You dont have javascript enabled! Please enable it!

মনতলার যুদ্ধ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর মনতলা ছিল মুক্তিফৌজদের শেষ ঘাঁটি। এর পতনের অর্থ হলো- বাংলাদেশের কোথাও আর মুক্তিফৌজদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না। ফলে মনতলাকে শত্রুমুক্ত রাখার ব্যাপারে সবাই খুব আগ্রহী হয়ে উঠেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ মনতলা রক্ষার কাজে মাত্র তিন কোম্পানি সৈন্য নিয়োজিত করেন। ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানিকে মনতলা এলাকা ও রেল স্টেশন; ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়ার কোম্পানিকে কাশিমপুর এলাকা ও রেল স্টেশন; লেফটেন্যান্ট মোরশেদের কোম্পানিকে হরষপুর এলাকা ও রেল স্টেশনে নিয়োগ করা হয়েছিল। মাহবুব-ই-খোদা লেফটেন্যান্ট মোরশেদের সাথে এই রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিফৌজ তেলিয়াপাড়া ছেড়ে চলে আসার পর পাকিস্তানী সৈন্যরা মনতলা দখল করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশের মাটি থেকে মুক্তিফৌজদের বিতাড়িত করার জন্য তারা তাদের সমস্ত শক্তির সমাবেশ করে এবং তিন সপ্তাহকাল যাবৎ অনবরত আক্রমণ চালিয়ে যায়। পাকিস্তানী বাহিনী ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানিও অবস্থানের উপর আঘাত হানতো উত্তরদিকের তেলিয়াপাড়া থেকে; ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়ার কোম্পানির অবস্থানের উপর আঘাত হানতো পশ্চিমদিকের মাধবপুর থেকে এবং লেফটেন্যান্ট মোরশেদের কোম্পানির অবস্থানের উপর আঘাত হানতো দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের চান্দুরা থেকে। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে মুক্তিফৌজদের বিতাড়িত করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিফৌজদের দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধে তারা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। পাকিস্তানী বাহিনী তথাপি মুক্তিফৌজদের উপর বেপরোয়া আক্রমণ অব্যাহত রাখে। প্রচলিত পদ্ধতির রণকৌশল পাকিস্তানীদের জন্য বড় রকমের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য ১৫ জুন, ১৯৭১-এর পর থেকে তারা রণকৌশলের পরিবর্তন করে। মনতলা-হরষপুর রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আর পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থানের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বড় মাঠ ছিল৷ দিনে পাকিস্ত ানী সৈন্যরা সবাই ক্রলিং করে অতি সাবধানে মুক্তিফৌজের অবস্থানের দিকে এগিয়ে এসে সারিবদ্ধভাবে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পজিশন নিয়ে একযোগে হামলা চালাতো। এ সময় তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্ত্র ব্যবহার করতো এবং গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণের মাধ্যমে মুক্তিফৌজদের ব্যস্ত রাখতো। আর রাতে আরও ভয়াবহভাবে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতো। পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রতিদিন ভোরে, দুপুরে ও সন্ধ্যায় এ তিন বেলা হামলা চালাতো। ফলে মুক্তিফৌজরা ঠিকমতো খাবার খাওয়ার সুয়োগও পেত না। তাছাড়া পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনীর কামানগুলো মুক্তিবাহিনীর মর্টারের রেঞ্জের বাইরে ছিল। ফলে যে শক্তি দিয়ে পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ করা উচিৎ ছিল, মুক্তিফৌজদের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এভাবে পাঁচদিন অবিরাম যুদ্ধ করার পর ২০ জুনের মধ্যে ট্রেঞ্চ করে অগ্রসরমান পাকিস্তানী ব্যাটালিয়নগুলো মুক্তিফৌজদের কাছাকাছি চলে আসে। পাকিস্তানীরা মুক্তিফৌজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওযার জন্য জঙ্গি বিমান থেকে ছবি তোলে। ইতিমধ্যে যুদ্ধের সকল ফ্রন্টেই শত্রুসৈন্যদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ২১ জুন ১৯৭১। মনতলা দখল করার জন্য পাকিস্তানী বাহিনী চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য সমাবেশ করে খুব ভোরে মুক্তিবাহিনীর উপর বেপরোয়া আক্রমণ শুরু করে। শত্রুসৈন্যদের ত্রিমুখী হামলা, অধিকন্তু গোলন্দাজ বাহিনীর নির্ভুল গোলাবর্ষণ এবং জঙ্গি বিমান থেকে গোলাবর্ষণ মুক্তিফৌজদের ক্ষুদ্র বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। ক্যাপ্টেন নাসিমের অবস্থানে তেলিয়াপাড়ার দিক থেকে ট্রেঞ্চ করে এগিয়ে আসা ২ ব্যাটালিয়ন সৈন্য আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়ার অবস্থানের চান্দুরার দিক থেকে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং লেফটেন্যান্ট মোরশেদের অবস্থানে মুকুন্দপুরের দিক থেকে একটি ব্যাটালিয়ন পাকসৈন্য আক্রমণ চালায়। উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন ক্যাপ্টেন নাসিম অতিরিক্ত সৈন্য চেয়ে পাঠায়। কিন্তু যুদ্ধের গতি ফেরানোর মতো সৈন্য না থাকায় সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ তাঁকে তাঁর সৈন্যদের নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি তাই করলেন। আর ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়ার অবস্থানে আক্রমণকারী ব্যাটালিয়ন বিদ্যুৎ গতিতে আক্রমণ চালিয়ে তার অবস্থানকে ভেঙ্গে দিয়ে বিধ্বস্ত করে ফেলে। ফলে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কোম্পানি কাশিমপুর থেকে ভারতীয় এলাকায় পাড়ি জমায় এদিকে মাহবুব-ই-খোদাসহ লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদের কোম্পানি একা পড়ে যাওয়াতে সমস্ত পাকিস্তানী বাহিনী তাঁদের ঘিরে ফেলে একযোগে হামলা চালায়। চতুর্দিক থেকে মেশিনগান, এলএমজি, রাইফেলের অবিরাম গুলিবর্ষণের পাশাপাশি গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ, জঙ্গি বিমানের বোমা বর্ষণ ও শেল নিক্ষেপের ফলে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের কোম্পানি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন পাকিস্তানী বাহিনী হেলিকপ্টারে করে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের কোম্পানির পেছনে কমান্ডো নামিয়ে দেয়। এতে দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ে। লেফটেন্যান্ট মোরশেদ তার কোম্পানির নিয়মিত সৈনিক ও রণকৌশলে অনভিজ্ঞ সংগ্রামী ছাত্র যুবকদের নিয়ে প্রাণপণ লড়াই করে শত্রু বেষ্টনী ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। সে ছিল এক ভয়ানক অবস্থা। ট্রেঞ্চে থাকা মুক্তিফৌজদের মাথার উপর দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর অবিরাম বৃষ্টির মতো গুলি শোঁ শোঁ শব্দ করে যাচ্ছিল। গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলা ট্রেঞ্চের আশেপাশের স্থানগুলোতে পড়ে বড় বড় গর্ত হয়ে যাচ্ছিল। এর উপর আবার জঙ্গি বিমানের গোলাবর্ষণ ও শেল নিক্ষেপ সামগ্রিক পরিস্থিতি এক ভয়ঙ্কর অবস্থার রূপ নিলো। প্রাণের ভয়ে তখন নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকরাও কান্নাকাটি শুরু করে পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। মাহবুব-ই-খোদা তখনও তার এলএমজি দিয়ে শত্রু সৈন্যদের প্রতি অবিরাম গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিতহলেন না। আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস রেখে তিনি যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন-দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দিব, কিন্তু শত্রুবাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করবো না। লেফটেন্যান্ট মোরশেদের কোম্পানির অবস্থা গুরুতর দেখে সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহসহ অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তারা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। সে মোতাবেক মেজর সফিউল্লাহ নিজে ক্যাপ্টেন মতিন ও ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কোম্পানি নিয়ে কলকলিয়ার দিকে থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর বেপরোয়া পাল্টা আক্রমণ চালান। তাদের আকস্মিক মরণপণ পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানী সৈন্যরা হতচকিত হয়ে যায়। মুক্তিফৌজদের ক্রমাগত গুলিবর্ষণে বহু শত্রুসৈন্য হতাহত হয়। মহান আল্লাহতায়ালার অপার মহিমায় মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় ও শক্তিতে কম হলেও বিশাল শক্তিধর পাকিস্তানী বাহিনী পিছনের দিকে হটে যেতে বাধ্য হয়। ফলে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের কোম্পানির সৈন্যরা সবাই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। শুধু তাই নয়, লেফটেন্যান্ট মোরশেদের কোম্পানির নেতৃত্বাধীন মাহবুব-ই-খোদাসহ অন্যান্য মুক্তিফৌজদের নিয়ন্ত্রিত হরষপুর-মুকুন্দপুরের ৪০ বর্গমাইল এলাকা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত মুক্তিফৌজদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। উল্লেখ্য যে, মুক্তিফৌজরা নিজেদের সীমিত অভিজ্ঞতা ও শক্তি নিয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি জমি রক্ষাকল্পে মরণপণ লড়াই করেছিল। এজন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের আশুগঞ্জ থেকে মনতলা পর্যন্ত অগ্রসর হতে আড়াই মাস সময় অতিবাহিত হয়েছিল।
[৫২] শাহজাহান আলম সাজু

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!