You dont have javascript enabled! Please enable it!

মতিউর রহমান, ফ্লাইট লে. বীরশ্রেষ্ঠ

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত একজন বীরশ্রেষ্ঠ। তিনি ১৯৪১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকায় আগা সাদেক রোডের পৈতৃক বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুস সামাদ ছিলেন ঢাকা কালেকটরেট অফিস সুপারিনটেনডেন্ট৷ মতিউর ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে সারগোদার পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমীতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৩ সালের জুন মাসে কমিশন লাভ করেন। কর্মস্থল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের রিসালপুর। পেশোয়ারে জেট পাইলট নিযুক্ত হবার পূর্বে জেট কনভার্সন কোর্স সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর ছুটিতে গ্রামের বাড়ি ঢাকার অদূরে রায়পুরা থানার রামনগরে বেড়াতে আসেন। এ সময় স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে তিনি একাত্ম হন। ২৫ মার্চ ঢাকাসহ দেশব্যাপী পাক বাহিনীর গণহত্যা শুরু হলে মতিউর দৌলতকান্দিতে এক জনসভা করেন। আশেপাশের লোকজনদের সংঘবদ্ধ করে পাকিস্তানী সৈন্য প্রতিহত করার জন্য প্রাথমিক সামরিক ট্রেনিং দেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ভৈরব, রায়পুরা এসব এলাকায় পাকিস্তান বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ শুরু করলে মতিউর বেঙ্গল রেজিমেন্টে ই.পি.আর-এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপরই ৬ মে কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে একটি জঙ্গি বিমান হাইজ্যাক করে ভারতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তের কথা তিনি কাউকেই জানান নি। তিনি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিটি পদক্ষেপ চুলচেরা বিশে-ষণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য বদ্ধপরিকর হন। জঙ্গী বিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তার পরিবার পরিজন যাদের তিনি মৌরিপুরের পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অফিসার্স কোয়ার্টারে রেখে যাচ্ছেন, তাদের কি ধরনের বিপদ হতে পারে তাও তাকে বিচলিত করতে পারেনি৷ মতিউর রহমান ২০ আগস্ট শুক্রবার করাচির মৌরিপুরের বিমানঘাঁটি থেকে টি-৩৩ জঙ্গি বিমান হাইজ্যাক করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মতিউরের এ অসম প্রচেষ্টার একমাত্র বাঙালি সাক্ষী ক্যাপ্টেন ফরিদুজ্জামান। ঐদিন ক্যাপ্টেন ফরিদুজ্জামান ও ফ্লাইট লে. আসেম রশিদ (পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার) কন্ট্রোল টাওয়ারে কর্তব্যরত ছিলেন। পরবর্তীতে ফরিদুজ্জামানের কাছে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়। মতিউর এ বিশেষ দিনটিকে বেছে নিয়েছিলেন কেননা ঐদিন (২০ আগস্ট) সকাল এগারটার দিকে পাইলট অফিসার মিনহাজ রশীদের (যার প্রশিক্ষক ছিলেন মতিউর) টি-৩৩ বিমান নিয়ে উড়বার শিডিউল ছিল, সকাল ১১টা বেজে ২৩ মিনিটে মিনহাজ টি-৩৩ প্লেনে চড়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করার এবং ট্যাক্সিইং করার অনুমতি চাইলে কন্ট্রোল টাওয়ার তাঁকে নিয়মমাফিক অনুমতি অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ারেন্স দেয়। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রত্যেক বিমানের একটা সাংকেতিক নাম থাকে, টি-৩৩ বিমানটির নাম ছিল ব্লুবার্ড-১৬৬। পাইলট অফিসার মিনহাজ যখন টি-৩৩ বিমানটি নিয়ে ২৭নং রানওয়েতে ঢোকার জন্য ৪নং ট্যাক্সি-ট্রাক দিয়ে এগিয়ে যায়, তখন ফ্লাইট লেফটেনান্ট মতিউর রহমান নিজের গাড়ী চালিয়ে তীব্রগতিতে ৪নং ট্যান্স ট্রাকে ছুটে যান। তিনি মিনহাজকে বিমান থামানোর সংকেত দেখান। মতিউর ঐ সময় সেফটি অফিসারের দায়িত্বেও নিয়োজিত ছিলেন। নিয়ম হলো কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমান নিয়ে উড়বার ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরও যদি ফ্লাইট সেফটি অফিসার কোনো বিশেষ কারণে (যেমন ইঞ্জিন থেকে হাইড্রোলিক ফ্লুইড লিকেজ, ফিউয লিকেজ, প্লেনের চাকার বা টায়ারের ত্রুটি) বৈমানিককে বিমান নামানোর সংকেত দেখান, তাহলে ঐ বৈমানিক বিমান থামাতে বাধ্য থাকেন। ফ্লাইট সেইফটি অফিসার মতিউরের সংকেতে মিনহাজ বিমান থামিয়ে ক্যানোপি (বৈমানিকের বসার স্থানের উপর স্বচ্ছ আবরণ) খোলেন। মতিউর দ্রুতগতিতে ককপিঠে উঠে যান। তার আগে তিনি নিজের গাড়িকে ৪নং ট্যাক্সি ট্রাকের ওপর আড়াআড়িভাবে পার্ক করে এমন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন, যেন অন্য প্লেন তার গাড়ি না সরিয়ে রানওয়েতে প্রবেশ করতে না পারে এবং খুব তাড়াতাড়ি যেন অনুসরণ করতে না পারে। রানওয়েতে, ট্যাক্সিট্রাকের মাঝপথে বিমানটিকে থেমে ক্যানোপি খুলতে দেখে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে পাইলট অফিসার ফরিদুজ্জামান ‘বুবার্ড-১৬৬’কে জিজ্ঞাসা করেন কোনো রকম অসুবিধা আছে কি না? কোনো জবাব আসেনি ব্লুবার্ড থেকে। হঠাৎ রুবার্ড দ্রুত রানওয়ের দিকে এগিয়ে যায় এবং বিমানটি ভীষণভাবে ডাইনে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে দুলতে দুলতে টেক অফ করে। আসলে সে সময় প্লেনের কন্ট্রোল নিয়ে মিনহাজ ও মতিউরের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছিল। টেকঅফ করার জন্য প্রত্যেক পাইলটকেই কন্ট্রোলারদের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু মিনহাজের প্লেন অনুমতি না নিয়েই টেকঅফ করা এবং অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে ‘ব্লুবার্ড’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে মিনহাজ কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে জানায় ‘আই অ্যাম হাইজ্যাকড’। ফরিদুজ্জামান যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি বলেছিলেন ‘প্লিজ সে এগেইন’। ফরিদুজ্জামানের উত্তেজিত ভাব এবং ‘হাইজ্যাকড’ শব্দ শুনেই আসেম রশিদ রেডিও এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিলো- ‘ব্লুবার্ড’-১৬৬’ হাইজ্যাকড হয়েছে। চারিদিকে হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হয়। খবর পাওয়া মাত্র বেস কমান্ডারসহ পাকবাহিনীর বড়বড় কর্মকর্তারা কন্ট্রোল টাওয়ারে চলে আসেন। সবাই বুঝতে পারলেন অবশ্যই কোনো বাঙালি পাইলট ব্লুবার্ডকে হাইজ্যাকড করেছে। ৪নং ট্যাক্সিওয়ের ওপর মতিউরের গাড়ি দাঁড় করানো দেখে সবাই নিশ্চিত হন ফ্লাইট লে. মতিউরই এ কাজ করেছে। করাচি ও ভারতীয় সীমান্তের মধ্যবর্তী স্থান সিন্ধু প্রদেশের কাফন ও খাট্টা নামের র‍্যাডার ঘাঁটিতে যোগাযোগ করা হলে জানা যায় ঐ র‍্যাডার ঘাঁটিদ্বয়ের কন্ট্রোলাররা তাদের স্ক্রিনে ‘ব্লুবার্ড-১৬৬’কে দেখতে পেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর চারটি এফ-৮৬ ফাইটার ব্লুবার্ডকে ধাওয়া করার জন্য টেকঅফ করে। কিন্তু মিনহাজ-মতিউর-এর প্লেন পাকবাহিনীর ফাইটার প্লেনগুলোর চেয়ে ৪০/৫০ মাইলে দূরত্বে ছিল। তাই ফাইটার প্লেনগুলো ব্লুবার্ডকে ধরতে পারেনি। মতিউর এবং মিনহাজ প্লেনের কন্ট্রোল নিয়ে মারামারি করতে করতে ভারতীয় সীমান্তের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তাদের প্লেন ভারতীয় সীমান্ত থেকে তিন মিনিটের দূরত্বে ছিল। এ সময় মিনহাজ প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য ইজেক্ট করার সুইচে চাপ দেয়। টি- ৩৩ প্লেনের সামনের এবং পিছনের দু’টো আসনেই ইজেক্ট সুইচ রয়েছে। যেকোনো একটি সুইচে চাপ দিলেই দু’জন পাইলটই বেরিয়ে যায়। মিনহাজ রশিদ ইজেক্ট সুইচে চাপ দেওয়ার ফলে মতিউর পিছনের আসন থেকে প্রথমে ছিটকে বেরিয়ে গেলেও যেহেতু তার ইজেক্ট করার উপযুক্ত পোশাক ছিল না অর্থাৎ সাধারণ পোশাকে ছিলেন তাই তিনি সরাসরি ভূমিতে পতিত হন এবং তৎক্ষণাৎ মারা যান। রাডার যন্ত্রকে এড়ানোর জন্য মতিউর প্লেন চালিয়ে ছিলেন ভূমি থেকে খুব অল্প উচ্চতায়। তাই মিনহাজ আর ইজেক্ট হওয়ার সুযোগ পাননি। প্লেন মাটিতে পতিত হয়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিনহাজও জ্বলেপুড়ে মারা যায়। মতিউর রহমানকে দাফন করা হয় মশরুর বিমান ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কবরস্থানে। দেশপ্রেমিক ও সাহসী পাইলট হিসেবে মতিউর রহমােেনর সমকক্ষ কেউ ছিল না। শান্ত মাথায় মৃত্যুভয়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা দুঃসাহসিক কাজ। এর সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। মতিউর রহমানের দেশপ্রেম ও আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
[২২,৬৪,২৩৮] মঞ্জুমা সেলিম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!