You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাইটভাঙ্গার যুদ্ধ, সন্দ্বীপ

১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে রক্তাত অভিযানে সন্দ্বীপের বীর মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা এই দিনে সন্দ্বীপের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় সর্বপ্রথম রচনা করে। জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে এই দিন তারা সর্বপ্রথম নিঃশেষে নিজ প্রাণ দান করার জন্য মুখোমুখি দাঁড়ায় সুশিক্ষিত পাক পুলিশ, রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি সম্মিলিত বাহিনীর। সন্দ্বীপের বীর সন্তানদের স্বাধীনতার জন্য প্রথম যুদ্ধ। গভীর রাত, প্রায় একটা হবে। মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিক ১। আবুল কালাম ২। রফিক উল্ল্যা ৩। রফিকুল মাওলা ৪। আবদুল বাতেনসহ প্রায় দশ বারোজন এবং সেই সঙ্গে বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরও কতিপয় মুক্তিবাহিনীভুক্ত সৈনিক মাইটভাঙ্গা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়কে সম্মুখে রেখে এর চারদিকে অস্ত্রশস্ত্র স্থাপন করে ব্যূহ রচনা করে। অতঃপর তারা কমান্ডারের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকে। সমস্ত গ্রাম ঘুমে অচেতন, নীরব নিস্তব্ধ। এমন সময় মুক্তিবাহিনীর সাইরেন বেজে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথমে গ্রামবাসীদের মাইকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, যুদ্ধ শুরু হলে তারা যেন কেউ বাসগৃহের বাইরে না আসে এবং ঘরের ভেতরও যেন কেউ দাঁড়িয়ে বা বসে না থাকেন। তা না হলে বিপদ ঘটবার আশঙ্কা অধিক। এরপর বিপক্ষ দলকে সম্বোধন করে বৃথা রক্তপাত ও প্রাণহানি বন্ধ করবার জন্য তাদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান হয়। প্রত্যুত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষ থেকে সঙ্গে সঙ্গে তাদের একমাত্র অস্ত্র ৩০৩ রাইফেল গর্জন করে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে তখন ত্বরিৎ গতিতে সঙ্গে সঙ্গে মাইকে গ্রামবাসী জনসাধারণকে হুশিয়ার করে দিয়ে আগের নির্দেশ পালন করতে পুনরায় অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আপনারা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করবেন না। শুয়ে থাকবেন। নির্দেশ দানের পরেই স্কুলের চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনীর মেসিনগান, স্টেনগান, গ্রেনেড ইত্যাদি একসঙ্গে ভীষণ গর্জন করে ওঠে। প্রবল যুদ্ধ চলতে থাকে। সমস্ত গ্রাম ও চারদিকের নৈশ আকাশ বাতাস, বৃক্ষ, লতা ও আবাসগৃহসহ সবকিছু থরথর করে কাঁপতে থাকে উভয় পক্ষের অস্ত্রের গর্জনে। জনসাধারণের কানের পর্দা বিদীর্ণ হওয়ার উপক্রম হয়। পাক বাহিনী বিদ্যালয়ের দ্বিতলে অবস্থান করলেও অন্ধকারে মুক্তি বাহিনীর কাউকেও দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু শব্দ লক্ষ্য করে অনুমানে গুলি চালাচ্ছিল। আর মুক্তিবাহিনী বিদ্যালয়ের দ্বিতলের দিকে অব্যর্থ লক্ষ্যে তাদের গোলাগুলি নিক্ষেপ করছিল। প্রায় এক ঘন্টা তুমুল লড়াইয়ের পর পাকবাহিনীর একজন নিহত হয়। এর পনের বিশ মিনিট পরে আর একজন নিহত হয়। এর প্রায় আধঘন্টা পরে আর একজন নিহত হয়। এই সময় মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে পুনরায় মাইকে পাক বাহিনীকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, তোমরা আত্মসমর্পণ কর, নতুবা আমাদের নিকট এমন অস্ত্র আছে যা প্রয়োগ করলে সমগ্র বিদ্যালয় ভবন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে পাক বাহিনীর আরও দু’জন গুরুতর আহত হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে। তাদের গোলাগুলিও ফুরিয়ে আসছিল। নিরুপায় হয়ে পাক বাহিনী ইতোমধ্যে স্বল্প চন্দ্রালোকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য শ্বেত পতাকা উত্তোলন করে। তা দেখে মুক্তিবাহিনীও যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ব্যুহ ভঙ্গ করে না। যুদ্ধ বন্ধ করে মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার পাক বাহিনীর সকলকে অস্ত্র পরিত্যাগ করে দু’হাত উর্দ্ধে তুলে একের পর একজনকে দ্বিতল হতে নিচে নামার জন্য মাইকে নির্দেশ দেন। অবিলম্বে সে আদেশ কার্যকর হয়। পাকবাহিনীর প্রায় পনের কুড়ি জন সকলে নিচে নামার সাথে সাথে মুক্তিবাহিনী তাদের সকলের হাত বেঁধে ফেলে এবং তাদের পরিত্যক্ত সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়। নিশা তখন অবসান প্রায়। নিকটবর্তী মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বিজয় গৌরবে উদ্দীপ্ত মুক্তিবাহিনী তখন এক কৌতুকাবহ ঘটনার অবতারণা করে। যুদ্ধে পরাজিত বন্দিদের হাত বেঁধে বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে সারিবদ্ধভাবে সকলকে বসিয়ে তাদের সকলের চোখ দৃঢ়ভাবে বাঁধা হয়। অতঃপর মুক্তিবাহিনী প্রধান বন্দিদের সম্বোধন করে বলেন, আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। নামাজের সময় হয়েছে। আমরা নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদে চললাম। আমরা নামাজ শেষ করে এখানে ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমরা এখানে বসে থাক। তারপর আমরা ফিরে আসলে তোমাদের বিচার হবে। সাবধান! কেউ পালাবার চেষ্টা করো না। করলে তোমাদের প্রহরী হিসাবে যে মুক্তি সৈনিকদের এখানে রেখে যাচ্ছি তারা সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের গুলি করবে। এই বলে সমস্ত গোলাগুলি ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনী রাতের স্বল্পান্ধকারে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। প্রহরী দু’জন অদূরে বসে পরস্পরে কথা বলতে থাকে। তাদের কথোপকথনের শব্দ শুনে বন্দিরা বুঝতে পারে, রক্ষীরা ঠিকই নিকটে আছে। এদিকে ক্রমেই ভোরের আলো ফুটে ওঠতে থাকে। কথোপকথনে রত রক্ষীদ্বয়ের কথোপকথন ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে এবং একসময় আর শোনাও যাচ্ছিল না। নিরস্ত্র বন্দিরা কিন্তু ভয়ে তথাপি বসেই থাকে। তারা ধারণা করে, প্রহরীরা নিশ্চুপ হয়ে নিকটেই কোথাও অবস্থান করছে। এদিকে ক্রমে ক্রমে চারদিকে একেবারে ফর্সা হয়ে যায়। দু’চারজন কৌতূহলী গ্রামবাসী তথায় এসে সমবেত হয়। তারা চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় বন্দিদের সেখানে অবস্থান করতে দেখে জিজ্ঞেস করে, এভাবে এখানে বসে আছেন কেন? বন্দিরা আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বিবৃত করলে গ্রামবাসীরা বলে, কই এখানে তো কোনো রক্ষী নেই। তখন বন্দিদের চোখ ও হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। বন্দিরা বুঝতে পারে, কৌশল অবলম্বনে মুক্তিবাহিনী তাদের নির্বোধ সাজিয়ে এখানে বসিয়ে রেখে তাদের অস্ত্রশস্ত্রাদিসহ নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। যুদ্ধে মৃত তিনজন ও আহত দু’জনসহ পাকবাহিনী সন্দ্বীপ টাউনে প্রত্যাবর্তন করে আহত দু’জনকে স্পেশাল নৌকাযোগে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে পাঠায়। কারণ, তাদের আঘাত ছিল খুবই গুরুতর। সন্দ্বীপে চিকিৎসা সম্ভব ছিল না। মৃত ব্যক্তিদের যথারীতি দাফন করা হয়। এই ঘটনার পর হতে সন্দ্বীপ থানার পাক বাহিনীর মনোবল বহুল পরিমাণে কমে যায়। ভয়ে তারা সন্দ্বীপ টাউনের বাইরে কোথাও যেতে সাহস করতো না। মাইটভাঙ্গা গ্রামের পুলিশ ক্যাম্পও পুনরায় স্থাপন করা হয়নি। মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব ও কার্য তৎপরতা দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে অনেক বেড়ে যায়।
[৩৩] এ.বি.এম. সিদ্দীক চৌধুরী

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!