শাহবাজপুর অভিযান, সিলেট
শাহাবাজপুর বারবার অপারেশন চলছে। পাকসেনারা জ্বালিয়েছে ঘরবাড়ি, স্কুল বিদ্যালয়, মরেছে মানুষ যার সঠিক তথ্য বের করা কঠিন হয়ে উঠেছে। নভেম্বরের শেষপ্রান্তে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চেহারা পালটে যায়। ক্রমশ পাক হানাদাররা মুক্তিপাগল বাঙ্গালিদের হাতে মার খেয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। নভেম্বরের শেষদিকে এক রাতে মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পাক হানারদের ওপর। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন প্রিয় স্বদেশের অবরুদ্ধ ভূমি উদ্ধারের জন্য লড়াইয়ে ব্যস্ত। বড়লেখা থানার শাহবাজপুর তখনও পাকহানাদারদের কবলে। তাদের নির্যাতন শাহবাজপুরে এতো নারকীয় রুপলাভ করছে যার ফলে গোটা শাহবাজপুরবাসী তটস্থ। এলাকার অনেক বাঙালি তাদের হাতে নির্মম হত্যার শিকার। ধর্ষিত নারীদের আহাজারিতে আকাশ- বাতাস প্রকম্পিত। মুক্তিসেনারা পাকহানাদারদের শাহবাজপুর ঘাঁটি আক্রমণে প্ৰস্তুত নেন তখন। বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হন সারপারে। সেদিন ছিল বুধবার। শাহবাজপুর বাজারের হাটবার। এদিনই যুদ্ধ বাধে দু’পক্ষের মধ্যে। পাক আর্মিরা লাতু শাহবাজপুর স্টেশন বাজার থেকে আক্রমণের জবাব দিতে থাকে। রাত্রির দ্বিপ্রহরের গভীর নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যায় মর্টার আর শেলিং গুলির আওয়াজে। সারারাত্রি গুলি বিনিময়ের পরও থামেনি। পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ চলে উভয় পক্ষে। সুনাই নদীর দু’তীরে দু’পক্ষের অবস্থান এবং যুদ্ধরত হাজারখানেক যোদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্রের আওয়াজে আতঙ্কে বাঙ্গালিরা হতবাক হয়ে যান। এ অপারেশনে শেষ পযন্ত মুক্তিসেনারা পিছু হটে এবং পাক হানাদাররা সারপার দখল করে নেয়। এ অপারেশনে মুক্তিসেনাদের একজনের লাশ পীরেরচক গ্রামে পড়ে থাকতে দেখেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। এছাড়া ইসলামপুরে একজন এবং নয়াগ্রামের একজন মোট দু’জন নিরীহ নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত হয়। ৭ টি গবাদিপশু এলোপাতাড়ি গুলিতে প্রাণ হারায়। রাতের অন্ধকারে হতাহতের সঠিকভাবে জানা দুঃসাধ্য ছিল। তবে এ অপারেশনে উভয়পক্ষের হতাহতের তালিকা প্রলম্বিত হবে এমনটা ধারণা এলাকার লোকের। এরপর শাহবাজপুর আক্রমণের প্রস্তুতি চলে উভয়পক্ষে। মুক্তিসেনাদের সারপার অবস্থানের সংবাদ প্রাপ্তির পর পাক হানাদাররা সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি চালিয়ে যায় দ্রুত। রাজাকারদের সহায়তায় নিরীহ মানুষদের ভীতি প্রদর্শন করে শত শত নৌকা নিয়ে সুনাই নদী দিয়ে উজানে তাদের নিয়ে যেতে বাধ্য করে। তারা এ কাজ করে মুক্তিসেনাদের নদী পাড়ি দেওয়ার পথ রুদ্ধ করতে প্রয়াস পায়। দিনের পর দিন না খেয়ে ও নিরীহ বাঙালিরা প্রাণভয়ে পাকিস্তানীদের আদেশ-নির্দেশ পালন করতে বাধ্য হয়। বড়লেখার মুক্তিযুদ্ধে এ অপারেশন এক উল্লেখযোগ্য রণাঙ্গনের স্মৃতি বহন করছে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত