মহেশপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় আক্রমণ, খুলনা
পাক হানাদারদের মূল সেনা ব্যারাক ছিল মহেশপুর থানা, মহেশপুর পাইলট হাই স্কুল ও পৌরভবনে। সাথে ছিল রাজাকারদের কয়েকটা প্লাটুন। চৌগাছা থানা সদরেও ছিল পাক সেনা ঘাঁটি যা দুটি সমন্বয়ের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করে চলছিল। মহেশপুরের চার কিলোমিটার উত্তরে খালিশপুরে ছিল পাক বাহিনীর একটি ছোট শক্তিশালী ইউনিট। মহেশপুরের পার্শ্ববর্তী জীবননগর থানা সদরে পাক বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছিল। গ্রামের উত্তরে দত্তনগর সরকারি কৃষি খামারে পাক বাহিনীর একটা প্লাটুন শক্ত অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ করছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগুপ্তা আক্রমণ। নিয়োজিত ছিল কিছু রাজাকার। এরা ছিল বেশ দুর্ধর্ষ। ঘাঁটিটিও ছিল সুরক্ষিত। পাক বাহিনী প্রথম থেকেই আত্মরক্ষার্থে এখানে কয়েকটি পাকা বাংকার তৈরি করে। এক একটা বাংকার ছিল ছোট ঘরের মতো। বাংকার থেকে বাংকারে যাওয়ার পথ ছিল জালের মতো।
এলাকায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সেকশন অনুযায়ী ভাগ হয়ে যায়। থাকা খাওয়ার সুবিধার জন্য এটা করতে হয়। কিছুদিন পর পান্তাপাড়া প্রাইমারী স্কুলে ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এখানে বসে পরিকল্পনা আর প্রতিনিয়ত চোরাগুপ্তা হামলা হত পাক বাহিনীর উপর। সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না। বৃষ্টি হতো প্রতিদিন। রাস্তাঘাট ছিল কর্দমাক্ত। অধিকাংশ রাস্তা পানির নিচে। হাঁটু পর্যন্ত কাঁদায় আটকে যেতো পা। ছোট ছোট তালের ডিংগা বা নৌকায় চলাচল করতে হতো। বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম অস্থিরতা অনিশ্চয়তার মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তির উৎস ছিল সাধারণ মানুষ।
সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া যুদ্ধ করা ছিল অসম্ভব। থাকা খাওয়া ও এতদসংক্রান্ত সাহায্য ছিল অপরিহার্য। কারণ অস্ত্র ছাড়া কিছুই ছিলনা তাদের। অসম্ভব এক যুদ্ধে এলাকার মানুষ সাহস জোগায়। বিভিন্ন বাড়িতে পালা করে খাওয়া শুরু হয়। পান্তাপাড়া গ্রামের আবদুল মজিদ, হযরত আলী, জব্বার মোল্লা প্রমুখ ব্যক্তিদের অনেক সহায়তা পেয়েছে যোদ্ধারা। অনেকে ক্যাম্পে খাবার নিয়ে আসতেন। বাজারে গেলে ডেকে চা খাওয়াতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করতে পেরে অনেকে গর্ববোধ করতো। না খেয়েও অনেকে ক্যাম্পে খাবার পাঠিয়েছেন। আবার অবস্থাপন্ন অনেকেই এড়িয়ে চলতো মুক্তিযোদ্ধাদের। এরা ছিল বিডি মেম্বার, চেয়ারম্যান। আয়ুব খানের এককালের দালাল।
মহেশপুর গ্রামের কেউ রাজাকার ছিল না। তবে পাকিস্তানীদের দালাল বেশ কয়েকজন। এরা লুকিয়ে থাকতো। কখনও বাইরে দেখা যায়নি এসব মীরজাফরদেরকে৷
পরিস্থিতি বুঝে অপারেশনের নির্দেশ ছিল। এ সময় মালেক, নাসির, শাজাহান, নুরুল ইসলাম কয়েকজন শলাপরামর্শ করে অপারেশন প্লান তৈরি করত। অপারেশন মূলত রাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অস্ত্র ও জনবল কম বিবেচনায় রেখে সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রাথমিক পর্যায়ে নিম্নোক্ত অপারেশন প্লান তৈরি হয়।
১. শত্রুসেনার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আঘাত হানা ও তা অকার্যকর করা।
২. শত্রু ঘাঁটিতে আচমকা আক্রমণ করে পাক বাহিনীর মনোবলে আঘাত হানা।
৩. টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
৪. শত্রু সেনার আসা-যাওয়ার পথে সুযোগমত মাইন স্থাপন করে ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা।
৫. সম্মুখ সমরের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
প্রয়োজন হয় চৌকস, বুদ্ধিমান ও সাহসী যোদ্ধার দল। দলে কয়েকজনের যুদ্ধের প্রতি ছিল অনীহা। এরা জীবন বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছিল। হতাশ হওয়ার কোন কারণও ছিল না।এদের মধ্যেই অসীম সাহসী কয়েকজন যোদ্ধা মালেক, নাসির, তালেব, হামজা, আক্কাস, শাজাহান, ফজলু, মাহাতাব, নিজাম ও নূরুল ইসলাম ছিলেন উল্লেখযোগ্য। জোর ছিল গুণগত যোদ্ধার ওপর, সংখ্যা নয়। মহেশপুর চৌগাছা সড়কটি ছিল শত্রুদের জন্য নিরাপদ। যশোর ক্যান্টনমেন্টের সাথে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা। ক্যান্টনমেন্ট থেকে টেলিফোনের তার টানানো হয়েছিল মহেশপুর পর্যন্ত। মহেশপুর থেকে খালিশপুর হয়ে পার্শ্ববর্তী কোটচাঁদপুরের সাথে একই লাইন চালু ছিল। শক্ত বাঁশের খুঁটি বা রাস্তার পাশের গাছের সাহায্যে টানানো হয়েছিল তারগুলো। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের স্থাপিত অস্থায়ী টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে শত্রুদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করে। আগস্টের শেষভাগে নির্ধারিত দিনে সাতজন ক্যাম্প থেকে ছোট্ট একটা ডিঙ্গিতে করে বিল পেরিয়ে দু’কিলোমিটার দূরে সস্তার বাজারে যায়। এখানে মাঝে মধ্যে রাজাকারারা পাহারায় বসতো। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে অতি সন্তর্পণে বাজারে প্রবেশ করে। জনমানবের কোন চিহ্ন পেলাম না। সিদ্ধান্ত ছিল সস্তা বাজারে রাজাকারদের মুখোমুখি হলে প্রথম সংঘাত হবে ওদের সাথে। প্রত্যেকের কাছে ছিল দুটো করে হ্যান্ড গ্রেনেড। এছাড়া ছিল বেয়নেট, একটা এস এমজি, তিনটা রাইফেল। রাত বারোটার মধ্যে বাথানগাছি নামক গ্রামে মহেশপুর চৌগাছা সড়কে পৌঁছে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। ঘুটঘুটে অন্ধকারের সাথে মুষলধারে বৃষ্টি চারপাশে তৈরি করেছিল ভূতুড়ে পরিবেশ। রাস্তার পাশে টানানো তার অনুসন্ধান করতে কিছু সময় লেগে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নাসির গাছে ওঠার ক্ষেত্রে ছিল খুব দক্ষ। সে তর তর করে ভেজা বাঁশের খুটি বেয়ে ওপরে উঠে যায়। বেয়নেট দিয়ে টেলিফোনের তার কাটার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষে দাঁত দিয়ে কাঁটার চেষ্টা করতে থাকে। বিলম্ব দেখে ছ’জন তিনজন করে ভাগ হয়ে রাস্তার বিপরীত দিকে বেশ কিছুদূরে গিয়ে পজিশনে নেয়। শেষ পর্যন্ত নাসির টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। মহেশপুর চৌগাছা সড়কে হানাদারদের টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা যে স্থানের তার কাটছিল, তা ছিল মহেশপুর পৌরসভার কাছাকাছি। টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মহেশপুরে হানাদারদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা ফাঁকা গুলি করতে থাকে। হানাদাররা চৌগাছা ও মহেশপুর থেকে ঘটনাস্থলে আসতে পারে অনুমান করে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা দেয়। টার্গেট সফল হওয়ায় সবাই বেশ খুশি আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বয়রা সাব সেক্টরের উত্তরদিকে ছিল বানপুর সাব সেক্টর। সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান। এ সাব সেক্টরের আওতায় ছিল কুষ্টিয়া জেলার (বর্তমান চুয়াডাঙ্গা) জীবন নগর থানা। জীবননগর স্থাপিত আর্মি ক্যাম্প থেকে সব সময় সমর্থন পেত সীমান্তে স্থাপিত পাক আর্মির দত্তনগর ক্যাম্প। জীবননগর আমি ক্যাম্পের সাথে সহজ যোগাযোগ ছিল মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর ক্যম্পের। এ ছাড়া জীবনের কোটচাঁদপুর সড়কে হাসাদহ হাই স্কুলে পাক বাহিনীর একটি ছোট গ্রুপ অবস্থান নিয়েছিল। উল্লিখিত সড়কের খালিশপুর নামক স্থানেও কিছু পাকসেনা ও রাজাকার থাকতো বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে। জীবননগর কোটচাঁদপুর সড়কটি ছিল শত্রু সেনাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। এ জন্য রাস্তাটিতে প্রায় প্রতি পাঁচশত গজ দূরে দূরে ছোট ছোট ঘর তুলে পাহারায় থাকতো রাজাকার ও সহযোগী লোকজন। এ সব রাজাকারদের অধিকাংশই ছিল নিরস্ত্র। বিশেষ ধরনের লাঠি হাতে পাহারা দিত রাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয় গোয়েন্দা সূত্রে এ সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছিলনা। হানাদের বাহিনীর দখলকৃত এই সড়কে ঝটিকা আক্রমণ করে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উদ্দেশ্য ওদেরকে সন্ত্রস্ত করা এবং একই সাথে রাস্তায় মাইন পুঁতে হানাদারদের যানবাহন ধ্বংস করা। এ ক্ষেত্রে মহেশপুর চৌগাছা সড়কের অভিজ্ঞতা কাজে লাগান হয়। মালেক, নাসির, শাজাহান, আনিসুর এ বিশেষ অপারেশনের জন্য সংঘবদ্ধ হন। সিদ্ধান্তটি এতই গোপনীয় ছিল যে, যাত্রার আগে কাউকে জানতে দেয়া হয়নি। রাত আটটায় স্থানীয় ঘুগরী বাজার থেকে নৌকায় প্রায় অর্ধেক রাস্তা অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধারা। পুরাতন ভোগেদ্দারী নামক গ্রামের কাছাকাছি এক গোপনস্থানে ধান ক্ষেতে নৌকা রেখে রাস্তায় উঠে হাঁটু সমান কাদা ভেঙে প্রায় তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর হাসাদহ নামক বাজারে পৌঁছে সবাই। এলাকাটি অতি পরিচিত থাকায় দ্রুত চলাচলে সুবিধা হয়। হাসাদহ বাজারের মধ্যে দিয়ে রাস্তায় যাওয়া ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বাজারের দক্ষিণ পাশের মাঠ দিয়ে বাজারকে বাঁয়ে ফেলে জীবননগর কোটচাদপুর সড়কে উঠে সবাই। আধো জোছনায় যতদূর চোখ যায় রাস্তার পাশে কিছুদূর পর পর ছোট ছোট ঘর। হ্যারিকেন জ্বলছে প্রতিটি ঘরে। শাজাহান, আনিসুর ও নাসির রাস্তার দক্ষিণ পার্শ্বে ধানক্ষেতে এস এল আর, থ্রি নট থ্রি নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। উল্লেখিত রাস্তা দিয়ে শত্রুদের বিভিন্ন ধরনের গাড়ি ঘন ঘন আসা যাওয়া করছিল। এজন্য তিনজনকেই সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। মালেক অতি দ্রুত বেয়নেট দিয়ে রাস্তার ইট তুলে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গর্ত করে একটা এন্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে। উদ্দেশ্য শত্রুদের কোন গাড়ি এলে যাতে আক্রান্ত হয়।
নিকটবর্তী ঘরে অবস্থানকারী রাজাকার বা সহযোগী যেই থাকুক তাদেরকে বন্দী করার সিদ্ধান্ত হয়। রাস্তার পাশে বাঁশের খুঁটিতে যে তার বাঁধা ছিল তা কাটার জন্য আলোর প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে টর্চের। সিদ্ধান্তটি ছিল কঠিন। রাজাকার ও সহযোগীরা খোশগল্পে মত্ত। রেডিওতে গান শুনছিল। চারজনে চলছিল তাস খেলা। অস্ত্র তাক করে বিদ্যুত গতিতে ঘরে ঢুকে পড়লে তারা অপ্রস্তুত ও হতবিহবল হয়ে পড়ে, কোন অস্ত্র ছিল না ওদের কাছে। চুপচাপ থাকার পরামর্শ দিয়ে তাস খেলা চালিয়ে যেতে বলা হয়। নির্দেশ অমান্য করার কোন সাহস ছিল না ওদের। একটা তিন ব্যাটারী টর্চ নিয়ে তড়িৎ তার কাটার উদ্যেগ নেয়া হয় আর রাজাকার চারটাকে মাথা উঁচু করতে মানা করা হয়। দুঃসাহসী মালেক দ্রুত একটা বাঁশের খুঁটির আগায় উঠে পড়ে। খুঁটিতে ওঠার আগে সে একটি বিশেষ অনুরোধ করে। খুঁটির মাথায় থাকা অবস্থায় হানাদারদের কোন গাড়ি এসে পড়লে প্রথমেই তাকে যেন গুলি করা হয়। শত্রুর হাতে ধরা পড়ার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয় মনে করে সে। একের পর এক খুটিতে উঠে প্রায় দু’কিলোমিটর রাস্তার তার কেটে ফেলা হয়। তার কাটার সময়ই বুঝা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন বার্তা হানাদারদের কাছে পৌঁছে গেছে। রাস্তার পাহারাদাররা অস্থির হয়ে উঠে। যে কোন পরিস্থিতির জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি ছিল। সংক্ষিপ্ত সময়ে কাটা তার নিয়ে ফিরে আসে হাসদহ বাজারের কাছে। ওখান থেকে রাস্তায় হৈ চৈ শুনা যায়। ততক্ষণ হানাদারদের কয়েকটা গাড়ি এসে পড়ে ঘটনাস্থলে। অতি দ্রুত গ্রামের রাস্তা ধরে ফিরে আসতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের অবস্থান সঠিকভাবে জানা না থাকায় ওরা প্রতিটি রাস্তায় সম্ভাব্য ফিরে আসার পথ অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে রাজাকারদের তৎপরতা, আগ্রহ ও বাড়াবাড়ি ছিল মাত্রাতিরিক্ত। অসংখ্য টর্চ লাইটের আলোয় হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের। দ্রুততার সাথে মুক্তাঞ্চলে চলে আসে সবাই।
[৫৭] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত