You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.19 | মন্দভাগ অপারেশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া - সংগ্রামের নোটবুক

মন্দভাগ অপারেশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

পাকসেনারা কসবা এবং মন্দভাগ পুনঃ দখলের জন্য জুলাই মাসে প্রস্তুতি নেয়। ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্ট এবং গোলন্দাজ বাহিনী কুটিতে সমবেত হয়। মুক্তিবাহিনীর ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে ওঠে।। মন্দভাগ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন গাফফার তাঁর বাহিনী নিয়ে শত্রু সেনার মোকাবিলায় প্রস্তুত হন।
১৯ জুলাই পাকসেনাদের ৩১তম বেলুচের একটি কোম্পানি শাদা নদী দিয়ে মন্দভাগের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই সংবাদ পেয়ে সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন পাকসেনাদের অগ্রবর্তী দলকে বাধা দেয়ার জন্যে অগ্রসর হন। সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুন নিয়ে মন্দভাগ বাজারের কাছে পৌঁছে অতর্কিতে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষের গুলি বিনিময়ে পাকসেনাদের অন্ততঃ ৬০ জন হতাহত হয় বলে জানা যায়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় পাকসেনারা নদীতে ঝাঁপ দেয়া শুরু করলে অধিকাংশই জলে ডুবে মারা যায়। নিহত পাকস্তিানীদের মধ্যে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল কাইয়ুম, ৫৩ তম গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার বোখারী এবং আরও ৩/৪ জন অফিসারসহ বেশ কয়েকজন জুনিয়ার অফিসার ছিল বলে শোনা যায়। পঁচিশে মার্চের পর থেকে কুমিল্লা শহরে একাধিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম নায়ক ছিল এই নিহত ক্যাপ্টেন বোখারী।
মে মাসে পাকসেনারা বেলুনিয়া দখল করার চেষ্টা করে। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে পাকসেনাদের অগ্রগতি রোধ করার নির্দেশ দেন। ছাগলনাইয়াতে তখন পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। পাকসেনা ফেনীর দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছাগলনাইয়ার উপর এবং একই সঙ্গে চট্টগ্রাম সড়কের উপরও আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে পাকিস্তানীরা ২০/২৫ জনে মৃতদেহ ফেলে রেখেই পিছনে সরে যায়। পাকিস্তানীরা পিছনে সরে গেলেও কয়েকদিন পর আবার শক্তি সঞ্চয় করে ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ থেকে ফেনী- চট্টগ্রাম পুরোনো সড়ক ধরে অগ্রসর হয়ে আকস্মিকভাবেই ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী বেশ হতাহত হয়ে পিছনে সরে রাজনগরে এসে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে। এই পিছনে সরে যাওয়াকে পাকসেনারা অত্যন্ত ভীতির চোখে দেখল। আর তাই পাকসেনারা ভীত হয়ে বেলুনিয়া ছেড়ে ফেনীতে মূল প্রতিরক্ষা ঘাঁটি প্রস্তুত করল। মুক্তিবাহিনীও বেলুনিয়া ছেড়ে ফেনীতে মূল প্রতিরক্ষা ঘাঁটি প্রস্তুত করে। মুক্তিবাহিনী বেলুনিয়া রক্ষার জন্য ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে একটি কলাম বান্দরুয়াতে (ফেনী থেকে ২ মাইল উত্তরে) এবং লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে অপর কলাম অপরদিকে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কমাণ্ডে মূল বাহিনী মুন্সীরহাটে আর একটি মজবুত ঘাঁটি গড়ে তোলে। বেলুনিয়া বাঙ্কার সামরিক দিক থেকে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই বাঙ্কার দৈর্ঘ্যে ছিল ১৭ মাইল এবং প্রস্থে ছিল ১৬ মাইল। ‘১৭ই মে পর্যন্ত মুন্সীহাটে ডিফেন্স এবং বান্দুয়ার অবস্থানটি বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জায়গাটির সামনে কতগুলো প্রাকৃতিক বাধাবিঘ্ন থাকায় শত্রুসেনার অগ্রসরের পথে ছিল বিরাট বাধা। এতে শত্রু সেনাদের নাজেহাল করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান মুহুরী নদীর পাশ ঘেঁষে পশ্চিম দিক থেকে ছিলোনিয়া নদী ছেড়ে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্যূহটি কমপক্ষে ৪ মাইল চওড়া ছিল। অবস্থানটি এইভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল যেন শত্রুসেনাদের বাধ্য হয়ে ঘাঁটি আক্রমণ করার সময় প্রতিরক্ষাব্যূহের সম্মুখ ছাড়া আর কোন উপায়ে অন্য কোন দিক থেকে আসার রাস্তা না থাকে। মুন্সীরহাটে প্রধান ঘাঁটি সম্বন্ধে শত্রুদের ধোঁকা দেওয়ার জন্যে বান্দুয়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এবং ছিলনিয়া নদীর উপর একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। যা ছিল একটি ডিলেয়িং পজিশন। এই পজিশনের সামনে রাস্তা ও রেলের সেতুগুলি ধ্বংস করে দেয়া হয় যাতে শত্রুদের অগ্রসরে আরো বাধার সৃষ্টি হয়। শত্রুসেনা অগ্রসরে রাস্তার পশ্চিম এবং পূর্বপাশে রাস্তার দিকে মুখ করে বেশ কতগুলো উঁচু জায়গায় এবং পুকুরে উঁচু বাঁধে মজবুত বাঙ্কার তৈরি করা হয় এবং তাতে সব সময় হালকা মেশিনগান প্রস্তুত রাখা হয়। এ ছিল এক রকমের ফাঁদ যাতে একবার অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হলে দু’পাশের গুলিতে শত্রুসেনা আর ফিরে যেতে পারেনা।
[৫৯৬] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত