম্বর রাতে মিত্রবাহিনী ফের আক্রমণ করলে পাকসেনারা আত্মসম্পণে বাধ্য হয় এবং ১৭ ডিসেম্বর সকালে তারা অস্ত্র পরিত্যাগ করে। পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ আনুমানিক ৩৭০০ সৈন্য নিয়ে এ আত্মসম্পণে নেতৃত্ব দেন।
এ যুদ্ধে দখলদার পাকবাহিনীর দুই শ’ জন নিহত, দুই শ’ জন আহত, চারটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস এবং চারজন অফিসার, একজন জেসিও এবং ছাব্বিশজন বিভিন্ন পদবির সেনা যুদ্ধবন্দি হয়। অপরপক্ষে মিত্রবাহিনীর প্রায় আড়াই-তিন শ’ জন শহীদ, তিন শ’ জন আহত এবং দুইটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়।
[৫৯৯] ইকবাল জাফর খন্দকার

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!