You dont have javascript enabled! Please enable it!

শাহপুর গড়ের যুদ্ধ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

২২ নভেম্বর পাকবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট দলদলি সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল তখন নিরূপ: মহানন্দা নদীর অপর তীরে আলীনগর-মকররমপুরে অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী, দলটির অধিনায়ক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রায়হান। আলমপুর-কায়সাবাড়ি প্রতিরক্ষা অবস্থানের অধিনায়ক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম ও আলতাফ হোসেন। আর শাহপুর গড়ের প্রতিরক্ষা অবস্থানের অধিনায়ক ছিলেন নায়েক ওয়াসিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি শেষ বর্ষের ছাত্র সানোয়ারও তখন এখানে অবস্থান করছিলেন। বলতে গেলে আকস্মিকভাবেই পাকবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর কামান গর্জে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ডানদিকে শাহপুর গড় এলাকার ওপর পাকসেনারা আক্রমণ করে বসে। অন্ধকার রাতে এ অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ফলে শাহপুর গড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে দলদলিতে চলে যান। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা নদী অতিক্রম করে আলীনগরেও চলে যান। পাকসেনারা তাই অতি সহজেই শাহপুর গড় দখল করে নেয়। পরে আলমপুর-কায়সাবাড়ি প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর কাছে তখন দুটি ৮১ মিলিমিটার মর্টার ছিল- একটি আলীনগরে, অন্যটি কায়সারবাড়িতে। মুক্তিবাহিনী সারাদিন মর্টারের গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অগ্রবর্তী দল আলমপুর আম বাগানের পূর্বদিকে অবস্থান গ্রহণ করে পাকসেনাদের অগ্রযাত্রা রোধ করেন। সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজি নুরুজ্জামান এই সময় ওয়ারলেসের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা লেফটেন্যান্ট রফিকের সঙ্গে কথা বলেন। শাহপুর গড় থেকে মুক্তিবাহিনীর পশ্চাদপসরণের ব্যাপারে তিনি খুবই রেগে ছিলেন। তাই অবিলম্বে আক্রমণ রচনা করার জন্য লেফটেন্যান্ট রফিককে নির্দেশ দেন। কর্নেল জামানের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিনই রাত ১-৩০ মিনিটে মুক্তিবাহিনী শাহপুর গড়ের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে বসে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর মোহদীপুর থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে এসে নৌকাযোগে খাল অতিক্রম করেন এবং শাহপুর গড়ের পূর্বকোণে অবস্থান নেন। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের আগে শিবরামপুর, রহনপুর ও শাহপুর গড়ের একযোগে কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করে শত্রুরা। আলীনগর-মকররমপুর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর ৮১ মিলিমিটার মর্টারও গর্জে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে শিবরামপুর ব্রিজের অপর প্রান্তে অবস্থিত পাক অবস্থান ও রহনপুরে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পাকবাহিনী যেন ধারণা করে যে, রহনপুরে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর মূল আক্রমণ হয়েছে। অল্প সময়ের ভেতরেই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের বাহিনী পুবদিক থেকে শাহপুর গড়ের ওপর আক্রমণ চালায়। লেফটেন্যান্ট রফিক, নজরুল, আলতাফ ও ওয়াসিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শাহপুর গড়ের সম্মুখ ও পশ্চিম দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর পাকসেনারা শাহপুর গড় ছেড়ে বিষ্ণুপুর ও কসবা এলাকায় পালিয়ে যায়। সেক্টর কমান্ডারলেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজি নুরুজ্জামান এই যুদ্ধের সার্বিক নেতৃত্ব দেন। শাহপুর গড়ের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ১৪ জন শহীদ হন। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ রেজা, জামির আলী, শামসুদ্দিন, গফুর, আমির আলী, ওয়াসিল, দুলুর রহমান, আলতাফ হোসেন ও সালাউদ্দিনসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। শাহপুর গড় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসছে, ঠিক এমনি সময়ে চর বাগডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে শুরু হয়ে যায় অপারেশনের প্রস্তুতি। ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়োজিত ইপিআর সুবেদার ইসমাইল সহযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে অপারেশনের বিষয় ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিতির চেষ্টা করছিলেন, তখন ফরিদপুর বিওপি থেকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ একদল গেরিলা মুক্তিসেনা নিয়ে চর বাগডাঙ্গায় উপস্থিত হন। গেরিলা দলটিতে ছিলেন নবাব জায়গির গ্রামের শামসুল হুদা, জয়েন্দিপুরের ইসমাইল, সুন্দরপুরের এনামুল হক, মর্দানা বিরহামপুরের রফিকুল ইসলাম, সুন্দরপুর বাগডাঙ্গার গোলাম মোস্তফা বাঘা, বাহার আলী, মফিজুদ্দিন, ইয়াহিয়া গাহালু, নামোশঙ্কারবাটির ইলিয়াস, মোস্তাফিজুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, দিনাজপুরের আবুল হোসেন। এঁদের সবাই গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন।
[৬] আব্দুল আজিজ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!