মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনে অভিযান, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের হালদা ব্রিজ থেকে ১০০ গজ পশ্চিমে মদুনাঘাট পাওয়ার হাউস অবস্থিত। এই কেন্দ্রের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত কাপ্তাই-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বন্দরের একমাত্র তৈল শোধনাগার অচল করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস না করে বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১, ২, ৩ নম্বর সেক্টরের সমন্বয়কারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার সাবেগ সিং এর সাথে পরামর্শ করে পরিকল্পনা করা হয়। ক) মদুনা ঘাটের বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ধ্বংস করা হবে। কারণ, মদুনাঘাট থেকেই পুরো চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এতে প্রশাসন দৈনন্দিন কাজকর্ম ও তৎপরতা চালাতে ব্যর্থ হবে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১ নং সেক্টর সদর দপ্তরে বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদকে নেতৃত্ব দেয়া হয় ও ব্রিফিং দেয়া হয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রও দেয়া হয়, দলের সদস্যও নির্বাচন করা হয়। এরপর আসন্ন অপারেশনের জন্য দলের সদস্যদের মহড়ার আয়োজন করা হয়। হরিণা ক্যাম্পেই প্রাথমিকভাবে ম্যাপে পর্যবেক্ষণ করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ১ নম্বর সেক্টরের গোপনীয় বার্তা নম্বর জি-০৯৪২, ২১ সেপ্টেম্বর ও অন্যান্য তথ্য থেকে চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কে হালদা নদীর উপর মদুনাঘাট অবস্থিত তা নিশ্চিত করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একদল গেরিলা ও নিয়মিত সৈন্য নিয়ে হরিণা ক্যাম্প থেকে রওনা হন। ভারত থেকে রামগড় হয়ে রাউজান থানার বড়ুয়া পাড়া স্কুলে এসে দল গোপন আস্তানা তৈরি করে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন করিম, সহাবুদ্দিনসহ তখন মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা হয় ৩৫। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন ও ক্যাপ্টেন করিম ছদ্মবেশে তথ্য সংগ্রহ করেন যে, (১) বড়ুয়া পাড়া স্কুল থেকে সাবস্টেশনের দূরত্ব প্রায় ২ কি. মি.। (২) সাবস্টেশনে আনুমানিক ১০০ জন মিলিশিয়া আছে। (৩) জোয়ার-ভাটা থাকায় দেখা যায় ভাটার সময় গোপন আস্তানা থেকে নৌকায় অপারেশন স্থলে আসা সহজ ও জোয়ারের সময় ফেরত যাওয়া হবে সহজতর। ফ্লাইটে লেফটেন্যান্ট সুলতান পুরো দলকে ৩ ভাগে ভাগ করেন। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে ছিল কভারিং ও হোল্ডিং পার্টি- ১ ও ২। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতানের নেতৃত্বে থাকে এ্যাকশন দল। নেতা সুলতান প্রথমে গুলি করবেন ও এটি অপারেশনের শুরু হিসেবে বিবেচিত হবে। কভারিং ও হোল্ডিং পার্টি- ১ রাস্তার দক্ষিণ পাশে ব্রিজের পূর্ব দিকে পজিশন নেয়। কভারিং পার্টি-২ ব্রিজের পূর্বদিকে রাস্তার উত্তর পার্শ্বে অবস্থান নেয়। এই উভয় দল মূল দলের নিরাপদে ফিরে না আসা পর্যন্ত শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখবে। মূল দল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতানের নেতৃত্বে সাব স্টেশনের পিছনে অবস্থান নেবেন ও মূল টার্গেট ধ্বংস করবেন। রাত ২টার মধ্যে সব দলের অবস্থান নেওয়া সম্পন্ন হয়। ২ জন মাঝি মূল দলের ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নৌকায় করে এনে ওয়াপদা কলোনিতে নামে। ওদিকে কাট অব পার্টিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় রাস্তার ওপর মিলিশিয়াদের অগ্রসর হবার চেষ্টা প্রতিহত করার জন্য। অন্যান্য অস্ত্রের সাথে রকেট লাঞ্চার আনা হয় মূল টার্গেট ধ্বংস করার জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী দলনেতা ফায়ার করার সাথে সাথে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। ১ ও ২ কভারিং পার্টি ব্রিজের মিলিশিয়াদের ব্যস্ত রাখেন। এ্যাকশন পার্টি রকেট লাঞ্চার নিয়ে ২টি শেল নিখুঁতভাবে ট্রান্সফরমারে আঘাত হানেন, ২টি ট্রান্সফরমার ধ্বংস হয়ে যায়। তবে হঠাৎ একটি গুলি এসে নায়েক মান্নানের পেটে বিদ্ধ হয়৷ (তিনি পরে নিহত হন)। মূল দল দ্রুত নৌকায় চড়ে পরিকল্পনা মতো বড়ুয়া পাড়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। এভাবেই এই গুরুত্বপূর্ণ অভিযানটি শেষ হয়।
[৫৯৭] কে. এম. আহসান কবীর
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত