মানিকনগর যুদ্ধ-৩, মেহেরপুর
ক্যাপ্টেন এ.আর. আজম চৌধুরী জুলাই মাসের শেষ দিকে বারবার মানিকনগরের দিকে মনোযোগ দেন। এখানে পাকসেনাদের ক্যাম্প থাকায় মুজিবনগর এলাকার পবিত্রতা এবং নিরাপত্তা রক্ষা করা দুরূহ হয়ে ওঠে। হাবিলদার আবু তৈয়ব এবং ল্যান্স নায়েক রহমতুল্লাহ খান সোনার যৌথ নেতৃত্বে এক শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধা দল ১ আগস্ট মানিকনগর আক্রমণ করে। পাকসেনারা হাল্কা অস্ত্রের সাথে সাথে ভারী মেশিনগান ব্যবহার করে। এক ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে মাত্র একজন পাকসেনা নিহত হয়। যুদ্ধের এ ফলাফলে ক্যাপ্টেন চৌধুরী সন্তুষ্ট হতে পারেন না। তিনি মানিকনগরের জন্য নতুন করে যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বলেন। মুক্তিযোদ্ধা এস. এম. আল আমিন বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে ভিন্ন রকমের প্রস্তুতি নেয়। আগস্ট মাসের ২ তারিখে গোভীপুরে বাগানের মধ্যে টহলরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর রাজাকাররা গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা অতিদ্রুত পজিশন নিয়ে প্রতিআক্রমণ রচনা করলে রাজাকাররা পিছু হটে পালিয়ে যায়। পিছন থেকে গুলি ছুঁড়লে দু’জন রাজাকার আহত হয়। এই একই দিনে সুবেদার মালেকের নেতৃত্বে নিয়মিত বাহিনীর একটি প্লাটুন কাথুলি বিওপিতে পাকবাহিনীর অবস্থানে প্রবল হামলা চালায়। এক ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধের তাৎক্ষণিক ফলাফল জানান যায়নি। তবে পাকবাহিনী এ দিনই সন্ধ্যা নাগাদ কাথুলি থেকে তাদের আস্তানা গুটিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী অবস্থান ভাটপাড়ায় চলে আসে। এরপর কাথুলিতে মুক্তিবাহিনী অবস্থান গ্রহণ করে। পরদিন মানিক নগরেও ঘটে অনুরূপ ঘটনা। সেখান থেকেও পাকবাহিনীকে আস্তানা গুটাতে হয়। ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর কাছ থেকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের পর এস. এম আল আমিন অতি দ্রুত হৃদয়পুর থেকে ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন দুর্ধর্ষ ডাকাত প্রকৃতির সাহসী লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রায় ৪০/৪৫ জনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়- গভীর রাতে সবাই মিলে একযোগে মানিকনগরে গিয়ে পাকসেনা ক্যাম্পের চতুর্দিকের বাংকারে হ্যান্ড গ্রেনেন্ড, বোমা ছুঁড়তে হবে। তাদের দায়িত্ব এ টুকুই। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই এক রাতের নবমুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে মতিন পাটোয়ারী সি কোম্পানির ৯নং প্লাটুনের অধিকাংশ সৈনিকসহ রাত দুটোর পর রওনা হয় মানিকনগরে। বোমা-বাহিনী যথারীতি ৩০টি বাংকারে অত্যন্ত সফলভাবে বোমা নিক্ষেপ করে। একই সঙ্গে গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সব কটি হাতিয়ার। মাত্র ৩০/৪০ মিনিটের মধ্যে যুদ্ধ শেষ। অধিকাংশ পাকসেনা এবং রাজাকার খতম হয়ে যায়। সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গে মানিকনগর থেকে ক্যাম্প উঠিয়ে নিয়ে যায় ভৈরব নদীর পূর্বপারে, মোনাখালি ঘাটে। মুক্তিবাহিনী মানিকনগর থেকে ২৭টি এন্টি পার্সন মাইন উদ্ধার করে। মানিকনগর ও বলল্পভপুরে টহল দিয়ে ৮২ মি. মি. মর্টার বোমা উদ্ধার করা হয়। আগের দিন কাথুলি ক্যাম্প থেকেও ৩টি এন্টি ট্যাংক ও ৯টি এ্যান্টিপার্সন বোমা উদ্ধার হয়। মানিকনগর থেকে পাকবাহিনীর ক্যাম্প উঠে যাবার পর কার্যত মুজিবনগর এলাকা অনেকাংশেই মুক্ত হয়ে যায়। এলাকার মানুষ স্বস্তি পায়। কেদারগঞ্জে হাট বসতে শুরু করে। মানুষ মাঠের ফসল ঘরে তোলে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প হৃদয়পুর থেকে তুলে এনে মুক্ত অঞ্চল সোনাপুরের হাবিবুর রহমানের বাড়িতে স্থাপন করা হয়। আবার সি কোম্পানির অনেক মুক্তিযোদ্ধাই সাতক্ষীরার কলারোয়া থানায় চলে যায় যুদ্ধে অংশ নিতে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে মানিকনগর এবং কাথুলি থেকে এভাবে ক্যাম্প গুটিয়ে মেহেরপুরের পাকবাহিনী তাদের প্রতিরক্ষাবলয় সংকুচিত করে আনার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল ভীষণ বেড়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত সাফল্য সম্পর্কে জনৈক বিদেশী কূটনীতিক মন্তব্য করতে গিয়ে নিউয়র্ক টাইমসের যুদ্ধ সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গকে বলেন: ভিয়েতকংরা যদি যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মধ্যে এই রকম অবস্থায় পৌঁছতে পারতো তবে একে চমকপ্রদ সাফল্য বলে গণ্য করতো।
[১০৩] রফিকুর রশীদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত