You dont have javascript enabled! Please enable it! বৃহত্তর ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর এলাকায় ব্যাপক গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ নানাবিধ যুদ্ধাপরাধ - সংগ্রামের নোটবুক

মাকমত হায়াত, ব্রিগেডিয়ার (১০৭ ব্রিগেড)
মঞ্জুর আহম্মেদ, ব্রিগেডিয়ার (৫৭ ব্রিগেড, পিএ-৩৪১৪)
আফ্রিদী, কর্নেল (৩৮ এফএফও ৫০ পাঞ্জাব সম্মিলিত কোম্পানী)
এহসান, লে. কর্নেল
শামস্-উল-জামান, লে. কর্নেল (২২ এফএফ, পিএ-৪৭৪৫) মতলব হোসেন, লে. কর্নেল (১৮ পাঞ্জাব)
শোয়েব, মেজর
এম ইয়াহিয়া হামিদ খান, মেজর (৬ পাঞ্জাব, পিএ-২৮১৮) শের-উর-রহমান, মেজর (ট্যাঙ্ক বাহিনী)
জাহিদ, মেজর (১৮ পাঞ্জাব)
রাঠোর, মেজর
রানা, মেজর
জয়েন্ট, মেজর
আফজাল, মেজর
লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্
মোহাম্মদ ইকবাল, ক্যাপ্টেন (১২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, পিএসএস-৮৯৭৭)
মুজাফফর হোসেন নাগভী, ক্যাপ্টেন (১৮ পাঞ্জাব, পিএসএস-৯৩৮৭)
আনিম খান, সুবেদার মেজর
এনায়েত খান, হাবিলদার

ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর।
অপরাধ: মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে মেজর জেনারেল আনসারীর ৯ম ডিভিশনের হেড কোয়ার্টার যশোর থেকে মাগুরাতে স্থানান্তর করা হয়। জেনারেল আনসারীর নির্দেশে ব্রিগেডিয়ার মনজুর আহমেদ তার ৫৭ ব্রিগেড ও অধীনস্থ অন্যান্য ইউনিট নিয়ে বৃহত্তর ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর এলাকায় ব্যাপক গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ নানাবিধ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটায়।
ঝিনাইদহ জেলায় এই পাকিস্তানী আর্মিরা কমপক্ষে ৬০০০ নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করে। ৫১টি গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। ১৮ এপ্রিল ক্যাপ্টেন ইকবাল ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক হালিম খানকে তাঁরই বাংলোর পেছন দিকে নিয়ে বেয়নেট ও তলোয়ারের নির্মম আঘাতের মাধ্যমে হত্যা করে। কর্নেল রহমানের (বাঙালি) কাছ থেকে টাকা, ঘড়ি ইত্যাদি কেড়ে নেয়।
পাকবাহিনী বর্তমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী বসন্তপুর গ্রামের অধিবাসীদের স্থানীয় স্কুল মাঠে জড়ো করে নির্মম অত্যাচারের পর নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এতে সেদিন ১৯ জন নিহত হন। ১৪ অক্টোবর শৈলকুপার গ্রামগুলোতে এরা নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সবার উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়, বহু ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে, অন্তত ২৮ জনকে হত্যা করে।
১৮ পাঞ্জাবের মেজর জাহিদ ও মেজর শের-উর-রহমান ১০ ডিসেম্বর তাদের বাহিনী নিয়ে কুষ্টিয়ার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে অপারেশন চালায়। এ দিনের যুদ্ধে নিহত মাঠ ও রাস্তার উঁচু ঢালে পড়ে থাকা মিত্রবাহিনীর সেনাদের মৃতদেহগুলোর উপর ট্যাঙ্ক চালিয়ে এই মেজর জাহিদ ও মেজর শের-উর-রহমান তাদের বাহিনী নিয়ে অত্যাচার করে এবং মৃতদেহগুলো ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ও বিকৃত করে৷ এই নিহতদের মধ্যে ভারতীয় এক জেনারেলের পুত্রও ছিলেন। গণহত্যায় এই দু’জনের বিশেষ কৃতিত্বের জন্য সিতারা-ই-জুরাত উপাধি দেয়া হয়। এখানে অপারেশনে আরও যারা অংশ নেয় তাদের মধ্যে মেজর রাঠোরের (প্রকৌশলী) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মাগুরার মোহাম্মদপুরে লে. কর্নেল এহসান ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চালায়। ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে কর্নেল আফ্রিদীর নেতৃত্বে ৩৮ এফএফ ও ৫০ পাঞ্জাবের দু’টি কোম্পানি অপারেশনে অংশগ্রহণ করে। প্রথমে তারা মাগুরার কাছাকাছি এলাকায় এবং পরে মধুমতির পূর্ব পাড়ের গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালায়।
ব্রিগেডিয়ার মনজুর রাজাপুর থেকে দর্শনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটায়। সে পাকশীর হার্ডিঞ্জ সেতু, জীবননগর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া প্রভৃতি এলাকায় অপারেশন চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটায়।
লে. কর্নেল শামস ২২ এফএফ বাহিনী নিয়ে হার্ডিঞ্জ সেতু এলাকা এবং যশোরের বেনাপোলে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ব্রিগেডিয়ার হায়াত পরে এদের সাথে যোগ দেয়৷
পাকসেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মহেশপুর এসে হাসপাতালে ঘাঁটি স্থাপন করে। সৈন্যদের কিছু অংশ থানায় অবস্থান নেয়। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে আরম্ভ করে। এ ছাড়াও তারা বাড়ি বাড়ি থেকে মালামাল লুট করে। এ সময় তারা যাকে সামনে পায় তাকেই হত্যা করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে ধরে আনত। এইসব লোকদের সৈন্যরা হাসপাতালের কক্ষে আটক রেখে নির্যাতন চালাত। মহেশপুরে পাক সৈন্যদের প্লাটুন কমান্ডার ছিল সুবেদার মেজর আনিস খান। তার নির্দেশে সৈন্যরা মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জ, বারোবাজার, খালিশপুর, চৌগাছা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে লোকজন ধরে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করত।
চৌগাছা থানা ও ডাকবাংলোতে এই পাক সেনারা ক্যাম্প স্থাপন করে। এখানে ডাকবাংলোর পেছনে বন্দিদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে সেই গর্তেই তাদেরকে পুঁতে রাখত। এদের মধ্যে বেশির ভাগই থাকত ভারতগামী শরণার্থী।
লুৎফর রহমান মোল্লা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাঁর উপর যে নির্যাতন চালানো হয় তার নেতৃত্ব দিয়েছিল মেজর মুজাফ্ফর হোসেন নাগভী। নাগভীর বুটের আঘাতে লুৎফর রহমানের বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। মিল পাড়ার কোহিনূর বেকারীর মালিককেও তারা এখানে সপরিবারে হত্যা করে।
২৭ বেলুচের ব্রিগেডিয়ার দূররানী ও তার অধীনস্থ অফিসাররা ১৬-৩০ এপ্রিল এই ১৫ দিনে কুষ্টিয়ায় অন্তত ২০ হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। উপরন্তু কুষ্টিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসে হত্যা করা হয় ৫০ হাজার বাঙালিকে।
কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। এখানে সন্দেহভাজন বাঙালিদের ধরে এনে তারা হত্যা করত। অধ্যাপক দুর্গাদাস সাহাকেও এখানে হত্যা করা হয়। এই সব হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিত ক্যাপ্টেন নাগভী।
১২ মে তার নির্দেশে আলমডাঙ্গায় ঢুকে পাকবাহিনী লুটপাট চালায় এবং হাটবোয়ালিয়ার কাছে বহু লোককে গুলি করে মাথাভাঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়।
একাত্তর সালের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন পাকবাহিনী রাজাকারসহ দারিক গ্রাম ঘেরাও করে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে প্রায় এক’শ নিরীহ বাঙালিকে। তারপর বাদবাকি সবাইকে দড়ি দিয়ে লাইন করে বেঁধে হাঁটিয়ে নদীর তীরে নিয়ে যায়। এক একজনকে জবাই করে নদীতে ফেলতে থাকে। এই পাকিস্তানী পশুরা দারিক গ্রামটি সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় এবং গ্রাম থেকে কিশোরী, যুবতী, গৃহবধূসহ দুইশ’ জনকে ধরে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই অনেক মেয়েকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে৷
সাক্ষী: চিনিবাস সরকার
৯ ডিসেম্বর এই পাকসৈন্যরা বাটিয়ামারা (কুমারখালী, কুষ্টিয়া) গ্রামে হামলা করে। এদিন গ্রামের সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দিয়ে যায়। গ্রামে যাকে পায় তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করে এবং প্রায় ৫০ জন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়৷
পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা প্রবেশের সময় ঝিনাইদহ সড়কের পাশের সকল বাড়ি- ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং যুবতী মেয়েদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। দু’পাশের গ্রাম লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকলে ২০ জন নিহত হন। তারা ডিঙ্গেদহ বাজারে ২৫/৩০ জনকে হত্যা করে। ১৫ ও ১৬ এপ্রিল এখানকার প্রায় ২০০ (মতান্তরে ৪০০) ব্যক্তিকে হত্যা করে। ১৮ এপ্রিল বাড়ি থেকে ধরে এনে সাংবাদিক-রাজনীতিক মল্লিকপাড়ার মোহাম্মদ আলীসহ আরও অনেককে হত্যা করে। পাকসেনারা ছাত্র যুবকদের ধরে নিয়ে কখনও গুলি করে, কখনও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করত। এই সমস্ত লাশ চুয়াডাঙ্গা আধুনিক হাসপাতালের পাশে পুঁতে রাখা হতো। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদীর চারপাশের গণকবরে পাওয়া গেছে হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ, মা বোনদের শাড়ি, ব্লাউজের বিধ্বস্ত অংশ। এসব গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের সাথে উপরোক্ত পাকিস্তানী অফিসাররা সরাসরি জড়িত ছিল।
উপরোক্ত সকল পাকিস্তানী অফিসার ও তাদের দোসরদেরকে বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্ত করা যায়।
[১৪] ডা. এম.এ. হাসান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত