You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.08 | ময়মনসিংহ সশস্ত্র প্রতিরোধ - সংগ্রামের নোটবুক

ময়মনসিংহ সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার: সুবেদার মেজর জিয়াউল হক ০৮-০৬-১৯৭১
২৬ মার্চ বেলা একটার সময় ঢাকা ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে কমর আব্বাসকে অয়ারলেস সেটে এ কথা বলার জন্য ডাকা হয়। তখন ডিউটি অপারেটর ছিল নায়েক ফরহাদ হোসেন (বাঙালি)। ঢাকা থেকে বলা হয়, অয়ারলেস সেট অন্ করার পর সেখানে যেন কেউ না থাকে। তাই নায়েক ফরহাদ হোসেন ঝুঁকি নিয়ে পাশের ঘরে একটা জায়গায় চুপি চুপি দাঁড়িয়ে থাকে। সৌভাগ্যবশত সে পাঞ্জাবী ভাষা বুঝত। ঢাকা থেকে উইং কমান্ডারকে বলা হচ্ছিল সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে নিরস্ত্র করার জন্য এবং কোত, ম্যাগাজিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গার চাবি নিয়ে নিতে এবং বাঙালি কাউকে ডিউটি না দেয়ার জন্য। ঢাকা থেকে ইপিআর-এর স্টাফ কর্নেল সিকান্দার খান তাকে আরো বলে যে, আজ রাতের মধ্যে সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে খতম করতে হবে এবং সীমান্তবর্তী এলাকার ইপিআরদের সম্বন্ধে তোমাকে পরে নির্দেশ দেয়া হবে। নায়েক ফরহাদ হোসেন ওয়ারলেস সেট-এর পেছনে চুপি চুপি এই কথাগুলো শোনে এবং সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে তা জানিয়ে দেয়। নায়েক ফরহাদ অয়ারলেস সেটে ২৭ মার্চ আমাকে ভোর ছটার সময় উক্ত মেসেজ জানায় এবং বলে যে, আপনি আপনার বন্দোবস্ত করেন যদি বাঙালি জোয়ানদেরকে বাঁচাতে চান। সেই নির্দেশ অনুযায়ী সবাইকে নিরস্ত্র করা হয়। একমাত্র সি-কোম্পানির এক প্লাটুন ইপিআর অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকার করে।
নিরস্ত্রকরণের মধ্যে সীমান্ত এলাকার ইপিআর’রা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ঐ প্লাটুন-এর নেতা ছিল সুবেদার ফরিদউদ্দীন আহমদ। এই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্রবৃন্দ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা আমাদেরকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার আবদুল্লা-আল-মাহমুদ ও তার সহকর্মীবৃন্দ আর ছিলেন এডভোকেট সৈয়দ আহমদ এবং তার সহকর্মীবৃন্দ, অধ্যক্ষ মতিয়ুর রহমান (আলমগীর মিন্টু কলেজ), সৈয়দ আবদুস সুলতান (বর্তমানে ইংল্যান্ডে হাই কমিশনার), জনাব রফিক উদ্দীন ভূঁইয়া, এডভোকেট মোশাররফ আকন্দ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অন্যান্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। মোজাফফর ন্যাপের অধ্যাপক আবদুল হান্নান ও অধ্যাপক দেওয়ান এবং ভাসানী সমর্থক ছাত্রনেতা আবদুল হামিদও ছিলেন। ২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস ঢাকার নির্দেশ অনুসারে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিও-এনসিওদেরকে বাঙালি ইপিআরদের খতম করার নির্দেশ দেন রাত এগারোটার সময়। ট্রুপস ব্যারাক, উইং কমান্ডারের বাংলো এবং কোয়ার্টার গার্ড কোতে এবং ম্যাগাজিনের সমস্ত এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ মোতায়েন করা হয়। উইং কমান্ডার-এর বাংলোতে সি- কোম্পনির এক প্লাটুনকে ডিউটির জন্য মোতায়েন করা হয়। গার্ড কমান্ডার শফি এবং অন্য দু’জনের কাছে একটা করে ৩০৩ রাইফেল ছিল। বাকিদের কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। রাত এগারোটার সময় হেডকোয়ার্টারের তিনতলা থেকে হাবিলদার মেজর হাসিবউল্লাহ এক রাউন্ড গুলি ফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক জায়গা থেকে ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। হেডকোয়ার্টারে তখন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি অবস্থান করছিল। গোলাগুলি শুরু হবার পর বাঙালি ইপিআররা ওদের সাথে মিশে যায়। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক সুবেদার বড়ুয়া এবং সুলতান আমাদের জোয়ানদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র বাঙালি ইপিআরদের দিয়ে দেয়। গোলাগুলি চলতে থাকে। ইতিমধ্যে ইপিআর-এর কিছু সাহসী বাঙালি জোয়ান স্থানীয় কয়েকজন ছাত্রের সহযোগিতায় কোতে এবং ম্যাগাজিন-এর ভেন্টিলেশন ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ে অস্ত্রশস্ত্র বের করতে সমর্থ হয়। ২৮ মার্চ ভোরবেলায় জনাব রফিকউদ্দীন ভূইয়া, শামসুল হক এমপিএ, ছাত্র নেতা আবুল হাশেম ও হামিদের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেল এবং পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এনে বাঙালি ইপিআরদের দেয়া হয়। ২৮ মার্চ বেলা ৮টা পর্যন্ত দু’পক্ষে তুমুল লড়াই চলে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৩/৯৪ জন। ১১ জন জেসিও-এনসিও জেসিও মেসে সারারাত ফায়ার করার পর ১৭ থেকে ১৯ বাক্স গুলিসহ আত্মসমর্পণ করে সুবেদার ফরিদের কাছে। ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস সকালবেলায় সিপাই নান্নু মিয়া এবং আফতাব হোসেনের সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, সিপাই নান্নু এবং আফতাব স্বাধীনতা সংগ্রামে কর্নেল নুরুজ্জামানের অধীনে এবং ডালু সেক্টরে অত্যন্ত সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে। ১১ জন জেসিও ও এসসিওকে সুবেদার ফরিদউদ্দিন ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেলে বন্দি করা হয়। অতঃপর ময়মনসিংহের সকল বাঙালি জোয়ান এনসিও ও জেসিও মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ৪/৬ কোম্পানি গঠন করে জয়দেবপুর ও টঙ্গী অভিমুখে যাত্রা করে। এদিকে রংপুর সীমান্ত এলাকার মাদারচর বিওপি থেকে সিলেট সীমান্তের মহেশখোলা বিওপি পর্যন্ত বাঙালি ইপিআরকে (প্রত্যেক বিওপিতে তিনজন করে রেখে) দু’কোম্পানিতে সংগঠিত করে সুবেদার মেজর আবদুল হাকিম এবং আমার নেতৃত্বে মুক্তাগাছা, রসুলপুর, মধুপুর, জামালপুর, ঘাটাইল এলাকা পর্যন্ত মোতায়েন করা হয়। তখন আমাদের সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরের শামসুল হক এমপি, মুক্তাগাছা শহীদুল্লাহ এমপি, রফিকউদ্দিন ভূইয়া, নাগরপুর কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ, লতিফ সিদ্দিকী এমপি এবং কাদের সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্য এবং সহযোগিতা করেন। এই সময় ময়মনসিংহ সদরের এসডিও মেজর শফিউল্লাহর প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান এবং জনাব রফিক উদ্দীন ভূইয়া ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং ত্যাগী ও কর্নেল রাংগাজান (৮৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়ান কমান্ডার)- এর সাথে যোগাযোগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে কোন সাহায্য না দিলেও ভবিষ্যতে কর্নেল রাংগাজান আমাদেরকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। তিনি আমাদের সামনে দিল্লীতে এ ব্যাপারে মেসেজ পাঠান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিকউদ্দীন ভূঁইয়া, আব্দুল মান্নান (বর্তমান পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী) ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আমার কোম্পানি হেডকোয়ার্টার কড়ইতলিতে (হালুয়াঘাটে) অবস্থান করছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে তাঁর বাড়ি থেকে জনাব আবুল হাশেম গাইড করে নিয়ে আসেন এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাঁকে নেতা বানানো হয়। তাদেরকে কর্নেল রাংগাজানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ভারতের গাচুয়াপাড়া রেস্ট হাউজ ইন্সপেকশন বাংলোতে। সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল প্রতিনিধি কলকাতাতে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চলে যান। সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগিতার ভার রফিকউদ্দীন ভূঁইয়ার উপর অর্পণ করা হয়। অন্য কোন অস্ত্রশস্ত্র না পেলেও আমরা যথেষ্ট পরিমাণ হ্যান্ড গ্রেনেড এবং ২৭টি এলএম জি ক্যাপ্টেন ত্যাগীর নিকট থেকে পাই। তিনি ছদ্মবেশে রসুলপুর এলাকাতে আমার সাথে কাজ করতে থাকেন। এ ছাড়াও প্রত্যেক রাতে ভারত থেকে (ডালু এবং মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে) ইন্ডিয়ান আর্মি ইঞ্জিনিয়ার টিম পুল এবং রাস্তা ধ্বংস করার জন্য আসতেন এবং কাজ সমাধা করে রাতেই চলে যেতেন। ২৭ মার্চ ময়মনসিংহের উইং হেডকোয়ার্টারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের খতম করার পর সীমান্তের সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদেরও খতম করা হয়। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় কি তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের উপর কালিহাতি, রসুলপুর, মধুপুর, জামালপুর, মুক্তাগাছা, শম্ভুগঞ্জ, গৌরিপুর ইত্যাদি স্থানে পাকিস্তানী বিমানবাহিনী পর্যায়ক্রমে হামলা চালায়। তাদের সৈন্যসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে এবং ক্রমশ আমাদের বাঙালিদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে থাকে অনুমান করি। বিমান হামলার ফলে মেজর শফিউল্লাহ তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে চলে যান।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত