মিরেসরাইয়ের প্রতিরোধ যুদ্ধ, চট্টগ্রাম
মিরেসরাই হল চট্টগ্রামের একটি থানা, যার অবস্থান চট্টগ্রাম জেলার পশ্চিম দিকে। থানাটির পশ্চিম দিকে ফেনী নদী, দক্ষিণ দিকে সিতাকুণ্ড থানা। পূর্বদিকে ফটিকছড়ি ও উত্তর দিকে রামগড় এলাকা। ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর, আনসার ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি কোম্পানি। এটি মিরসরাইতে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। মূল প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল। মিরেসরাইয়ের প্রতিরোধ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করে অগ্রসর হয়, যেমন- মুক্তিযোদ্ধাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল রামগড় অভিমুখে পাকবাহিনীর যে কোনো অভিযান বন্ধ করা ও প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম দিকেই পাকবাহিনীকে আঘাত করে বস্তুগত ও মানসিকভাবে দুর্বল করা এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করা। মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে কেন্দ্র করে তিনটি দলে বিভক্ত হয় মুক্তিবাহিনী। একটি দল মিরসরাই থানার ১০০০ গজ দক্ষিণে খালপাড় বরাবর অবস্থান নেয়। ২য় দলটি থানার ঠিক দক্ষিণ দিকে ও অপর দলটি থানার উত্তর পার্শ্বে খালের কাছে ব্রিজ এলাকায় একে অপরের ৭০০ গজের মধ্যে অবস্থান নেয়। এই অবস্থানটি ছিল অনেকটা ইংরেজি অক্ষর ঞ এর মতো। প্রায় ১০০ জনের মতো যোদ্ধা ১টি মেশিনগান, ১২টি হালকা মেশিনগান, ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ১টি রিকয়েললেস রাইফেল নিয়ে এই দলের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন অলি আহম্মেদ। এভাবে তারা উল্লিখিত ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বরাবর অর্থাৎ মিরসরাই থানার দক্ষিণ খালপাড়, অন্যটি দক্ষিণে, অপর দল উত্তর দিকের খালের ব্রিজের কাছে অবস্থান নেয়। এই কোম্পানি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসমূহ প্ৰথম প্লাটুনের সম্মুখভাবে স্থাপন করে। প্রত্যেক দল ৫০০/৭০০ গজ দূরে একে অপর থেকে অবস্থান গ্রহণ করে। ২০ এপ্রিল পাক-বাহিনীর একটি বড় কনভয় দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হলে, ৫০ গজ দূরে থাকা ১ম দলটি তাদের অধিনায়কের নির্দেশে পাকিস্তানী বাহিনীর সবচেয়ে পিছনের গাড়িটাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এদিকে সর্ব সামনের গাড়িটিকেও অন্য দলটি আক্রমণ করে। আর ২০ গজ দূরে মর্টার নিয়ে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার সিদ্দিক মাঝের ট্রাকগুলোর ওপর গোলাবর্ষণ করে। ক্যাপ্টেন অলি আহম্মেদ গেলেন ২য় দলটিতে শক্তি বৃদ্ধি করতে এবং সেখান থেকে সুবেদার সাইদুল হকের নেতৃত্বে আরো ত্রিশজনকে ১ম দলটির সাথে যোগ দিতে বললেন। অর্থাৎ তিন দিক থেকে আক্রমণ হয় ও ১ম দলটি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে আক্রমণে যোগ দেয়। পাকবাহিনীর ট্রাকে আক্রমণ করলে সৈন্যরা লাফিয়ে পড়তে শুরু করে রাস্তার দুপাশে। এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। আর দুদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান গর্জে উঠলে, এ যুদ্ধে ১৫০ জনের মতো পাকসৈন্য হতাহত হয়। এই প্রতিরোধ যুদ্ধ ১২ ঘণ্টার মতো স্থায়ী হয়েছিল। এ যুদ্ধে পাকবাহিনী ধরাশায়ী হলেও ক্যাপ্টেন অলি কৌশলে পশ্চাদপসরণ করেন কারণ ভোরের আলো ফোটার পর পাকসেনাদের থেকে জোরালো আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে এই যুদ্ধকে অনেকেই পাক-বাহিনীর উপর অন্যতম বড় আঘাত বলে মনে করেন৷ এই প্রতিরোধ যুদ্ধে ইপিআর এর ল্যান্সনায়েক কালাম অসমসাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন হালকা মেশিনগান নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে অস্ত্রের পরিখা ত্যাগ করলে শত্রুর মর্টারের আঘাতে শহীদ হন ল্যান্স নায়েক কালাম। এছাড়া হাবিলদার সিদ্দিকও গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এই যুদ্ধে মিরসরাই এলাকার জনসাধারণের আন্তরিক সহযোগিতা ছিল উল্লেখযোগ্য।
[৫৯৭] কে. এম. আহসান কবীর
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত