শালদা নদীর দ্বিতীয় যুদ্ধ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
৮ সেপ্টেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছুটা সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হলেও পাকবাহিনীকে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব হয়নি। প্রথম আক্রমণের পর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে মেজর সালেক চৌধুরী শালদা নদী সাব- সেক্টরের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন গাফ্ফার -এর নিকট অর্পণ করে সদর দপ্তর মেলাঘরে চলে যান। গাফ্ফার সাহেব দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকেই চিন্তা করতে লাগলেন যে, পাকবাহিনীকে কীভাবে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিতাড়িত করা যায়। সে উদ্দেশ্য নিয়ে ক্যাপ্টেন গাফ্ফার মূল ঘাঁটি মন্দভাগ থেকে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য কৃষকবেশে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের নিকট যান। ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের নদীর বিপরীত দিকে একটি বিরাট নিম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে শত্রুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলেন। পাকবাহিনীর এক সদস্য ক্যাপ্টেন গাফ্ফারকে দেখে ফেলে এবং সাথে সাথে তাঁর উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়ে। অবশ্য পাকবাহিনীর গুলিতে ক্যাপ্টেন গাফ্ফারের কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি। সন্ধ্যার পর গোলাগুলি বন্ধ হলে তিনি সাব- সেক্টরের সদর দপ্তর কোনাবনে ফিরে আসেন। পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝতে পারলেন যে, শত্রুদের প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী। নদীর তীর বরাবর মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের সামনে তারা চারটি পরিখা (বাংকারে) খনন করেছে। শালদা নদী গোডাউনের পাশ দিয়েও তারা শক্তিশালী পরিখা খনন করেছে। এ অবস্থায় তাদেরকে কাবু করার উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন গাফ্ফার চারদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা নেন। পরিকল্পনাটি নিম্নরুপ:
(১) নায়েক সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব পাশে পাহাড়ি জায়গায় এক প্লাটুন সৈন্য মোতায়েন করেন।
(২) সুবেদার মঙ্গল মিয়ার অধীনে আরেক প্লাটুন সৈন্য পাঠানো হয় শালদা নদীর গোডাউনের নিকটে।
(৩) সুবেদার বেলায়েতকে আরেক প্লাটুন সৈন্য দিয়ে শালদা নদীতে শত্রুদের ঘাঁটির বিপরীতে পাঠানো হয়; মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যাতে পেছন দিক থেকে কোন প্রকার আক্রমণ করতে না পারে।
(৪) সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈন্য সুবেদার মঙ্গল মিয়ার পিছনে অবস্থান নেয়। এছাড়া পাকসেনাদের মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর জন্য চারটা আক্রমণকারী দলকে (রেইডিং পার্টিকে) অন্যান্য অবস্থান যথা বড়ধুলিয়া, চাঁদলা, কায়ামপুর, সাহেব বাড়ি, গোবিন্দুপুর ও কাইয়ুমপুরের ঘাঁটিতে রাতে হঠাৎ রেইড করার জন্য বলা হয়েছিল। এই সকল ঘাঁটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। হঠাৎ এই ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণ করলে তাদের অবস্থান রক্ষার জন্য মর্টার ও কামানের গোলা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নিক্ষেপ করবে। এভাবে তাদের মর্টার ও কামান গোলা অনেকটা কমে আসবে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮ অক্টোবর রাত ১১টায় ৪(চার)টি রেইডিং পার্টি ক্রমান্বয়ে পাকবাহিনীর ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে, এতে উভয় পক্ষের অনেক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে ভোর রাতে তার সমাপ্তি ঘটে। সবাই নিজ নিজ বাংকারে চলে যায়। পাকবাহিনী সকালবেলা বিহারি ও রাজাকারদের পাহারায় মোতায়েন করে তারা বিশ্রামে যায়। ৯ অক্টোবর সকাল ৮টার সময় মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। সুবেদার মঙ্গল মিয়া শালদা নদী গোডাউনের পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের ওপর গুলি চালাতে থাকে। সুবেদার বেলায়েত নদীর পাড় থেকে নদীর ওপারে শত্রুদের পরিখার ওপর গুলি ছুঁড়তে থাকে। নায়েক সুবেদার সিরাজ পাহাড়ি অবস্থান থেকে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যেই প্রচণ্ড গোলাগুলি চলতে থাকে। নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ হোসেনের আর.আর.