You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাদারীপুরের শেষ যুদ্ধ

ডিসেম্বরের প্রথমদিকে মাদারীপুরের বাইরের সবক’টি থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। পাকবাহিনী এই সময় মাদারীপুর শহরে অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন তারা শহরের চারপাশ থেকে একযোগে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাবেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের এই রকম চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রস্তুতির মুখে ৮ ডিসেম্বর কলাগাছিয়ার প্রধান ক্যাম্পে সংবাদ এল, আজ ভোররাতেই সড়কপথে হানাদার বাহিনী মাদারীপুর ছেড়ে ফরিদপুরের দিকে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করেছে। সাথে সাথে চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের এই খবর পাঠানো হলো। পরিকল্পনা মোতাবেক মাইন পোঁতা হলো সমাদ্দার ব্রিজের দু’পাশে। মুস্তাফাপুরের পর থেকে বিরাট এলাকার সড়কপথের দু’পাশে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিলো সন্ধ্যারাত থেকেই। রাত জেগে কঠোর সতর্ক প্রহরায় প্রত্যেকটি মুক্তিযোদ্ধা। নির্দেশ ছিল ঘটকচর ব্রিজ পার হয়ে এগিয়ে আসা মাত্রই পেছন থেকে আক্রমণ করতে হবে পলাতক হানাদার বাহিনীর ওপর। ভোররাতের দিকে পাকদস্যুরা ৮টি ট্রাক এবং ১টি সামরিক জিপে চেপে তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও মুজাহিদ বাহিনীসহ তল্লি-তল্পা নিয়ে মাদারীপুর ছেড়ে রওনা দেয়। ঘটকচর ব্রিজ পার হয়ে হানাদার বাহিনী কিছুদূর এগুতেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা পেছনদিক থেকে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। গুলির শব্দ পেয়ে সমাদ্দার ব্রিজের চারপাশে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা আরও সতর্ক হয়ে ওঠে। পেছনদিক থেকে তাড়া খেয়ে পাকদস্যুরা তাদের গাড়িবহরসহ আরও বেগে সমাদ্দার ব্রিজে গিয়ে ওঠে। সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দে মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। আর বিস্ফোরণ ঘটতেই ব্রিজসহ ওদের দু’টি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে নিচে পড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড গোলাবৃষ্টির মধ্যে ছুটোছুটি করতে করতে হানাদাররা ব্রিজের দু’পাশে তৈরি করা তাদের পুরনো বাঙ্কারগুলোতে আশ্রয় নিয়ে পাল্টা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। ৯ ডিসেম্বর সারাদিন ও সারারাত ধরে যুদ্ধের পর ১০ ডিসেম্বর দুপুরে মুক্তিযোদ্ধারা মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তাতে সাড়া দিয়ে পাকবাহিনীর সদস্যরা বাঙ্কার থেকে রাইফেলের মাথায় শাদা জামা উচিয়ে দেখায়। ওরা তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত, ওদের হাতের অস্ত্রগুলো জ্যাম হয়ে গেছে। তাই আত্মসমর্পণের কথা বলে বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী খালে নেমে ওরা পানি পান করে এবং গাড়ির মধ্যে রাখা শুকনো খাবার ইত্যাদি খায় এবং আহারপর্ব শেষ হতেই হঠাৎ করেই ওরা গুলির পেটিসহ আবারো বাঙ্কারে নেমে গিয়ে মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু করে বেঈমানির পরাকাষ্ঠা দেখায়। কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ ওদের অস্ত্র আবার অচল হয়ে পড়ে এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হয় সরোয়ার হোসেন বাচ্চু, হাফপ্যান্ট পরা ছোট্ট বাচ্চুর ছুঁড়ে দেয়া গ্রেনেডের আঘাতে বাঙ্কারের ভেতরে হানাদার দস্যুদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করে৷ মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গুরুতর আহত হয় আক্তার হোসেন। অপরপক্ষে পাক হানাদার বাহিনীর প্রায় ৪০ জন সৈন্য নিহত হয়। মেজর খটক ও ক্যাপ্টেন শহীদসহ ৭০ জন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। এছাড়া রাজাকার, মুজাহিদ ও আলবদর বাহিনীর অসংখ্য সদস্য মুক্তিবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় অথবা তাদের হাতে বন্দি হয়। পাকবাহিনীর এখানকার এই যুদ্ধে পরাজয়ের ভেতর দিয়ে মাদারীপুর জেলা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়।
[৭] সংকলন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!