You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বশাসন সংগ্রামে পূর্ববঙ্গ | কৌশলের পর কৌশল - সংগ্রামের নোটবুক

স্বশাসন সংগ্রামে পূর্ববঙ্গ | কৌশলের পর কৌশল

আইয়ুব কর্তৃক গণতন্ত্র স্তব্ধ করার কৌশল নিয়ে আলাদা একটা সাবজেক্ট খোলা যায়। অদ্ভুত সব কর্মকান্ড করেছেন তিনি পূর্ব বাংলাকে করায়ত্ব করতে। আর বারবার পিছলে যাচ্ছিলো দক্ষ সব রাজনীতিবিদ আর সাংবাদিকদের কৌশলে।

প্রেসিডেন্ট পদ আঁকড়ে থেকেও ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আয়ুব খান কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে পারেন নি। তবে এর ফলে ঐ আন্দোলন যে বাধাপ্রাপ্ত হয় সে কথা সত্য। অসন্তোষের যে-কারণগুলাে এই আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়েছে তাদের অপনােদন দূরের কথা প্রশমনের চেষ্টাও হয় নি। কেন্দ্রীয় সরকার বরং কিছু প্রতীকী শব্দগুচ্ছ উপহার দিয়ে উত্তেজনা সামাল দিতে চেয়েছে। তার প্রকৃত সমাধানের চিন্তাও করে নি কখনও। ১৯৬২-র সংবিধানের উদ্বোধন লগ্ন থেকে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবির সামাল দিতে মৌল গণতন্ত্রের প্রতীক এবং অর্থবৈষম্য বিলােপ দাবির মুখােমুখি জাতীয় আর্থিক পরিষদ নামের প্রতীকী সমাধান বাতলানাে হয়। এই পরিষদ গঠিত হয় ১৯৬২-র সংবিধানের ১৪৫ ধারা অনুসারে। অর্থসারূপ্য, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্বপাকিস্তানের পিছিয়ে-পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে অতি দ্রুত দেশের দুই অঙ্গের মধ্যে সমতা ফিরিয়ে আনতে নানা পরিকল্পনার খসড়া করার দায়িত্বও ঐ আর্থিক পরিষদের উপর ন্যস্ত ছিল। বৈষম্য দূরীকরণের কাজে ফী বছর সংসদে অগ্রগতি-সংবাদ পেশও করতে বাধ্য ছিল পরিষদ। শুধু কি তাই ? প্রতি প্রাদেশিক আইনসভা ঐ অগ্রগতি-সংবাদের কপি বা অনুকৃতিও পাবে—এমন কথা ছিল। দেশের দুই অঙ্গের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠায় এভাবে আদানুন খেয়ে লেগে পড়ায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সাধারণ পূর্বপাকিস্তানীর মনে ইতিবাচক সাড়াও নিশ্চয়ই জাগিয়ে থাকবেন সে সময়। অবশ্য ১৯৬৪-র ১৩ই আগস্ট জাতীয় ব্যবস্থাপক সভাকক্ষে অর্থাৎ সংসদে মাহাবুবউল হক যে ভাষণ দিলেন তা ছিল প্রচারে বিভ্রান্ত পূর্ববঙ্গের অতি-সরল অংশের কাছে নিতান্তই মােহমুগর। মাহাবুবউল বলেন, ‘মহাশয়, ১৯৬২-র মতাে ১৯৬৩-র বছরটা অতিক্রান্ত হয়েছে। ১৯৬৪-ও অতিক্রান্ত হতে চলেছে। জাতীয় আর্থিক পরিষদ আজ অবধি কোনাে রিপাের্ট পেশ করে নি। যদিও তা ছিল সাংবিধানিক কর্তব্য। অর্থাৎ, সংবিধান প্রয়ােগ আমরা কতােটুকু করছি। তারই একটি নমুনা এই পরিষদের কার্যধারা।’ (১)
একই সমতার লক্ষ্যে জাতীয় অর্থ কমিশনও প্রতীকী অর্থে উৎসর্গীকৃত ছিল। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উন্নয়নখাতে পূর্বখণ্ডের জন্য বরাদ্দ হয়েছে পশ্চিম খণ্ডের চেয়ে ঢের কম। মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য। কতােদূর তা না জেনে বৈষম্য দূর কোনাে ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। তথাপি ১৯৬৩ তে গঠিত জাতীয় আয় কমিশনের রিপোের্ট প্রকাশিত হবার পূর্বেই এই পরিকল্পনায় স্থির করা হয়ে যায় যে এই পাঁচবছরে পরিকল্পনা মারফৎ পূর্বপাকিস্তানে মাথা পিছু ৪৯২ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে মাথা পিছু ৭৬৬ টাকা ব্যয় করা হবে। গৃহীত নীতি যে পূর্ব-পশ্চিম অঙ্গ দুটোর মধ্যে বৈষম্য আরাে বাড়িয়ে তুলবে এই সহজ সত্য চাপা দিতে সমতা এল ঐ’এমনি জোর প্রচার চালানাে হ’ল সরকারী তরফ থেকে। তৃতীয় পরিকল্পনা সমাপ্ত হলে ঐ বৈষম্য এক পঞ্চমাংশ হ্রাস পাবে, এমন গাণিতিক সংকেতও ছিল ঐ প্রচারে। এই সব বেহিসাবী আশ্বাস দেওয়ার অভ্যাস গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী সরকারের তাে থাকবেই। (২)
পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সৌষম্য চাইলে অনেক পিছিয়ে পড়া পূর্বপাকিস্তানের জন্য অর্থবরাদ্দ সাময়িক ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ঢের, ঢের বেশি ধরতে হত। ১৯৬৪-৬৫তে পশ্চিমের বরাদ্দ ১৯৫ কোটির চেয়ে মাত্র ১০ কোটি টাকা বেশি পূর্ববঙ্গের জন্য বাজেটে বরাদ্দ করা হয়। বি, ডি-দের ভােটর বছর খুসি রাখতে কর্মপ্রকল্পেও পূর্বপাকিস্তানীদের বরাদ্দ ২৫ কোটি টাকা অন্ততঃ পশ্চিমপাকিস্তানের বরাদ্দ ১৫ কোটি টাকার চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এলাকার জন্য ধরা ৭৩ কোটি টাকার উপকারটুকু-ও তাে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পাবেন। বৃহৎ সিন্ধু উপত্যকা পরিকল্পনায় ৮৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হলে, তার উপকারও পশ্চিম পাকিস্তানীরাই পাবেন। প্রতিরক্ষাই তাে মােট বাজেটের অর্ধেক টেনে নেয়। এ-ও তাে পূর্বপাকিস্তানীর উপকারে তেমন আসে না। অতএব বাজেট বহির্ভূত নানা খাতে এখনও পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বার্থই পূর্ব পাকিস্তানীর চেয়ে সমধিক রক্ষা পাচ্ছে – এই সত্য চাপা দিতে প্রচারের মাত্রা আরাে বাড়ানাে হ’ল। (৩)


সামুদ্রিক জলকে লবণমুক্ত করার প্রকল্পে ৮০০ কোটি টাকা খরচ করে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বার্থ ভাবছে যখন কেন্দ্রীয় সরকার, পূর্বপাকিস্তানের ১৯৬৫ র ১১ই মের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন এক কোটি মানুষের কথা তখন তাদের কাছে কোনাে ব্যাপার-ই মনে হয় নি। খয়রাতির বহর থেকেই তা বােঝা যাবে। অন্ততঃ ২০০ কোটি টাকার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সম্পত্তির ক্ষতির সঙ্গে সরকারী অট্টালিকা প্রভৃতির মেরামতি এবং পুনর্নির্মাণ ব্যয়ে ৩০০ কোটি টাকা প্রয়ােজন – এই সব ভীষণ সংবাদের মুখে কেন্দ্র ত্ৰাণকার্যে দান করলাে ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা। এই প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও কেন্দ্রীয় সরকার তার বাঙালী-বিদ্বেষ ভােলে না। ১৯৬২-র চার চার বার বন্যার তাণ্ডবেও এটা তারা মনে রেখেছিল। ১৯৬৫-র ঘূর্ণিঝড়ের সাত দিনের মধ্যে প্রাদেশিক গভর্নরকে দেখাও যায় নি দুর্গত মানুষদের এলাকায়। উপকূল অঞ্চলে যে বাঁধ এবং প্রাচীর নির্মাণ এ সবের প্রতিরােধে অবশ্য করণীয় তার প্রতি চরম অবহেলা দেখাতাে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই ১৯৬৩ র ১৭ই জুন পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদ সৈয়দ মুহম্মদ হাবিবুল হক বলেন, ‘লবণমুক্ত জলের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার যে ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে তার এক চতুর্থাংশ ব্যয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্ত করা যেত পূর্ব পাকিস্তানের বহু মানুষকে চির অবহেলিত বাঁধ এবং প্রাচীর নির্মাণের মাধ্যমে। নিষ্ঠুরতার চেয়েও অসহ্য ঠেকে মেকী সহানুভূতি। ৩০০০ মাইল কর্দম-প্রাচীর গাঁথার সরকারী পরিকল্পনা পূর্বপাকিস্তানীদের সেই কারণে আরাে ক্ষুব্ধ করলাে। ঐ প্রাচীর তাে সামান্য ঝড়েই ধ্বসে যাবে – এ তাঁরা অভিজ্ঞতায় দেখেছেন। সরকারী খয়রাতির হাস্যকর অপ্রতুলতা প্রসঙ্গে সংসদে আজিজুর রহমান বলেন, ‘ছুটি ছাঁটায় শৈলশহর মুরীতে প্রমােদ ভ্রমণ করতে পেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত পূর্বপাকিস্তানীদের কথা মনে আসবে কী করে?’ (৪)
ঢাকা শহরে কিছু অট্টালিকা বা রাস্তা নির্মাণ করলেও গ্রামীণ অর্থনীতি ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। আয়ুবের রক্ষাকবচ তার আশ্রিতদের সকল দুর্নীতির পরেও অভয় দিত। গঙ্গা কপােতাক্ষ পরিকল্পনায় কাজের নামে বর্ষার মুখে কিছু খাল খনন করা হত। বর্ষা নামলে সে কাজ ধুয়ে মুছে যেত। কাঁচা গাঁথুনিরও হত একই দশা। অথচ ঠিকাদাররা পুরাে কাজের দাম আদায় করে নিত। সে-কাজের পরিমাণ যাতে না করা যায় তার জন্যই তাে বর্ষার মুখে কাজের ধুম পড়ে যায়। যে কাঁচা গাঁথুনির কথা বলা হ’ল তা ঐ কর্মপ্রকল্পের অন্তর্গত। মার্কিনী খয়রাতি খাদ্য বেচে পাওয়া টাকায় ঐ প্রকল্প শুরু হয় হাভার্ড-এর পরামর্শ দাতাদের অন্যতম রিচার্ড গিলবার্টের অনুরােধ-উপরােধ ইত্যাদির চাপে। আয়ুব শেষ পর্যন্ত গিলবার্টের পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য হন। কর্মপ্রকল্পের কোন স্তরে আয়ুবচক্রের কৃতিত্বসূচক কোনাে কথা বলার নেই। (৫)
১৯৬৪-র আমলে পূর্বপাকিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে মাথাব্যথা প্রকাশ করাটা আয়ুবগােষ্ঠীর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। ঐ বছরও যে ৯ টি শিল্প নূতন করে স্থাপিত তার সব কটি হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে একটিমাত্র শিল্পের কিছু সম্প্রসার ঘটে। আমদানি বাণিজ্যে ১৯৬০ সালে মধ্যবিত্ত পূর্বপাকিস্তানী যে-সুযােগ প্রথম পান, অচিরাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী ধনী বণিকদের স্বার্থে তা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়। এই উদ্দেশ্যে আমদানি সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ সরকারপক্ষ পাল্টে ফেলে ১৯৬৬ সালে। (৬)
ন্যূনতম যে-বরাদ্দ পূর্ববঙ্গের প্রকল্পাদির জন্য কেন্দ্র বরাদ্দ করে থাকে, তাও অব্যবহৃত হয়ে কেন্দ্রের অর্থ কেন্দ্রের-ই হাতে থেকে যেন যায়, সেই উদ্দেশ্যে নিমণি প্রকল্পের জন্য অবশ্য প্রয়ােজনীয় সিমেন্ট, লােহার রড, এ সবের অনুমতি আটক রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময়সীমা এই ভাবে পার করে দেবার চক্রান্ত সফল হলে পর ঐ কেন্দ্রের কর্তারাই বলে বেড়ান, পূর্ব পাকিস্তান সরকার, কেন্দ্র-প্রদত্ত অর্থের ব্যবহারের যােগ্যতাই রাখে না। ১৯৬৩-র ১৭ই জুন রামিজুদ্দিন, কেন্দ্রের ছড়ানাে কুৎসার যােগ্য উত্তর দিতে এই তথ্য পেশ করেছিলেন। (৭)।
পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের স্বার্থে শিল্প-ঋণ প্রতিষ্ঠান ই, পি, আই, ডি, সি নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিল্প এককগুলি ঐ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে তুলে দিত। অন্যদিকে পি, আই, সি, আই, সি নামের অপর প্রতিষ্ঠান ২৫ লাখ টাকার কম মূল্যের ঋণ দেওয়া বন্ধ করে, পূর্ব পাকিস্তানীদের জন্য তার দরজা বন্ধ করে দিল। ২৫ লাখ টাকার চেয়ে বেশি মাপের শিল্প স্থাপনের সাধ্য তাঁদের ছিল না, ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী ধনী ব্যবসায়ীদের। যে-একটি ব্যাঙ্ক ঋণ দিত, তার ঋণের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কাজের কাজ কিছু হত না। ২৫ লাখ টাকার কম ঋণ এই ব্যাঙ্ক-ই দিত, যা ছিল অকেজো। ১৯৬৩-র মার্চ থেকে সরকারের নূতন ঋণদান নীতির সমালােচনা করে মাহাবুবউল হক এবং আবদুল মুস্তাকুইম চৌধুরী ভাষণ দিয়েছিলেন ঐ বছরের ১লা অগাস্ট সংসদ সমক্ষে।(৮)
১৯৬৬-র মার্চে উৎপন্ন পণ্যের উপরে শুল্ক বা একসাইজ ডিউটির পরিবর্তে শিল্প এককের উৎপাদন ক্ষমতার উপরে আয়কর এবং বিক্রয়কর বসানাে হ’ল। এই মর্মে সংবিধানের যষ্ঠসংশােধনী বিল উপস্থাপিত হলে পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদরা তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁরা বলেন, নূতন শিল্পের পথে শ্রমিক, বাজার ইত্যাদির বহু সমস্যা। লিখিত উৎপাদন ক্ষমতার একটা অংশমাত্র কার্যক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়। করের এই অন্যায় বােঝা বয়ে পূর্বপাকিস্তানের শিল্পপতিরা – যাঁরা এই উদ্যোগ সবে মাত্র নিয়েছেন তাঁরা পশ্চিমী প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিদের ধাক্কায় উৎখাত হয়ে যাবেন। আয়ুবের মুসলিম লীগের সদস্য ফজলুল কাদের চৌধুরী পর্যন্ত বলেন, নিয়মানুবর্তিতায় আস্থাশীল সদস্য না হলে তিনি এই বিলের বিরুদ্ধে ভােট দিতেন। ১৯৬৫- ৬৬ র বাজেটে মূলধনী পুঁজির উপর সাড়ে বারাে শতাংশ কর ধার্য হওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পায়ন এমনিতেই ব্যাহত হচ্ছিল। তদুপরি নূতন এই বিল পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের একচেটিয়া অধিকারের ক্ষেত্র প্রসারিত করা ভিন্ন অন্য কিছুই ছিল না। (৯)
১৯৬৫ র সেপ্টেম্বরে ভারত পাকিস্তান বিরােধের সময় ভারত থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ থাকে। বস্ত্রশিল্প, আভ্যন্তরীণ জলযান, নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি চরম সঙ্কটে পড়লাে এর ফলে। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের কয়লা সঙ্কটে কোনাে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে নি। ইটের প্রস্তুতিতে নিযুক্ত অজস্র মানুষ এই সময় বেকার হয়ে যান। রঙ এবং রাসায়নিকের আমদানির জন্য আলপত্র বা লেটার অব ক্রেডিটের কার্যকারিতা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হ’ল পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমহল। পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত ব্যাঙ্কগুলির হাতেই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা বন্টনের সুযােগ। ‘প্রথমে আবেদন করেছে’ – এই অজুহাতে এই সম্পর্কিত সবটুকু বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানীদের ইতােমধ্যে প্রদত্ত হয়েছে – এই সংবাদটুকুই শুধু প্রাপ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদের। স্থানীয় ব্যাঙ্কে ঐ মর্মে সংবাদ এসেছিল। পূর্ব পাকিস্তান বিরােধী কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্রের অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে রইল ঘটনাটি। (১০)

১৯৬২ র সংবিধানের ভণ্ডামির সূত্রে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের মৈত্রী প্রসারে ৫০ লক্ষ টাকার বরাদ্দকে ব্যঙ্গ করে সিরাজুল ইসলাম মিঞা জানান, ১৯৬৩ র ৩১ শে জানুয়ারী পর্যন্ত গৃহনির্মাণে পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে ২ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা এবং করাচি পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার ফলে করাচি সহ পশ্চিম পাকিস্তান পেয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। শুধু করাচির-ই ভাগে পড়েছে প্রায় দশ কোটি টাকা। সমরবিভাগের নিয়াৈগ পরিষদের ১৬ জন। সদস্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানী মাত্র এক জন। অথাৎ ১৯৬২-র সংবিধানের পরে বৈষম্য কমছে না, বাড়ছে। (১১)
১৯৬০-৬৫ র মধ্যে অর্থাৎ দ্বিতীয় পরিকল্পনাকালে করাচি এবং চট্টগ্রামে দু’টি তৈল শোধনাগার স্থাপিত হবে’- এমন প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও ১৯৬৪ র মার্চ নাগাদ করাচির শােধনাগার স্থাপনকর্ম বেশ এগিয়ে গেলেও, চট্টগ্রামেরটি থেকে গেল শুধু কথার কথা।(১২)
আখতার উদ্দিন আহমদ ১৯৬৪-র ২৭ শে জুন সংসদে বিবৃত করলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীদের নূতন ব্যাঙ্ক খােলার দরখাস্ত সরকার বাক্সবন্দী অবস্থায় ফেলে রেখেছে। ১৮ টি বিধিবদ্ধ ব্যাঙ্কের ১৬ টি যেখানে পশ্চিম খণ্ডের, এবং ৩৩ টি বীমা কোম্পামির মধ্যে পূর্বখণ্ডে কেন্দ্রীয় কার্যালয় মাত্র ৩ টির এই যেখানে অবস্থা, তখন সরকারী বিজ্ঞাপন বন্টনের কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা করা হ’ল বীমা কোম্পানি গুলির জন্যে। এর কুফল পড়বে পূর্ব পাকিস্তানী বীমা কোম্পানিদের উপর। যে বীমা কোম্পানি গুলির কেন্দ্র পশ্চিম পাকিস্তান, তারা পশ্চিম পাকিস্তানে ২৮ কোটি টাকা বিনিয়ােগ করলেও পূর্ব পাকিস্তানে করেছিল মাত্র ২ কোটি টাকা বিনিয়ােগ। অথাৎ শিল্পপুঁজি সংগ্রহের উৎসও যেন পূর্ব পাকিস্তানীরা না পেতে পারেন, কেন্দ্রীয় শাসকচক্র সেই ব্যবস্থাই করে চলেছেন এ সময় (১৩)
পশ্চিম পাকিস্তানেই অবস্থিত ছিল পাকিস্তানের মােট ছ’টি বাস-ট্রাক নির্মাণের কারখানার প্রত্যেকটি। তথাপি আয়ুব পুত্রের গান্ধার শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অনুরূপ বাস-ট্রাক নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হল। (১৪)
পশ্চিম পাকিস্তানী বয়নশিল্পের মালিকদের কলকাঠি নাড়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানী হস্তচালিত বয়নশিল্পের জন্য প্রয়ােজনীয় সূতাে দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য হয়ে পড়লাে। সরকার ঐ পশ্চিম পাকিস্তানী বৃহৎ শিল্পপতিদের ট্যাক্স-ছুটি দিয়ে পূর্বপাকিস্তানী কুটির শিল্পকে বিষম প্রতিযােগিতার মুখে ঠেলে দেয়। (১৫)
প্রায় ২৫ লক্ষ পূর্ব পাকিস্তানীর জীবিকা নির্ভর করতে ভারত থেকে আমদানি করা তেন্দু পত্রের ব্যবহারে প্রস্তুত বিড়ির শিল্পের উপর। ১৯৫৫ তে যে আমদানি শুল্ক ছিল ৩৫ শতাংশ, দফায় দফায় বাড়িয়ে তা ১৯৬৪ তে ১২৫ শতাংশ হলে বহু বিড়ি প্রস্তুত কারক উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হন। তবুও যেটুকু আমদানি করা তেন্দুপত্রের জোরে বিড়ি উৎপাদন চলছিল তাকে সরকারী আদেশনামা দিয়ে বন্ধ করা হল। তেন্দুপত্রের বিড়ি উৎপাদন বা বিক্রয় পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হ’ল। এ কি ভারত বিদ্বেষ? মােটেও না। বিশুদ্ধ পূর্ববঙ্গ বিদ্বেষ। পশ্চিম পাকিস্তানে এই সুযােগে তেন্দুপাতার বিড়ির রমরমা ব্যবসা জাঁকিয়ে বসল পশ্চিম পাকিস্তানীরা। (১৬)
পশ্চিম পাকিস্তানী চক্র রটনা করতাে; উচ্চশিক্ষিত এবং মেধাবী লােকের সংখ্যাল্পতা হেতু পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নত হতে পারে নি। বাঙালীকে সেনাবাহিনীতে নিতে ব্রিটিশ সরকার ভয় পেত কারণ বাঙালীর রক্তে গােলামি নেই। কিন্তু মুখে বলতাে, বাঙালীর সমর প্রতিভা নেই। যে-পশ্চিম পাকিস্তানী কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রে অর্থাভাবে পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে, যে সরকার একতরফা পশ্চিমখণ্ডেই শিক্ষাখাতের কর্মকাণ্ড কার্যতঃ সীমিত রেখেছে তারাই ব্যঙ্গ করছে ! বাঁচার মতাে বেতন না পেয়ে ১৯৫৭-৬১ র মধ্যে সাতাশ শতাধিক শিক্ষক, স্কুলের চাকুরী ত্যাগ করেন পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ পশ্চিমে শিক্ষকতা আদরণীয় জীবিকা। যতাে সরকারী স্কুল তার প্রায় সবই যে পশ্চিম পাকিস্তানে। তবুও যে ১৯৬১ তে পশ্চিম পাকিস্তানের ২৪ হাজার স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারীর বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে ৭ হাজার অনুরূপ ডিগ্রীধারীর তথ্য পাওয়া যায়, তার মূলে পূর্ব পাকিস্তানী মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং বিদ্যোৎসাহিতাই প্রতিপন্ন হয়। এতে বিদ্রপ করা গর্হিত। (১৭)
কালা কানুনের প্রয়ােগে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে দেওয়া হ’ত খুব কম ছাত্রকে। করাচিতে প্রায় সবাই পেত প্রথম শ্রেণী। উপাধ্যক্ষ এবং অন্যান্যরা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের জাতীয় স্তরের প্রতিযােগিতায় পিছিয়ে দিত। যে- আইন গুলাে জোর করে ছাত্রদের পরীক্ষার ফল খারাপ করতাে তাদের অবসানের দাবি করলাে ছাত্ররা। সন্ত্রস্ত কর্তৃপক্ষ ২৮ শে জুন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে, ৪ঠা জুলাই আন্দোলনের নেতাদের নামের তালিকা চেয়ে সার্কুলার পাঠায়। (১৮)
১৯৬৩-র ২৩শে এবং ২৪ শে মে জাতীয় আর্থিক পরিষদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ভেদের কারণ হিসাবে যা বলা হ’ল তাদের বৈষম্যের কারণ না বলে বৈষম্যের বহর বা সূচক বলা উচিত – এই মন্তব্য করে পূর্ব পাকিস্তানী সরকার। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে এটুকু সৎসাহস প্রাদেশিক সরকার দেখিয়েছিল। যােজনা পরিষদের পক্ষে পেশ করা ঐ প্রতিবেদনে বলা হয় – প্রতুলতর পুঁজি, বৃহৎ শিল্পে দ্বিগুণের চেয়ে বড় মাপের দক্ষতর শ্রমশক্তি, অধিকতর শহরাঞ্চল, প্রশাসনিক এবং কারিগরি উৎকর্ষ প্রভৃতি কারণে পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। স্পষ্টতঃই ফলকে কারণ বলা হয়েছে। (১৯)
মাহাবুবউল হক ১৯৬৪ র ১৩ ই অগাস্ট তাঁর দীর্ঘ ভাষণে উক্ত প্রতিবেদন, বিরােধী প্রতিবেদন এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়গুলির উল্লেখ করেন তা সংক্ষেপে বলা হবে। মাহাবাবউল বলেন, ১৯৪৭-এ কৃষি, যানবাহন, শিল্প এবং অন্যান্য মৌলিক বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান-ই ছিল এগিয়ে। একটানা ঔপনিবেশিক শোষণপীড়ন চালিয়ে ১৯৬৪-তে অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে পশ্চিম পাকিস্তানকে তুলনামূলক অর্থে অনেক এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা কী কী ভাবে এবং কোন্ কোন্ দিকে চাপানাে হয়েছে তার উল্লেখ জরুরি।
(১) পূর্ব – পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করে তা দিয়ে তার পণ্য এবং পূজির প্রয়ােজন মেটানাে হয়েছে।
(২) পূর্ব পাকিস্তানে লভ্য কাঁচামাল ব্যবহার না করে পূর্ব পাকিস্তান উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাহায্যে বৈদেশিক কাঁচামাল আমদানি করে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পাকামাল বা শিল্প পণ্যে রূপান্তরিত করে ঐ পূর্ব পাকিস্তানেই সেসব রপ্তানি করেছে।
(৩) পূর্ব পাকিস্তানের পাটের বিনিময়ে লব্ধ বৈদেশিক কারিগরি বা যান্ত্রিক সহায়তায় শিল্পস্থাপন বা শিল্প প্রসার করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
(৪) চামড়া ইত্যাদি কাঁচামাল পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমদানি করে সংশ্লিষ্ট চামড়াশিল্পাদিজাত পণ্য ফের ঐ পূর্ব পাকিস্তানে বিক্রয় করা হয়েছে।
(৫) বিদেশী পণ্য পূর্ব পাকিস্তানে বিক্রয় করা কার্যতঃ বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বাধ্য করা হয়েছে চড়া দামে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য ক্রয় করতে।
(৬) পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপিত করে পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে লাভ করেছে তা পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে ফেলেছে।
(৭) পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারী এবং আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানে এবং বাণিজ্যিক এজেন্সিতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিযুক্ত করা হয়। উপার্জিত অর্থের একাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। সর্বশেষে, কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করে থাকে, তাতে থেকে যায় বিরাট বৈষম্য। (২০)
রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জন না করতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তি নেই — একথা বুঝে পূর্ব পাকিস্তানীরা তাঁদের দাবির সমর্থনে আন্দোলন চালিয়ে গেলেন। ১৯৬৫-তে আয়ুব প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হলেও এ আন্দোলন চালু রইলাে। শ্রমিকবুদ্ধিজীবীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর দমননীতির মুখে আন্দোলনে সাফল্য আসা দুরহ। এ সময় অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত কলে কারখানায় শ্রমিক আন্দোলন ব্যাপকরূপ ধারণ করতে থাকে। যেহেতু মৌলগণতন্ত্রের কর্তারা শ্রমিকদের ভােটের চেয়ে মৌল গণতন্ত্রীদের খরিদ করার অর্থের তাগিদে ধনী পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের উপর সমধিক নির্ভরশীল, সুতরাং শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক বা আর্থিক অধিকার স্বীকার করার কোনাে আগ্রহ তাঁদের ছিল না। শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ করতে তাঁদের দাবি মেনে না নিয়ে, অন্যপথ ধরলাে আয়ুবচক্র। ১৯৬৫তে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার পথেই নামলাে ঐ চক্র।
১৯৬৪ র জুলাই-এ পাঁচটি পূর্ববঙ্গীয় চটকলের ৫০ হাজার শ্রমিক লাগাতার ধর্মঘট চালিয়ে যান। নানা দাবির ভিত্তিতে চলা এই ধর্মঘটের ঊনিশ দিনের দিন অর্থাৎ ২ রা অগাস্ট বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ঐ ধর্মঘটী শ্রমিকদের সমর্থনে সভা, শােভাযাত্রা ইত্যাদির আয়ােজন করে। ৪ঠা অগাস্ট অপর কয়েকটি চটকলের শ্রমিকরাও ধর্মঘটে সামিল হন। পরের দিন অন্তর্বর্তী বেতন বৃদ্ধি এবং অপরাপর সুযােগ সুবিধার দাবি মানা হয়েছে এই কারণে এবং সকল দাবিই আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে মানা হবে এই সরকারী প্রতিশ্রুতির ফলে শ্রমিক ধর্মঘট প্রত্যাহত হয়। তথাকথিত এতিশ্রুতি রক্ষা করে নি সরকার। আলােচনাই ভেস্তে যায়। ১২ই অক্টোবর সমস্ত চটকলের একলক্ষ শ্রমিক ধর্মঘট করেন। একই দিনে খুলনায় বিনা প্ররােচনায় শান্তিপূর্ণ শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ এবং ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনী হামলা চালায়। শত শত শ্রমিকের জীবনহানি ঘটায় তারা। ৩রা নভেম্বর রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। এর পূর্বে অক্টোবরের ২৪ এবং ২৫ তারিখে রাজ্যের ১১৮ টি ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সম্মেলন ঘােষণা করে, সামরিক আইন উঠে গেলেও প্রকৃত শ্রমিক স্বার্থ বাহী আন্দোলন সরকার করতে দেয় না। আন্দোলন চালানােই দুরূহ। আবেদন নিবেদনের বাইরে কিছু করাই নিষিদ্ধ। উনিশ শতকে ফিরে গেছি যেন আমরা আজ।(২১)
ধর্মঘটী শ্রমিকদের খুলনায় যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৬৪ র ১২ই অগাস্ট তার তদন্ত পর্যন্ত না করে প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃপক্ষের প্ররােচনায় শত শত চটকল শ্রমিক ছাঁটাই হলেন। অনেককে সাজানাে মামলায় জড়ানাে হ’ল। পীড়নের মাত্রা বাড়িয়েও সরকার এর পরেই ধার্য ১৯৬৫ র ২৭শে মের রেল ধর্মঘট বানচাল করতে পারে নি। ২৭ শে মের ধর্মঘটের মুখে শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হ’ল এবং ধর্মঘটকে বেআইনী ঘেষণা করলাে সরকার। তথাপি ২০ শে মে চট্টগ্রামের ধর্মঘট ইঙ্গিত দিল ২৭ শে মে কী হতে চলেছে তার। ২৭ শে মে রেল ধর্মঘট শুরু হল। চট্টগ্রামে ২৮ শে মে একজন শ্রমিককে পুলিশ হত্যা করে। অনেক শ্রমিক পুলিশের হামলায় আহত হন। ২৯ শে মে চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় যথাক্রমে ছাত্র-শ্রমিক এবং ছাত্র ধর্মঘট হয়। ভারত নাকি পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করবে- সুতরাং এ সময় রেল ধর্মঘট হবে দেশদ্রোহিতা — এই সব অসার সরকারী প্রচারে ছাত্র-শ্রমিক কেউ-ই বিভ্রান্ত হন নি। (২২)
পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদরা স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি লাগাতার করে চললেন। এর ফলে আর কিছু না হােক পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থবৈষম্য বৃদ্ধি পাবে না – এই তাঁরা মনে করতেন। অর্থমন্ত্রকে বাঙালীর চিহ্নমাত্র রাখা কোনদিনই হয় নি বলে এই বৈষম্য হয়ে উঠেছে এত তীব্র। এই কারণে পূর্ব পাকিস্তান পুঁজিগঠন বা ক্যাপিটাল ফরমেশান – এর সুযােগ পায় নি। ঐ সুযোেগ একতরফাভাবে পেয়ে এসেছে পশ্চিম পাকিস্তান। ১৯৬৫ র ২১ শে জুন নুরুল আমিন বলেন, “যে-আর্থবৈষম্য পাকিস্তান সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে। তাকে দূর করতেও হবে ঐ একই সরকারকে। ঐ দিনেই এ, এইচ, এম কামারুজ্জমান বলেন, দুই অঙ্গে সাম্যপ্রতিষ্ঠার দাবি ভিখারীর আবেদন নয়, এ হ’ল ন্যায্য দাবি, আমাদের এই দাবি ন্যায্য এবং সঙ্গত। অবশ্য আয়ুবের অভিভাবকত্বধন্য ‘ডন’ সম্পাদক ব্রিটিশ এবং হিন্দুদের শােষণেই পূর্বপাকিস্তান দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে – এ সব প্রচার করে সমতাকামী পূর্ব পাকিস্তানীদের বিভ্রান্ত করতে পারেন নি। বরং ২৪ শে জুন ইত্তেফাক, সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ‘ডন’ সম্পাদকের কথা উড়িয়ে দিয়ে জানালাে – পাকিস্তানের জন্মলগ্নে নানা দিক দিয়ে বিচার করলে দেশের পূর্বখণ্ডই পশ্চিম খণ্ডের চেয়ে অধিক সমৃদ্ধ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় পুঁজিপতিকে ক্রমাগত মদত দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারই সেই তুলনামূলক অর্থে অগ্রসর অর্থনীতির অঞ্চলকে আজ পশ্চিমাঞ্চলের উপনিবেশে পরিণত করেছে। সরকারপক্ষের জুলফিকর এবং কিজিলবাশ এই সময়ে অথাৎ ১৯৬৫ জুন মাসে ভারতীয় আগ্রাসনের আশঙ্কার কথা সংসদে তুলে পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্য প্রশ্নটি চাপা দিতে চেষ্টা করেন।(২৩)
অবশ্য পাকিস্তান সরকার যে স্বভাবতঃই ভারতের সঙ্গে বিবাদ বাধিয়ে এই প্রশ্নটি চাপা দিতে চাইছে ইত্তেফাকের ভীমরুল’ ছদ্মনামের একজন বিভাগীয় লেখক তাঁর প্রবন্ধে তার উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৪০ – এর লাহাের প্রস্তাবের সূত্র ধরে ঐ পত্রিকায় মুসাফির লিখলেন, আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান কল্পে চাই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ১৯৬৫ – র ১৯ শে অগাস্ট ইত্তেফাক লিখলাে, কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলার পরিণামে ১৯৪৭-৪৮ সালের ৬৮,৭৩ লক্ষ বস্তার স্থলে ১৯৬৪-৬৫ তে পাটের উৎপাদন নেমে এসে হয়েছে। মাত্র ৫৩ লক্ষ বস্তা। সেদিন বিশ্বের মােট পাট উৎপাদনের ৮০.৫৮ শতাংশ উৎপাদনের গৌরব ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। ১৯৬৪-৬৫ তে আজ তা এসে ঠেকেছে মাত্র ৩৫ শতাংশে। যে-পাট পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ, তার বিলুপ্তির পথেই তাে কেন্দ্রীয় সরকার চলেছে। পাট চাষীর প্রতি বিরূপ আচরণ করে সরকার এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তাদের ন্যূনতম প্রয়ােজন ও মেটানাে হয় নি। ২২ শে অগাস্ট ঢাকার সংবাদপত্রে চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশ পেল। বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলি যে-অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যয় করার জন্য ধার্য করেছিল, পশ্চিম পাকিস্তানী বণিক জোট পরিচালিত ব্যাঙ্কগুলি সেই অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে ফেলছে। এমন কি, ব্যাঙ্ক এবং বীমায় পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রদত্ত আমানতও পূর্ব পাকিস্তানের কল্যাণে ব্যয় করা সম্ভব ছিল না। ১৯৬৫ র ২৫ শে অগাস্ট ‘আজাদ’ সংবাদ দিল যে, বীমা কোম্পানিগুলির আদায়ীকৃত কিশতির অর্থের ৪০ শতাংশ আসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। অথচ এখন পর্যন্ত বীমা কোম্পানিরা তার মােট বিনিয়ােগের মাত্র ৭ শতাংশ এই প্রদেশের জন্য ধার্য করে চলেছে। (২৪)
ইত্তেফাক, ১৯৬৫ র ২৮ শে অগাস্ট শাসকচক্রের আরাে এক ভণ্ডামি ফাঁস করে দেয়। দ্বিতীয় পরিকল্পনাকালে পূর্ব পাকিস্তানে ১৫০ টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করে মাত্র ৫০ টির মতাে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থা হয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিদারুণ অভাব আছে। পশ্চিম পাকিস্তানে মফঃস্বল বা গ্রাম এলাকার বাসিন্দার সংখ্যা পূর্ব। পাকিস্তানের চেয়ে ঢের কম হওয়া সত্ত্বেও সেই অঞ্চলে ১০০ টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল একই সময়ে। ইত্তেফাক ধারাবাহিক ভাবে লিখে চলে আমলা এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের নানা কারসাজি, প্রতিবন্ধকতা এবং টালবাহানায় কীভাবে পূর্ববঙ্গের যৎসামান্য উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ-ও পূর্ব পাকিস্তান সরকার সম্পন্ন করার সুযােগই পান না সেকথা। উন্নয়নমূলক কাজের যে প্রাথমিক অবলম্বন সেই বিদুৎশক্তির উৎপাদনেও পূর্বপাকিস্তানকে কৃত্রিমভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক নিচে ফেলে রাখার জন্য দায়ী তথ্যাদি পেশ করে ইত্তেফাক’ লিখলাে, পশ্চিম পাকিস্তানকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২৩ কোটি টাকা দিলেও কেন্দ্রীয় সরকার কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে ঐ খাতে দিয়েছে মাত্র ৭ কোটি টাকা। ফল যা হবার তাই হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা পৌনে ৮ লক্ষ কিলােয়াট, আর পূর্ব পাকিস্তানে এই পরিমাণ মাত্র ২ লক্ষ কিলােয়াট। তা ছাড়া, ই, পি, আই, ডি, সি সব সময় উন্মুখ হয়ে আছে নিজেদের শিল্প সং স্থাগুলি পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিতে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানী শিল্পপতিরা বিশেষ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান নিজেদের হাতে নিতে চেয়ে আবেদন করেও বিফলমনােরথ হয়েছেন। ই, পি, আই, ডি, সি এই হস্তান্তরে সম্মত হয় নি। (২৫)
১৯৬৫ র এই অগাস্ট মাসে শ্রমিকদের উপর চূড়ান্ত দমনমূলক বিধিনিষেধ চাপানাে হয়। শ্রমবিরােধ বিলের নামে ধর্মঘট বেআইনী ঘােষণার অধিকার সরকার হাতে নেবার তােড়জোড় করলাে। একই সঙ্গে সরকারী বা আধা-সরকারী সংস্থার শ্রমিকদের পক্ষে নিষিদ্ধ হ’ল বেসরকারী সংস্থায় সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নদের ফেডারেশনের সঙ্গে সংস্রব রক্ষা করা। প্রাদেশিক আইনসভায় পূর্বপাকিস্তানের শ্রমমন্ত্রী জানালেন, পাকিস্তান আই, এল, ও – বিধি মানতে বাধ্য নয়। শ্রমিক দলনের আয়ােজনের পাশাপাশি ভারত-বিরােধী। জিগির তুলে ভারতের উপর আক্রমণ শানানাের প্রস্তুতিও নিয়ে চললাে পাকিস্তান সরকার।(২৬)
পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষার সময় বন্যা নিয়মিত দেখা দেয়। জলধারার অভাব নয় আধিক্যও তার সমস্যা। ভারত সরকারের ফারাক্কা পরিকল্পনা চল্লিশ হাজার কিউসেক জলধারা পদ্মা থেকে হুগলীমুখী করে নিলে প্লাবনের দেশ পূর্ব পাকিস্তানে খরা দেখা দেবার কথা নয়। তবু সেই অসম্ভব কথাই বলে চললাে পাকিস্তান সরকার। উদ্দেশ্য ছিল ভারত-বিরােধী জিগির উচ্চগ্রামে তােলা। (২৭)
কাশ্মীর প্রশ্নও ভারত-বিরােধী মনােভাব জাগানাে সরকারী প্রচারে গুরুত্ব পেল। অবশ্য ফারাক্কা বা কাশ্মীরের প্রশ্নে আবেগ তাড়িত হয়ে সাম্প্রতিক শ্রমিক-বিরােধী আইন গুলাে স’য়ে যাবার মতাে অবােধ পূর্ব পাকিস্তানীরা ছিলেন না। শ্রম বিরােধ বিল পাশ করানাে হয় ৩রা অগাস্ট। ঐ দিনই শ্রমিক-বিরােধী আইন প্রতিরােধ সমিতির ডাকে ঢাকা, নারায়ণ গঞ্জ এবং পােস্তা গাে লার শ্রমিক জনতার সঙ্গে সাধারণ মানুষ এক জোট হয়ে যে বিশাল জনসভার আয়ােজন করেন সেখানে প্রস্তাব নেওয়া হয়, ‘৬-ই অগাস্ট রাজ্য জুড়ে ধর্মঘট। নিধারিত দিনে শ্রমিকদের একদিনের প্রতীক ধর্মঘট এবং ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষ মানুষের জমায়েতে শ্রমিকশ্রেণীর উপস্থিতি আয়ুব-চক্রকে সন্ত্রস্ত করে থাকবে। মালিক এবং সরকার পক্ষ শ্রমিকসংহতি বিনাশে এবং গুণ্ডাবাহিনীর সাহায্যে সন্ত্রাসসৃষ্টিতে আত্মনিয়ােগ করলাে। পূর্ব পাকিস্তান শ্রম পরিষদ, ২৮ শে অগাস্ট এই মর্মে সংবাদপত্রে বিবৃতি পেশ করলাে যে, শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাদের বিশৃঙ্খলতার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ভারতকে আক্রমণ করার দিনটি যখন অদূরে দৃশ্যমান ঠেকছে, পাকিস্তানী সরকার তখন কিন্তু সত্য সত্যই শ্রমিক শ্রেণীর বিশৃঙ্খলতার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। আয়ুবচক্রের জন্য ১৯৬৫-র অগাস্ট জুড়ে দিনগুলি ছিল এই যুদ্ধপ্রস্তুতি এবং শ্রমিক অশান্তির দোটানায় বাঁধা। (২৮)
অথচ বুদ্ধিজীবী মহলে ভারত-বিরােধী প্রচারে তেমন ফয়দা তুলতে পারে নি। আয়ুবগােষ্ঠী। ইত্তেফাক ৯-ই অগাস্ট সাফ লিখলাে, পশ্চিম পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে নদীর জল বাঁটোয়ারা শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ভারতই তার উদ্যোগ নিয়েছিল। ফারাক্কা প্রশ্নের মীমাংসাও ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমেই করতে হবে। আয়ুবচক্রের মুখপাত্ররা আবেদন করে চললেন, কাশ্মীরে ভারতের হামলার ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান কল্পে আয়ুবের পাশে দাঁড়ান। এই যুদ্ধোন্মাদনার উপযুক্ত জবাব দিলেন ‘ইত্তেফাকে’র ২৪ শে অগাস্ট সংখ্যায় মােসাফির। তিনি লিখলেন, পাকিস্তানীদের গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকার একটি জ্বলন্ত সমস্যা। এর গুরুত্ব ঐ কাশ্মীরের তথাকথিত সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের খুলনা, মৈমনসিংহ এবং যশাের শাখা, পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে প্রস্তাব নেয়। ঐ ছাত্রসংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে প্রভাব ছিল অসামান্য। (২৯)
১৯৬৫ র সেপ্টেম্বর মাসে ২২ দিনের যে-যুদ্ধ ভারতের বিরুদ্ধে চালিয়েছিল পাকিস্তান সরকার তার একটা উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিক-বুদ্ধিজীবীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। সে উদ্দেশ্য তাে ফলেই নি, এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা পূর্বপাকিস্তানী সাংসদদের আরাে সােচ্চার করে তুললাে পূর্বখণ্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দাবিতে। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের আত্মরক্ষার কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। অবশ্য পাকিস্তান সরকার এবং তার সমর্থক পত্র পত্রিকা, পূর্ব পাকিস্তানীদের তথা ইত্তেফাক পত্রিকার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেও ঐ প্রতিরক্ষা ঘটিত দাবিকে স্তব্ধ করতে পারে নি। (৩০)
সচেতন পূর্ব পাকিস্তানী ভালােই বুঝতেন, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষুন্ন হবে। এর কুফল জনসাধারণের উপর পড়বে। যুদ্ধে লাভবান হবে ধনিক শ্রেণী মাত্র। তাই চট্টগ্রাম, ঢাকা এবং খুলনায় ভারতীয় বিমান থেকে বােমাবর্ষণের আজগুবি সংবাদ প্রচার করেও ২২ শে অক্টোবরের ভারতকে ধ্বংস করাে দিবস পালন করতে গিয়ে আয়ুবের মুসলিম লীগ কোনাে বিক্ষোভ-সমাবেশ বা মিছিলের আয়ােজনও করতে পারে নি। পুলিশ মিলিটারির কড়া প্রহরার মধ্যেও যুদ্ধ বিরােধী, গণতন্ত্র এবং শান্তিকামী দেওয়াল-লিপি সর্বত্র লক্ষ্য করা গেছে। ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর স্বপক্ষে এবং পূর্বপাকিস্তানের জন্য স্বাধিকারের দাবিতেও দেওয়াল-লিপি নজরে পড়েছে। আয়ুব-ভুট্টোর সমরবাদ এবং আয়ুবের পূর্ব পাকিস্তানে উপনিবেশবাদ নিপাত যাক – এমন পােষ্টারও লেখা হয়েছে ঐ তথাকথিত ভারত ধ্বংস ডাকের দিন। (৩১)
অবশ্য সরকার পক্ষ ও চুপ করে বসে ছিল না। পাঞ্জাবী মুখ্যসচিবের মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বার্থবিরােধী কেন্দ্রীয় সরকারের হুকুম তামিল করা বরাবরই হ’ত। এবারে এক অতিরিক্ত মুখ্যসচিবও এলেন। তিনিও পাঞ্জাবী। কলকাতায় প্রকাশিত বাঙলা বই বিক্রয় পর্যন্ত নিষিদ্ধ হ’ল। বিদেশী বই’ সংক্রান্ত এই হুকুমের লক্ষ্য যে, বাঙালীসুলভ চিন্তাভাবনা তথা পশ্চিম বাংলার সঙ্গে মতাদর্শগত যােগসূত্র বিনষ্ট করা একথা বলাই বাহুল্য। বিদেশী বই পূর্ব পাকিস্তানে পুনর্মুদ্রিত হলেও ২ বছরের জেল এবং হাজার টাকা জরিমানার ফতােয়া ছিল ঐ হুকুমনামায়। কিন্তু পাঞ্জাবী আমলাদের ঔদ্ধত্যে আয়ুবের মুসলিম লীগের পূর্বপাকিস্তান শাখার কার্যকরী সমিতিতে বিরােধ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, ঐ সমিতি ভেঙে দিয়ে সাময়িক কাজ চালাবার মতাে অ্যাড হক কমিটি করতে হ’ল (৩২)
তাসখন্দ চুক্তিকে অভ্যর্থনা জানালাে ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’, ‘আজাদ’ প্রভৃতি সংবাদপত্র। সময়টা ছিল ১৯৬৬ র ১১ই সেপ্টেম্বর। অথচ কাশ্মীর সমস্যার যুদ্ধের মাধ্যমে মীমাংসায় বিশ্বাসী পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাশখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, ঐ বিক্ষোভকে সাম্প্রদায়িকতার সহায়ক বলে বিবৃতি দিলেন। তাশখন্দের সমর্থনে মত প্রকাশ করলেন নুরুল আমিন, মুজিবর থেকে শুরু করে ছাত্রনেতারা পর্যন্ত সকলে। মুজিবর বললেন, ‘ভারতের সঙ্গে বিগত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা হ’ল এই যে, জাতীয় সংহতির স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার এবং স্ব-নির্ভর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অবশ্য প্রয়ােজন। ১৯৪০ এর লাহােরের প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই স্বাধিকারের প্রসঙ্গ তােলা হয়েছে। (৩৩)।
১৯৬৬ র ৫ই এবং ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহােরে যে সম্মেলন কাউনসিলরস মুসলিম লীগ, আওয়ামি লীগ, জমাত-ই-ইসলাম এবং নিজাম-ই-ইসলাম – এই দলগুলি ডেকেছিল এন, ডি, এফ তা বয়কট করে। মুজিবরের নেতৃত্বে আওয়ামি লীগও ঐ সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের পরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সম্মেলন পরিহার করেন। ৭৪০ জন প্রতিনিধির মধ্যে ৭১৯ জনই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। এঁদের উৎসাহেই তাশখন্দ বিরােধী মিছিল ইত্যাদি হয়েছিল কিছুদিন পূর্বে। মুজিবর পরে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি যারা শুনতে প্রস্তুত নয়, তাদের সঙ্গে সম্মেলন কী কারণে করবাে? ‘সংবাদ’, ‘ইত্তেফাক’ প্রভৃতি সংবাদপত্র ঐ যুদ্ধবাজদের সমালােচনা করে লেখে যে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। শান্তিপূর্ণ পথেই কাশ্মীর প্রশ্নের সমাধান সম্ভব। ইত্তেফাকে’ ১৯৬৬ র ১৩ই ফেব্রুয়ারী মােসাফির লিখলেন, কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার-ই যদি মেনে নিতে হয়, তবু ঐ উদ্দেশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়া পাকিস্তানের পক্ষে বাস্তববুদ্ধির পরিচায়ক হবে না। (৩৪)
প্রভাবশালী, সমরবাদী উর্দু দৈনিক ‘নােয়া-ই-ওয়াকৎ’ ১লা ফেব্রুয়ারী সম্পাদকীয় মন্তব্যে পূর্ব পাকিস্তানীদের তাশখন্দ প্রস্তাবের সমর্থক হবার হিসাবে দেখালাে তাদের ভারতে চোরাচালানের তথাকথিত দিকটিকে। এই সম্পাদকীয় প্রবন্ধে পরামর্শ দেওয়া হল – পূর্ব পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট নদীগুলি থেকে ভারত যে সুবিধা পায় তা বন্ধ করে ভারতকে বাধ্য করতে হবে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের দাবি মেনে নিতে। আসলে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘকাল যে-সব ব্যবসা চলছিল আচমকা তা আইনের বলে বন্ধ করলে ঐ ব্যবসা চোরাচালান অপবাদ নিয়েও চলতে থাকে। একই উর্দু দৈনিকে অতীতে সংবাদ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী গম ভারতে পাচার করা সম্পর্কে। তাই পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানীদের এককভাবে চোরাচালানে জড়িত বলায় পাকিস্তান অবসাভার’ লিখলাে — পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে কোনটি অপরটিকে চোরাচালান খেলায় হার মানায় সেকথা বলতে গেলে আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্ব-ই এসে, যায়।’ (অথাৎ নিরপেক্ষ বিচারে বলতে হত, কেউ কম যায় না।) ৬ই ফেব্রুয়ারির সম্পদকীয় স্তম্ভে সংবাদ পত্রিকা মন্তব্য করে — যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান-ভারত দু’দেশের মধ্যস্থ সমস্যাগুলির আদৌ কোনাে সমাধান মেলে নি – এই অভিজ্ঞতা থেকেই পূর্ব পাকিস্তানীরা তাশখন্দ ঘােষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। একই দিনে ঐ বাঙলা দৈনিকেই ‘নােয়া-ই-ওয়াকৎ’- এর মন্তব্যে যে ঢাকার সর্বস্তরের মানুষ ক্ষুব্ধ একথা প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছিল। (৩৫)
তাশখন্দ ঘােষণা সৃষ্ট নূতন পরিস্থিতিতে রাজনীতিক নেতা থেকে ছাত্রনেতা মাত্রেই দাবি তুললেন রাজবন্দীদের মুক্তি, জরুরী অবস্থা বিধির বিলােপ এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের স্বপক্ষে। ভাসানি ১৭ই ফেব্রুয়ারির বিশাল শ্রমিক-কৃষক সমাবেশে ঐ দাবিগুলির স্বপক্ষে ভাষণ দিলেন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ন্যাপ’ দল ‘জরুরী অবস্থা রদ করাে’ দিবস পালন করলাে শােভাযাত্রা, প্রচারপত্র বিলি, জনসভা ইত্যাদির মাধ্যমে। তাশখন্দ ঘােষণার অব্যবহিত পরেই উৎসাহী ছাত্রনেতারা বিবৃতি দিয়েছিলেন, কোন প্রকার স্বৈরাচারী শাসনে আমাদের আস্থা নেই। তাশখন্দ চুক্তির কল্যাণে জরুরী অবস্থা রদ করার পরিস্থিতি এসে গেছে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আমরা লড়াই চালিয়ে যাবাে। এই ছাত্রনেতারা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের সদস্য। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক দৈনিকে মােসাফির লিখেছিলেন – ৫ কোটি বৈধ ভােটারের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক অথাৎ মাত্র ৮০ হাজারকে ভােটাধিকার দেওয়া হয়েছে বলেই নজিরবিহীন ব্যাপকতা নিয়ে দুর্নীতির রাজত্ব চলছে। … পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান করতে হবে সমস্যা আছে মেনে নিয়ে, নেই বলে উড়িয়ে দিলে সমাধানও উবে যাবে। (৩৬)
১৪ই ফেব্রুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সপ্তাহব্যাপী বঙ্গভাষা প্রচার অনুষ্ঠান চালায়। সর্বস্তরে বাঙলাভাষার ব্যবহারের দাবিও করা হয়। সাপ্তাহিক ‘ঢাকা টাইমস লেখে, ‘কার্যতঃ বাঙলা ভাষা সরকারী ভাষার কোনাে মর্যাদাই পায় নি। উচ্চশিক্ষায় পর্যন্ত বাঙলা ভাষা অপাঙক্তেয়। ১৯৫২ র ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতে শহীদ দিবস এবারেও প্রতিপালিত হ’ল। ঢাকা টাইমসের উদ্ধৃত বক্তব্য শহীদ দিবসেই প্রকাশিত হয়। একই দিনের ইত্তেফাকে’ লেখা হ’ল – ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলনই পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ। এই ভাষা আন্দোলনই সম্প্রসারিত হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবির রূপে। জীবনের সর্ব অঙ্গে এই অধিকার বােধ আজ পূর্ব পাকিস্তানীর ভাবাবেগের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। (৩৭)।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন-আন্দোলন এই সময় প্রবল উদ্দীপনা এবং সুনির্দিষ্ট গতিবেগ পেল মুজিবর রহমানের ছয় দফা দাবি সম্বলিত পুস্তিকা আমাদের বাঁচার দাবি প্রকাশিত হলে। অবশ্য একই সময়ে পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্যের উপর আবুল কালাম আজাদ লিখিত পুস্তিকা পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য’-ও ছিল একটি সাড়া জাগানাে পুস্তিকা। আজাদ ছিলেন বি, এ পাঠরত ছাত্র মুজিবর অত্যন্ত অর্থনৈতিক বাস্তববােধের পরিচয় দিয়ে ১৯৪০-এর লাহাের প্রস্তাবের ধাঁচে স্ব-শাসিত প্রদেশ গুলি দিয়ে গঠিত একটি ফেডারেশন হিসাবে পাকিস্তানের বিবর্তনের প্রয়ােজনের কথা বলেন। সার্বজনীন বা প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার এই রাষ্ট্রের সংসদীয় গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে-প্রদেশ কর আদায় করবে সেকর ঐ প্রদেশ থেকে গৃহীত বলে প্রদেশের-ই প্রাপ্য হবে। দেশের দুই অঙ্গে সহজ বিনিময়যােগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে। প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র নীতি থাকবে কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকারের হাতে। তবে আর্থিক হিসাব রক্ষা এবং তার দায়-দায়িত্ব প্রাদেশিক স্তরে প্রাদেশিক সরকারের উপর বর্তাবে। প্রতিরক্ষা কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ার হলেও প্রাদেশিক সরকার গুলির থাকবে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রক্ষা করার দায়িত্ব এবং অধিকার। সংক্ষেপে মুজিবরের ছয়দফা বলতে স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশদের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের জন্য এই মূলনীতিগুলিই বােঝায়। পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে মুজিবরের ইশতেহারই সর্ব প্রথম পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক বাস্তবের রূপরেখা হিসাবে বিশেষ প্রণিধানযােগ্য। পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সংগ্রামে এই ছয়দফার অগ্রণী ভূমিকা স্বীকার করতেই হবে। (৩৮)।
পশ্চিম পাকিস্তানী শক্তিচক্রের অঙ্গুলি হেলনে পাকিস্তান সরকারের আইন, প্রশাসন, সংসদ সবই চালিত হয়। এই পরিস্থিতির সুযােগে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি বণিক গােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করেছে – এ অভিযােগ পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদরা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন। মুজিবরের ছয়দফা সেই অভিযােগের পুনরাবৃত্তি নয়। যে-পরিস্থিতির বিরুদ্ধে এত অভিযােগ তারই পরিবর্তনের ইশতেহার এটি। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার নয়, সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য বিজ্ঞান সম্মত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নির্দেশিকা হিসাবে মুজিবরের ছয় দফা বরেণ্য। (৩৯)
প্রকৃত প্রস্তাবে একই দেশে দুটি অর্থনীতি চালু করেছিল পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী। ঔপনিবেশিক মুনাফা লুণ্ঠনের অর্থনীতির ধারক পশ্চিম পাকিস্তান, দেশের-ই পূর্বখণ্ড বা পূর্ব পাকিস্তানকে করে ফেলেছিল নিজস্ব উপনিবেশ। এই দ্বিবিধ অর্থনীতির প্রাথমিক রূপকার কেন্দ্রীয় শাসকচক্র। তার প্রায় সবটুকুই পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়ে গঠিত। নামে পূর্ব পাকিস্তানী এক আধজন সরকারের উচ্চপদে আসীন থাকলেও তাঁর ভূমিকা ছিল ক্রীড়াপুত্তলীর। সরকারী নীতি কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে তার সহজ দৃষ্টান্ত দেশের রাজধানী পশ্চিম খণ্ডে স্থাপন। এমন কি, রাজধানী শহর পরিবর্তিত হলেও ঐ খণ্ডেই অবস্থিত হয়েছে। রাজধানীর সাজসজ্জা, সড়ক বা ইমারত নির্মাণ সবই আঞ্চলিক ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংগ্রহের পথ খুলে দেয়। বাণিজ্যিক দপ্তর গুলির অবস্থানের বাড়তি সুবিধাও ঐ পশ্চিম পাকিস্তানীরাই পেয়েছে। সরকারী পক্ষপাতিত্বে শিল্প স্থাপন, আমদানি-রপ্তানির পারমিট লাইসেন্স ইত্যাদি সকল অনুষঙ্গ বিচারেই পরিকল্পিত ভাবে পূর্ব পাকিস্তানীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। চট শিল্পের স্বাভাবিক এলাকা পাট উৎপাদনক্ষম পূর্ব পাকিস্তান। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনীতিগত বিবেচনা না করে চটশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবস্থানদোষে যে শিল্প পশ্চিমখণ্ডে অচল, সরকারী ভরতুকির জোরে সেই শিল্প ঐ অঞ্চলে স্থাপিত করে ঐ ভরতুকির জোরেই তাকে লাভজনক দেখানাে হয়েছে। পেট্রোকেমিক্যাল এবং চিনির কল-ও অযৌক্তক ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে খােলার চিন্তা করা হয়েছে। উদাহরণ বাড়িয়ে কী হবে? চটকলের উদাহরণই বুঝিয়ে দিচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান নিতান্ত কৃষিকর্মে লিপ্ত তথা পশ্চিমপাকিস্তানী পণ্যের লাভের বাজার এলাকা হিসাবে থেকে যাবে – এই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অভিসন্ধি। (৪০)
পূর্ব পাকিস্তানে খনিজ সম্পদের ঘাটতির কারণে শিল্পায়ন দুঃসাধ্য এ যুক্তিও অনুপপত্তি দোষে দুষ্ট। পশ্চিম পাকিস্তানও তার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে শিল্পের পর শিল্প প্রতিষ্ঠা করে চলছে – একথা সম্পূর্ণ ভুল। বিদেশ থেকে নানা প্রকার কাঁচামাল (শুধু যন্ত্র, প্রযুক্তি নয়) আমদানি করে থাকেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাঁদের শিল্প
১১৫

প্রতিষ্ঠানগুলির প্রয়ােজনে। রাসায়নিক শিল্প, পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প, মূল ধাতু শিল্প অথবা বিদ্যৎ শিল্প – সর্বত্রই কাঁচামাল আসে বহুলাংশে বিদেশ থেকে। এই সব শিল্পে ন্যূনতম যে আমদানি করে থাকে পশ্চিম পাকিস্তান তা-ও ৬১ শতাংশ। সর্বোচ্চ পরিমাণ ৮৬ শতাংশ। প্রয়ােজনে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানির পাশাপাশি যেখানে সম্ভব পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও কাঁচামাল আমদানি করে অনুরূপ ভাবেই শিল্প প্রতিষ্ঠার এবং শিল্পোৎপাদন বজায় রাখার সুব্যবস্থা পূর্বপাকিস্তানীরাও নিশ্চয়ই করতে সমর্থ হবেন। শিল্পজাত ভােগ্য পণ্য যে চড়া দামে আজ পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণকে কিনতে হয় ঐ পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে, কাঁচামাল আমদানি করা সত্ত্বেও নিজস্ব অঞ্চলে উৎপন্ন ভােগ্যপণ্য তার চেয়ে ঢের কম দামেই বিক্রীত হতে পারবে। আসলে কোন্ পণ্যের জন্য শিল্প কোন্ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হবে তা ঐ পণ্যের বাজারের প্রসার দ্বারা নিরূপণ করা হয়। কাঁচামালের সহজলভ্যতা এখানে নির্ভরযােগ্য সূচক বা নিরিখ হতে পারে না। অর্থনৈতিক বিবেচনা থেকে একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা চলে, পূর্ব পাকিস্তানে সিগারেট, বস্ত্র, দিয়াশলাই, চট, চর্ম, তণ্ডুল, চটিজুতা, উন্নত পর্যায়ের ইট এবং তাপসহ ধাতব পদার্থের উৎপাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলির জন্য পূর্ব পাকিস্তান উপযুক্ত। (৪১)
মৈমনসিং-এর এক মহতী জনসভায় মুজিবর সহজ ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়েছিলেন করাচী, রাওয়ালপিণ্ডি এবং ইসলামাবাদ – পর পর তিনটি রাজধানীই স্থাপিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের এলাকায়। সাধারণ সরকারী দপ্তরগুলি ছাড়াও সামরিক বিভাগের সদর দপ্তর গুলির প্রয়ােজনে যে বিপুল অর্থ লগ্নী করা হয়, যতাে সড়ক এবং অট্টালিকা নির্মাণ করা হয় এবং রাজধানীর সুবিধায় যতাে শিল্প আশে পাশে গড়ে ওঠে, তার সবটুকু উপকার পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্বপাকিস্তান স্বাধিকার পেলে অনুরূপ সুযােগ তারও সামনে আসবে। বিগত ১৮ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানকে যতাে শােষণ করেছে ২০০ বছরের ব্রিটিশরাজও ততাে করে নি – এই মন্তব্য করেন মুজিবর। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন অর্থনীতি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছয় দফা কর্মসূচি যে বিচ্ছিন্নতাবাদ নয়, একথা বলেও মুজিবর জোরের সঙ্গে বলেন, ‘অবশ্য আমরা ঐ সব কুৎসার জন্য প্রস্তুত আছি। পাকিস্তানের সৃষ্টিতে উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেও যখন ফজলুল হক এবং সােহরাবর্দিকে অনুরূপ কুৎসা লাভ করতে হয়েছে, তখন কুৎসাকে মূল্য দেওয়া অর্থহীন।(৪২)
মুজিবরের ছয়দফা কর্মসূচি, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অনুরূপ আর্থরাজনীতিক স্বাধিকার চেয়েছিল। ফেডারেল প্রথামতাে একটি কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের দুই অঙ্গ হয়েই এই দুই স্বায়ত্ত্বশাসনাধীন প্রদেশ বা অঞ্চলের অর্থ পশ্চিম বঙ্গপূর্ববঙ্গ মিলে নূতন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়। এ প্রস্তাব মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানীদের বহুদিনের দাবিরই প্রতিরূপ। সব জেনে শুনে ইচ্ছাকৃত বিকৃতি ঘটিয়ে আয়ুব স্বয়ং মুজিবর পন্থীদের পশ্চিমবঙ্গ- পূর্ববঙ্গ একীকরণপন্থী তথা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার রাজনীতি প্রচারক হিসাবে দেখাতে চাইলেন ১৬ই মার্চ থেকে ১৮ই এপ্রিল, ১৯৬৬ র মধ্যে অন্ততঃ ছয়টি ভাষণের প্রত্যেকটিতে। আয়ুব ব’লে চললেন, “ব্রিটিশ আমলে হিন্দুরা মুসলমানদের দাবিয়ে রেখেছে। কখনাে বললেন, ‘মুজিবের সার্বভৌম বঙ্গদেশ প্রবল ভারত সরকার বরদাস্ত করবে না – এ তার বৃথা আশা। আসলে সার্বভৌম বঙ্গদেশ মুজিবর দাবি করেন নি। সার্বভৌম পাকিস্তানের দুটি প্রদেশের জন্য দুই বিধির বদলে একই বিধি দাবি করেছিলেন। যা উভয় প্রদেশকে অনুরূপ ধাঁচের স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দেবে। ২০ শে মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে মুজিবর এই সব কুৎসার জবাব দিয়ে বলেন, দেশের দুটি অঙ্গ সবল হলে দেশ দুর্বল হয় না। এই সঙ্গে ছয়দফা দাবি পুনর্বার তিনি জোরের সঙ্গে তুলে ধরেন এবং আয়ুবকে কুৎসা অভিযান বন্ধ করার পরামর্শ দেন। (৪৩)।
আয়ুব- আশ্রিতরা, যেমন মােনেম খান, ২৯ শে মার্চ এবং ১৮ ই এপ্রিল বক্তৃতা করেন, যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪-র ২১ দফা দাবিসনদ এবং তারই অংশবিশেষ মুজিবরের ৬ দফা কর্মসূচি জনসাধারণকে ধোঁকা দেওয়ার ছল। ১৯৬২ র সংবিধান পাকিস্তানের দুই অঙ্গের আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। অতএব স্বায়ত্তশাসনের দাবি অমূলক। ১৮ই এপ্রিলের ভাষণে মােনেম খান তথ্যবিকৃতির চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে দাবি করলেন, লাহাের প্রস্তাবে যে লেখা হয়েছিল ‘স্টেটস অব পাকিস্তান’ শব্দনিচয়, তা ছিল ছাপার ভুল। মুদ্রাকর- প্রমাদ শুধরে দিলেন তিনি নিজেই এই বলে যে ওটা হবে ‘স্টেট অব পাকিস্তান। অর্থাৎ মুজিবর কর্মসূচিতে ব্যাখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের ঐতিহাসিক সমর্থন, মমানেম ‘ছাপার ভুলে’র ধোঁকা দিয়ে কাটিয়ে দিলেন। কার্যতঃ তঞ্চকতার ধারে কাটে না কিছুই। বঞ্চনার ভারে দিনই কাটে না যার সে এই চটুল, তাৎক্ষণিক অনৃত ভাষণে কর্ণপাত করে না। আয়ুব এবং মােনেম যতােই প্রচার করলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার এসে যাবার কথা, জনসাধারণ ততােই আঁকড়ে ধরলেন তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বাসভাজন পূর্ব পাকিস্তানী নেতাদের কার্যক্রমের মূলসুরটি যে, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে আছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। ৫ই এপ্রিল পাকিস্তান অবসাভার’ লিখলাে, একটি বিন্দু থেকে যেখানে আইন, প্রশাসন প্রভৃতি সর্ববিধ ক্ষমতা বিকীর্ণ হয়, সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ বা স্বাধিকার ঐ একটি মাত্র বিন্দুতেই অবস্থান করে। আর সেই সর্বগ্রাসী বিন্দুটি ছিল প্রেসিডেন্ট পদাধিকার। ২০ শে এপ্রিল ঐ সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় মন্তব্যে আয়ুবের স্ববিরােধের ইঙ্গিত দিতে লেখা হ’ল – যে-আয়ুব রাজনীতিকে সর্বনাশের কারণ বলতেন আজ তিনিই একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। রাজনীতিক মাত্রেই ভিন্নমতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। করেন না শুধু আয়ুব। ভিন্নমতকে দেশদ্রোহিতা, বিশৃঙ্খলতা ইত্যাদি অপবাদ দিয়ে মুছে দিতে চান। অথাৎ রাজনীতিকের যেটুকু সততা এবং ন্যায়নিষ্ঠা থাকে আয়ুবের তা নেই। ২০ শে এপ্রিল পাকিস্তান অবসাভার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে এই কথাগুলিই একটু মৃদু ঢঙে বলা হয়েছিল। সঙ্গে এ সব কুৎসা বন্ধ করতে আবেদন করাও হয়েছিল। (৪৪)
আয়ুব প্রচার করতেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তত্ত্ব কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকের মগজ-উদ্ভূত উদ্ভট কল্পনামাত্র। কিন্তু ১৯৬৬ র এপ্রিল এবং মে মাসে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস, এবং লণ্ডনের ‘অবসাভার’ বা ‘টাইমস পত্রিকাগুলি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানীদের আন্দোলনকে পূর্বের মতাে উপেক্ষা করতে পারলাে না। অবশ্য তারা এর অতি সরলীকরণ করে দেখাতে চাইলাে, ১৯৬৫ র সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দিনগুলাে ভারতের সম্ভাব্য আক্রমণের মুখে পূর্ব পাকিস্তানকে অরক্ষিত ফেলে রাখার প্রতিক্রিয়াতেই এই উদাসীন-কেন্দ্র-বিরােধী প্রাদেশিক স্বাধিকার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। ভারত, চীনের পাল্টা আক্রমণের ভয়ে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করবে না জেনেই পূর্ব পাকিস্তানকে অরক্ষিত রাখা হয়েছিল — এমন একটা ধারণা ভূট্টো চেষ্টা করেও জনপ্রিয় করতে পারেন নি। প্রতিবেশী ভিয়েনামের যুদ্ধেই যে-চীন প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নেয় নি, তার সম্পর্কে ভুট্টোর কথা আজব। সেপ্টেম্বরে যুদ্ধারম্ভের দু’মাস পূর্বেই ১০ই জুলাই পূর্ব পাকিস্তানী সাংসদরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবিতে চরম কথা বলেছিলেন। তাঁরা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের জন্মভূমিকে চরম অবহেলা করে অরক্ষিত রেখে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টপক্ষকে কোনােদিন ক্ষমা করবে না। এই সাংসদরা বলতেন, শাসকচক্রের যুক্তি অসার। পূর্ব পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে পশ্চিম পাকিস্তানের নিকটবর্তী দিল্লি নাকি জয় করে নেওয়া হবে। তা ছাড়া আক্রান্ত পূর্ববঙ্গে চটজলদি সেনা পাঠানাে হবে। প্রথমটি অলীক। দ্বিতীয়টিও দুঃসাধ্য। এই দীর্ঘ পথ জলপথে বা বায়ুপথে অতিক্রম করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথাযথ করা যায় না। ছয়দফাকে যুদ্ধোত্তর দাবি বলে পশ্চিম দুনিয়ার সাংবাদিকরা ভুল করেছেন। প্রতিরক্ষার সমস্যা পূর্ব পাকিস্তানীরা যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে জুলাই মাসেও যেমন তুলে ধরেছিলেন, যুদ্ধ যখন কল্পনাও করা যেত না সেদিনও ধরেছিলেন। (৪৫)