এর গোলার আঘাতে নদীর পারে অবস্থিত চারটি পরিখার মধ্যে দুইটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। শত্রুরা বিধ্বস্ত দুইটি পরিখা ত্যাগ করে অন্য দুইটি পরিখায় চলে যায়। এই দিক থেকে সুবেদার বেলায়েত সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাহিনীর নিয়ে নদী সাঁতরিয়ে গিয়ে বিধ্বস্ত পরিখায় অবস্থান নিয়ে নেন। এর ফলে শত্রুরা দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। তখন শালদা নদী গোডাউনে অবস্থানরত পাকবাহিনীর সাথে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত পাকবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কোন প্রকার উপায় না দেখে এবং কোন প্রকার সাহায্যের আশায় না থেকে শালদা নদীর গোডাউনে অবস্থানরত পাকবাহিনী গোডাউনের পাশ দিয়ে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনে তাদের অবস্থানে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে মঙ্গল মিয়া তার বাহিনী নিয়ে শালদা নদী গোডাউনটি দখল করে নেন। দুপুর ১১টার সময় পাকবাহিনীর একটি ম্যাসেজ ক্যাপ্টেন গাফ্ফারের ওয়ারলেসে ধরা পরে। এতে তারা কর্তৃপক্ষকে জানায়, মুক্তিবাহিনী তাদেরকে যেভাবে আক্রমণ করেছে, তাতে এ মুহূর্তে তাদের পক্ষে এ ঘাঁটিতে টিকে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। এই ম্যাসেজ ধরার পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরো বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। ক্যাপ্টেন গাফ্ফার সৈন্যদেরকে আরও তীব্রভাবে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আরো গতিশীল করার পর শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত পাকবাহিনী ধীরে ধীরে রেললাইন দিয়ে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনে তাদের অপর ঘাঁটিতে পালিয়ে যেতে থাকে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সমগ্র শালদা নদী এলাকা দখল করে নিয়ে নিজেদের আধিপত্যকে শক্তিশালী করে তুলেন, যাতে করে পাকবাহিনী শালদা নদী পুনর্দখল করে নিতে না পারে। দুই নং সেক্টরের সদর দপ্তর মেলাঘর থেকে খালেদ মোশাররফ এ জয়ের খবর শুনে নতুন এলাকা দেখার জন্য মিত্র বাহিনীর কমান্ডারকে নিয়ে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একথা শুনে ক্যাপ্টেন গাফফার পাকবাহিনী যাতে শালদা নদী রেল স্টেশন, শালদা নদী বাজার পুনর্দখল করতে না পারে এ ব্যবস্থা নিঃচ্ছিদ্রভাবে সম্পন্ন করেন। প্রতি আক্রমণের (কাউন্টার এ্যাটাকের) সম্ভাবনা দেখে শালদা নদী রেলস্টেশন এবং নয়নপুর রেল স্টেশনের মাঝামাঝি অবস্থানে তার বাহিনী অবস্থান নেয়। শালদা নদী বাজার এবং চাঁদলা এলাকার মাঝামাঝি সুবেদার বেলায়েতের প্লাটুন অবস্থান নেয়। পরদিন ১০ অক্টোবর সকাল নয়টার সময় হেলিকপ্টারে করে মিত্রবাহিনীর ৫৭ ডিভিশনের কমাণ্ডার জেনারেল জগত সিং ও জেনারেল গনজালভেস আসেন। খালেদ মোশাররফ সড়ক পথে চলে আসেন। ক্যাপ্টেন গাফফার তাদের সকলকে নতুন এলাকা দেখানোর সময় পাকবাহিনী প্রতি-আক্রমণ করে। সুবেদার বেলায়েতের সৈন্যবাহিনী তা প্রতিহত করেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় শত্রুর একটা বুলেট সুবেদার বেলায়েতের বুকের বাঁ পাশে আঘাত করে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে চিকিৎসার জন্য সেক্টর-২ এর হাসপাতালে পাঠানো হলেও পথিমধ্যে তিনি শহিদ হন। শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল করার পর প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। যেমন—২১টা ৩০৩ রাইফেল, ৫টা হালকা মেশিনগান, এম.জি.আই-এ-৩–৩টা, ম্যাগজিন বক্স ২টা, হালকা মেশিনগান ম্যাগাজিন ৩১টা, বেটাগান ২টা, রকেট লাঞ্চার ৪০ এম এম ১টা, অয়্যারলেস সেট পি-আর-সি-৬২ ১টা, হারিকেন ৩টা, গোলাবারুদ ২০, ২৫০টা ২ ইঞ্চি মর্টার, বোমা ২০০টা, ৬০-এম-এম- মর্টার বোমা ৭২টা, ৩০৩ বল ১০ হাজার, ২ইঞ্চি মর্টার বোমা ধোয়া ৪টা, টেলিফোন সেট ৩টা, জেনারেটর ১টা, পি-আর -সি-১০ অয়্যারলেস সেট ব্যাটারিসহ ৫টি, ট্রানজিষ্ট্রার ৩ ব্যান্ড ১টা এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য রসদ ও অসংখ্য কাপড় চোপড়। এ ছাড়াও ব্যারেল হোল্ডার ২টি, এম-জি স্পেয়ার ব্যারেল ২টা, ম্যাপ এবং বিভিন্ন ধরনের নথিপত্র। তাদের নথিপত্র থেকে জানতে পারা যায় ৩০ পাঞ্জাবের ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানি এখানে মোতায়েন ছিল। উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলছিল। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সুবেদার বেলায়েত ও সুবেদার মঈন শহীদ হয়েছিলেন এবং ৬ জন আহত হয়েছিলেন। পাকবাহিনীর প্রায় ১০০ জন নিহত এবং ধৃত হয়। এর মধ্যে ১২ জন পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধারা জীবিত অবস্থায় ধরতে পারেন। শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে কৃতিত্বের সঙ্গে লড়াই করে পাকবাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য বাংলাদেশ মুজিবনগর সরকার সেনাবাহিনীর তরফ থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে ক্যাপ্টেন গাফ্ফারকে বীরত্বসূচক ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে সম্মানিত করে।
[৫৯৪] মোঃ আবু মুসা
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত