You dont have javascript enabled! Please enable it!

মহেশপুর মুক্ত, খুলনা
[অংশগ্রহণকারির বিবরণ]

নভেম্বরে দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য সাড়াশি আক্রমণ পাকবাহিনীকে দিশেহারা অবস্থায় ফেলে দেয়। ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে চলছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযান। আমাদের প্ৰধান টার্গেট মহেশপুর থানা সদরে শত্রুদের প্রধান ঘাঁটি দখল। এফ এফ এর পান্তাপাড়ায় অবস্থানরত এই কোম্পানির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল কোম্পানি কমান্ডার। যুদ্ধের জন্য একজন সৈনিকের যতগুলো গুণ থাকা দরকার বলা যায় তার অধিকাংশ ছিল তার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। কমান্ডারের অস্তিত্ব টের পাইনি কখনো। কর্তৃপক্ষ কোনো রকম দক্ষতা ও যোগ্যতা বিচার না করেই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে একজন অযোগ্য অচেনা এক এফ এফ কে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেন। অবশ্য গেরিলারা এ বিষয়ে ছিল নিশ্চুপ। এ নিয়ে কারো মধ্যে কোনো বাহ্যিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। সিদ্ধান্ত নেয়া হতো সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে। মহেশপুর আক্রমণ পরিকল্পনায়ও ঘটে তাই। ২১ নভেম্বর দত্তনগর আর্মি ক্যাম্প দখলের পর কিছুদিন বিরতি নেই আমরা। বিশ্রাম, গোলাবারুদ সংগ্রহ, মহেশপুর থানায় যুদ্ধরত বিভিন্ন গ্রুপগুলোর সমন্বয়ের জন্য এ সময়ের প্রয়োজন ছিল। মহেশপুরে হানাদারদের ঘাঁটিটি ছিল অধিকতর সুরক্ষিত। পৌরসভার কেন্দ্রস্থলে পৌরসভার অফিস, মহেশপুর হাই স্কুল ও থানায় পাকা বাংকার করে পাকবাহিনী তাদের অবস্থানকে করে তুলেছিল দুর্ভেদ্য। পিস কমিটির সদস্য, রাজাকারদের সমর্থনে বেশ আরামেই ছিল তারা। কিন্তু দেশের বিভিন্ন সেক্টরে ও আশেপাশে পাক সেনাদের বিপর্যয়ের সংবাদে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল মহেশপুরের খান সেনারা যা ছিল আমাদের অনুকূলে। মনোবল ভেঙ্গে পড়া পক্ষ যুদ্ধে কখনো সাফল্য আশা করতে পারে না। ৫ ডিসেম্বর মহেশপুর আক্রমণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। যোদ্ধারা প্রস্তুত। সংবাদ আসে মহেশপুরের সকল প্রবেশ পথের আশেপাশে পাকবাহিনী প্রচুর এন্টি পারসোনাল মাইন পুঁতে রেখেছে। এটা ছিল আমাদের জন্য এক দুঃসংবাদ। বিপদজ্জনকও বটে। কারণ আমাদের সাথে না ছিল কোনো মাইন ডিটেকটর না ছিল কোনো বিশেষজ্ঞ। কিন্তু আক্রমণে বিলম্ব করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। অগত্যা মহেশপুর আক্রমণে দুর্গম পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ছোট ছোট ঝোপঝাড়, বাবলা গাছের কাটা, ঘুটঘুটে অন্ধকার, পানের বরোজের অচেনা পথ পেরিয়ে লক্ষ্যস্থলে যাওয়া ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মহেশপুরের পার্শ্ববর্তী হানাদারদের ঘাঁটিগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যাহত সাঁড়াশী আক্রমণে ছিল তটস্থ। পার্শ্ববর্তী ঘাঁটি চৌগাছা ও কোঁটচাঁদপুরের সাথে মহেশপুরের ঘাঁটির প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থা। পাকবাহিনীর টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। রাজাকাররা আতঙ্কগ্রস্ত। এ অবস্থায় ৫ ডিসেম্বর শেষ রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু হয়। এফএফ-এর একটি কোম্পনি তিন ভাগ হয়ে এ আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। একটি গ্রুপকে মহেশপুর পৌরসভা, দ্বিতীয়টিকে মহেশপুর হাই স্কুল ও থানা এবং তৃতীয় গ্রুপকে মহেশপুর বাজারে রাজাকারদের অবস্থানের ওপর আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। রাত ৩ টায় যুগপৎ আক্রমণ শুরু হলে মনোবল হারানো পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ দত্তনগর আর্মি ক্যাম্প থেকে দখল করা কিছু গোলাবারুদ এ আক্রমণে ব্যবহার করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাকবাহিনী খুব কম সময়ের জন্য প্রতিরোধ গড়তে সমর্থ হয়। ভোর হওয়ার কিছু আগে জীবন নিয়ে কোনো রকমে মহেশপুর পৌরসভার শেষ প্রান্ত ভালাইপুর ব্রিজের অপর পাশে তারা অবস্থান নেয়। সকাল ৮ টায় হানাদারদের মূল ঘাঁটিতে আমরা প্রবেশ করি। বিজয় উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধারা। তারা থানাচত্বরে একত্রিত হয় এবং আকাশে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে থাকে। মহেশপুরের মুক্তিকামী জনতা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অভিনন্দন জানায়। এ সময় মহেশপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হকসহ বেশ কিছু রাজাকারকে গ্রেফতার করা হয়। পাকবাহিনীর দোসর কুখ্যাত এ সকল লোকজনকে কোম্পানি কমান্ডার দুদিন পর অজ্ঞাত কারণে ছেড়ে দেন। গ্রেফতার হওয়ার পর হকের স্ত্রী, কন্যা ও অন্যান্যদেরকে কোম্পানি কমান্ডারের নিকট দিন রাত ধর্ণা দিতে দেখা যায়। ভালাইপুর ব্রিজে শত্রুদের অবস্থান ছিল ক্ষণিকের। তারা অবস্থা বেগতিক দেখে দুপুরের দিকে পালিয়ে যেয়ে খালিশপুর আশ্রয় নেয়। একই দিন জীবননগর হানাদারমুক্ত হলে সেখান থেকে পালিয়ে আসা হানাদারদের সাথে খালিশপুরের পাকবাহিনী কোটচাঁদপুর হয়ে যশোরের দিকে চলে যায়। মুক্ত হয় সমগ্র মহেশপুর। পত পত করে উড়তে থাকে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মহেশপুর মুক্ত হওয়ার পরের দিন মিত্রবাহিনীর সাথে আমরা কয়েকজন যশোরের দিকে অগ্রসর হই। পথে পথে সাধারণ মানুষের প্রাণঢালা অভিনন্দন ও উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত হয় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। বিশেষ করে ভারতীয় বাহিনীর প্রতি মানুষের ভালোবাসার উচ্ছ্বাস দেখে অভিভূত হয়ে যায় ভারতীয় অফিসার ও জওয়ানরা। স্বাধীনতাকামী বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন পূরণে সাথী ভারতীয় বাহিনীকে বিপুলভাবে স্বাগত জানায় আপামর জনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ত্রিশ লক্ষ বাঙালির রক্তস্রোতের সাথে যেন একটা উষ্ণ রক্তনালী যোগ হয়েছিল। সর্বস্তরের জনতা বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় বিজয়ের মুকুট পরায়, ফুলের মালায় বরণ করে নেয় ভারতীয় বাহিনীকে।
[৬] আব্দুল আজিজ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!