পাশ্চাত্ত্য সাংবাদিকরা পল্লব গ্রাহিতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেও অপর একজন পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত ডঃ জন ই ওয়েন কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানীদের ক্ষোভের বাস্তবানুগ ব্যাখ্যা করেছিলেন। উঃ ওয়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০-৬৩ সালে জাতিসঙ্ঘের পক্ষে পরামর্শদাতা হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। হিন্দু পত্রিকায় তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। লখনৌ এর ‘দি পাইওনিয়র পত্রিকা তার পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করে। ঐ প্রবন্ধে ডঃ ওয়েন লেখেন – সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকেই অত্যধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছে আয়ুব প্রশাসন। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় ঢের বেশি দরিদ্র এবং বঞ্চিত পূর্ব পাকিস্তান, স্বভাবতঃই সুবিধাপ্রাপ্ত অঙ্গের প্রতি বিরূপ হয়েছে। আয়ুবজমানার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা তার সামরিক শক্তি। পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশমাত্র গণ্য করা হয় এই জমানায়। অনেক বাঙালী মুসলিম তাঁকে জানিয়েছেন তাঁরা ১৯৪৭ এর চেয়েও এখন পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকতর দৈন্যক্লিষ্ট দেখছেন। ডঃ ওয়েনকে অপরপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানী বিশিষ্ট নাগরিকরা এমন কথাও বলেছেন, পাটের লাভজনক দিকটা আছে। তাই– নইলে ঐ পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা পরিত্যাগ করতাম, ওদের মুখদর্শন করতাম না। দেশের ভিতরের সমস্যা থেকে নজর অন্যদিকে চালিত করা ছাড়া ১৯৬৫-র সেপ্টেম্বরে কাশ্মীর-যুদ্ধ বাধাবার আর কী কারণ ছিল আয়ুবের। একনায়কত্বের কর্ণধাররা বিদেশে যুদ্ধের ভেল্কি দেখিয়ে ঘরের সমস্যা ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করেই থাকেন। প্রেসিডেন্ট ধাঁচের একনায়কত্ব-ই তাে আয়ুব প্রশাসনের স্বরূপ। এখানে সাংবাদিকের স্বাধীনতাও নেই। সামন্ততান্ত্রিক আতঙ্কবাদী এক চক্র এখানে সক্রিয়। সংখ্যালঘুদের অধিকার পদদলিত বলেই বিগত কুড়ি মাসের মধ্যে ১০ লক্ষ হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খৃষ্টান পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে আন্দোলন করলে পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর চলে ক্রমবর্ধমান অত্যাচার এবং নিপীড়ন। এই নিপীড়ন ভরসা করে। সরকার চালিয়ে আয়ুবপ্রশাসন ধরা পড়ে গেছে। সত্যই নিজের দেশের নাগরিককেই তার সব চেয়ে বেশি ভয় – এ সত্যই ধরা পড়েছে আয়ুবতন্ত্রের এই দমন পীড়নের প্রশাসনের মধ্যে।(৪৬)
১৯৬৬ র ২০ শে মার্চ ঢাকায় প্রথাবাদী মুসলিম লীগের সমাপ্তি পর্বের অধিবেশনে আয়ুব, বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি কারী স্বায়ত্তশাসন পন্থীদের অস্ত্রের সাহায্যে মােকাবিলার হুমকি দিলেন। ২০ শে ফেব্রুয়ারী ‘আজাদ পত্রিকাকে ২০ হাজার টাকা নিরাপত্তা দাদন হিসাবে। জমা দিতে আদেশ করা হ’ল। সরকার ঘেঁষা এই পত্রিকাকেও ছাড় দেওয়া হল না তার। একটিমাত্র অপরাধের কারণে। অপরাধটি ছিল মুজিবরের একটি বিবৃতি ছাপা। ছাত্র আন্দোলন অথবা অন্য যে সব রাজনৈতিক আন্দোলন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে সে-সব ছাপা চলবে না — এই আদেশ জারী হ’ল। ইত্তেফাক, সান্ধ্যপত্রিকা ‘আওয়াজ’ এবং ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা টাইমস’ পত্রিকার উপরে। এই নিষেধাজ্ঞার সংবাদ ছাপা-ও নিষিদ্ধ হ’ল। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে পােষ্টার পড়লাে ঢাকা শহরে। যা ছাত্রদের কাজ বলে অনুমান করা চলে। একই সঙ্গে আওয়ামি লীগের সভাপতি মুজিবর সহ সর্বোচ্চ পর্যায়ের সকল নেতাকে গ্রেপ্তার করা হ’ল। ছয়-দফার দাবি উচ্চারণ করাও বলপ্রয়ােগে বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর এই স্বৈরাচারী সরকারের কাছে আবেদন করে পূর্ব পাকিস্তানীরা যে কোনাে ফল পাবেন না, সেকথা ইত্তেফাকের ৫-ই জুন লেখা হ’ল। লেখক মােসাফির। (৪৭) |
১৩ই মে ‘সংবাদ’ লিখলাে, ‘মুজিবর এবং তাঁর সহযােগীদের গ্রেপ্তার করে সরকার বুঝিয়ে দিল ‘জরুরী অবস্থা’ কে বিরােধী রাজনীতিকদের দূর করতেই ব্যবহার করা হল তার অভিসন্ধি। নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হ’লেও ছয়দফার সমর্থনে ঢাকার পল্টন ময়দানে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হ’ল। উদ্যোক্তা আওয়ামি লীগ। আওয়ামি লীগ এবং ছাত্র সম্প্রদায় সরকারের দমন নীতির প্রতিবাদে এবং মুজিবর প্রমুখ নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে ৭ই জুন রাজ্য জুড়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট ডাকলেন। ৫ই জুন গভর্নর মােনেম খান নারায়ণ গঞ্জে হরতালের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করতে গিয়ে স্বায়ত্তশাসনবাদীদের নিন্দা করা মাত্র সভার জনতা দলবদ্ধ ভাবে সভাস্থল ত্যাগ করেন। স্বায়ত্তশাসনের দাবির সমর্থনে শ্লোগানও দেওয়া হয় ঐ সভা চলাকালে। (৪৮)
৭ই জুনের হরতাল পূণাঙ্গ সাফল্যলাভ করে। হরতাল আহ্বায়কদের শােভাযাত্রা এবং সভা ভিন্ন রাজ্যের কোথাও অন্য কোনাে সরকারী বা বেসরকারী কার্যক্রম বা দপ্তর চালানাে সম্ভব হয় নি সেদিন। গুণ্ডাদের দিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করে হরতাল সমর্থকদের উপরে গুলি চালানাের পিছনে সরকারের হাত ছিল এই ইঙ্গিত দিয়ে ঐ দিনেরই বিশেষ সান্ধ্য সংস্করণে ‘সংবাদ সরকারের নিন্দা করে। রাজনীতিতে পরাস্ত সরকার পশুবলের মাধ্যমে জিততে চাইছে। এই সত্যই বেরিয়ে পড়ে নিরস্ত্র প্রতিপক্ষকে গুলি করে শেষ করার প্রবৃত্তির মধ্যে। সংবাদে এমন কথাও লেখা হয়, এ সরকারের কাছে মানুষ জীর্ণ সম্মার্জনীর চেয়েও যেন তুচ্ছ। ক্ষীণতম প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে এ সরকার করে লাঠি, গ্যাস, গুলির ব্যবহার করে গ্রেপ্তার চালিয়ে দেয় অত্যাচারের দুর্দম রথচক্র। পরবর্তী দিনের সংবাদ প্রকাশ করা হয় নি। হরতাল চলাকালে পৈশাচিক যে- আচরণ সরকারপক্ষ করেছে এবং ঐদিনের সংবাদ প্রকাশে যে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে তার প্রতিবাদেই ‘সংবাদ’ দৈনিকটির পরিচালকরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৭ই জুনের ‘ইত্তেফাক, স্বায়ত্ত্ব শাসনবাদীদের বিরুদ্ধে যে সন্ত্রাস বা পীড়ন চলছে তার নিন্দা করলেও হরতাল সম্পর্কে কোনাে সংবাদ দেয় নি। ঐ দিনের ‘পাকিস্তান অবসাভার’ যে বিদ্রুপাত্মক সম্পাদকীয় রচনা করে, তার উদ্দেশ্য ধরতে পারলে আয়ুবপন্থীদের গায়ে ফোস্কা পড়তাে। কোন্ কোন্ জাতের আমের ঘুম পাড়ানাের গুণ কতােটা তার বিশ্লেষণ এই প্রবন্ধের পাশাপাশি কোথাও কোনাে খবর ছিল না হরতাল সম্পর্কে। (৪৯)
সফল হরতালে ক্ষিপ্ত সরকার ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করলাে। থানার ভিতরে তাে বটেই, মাঝরাস্তায় মাঝরাতে বিচারের প্রহসনের পরে আটক করা শুরু হ’ল। গভর্নর মােনেমের হুমকি যে সত্য, সরকার যে আরাে বীভৎস নৃশংসতার পথ ধরবে স্বাধিকারপন্থীদের বিরুদ্ধে তা শীঘ্রই বােঝা গেল। মােসাফির ৯ই জুন খুবই তাৎপর্য পূর্ণ এক ইঙ্গিত দিয়ে লিখলেন, “ভাষা আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়েছে ওরা পূর্ব পাকিস্তানীদের রক্ত ঝরার পরে। ১৭ থেকে ১৯ শে জুন পূর্ব পাকিস্তানীরা প্রতিবাদ দিবস পালন করেন। ১৬ ই জুনের ইত্তেফাকে’ ৭ই জুনের হরতালের সব তথ্য প্রকাশ করা হয়, যা করা সেদিন নিষিদ্ধ ছিল বলে করা যায় নি। ১৬-ই জুনের ইত্তেফাকের সকল সংখ্যা সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ঐ দিনই রাত্রিতে ‘ইত্তেফাক দৈনিকের নির্ভীক সম্পাদক তােফাজ্জলকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। যে “নিউ নেশান প্রিন্টিং প্রেস থেকে ইত্তেফাক’, ‘ঢাকা টাইমস’ এবং চলচ্চিত্রের সাপ্তাহিক পূর্বাশা’ ছাপা হত তা বাজেয়াপ্ত হয়। ২০ শে জুন সংবাদপত্র এবং মুদ্রণ শিল্পের সমস্ত কর্মচারী এবং শ্রমিক ধর্মঘট পালন করেন। সংবাদ পত্র, সাংবাদিক এবং মুদ্রণ সংস্থার উপরে যথেচ্ছ অত্যাচারের এই ‘সরকারী অরাজকতা’র প্রতিবাদ করতেই এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। তােফাজ্জলকে ডি, পি, আর বা পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করার বিষয়টিও অবশ্যই এই ধর্মঘটের অন্যতম কারণ ছিল। সংবাদ পত্র জগতের রাজ্য জুড়ে এই ধর্মঘটের দিনে সরকারের পেটোয়া কিছু দৈনিক পুলিশ প্রহরায় ছাপা হয়। এই দৈনিক গুলি হল ‘আজাদ’, ‘দৈনিক পাকিস্তান এবং মনিং নিউজ’। খুবই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বের করা হয়েছিল সংবাদপত্র গুলির। কিন্তু সংবাদপত্রের ফেরীওয়ালারা ঐ সরকারসমর্থক পত্রিকাগুলাে বিক্রয় করা দূরের কথা, হাত দিয়ে স্পর্শ পর্যন্ত করে নি। ধর্মঘটী সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র সেবীদের প্রতি তথা জনগণের অধিকারের প্রতি ফেরীওয়ালাদের এই মমত্ববােধ উচ্চ প্রশংসার দাবি করে। রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক চেতনা কতদূর বিকাশ লাভ করেছিল এই আশ্চর্য ঘটনা যেন তারই সংকেত। (৫০)
একটানা পীড়ন, আর্থিক চাপ এ সবের ফলে সংবাদপত্র গুলি এর পরে নরমপন্থী হ’তে বাধ্য হ’ল। স্বায়ত্তশাসন সমর্থক সম্পাদক জাহিদ এবং সম ভাবাপন্ন সংবাদিকদের সরিয়ে দিয়ে ‘জনতা’ আত্মরক্ষা করলাে। সংবাদ’ কলেরা, বন্যা এই সব সংবাদ দিয়ে কাগজ ভরতি করতাে। ১২ই জুলাই থেকে একটি ব্যক্তিগত মালিকানায় চলা ছাপাখানা থেকে ‘ইত্তেফাক’ এক পাতার কাগজ আকারে যাওবা বের হ’ত, ২৭ শে জুলাই থেকে তা-ও বন্ধ হ’ল। সরকারী অনুমােদন থেকে নবপর্যায়ের ইত্তেফাক’ বঞ্চিত হবার কারণে। ঐ তারিখের ‘আওয়াজ, ইত্তেফাক দৈনিকের অনুমােদন নামঞ্জুর করাকে নিন্দা করে। বলে, বর্তমান পাকিস্তান সরকারের আমলের চেয়ে ব্রিটিশ আমলেও দেশবাসীর স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। ১৯৬৬ র ১১ই অগাস্ট ‘পাকিস্তান অবসা ভার’-এ সৈয়দ কামারুল আহসান লিখলেন, ভারত প্রশাসনে ব্রিটিশরা যেটুকু নৈতিকতার নিদর্শন রেখেছিলেন সেখানে পাকিস্তানী প্রশাসকরা এখনও পৌঁছাতে পারেন নি। ‘নিউ নেশান প্রিন্টিং প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করার সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় সরকার স্বৈরাচারের চূড়ান্ত ব্যভিচারের পথে অগ্রাহ্য করে। নিরাপত্তা আইনের সুযােগে সুপ্রিম কোর্টের রায় অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাকে আইনসিদ্ধ করে নেয়। যে-তড়িঘড়ি উপায়ে এটি করা তা এক তাজ্জব ব্যাপার। (৫১)
অগাস্টের গােড়ার দিকে ছয়দিনের সফরে ঢাকায় এসে স্বায়ত্তশাসনবাদীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করলেন আয়ুব খান। হাজার আন্দোলন কারীকে জেলে পুরে দিয়ে তারপরেও আয়ুব এই উক্তি করলেন যে, এ হ’ল মুষ্টিমেয় লােকের আন্দোলন এবং বড়ই দায়িত্বজ্ঞানহীন তারা। এদিকে কারান্তরালে অবস্থিত নেতা-কর্মীদের পরিবার-পরিজনের সংসার নির্বাহ করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়লাে। প্রায় উপােস করে দিন কাটাতে হবে – এমন অবস্থা এসে গেল অনেক ক্ষেত্রে। ৭ই অগাস্টের আগে-পরে যে ব্যাপক ধরপাকড় হয়, তার পুনরাবৃত্তি হলে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন আরাে ঝিমিয়ে পড়বে। জঙ্গী কার্যক্রমের বদলে তাই আওয়ামি লীগ গণস্বাক্ষর অভিযানের সিদ্ধান্ত নিল। নিতান্ত নিস্তেজ হয়ে পড়া আন্দোলনের সময়ও আওয়ামি লীগকে ১৬ই অগাস জনসভা করার অনুমতি দিল না সরকার।(৫২)
নরমপন্থী আন্দোলনও আংশিক কার্যকারিতা পেতে পারে সকল আন্দোলনকারী ঐক্যবদ্ধ হলে। জমাত-ই-ইসলাম এবং কাউনসিলরস মুসলিম লীগ ঠিক ছয়-দফা মেনে নিলেও এবং প্রথমােক্ত দল ১৯৬৬-র জুন মাসে স্বায়ত্তশাসন-আন্দোলনে যােগ দিলেও, মমাটের উপর পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধানে ছয়-দফার অধিকাংশ কার্য সূচির সঙ্গে এই সব দলের বড় কোনাে মতভেদ ছিল না। তবে সম্পূর্ণ স্বাধীন অর্থনীতির দাবি পর্যন্ত। অনেকে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। নুরুল আমিনের বাড়িতে বিভিন্ন দলীয় নেতাদের এক বৈঠকে যুক্ত কর্মসূচি প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে আলােচনা বেশ ফলপ্রসু হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে এইরূপ আলােচনা আরাে চলবে একথা ঐ বৈঠকের পরে জানানাে হয়।(৫৩)
৭ই জুনের হরতালে কিংবা তার পরিণামে মৌলানা ভাসানী এবং তাঁর অনুগামী ন্যাপপন্থীরা সম্পূর্ণ অসহযােগিতা এবং ঔদাসীন্য দেখালেও, ভাসানী স্বায়ত্তশাসন সমর্থক হিসাবে নিজেকে চিহ্নিত করলেন। ঐ উদ্দেশ্যেও তিনি আওয়ামি লীগের সঙ্গে হাত মেলাবেন না একথাও বলতে দ্বিধা করলেন না। কাগমারির সম্মেলনের আমল থেকেই তিনি মুজিবরের বিরােধী – শুধু এটুকু বললে যথেষ্ট হবে না। ভাসানি আসলে আয়ুবের প্রশ্রয়ে প্রীত হয়েছেন এখন। চীনপন্থী বলে পরিচিত ভাসানির চীনভক্ত সহকর্মীদের আয়ুব জেল থেকে মুক্তিও দিলেন এই সময়। চীনের আনুকূল্য লাভ করে আয়ুব এটুকু করতে বাধ্য ছিলেন। ভাসানির ন্যাপ দলের শ্রমিকরাও যখন মুজিবরপন্থীদের ডাকা ৭ই জুনের হরতালে দলে-দলে যােগ দিলেন, ন্যাপ এবং ভাসানি স্বয়ং হকচকিয়ে গিয়ে স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। কিন্তু মুজিবরের ছয় দফা মানবেন না এটুকু যােগ করতে ভাসানির ভুল হ’ল না। যাই হােক ১৪-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ১৪ই অগাস্ট ন্যাপ তার আন্দোলন শুরু করে। আয়ুবের মুসলিম লীগ ঐদিন জাতীয় সংহতি দিবস হিসাবে পালন করতে গিয়ে জনসমর্থন আদৌ পায় নি। অন্যদিকে ন্যাপ যথেষ্ট জনসমর্থন লাভ করেছিল। (৫৪)
আওয়ামি লীগ নেতা সব জেলে। ন্যাপ নেতারা মুক্ত। এই সুযােগে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের চালকের আসনে দেখা গেল ন্যাপকে। ৪ঠা সেপ্টেম্বর তদানীনন্তন বন্যার ত্রাণকার্যের দাবিতে এক দাবি দিবস পালন করে ন্যাপ। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিও করে।
২রা এপ্রিল, ১৯৬৭ ফের দাবিদিবস পালিত হল। এবারে ছিল প্রায়-দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। ঐ বন্যার পরিণামেই এই খাদ্যাভাব। ২রা এপ্রিলের দাবিদিবসে চাকুরী এবং বর্ধিত মজুরির দাবিও ছিল। কাজেই ন্যাপের সর্বস্তরের কর্মী এবং নেতার সঙ্গে ছাত্র-শ্রমিক নেতা এবং বহু শিক্ষকও কারারুদ্ধ হলেন এই সময়। ন্যাপের সহ-সভাপতি দানেশ এবং সাধারণ সম্পাদক হুসেইনকে গ্রেপ্তার করা হল। চীন-পন্থী নয় এমন ন্যাপ সদস্যদের সমর্থক ‘সং বাদ’ ২৫ শে মে, ১৯৬৭ থেকে তার প্রকাশনা বন্ধ করতে বাধ্য হ’ল। পূর্বতন সম্পাদক পদত্যাগ করলে নূতন সম্পাদকের নিয়ােগ হয় সংবাদ পত্রিকায়। সরকার নূতন পরিস্থিতিতে অনুমােদন প্রত্যাহার করে পত্রিকাটি স্তব্ধ করে দিল। পরিকল্পিতভাবে একের পর এক বিরােধী সংবাদপত্র উৎখাত করে চললাে সরকার পক্ষ। (৫৫)
১৯৬৭ র ৩০ শে এপ্রিল, এন, ডি, এফ নেতা আতাউর রহমানের বাসভবনে আওয়ামি লীগ, কাউনসিলরস মুসলিম লীগ, জমাত-ই-ইসলাম, নিজাম-ই- ইসলাম এবং এন, ডি, এফ প্রতিনিধিরা ৮ – দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পি, ডি, এম নামে এক পাকিস্তানী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৬ র সংবিধান ফিরিয়ে আনা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের তথা প্রত্যক্ষ এবং প্রাপ্তবয়স্ক মাত্রের ভােটাধিকার দাবির সঙ্গে পাকিস্তানের উভয় অঙ্গের মধ্যে সর্বাঙ্গীণ সমতার দাবি করা হয়। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছয়দফার মতাে অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য দাবি ছিল না। পরিবর্তে কেন্দ্রীয় বিষয় গুলি অথাৎ মুদ্রা, ব্যাঙ্ক, বৈদেশিক মুদ্রা এবং দেশের দুই অঙ্গের মধ্যে অন্তর্বানিজ্য তথা যােগাযােগ পরিচালন এবং পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথক পৃথক বাের্ডের প্রস্তাব করা হ’ল। প্রত্যেক বাের্ডে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য সংখ্যা সমান থাকবে – এ প্রস্তাবও ছিল। ন্যাপ এই ফ্রন্টে যােগ দেয় নি। নেতারা তাদের জেলে তাই মার্কিন চক্রান্তে সৃষ্ট এই ফ্রন্টে তারা যােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি—এই হাস্যকর চপলােক্তি সত্ত্বেও এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তারা আয়ুবকে চটাতে চায় না। (৫৬)
বিরােধী ঐক্যের অভাবে এই স্তিমিত আন্দোলনে কাজের কাজ কিছু না হলেও লােক-দেখানাে অর্থে ঢাকাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে জাহির করতে বেশ কিছু ইমারত গড়া হল। নূতন নূতন অট্টালিকা শােভিত এলাকার নাম দেওয়া হ’ল আয়ুব নগর। সরকারী দপ্তরগুলােও এল না। সে সবে পূর্ব পাকিস্তানীদের নিয়ােগ করাও হ’ল না। এই প্রতীকী সমতার প্রয়াস সরকারের দমননীতির পাশাপাশি একটি ভণ্ডামির নিদর্শন বই কিছু ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের মূল দাবিগুলির কোনােটি, এমন কি ভাষা-সংস্কৃতির সমস্যার কোনাে সমাধান হ’ল না। ধাপ্পাবাজির চরম নিদর্শন দিয়েছিলেন যােগাযােগ মন্ত্রী সাবুর যিনি ঢাকায় দুটি বন্দুক কারখানার কথা এমন কি একটিতে উৎপাদন চালু হয়ে। গেছে এমন কথা বলেছিলেন ১০ই এপ্রিল ঢাকায় এসে। সংসদে প্রতিরক্ষা সচিবের উক্তি অনুসারে ঐ কারখানা ভবিষ্যতে হবে। এই উক্তির ২৬ দিন পরেই সাবুরের উক্তি। ১২ই এপ্রিল ‘ইত্তেফাক’ এই নিয়ে প্রশ্ন তােলে। ঐ দিন ‘আজাদ’ লেখে, ‘সাংবাদিকদের কারখানার কাজ দেখিয়ে সন্দেহ দূর করা হােক।’ (৫৭)।
অতি স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানীর মাতৃভাষা উর্দুকে পাকিস্তানী ভাষা শিরােপা দেবার প্রস্তাব করে বসলেন কেন্দ্রীয় উর্দুবাের্ডের সভাপতি। ১৯৬৬ র ২৬ শে অগাস্ট এই অদ্ভুত প্রস্তাব উত্থাপিত হলে ‘সংবাদ পত্রিকা লিখলাে, এ হ’ল বাঙলা ভাষা এবং বাঙালীকে হিন্দুজাতির ব্যাপার হিসাবে দেখানাের পুরানাে খেলা।’ রবীন্দ্র সঙ্গীত উভয় বঙ্গেই জনপ্রিয়। ১৯৬৭ র জুনে যে রেডিও পাকিস্তানকে আদেশ করা হ’ল রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করতে তার মূলে সামরিক শাসকদের ঐ অমূলক ভীতি। দুই বাঙলার যােগসূত্র খতম করলে ওদের কী যে বিপদ হত ওরাই জানে। (৫৮)।
‘পাকিস্তান অবসাভার’ ১৯৬৬ র ৫ই সেপ্টেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশ করলাে। সংসদে সরকার পক্ষ জানিয়েছিল ন্যাশানাল শিপিং করপােরেশনের ৫ লাখ টাকার শেয়ার মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানের গরিবদের ক্রয় করার সুযােগ দেওয়া হবে। ৫ই সেপ্টেম্বর ঐ শেয়ার ক্রয় করতে হত। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাঙ্কে সংশ্লিষ্ট ফর্ম ৩রা সেপ্টেম্বরের আগে পৌছায় নি। ঢাকাতেই এই অবস্থা ছিল। মফঃস্বলের কথা বলাই বাহুল্য। অথাৎ পূর্ব পাকিস্তানীদের ঐ শেয়ার কেনা থেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা হ’ল। কারসাজির এ ছিল এক বড় প্রমাণ। (৫৯)
পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকরা ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন সমরবিভাগের এবং প্রশাসনের হাতে। পূর্ব বাঙলার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দুই শীর্ষ নেতা মুজিবর এবং তােফাজ্জলকে প্রলােভন দিয়ে আন্দোলন বিমুখ করতে ব্যর্থ হয়েছিল শাসকচক্র। (৬০) আন্দোলনের পক্ষে নেতৃত্বের এই নিষ্ঠা ছিল একটি প্রধান শক্তি। অবশ্য চাকুরীর টোপ গিলে অনেক ছাত্রনেতাই আন্দোলনের পথ থেকে সরে দাঁড়ায় এ সময়। তথাপি জনজাগরণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অনিবার্যতা নিয়ে যে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল, নিছক পাশব বলের জোরে তাকে স্তব্ধ করতে গেলে প্রতিক্রিয়া সহজেই অনুমেয়। বিশেষতঃ পাকিস্তানের জন্মের এতদিন পরে পূর্ব পাকিস্তানেও জেগে উঠেছিল যে মুসলিম মধ্যশ্রেণী আন্দোলনের পুরােভাগে তারই তাে আসার কথা। (৬১)
আবুল মনসুর ১৯৫৬ র ২২ শে মার্চ সংসদে বলেছিলেন – সংবিধান চালু হবার পূর্বে যারা পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করতাে আজ তারা সংবিধানের নামে ঐ শােষণ বজায় রাখছে। ভৌগােলিক ব্যবধান, সমুদ্রের ফারাক অগ্রাহ্য করে আমেরিকাকে যে চোখে দেখতাে ইংরেজরা, এডমণ্ড বার্ক তা শুধরে নিতে বললেও কেউ তাঁর কথা মানে নি। আমেরিকার জনগণের কথা মেনে নিতে কিন্তু সবাই বাধ্য হয়েছিল। ভূগােলের সত্য। অস্বীকার যে করবে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। এর প্রায় দশবছর পরে নুরুল ইসলাম বলেছিলেন — যদি পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার না মানা হয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুখে হয়তাে পাকিস্তান সরকার শুনবে বিদায় সম্ভাষণ। অধ্যাপক রুপার্ট এমার্সনের কথায়, “যে-কোন কিছু দাঁড় করানাের ব্যাপারে উতরে গেলে শুধু সেই কারণেই জাতিসত্তা প্রতিপন্ন হয়। অন্ততঃ পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। অনুরূপে পূর্ব পাকিস্তান যদি আজ পৃথক জাতি হিসাবে বেরিয়ে আসে তত্ত্বগত ভাবে তার বিরােধিতা করার কিছু নেই। (৬২)।
ব্যাপক ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র এবং কয়েদখানার যথেচ্ছ ব্যবহারে গণদাবির সমাধি রচনায় তৎপর এই আয়ুবতন্ত্র। পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্য কিংবা বলিষ্ঠ জাতীয়তাবােধের উদ্ভবের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের স্বতঃপ্রণােদিত মিলনের দিন আজো যেন দূরেই রয়ে গেল।
আয়ুবরাজ বাহুবলের জোরে টিকে আছে। শক্তির কেন্দ্রভূমিতে অবস্থান করছেন পশ্চিম পাকিস্তানী সমরনায়কগােষ্ঠী এবং অসামরিক প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তিবর্গ। তাঁদের কেউ কেউ আয়ুবের মতােই পুরাদস্তুর রাজনীতিকে রূপান্তরিত হয়েছেন। এই শাসকগােষ্ঠী দেশের উভয় অঙ্গের পেটোয়া রাজনীতিকদের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে এক ঔপনিবেশিক শাসনের জগদ্দল পাথর চাপিয়েছে। তার অনিবার্য পরিণামে সেখানে বিরাজ করছে এক চরম নৈরাশ্য। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি – সর্বত্র একই বঞ্চনার হাহাকার। এই উপনিবেশবাদ চালিয়ে যাবার স্বপক্ষে যে চিরাচরিত অজুহাত দেখানাে হচ্ছে তার কথা উপনিবেশবাদের গবেষকমাত্রেরই জানা আছে। বলা হচ্ছে, স্বায়ত্তশাসনের যথাযথ প্রয়ােগের যােগ্যতাই নেই পূর্ব পাকিস্তানীদের। মুষ্টিমেয় বিপথগামী লােকের এই দাবির পিছনে শত্রুদেশগুলির মদত আছে। অবশ্য এই দাবির যৌক্তিকতার স্বপক্ষে বিস্তর তথ্য প্রমাণ সন্নিবিষ্ট হয়েছে এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়ােজন বর্তমান গ্রন্থলেখক পদার অন্তরালের বিশিষ্ট সাক্ষীসাবুদের সহায়তা লাভ করেছেন। সেই বিশিষ্ট এবং সাধারণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছিল তাঁদের পরিচয় অপ্রকাশিত রাখার শর্তে। তা ছাড়া বহুলাংশে অবহেলিত বাঙলা সংবাদ পত্র পত্রিকা এবং ‘ বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন শিরোনামাক্লিষ্ট সংসদীয় বিতর্কের অপ্রকাশিত অংশাদি এ গ্রন্থের তথ্যসূত্রের অন্তর্গত। বর্তমান বিষয়বস্তুর উপরে গ্রন্থরচনার ক্ষেত্রে পূর্বতন গ্রন্থকাররা সংসদীয় বিতর্কের অসম্পূর্ণ তথা অপ্রতুল উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। প্রাগুক্ত বাঙলা সংবাদপত্রাদির ব্যবহারও যথেষ্ট ছিল না সে সব গ্রন্থে।
সন্ত্রাসের বল্গাহীন অপপ্রয়ােগ, যােগাযােগ মাধ্যমগুলির উপর একপেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যে আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে এই শাসনযন্ত্র, তার পেষণে থেকে নিকট ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানীদের অভীপ্সা পূর্ণ হবে – এমন কথা বলা দুরূহ। সামরিক একনায়কতন্ত্রের মােকাবিলায় বলপ্রয়ােগের প্রয়ােজন হলেও সুযােগ নেই। গােপন
১২৫
অস্ত্রাগারের বন্দোবস্তও সম্ভব নয়। প্রতিবেশী কোনাে দেশও এখন পর্যন্ত প্রয়ােজনে অস্ত্রের যােগান দেবে – এমন আভাস নেই। মৌল মানবিক অধিকার পদদলিত হলে নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণে অভ্যস্ত জাতিসঙ্খ-ও পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে – এমন আশা করা যায় না। কেন না, বৃহৎ শক্তিদের হস্তক্ষেপ অসম্ভব না হলেও অবাঞ্ছিত। বৃহৎ শক্তিদের ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ব পাকিস্তান দ্বিতীয় ভিয়েনামে পরিণত হতে পারে সেক্ষেত্রে। বরং পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যেই সুস্থ গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষ ঘটলে পূর্ব পাকিস্তানীদের বাসনা চরিতার্থতা পেতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে তাদের অভীপ্সা পুরণের পথে যা কিছু অন্তরায় তারই তাে অপনােদন হবে। এই মুহূর্তে সেই শুভ পরিস্থিতির প্রতীক্ষা করাই পূর্ব পাকিস্তানীদের পক্ষে বাঞ্ছনীয় মনে হয়।

References:
1. G. W. CHOUDHURY, Democracy in Pakistan, pp. 242-43. NAP Debates, 13 August 1964, Vol. III, No. 12, p. 769.
2. G. W. CHOUDHURY, n. 1, p. 242. Ittefaq 29, 30 August 1964. Janata, 23 December 1964.
3. NAP Debates, 18 June 1962, Vol. I, No. 4, p. 109. NAP Debates, 12 June 1963, Vol. II, No. 7, pp. 353-54, 367. NAP Debates, 15 June 1963, Vol. II, No. 10, pp. 537-38. NAP Debates, 15 June 1964, Vol. II, No. 12, pp. 744-45. KHALID B. SAYEED, “Pakistan’s Constitutional Autocracy”, Pacific Affairs, Winter 1963-64, p. 372.
4. NAP Debates, 13 June 1963, Vol. II, No. 8, p. 404. NAP Debates, 14 June 1963, Vol. II, No. 9, p. 479. NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, pp. 577-78. Ittefaq, 17 June 1964. NAP Debates, 17 June 1965, Vol. II, No. 3, pp. 186-87.
5. Ittefaq, 22 March 1964. ASGAR ALI, “Eleven years of the Ganges-Kabodak Project”, Janata, 28 October 1964. An Evaluation of the Rural Public Works Programme East Pakistan 1962-63, by an Evaluation Team (Comilla, East Pakistan, Pakistan Academy for Rural Development, 1963), pp. 3, 110-12.
6. Janata, 21 October 1964. Pakistan Observer, 14 March 1966. 7. NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, p. 565.
8. NAP Debates, 1 August 1963, Vol. II, No. 39, pp. 2438-39, 2443, 2446, 2449, 2451-52.
9. Pakistan Observer, 18, 19 March 1966. NAP Debates, 17 June 1965, Vol. II, No. 3, p. 163.
10, Pakistan Observer, 24, 27 April 1966.
11. NAP Debates, 15 June 1963, Vol. II, No. 10, pp. 536-38.
12. Ittefaq, 9 March 1964. NAP Debates, 18 June 1963, Vol. II. No. 12, p. 662
13. NAP Debates, 27 June 1964, Vol. II, No. 24, pp. 1996-97. NAP Debates, 17 June 1963, Vol. II, No. 11, pp. 556-57. 14. Janata, 28 October 1964. 15. Ittefaq, 28 February 1964.
16. NAP Debates, 27 June 1964, Vol. II, No. 24, p. 2004. The Times of India, 6 December 1965. Azad, 14 May 1966. Sangbad, 20, 21 May 1966.
17. NAP Debates, 12 June 1963, Vol. II, No. 7, pp. 334-35.Ittefaq, 23, 25 February, 5, 12, 13 March 1964. REHMAN SOBHAN, “The Problem of Regional Imbalance in the Economic Dvelopment of Pakistan”, Asian Survey, July 1962, p. 36.
18. Sangbad, 25, 29 June, 22 July 1966. Compass, 10 September 1966, pp. 984-86.
19. NAP Debates, 13 August 1964, Vol. III, No. 12, pp. 772-73. 20. Ibid. 21. Ittefaq, 2, 3, 4, 5 August 1964. Janata, 21 October, 4, 25 November 1964.
22. Ibid., 5 May 1965. Provatee (Weekly, Chittagong), 7 May 1965. Ittefaq, 10, 19, 21, 28, 29, 30 May 1965. The Pakistan Times, 19, 28 May 1965. Compass, 29 May 1965, pp. 16-17.
23. NAP Debates, 17 June 1965, Vol. II, No. 3, pp. 184-85, 193-94. NAP Debates, 21 June 1965, Vol. II, No. 6, pp. 300-01, 312, 359. NAP Debates, 22 June 1965, Vol. II, No. 7, pp. 416, 420-21, 422-24. Ittefaq, 23, 24 June 1965. Purbodesh, 27 June 1965.
24. Ittefaq, 3, 14, 19, 22 August 1965. Azad, 24, 25 August 1965. Sangbad, 14, 22 August 1965. 25. Ittefaq, 28, 30 August 1965. The Patriot, 3 August 1965. 26. Pakistan Observer, 4, 5, 7 August 1965. Ittefaq, 6 August 1965. Sangbad, 6, 9, August 1965.
27. S. P. CHATTERJEE, Bengal in Maps (Calcutta, Orient Longmans, 1949), pp. 10-11. ASIT BHATTACHARYA, “The Farakka Barrage and East Bengal”, Compass, 24 July 1965, pp. 14-15. The Times of India, 4 August 1965. Azad, 4, 9, August 1965. Ittefaq, 8, 16 August 1965. The Morning News (Dacca), 9 August 1965.
28. Pakistan Observer, 4, 5 August 1965. Ittefaq, 7, 29 August, 3 September 1965. Sangbad, 7, 29 August, 2 September 1965.
29. Ittefaq, 9, 24 August, 3, 4 September 1965.
30. NAP Debates, 19 November 1965, Vol. III, No. 4, pp. 205, 21011, 235-36, 243-44, 257-58.
31. Ittefaq, Sangbad, Pakistan Observer, 22, 23 October 1965. The Bombay Chronicle (Bombay), 28 October 1965. The Amrita Bazar Patrika, 29 October 1965. The Patriot, 3 November 1965. Ittefaq, Sangbad, 10 February 1966.
32. Ittefaq, Sangbad, 1, 2 November 1965. The Patriot, 3, 28, 29 November 1965. The Times of India, 4 November 1965.
33. Azad, 11, 15, 18 January 1966. Ittefaq, 11, 16, 18 January, 5 February 1966. Sangbad, 11, 12, 14, 16, 18, 22 January, 6 February 1966.
34. Azad, 3 February 1966. Ittefaq, 3, 6, 10, 12 February 1966. Sangbad, 4, 9, 10 February 1966.
35. Pakistan Observer, 4 February 1966. Sangbad, 6 February 1966.
36. Ittefaq, 22 January, 3, 14 February 1966. Sangbad, 20, 21 January, 17, 27 February 1966. Pakistan Observer, 6, 20 February 1966.
37. Azad, Ittefaq, Sangbad-For the week 14-20 February 1966. Dacca Times, 21 February 1966. Ittefaq, 21 February 1966.
38. Ibid., 27, 28 February 1966. SHAIKH MUJIBUR RAHMAN, Amader Banchbar Dabi (Dacca, 1966); ABUL KALAM AZAD, Pakistaner Ancholik Boishamyo (Dacca, 1966); both in Bengali.
39. GUNNAR MYRDAL, Development And Under-Development (Cairo, National Bank of Egypt, Fiftieth Anniversary Commemoration Lectures, 1956), pp. 53-55. NAP Debates, 12 June 1963, Vol. II, No. 7, p. 367. Ibid., 19 June 1963, Vol. II, No. 13, pp. 705-6. NAP Debates, 17 June 1965, Vol. II, No. 3, pp. 184-85.
40. MYRDAL, n. 39, pp. 27-31. K. L. SETH, The Pattern of Economic Development in Pakistan (Ph. D. Dissertation, Indian School of International Studies, New Delhi, 1965), pp. 198-99. NAP Debates, 13 August 1964, Vol. III, No. 12, pp. 771, 775. J. C. EDDISON, “Industrial Location and Physical Planning in Pakistan”, The Pakistan Development Review, Spring 1961, pp. 2-3. REHMAN SOBHAN, “The Problem of

Regional Imbalance in the Economic Development of Pakistan”, Asian Survey, Berkeley, July 1962, pp. 35-36.
41. SETH, n, 40, pp. 200-21. NURUL ISLAM, “Some Aspects of Interwing Trade and Terms of Trade in Pakistan”, The Pakistan Development Review, Spring 1963, pp. 3-5.
42. Ittefaq, 4, 12 March 1966. 43. Pakistan Observer, 17, 19, 20, 21 March, 4, 19 April 1966. Ittefaq, 1 April 1966.
44. Pakistan Observer, 5, 19, 20 April 1966. 45. Ittefaq, 16 March 1966. Pakistan Observer, 4 April 1966. The New York Times, 21, 24 April 1966. The Observer (London), 24 April 1966. The Times (London), 17 May 1966. NAP Debates, 22 June 1965, Vol. II, No. 7, pp. 420-21. NAP Debates, 10 July 1965, Vol. II, No. 17, pp. 1264, 1273, 1278.
46. JOHN E. OWEN, “Frustrations of East Pakistanis”, The Pioneer (Lucknow), 14 November 1965.
47. Azad, 20, 26, 27 February 1966. Dacca Bengali Press reports, 1-15 April 1966. Ittefaq, 5 June 1966. Pakistan Observer, 5 June 1966.
48. Ittefaq, 13, 15 May 1966. Sangbad, 13 May 1966. Dacca Times, 27 May 1966.
49. Ittefaq, 7 June 1966. Pakistan Observer, 8 June 1966. Sangbad, 7 June 1966.
50. Ittefaq, 9 June 1966. Pakistan Observer, 16, 22 June 1966. Sangbad, 16-22 June 1966.
51. Pakistan Observer, 22 June, 10, 11 August, 16, 17 November 1966. Awaz, 12, 27 July 1966.
52. Pakistan Observer, 7, 8, 17 August 1966. The Pakistan Times, 13 June 1966.
53. GHULAM AZAM, Purbo Pakistaner Mukti Kon Pathey (i.e., Which Way Lies the Emancipation of East Pakistan), Dacca, 1966. Azad, 1 August 1966. Sangbad, 1 August 1966. 54.The Patriot, 4, 5 December 1965. Sangbad, 19, 20 July, 14, 15 August 1966.
55. Sangbad, 2, 3, 4, 5 September 1966 ; 1, 2, 3 25 April 1967. Pakistan Observer, 25 May 1967.
56. Sangbad, 1, 2 May 1967. 57. Azad, 11, 12 April 1966. Ittefaq, 12 April 1966. 58. Sangbad, 26 August 1966. Jugantar, 29, 30 June 1967. 59. Pakistan Observer, 5 September 1966. 60. Interviews. 61. P. C. LAHIRY, Letter to the author, dated 20 July 1966. BROJOMADHAB DAS, Letter to the author, dated 22 August 1966. Mr.Das was a member of the provincial legislature of East Pakistan during 1947-58, and came to India a few days before the outbreak of hostilities in September 1965.
62. Speech by ABUL MANSUR AHMAD, CAP (Legislature) Debates, 22 March 1956, Vol. I, No. 7, pp. 361-62. Speech by A. B. M. NURUL ISLAM, NAP Debates, 10 July 1965, Vol. II, No. 17, p. 1278. RUPERT EMERSON, From Empire to Nation (Boston, Beacon Press, 1962), p. 92.
63. গনতন্ত্র এবং জাতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা – জয়ন্তকুমার রায়, pp 101-126